ল্যাম্পপোস্ট পর্ব -০৪

#ল্যাম্পপোস্ট ( ৪ )

আরাজের মৃত্যু তে পাগলের মতো হয়ে যায় বিভা। কোনো দিক না তাকিয়ে ছুটতে থাকে। এমনকি নিজের কার্ড নিতে ও ভুলে গেছে। অথচ বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রিয়াতে যাবে বলে স্থির করেছে। আশে পাশে মানুষের আনা গোনা নেই বললেই চলে। কারন এখন সময় রাত দুইটার কাছাকাছি। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে হেঁটে চলেছে বিভা। একটু আলোর দেখা ও যেন নেই। রাতের রাজা চন্দ্রমামা ও যেন আজ মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে অভিমান করে। লুকিয়ে আছে কুয়াশার চাদরে। হালকা শীতের মাঝে অতিরিক্ত কুয়াশা বিষয় টা অবাক করার মতোই। চারপাশে জঙ্গলে ঘেরাও করা। বিভা কোথায় যাচ্ছে জানা নেই। ওর মস্তিষ্ক একটাই কথা জানে
‘আমাকে যেতে হবে, এখনি আরাজের কাছে যেতে হবে।’

রাস্তার ধার ধরে হাঁটছিল বিভা। হঠাৎ করেই জঙ্গল থেকে ভেসে আসে তক্ষক এর ডাক। সে ডাক শুনশান মাঝ রাতে কেমন ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। শরীরের প্রতিটি লোম কূপ জেগে উঠে। বিভার অন্তর আত্মা অবধি ধুক পুক ধুক পুক করছে। প্রতিটা নিউরন যেন থমকে যায়। পেছন থেকে কিছু পড়ার শব্দ পেয়ে দ্রুত হাঁটা লাগায় মেয়েটি। ভয় হচ্ছে এবার। বন্য প্রানীর হিস হিস ফিস ফিস শব্দে নিঠাল পরিবেশ যেন অদ্ভুতুড়ে হয়ে পড়ছে ক্রমশ। বিভা ছুটতে থাকে , ছুটতে ছুটতে চিকন এক রাস্তার ধারে এসে পড়ল। সেই রাস্তাই যে মেয়েটির জীবনে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় নামিয়ে দেবে তা কে জানত! একটু দূরে ছোট এক বাড়ি দেখতে পায়। আশ্রয়ের জন্য সেখানে গেলে ও আশ্রয় না পেয়ে শিকার হতে হয়। পাঁচ জন লোক সহ চারজন মহিলা কোনো বিষয়ে চিন্তাগ্রস্ত। চিন্তার বিষয় আজকে রাতের মধ্যে ই চারটে মেয়ে কে পা চা র করতে হবে। অথচ একটা মেয়ে কে রে প করায় প্রচন্ড ব্লি ডিং হয়ে মা রা গেছে। চারটে মেয়ে না পাঠালে সমস্যা হয়ে যাবে। কথা গুলো আড়াল থেকে শুনেই ছুট লাগায় বিভা। অসর্তক অবস্থায় পালাতে যেতেই পাশের ভাঙা পুরনো টিনের স্তূপে গিয়ে পড়ে। ঝম ঝম আওয়াজ হতেই ছুটে আসে লোকগুলো। বিভা পালায় , নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে পালায় তবে বেশি দূর যেতে পারে না তার আগেই ধরা পরে যায়। বিদঘুটে রূপের অধিকারী এক পশু বলে উঠে, “একে দিয়ে রাতের ডিনার টা হয়ে যাবে।”

“উল্টো পাল্টা চিন্তা করিস না এখন। ভাগ্য ভালো যে একে পেয়ে গেছি। একে ও পাঁ চার করতে হবে।”

কথাগুলো শুনেই চমকে উঠে বিভা। চিৎকার করতেই একজন মহিলা সজোড়ে থা প্প ড় মেরে দেয় তার ফর্সা তকতকে গালে। প্রথম কয়েক সেকেন্ড দম ফেলে বিভা। পরিশেষেই চিৎকার করে ডাকে।
“কেউ আমাকে সাহায্য করো। এরা আমাকে পা চার করে দিবে। হেল্প, কেউ আছ।”

কথা টা শেষ হতেই আরেকজন মহিলা আরেক টা থা প্প ড় দেয়। মহিলার শক্ত হাতের প্রকোপে পড়ে ছিটকে পড়ে যায় বিভা। সম্ভবত দলের লিডার বলে উঠে, “শালী রে বেঁধে রাখ। আজ কপাল খারাপ তাই বেঁচে যাচ্ছে না হলে এখানেই রফা দফা হয়ে যেত।”

“বস কচি মাইয়া। একদম ই সতেজ মনে হচ্ছে। একে ছেড়ে দিব? আমার কলিজাটা কেমন করতেছে।”

