শিশিরে ভেজা আলতা পর্ব -০৬+৭

#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

৬.
দু পাশে সবুজ লতায় ঢাকা দেয়াল মাঝখানে সরু রাস্তা। মাত্র বিশ কদমের দূরত্বে একটা লোহার গেইট সেটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আলতা মুগ্ধ নয়নে তাকায় চারপাশে। রিকশা থেকে নেমেই সেই লতায় মোড়ানো দুই দেয়াল এবং তার আশপাশের ফুলের গাছ দেখেই তো কত অবাক হয়েছিলো এখন তা আরো দ্বিগুণ হয়ে গেল গেইট পেরিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই।আঙিনা বলতে যতটুকু চোখে পড়ে সবটাই রংবাহারি গাছ আর লতায় ঢাকা। একদম মাঝামাঝি অংশে একটা গাছ যা দেখতে অনেকটা খেজুর গাছের মত মনে হলো আয়নার। সেই গাছ ঘিরেই আবার মানিপ্ল্যান্ট আর বিভিন্ন পাতাবাহার। বাড়ির চারিধারে গাছ লতাপাতায় একদম জঙ্গুলে বাংলো মনে হচ্ছে। শিশির খেয়াল করেছে আলতার মুগ্ধ দৃষ্টি তাই সে নিচু স্বরে প্রশ্ন করলো, “অবাক হয়েছিস?”

আলতাও ধীরে বলল, “অন্নেক সুন্দর জায়গাটা৷ এটা কোন জায়গা শিশির ভাই?”

“আমার বান্ধবী সোহাদের বাড়ি এটা।”

মুহূর্ত কয়েক আগের চমৎকার হাসিমাখা মুখটা আচমকাই দূর্যোগ পূর্বের আকাশের মত হয়ে গেল। শিশিরও বুঝি খেয়াল করলো এই আকস্মিক পরিবর্তন কিন্তু আজব বিষয় এমন কেন হলো! আলতা নরম স্বরে বলল, “ওহ!”

একটু আগের প্রশ্নের সাথে যে উচ্ছাস মিশে ছিল তার ছিটেফোঁটাও আর এখন পাওয়া গেল না। শিশির আবার বলল, “সোহার বাবা সচিবালয়ে চাকরি করেন এই বাড়ি সরকার থেকেই পেয়েছেন। রিটায়ার্ড করার পর অবশ্য এটা আর তাদের থাকবে না।”

আলতা কথাগুলো শুনলো কি শুনলো না কে জানে। শিশির ইচ্ছে করেই কথা চালাচ্ছে আলতার মলিন মুখের ভাব ধরতেই কিন্তু না আলতা আর রা কাড়লো না। মূল গেইট পেরিয়েও এখন আরো এক লোহার গেইট লাগানো এটা সোহাদের ঘরের। শিশির একবার ডাকবে ভেবেও না ডেকে ফোন বের করে কল দিলো। ওপাশ থেকে কি বলল শুনতে পেলো না আলতা তবে শিশির বলল, “হ্যাঁ ওকে নিয়ে এসেছি সাথে।”

কথা বলার কয়েক সেকেন্ড এর মাঝেই সোহাকে দেখা গেল। সে ভেতর থেকে দরজা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো আলতা?”

আলতা সালাম দিয়ে জবাব দিলো সোহার কথার। দুজনে ভেতরে যেতেই শিশির অনু, হৃদয় আর পরশের কথা জিজ্ঞেস করলো। সোহা বলল কথা হয়েছে অনু এখানে আসবে আর বাকি দুই বন্ধু নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে আগেই টিকিট কেটে রাখবে। অনু আসবে মানে তাদের গাড়ি নিয়ে চিন্তা রইলো না। অনু গাড়ি নিয়ে আসবে তাতে করেই পৌঁছে যাবে তারা। সোহা অনুকে ডেকে নিজের শোবার ঘরেই নিয়ে গেল শিশির অবশ্য সোহার ছোট ভাই সোহানকে দেখলো বসার ঘরেই ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। সোহানের সাথে পূর্ব পরিচিত হওয়ায় তার গল্প করার সুযোগ হলো। এক ফাঁকে সোহাকে বলল, “তাড়াতাড়ি করবে এখানে বেশিক্ষণ বসবো না।”

সোহা কাজের মেয়েকে ডেকে বলল চা আর পেস্ট্রি দিতে শিশিরকে আর আলতাকেও। আলতা চুপচাপ বসে আছে সোহার ঘরে আর লুকিয়ে বারবার সোহাকে দেখছে। সোহা তার ওয়াল কেবিনেট থেকে একটা ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। অল্প সময়েই সে পোশাক বদল করে বেরিয়ে এলো৷ কাজের মেয়েটি এক কাপ দুধ চা আর পেস্ট্রি রেখে গেছে আলতার সামনে। সোহা আলতার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, “চা খাও না তুমি আয়শা?”

“জ্বী”

“ঠান্ডা হয়ে যাবে চা টা খাও। আসলে আজ আম্মু বাড়ি নেই তো তাই সকালে নাশতা আমরা পাউরুটি আর জ্যাম দিয়ে করেছি তাই আর তোমাকে নাশতার জন্য বললাম না কিছু মনে করো না।” আন্তরিকতার সুর ছিলো সোহার কণ্ঠে তবুও আলতার ভালো লাগলো না। তার শুধু মনে হচ্ছে না আসাটাই ভালো হতো। সোহা তার ছোট্ট ড্রেসিংটেবিলটার সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন প্রসাধনী মাখছে আর আয়নায় ভেসে ওঠা আলতার প্রতিবিম্ব দেখছে।

“কি দেখছো আয়শা?”

