#ল্যাম্পপোস্ট (৩)
ডুপ্লেক্স বাংলোর কাছে এসে গাড়ি থামে। তবে সে দিকে ধ্যান নেই বিভার। পর পর কয়েক বার ডাকার পর ও শুনতে পায় নি সে। হালকা হাতে বাহু তে স্পর্শ করতেই ছিটকে দূরে সরে যায় মেয়েটি। অ্যাড হাত দিয়ে আশ্বস্ত করে বলে,”আমরা চলে এসেছি। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসো।”
“কোথায় এসেছি?”
“এটা একটা বাংলো। সো আমরা বাংলোতেই এসেছি।”
বাংলোর কথা শুনেই চোখ বড় বড় হয়ে যায় বিভার। অ্যাডের দিকে অবিশ্বাসের চাহনি আর ভয়ার্ত স্বরে বলে
“তোমার উদ্দেশ্যে ঠিক নেই। আমার ভয় হচ্ছে। তুমি নিশ্চয়ই কোনো বাজে লোক।”
“ওহ বিইভা প্লিজ। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমাকে বিশ্বাস করা ছাড়া কোনো উপায় নেই তোমার। তাই প্লিজ কোনো কথা বলো না। আগে ও বলেছি আমায় রাগাবে না। আমি তোমার সাথে ভয়ঙ্কর হতে চাচ্ছি না।”
“আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না তো?”
ধীর পায়ে এগিয়ে আসে অ্যাড। বিভার হাতে হাত রেখে বলে “ট্রাস্ট মি আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না। আর না কাউকে করতে দিব। আমি কানাডা যাচ্ছি। এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরে আসব। নিজের খেয়াল রেখো। তোমার কথা মনে পড়বে।”
উত্তর দেয় না মেয়েটা। অ্যাড ক্লান্তিময় এক নিশ্বাস ফেলে। চার পাশে যেন দীর্ঘশ্বাসে ভরপুর। অদ্ভুতুড়ে লাগে সব। এত সুন্দরের মাঝে ও সব কেমন তিক্ত। অশ্রুতে ভিজে যায় চোখ। অ্যাডের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি অপেক্ষায় থাকব। তুমি প্রমিস করেছো আমাকে সাহায্য করবে। বিশ্বাস করলাম আমি। আশা করি ঠকাবে না।”
থমকে যায় অ্যাড। পেছন ফিরে বলে,”তোমার জীবনের ল্যাম্পপোস্ট হয়ে ফিরব আমি। কথা দিলাম। নির্ঘুম রাত্রি গেলেও তোমায় সাহায্য করতে এক বিন্দু ক্লান্ত হব না।”
অ্যাড চলে যায়। শিশির ভেজা সবুজ ঘাসে বসে পড়ে বিভা। ঘাসে জমে থাকা বিন্দু পানি কণা ভিজিয়ে দেয় তার পরনের ট্রাউজার। আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠে। অশ্রুতে পূর্ণ টলটলে দুঠি চোখ।
“আমি কারো জীবনের আলো হতে পারি নি। সবার জীবন থেকে সুখ কেড়ে নিয়েছি। সবাই আমার জন্য বিপদে পড়ে। আমি আসলেই খারাপ।”
ঝমঝমে কাঁদে সে। চোখ মুছে নিয়ে বাংলোর দিকে হাঁটা লাগায়। হাঁটা পথেই উচ্চারণ করে,”আলো হয়ে ও হয়েছি আঁধার। এত নিষ্ঠুর কেন হলেন সৃষ্টিকর্তা?”
