শত্রু শত্রু খেলা পর্ব -২৭+২৮

#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_২৭
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

ফুল সজ্জিত রুমে বসে আছে আলিশবা। তার চারপাশে বাহারী ফুলের সমাহার। বাগানের সতেজ ফুল হওয়ায় পুরো রুম জুড়ে গন্ধে মৌঁ মৌঁ করছে। সে হাত দিয়ে একবার পরখ করে যা দেখছে তা সত্যিই! তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। সে শ্বশুর বাড়িতে পা রেখেছে। বিবাহিত জীবনের তিনটি বছর কেটেছে তাদের। কিন্তু গৌরব তাকে ভালোবেসে বিয়ে করলেও রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদে বেড়াতো। তার নিজেরও কষ্ট হতো গৌরবের জন্য। তাই তো সে কখনোই জোর করে বলেনি তোমার পরিবারের কাছে আমাকে নিয়ে চলো। তবে গৌরব তাকে পেলেও পরিবার হারানোর নিঃসঙ্গতায় ভুগতো সবসময়। আজকে নিজের থেকেও গৌরবের জন্য তার ভীষণ ভালো লাগছে। অবশেষে তার স্বামী মন খুলে হাসতে পারবে। যেখানে থাকবে না চাপা আর্তনাদ।

গৌরবকে সৌরভ নিজের রুমে বন্ধি করে রেখেছে। সে পালাতেই পারছে না সৌরভ থেকে। সৌরভ সরাসরি হুমকি দিয়েছে। এতদিন আমার রুম তোর ছিল, আমার কাপড় তোর ছিল, আমার বাথরুমও তোর ছিল, এমনকি আমার বিছানার অর্ধেকও তোর ছিল। তাহলে আজকে অন্যরুমে যাবি কেনো? আজকেও এই রুমে থাকবি কোথাও যাবি না।

গৌরব ভাইয়ের সাথে না পেরে পরে হার মানলো। তবে সুযোগ খুঁজলো বেরুনোর। সে আর কম কিসের? মুখ ফোঁসকে বলে ফেললো,

আমি আজকে না গেলেও কিছু হবে না। বাসর করে বাচ্চাও পয়দা করে ফেলেছি। কিন্তু জনাব সৌরব ফায়াজ আপনি বিয়ের সময় বউ তো দূরে থাক বউয়ের ঠিকি টাও পাবেন না। তো ভেবে দেখেন যেতে দিবেন না’কি বন্ধি রাখবেন।

সৌরভ ভাইয়ের কথার প্রতিত্তোর করলো না। সে চুপচাপ ভাইয়ের বকবক শুনছিলো। মনে মনে চাইছিলো গৌরব নিজ থেকে চলে যাক। তার এখন ভীষণ ঘুম আসছে। সে শান্তিতে ঘুমাতেই চাই। কিন্তু ভাইয়ের বকবক শুনে অবশেষে মুখ খুলে,

স্ত্রীর কাছে যাওয়া একজন স্বামীর স্বামীগত অধিকার। সেই অধিকার থেকে তুই কেনো আমিও বঞ্চিত করতে পারবো না। যা এবার তুই তোর রুমে যা। আমার কান খাস না।

গৌরব ভাইয়ের কথা শুনে হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। বাহ্! এতক্ষণ তাকে আটকে রেখেছিল আর যখনি ওর নিজের বউয়ের সাথে দেখাও করতে দিবো না বললাম অমনি মুহূর্তেই বোল চেইঞ্জ। বাহ্! কি ধুরন্দর ভাই তার। মনে মনে আফসোসের সুর তুললেন।

রুমের সামনে আসতেই গৌরবকে শোভা আটকালো। গৌরব যারপরনাই অবাক। তার ভাই বোন আজকে তার ভালোই মজা নিচ্ছে। গৌরব নিভৃতে হাসলো। এমন একটা দিন তার জন্য সত্যিই আনন্দের। সে বোনের সাথে টুঁশব্দও করলো না। বোনের দাবির থেকেও বেশি দিলেন। হাতে একটা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে দিলো।