চমকে গেল আলতা সোহার প্রশ্নে। সে আবারও আঁড়চোখে সোহাকেই দেখছিলো কিন্তু এভাবে ধরা খেয়ে যাবে বুঝতে পারেনি।

“কিছু না…”

আমতা আমতা করতে লাগলো আলতা তা দেখে হেসে ফেলল সোহা। আবারও সেই মিষ্টি হাসির সাথে আলতার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপু বলতে পারো আমি শিশিরের বয়সী। আচ্ছা আয়শা তুমি তো সকাল সকাল উঠেই এখানে এসেছো একটু সাজগোজ করারও সুযোগ পাওনি৷ এখানে এসো আমি সাজিয়ে দেই তোমায়।”

আলতা বলল সে এমনই সাজে তার বেশি সাজাটা শিফা মামীর ভালো লাগে না। সোহা জানতে চাইলো শিফা কে আলতাও বলল শিশির ভাইয়ের মা৷ এ কথার পরই যেন সোহা সুযোগ পেলো মনমতো কিছু কথা জানার। সে আলতাকে জোর করেই বসিয়ে দিলো তার ছোট টুলে। আলতার গায়ের রঙটা এতোই ফর্সা যে তাতে ফাউন্ডেশন এর প্রলেপ লাগানোর দরকার মনে করলো না। সে একটুখানি কম্প্যাক্ট নিয়ে আলতার গালে মুখে আলতো হাতে লাগিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করলো, “মামি ছাড়া আর কে কে আছে ও বাড়িতে।”

কিশোরী, দুরন্ত, চঞ্চলা আলতা তখনও নিজেকে গুটিয়ে খুব ধীর স্বরে বলল, “মামা, বড় মামী আর শরত ভাই। শিউলি আপার বিয়ে হয়ে গেছে তাই সে এখন শ্বশুর বাড়ি আর আম্মাও…” বলে থেমে গেল সে। সোহা জানে নকশির বিয়ের ব্যপারটা শিশিরের মুখে শুনেছিলো। তাই কথা ঘুরিয়ে বলল, “শরত ভাই মানে ওই যে হাসপাতালে যে ভাইয়া এসেছিলো?”

“হ্যাঁ”

“কি করেন তোমার শরত ভাইয়া? ”

“শরত ভাইয়ের বড় একটা দোকান আছে । সেখানে অনেক রকম জিনিস মানে মুদি বাজার সব।”

আলতা একমনে বলে চলছিলো কথা। তার মনের ভীরু আচরণ এবার আগল ভেঙে খুব স্বাভাবিক যেমনটা বাড়িতে থাকতে হতো। সোহাও সুযোগ বুঝে বলল, “সেই ভাইয়া বিয়ে করেনি?”

“নাতো তবে বড় মামী সেই কবে থেকেই পাত্রী খুঁজছেন। শরত ভাই-ই রাজী হয় না।”

“রাজী হয় না কেন?”

“ওই যে অলি আপা ধোঁক….” আলতা চুপ হয়ে গেল এইটুকু বলেই। সে তো কথা বলতে বলতে ভুলেই গেল বাইরের কাউকে এত কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। সোহাও তার থেমে যাওয়া দেখে বুঝতে পারলো আলতা এরপর আর বলবে না। তবুও আর কিছু জানার আছে বলে মনে হয় না তার। সে কথা শুনতে শুনতেই আলতার চোখে আইলাইনার লাগিয়ে দিল। গোলাপি ফর্সা চোখের পাতায় কালো রঙ দূর থেকেই যেন দৃষ্টি কাড়ছে৷ সোহা নিজেই মুগ্ধ হয়ে দেখলো আলতাকে। এবার চোখ পড়লো আলতার বেণীতে। সে বেণী খুলতে গিয়ে বলল, “ভেজা চুল বেঁধেছো কেন?”

“বাইরে চুল খোলা রেখে বের হলে বড় মামী রাগ করতেন৷”

“বড় মামী কি তোমার শরত ভাইয়ের মা!”

“জ্বী”

“আর কি করলে রাগ করতেন মামী?” সোহা উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো। বাইরে থেকে শিশির আর অনুর গলার আওয়াজ পাওয়া গেল তাই আলতা চুপ হয়ে গেছে। সোহার সাজ আগেই হয়েছে সে এবার শুধু চুল গুলো একটু স্ট্রেইটনার দিয়ে সোজা করে নিলো। তার চুল আগে থেকেই রিবনডিং করা থাকায় খুব একটা সময় নিলো না হালকা টাচআপে। কিন্তু সে দেখলো আলতা বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছে মেশিনটার দিকে।

“তুমি সোজা করবে?”

“না আপু।”

আলতার কোঁকড়াচুল আগেই খুলে ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে দিয়েছিলো সোহা কিন্তু এবার মনে হলো বাচ্চা মেয়েটা বেশ চমকেছে জিনিসটা দেখে। তাই হঠাৎই সে অনুকে ডেকে বলল ভেতরে আয়৷ শিশির রেগে বাইরে থেকেই বলল, “এখানেই থেকে যাই!”

