শত্রু শত্রু খেলা পর্ব -৩১+৩২

#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৩১
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

একটা বছর দীর্ঘ সময় তাই না? জানো তো, ৩৬৫ দিন হয় কিন্তু। ততদিন আমার জন্য অপেক্ষা করবে তো বউ? সৌরভের এহেন প্রশ্নে হতচকিত হয়ে গেলো প্রিয়া। সে অপেক্ষা করবে না কেনো? সৌরভ তো তার স্বামী হয়। আর স্বামীর জন্য অপেক্ষা করবে না এটা কেমন অদ্ভুত প্রশ্ন করছে সৌরবিদ্যুত। তার মনে এত উৎকন্ঠা সৃষ্টি করছে কেনো? সে এসবে ভীষণ ভয় পায়? তার বক্ষস্থল ভীষণভাবে কাঁপছে। উত্তর দেবার শক্তিও যেনো ক্ষয় হয়ে গিয়েছে।

সৌরভ পুনশ্চঃ প্রিয়াকে বলল, যদি আমি হারিয়ে যাই তখন কিংবা আমাদের মিলন যদি আধুরা থেকে যাই?

ত্বরিত ঘুম ভেঙে যাই প্রিয়ার। বুক ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে। তার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। এমন স্বপ্ন কেনো সে দেখলো? দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখলো রাত দু’টো বাজে। কালকে রাতেও সৌরভ তার পাশে ছিল। কিন্তু আজকে তার বিছানাটা একদম শূন্য পড়ে আছে। সত্যি জীবনটা কত অদ্ভুত! এক রাতের ব্যবধানে তার জীবন কত পরিবর্তন হয়ে গেলো। কালও সে সৌরভকে স্বামী মানতে নারাজ ছিল অথচ আজ সে স্বামী সোহাগী হয়ে গেছে।

কাল রাতে স্বামীর বুকে তার নিদ্রা যাপন হলেও ভোর সকালে উঠেই সে হাওয়া হয়ে গেছিলো। এমনকি সৌরভ যাওয়ার সময়ও সে আর সামনে আসে নি। সৌরভ যে যাওয়ার সময় তাকে মনে মনে খুঁজেছিলো সে বেশ বুঝতে পেরেছিলো। কিন্তু সে কি করবে লজ্জায় তো তার সামনে দাঁড়াতেই পারছেনা। তাই তো সে ছাদে লুকিয়েছিল সারা সময়।

কিন্তু সেই যে সৌরভ গিয়েছে তাকে কোনো কলই দেয়নি না তার কোনো খোঁজ নিয়েছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা। আর এখন নিস্তব্ধ নিশুতি রাত। তার কোনো খোঁজই রাখেনি সৌরভ। কত নিষ্টুর এই লোকটা। তাকে এক রাতেই বিরহের অনলে দগ্ধ করে ফেলেছে।

প্রিয়া জানালার পাশে আনমনা হয়ে বসে আছে। হাতের মাঝে তার মুঠোফোন। নিজের লজ্জাকে জলাঞ্জলি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির নাম্বারে ডায়াল করলো। কিন্তু বার কয়েক ডায়াল করেও সে তার নাগাল পেলো না। যতবারই ডায়াল করেছে ফলাফল একি। আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মূহুর্তে বন্ধ আছে। আর কাউকে লজ্জায় কলও করতে পারছে না। তার হৃদয়টা খুব পুড়ছে সৌরবিদ্যুতকে দেখার জন্য। কবে দেখতে পাবে তাকে?

সৌরভ-প্রিয়ার বিয়ের দু’দিন পেরিয়ে গেছে।

প্রিয়ার দাদার অবস্থা আগের মতই আছে। আনোয়ারকে আজকে বাসায় ফিরতে হবে। পরশু প্রিয়ার পরীক্ষা শুরু। মারিয়া কাপড় গোছাচ্ছেন। প্রিয়া তো তড়িঘড়ি করছে কবে তারা ফিরবে। সৌরভকে দেখার জন্য সে উতলা হয়ে পড়েছে। এই লোকটা গত দু’দিনে তাকে একটা ফোনকলও করেনি। কেমন পাষাণ স্বামী তার। সে ফিরে গিয়ে এই সৌরবিদ্যুত এর মজা নেবে।
____________________