শুভি তোর যা খুশি নিয়ে নিস।

আরাভ দাদা-দাদুর সাথে আরামে ঘুমে তলিয়ে আছে। নাজমা আর মাসুদ দুইজনেই কাড়াকাড়ি নাতিকে নিয়ে। মাসুদ একবার নিজের দিকে টানে আর একবার নাজমা নাতিকে নিজের দিকে টানে। পরে মাসুদ বিরক্ত হয়ে নিজের বিছানা ছেড়ে চেয়ারে গিয়ে বসে আছে।
_____________

প্রিয়ার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেলো নাজমার কথা শুনে। সারাদিন এত কাজ করার পরও তাকে আবার সৌরভের বিয়ের দাওয়াত দিয়েছে আসার সময়। বিয়ের একসপ্তাহ আগে যেতে বলেছে। এ কেমন কথা সে কেনো তাদের কাজ করবে? ছেলের বিয়ে করাবে কাজের লোক নিবে তা’ না, তাকে দিয়ে কাজ করাবে। এসব ভাবতে ভাবতে বিছানায় গড়াগড়ি করে অবশেষে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায় সে।

সকালে ঘুম ভাঙে হকারের চেঁচামেচিতে। বাজার, বাজার, এই শব্দ শুনে তার কান পঁচে গেছে। ইচ্ছে করে এই ব্যাটার দুই কানে নিজের করা চেঁচামেচির একটা রেকর্ড লাগিয়ে দিতে। তারপর বুঝতো শব্দদূষণ কাকে বলে?

কলেজ এসে প্রিয়া বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। তার সামনে এক সদ্য বিবাহিত হওয়া নববধূ দাঁড়িয়ে আছে। তার রাগের চেয়েও বড্ড অভিমান জমলো। তার প্রাণপ্রিয় বান্ধুবী আচমকাই বিয়ে করে নিলো। তাকে জানানোর প্রয়োজনবোধও মনে করেনি। হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

রাঢ়ী নিজেও জানতো না। আচমকাই তার বিয়ে সম্পন্ন হলো রাত্রিবেলা। তার ভাইয়েরা সন্ধ্যোরদিকে এসে বললো ছেলের মায়ের শরীর অবস্থা ভালো নয়। তাই তড়িঘড়ি বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে। সে তো বরের মুখটাও ভালো করে দেখেনি রাতে। ছেলের মা’ হাসপাতালে তাই রাতে বিয়ে সম্পন্ন করে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে দেখার জন্য। কিন্তু গাড়িতে উঠে সে বর হিসেবে যাকে দেখলো কস্মিনকালেও তার চিন্তা মাথায় আসেনি। এসব ভাবতে গিয়ে লজ্জায় সে মাথা নুয়ে ফেলেছে।

প্রিয়ার একেতে অভিমান হচ্ছে তার উপর বান্ধুবীর এমন নিশ্চুপতা তাকে আরও রাগিয়ে দিচ্ছে। সে রাঢ়ীকে এক ধমক দিলো। এ্যাই তুই এই দেশে আছিস না’কি জামাইয়ের কাছে গিয়ে বসে আছিস?

রাঢ়ী চমকে উঠলো জামাইয়ের নাম শুনে। ঐ লোকটার নাম শুনলে তার বুকটা দুরুদুরু করে। ভীষণ লজ্জা লাগে তার। বার বার গাড়িতে একসাথে বসার দৃশ্যটা মনে পড়ে। তার সদ্য বিবাহিত জামাই তার দুই হাত দিয়ে তাকে কিভাবে জড়িয়ে নিয়ে ছিলো ভাবতেই তার গা শিউরে উঠলো।