লোকটার কথাতে লিডার একটু থামে। পৈশাচিক হাসি তে মেতে উঠে সে। বিভার দিকে হাত বাড়াতেই বিভা চিৎকার করতে থাকে। মুখ বাঁধা থাকায় উম উম শব্দ হয় কেবল।একজন লোক ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে আসে। লিডার কে বলে,”বস উপর মহল থেকে কল আসছে। এই মুহূর্তে এদের গাড়ি তে উঠাতে বলেছে। বার বার করে বলে দিয়েছে মেয়ে গুলোর গায়ে যেন কোনো রকম আ ঘা ত না থাকে।”

বিষাক্ততায় ছেয়ে যায় লিডারের মুখ। বিভার দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকায়। নোংরা দৃষ্টি তে কেঁপে উঠে বিভার চিত্ত। পরিশেষে তাকে পাঠানো হয় গাড়ি তে। যেখানে আগে থেকেই বাঁধা অবস্থায় ছিল আরো তিনটে মেয়ে। শিপ এ করে পাচার করা হবে ওদের।

গাড়ি থেকে নামিয়ে শিপ এ উঠানো হয়। মুখের বাঁধন আলগা হতেই বিভা চিৎকার করে বলে, “আমাকে কেউ সাহায্য করো ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। সাহায্য করো কেউ, সাহায্য করো।”

বিভা কাঁদতে থাকে। বার বার একি কথা বলে। অ্যাড যেন বোকা বনে যায়। বিভার দৃষ্টি অ্যাডের দিকে যেতেই দু হাত পিছিয়ে যায় মেয়েটি। বিভা বলে “কাছে আসবে না, একদম কাছে আসবে না। আমি কিন্তু তোমাকে খু ন করব। খু ন করে দিব। সরে যাও, সরে যাও বলছি।”

“বিইভা কি বলছ এসব? আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। প্লিজ ইংরেজি ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজ করো।”

সচকিত হয় বিভা। পুরো বিষয় টা তার মাথায় খেলে যায়। সে স্বপ্ন দেখছিল। এক মাস আগে ঘটে যাওয়া সেই কালো রাত্রিটিই স্বপ্ন দেখছিল সে! হঠাৎ করেই ঝমঝমে কেঁদে উঠে মেয়েটা। অ্যাডের মায়া হয়। তার আদুরে কণ্ঠে ডাকে,
“কাঁদছ কেন বিইভা? আমি কি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি? লুক আমি তোমার কাছে আসছি না। তুমি প্লিজ শান্ত হও।”

“আমাকে সাহায্য করো অ্যাড। আমাকে সাহায্য করো। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”

পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় অ্যাড। এক নিশ্বাসে তা পান করে বিভা। অ্যাডের জ্যাকেট এর হাতা ধরে বলে,
“আমাকে প্রমিস করেছ তুমি। আমাকে সাহায্য করবে তো?”

“শান্ত হও বিইইভা। আমি তোমাকে সাহায্য করব। তুমি প্রচন্ড উইক , তাছাড়া অনেক রুলস আছে সেগুলো কমপ্লিট করেই তোমাকে সাহায্য করব আমি। আপাতত তোমাকে কানাডায় নিয়ে যেতে পারব। আর সেটা ও ব্ল্যাক এ, কারণ আমি চাচ্ছি না তোমার বিষয়টা ইন্টারন্যাশনাল হয়ে যাক। তেমনটা হলে প্রচুর ভোগান্তি পেতে হবে। আমার কথা বুঝতে পেরেছ তুমি?”

দু দিকে মাথা কাত করে সম্মতি জানাল বিভা। অ্যাড ইশারায় তাকে ফ্রেস হয়ে আসতে বলে। বিভা চলে যেতেই চিন্তা গ্রস্ত হয় ছেলেটা। আজ সাত দিন ধরে বিভা তার কাছেই আছে। চাইলেই বিভার সমস্ত পরিচয় বের করতে পারে। কিন্তু বিষয়টা পার্সোনালি ট্রিট করতে চাচ্ছে। ঘটনা ভাইরাল হলে বিভার জীবনে বিপর্যয় হতে পারে। আর কোনো মতেই সেটা চায় না অ্যাড। ফ্রেস হয়ে আসে বিভা। তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে অ্যাড বলে “গল্প করি চলো।”

ট্রেরেস এ বসে আছে বিভা আর অ্যাড। নীল চোখ দুটো কেমন আকর্ষনীয় লাগছে। বিভা এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। গার্ডেনে বিশাল পাইন গাছের সারি। কোথাও একটা ময়লার অবকাশ নেই। অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাংলো। মনে হচ্ছে সারাক্ষন ই কেউ পরিষ্কার করে চলেছে। প্রাণ ভরে শ্বাস নেয় বিভা। যানবাহনের আওয়াজ কানে আসে না। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা নয় এটা। যার দরুন আবহাওয়া সব সময় শান্ত। কফি কাপে চুমুক দেয় অ্যাড। বিভার দৃষ্টি সামনের দিকেই নিমজ্জিত রাখা। মৌনতা ভেঙে অ্যাড বলল “প্লিজ আমাকে একটু ডিটেলসে বলো বিইভা। তুমি কি করে এখানে আসলে। সমস্তটা বলো প্লিজ। না হলে আমি সাহায্য করব কি করে?”

