শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব -১১+১২

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_11
#Writer_NOVA

রওনকের রাগ দেখে সবাই ভয় পেলেও আমি কিন্তু বেশ মজা পাচ্ছি। যার কারণে মিটমিট করে হাসছি।আমাকে হাসতে দেখে রওনক রেগে আমার দিকে তেড়ে আসলো।ওকে তেড়ে আসতে দেখে আমি দুই লাফে পিছিয়ে গেলাম।রওনক দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

—তোমাকে কি আমি ক্লাশ ওয়ান টু এর বাচ্চার মতো মাছ,শাপলা ফুল,তাল,প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকতে বলছি?

আমি একটা ভেংচি কেটে কনফিডেন্সের সাথে বললাম,

—একাউন্টিং -এর স্টুডেন্টকে বায়োলজি ডিপার্টমেন্টের প্রাকটিকাল করতে দিলে এর থেকে ভালো কিছু হবে না। তাও ভালো আমি মাছ,ফুল,পাখি, প্রাকৃতিক দৃশ্য এঁকেছি। একবার তো ভেবেছিলাম একাউন্টিং-এর অঙ্ক করে দিবো।কিন্তু মন চাইলো অনেক দিন ধরে চারুকলার কোন কিছু আকি না।সেই যে অষ্টম শ্রেণিতে চারুকারু সাবজেক্টের জন্য একেক কিছু এঁকেছিলাম। তারপর থেকে বহুদিন সবকিছু অফ।তাই আমি ভাবলাম আপনাদের প্রাকটিকাল খাতার স্বদ্যবহার করি।

আমার উত্তর শুনে সবাই বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তন্বীর চোখগুলো তো কোটর থেকে বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। শুধু রওনক রাগে ফুঁসছে। হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই ধরেছেন।আমি ওদের প্রাকটিকাল খাতায় কলম দিয়ে মাছ,শাপলা ফুল,গোলাপ ফুল,পাখি,প্রাকৃতিক দৃশ্য এঁকেছি। এক ঘন্টার মধ্যে সবগুলো খাতায় আকা কমপ্লিট হয়ে গেছে। শুধু খাতার পেজ উল্টিয়েছি আর তাড়াহুড়ো করে কোনরকম এসব এঁকেছি। একবার ভেবেছিলাম একটা খাতায় আঁকবো। কিন্তু মাথায় শয়তানি বুদ্ধি হানা দেওয়ায় সবগুলোতে বসে বসে একে ফেললাম।

রওনক রাগে থেমে থেমে ফুঁসে উঠছে।দুই হাত মুঠ করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।আমি বোকা ফেস করে তার দিকে তাকিয়ে আছি। রওনক আমার দিকে ঘুরে বললো,

—কাজটা ঠিক করলে না।

—কাজটা আপনিও ঠিক করেননি।আপনারও বোঝা উচিত ছিলো একাউন্টিং নিয়ে পড়ুয়া মেয়ে কি করে আপনাদের প্রাকটিকাল করবে।

—করতে পারোনি যখন তাহলে খালি খাতা ফেরত দিতে।কিন্তু এরকম করে নষ্ট করলে কেন?

—ইচ্ছে করে করেছি।যাতে পরবর্তীতে আমাকে দিয়ে প্রাকটিকাল করানোর কথা ভুলেও মনে না আনেন।

—তোমার বিরুদ্ধে কিন্তু আমি এখন ব্যবস্থা নিতে পারি জানো?

—আপনি কি ব্যবস্থা নিবেন? নিবো তো আমি।এখন সোজা প্রিন্সিপালের রুমে যাবো।তারপর আপনি যা যা করেছেন আমার সাথে তা তো বলবোই।সাথে বানিয়ে বানিয়ে এক্সট্রা কিছু জুড়ে দিবো।সাথে এটাও বলবো যে আপনি আমাকে রেগিং করেছেন।আপনারা যা করেছেন আমার সাথে তা রেগিং-এর পর্যায় পরে।
আর এই কলেজে কোন সিনিয়র রেগিং করলে তার কঠোর শাস্তি হয়।সে কলেজের ভিপি হোক কিংবা সাধারণ কোন ছাত্র-ছাত্রী।তা কিন্তু দেখা হয় না।আপনারা নিশ্চয়ই তা আমার থেকে ভালো জানেন।আমি চললাম প্রিন্সিপালের কাছে বিচার দিতে।ভিপি পদটা হারানোর জন্য তৈরি থাকেন।চল রে তন্বী, আমার অনেক কাজ আছে।

আমার কথা শুনে রওনক ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,

—যাও বলো।তাতে আমার কি?আমি কি প্রিন্সিপালকে ভয় পাই নাকি?