প্রিয়া জহুরি চোখ দিয়ে প্রাণপ্রিয় বান্ধুবীকে দেখছে এই মেয়ে বিয়ে হতে না হতেই কেমন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে? বাপ্রে! এত জলদি জামাই পাগলি হয়ে গেলো।

নীল, শ্রাবণ আসলো রাঢ়ীকে দেখতে। মেয়েটা অ্যাপ্রোন গায়ে জড়ালেও হাতে বালা, কানে দুল, নাকে নাকফুল পরে এসেছে। এতেই স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে সদ্য বিবাহিত ছাত্রী কলেজ এসেছে। নীল রাঢ়ীকে পর্যবেক্ষণ শেষে বলে উঠল,

তোর জামাই কোথায় রে রাঢ়ী? বিয়ে করার এতই তাড়া, মাত্র কিছুদিন ধৈর্য্য ধরতে পারলো না। পরীক্ষার পর তোদের বিয়ের কথা ছিলো কিন্তু এত তাড়াহুড়ো কেনো করলো? রাতে কি তোর জামাইয়ের ঘুম আসে না?

প্রিয়াসহ বাকিরা হো হো করে হেসে উঠল নীলের কথা শুনে।

রাঢ়ী তো লজ্জায় শেষ। একবার যদি জানতে পারে ওর জামাই কে তখন এরা তাকে আরো বেশি পঁচাবে। তাদের কথার মাঝেই লুবনার আগমন ঘটলো হাসিমুখ নিয়েই। তার হাসিমুখ দেখেই শ্রাবণ জিজ্ঞেস করলো।

তুই এমন পকপকা দাঁত দেখরে কিল্লাই? কিছে তোর জামাই চাইতো আইছেনি?

লুবনা বিস্মিত নয়নে তাকালো শ্রাবণের দিকে। হা’ হয়ে বলল তুই কিভাবে জানিস? শ্রাবণ তো পুরাই বেকুব বনে গেলো। সে তো মজা করে বলেছে। এই মেয়ে কি সত্যিই পাগল হয়ে গেছে না’কি সত্যি বলছে। সে কিছু বলবে তার আগে লুবনায় বললো,

সত্যি আজকে আমাকে দেখতে আসবে। কে দেখতে আসবে জানিস?

নীল খিল খিল করে হেসে উঠল। তুই না বললে আমরা কি করে জানবো? লুবনা লাজুক হেসে বলে উঠল,

“সৌরভের মা আসবে আমাকে দেখতে। ”

নীল, শ্রাবন, রাঢ়ীসহ প্রিয়াও চমকে উঠলো লুবনার কথা শুনে।

_______________________

প্রিয়া মাত্রই কলেজ থেকে ফিরেছে। বাড়িতে প্রবেশ করার সময় দেখলো নাজমা নিচে নামছে। তার চোখে মুখে কেমন রক্তিম আভা ছড়িয়ে আছে। তাকে দেখেও তাকালো না। এটার হেতু সে বুঝলো না। নাজমার পিছু পিছু গৌরবও নামলো। তার চোখে মুখে কেমন হতাশার ছাপ। দুইজনের কি হয়েছে বোধগম্য হলো না। সে নিজের উপর তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিল।

সে’তো বসন্তের সদ্য ফোটা ফুল, রৌদ্রজ্বল দিনের দাবদাহে যেকোনো সময় ঝরে যাবে।
না সে কারো বাগানের প্রস্ফুটিত ফুল, সে ‘তো’ ক্ষণিকের একটা আগাছা মাত্র। কি লাভ আধিপত্য খাটানোর।

বাসায় প্রবেশ করে বাবা-মায়ের থমথমে মুখ নজরে এলো প্রিয়ার। মারিয়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। আনোয়ার হেসে উঠল প্রিয়াকে দেখে। যাও মা’ ফ্রেশ হয়ে এসো একসাথে খাবার খাবো।