প্রিয়াদের গাড়ি সৌরভদের বাড়ির সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রিয়া দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। তার তো গাড়ি থেকে বের হতে ভীষণ লজ্জা করছে। আনোয়ার তাড়া দিলেন মেয়েকে নামার জন্য। প্রিয়া অগত্যা গাড়ি থেকে বের হলো। লম্বা করে দম ফেলে চারপাশে চোখ বুলানো কেউ তাকে দেখছে কিনা? না’হ তেমন কেউ নেই। তিন তলার বারান্দায় একবার চোখ বুলালো। কিন্তু নাহ ঐ বজ্জাতটাও নাই। মনে মনে নারাজ হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। চুপচাপ নিজের বাসায় ঢুকলো।

বিছানায় বসে কিছুক্ষণ ছটপট করলো। সৌরবিদ্যুত কোথায়? এখন তো তার বাসায় থাকার কথা। সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ উঁকিঝুঁকি মারলো সৌরভের বারান্দার দিকে। কিন্তু তার ঐ ভদ্র বজ্জাত স্বামীটা কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো? তাকে না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে সে রুমে ফিরে আসে।

ঘড়ির কাটায় দুপুর বার’টা।

প্রিয়া আর কি করবে ফ্রেশ হওয়ার জন্য সে বাথরুমে চলে যায়। প্রবেশ করতেই আচমকা তার বাথরুমের দরজাতে খটাখট আওয়াজ হতে লাগলো। অর্ধভেজা তার শরীর। এই সময় এলো’টা কে? আতংকিত হয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। সৌরভ তার রুমে আসে নি তো। ভয়ে কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলল সে। জিজ্ঞেসও করতে পারছে না লজ্জায়। হঠাৎ মারিয়ার গলা শুনে নিজেকে স্থির করলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দ্রুত কাপড় চেইঞ্জ করে।
দরজা খুলে দেখলো আলিশবা, শোভা, আরাদ দাঁড়িয়ে আছে। কিঞ্চিৎ হাসলো। সে শুধু শুধু আরেকজনকে ভেবেছে।

শোভা প্রিয়ার সামনে এসে বললো,

ছোট ভাবীজান কেমন আছেন? দুইদিন পর তোমাকে দেখলাম। জানো কত কষ্ট হয়েছে?

শোভার মুখে ভাবী ডাক শুনে প্রিয়ার ভীমড়ি খাওয়ার উপক্রম। লজ্জায় ইচ্ছে করছে মাটি ফুঁড়ে তার ভিতরে প্রবেশ করতে। কাঁচুমাচু করে সে কোনো রকম সামনে দাঁড়ালো। আলিশবা এসে তাকে বিছানায় বসালো। তারপর দু’ জা মিলে গল্প জুড়িয়ে দিলো।

আরাদ প্রিয়ার কোলে গিয়ে বসলো। প্রিয়াও কাছে টেনে নিলো। আরাদ প্রিয়ার গালে হামি দিয়ে বললো,

মা,,মা।

প্রিয়া হাসলো আরাদের কথা শুনে। আলিশবা প্রিয়ার কানে কানে বললো চাইলে আগামী বছর এরকম একটা মিষ্টি বাবু তোমরাও নিতে পারবে। আলিশবার কথা শুনে প্রিয়া ভীষণ লজ্জা পেলো। মুখে লাজুক হাসি তার। শোভাও টিপ্পনী মারলো,

ছোট ভাবি ভাইয়াকে বলবে আরাদের মত তোমারও একটা মিষ্টি বেবি চাই। তাহলে তো হয়ে গেলো।

প্রিয়া এদের দিকে তাকালো না আর। এরা নিশ্চয়ই প্লান করে এসেছে দু’জন একসাথে লজ্জা দেওয়ার জন্য। আলিশবা প্রিয়াকে ভালো করেই পর্যবেক্ষণ করে বললো,

তা ফার্স্ট নাইটে কি উপহার পেলে জামাইর কাছ থেকে। প্রিয়া বলার আগেই শোভা প্রিয়ার গলার দিকে তাকিয়ে বললো,

ছোট ভাইয়া তোমাকে গলার ঐ লকেট গ্রিফট করেছে।

প্রিয়া ছোট্ট করে বলল হুম। শোভা হাত দিয়ে লকেট টা ধরে বললো,

আমার ভাইয়ের পছন্দ সত্যিই দারুণ! তা ছোট ভাবি তোমার পছন্দ হয়েছে?