—আপনি প্রিন্সিপালকে ভয় পান না?

—একটুও না।প্রিন্সিপাল আমার কিছুই করতে পারবে না। উনার এখানে কোন হাত নেই।

রওনকের কথা শুনে আমি হতাশ হলাম।ঠিকই তো।প্রিন্সিপাল ওদের কি বলবে?ভি.পি তো নির্বাচিত হয় ছাত্রদের ভোটে।হঠাৎ আমার মনে হলো বর্তমানে কলেজের ভিপি পদে তো যুবরাজ ভাইয়া আছে। আর সে এক্সিডেন্ট করায় রওনককে সাময়িক সময়ের জন্য ভারপ্রাপ্ত ভি.পি করা হয়েছে। যদি যুবরাজ ভাইয়ার ভয় দেখাই তাহলে কাজ হবে।কারণ যুবরাজ ভাইয়া নাকি তার সুস্থতা হওয়া অব্দি রওনককে ভিপি দিতে বলেছে।আর ছাত্র সংগঠন মিটিং ডেকে প্রত্যেকটা সদস্যের মত নিয়ে রওনককে ভিপি বানিয়েছে।

আমাকে চুপ থাকতে দেখে শয়তানি হাসি দিয়ে দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—কি চুপ হয়ে গেলেন যে মিস ঝগড়ুটে? প্রিন্সিপালকে বিচার দিবেন না।

আমিও একটা শয়তানি হাসি দিলাম।তা দেখে রওনক চোখ, মুখ কুঁচকে ফেললো।তারপর খুশিমনে বললাম,

—প্রিন্সিপালকে বিচার দিলে তো কিছু হবে না। তারচেয়ে আমি বরং যুবরাজ ভাইয়াকে বিচার দিবো।তার অবর্তমানে আপনি রেগিং করে তার পদটাকে কলুষিত করছেন।আমার জানামতে ভাইয়া তার রিপিটেশন নিয়ে অনেক সচেতন।কেউ তার অবর্তমানে তার পদটাকে কলুষিত করবে আর তিনি নিশ্চয়ই সহ্য করবে না।আমার তায়াং ভাইয়ার সাথে যুবরাজ ভাইয়ার অনেক ভাব।আমিও সেই ভাবের স্বদ্যবহার করবো।

আমার কথা শুনে সবাই আৎকে উঠলে। নিমিষেই রওনকের মুখের রাগ হাওয়া হয়ে ভয়ে পরিণত হলো।সাথের আণ্ডাবাচ্চাগুলোও বেশ ভয় পেয়ে গেল।ওদের ভয় দেখে আমি আরো দ্বিগুণ সাহস পেয়ে গেলাম।ওদের একেকটার মুখ দেখে শয়তানি হাসি দিয়ে তন্বীর হাত ধরে উল্টো দিকে রওনা দিলাম।দু পা এগুতেই রওনক আমার সামনে এসে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,

—বোন, আমার এই সর্বনাশটা করিস না।যুবরাজ ভাইয়ার কাছে বিচার দিয়ো না। তুমি বিচার দিলে আমাকে অনেক বকবে।ভাইয়া আমাকে ওয়ার্ণিং দিয়েছে যদি আমার নামে আরেকটা নালিশ যায় তাহলে আমার খবর আছে। প্লিজ বোন তুমি আমার কথা শুনো।আমি কখনো তোমার সাথে লাগতে যাবো না। তাও তুমি কমপ্লেন করো না।

আমি খুশিমনে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
—আমাকে দিয়ে আবার প্রাকটিকাল করাবেন নাকি?

রওনক মুখটাকে কালো করে আমাকে উত্তর দিলো,
—ছাইড়া দে বোইন, কাইন্দা বাঁচি। আরেকবার তো দূরে থাক জীবনে প্রাকটিকাল খাতা নিয়ে তোমার সামনেও আসবো না।

তন্বী আমাকে খোঁচা দিয়ে বললো,
—এত করে যখন বলছে বিচার দিয়ো না নোভাপু।

আমি তন্বীর দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বললাম,
—এই তোর এত জ্বলে কেন রে?

—আমার জ্বলবে কেন? আমি তো এমনি বলছিলাম।

—তাহলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক।

—এমন করো কেন?

—আবার কথা বলিস?