বিভা কে দেখাশোনার জন্য দুজন মহিলা সার্ভেন্ট রাখা হয়েছে। এমিলি আর এলা দু বোন ই যথেষ্ট হেল্পফুল । কয়েক ঘন্টা যাবত যথেষ্ট কেয়ার করেছে বিভার। মিষ্টি ভাষী দু বোন ই ইংরেজি ভাষায় চটপটে কথা বলে। যদি ও তারা আইরিশ ভাষাতে তেমন দক্ষ নয়। এমিলির সাথে কথা বলে জানতে পেরেছে অ্যাড তাদের কে কড়া নির্দেশনা দিয়ে গেছে যাতে করে কোনো ভাবে অসুবিধা না হয় বিভার। শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে মাত্র তখনি এলার কণ্ঠের মিষ্টতা কানে আসে।
“ব্রিভা , ব্রিভা লাঞ্চ এর সময় হয়ে গেছে সুইটহার্ট। দ্রুত ডাইনিং এ আসো।”
“আসছি এলা। চুল গুলো শুকিয়ে নিই।”
“ওকে ডিয়ার। লেট করো না।”
তোয়ালে দিয়ে ভালো করে চুল মুছে নেয় বিভা। হেয়ার ড্রায়ারের গরম হাওয়া চুলের সাথে সাথে শরীর কে ও উষ্ণতা দেয়। দম ফেলে বিভা। এমিলি আর এলা ও তার নাম ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারে না। কি একটা সমস্যা! এমনকি বাংলাদেশ নামে কোনো দেশ আছে তারা জানেই না। এক মুহূর্তের জন্য প্রচন্ড রাগ হলো মেয়েটার। কেন জানবে না তার দেশের কথা? সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরা বাংলাদেশ কে না চেনা বড় অন্যায় শুধু অন্যায় ই নয় এ যেন মহা পাপ। এমিলির ধাক্কাতেই ধ্যান ভাঙে বিভার। হেয়ার ড্রায়ার টা হাতে নিয়ে বলে, “ফেলো এটা। কি করছিলে কি? একটুর জন্য শরীর পু ড়ে যেত।”
“দুঃখিত এমিলি। আমি আসলেই অসুস্থ।”
বিভার অসহায় কণ্ঠে মায়া হয় এমিলির। বিভা ওর থেকে বছর পাঁচেক এর ছোট হবে। তবু ও বন্ধুর মতোই সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”চিন্তা করো না মেয়ে , সব ঠিক হয়ে যাবে। গড তোমার সাথে আছেন।”
একটু করে ঠোঁট প্রসারিত করে বিভা। এমিলির হাতে হাত রেখে উঠে দাঁড়ায়। এলা খাবারের ট্রে হাতে রুমে প্রবেশ করে। বিচলিত হয়ে বিভা বলল,”একি খাবার রুমে নিয়ে আসলে কেন এলা?”
“তোমার লেট হচ্ছিল তাই ভাবলাম তোমার রুমেই লাঞ্চ করা যাক।”
“আচ্ছা বসো তোমরা।”
বিদেশী খাবারে ভরপুর ট্রে। ক্রুবিনস , আইরিশ স্ন্যাকস, স্যুপ , আর স্যামন সাথে আছে আইরিশ মধু পানীয়।
খাবারের তালিকা বিশাল হলে ও এগুলো হালাল নাকি তা জানা নেই বিভার। তাই স্যামন আর স্যুপ তুলে নিল। বাকি খাবার গুলো স্পর্শ ও করল না মেয়েটি। এদিকে এলা আর এমিলি আয়েস করে আইরিশ মধু পানীয় পান করছে। বিভা তীক্ষ্ম দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকে। এটা নিশ্চয়ই নেশাক্ত পানীয়।
বিভার খাওয়া শেষ হলে এমিলি তার দিকে ওয়াইন বাড়িয়ে দেয়। হাত দিয়ে নাকচ করে সে। এলা বলে
“ওয়াইন পান করো না কেন তুমি?”
“এটা আমার জন্য হালাল নয় এলা। তোমরা পান করো।”
“হালাল!”
“ইয়েস। আমি মুসলিম।”
গালে হাত দিয়ে এলা বলে
“তুমি মুজলিম , ও মাই গড।”
বিভা একটু করে হাসে। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকে। এমিলি আর এলা কাজ করছে। হঠাৎ করেই এমিলির কাছে ছুটে যায়। বিভার বাহু চেপে ধরে এমিলি বলে,
“কি হয়েছে ব্রিভা। তুমি এমন করে শ্বাস নিচ্ছ কেন?”
“আমি ঠিক আছি এমিলি। আসলে একটা সাহায্যের প্রয়োজন।”
“হ্যাঁ বলো।”
“তুমি কি তোমার ফোন টা দিতে পারবে এমিলি?”