“ইশ, একটু অপেক্ষা করো দশ মিনিট আর।”

অনু ভেতরে ঢুকতেই সে তাকে চিরুনি ধরিয়ে দিয়ে বলল, “হেল্প কর তার চুল স্ট্রেইট করব।”

অনু কয়েক পল গম্ভীর হয়ে আলতাকে দেখে বলল, “মিষ্টি মেয়েটাকে ভূত না বানিয়ে ছাড়বি না তুই?”

আলতা বোধহয় কথাটা শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলো৷

” আজকে দোকানে যাইতে হইবো না আব্বা আমরা শিউলির খালা শ্বাশুরির বাড়ি যামু।”

জয়তুন খুব ইনয়িবিনিয়েই বলল শরতকে। সে সকালে মা আর চাচীর হদিশ না পেয়েই বুঝতে পেরেছিলো কোন লুকানো ব্যাপার আছে। কিন্তু সেই ব্যাপার যে এত দ্রুতই খোলাসা হবে তা বোঝেনি। সে নাশতা শেষে দোকানের জন্য বের হবে ভাবছিলো কিন্তু তখনই তার মা এসে ঘরে ঢুকে এ কথা বলল। শরত আন্দাজ করেছে আম্মা নিশ্চয়ই কোন পাত্রীর খোঁজে বেরিয়েছে। কিন্তু এখন জানতে পারলো সকালেই আম্মা আর চাচী পাশের গ্রামেই পাত্রী দেখে এসেছে কিন্তু মেয়ে পছন্দ হয়নি বলে তাড়াতাড়িই ফিরে এসেছে। আর আসার পথেই শিউলির ফোন পেয়েছে সেও এক পাত্রী পছন্দ করেছে মাকে জানালো। তারই খালা শ্বাশুরির দেবরের মেয়ে দেখতে যেমন সুন্দরী পড়াশোনায়ও ভালো। আর সবচেয়ে বড় কথা মেয়েটা নাকি নিজেই বলেছে শরতকে তার পছন্দ৷ মায়ের চাপাচাপিতে ভ্রু কুঞ্চিত করে কিছু সময় বসে থেকে সে উঠে পড়লো। তার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব নয় এটাই শেষ কথা। রেগে গেল জয়তুন ছেলের কথা শুনে কিন্তু ছেলে সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বেরিয়ে গেল। মনকাননে এখনই আর ফুল ফুটবে না আগেই জেনেছে শরত। তার আরো সময় চাই স্বার্থপর মানুষটাকে মন থেকে মুছে ফেলতে। কয়েক দিন আগেই দেখা হয়েছিলো তার অলির সাথে। বাজারের মোড়ে বাস থেকে নেমে অটো ধরেছিল। অকস্মাৎ চোখের সামনে তাকে দেখে থমকে গিয়েছিলো শরত কিছু সময়ের জন্য। ফর্সা মেয়েটা আগের চেয়ে কালো হয়েছে, মায়াবী চোখ দুটোয় বিষন্নতা আর নিম্নাংশে তাকাতেই দেখতে পেয়েছিলো মেয়েটি সর্বোচ্চ সুখের সময়ে আছে এখন৷ ফোলা পেটে প্রকাশ পাচ্ছিলো তার অনাগত সন্তানের সংবাদ৷ অলি যদি সুখী হয়ে থাকে তাতে শরত অসুখী নয় শুধু তার দুঃখ হয় মেয়েটাকে সে আজীবন নিজের পাশে চেয়েছে অথচ সে আজীবনের জন্য অন্যকারো হয়ে গেছে।

আলতার চুল খুব ঘন আর অতিরিক্ত কোঁকড়া হওয়ায় দশ মিনিটে খুব একটা সোজা করা গেল না। এতে অবশ্য আলতাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। যেভাবে দুজন মিলে তার চুলের পেছনে পড়েছিলো তাতে মনে হচ্ছিলো যেকোন মুহূর্তে মাথাটাই আলাদা করে দিবে তার। অবশেষে তিনজনেই ঘর ছেড়ে বের হলো। শিশির তখন বাইরে বাগানের পাশে ছায়ায় দাড়িয়ে বিরক্তি নিয়ে ফোন স্ক্রল করছিলো। একসাথে আলতাদের বের হতে দেখে ভ্রু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, “রং ঢং শেষ হয়েছে?”

” এমনে কও ক্যান মামা তোমার কি নায়িকা পছন্দ হয় নাই?”

মুখ বাঁকিয়ে বলল অনু। আলতার খুব লজ্জা করছিলো শিশিরের সামনে এসে। অনুর মুখের কথা শুনে তার মন খারাপ হয়ে গেছে সাথে সাথে সে সোহা আর শিশিরের দিকেও তাকাচ্ছে। শিশির নিশ্চয়ই এখন সোহাকে দেখে খুব খুশি হয়েছে সেজেছে বলে! সত্যিই শিশির গভীর মনযোগে তাকিয়ে দেখছিলো সামনের দিকে। আলতার পাশেই সোহা তার পাশেই অনু। আলতার মনে হলো শিশির বুঝি সোহাকেই দেখছে৷ এ মুহূর্তে তার আর একটুও ভালো লাগছে না এখানে থাকতে কিন্তু উপায় নেই ফিরে যাওয়ার। অনু তাড়া দিয়ে সে গাড়িতে উঠে ড্রাইভিং সিটে বসলো। শিশিরও গিয়ে অনুর পাশে বসতে চাইলে অনু ইশারা করলো পেছনে গিয়ে বসতে। ততক্ষণে সোহা পেছনে বসে পড়েছে। আলতার হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল কেন! কিন্তু না এখানে কিছুতেই কান্না করা যাবে না। শিশির অনুর কথা না শুনে বলল, “তুই চুপ থাক গাড়িতে মন দে।” বলেই শিশির পেছনের দিকের আরেক দরজা খুলে আলতাকে বলল, “ওঠ”