প্রিয়া আবারও ছোট্ট করে বলল হুম।

আলিশবা আরও অনেক কিছুই বলতে চাইলো। কিন্তু তার আগে মারিয়া তাদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসলো। দু’জনকে খেতে বলল। প্রিয়াও তাদের হাতে নাস্তা উঠিয়ে দিলো।

তারা আরও কিছুক্ষণ কথা বলে বাসায় চলে গেলো।

প্রিয়া দুপুরের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুম ভাঙলো বিকেল পাঁচটায়। কিয়ৎক্ষণ গড়িমসি করলো সে। পরে মনে পড়লো বিকেলে তো সৌরভ তাকে পড়াতে আসবে। তার আগে সে ছাদে গেলো। এখন তো সৌরভ ছাদে যাবে। তড়িঘড়ি সে বিছানা ছেড়ে উঠলো।

হাঁফাতে হাঁফাতে ছাদে আসলো। কিন্তু সৌরভের নাগাল সে পেলো না। উল্টো পড়লো ফ্যাসাদে। গৌরব সেখানে বসে আছে। সে গৌরবকে দেখে সালাম দিলো। গৌরবও হাসি-মুখে সালাম নিলো। জিজ্ঞেস করলো কেমন আছো কিউটিপাই?

প্রিয়া মৃদুহেসে বললো জ্বী ভাইয়া ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?

গৌরব আফসোস করলো প্রিয়ার জন্য। আহা! বেচারি জামাইকে খুঁজতে এসে ভাসুরের খপ্পরে পড়েছে। মনে মনে কুটিল হাসলো। প্রিয়াকে আচমকা বলে উঠল,

তোমার সৌরভের সাথে দেখা হয়েছে?

প্রিয়া এহেন প্রশ্নে কি বলবে এখন? সে চুপ থেকে কিছুক্ষণ পর ডানে বামে মাথা নেড়ে না বললো।

গৌরব হা-হুতাশ করলো প্রিয়ার জন্য কিয়ৎক্ষন। তারপর মুখ মলিন করে প্রিয়াকে বললো,

জানো প্রিয়া, সৌরভ তো বাসায় নেই। আজ সকালেই ঢাকা গেলো বন্ধুদের সাথে। পরশ বউকে নিয়ে হানিমুনে যাবে শুনলাম। সেই সাথে তোমার জামাইও যাবে। তোমাকে কিছু বলেনি।

সৌরভের উপর বড্ড অভিমান জমলো প্রিয়ার। এই লোকটা তাকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলো। বিয়ে করে এখন তাকে চেনেই না। একদম দূরে সরে গেছে তার। অশ্রুসিক্ত আঁখিদুটি তার কিন্তু গৌরবের কথায় মৃদু হাসলো। তারপর আবারো ছোট্ট করে বললো,

ওহ।

গৌরব আবারও বলে উঠল,

তোমাকে একবারও বলেনি সে। দেখেছো কেমন স্বামী তোমার? বিয়ে করে বউকে একটুও পাত্তা দেয় না। সত্যিই! তোমার জন্য আমার খারাপ লাগছে। আমার ভাই হলে কি হবে সে একটুও বউকে ভালোবাসে না। বউয়ের প্রতি তার কোনো দায়িত্ব নেই দেখেছো? আহারে! আমার তোমার জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে। তুমি সত্যি সৌরভকে বিয়ে করে ঠকে গেছো।

প্রিয়া ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সে কি বলবে গৌরবের কথার জবাবে। সৌরভ সত্যি তাকে ভালোবাসে না। তাহলে সেদিন যে বলেছে তাকে সেসব কি ছিল? প্রিয়া যখন নিজ ভাবনায় নিমজ্জিত আচমকা কারো রামধমকে সে কেঁপে উঠলো।

প্রিয়া, তুমি এখানে কি করছো? তোমার না এখন টিউশন টাইম। আর তুমি এখানে এসে আড্ডা দিচ্ছো। তোমার বিবেকবোধ দেখে আমি অভিভূত। যাও টেবিলে গিয়ে বসো। আমি আসছি।

সৌরভের রামধমক খেয়ে প্রিয়া আর দাঁড়ালো না ছাদে। দ্রতই নিচে নেমে এলো।

সৌরভ এবার গৌরবকেও শাসালো। ভাই তোর কি মাথা গেছে। প্রিয়া কিন্তু এগুলো সত্যি মনে করে বসে থাকবে।

গৌরব ভাইয়ের কথায় কর্ণপাত করলো না। সে গা দুলিয়ে হেসে উঠল। যাও এবার বউয়ের অভিমান ভাঙাও।

চলবে,,,,,,,,,,#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৩২
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

নাজমা ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে গেলো রাগ ঝাড়লো মাসুদের উপর। আনোয়ারের উপর তো সে আগে থেকেই ক্রোধে ফেটে পড়ছে। কিন্তু এখন নিজের জামাইয়ের উপরও অতিষ্ঠ সে। রেগে গর্জে উঠলো মাসুদের উপর।

তুমি বাবা হয়ে কিভাবে চুপ আছো বলো তো? সৌরভ প্রিয়া বিবাহিত। তারা দু’জন ধর্মীয়-আইনি ভাবেও স্বামী-স্ত্রী। তাহলে এভাবে অপরিচিতদের মত এরা বিছিন্ন থাকবে কেনো? আমাকে বুঝাও।

মাসুদ বউয়ের কথায় কিঞ্চিৎ হাসলো। সে বাবা হয়ে কি করবে? যেখানে তার ছেলেই এই প্রস্তাবেই রাজি হয়েছে। তাছাড়া মেয়েটা সদ্য আটারোতে পা’ দিয়েছে। কলেজ শেষ হয়নি এখনো। তাই হয়তো আনোয়ার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিষয়টা অন্যদিক থেকে খারাপ নয়। আবার একজন ছেলের দিক থেকে ভাবতে গেলে অনেক কিছু। যাই হোক এটা এখন ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাদের নাক না গলানোই ভালো।

নাজমা মাসুদের নিশ্চুপতা দেখে কর্কশ গলায় চেঁচালো।

তুমি কি মুখে কুলুপ এঁটেছো। কোনো জবাব দাও না কেনো?

মাসুদ বউয়ের আচরণে বিরক্ত হলেন। তার বউ একটু না পুরোই বেশি বুঝে। তার ছেলের সমস্যা না হলে তাদের কিসের সমস্যা। কিন্তু এই মহীয়সী নারীকে কে বোঝাবে? তিনি মনে মনে হা-হুতাশ করলেন। কিঞ্চিৎ সাহস সঞ্চার করে বললেন,

একটা বছরেরই তো ব্যাপার। দেখবে চোখের পলকে চলে গেছে। এটা নিয়ে মাথা ঘামিয়েও না’তো আর। কথাগুলো বলে মাসুদ নিজের জান বাঁচাতে জলদি রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

পিছন থেকে নাজমা চেঁচালো। কিন্তু মাসুদ তার কথাকে আর পাত্তা দিলো না। সে ড্রয়িং রুমে বসে টিভির ভলিউম বাড়িয়ে খবর দেখছে। আরাভ গুটি গুটি পায়ে দাদার কাছে আসলো। মাসুদ তাকে কোলে তুলে নিলো। কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

দাদাভাই তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে যাও। তারপর দু’জন মিলে এই বুড়িকে শায়েস্তা করবো। ঠিক আছে।

আরাভ দাদার কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর আধো আধো বুলিতে আওড়ালো,

তাততা,,,ভুত,,ভুত।

দাদা নাতি দুইজনে খুঁনশুটিতে মেতে উঠলেন। আচমকা গৌরব বাসায় প্রবেশ করতেই তার আর মাসুদের চোখাচোখি হয়ে গেলো। মাসুদ নিজেই চোখ নামিয়ে নিলেন। এ বেয়াদব ছেলের দিকে তিনি তাকাতেই নারাজ আর কথা তো অনেক দূরের বিষয়। গৌরব তার বাবার রাগের কারণ বুঝতে পারে। কিন্তু মনোঃক্ষুন্ন হলেও অন্যদিক থেকে তার মন তৃপ্তিতে ভরে আছে।

মাসুদ আলিশবাকে ডাকলেন,

মা’ আমাকে এককাপ চা’ দাও তো। আমার দাদু ভাইয়ের জন্যও কিছু নিয়ে আসো। দুইজনে মিলে খাবো।

আলিশবা শ্বশুরের জন্য চা নিয়ে আসলেন। মাসুদ হাসি-মুখে নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন। মা’ তোমার বাড়িতে কথা হয়েছে? তারা কবে আসবেন? আলিশবা শ্বশুরের কথায় কিঞ্চিৎ হাসলো। হাসি-মুখেই বললো,