প্রিয়া ফ্রেশ হয়ে আসলো। কিন্তু বাবা-মায়ের সেই গম্ভীর মুখ তার নজরে এলো বেশ ভালোভাবেই। খাবার খেতে খেতে আনোয়ার বলে উঠলেন। আমরা আজকে গ্রামের বাড়ি যাব। প্রিয়া তুমি তৈরি হয়ে থেকো।

প্রিয়া চমকালো। হঠাৎ গ্রামের বাড়ি কেনো? তার তো পাঁচদিন পর পরীক্ষা। সে কীভাবে যাবে? আনোয়ারের উদ্দেশ্য বললো,

আব্বু আমার তো পরীক্ষা। আমি কীভাবে যাবো?

আনোয়ার মেয়ের কথার পাত্তা দিলেন না। আগের মতই বলে উঠলো পরীক্ষা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। পরীক্ষার আগেই ফিরে আসব?

প্রিয়া নৈশব্দে খেয়ে উঠলো। তার মনটা আজ বিক্ষিপ্ত। কারণটা তার অজানা নয়। বারান্দার চেয়ারে গিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসলো। কিন্তু বেশিক্ষণ বসার সু্যোগ পেলো না। আনোয়ার তাড়া দিলেন তৈরি হওয়ার জন্য।

প্রিয়া, মারিয়া, প্রত্যুষ গ্রামের বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্য নিচে নামলো। তাদের গাড়িও সদর দরজায় দাঁড়ানো। তারা সবাই উঠে বসলো বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্য।
___________________

সৌরভ মায়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নাজমা তার তোয়াক্কা করলো না। সে নিজের কার্যসিদ্ধি করেই ছাড়বেই। সৌরভ গর্জে উঠলো,

আম্মা তুমি কথা বলছো না কেনো?

নাজমা ছেলের দিকে তাকালেন না। দোকান থেকে একটা ডায়মন্ডের আংটি নিলেন। দোকানির সাথে কথা বলছেন দরদাম নিয়ে। সৌরভ আবারো জিজ্ঞেস করলো।

আম্মা তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে তুমি ঐ লুবনা মেয়েটা’কে কেনো দেখতে যাচ্ছো?

“তো কি করবো?”

“আমি ঐ মেয়ে কে বিয়ে করবো না।”

“কেনো করবে না? ঐ মেয়ে খারাপ কোথায়? তোমার সাথে ভালোই মানাবেই।”

সৌরভ কোনো ভণিতা ছাড়াই বললো,

“আমি প্রিয়াকে ভালোবাসি। বিয়ে করার হলে তাকেই করবো।”

চলবে,,,,,,,,,,,

নাজমা আন্টি কি প্রিয়াকে মেনে নিবে এবার?

“ব্যাই দ্যা ওয়ে রাঢ়ীর জামাই কে বলেন তো?”#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_২৮
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

নাজমা সৌরভের দিকে কোমল দৃষ্টিতে তাকালেন। নিশ্চুপ হয়ে ছেলের কথা শুনলেন। মনের কোণে তারও হতাশা জমলো। আনোয়ারকে কত করে বুঝালো সে কিন্তু লোকটা মানলই না। প্রিয়াকে তিনি দু’বছরের আগে বিয়ে দেবেন না। এ নিয়ে তাদের মধ্যে তুমুল বাক-বিতন্ডার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি তো প্রথমেই আঙ্গুল তুলেছেন শোভার দিকে। আমি যেখানে নিজের মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দেবো না সেখানে প্রিয়ার জন্য কিভাবে প্রস্তাব দিতে পারি। কত খোঁড়া যুক্তি! কখন বললাম আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দেবো না। তার এইচএসসি শেষ হলেই তো বিয়ে দেবো। এখন প্রিয়ার সাথে সৌরভের আকদ সম্পন্ন করে রাখবো কিন্তু সৌরভ প্রিয়ার সংসার তো আর এখন করতে যাচ্ছে না। পরে আনোয়ারের সাথে তর্কে না পেরে সে শুধু বলেছে তাদের দুইজনের বাগদানের কথা। তাতেও রাজী নন আনোয়ার।