আলতা কিছু না বলে উঠে বসলো শিশিরও সামনে বসলো৷ গাড়ি চলছে আহসান মঞ্জিলের উদ্দেশ্যে। শিশির হঠাৎ গাড়ির সামনের ছোট্ট আয়নাটা একটু কাত করে দিলো। আলতা খেয়াল করেছে তা আর তার মনে হলো আয়নাটা বুঝি সোহাকে দেখার জন্যই অমন করে দিলো শিশির ভাই!

প্রায় এক ঘন্টা পর যখন তারা এসে পৌঁছুলো তখন আগে থেকেই দুই বন্ধু উপস্থিত ছিলো। তারা টিকিটও কেটে রেখেছে শুধু বন্ধুদের আসার অপেক্ষায়। সবাই গাড়ি থেকে নামতেই শিশির আলতার কাছে এসে বলল, “জানিস এই মহলটার নাম কি?”

আলতা মাথা নেড়ে জবাব দিলো, “না”। শিশির বলল পুরনো আমলের নবাবদের বাড়ি ‘আহসান মঞ্জিল’ একন অবশ্য এটা বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরের একটা শাখা।”

আলতা সামনে তাকিয়ে দেখলো বিশাল প্রাসাদটি৷ আহসান মঞ্জিল নামটা সে অনেকবার শুনেছে এবং সাধারণ জ্ঞান বইয়েই হয়ত পড়েছিলো। কিন্তু কখনো এমন ঐতিহাসিক কোন প্রাসাদ দেখার সুযোগ হবে ভাবতে পারেনি। শুক্রবার বলেই হয়ত আজ খুব ভীড় তবে এখানে বেশিরভাগই কলেজ, ভার্সিটি পড়ুয়া মনে হচ্ছে। আলতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শিশির বলল, “চল ওরা ভেতরে ঢুকে গেছ।”

টিকিট দেখিয়ে শিশির, আলতাও ভেতরে ঢুকলো। চারপাশে সবুজ মাঠ আর সামনে বিশাল প্রাসাদ। দেখতে ভালো লাগছে আর শিশিরের পায়ে পা মিলিয়ে চলাটাও। বন্ধুরা সব আগেই সামনের মহলে ঢুকে গেছে। আলতাকে নিয়ে শিশিরও আগাচ্ছে সামনে। আজ কমলা রোদ চকচকে আর বড্ড তেজী। রোদ থেকে বাঁচতেই আলতা মাথায় তার লাল ওড়ানাটায় ঘোমটা টেনেছিলো। সিঁড়ি বেয়ে সেও উপরের দিকে উঠতে যাচ্ছিলো। হঠাৎই হাতে টান পড়ায় পিছু ফিরে চাইলো সে। মাথার ঘোমটা পড়ে গেছে তার হাতের টানেই। রোদের আলোয় পিটপিট করে চাইলো প্রথমে হাতের দিকে তারপরই হাতটি ধরে রাখা মানুষটির দিকে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা যুবকটির চোখেমুখ সূর্যকিরণে স্বর্ণরঙা লাগছে যেন! কিশোরী মন চোখের সামনে প্রিয় মানুষটিকে এরূপ দেখে হয়ত বিভ্রমে এক মুহূর্ত থমকে গেল। শরতের আকাশে ভেসে আসা শুভ্র মেঘের মত হালকা অথচ কোমল হয়ে ছুঁয়ে দিতে চাইলো আবেশে। গালভর্তি সদ্য বেড়ে ওঠা খোঁচা দাঁড়ি আর রোদ্র তেজে ছোট হয়ে আসা চোখের দৃষ্টিতে নিজের ম”র”ণ যেন দেখতে পাচ্ছিলো আলতা। শিশির এদিকে যাবো না বলেই আলতাকে টেনে চলে গেল গ্যালারি সাইডে। দ্বিতীয় প্রাসাদের পেছন দিকে চিকন বাঁকানো লোহার সিঁড়িটা দেখিয়ে শিশির বলল, “ছবি তুলবি! চল ওপরে ওঠে দাঁড়া আমি তুলে দিচ্ছি।”

আলতা দেখলো সিঁড়িটা খুব চিকন ওপরের অংশে একটুখানি জায়গায়৷ সিঁড়িটা একতলা সমান উঁচু কিন্তু তার ভয় লাগছে সে উঠবে না। শিশির শুনলো না বলল, চল আমি হাত ধরে নিয়ে যাই।”