তারা আগামী কাল রওনা দিবেন। কাল দুপুর দু’টোয় ফ্লাইট।

মাসুদ নিশ্চিন্ত হলেন। এবার আলিশবার রিসিপশান সেরে নিবেন। তার বেয়াড়া ছেলের জন্য মা’ ছেলে দুইজনে এসব কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তার ছেলের কান্ডের কথা ভাবলে এখনো গা শিউরে ওঠে তার।

______________________________

প্রিয়া গত দুই’দিন সৌরভকে দেখার জন্য চড়ুই পাখির মত ছটপট করলেও এখন সে একদম শান্ত। মনে হচ্ছে সে এই সৌরভকে চিনেই না। লজ্জায় আর জড়োতায় সে একবারও সৌরভের দিকে তাকায়নি। চুপচাপ সে নিজের ম্যাথ করে যাচ্ছে।

সৌরভও নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখেছে। সে আগের মতই গম্ভীর হয়ে প্রিয়াকে পড়াচ্ছে। তাদের মাঝে যে একটা স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক আছে কেউ দেখলে বলতেই পারবে না। দুইজনে চুপচাপ। পড়ার ব্যাপার ছাড়া টুঁশব্দও তাদের মাঝে নেই। প্রিয়া নিজেকে মনোযোগী দেখালে সে আধোতে কোনো মনোযোগ দিতেই পারছে না। তার তো পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। নাহ, পড়ার জন্য না বরং লজ্জায়। সে একের পর এক ভুল ম্যাথ করেই যাচ্ছে। কিন্তু সৌরভকে বলতেও পারছে না। সে হাজার ভেবেও কূল কিনারা খুঁজে পেলো না সৌরভকে কি নামে ডাকবে এখন?

স্যার, ভাইয়া, না’কি এই যে শুনছেন। উফফ্! কিছুই মানসম্মত নয় তার কাছেই। সেই থেকেই তার শরীর থরথর করে কাঁপছে।

সৌরভ প্রিয়ার খাতা দেখে অবাক। এই মেয়ে কি ভুলের ফ্যাক্টরি নিয়ে বসে আছে। সে একটা ধমক দিলো।

কি ব্যাপার প্রিয়া! কি সমস্যা তোমার? আমি কি এখানে তোমার সাথে রোমান্স করতে আসছি। এরকম কাঁপছো কেনো? এতগুলো ভুল ম্যাথ হলো কিভাবে তোমার? এই ম্যাথ কিন্তু তোমাকে আগেও করা হয়েছে। ভুল হওয়ার তো কথা না প্রিয়া।

প্রিয়া ভয়ে শুকনো ঢোক গিলল। সে গাইগুই করছিল কি উত্তর দিবে এখন?

অস্থির হয়ে সৌরভ নিজের কপালে নিজের বাম হাত ঠেকালো। এই মূহুর্তে তার কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দুষ্কর কাজ নিজের বউয়ের সামনে নিজেকে সংযত রাখা। কিন্তু তাকে যে এই কাজ করতেই হবে। নয়তো এই মেয়ের পড়াশোনা সব লাটে উঠবে। কিয়ৎক্ষন সে চুপচাপ প্রিয়াকে পর্যবেক্ষণ করলো। তারপর সে কোমল গলায় বললো,

প্রিয়া আমি কি তোমার জন্য নতুন টীচার নিয়ে আসবো? আমার কাছে পড়তে তোমার অসুবিধা হচ্ছে মেইবি।

প্রিয়ার বক্ষস্থল কেঁপে উঠলো সৌরভের এমন কথায়। সত্যি সৌরভ তাকে আর পড়াবে না। তার অক্ষিদ্বয় জলে টইটম্বুর হয়ে উঠলো। প্রথমদিন সৌরভ পড়াতে আসলো সেদিন সে প্রত্যাখ্যান করেছিল পড়বে না বলে তবুও সৌরভ তাকে পড়িয়েছে। আর এখন সে পড়তে চাইছে কিন্তু সৌরভ চলে যেতে চাইছে।

প্রিয়ার বড্ড অভিমান হলো। সে উত্তর দিলো না, না একবারের জন্য সৌরভের দিকে তাকালো। নিজের হৃদগহীনের কষ্টগুলো সে আড়াল করে রাখলো সৌরভ থেকে। নৈশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে।