আনোয়ারের একরোখা কথা সে দু’বছর আগে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিবেন না। এমনকি এখন কোনোরূপ বাগদান বা আকদ করাবেন না। মেয়ের পড়াশোনার ক্ষতি হোক তিনি চান না। বিয়ে হোক বা বাগদান এসবের পরে মেয়েরা পরাধীন হয়ে যায়।

নাজমা সেই জেদ থেকেই আনোয়ারকে বলেছে ঠিক আছে সে তার ছেলেকে প্রিয়ার বয়সী মেয়েকেই বিয়ে করিয়ে দেখিয়ে দেবো। বিয়ে হলেই পড়াশোনার ক্ষতি হয় না। সে ঐ মেয়েকে পড়াশোনা সব করাবে। তাই তো লুবনাকে দেখতে যাচ্ছে। পছন্দ হলেই পাকা কথা বলে আসবেন।

সৌরভ ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে মা’কে জিজ্ঞেস করলো,

কি হয়েছে আম্মা’ কথার জবাব দিচ্ছো না কেনো? নাজমা ছেলের জবাব না দিয়ে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে ছেলের মুখপানে চেয়ে আছেন। কি বলবেন তিনি তার তো উত্তরই জানা নাই।

_________________________

গ্রামের বাড়ির উঠোনে এসে নামলো প্রিয়াদের গাড়ি। দীর্ঘ এক বছর পর দাদার বাড়ি এসেছে তারা। আগের থেকে বেশ অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে তার দাদা বাড়ি। দক্ষিণকোণে আরেকটা পাকাঘর নির্মাণ হয়েছে। এটা তার ছোটো চাচ্চুর ঘর। এর আগে এই বাড়িতে দু’টো পাকাঘর ছিলো। একটা দু’তলা বিশিষ্ট যেটাতে তার বাবা আর বড়ো জেঠু থাকে। তার দাদাও সেই দু’তলা পাকাঘরে থাকে। এই ঘর দাদা নিজের হাতে নির্মাণ করেছেন। আরেকটা পাকাঘর সেজো চাচ্চুর।

বাড়ির প্রবেশদ্বারে আগের মতই বাগানবিলাসের গাছটা এখনো আছে। তার পাশে দেয়ালের সাথে লাগানো কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল দিয়েছে। কি অসাধারণ দৃশ্য! তাদের বাড়ি অসংখ্য গাছ-গাছালি দিয়ে ঘেরা। তাই পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যায় গাছে গাছে।

উঠোনে পা রাখতেই প্রিয়ার মন আনন্দে ভরে উঠল। কিন্তু এত আনন্দের মাঝেও তার হৃদগহীনে বিষাদের এক তিক্ত ছায়া নেমে এসেছে।

তাদেরকে দেখে তার বড়জেঠি, সেজো আর ছোট চাচীসহ সবাই ছুটে এসেছে। মারিয়া তার জা’ এর সাথে কুশল বিনিময় করলেন। তার কাজিনরা বেশ খুশি তাদের দেখে। সামান্তা বড়ো জেঠুর মেয়ে সে কাজিনদের মধ্যে সবার বড়ো। সে এসে প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল এতদিন পর বুঝি বাড়ির কথা মনে পড়লো। জানিস দাদা ভাই তোদের খুব মিস করে। চল দাদাভাইয়ের ঘরে চল। দাদাভাই তোদের দেখার জন্য সেই সকাল থেকেই মুখিয়ে আছে।

প্রত্যুষ নিজের সমবয়সী কাজিনদের পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। সামান্তার ছোট ভাই অভ্র প্রত্যুষকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো।