শিশির খেয়াল করে দেখলো আশেপাশে কাউকে দেখা যায় কিনা। বন্ধুরা তো ভেতরে চলে গেছে আগেই। আশেপাশে দেখতেই চোখে পড়লো কাপল আর তারা বিভিন্ন পোজে নিজেদের সেলফি তুলছিলো। আলতাকে একটু অপেক্ষা কর বলেই সেই জুটির দিকে ছুটে গিয়ে অনুরোধ করলো একটা ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। ছেলেটি রাজী হতেই শিশির আলতার হাত ধরে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। আলতাকে সামনে দাঁড় করাতেই শিশির পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে ইশারা করলো ক্লিক করতে। খুব একটা বাতাস নেই তপ্ত প্রকৃতি তবুও একটু উঁচুতে হওয়ায় যেন হালকা বাতাস এসে লাগছিলো গায়ে। পাট করে রাখা চুলগুলো আলগোছে ডান গালে জায়গা করে নিলো। শিশির ঘাড় বাঁকিয়ে দেখলো সেটা। তার মনে হলো চুলগুলো সরিয়ে দেওয়া দরকার আলতা তো ভয়ে ঠিকঠাক নিঃশ্বাসটাই নিচ্ছে না। চোখমুখে খিঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা শিশির হাত উঠিয়ে চুল সরালো। শিশিরের ছোঁয়াতেই বুঝি আলতাশুভ্রা মুখের সেই কুঞ্চন আপনাআপনি সরল হয়ে এলো। বাতাসে তখন শিশিরের গায়ের মাতালকরা পারফিউম এর সুবাস আলতাকে ভাসিয়ে নিচ্ছিলো দূর কোন বনপাহাড়ে।
#শিশিরে_ভেজা_আলতা
(২য় খন্ড)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা

৭.
ভেজা বাতাসে বুনোফুল দোলে!

কিশোরী কন্যা তার চুলের বাঁধন খোলে,,

ও কন্যা এলিয়ে যদি দিবি তোর কেশ…..

“আর কত আওড়াবে এই লাইনগুলো বলো তো!”
শৈলী আপা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে কথাটা বলল। সারাদিনের ঘুরাঘুরি শেষে হোস্টেলে ফিরেছে আলতা। ফেরার পর থেকেই ফোনের ওয়াল স্ক্রীণে তাকাচ্ছে আর গুনগুন করে গানের মত করে গাইছে লাইনগুলো। শুধু মাত্র একবার বিড়বিড় করে শিশির এই লাইনগুলো বলেছিলো তার পেছনে দাঁড়িয়ে। ওই যে চিকন আঁকাবাঁকা সিঁড়িটার মাথায় দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সময় বাতাসে এলোমেলো হলো আলতার চুল। তখনি বলেছিলো লাইনগুলো কিন্তু আলতা নিজের স্মৃতি শক্তিতে অবাক হয়। মাত্র তো একবার বলেছে শিশির লাইনগুলো অথচ তার একটুও ভুল হচ্ছে না গুনগুন করতে। প্রতিটা শব্দ সে ঠিকঠাক মনে করতে পারছে। আজ শিশির তাকে আরও একটা কথা শুনিয়েছে, “শহুরে হাওয়া গায়ে লাগাতে চাইলে গায়ে আগুন ধরিয়ে দিব। সুন্দর চুলগুলোকে একদম সেমাই বানিয়ে ছেড়েছে। তোর মুখ ছিলো না তুই বারণ করতে পারিসনি?”

কথাগুলো রেগে নয় কেমন যেন চিবিয়ে চিবিয়ে বলছিলো শিশির ভাই। মনে হচ্ছিলো চুলগুলো আলতার নয় তার নিজেরই বুঝি সোজা করে ফেলেছে। এই কথাগুলো শোনার পর থেকেই আলতা ফরফর করে ওড়ছে প্রজাপতির মত। শৈলী আপা দু চার কথা শুনিয়েই আবার বললেন, বয়সটা অল্প এখন চোখের ওপর রঙিন চশমা লেগেছে। যা দেখবে তাই ভালো লাগবে, যা শুনবে তাই আমোদময় মনে হবে তাই বলে ভুলে গেলে চলবে না নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার কথা। শিশিরকে তুমি খুব পছন্দ করো আবার শিশিরও তোমার প্রতি আসক্ত তা তোমাদের আচরণেই স্পষ্ট। কিন্তু এতে করে ভুলে গেলে চলবে না তুমি শহরে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছো। কি ঠিক বলছি না!

আলতা মাথা নাড়লো ‘হ্যাঁ’ সে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছে। মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকা যেন মা তার নতুন জীবন সঙ্গীকে সহজে মন থেকে মেনে নিতে পারে। মন দিয়ে পড়াশোনা করে নিজের জন্যও কিছু করা যেন বাবা, মা কিংবা অন্যকারো ওপর তাকে নির্ভরশীল না হতে হয়। আরো একটা উদ্দেশ্য আছে তার আর তা হলো নিজের জন্য একটা বাসস্থান এর ব্যবস্থা করা যা করার জন্য হলেও তাকে শিক্ষিত হয়ে স্বাবলম্বী হতে হবে। ছোট্ট মনেই তার অনেক ভাবনা। বাবার একটা নিজস্ব পরিবার আছে সংসার আছে সে চাইলেও সহজে সে সংসারে ঢুকে তাদের একজন হতে পারবে না। আর মায়ের কাছে থাকলে মা নিজের জন্য একটা ঘর, একটা সঙ্গী মানসিক ভাবে মানতে পারবে না। তাই ঘুরেফিরে তাকে সারাজীবন এই দুইজন মানে তার আপন বলতে দুজন মানুষ কখনোই তাকে পাশে রাখতে পারবেন না৷ না চাইতেও সে ওই দুজনের সংসারে বাড়তি ঝামেলার মত এক বস্তু। সত্যিই আলতা আজকাল শিশিরকে ভাবতে গিয়ে বেশিই বিভোর থাকে যার ফলে তার পড়াশোনায়ও ঢিলেমি চলছে। শৈলী আপা গম্ভীর স্বভাবের হলেও তিনি শুরু থেকেই আলতাকে খুব সাপোর্ট করে আসছে। আলতা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে একবার তাকালো শৈলীর দিকে। নিজের লক্ষ্যে দৃঢ় থাকার জন্য হলেও তাকে শৈলী আপার কথাগুলো মাথায় রাখতে হবে। সে রাতে আর শিশিরকে নিয়ে ভাবনা নয় বইয়ের পাতায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখলো আলতা। রাতের ঘুমটাও তার ঠিকঠাক ধরা দিলো না চোখে।