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় এমিলি। অ্যাড তাকে বার বার করে বলেছে বিভা কে ফোন না দিতে। তবে তার ইচ্ছে হয় ফোনটা দেওয়ার। অ্যাডের আদেশ কে তুচ্ছ করে ফোন তুলে দেয় এমিলি। কৃতঙ্গতায় উজ্জ্বল হয় বিভার দু চোখ। এমিলি দু ঠোঁটের মাঝে ফাঁকা রেখে হাসে। বিভার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মৃদু স্বরে বিভা বলল,
“ধন্যবাদ এমিলি। তোমার উপকার আমি কখনোই ভুলব না।”
থমথমে মুখে বসে আছে বিভা। সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো কিছুই কাজ করছে না। তার সমস্ত ডিটেলস অফ করে দেওয়া হয়েছে। ইফতেখারের নাম্বারে ফোন যাচ্ছে না। সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। ডুকরে কেঁদে উঠে বিভা। প্রিয় মানুষের দেখা পাওয়া হবে না। আর না হবে ইফতেখারের সাথে দেখা। উম্মাদের মতো বাসা থেকে পালিয়ে এসেছিল সে। একবার পেছন ফিরে ও তাকায় নি। আরাজের স্মৃতি যেন পাগল করে যাচ্ছে। আরাজের মৃত্যু সংবাদ টা এখনো কানের কাছে বেজে চলে। মনে পড়ে যায় প্রিয় মানুষের দেওয়া প্রথম একশ খানা সাদা গোলাপ। শুভ্র সাদা গোলাপ দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল বিভা কে। কত শত রঙিন স্বপ্ন এক সাথে পথ চলা সব কিছু নিমেষেই শেষ হয়ে গেল। বুকে পাথর চেপে বসে আছে বিভা। হিয়ার মাঝে ভীষন জ্বালা হচ্ছে। বুকের ভেতর এক আকাশ সমান ভালোবাসা জমিয়ে রাখা প্রিয় মানুষ টির জন্য। সমুদ্র উথাল করা সেই দৃশ্য বুক কাঁপিয়ে তুলে। বার বার ভেসে আসে হেডলাইন,
“সুপার স্টার আরহাম আরাজ মা রা গেছেন।”
বালিশে মুখ গুঁজে দেয় বিভা। চিৎকার করে উঠে। হঠাৎ পিঠে কারো স্পর্শ পায়। এলার চোখে মুখে বিস্ময়। বিভা চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। এলার হাতে হাত রেখে বলে
“কিছু বলবে?”
“তুমি কাঁদছ ব্রিভা। আমরা কি কোনো ভাবে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি ডিয়ার?”
“না এলা তোমরা কেন কষ্ট দিবে আমায়। তোমরা তো খুব ভালো। কষ্ট তো আমি ভাগ্যে লিখে নিয়ে এসেছি।”
পেছন থেকে এমিলি বলে
“একি কথা বলছ তুমি ব্রিভা। এটা একদম ই বাজে কথা। গডের উপর বিশ্বাস রাখো। আশাহত কেন হচ্ছ? তোমার সমস্যা নিশ্চয়ই সমাধান হবে। থিংক বি পজেটিভ।”
“সত্যি বলছ এমিলি? আমি ফিরে পাব আমার প্রিয় মানুষ টি কে?”
“ব্রিভা কি বললে তুমি আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। এটা কেমন ল্যাঙ্গুয়েজ!”
চোখ মুছে নেয় বিভা। বার বার বাংলা চলে আসে। অভ্যাস তো অভ্যাস ই হয়। এমিলির দিকে এগিয়ে যায় সে। এলা কে উদ্দেশ্যে করে ইংরেজি তে বলে
“তুমি বলেছিলে এমিলির কোলে মাথা রাখলেই নাকি ঘুম চলে আসে। তাই রোজ এমিলি তোমাকে ঘুম পারিয়ে দেয়। আজ আমি যদি এমিলির কোলে মাথা রেখে ঘুমাই তুমি কি কষ্ট পাবে এলা?”
চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি