শাওয়াম পর্ব -০৫

#শাওয়াম
পর্ব ৫
Suvhan Arag (ছদ্মনাম)

স্কুলের কমন রুমে বসে আছে শাওয়াম।হাতে মুখে পানি দিয়ে জামার গলার দিকের অংশ ভিজিয়ে ফেলেছে।সকালের পর যে কিভাবে স্কুল গেটে সে পা ফেলেছে সেই জানে।যদিও তার পক্ষে একা হেঁটে আসাটাও কষ্ট কর হয়ে গেছিল।নিজেকে পাথরের মতো অসাড় মনে হচ্ছিল।ঠিক তখনি নাটকীয়ভাবে সানিয়া চলে আসে।এতকাল ধরে কখনো শাওয়ামের সাথে বিন্দু মাত্র খাতির ছিল না তার।হুট করে যেন সব কর্তব্য বন্ধুত্ব কলসীর ভেওর নুড়ি পাথর ফেলে পানি উপচে পড়ার মতো উপচে পড়েছে।কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে শাওয়াম।সানিয়া পাশে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছে বারবার।সেটা যে সান্ত্বনা নাকি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়া বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না শাওয়ামের।পুরো স্কুশ ছুটি।ছুটির পর স্কুলের কোন কোন টিচার প্রাইভেট পড়ান।সেই কারণে কিছু ছাত্র ছাত্রী এখনো আছে স্কুল মাঠে।

সানিয়া আবার শাওয়ামের কাঁধে হাত রেখে পূর্বের ন্যায় বলতে শুরু করলো,

‘দেখ এখন কেঁদে কি হবে?তুই আর ভাইয়া লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলেছিস।এখন যতই টালবাহানা করিস সত্যি এটাই তুই এখন সম্পর্কে আমার ভাবী হয়ে গেছিস।’

‘তুই একটা মিথ্যাবাদী আর তোর ভাই আরেক মিথ্যাবাদী।দুই ভাই বোন ইবলিশের মতো জঘন্য।’

শাওয়ামের কথা গুলো শুনে সানিয়া বেশ চটে গেল।নাটকীয়তা আর সম্ভব হচ্ছে না।সামনের টেবিলের ওপর হাত দিয়ে আঘাত করে উঠে দাঁড়ালো।মৃদু শব্দে শাওয়াম কিছুটা চমকে উঠলো।দাঁতে দাত চেপে সানিয়া হুশিয়ার করে দিল,

‘অনেকক্ষণ ধরে ভালো কথা বলছি কানে যাচ্ছে না তাই না!তোর জন্য এখানে স্কুল শেষেও বসে আছি।ফের যদি আমাকে আর ভাইকে কিছু বলতে আসিস খবর করে ছাড়ব তোর।’

সানিয়ার কথা শুনে শাওয়াম ও ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো উঠে দাঁড়ালো।তেড়ে গেল সানিয়ার দিকে।তার মুখের ওপর নিজের আঙুল উঁচিয়ে বললো,

‘চোরের মায়ের বড় গলা মানুষ এমনে বলেনা।নিজেরা চক্রান্ত করেছিস এখন ভয় দেখাচ্ছিস!তোদের সব কথা আমি সবাইকে বলে দেব।’

‘ও তাই বুঝি।বলে দে।এখনি গিয়ে মাইকিং কর পুরো এলাকায়।তাতে আমার বাল ছেড়া যাবে।’

সানিয়ার মুখভঙ্গি দেখে দমে গেল শাওয়াম।সানিয়ার মুখে বিন্দুমাত্র ভয়ের ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়না।উল্টা সে নিজেই গরম দেখাচ্ছে শাওয়ামকে।শাওয়াম নিজেকে শক্ত করলো।শান্ত গলায় বললো,

‘কেন আমার এত বড় সর্বনাশ করলি তোরা?’

‘কি রে তুই না সবাইকে বলবি বলেছিলি!’

‘আমি তোর সাথে কথার প্যাচে পড়তে চাইনা।কেন আমার ক্ষতি করলি বল?’

‘আমি কিছুই করিনি।নিজে পাঙ্গা নিতে এসেছিলি না আমার ভাইয়ের সাথে?খুব পার্ট দেখিয়েছিস এতদিন ভাইকে।পাটের বিবি এবার আমার ভাইয়ের সামনে মেউ মেউ করার জন্য প্রস্তুত হ।আর সবাইকে বলে দিবি?দে।তাতে ক্ষতি কার?তোর।আমার ভাই তো সময় দিয়েছে তুই অন্তত এস এসসি টা পাশ কর তারপর ঢাকঢোল পিটিয়ে বাজনা বাজিয়ে তোকে ঘরে তুলবে।তোর মা বাপ কেন চৌদ্দ গোষ্ঠী তার আগে কিছু জানবে না।এখন যদি বেশি ত্যাড়ামি করিস তাহলে এলাকায় টিকতে পারবি না।ভালোয় ভালোয় বলছি চুপচাপ যা হচ্ছে হতে দে।ভাইকে স্বামী হিসেবে মানতে শেখ।দেখবি সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। ‘

সানিয়ার কথা শুনে শাওয়াম আবার ধম করে চেয়ারের ওপর বসে পড়লো।নিয়তি আজ কোথায় এনেছে তাকে?না পারছে কাউকে বলতে না পারছে গিলতে।আজ যেন তার মুখের ভেতর আলো চাল।শাওয়ামের অবস্থা এখন যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের মতো।সানিয়া বেশ মজা পাচ্ছে দৃশ্যটা দেখে।নিজেই এবার হেলে দুলে এগিয়ে গেল শাওয়ামের দিকে।এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রাখলো।অসহায়ত্বের সুযোগটা লুফে নিল।সান্ত্বনার সুরে বললো,

‘দেখ স্কুল শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ।তোর মা বাবা চিন্তা করছে।বাড়ি গিয়ে যা ভাবার ভাবিস।এখন ওঠ।বাড়ি চল।’

সানিয়া শাওয়ামকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে কমন রুম থেকে বেরিয়ে এলো।ক্রমশ স্কুল গেটের দিকে এগিয়ে গেল।

স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে দারোয়ানের সাথে কথা কাটাকাটি করছেন রাশেদ সরদার।দারোয়ান তাকে ভেতরে ঢুকতে দেবেই না।মেয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হলে গেটের বাইরে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে।সব প্রাইভেটের ব্যাচ শেষ হলে যদি অন্যান্য ছাত্র ছাত্রীদের সাথে নিজের মেয়েকে দেখতে পায় তো ভালো না হলে দারোয়ান কড়া সুরে বলে দিয়েছে অন্য কোথাও দেখুন।রাশেদ সরদার আবার মিনতির সুরে বললেন,

‘ভাই,আপনার রুলস আপনার কাছে রাখুন।আমি তো চুরি ডাকাতি করতে যাচ্ছি না।আমার মেয়েটা বাড়ি ফেরেনি।’

‘দেখুন ভাই,স্কুল টাইম শেষ।অফিস বন্ধ।এখন আপনি কোনওক্রমে ভেতরে যেতে পারবেন না।’

‘আমার মেয়ে তো স্কুলে কোন টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়ে না।কেন বুঝতে চাইছেন না আপনি!’

‘তাহলে দেখুন কোন ছেলের সাথে ভেগেছে।আজকাল কার ছেলে মেয়েগুলো যা।বাপ মায়ের চোখে ধুলো দিতে এদের কলিজা কাপেনা।’

দারোয়ানের কথা শুনে রাশেদের মুখের চিন্তিত ছাপ মুছে যেন রক্তিম আভা ফুটে উঠলো।তার মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা!হুংকার দিয়ে উঠলেন রাশেদ,

‘খবরদার!আমার মেয়েকে নিয়ে একটা বাজে কথা বলবেন না।কিছু বলছিনা বলে পেয়ে বসেছেন!মাথার ওপর উঠে নাচতে শুরু করেছেন?এখানে চাকরি কিভাবে করেন দেখে নেব আমি।’

রাশেদ কথার মধ্যে সামনে তাকালো।গেট দিয়ে বের হচ্ছে শাওয়াম সাথে সানিয়া ।শাওয়ামকে দেখে খুশি হলেও সানিয়াকে দেখে খুশি হতে পারলেন না।বরং মেয়ের সাথে ঐ মেয়েটিকে দেখে সন্দেহ হচ্ছে তার।ঐ টুকুন মেয়ে তার পরিবার নিয়ে কম জালায়নি শাওয়ামকে।আজ হুট করে মেয়েটার শাওয়ামের সাথে এতো ঘেষে ঘেষে চলা পছন্দ হচ্ছে না তার।

শাওয়াম এতক্ষণ মাথা নিচু করে পায়ের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ হেঁটে আসছিল।হুট করে মাথা উঁচু করে বাবাকে দেখতে পেয়েই সানিয়ার থেকে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো।অপ্রত্যাশিত সুরে বললো,

‘বাবা!তুমি এখানে?’

মেয়েকে বুকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে রাখলেন রাশেদ।এতক্ষণে তার মনের তেষ্টা মিটেছে।শাওয়ামের মাথাটা ধরে উঁচু করে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন,

‘এতক্ষণ স্কুলে কি করছিলি মা?তোর জন্য চিন্তায় তোর মা কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে।’

শাওয়াম আমতা আমতা করতে করতে সানিয়ার দিকে তাকালো।সানিয়া ইশারায় বলে দিল চুপচাপ থাকতে।শাওয়াম ঢোক গিলে বললো,

‘বাবা আমি ইংরেজির একটা চ্যাপ্টার বুঝতে পারিনি তাই ম্যামের কাছে বুঝতে গেছিলাম।’

‘তোর চোখ মুখ এমন ফোলা কেন মা?’

‘মাইগ্রেনের ব্যথাটা বেড়েছে বাবা।তুমি তো জানো ব্যথা শুরু হলে কত কান্না আসে।’

‘তাই বলে অসুস্থ অবস্থায় ক্লাস করবি!ছুটি নিয়ে চলে আসিস নি কেন?’

‘সামনে পরীক্ষা।এইটুকু কষ্ট তো সহ্য করতেই হয় বলো।’

বাবা মেয়ের কথার মাঝে সানিয়া এগিয়ে আসলো।সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললো,

‘আসসালামু আলাইকুম আংকেল।কেমন আছেন?’

সানিয়ার যেচে কথা বলতে আসাটা মনঃপূত হলোনা রাশেদের কাছে।এই মেয়ে এত অভদ্র বড়দের বাপ মার নাম ধরে গালি গালাজ করতে বাধেনা।হুট করে তার এতো সৌজন্যতা চিন্তায় ফেলছে রাশেদকে।আপাতত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য রাশেদ বললো,

‘ওয়ালাইকুম আসসলাম।আমি ভালো আছি।তুমি কেমন আছো?’

‘জি ভালো।’

সানিয়ার সাথে কথা না বাড়িয়ে রাশেদ দারোয়ানের দিকে তাকালো।বেচারা কেমন অপরাধীর মতো দাড়িয়ে আছে।রাশেদ তাকে কড়া সুরে বললো,

‘কারোর সন্তানকে নিয়ে কথা বলার আগে একশত বার ভাববেন।স্কুলের দারোয়ান আপনি।নিয়মিত এখানে জ্ঞানের আলো ছড়ানো হয় সেখানে থেকেও এরকম মানসিকতা !ধিক্কার জানাই।’

দারোয়ান কোন কথাই বলতে পারলোনা।মাথা নিচু করে নিজের ডিউটিতে মনোনিবেশ করলো।

রাশেদ শাওয়ামকে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে রিকশা করলেন।এর মধ্যে হুট করে তাদের সামনে একটা বাইক এসে থামলো।রাশেদ অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।রাস্তার মাঝে কারোর সামনে হুট করে এভাবে বাইক দাঁড় করানো অসভ্যতা ছাড়া কিছুই না!রাশেদের সাথে সাথে শাওয়াম ও বাইক চালকের দিকে তাকালো।দুজনেই অপ্রস্তুত।শাওয়াম তো ভয়ে ঢোক গিলছে।আবার সাদাফের সম্মুখীন হতে হলো তাকে!সাদাফ হেলমেট খুলে রাশেদকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিতেই রাশেদ উওর না দিয়ে মেয়েকে নিয়ে রিকশায় উঠে বসলেন।তাড়া দিলেন রিকশা চালককে।সালামের উওর দেওয়াটা ও তার কাছে অনুচিত বলে মনে হয়েছে।সাদাফ এতোটাই অধম যে সালামটাও ঠিকভাবে দেয়নি।

ভাইয়ের বাইক দেখে সানিয়া এগিয়ে এলো।সাদাফ পিছু ঘুরে দেখছে রিকশা কতদূর গেছে।সানিয়া এসে ভাইয়ের বাইকের পেছনে বসে পড়লো।কাঁধে হাত রেখে বললো,

‘দেমাগ দেখলি ওর বাপের!’

‘সব দেমাগ ছুটিয়ে দেব।আমার নাম শুনলেও ভয়ে কাপবে।’

‘এবার বাড়ি চল।আমার খুব খিদে পেয়েছে।’

‘তোকে নামিয়ে দিতে পারলে আমিও বাচি।আমার দেরী হয়ে গেছে।’

‘তোর আবার কিসের দেরী!’

‘স্পেশাল ডেট আছে আজ।ফোর স্টার হোটেলে রুম বুকড করেছি।’

‘তোর কয় নম্বর গফের সাথে?’

‘আপাতত সেই আধভোলাটা।ঐ যে গ্রামের মেয়ে।সবে শহরের কলেজে ভর্তি হয়েছে।বলেছিলাম না!’

‘রাজি হলো?’

‘আরে বোন জানিস না এটা আমার বা হাতের খেল।’

‘নে বাড়ি চল।’

সাদাফ বাড়ির উদ্দেশ্য বাইক স্টার্ট দিল।

চলবে———-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here