শরত দোকানে বসে একটা বই পড়ছিলো। দুপুরের দিকে কাস্টমার খুব একটা আসে না বললেই চলে। নতুন কর্মচারী ছেলেটি ভীষণ লক্ষী স্বভাবের। শরত আজকাল প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে বইয়ে ডুবে থাকে দোকানে বসেই। কখনো কখনো তো কাস্টমার এসে তাকে ডাকলেও সে শুনতে পায় না যেন কিন্তু এতে ক্রেতা বিরক্ত হওয়া বা ফিরে যাওয়ার সুযোগ পায় না। ছেলেটি নিজেই সামলে নেয় সব। আজ শরত দুপুরে বাড়ি যায়নি ইচ্ছে করেই। মা সারাদিন জোরাজুরিতে লেগে থাকবে মেয়ে দেখতে যাবে বলে। শরত কিছুতেই এখন বিয়ে নিয়ে ভাবতে চাচ্ছে না৷ বিয়ে সে করবে কিন্তু মন থেকে আরেকটু ফিকে হয়ে যাক অলির সাথের স্মৃতিগুলো তারপর। এখন সে যাকেই বিয়ে করুক পরিপূর্ণ সুখী করতে পারবে না। সময়ে অসময়ে অলির সাথের সময়গুলো মনে উঁকি দেয় আর তখনই সে নিজেকে বেসামাল পায়। এক নারীর সামনে অন্য নারীকে নিয়ে তার দূর্বলতা সে প্রকাশ করতে চায় না। তারচেয়ে বরং আরেকটু ফিকে হোক অলির ভাবনা যখন সে অনায়েসে অতীতকে মনে করেও নিজেকে সামলে রাখতে পারবে তখনই বিয়ের কথা ভাববে। বইয়ে মুখ গুঁজে আবারও বুদ হয়ে থাকার চেষ্টা করলো শরত অমনি তার ফোন বাজলো। নাম্বারটা সেভ করেছিলো সে কাল ভোরেই তাই ‘সোহা’ নামটা দেখেই কপাল কুঁচকালো। মেয়েটার সমস্যা তো কালই সে দূর করেছিলো আজ আবার কেন কল দিচ্ছে!

বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ না করে হ্যালে বলল শরত। ফোনের ওপারে সোহা হাসিমাখা মুখে সালাম দিলো। শরত জবাব দিতেই সোহা আবার কথা বলল, “আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া।”

“স্বাগত”

দুপাশেই এবার নীরবতা। সোহা ভেবেছিলো লোকটা আরো কিছু বলবে কিন্তু না সৌজন্যতা রক্ষার বাইরে কথাই বলছে না৷ আরো কিছু সেকেন্ড অপেক্ষা করে সোহা বলল, “অনুও খুব স্যরি করছে আপনাকে।”
সোহার কথাটা বলতেই শিশির কটমট চোখে তাকালো সোহার দিকে। অনু তো ঠাস করে একটা চড়ই মেরে দিলো তার বাহুতে। সোহা বন্ধুদের এসবে পাত্তা না দিয়ে শরতের উদ্দেশ্যে আবার বলল, “আবার কখনো ঢাকায় আসলে বেড়াতে আসবেন আমাদের বাসায়।”

শরত বিরক্তি ধরে রেখেই হালকা হাসিমুখ করে বলল, “আচ্ছা।”

আবার চুপ রইলো দুজনেই তবে শরত বলতে চাইলো, “আর কিছু কি বলার আছে না থাকলে কল কাটো।” কিন্তু মুখে সে কথা বলতে পারলো না। এদিকে শিশির ইশারা করলো কল কাটার জন্য কিন্তু সোহা কিছুতেই তার কথা শুনতে চাইলো না। ওপাশ থেকে শরতই বলে বসলো, “ভালো থাকবেন।”

মন খারাপ হয়ে গেল সোহার কিন্তু সে কথা কি আর প্রকাশ করা যায়! সেও কল কেটে দিলো। ফোন রাখতেই অনু দুম করে কি”ল দিয়ে বসলো সোহার পিঠে, “ওই হা”রা’মী আমি কখন সরি বললাম ওই শরৎচন্দ্ররে! আমার অত ঠেকা পড়ে নাই ওই বল”দরে সরি বলতে হুহ।”

এ কথার পর শিশিরও একটা ঠোকা মে*রে বসলো অনুর মাথায়। সেও বলল, “তোর মতিগতি আমার টিক লাগে না অনু তুই আমার ভাইয়ের প্রেমে পড়িসনি তো আবার!” এ কথা শুনে অনু মুখ বাঁকালো, “ই*শ তোর আবুলমা*র্কা ভাইয়ের প্রেমে পড়তে আমার বয়েই গেছে।”