—😑😑

তন্বীর দিকে একটা ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রওনকের দিকে তাকিয়ে একগালে শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম,

—এত করে যখন বলছেন তাহলে তো বিচারটা না দিলেই ভালো হয়।আচ্ছা আপনি যখন আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন তাহলে আমি আর বিচার দিবো না। তবে এর বিনিময়ে আমাকেও কিছু টাকা দিতে হবে। আমার টাকা লাগতো না।কিন্তু এত কষ্ট করে প্রাকটিকাল খাতা কমপ্লিট করে দিলাম তাই তার পারিশ্রমিক দিলেই হবে।

রওনক ব্যস্ত ভঙ্গিতে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ভেতরটা খুলতে খুলতে বললো,

—কত লাগবে তোমার? ৫০০ দিলে চলবে?

—পাঁচ শততে কাজ হবে না। এক হাজার লাগবে।

রওনক চমকে কিছুটা জোর চেচিয়ে বললো,
—এক হাজার!!!

—জ্বি, এক হাজার।এক হাজার দিলে আমি প্রিন্সিপালের কাছে বিচার দিবো না। নয়তো এই যে গেলাম।

আমি পেছন দিকে ঘোরার আগেই রওনক মানিব্যাগ থেকে পাঁচশত টাকার দুটো নোট আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

—আরে না না তোমার কোথাও যেতে হবে না। এই নাও তোমার টাকা।

আমি নোট দুটো হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে জিজ্ঞেস করলাম,
—জাল নোট না তো?

—একটাও না।তুমি চেক করে দেখতে পারো।

—আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি যখন খুশি হয়ে আমাকে প্রাকটিকাল করে দেওয়ার পারিশ্রমিক দিয়েছেন আমি কি না নিতে পারি বলেন।আর নিশ্চিন্তে থাকেন।আমি যুবরাজ ভাইয়ার কাছে কিছু বলবো না। কি আসবেন আবার আমার সাথে লাগতে?যদি আবার আসেন তাহলে আমি কিন্তু সত্যি বিচার দিবো।

—আমি বোইন তোর হাতেও ধরি পায়েও ধরি।আজকের থেকে তুই আমার বড় বোইন।আমি ভুলেও তোমাকে দিয়ে কোন কাজ করাবো না।বরং তোমার থেকে ১০ হাত দূরে থাকবো।যেই থ্রেট তুমি দিছো।আর আমার পকেটও খালি করছো।আমি তোমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখবো।ঐ শাওন,মহিম চল এখান থেকে। আমার মাথা ঘুরতাছে।আর কিছু সময় এখানে থাকলে আমি অজ্ঞান হবো।

রওনক ওর সাঙ্গপাঙ্গদের কথাগুলো বলে এখান থেকে দ্রুত কেটে পরতে নিলেই আমি রওনকে ডেকে উঠলাম,

—এই যে মিস্টার রওনক।

—জ্বি আপু।

—বড় বোন বানালেন আর তাকে সম্মান না করেই চলে যাচ্ছেন।

—মানে বুঝলাম না আপু।

—-সালাম কে দিবে?

—কিন্তু তুমি তো আমার ছোট।

—একটু আগে আমাকে বড় বোন কে বানালো?তাছাড়া সালাম ছোট-বড় সবাইকে দেয়া যায়।

—ওহ্ ভুলে গেছিলাম।

—জোরে সালাম দেন।

—দিতেই হবে।

—না দিলে কিন্তু যুবরাজ ভাইয়ার কাছে বিচার দিবো।

—আবার ব্লাকমেইল 😶।

—হুম,জলদী সালাম দেন।

—আসসালামু আলাইকুম আপু।

—ওয়া লাইকুমুস সালাম।বেঁচে থাকো বৎস। এখন থেকে যখন যেখানে আমায় দেখবেন তখুনি সালাম দিবেন।

—কেন?

—দিতে বলছি দিবেন।এত কথাতো শুনতে চাইনি।নয়তো আমি কিন্তু ভাইয়ার কাছে বিচার দিবো। আর আমাকে কিন্তু যুবরাজ ভাইয়া চিনে । আমি বিচার দিলে ভাইয়া সব বিশ্বাস করে নিবে।

মারলাম একটা ঢপ।আমাকে যুবরাজ ভাইয়া চিনে না। ভাইয়ার কাছে গিয়ে যদি বলি আমি অন্য কলেজের স্টুডেন্ট তাও বোধহয় বিশ্বাস করে নিবো।কারণ স্কুল-কলেজের সবাই শুধু দুই টাইপের স্টুডেন্টদের চিনে।১.ক্লাশের টপার স্টুডেন্টদের ২.ক্লাশের সবচেয়ে বাজে স্টুডেন্টদের।আর মাঝামাঝি যারা থাকে তাদের কোন কারণ ছাড়া খুব কমই চিনে তারা।আমি হলাম ঐ মাঝামাঝি ধরনের স্টুডেন্ট। তাই আমাকে সবাই চিনেও না ভালো মতো।

রওনক আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—আমি কি যাবো?