“তুমি সাহায্য করবে তো আমায়?”

“অবশ্যই সাহায্য করব।”

সিক্ত নয়নে তাকায় বিভা। বিচলিত হয়ে অ্যাড বলে
“তুমি অলয়েজ কাঁদো কেন? ঠোঁটের কোণে সব সময় হাসি রাখবে। লাইক মি।”

“তুমি সারাক্ষন হাসি ফুঁটিয়ে রাখো?”

বিভার প্রশ্নে বিভ্রান্ত হয় অ্যাড। মুখে কাঠিন্য ফুটিয়ে রাখা মানুষ টা কি করে বলবে সে সর্বদা হাসি ফুটিয়ে রাখে?
প্রসঙ্গ পাল্টা তে বলল, “আচ্ছা বাদ দাও সেসব। এখন বলো কি করে আসলে তুমি।”

“আমি এশিয়া মহাদেশের একটি দেশ বাংলাদেশের নাগরিক।”

“বেংলাদেশ! আমি ঠিক বুঝতে পারছি না এটা কোন দেশ।”

“পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত কোথায় জানো তুমি?”

“ইয়াহ ইটস বিডি।”

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় বিভা। বাংলাদেশ বললে চিনে না অথচ বিডি বললেই চিনে! তপ্ত শ্বাস ফেলে মেয়েটি। কফি কাপ এদিক সেদিক নড়চড় করতে থাকে। মৃদু স্বরে বলে,
“হ্যাঁ। বিডি ই আমার দেশ। ছোট্ট একটা দেশ। তবে মানুষে ভরপুর। কোলাহলমুক্ত নয় , পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও নয়। তবে সুন্দর একটি দেশ। আমার মাদারল্যান্ড।”

“আচ্ছা। তো বিডি থেকে কি করে এলে তুমি?”

“আমার বয়ফ্রেন্ডের মৃ ত্যু সংবাদ শুনেই আমি ছুটে যাই। মাঝে দুষ্টু প্রকৃতির মানুষের সাথে দেখা হয়। যারা নারী পাচার সহ রে পের সাথে ঘনিষ্ঠ। আমাকে ও পা চার করার জন্য নেওয়া হয়। শিপ এ তুলে কোনো এক দেশে নিয়ে আসা হবে বলেই শুনেছি। আমি জানি না তারপর কি হয়েছিল।”

কথা টা বলেই মাথা নিচু করে বিভা। অ্যাড বুঝতে পারে আশংকায় ভুগছে বিভা। পকেট থেকে ফোন বের করে রিপোর্ট টা বের করে সে। বিভার হাতে ফোন দিয়ে বলে
“লুক। তুমি টোটালি ভার্জিন। তোমার সাথে কোনো খারাপ ঘটে নি। তবে ঘটতে পারত, কারণ তুমি ব্রোথেলে ছিলে।”

“ব্রোথেল?”

“হ্যাঁ।”

দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলে বিভা। না জানি কোন অঘটন ঘটে যেত। চোখ দুটো বিস্ময়ে পাগল প্রায় অবস্থা। অ্যাড হালকা হাতে বিভার বাহু তে স্পর্শ করে। কেঁপে উঠে বিভা।
“রিলাক্স তুমি এখন টোটালি সেফ। বাট তোমার বয়ফ্রেন্ড….।”

“আমার মনে হচ্ছে খবর টা মিথ্যে। ওকে কেউ আটকে রেখেছে। ওর ফ্যামিলির সাথে ও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। আমাকে সাহায্য করো অ্যাড। আমি চিরকৃতঙ্গ থাকব তোমার নিকট।”

“এমন কেন মনে হচ্ছে তোমার?”

“জানি না। তবে মনে হচ্ছে এমন কিছু।”

“তোমার বয়ফ্রেন্ড কোন দেশে ছিল?”

“অস্ট্রিয়া।”

“ওহ শীট। এটা তে যাওয়ার জন্য মাস দেড়েক সময় লাগবে। আমাদের একটা ডিল স্বাক্ষরিত হয়েছে। মাস দেড়েকের জন্য ফ্লাইট অফ।”

বিভা উত্তর দেয় না। অ্যাড বুঝতে পারে হঠাৎ ই বিভার মন খারাপ হয়ে গেছে। অ্যাডের মনে এক ইচ্ছে জাগে। ব্যগ্র কন্ঠে বলে
“বিইভা আয়ারল্যান্ড ঘুরে দেখাই চলো। এভাবে মন মড়া হয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে।”

চলবে……
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here