প্রিয়ার দাদার ঘরে পুরো পরিবারের মিলনমেলা বসেছে। আনোয়ার বাবার সামনে থম মেরে বসে আছে। তার বাবার শারীরিক অবস্থা বেশি ভালো না। জীর্ণশীর্ণ শরীর, চোখ দু’টো কোটরে বসে গেছে, কথাও অনেক অস্পষ্ট। আনোয়ার বাবাকে দেখে হু হু করে কেঁদে উঠলেন। তাকে তো শুধু বলা হয়েছে তার বাবার শরীর সামান্য খারাপ। এত খারাপ অবস্থা বলা হয়নি। তার রাগটা পড়লো গিয়ে তার বড়ো ভাইয়ের উপর। সেই লোকটার জন্যই আজ সে বাড়ি ছাড়া হয়েছে। নয়তো বাবার পাশেই থাকতো। বাবার এত করুণ অবস্থা অন্তত নিজের চোখে দেখতো।

তার বাবা তাকে ইশারায় ডাকলেন। মুখ হা’ করে কিছু একটা বিড়বিড় করলেন। কিন্তু আনোয়ার অনেকবার খেয়াল করেও বুঝতে পারলেন না। শেষে বাধ্য হয়ে সবাইকে বললেন ঘর খালি করতে। বাচ্চারা সব বাইরে চলে গেছে। ঘর মোটামুটি কোলাহল মুক্ত। আনোয়ার পুনরায় বাবার কানের কাছে গিয়ে নিজের মুখটা রাখলেন। তার বাবা অস্পষ্ট সুরে আওড়ালেন,

আর্দ্র আসবে এক সপ্তাহ পর। প্রিয়ার বিয়েটা দিবি তো এবার আর্দ্রের সাথে। ছেলেটা এবার একদম নিজেকে পুরোপুরি সুস্থ করেই ফিরবে কিন্তু।

আনোয়ার বাবার কথা বুঝতে পেরে আৎকে উঠলেন। আনমনে বার কয়েক বিড়বিড় করলেন,

আর্দ্র ফিরে আসবে।
_____________________________

বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে সৌরভ বাসায় ফিরলো সন্ধ্যায়। বিষন্ন মনে বাসায় প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো প্রিয়াদের বাসায় তালা দেওয়া। উদ্ধিগ্ন মনে ভাবলো প্রিয়ারা আচমকা কোথায় হাওয়া হলো। বাসায় এসে নাজমাকে জিজ্ঞেস করলো। নাজমার মুখে বিষাদের ছায়া। গম্ভীর মুখে বললো আমি জানি না। বাসার বাকিরাও কেউ কিছু জানে না।

মাসুদ সৌরভকে ডাকলেন। সে বাবার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাসুদ ছেলেকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে একবার পর্যবেক্ষণ করলেন। পরিশেষে বললেন,

তোমার কি আনোয়ারের সাথে কোনো কথা হয়েছিল?

সৌরভ অবাক হয়ে ভাবলো। তার তো আনোয়ার আঙ্কেলের সাথে কোনো কথায় হয়নি। বাবা তাহলে কিসের কথা বলছে। সে ভেবেও কিছু খুঁজে পেলো না। পরে মাসুদকে মাথা নেড়ে বললো,

না ‘তো’, আমার কোনো কথা হয়নি আঙ্কেলের সাথে। কিন্তু কেনো বাবা?

“তাহলে রাতে তোমার কাছে আনোয়ারের কল আসতে পারে?”

সৌরভ গভীর ভাবনায় ডুবে গেলো। আনোয়ার আঙ্কেল কিসের কথা বলবে?
__________________

সামান্তা, প্রিয়া, প্রত্যুষ, অভ্রসহ পুরো কাজিনগুষ্টি মিলে বসে গল্পের আসর জমিয়েছে। সামান্তা নিজের শ্বশুর বাড়ির গল্প, স্বামীর গল্প করছে। তার তিন বছরের দুষ্ট মিষ্টি একটা মেয়ে আছে সামাইরা। সে মেয়ের জন্য ঠিক করে কথায় বলতে পারছে না। এই মেয়ে কথার মাঝে এসে নিজের কথাই বলে। সে ভূত দেখেছে তার দাদু বাড়িতে। সেই ভূত একদম সাদা পানির মত। সামাইরার গল্প শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠে।

সামান্তা কথায় কথায় নিজের ছোট ভাইয়ের কথা প্রিয়াকে বলে উঠে। প্রিয়া জানিস আর্দ্র আসছে আগামী সপ্তাহে।

প্রিয়া আর্দ্রর কথা শুনে চমকে উঠে। এতদিন পর আর্দ্র ফিরে আসছে। বক্ষস্থলে সূক্ষ্ম ব্যথার জায়গায় বরং অস্থির লাগছে তার। আর্দ্র ফিরলে আবার আগের মত জেঠু আর বাবার মধ্যে দ্বন্দ্ব বিবাদ জড়াবে। এসব ভাবতে তার চক্ষুদ্বয় ঝাপসা হয়ে এলো। এক সময় এই আর্দ্রকে দেখলে তার মন কেমনের বৃষ্টি হতো, ফুলের মাঝে হাজারো রঙিন প্রজাপতির মেলা বসতো। আকাশ মাঝে পাখির ডানায় সে ঘুড়ে বেড়াতো। কিন্তু আজ তার সেগুলোর কিছুই অনূভুতি হচ্ছে না। বরং আতঙ্ক তাকে ঘিরে ধরেছে। এই আর্দ্রের জন্যই তার বাবা বাড়ি ছেড়েছে। তার জেঠু আর বাবার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

সেই স্কুল জীবনের এক তপ্ত দুপুরের কথা। সে বাড়ি ফিরছিলো। আর্দ্র তাকে এসে একটা খামসহ চিঠি দিয়ে যায়। চিঠি দেয়ার সময় বলে তাকে একদিনের সময় দিয়েছে শুধু পরেরদিন যেনো তার চিঠির জবাব দিয়ে দেয়। প্রিয়া তো পড়েছে মহা বিপদে। রাতে চিঠি পড়ে অবাক। আর্দ্র তাকে প্রপোজ করেছে।

আর্দ্র তার থেকে গুণে গুণে সাড়ে তিন বছরের বড়ো। বড়ো হলেও সে আর্দ্রের সাথে বন্ধুর মত কথা বলত। প্রিয়া নিজেও আর্দ্রের প্রতি দুর্বল ছিলো। কিন্তু চিঠি পেয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলো কি উত্তর দেবে। সে উত্তর দেবার ভয়ে আর্দ্রের সামনে দুইদিন পড়েনি। শেষে আর্দ্র নিজেই একদিন প্রিয়ার রুমে যাই। তখন রাত এগারোটা। প্রিয়া তখন পড়ছিলো।

আচমকা প্রিয়া আর্দ্রকে নিজের রুমে দেখে ভয় পেয়ে যায়। আর্দ্র চুপচাপ বসে থাকে নিজের চিঠির উত্তরের জন্য। অগত্যা প্রিয়া ভয়ের চোটে তাকে হ্যাঁ বলে দেয়। আর্দ্র খুশি হয়ে প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরতে যাই। কিন্তু প্রিয়া সরে যাই। আর্দ্র অবাক হয়ে বলে কি ব্যাপার তুই সরলি কেনো? প্রিয়া অস্থির হয়ে বলে দেখ আমরা অবিবাহিত দু’জন। বিয়ের আগে এভাবে কেউ কাউকে জড়িয়ে ধরা উচিৎ নয়।

আর্দ্র চুপচাপ কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর রগড় গলায় বললো যদি বিয়ে করি তখন জড়িয়ে ধরতে পারবো? প্রিয়া উত্তর না দিয়ে বলল প্লিজ আর্দ্র ভাইয়া আমার রুম থেকে এখন যাও।