সৌরভ প্রিয়ার যথাযথ উত্তর পেলো না। তার মনটা বড্ড আকুপাকু করছে প্রিয়ার মুখ নিঃসৃত একটা বাক্যে শুনতে। এই মেয়েটাকে সে বুঝতেই পারে না। তার তো খুব ইচ্ছে করে বউটাকে নিজের কাছে রাখতে। সারাক্ষণ অপলক ঐ অক্ষিদ্বয়ের মাঝে নিজেকে হারাতে। কিন্তু সে তো অপারগ চাইলেও সব কিছু করতে পারবে না। সে যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নিজের সাথে। এর হেরফের হলে তার ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে। আর যাই হোক সে নিজেকে এতটা ছোট করতে পারবে না। সৌরভ প্রিয়াকে ফের প্রশ্ন করলো,

তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে আমার কাছে পড়তে?

প্রিয়ার যেনো এবার রাগ থরথর করে বাড়লো। সে কি একবারও বলেছে তার সমস্যা হচ্ছে। এই সৌরবিদ্যুত এত বেশি বুঝে কেনো? কই এসে তো একবারও জিজ্ঞেস করেনি প্রিয়া কেমন আছো? এই যে তার সামনে আস্ত একটা মানুষ বসে আছি সেই খবর তার নেই। অথচ সে যা চিন্তা করেনি সেটা তো ঠিকই তিনি দার্শনিকের মত ভেবে নিয়েছে। এবারও উত্তর দেয়ার ইচ্ছে হলো না তার। টিউশন শেষে উঠে দাঁড়ালো প্রিয়া। তবে যাবার আগেই সৌরভকে ধীর কন্ঠে বলল,

কালকে নতুন টীচার পাঠিয়ে দিবেন। আমি আর আপনার কাছে পড়বো না।

ছোট্ট দু’লাইনের বাক্য সৌরভের কর্ণকুহরে যেনো বজ্রপাতের সৃষ্টি করলো। মস্তিষ্কে তার র*ক্তক্ষরণ হতে লাগলো। একটা বছরের জন্য বউ থেকে সে এমনিতেই দূরে আছে। চাইলেও না ছোঁয়া যাবে, না ধরা যাবে। কিন্তু মন ভরে দেখার জন্য টিউশনটাই হচ্ছে একমাত্র উপায়। যদি দিন শেষে টিউশনটাও না থাকে তাহলে সে বাঁচবে কিভাবে? পিছন থেকে সে প্রিয়ার হাতটা খপ করে ধরলো। ত্বরিত টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।

প্রিয়া সৌরভের এহেন আচরণে হতচকিত হয়ে গেলো। মনে মনে উত্তরের বহর সাজালেও মুখে কোনো বাক্য উচ্চারিত হলো না।

সৌরভ প্রিয়াকে নিজের মুখের সামনে নিয়ে এসেই তার চক্ষুদ্বয়ে অগ্নিদৃষ্টি ফেললো। প্রিয়ার মুখে ফুঁ দিয়ে তার এক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

এত শখ কেনো নতুন টীচারের? কিন্তু প্রিয়ারানী আপনার জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে আমার। অন্তত আপনার জামাই বেঁচে থাকতে নতুন টীচারের কথা তো ভুলেই যান।

প্রিয়া সৌরভের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। সে চাইছে ছুটে পালাতে। কিন্তু সে হাঁসফাস করলেও সৌরভ থেকে সে পালাতে পারলো না। সৌরভও সুযোগ বুঝে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ করে ফেললো। প্রিয়া লজ্জায় মিইয়ে গেলো। সৌরভ তাকে লজ্জা দিতে আবারও একি কাজ করলো। পরে ধস্তাধস্তি করে সৌরভ থেকে ছাড়া পেতেই ছুটে পালালো। যাওয়ার আগেই কিন্তু সৌরভকে সে গালি দিতে দিতে পালালো।

অসভ্য বেয়াদব সারাক্ষণ খালি চুমু খাওয়া।

সৌরভ মিট মিট করে হাসলো। সে কখন সারাক্ষণ চুমু খেলো। বউকে তো সে কাছেই পাই না। তার বউয়ের সাথে দূরত্ব শুধু একটা দেয়ালের মাত্র। কিন্তু দেয়ালের অপর পাশেই তার বউ থাকলেও তাকে সে কাছেই পাই না। বউ তার পাশে থাকলেও সাথে নেই। চাপা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো তার।

এখনো ৩৬২ দিন তাকে অপেক্ষা করতে হবে।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here