পরশু রাতে শরতকে ফোন করেছিলো এই বলতে, “শিশির তাদের সাথে কথা বলছে না।”

কিন্তু সে কথার আর সুযোগ হয়নি তার তবে পরেরদিন সকালে শরত যখন নাশতার জন্য বসেছিল তখনই আবার সোহা ফোন করেছিলো। তখনই সে শিশিরের রাগের কথা জানায় আর অনুর পক্ষ থেকেও পুনরায় সরি বলে সে। তখন শরত জানায় সে শিশিরকে বলবে যেন রেগে না থাকে। এ কথার পরই শিশিরের সাথে শরতের কথা হয় শিশির বান্ধবীদের ক্ষমা করে দেয় এবং সে ঘটনাকে কেন্দ্র করেই অনু ঘুরতে যাওয়ার বায়না করে। মনোমালিন্য দূর হয়েছে তাই যেন সেলিব্রেট করা কিন্তু সে কথা আবার আলতা আর বাকি দুই ছেলে বন্ধুর অজানা৷

পড়াশোনা আর টিউশনিতে ব্যস্ত হয়ে শিশিরের দেখা কম মিলতে থাকল। বন্ধুরা আর আলতাও খুব মিস করতে লাগলো শিশিরকে অথচ ছেলেটা হঠাৎ করেই কেমন ডুব মে'”রে গেল। আলতাও পড়ায় মনযোগী হলো সেই সাথে নিয়ম করে মা আর বাবার খোঁজও রাখলো৷ নকশি আজকাল আর ছটফটায় না আলতার জন্য তবে মনকে পুরোপুরি শক্তও করতে পারেনি। জহির নিজের সাধ্যমত নকশিকে আগলে নিয়েছে এমনকি প্রতিটাক্ষণ আলতাকে নিয়ে যতোটা সম্ভব নিশ্চিন্ত রাকার চেষ্টা করে নকশিকে। নকশিও বোঝে মানুষটা তাকে ভালোবেসে তার কন্যাকেও আপন করে নিয়েছে খুব আর এ কারণে তার অপরাধবোধও হয় খুব। যে মানুষটা হরদম তার ভালো ভেবে তার সন্তানকে আপন করে নিতে চায় সে মানুষটাকে সে তার প্রাপ্য আজও বুঝিয়ে দিতে পারছে না বলে। অথচ লোকটা ধর্মমতে এখন অনেকটা পাওনাদার তার কাছে। দেনমোহরের পাই টু পাই তাকে কবুল বলা রাতটিতেই বুঝিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু নকশি কি করবে! তার মন যে দৈহিক, মানুষিক দু দিক থেকেই বিমুখী হয়ে গেছে৷ মনের ঘরে যে আগল টেনেছিলো অনেক বছর আগে সে আগল ভাঙতে যে আরো সময় লাগবে। হয়ত এতোটাও সময় লাগতো না কিন্তু কয়েকদিন ধরে জহিরের এক চাচাতো বোন হঠাৎ করেই নকশিকে খুঁচিয়ে যাচ্ছে আলতার বিয়ে নিয়ে। সেই থেকেই নকশির মনে হচ্ছে মেয়েটা বড় হয়ে গেছে দেখতে দেখতে কলজেও পাশ করে যাবে। এরপর আর অপেক্ষা করা যাবে না মেয়ে বিয়ে দিতে হবে। আর এ বয়সে এসে সে নতুন বউয়ের মত সংসার করতে পারবে না। হতে পারে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিই তাকে এতোটা হীনমন্য করে তুলছে নিজের জীবন নিয়ে কিন্তু আলতা খুব করে চায় তার মায়ের জীবনটা আর দশটা নারীর মত সাংসারিক হোক। সেই সংসারে তার নিজস্ব স্থান, অবস্থান হয়ত নড়বড়ে থাকবে তবুও চায়। মা তো চাইলেই পারতো তার ছোট্ট বয়সেই নিজেকে অন্য কারো করে নিতে শুধু মাত্র তার কথা ভেবেই একাকীত্বকে আপন করেছিলো। মেয়ে হিসেবে তাই তারও চাওয়া মায়ের জীবনটা এখন সাধারণ রমনীর মত হোক। সময়ের আবর্তনে তাই হতে শুরু করেছিলো কিন্তু সময় কোথাও না কোথাও আবারও পথরোধ করতে চাইলো। আলতার কলেজের সময়গুলো ভালো কাটলেও কয়েকদিন আগে শিফা মামীর কিছু কথা তাকে আবারও ভেতরে ভেতরে কেমন যেন নিষ্প্রাণ করে দিলো। হেমন্তের শুরুর এক বিকেলে মামী হঠাৎ করেই ফোন দিয়ে বললেন বাড়ি কবে আসবি? আলতার তখন প্রথম সেমিস্টার চলছিলো সে ভাবলো পরীক্ষার পর কয়েকটাদিন হাতে থাকবে তখন সে বাড়ি যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো সে কোথায় যাবে, কোন বাড়িতে যাবে! জহির কাকার বাড়ি নাকি আব্বার বাড়ি? প্রতিটা মানুষেরই তো জন্মের পর একটা বাড়ি থাকে নিজের বলতে কিন্তু তার তো কোন বাড়িই নেই। জন্মের পর থেকে শিশির ভাইদের বাড়িটাকে নিজের বাড়ি বলে জানতো এরপর জানলো সেটা তাদের বাড়ি নয় তার বাবা আছেন তখন ভাবলো সেটা তাদের বাড়ি কিন্তু যেদিন সে প্রথম আব্বার সাথে সেই বাড়ি গেল তার ধারণা বদলে গেল সেদিনই। কারণ সে বাড়িতে একটা সৎ মা আছে, দুইটা ভাই আছে আর সেই বাড়িটা তাদেরই। যে বাড়িতে নিজের নেই সে বাড়ি তার নয়। এরপর মায়ের বলতে একটা বাড়ি হলো কিন্তু সে বাড়িতে তার বাবা নেই আছে মায়ের বর তার জহির কাকা। জহির কাকার বাড়ি কখনোই তার বাড়ি নেই। এই কথাগুলো ভাবতে গিয়েই কলি’জা ফাটা আর্তনাদ বুকের ভেতরটা ভেঙে চৌচির করে দিচ্ছিলো। বারংবার মনে হয়েছে সে এতিমের চেয়েও অসহায়। এতিমের তো বাবা মা কেউ থাকে না তাই তারা নিঃস্ব অথচ তার সব থেকেও সে নিঃস্ব। শুধু মনে হয়েছে মাকে কেন জোর করলো বিয়ে করতে! সে যদি এমন জোরাজুরি না করতো মাকে বাধ্য না করতো তবে আজ মা তার থাকতো শুধুই তার একার। মামীকে সেদিন খুব ইচ্ছে করছিলো বলতে, “মামী আমার অন্তরটা চি”রে গেছে ভেতরে খুব যন্ত্রণা আমার মাকে বলো আমার কাছে আসতে, আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে আমি একা একা থাকতে পারি না। কিন্তু বলা হলো না সে কথা কারণ এই যন্ত্রণার মাঝেই মামী তাকে আরো একটা কথা বলেছিলো, ” আলতা তোর মায়ের যদি আরো একজন বাচ্চা হয় তুই কি খুশি হবি না? তোর আরো একটা ভাইবোন এলে কি তুই খুশি হবি নারে মা!”