পরেরদিন আর্দ্র আনোয়ারকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। এতেই বাদ সাধে আর্দ্রের বাবা। তিনি বিয়ে তো দূরে থাক ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক রাখতেও নারাজ। সেই থেকে তিক্ত হয়ে উঠে সম্পর্ক। এদিকে আর্দ্র ও তার বাবার মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। আর্দ্র ধীরে ধীরে খারাপ সঙ্গের সাথে মিশে নিজেকে বিপথে নিয়ে যাই। বিভিন্ন নেশা থেকে শুরু করে যত নোংরামি ছিলো আর্দ্র সব করতো, এমনকি নারী সঙ্গও।

পরে আর্দ্রের বাবা ছেলেকে সংশোধন করতে রিহ্যাবে পাঠায়। তবে শর্ত ছিল সে ভালো হয়ে ফিরলে প্রিয়াকে যেনো তার সাথে বিয়ে দেওয়া হয়।

সে কথা ভেবে প্রিয়া আৎকে উঠলো। তার যে আর্দ্রের প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই। যা ছিলো তা নিছকই ভালোলাগা মাত্র।

সামান্তা প্রিয়ার মজা উড়ালো। এবার তো তুই আমার ভাইয়ের বউ হয়ে যাবি। আমি তোর ননাস হবো। আমাকে তোর পা ধরে সালাম করতে হবে। প্রিয়া সামান্তাকে থামিয়ে দিলো। প্লিজ আপু এগুলো শুনতে ভালো লাগছে না আমার।

সামান্তা হা’ হয়ে আছে প্রিয়ার কথা শুনে।
____________________

আনোয়ার অকূল পাথারে পড়লেন। নাজমার সাথে বাক-বিতন্ডা করে তিনি বাড়ি এসেছেন। শুধু এখন মেয়ে বিয়ে দেবেন না বলে। কিন্তু এখানে এসে উল্টো ঝামেলায় পড়েছেন তিনি। তার বাবাও আর্দ্রের সাথে প্রিয়ার বিয়ের কথা বলছেন। কিন্তু তিনি জানেন তার মেয়ের যোগ্য পাত্র কে?

তিনি মোবাইল হাতে নিলেন কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির নাম্বারে ডায়াল করলেন। রিসিভ হতেই বললেন,

কেমন আছো বাবা?

অপর পাশের ব্যক্তির মুখে সূক্ষ্ম হাসির রেখা দিলো। যা মোবাইলের এ পাশের ব্যক্তি ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না। সেও জবাব দিলো,

জ্বী, ভালো। আপনি?

আনোয়ার হাসলেন। তিনি ভালো-মন্দ দুটোর মাঝেই আছেন। তবুও বিনয়ের সুরে বললো,

ভালো। তবে তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই। একজন বাবা হিসেবে আমি আমার মেয়েকে তোমার হাতে সঁপে দিতে চাই। তবে শর্ত একটাই স্বামী-স্ত্রী হিসেবে এখনো সংসার শুরু করতে পারবে না। আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকবে এখন। স্বামী হিসেবে তুমি একবছর পর পূর্ণ অধিকার পাবে। বলো আমার শর্তে রাজি। রাজি হলে বর সেজে পরিবার নিয়ে চলে এসো।

অপর পাশের ব্যক্তি বক্র হাসলো। কি ধঁড়িবাজ শ্বশুর ‘রে তার! একবার মেয়েকে পাই। তারপর এই শ্বশুরের ক্লাস নেবে সে।

চলবে,,,,,,,,,,

আগামী কাল প্রিয়ার বিয়ে। সবাই আমন্ত্রিত। গ্রিফট নিয়ে চলে আসবেন কিন্তু।

“ব্যাই দ্যা ওয়ে বলেন তো জামাইটা কে?”

জানি উত্তর পারবেন। আজকাল আপনারা অনেক চালাক হয়ে গিয়েছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here