না চাইতেও আলতার চূর্ণ হৃদয়ে রক্তক্ষরণ সেদিন ঝর্ণা বেয়ে নেমে আসা নদীর স্রোতের মত বয়েছিল। মায়ের জন্য খুশি হতে গিয়েও কেন জানি খুশি হতে পারেনি সেদিন আলতা। মামীকে মুখে বলেছিলো, “খুব কুব খুশি হবো মামী। আমি তো চাই আমার আরো কয়েকটা ভাইবোন হোক কত্তো ভালো হবে এতে। আমি তাদের জন্য ঢাকা থেকে কত কি কিনে নেবো।”

শিফা এ কথা শুনে কিছুটা সময় চুপ থেকে বলেছিলো, ” তোর এই খুশি হওয়ার সুযোগ এসে গেছে। নকশি পোয়াতি কিন্তু…”

শিফা থেমে যেতেই আলতা নিজের কান্না লুকিয়ে প্রশ্ন করে কিন্তু কি মামী?

“নকশি বাচ্চাটাকে রাখতে চায় না। নিজেী ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে রে সে। তার ধারণা তুই কষ্ট পাচ্ছিস তার বিয়ের জন্য৷ তুই দূর হয়ে গেছিস সে বিয়ে করেছে বলে। এখন এই সন্তান হলে তুই আর কখনোই তার কাছে আসবি না।”

মামীর কথা শুনে আলতার মন বলছিলো, “সত্যিই মামী আমি দূর হয়ে গিয়েছি আম্মার কাছ থেকে আরো হয়ে যাবো হয়তো!” কিন্তু মুখে বলল, “আম্মারে বুঝাও মামী এমন কিছু হবে না। আমি কথা বলবো আম্মার সাথে আমি বোঝাবো। এসব উল্টাপাল্টা কথা কেন ভাবে। আমি সত্যিই খুব খুশি হবো মামী তুমি আম্মার কাছে যেও। বুঝিয়ে এসো যেন নিজের ক্ষতি না করে কিছুতেই।”

শিফা জানালো, নকশি তাদের বাড়িতেই আছে। সে প্রেগন্যান্ট জানার পর থেকেই কেমন আজব আচরণ করছিলো তাই জহির খুব ভয় পেয়েছে। নকশিকে বাড়িতে একা রাখতেও খুব ভয় হয় তার তাই আহসানের সাথে কথা বলেই এ বাড়ি পাঠিয়েছে। আলতা সেদিন ফোন রেখেই কান্নায় ভেঙে পড়ে খুব। মনে মনে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যায় জাগতিক সকল ভাবনার বাইরে। ওপরওয়ালার কাছে শুধু প্রার্থনা করে তাকে যেন একা বেঁচে থাকার একটু শক্তি দেন৷ মন তার এত কেন স্বার্থপর হয়ে উঠছে সে জানে না। তার একটা ভাইবোন এলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যাবে তার তো খুশি হওয়ার কথা কিন্তু তার খুশি লাগেনি। মনটা শুধু বলছিলো এ দুনিয়ায় সে আরো একা হয়ে যাবে একদম একা! এ দুনিয়ার কোন সম্পর্ক তার আপন রইবে না আর।

চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here