—হুম ঠিক আছে। যান এবার।

আমি বলতে দেরী কিন্তু রওনকের কোনরকম সেখান থেকে কেটে পরতে দেরী না।আমি হাসতে হাসতে পেট ধরে বসে পরলাম।আজ বেচারাদের আচ্ছা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তন্বী আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে হাতের পাঁচশত টাকার নোট দুটোয় গাঢ় করে একটা চুমু খেলাম।এই না হলে কি একাউন্টিং এর স্টুডেন্ট। সব জায়গায় বিজনেস খুঁজে নেই।এতকিছু হয়ে ভালোই হয়েছে মাঝ থেকে আমার এক হাজার টাকা লাভ হলো।একাউন্টিং-এর স্টুডেন্ট বলে কথা। লাভ-লোকসানের হিসাব যদি না করি তাহলে কিরকম একাউন্টিং-এর স্টুডেন্ট হলাম😎!!!
#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_12
#Writer_NOVA

“একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি,একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি,
আমার সহজ সরল মনটা কোথায় জানি হারিয়ে গেছে
মনটার রং ছিলো সাদা।মনে ছিলো সীমাহীন ভালোবাসা। যদি কোন সহৃদয়বান আমার মনটা পেয়ে থাকেন,তাহলে অনুগ্রহপূর্বক আমার সাথে যোগাযোগ করুন।”

সদর দরজা দিয়ে ঢুকে মাইকের মতো চেচিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিতে দিতে দিতে আসছিলাম।ছাদ থেকে মাত্রই ফিরছি।খালামণি আস্ত ধনিয়া রোদে দিয়ে আসতে বলেছে।তাই ছাদে গিয়েছিলাম।ভেতরে ঢুকতেই চোখ ছানাবড়া। তায়াং ভাইয়া আর তার দুই বন্ধু সোফায় বসে আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তারা দুজন হলো ইমরান হাশমি ভাইয়া আর এনজিও সংস্থা। ভাইয়ার বন্ধুদের আসার নির্দিষ্ট একটা সময় আছে। হয় সকাল আটটার দিকে আসবে।নয়তো দুপুরে খাবার আগে কিংবা পরে।তবে এনাজের জন্য কোন সময় বাঁধা নেই। সে যখন খুশি তখন আসতে পারবে।তায়াং ভাইয়ার জানে জিগার দোস্ত বলে কথা।আমি তাদের দেখে বেশ লজ্জায় পরে গেলাম।ইস,কি না কি ভাবছে তারা।হাতে থাকা বড় প্লাস্টিকের থালাটা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম।দ্রুত তাদের পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই তায়াং ভাইয়া গম্ভীর গলায় বললো,

—তোর মন আবার কোথায় হারিয়ে গেলো?কেউ কি চুরি করে নিয়েছে নাকি?যদি কেউ চুরি করেও তাহলে সে শয়তানি বুদ্ধি ছাড়া আর কিছু পাবে না।তা চোরটা কে?

আমি থালা সরিয়ে শুধু চোখ দুটো বের করলাম।তারপর রাগী চোখে তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,

—এমনি বলছিলাম।আমার মন কোথাও হারায়নি।আর এই নোভার মন চুরি করা এতো সোজাও নয়।

এনাজ মুচকি হেসে তায়াং ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—টিডি পোকার মন চুরি করবে কি করে তায়াং?সারাদিন লাফাতে লাফাতে দিন যায়।ওকে কেউ ধরতে পারলে না চুরি করবে।তারচে দেখগা কোথায় লাফাতে গিয়ে ফেলে রেখে এসেছে। যে পেয়েছে সে এবার দিলেই হয়।

—এনজিও সংস্থা ভালো হবে না কিন্তু।

—উচিত কথা বললে সবারই গায়ে ফোস্কা পরে।তা মিস টিডি পোকা মনটা হারালেন কোথায়?ঘাসে নাকি রাস্তায়?আমি খুঁজে পেলে কিন্তু দিবো না। আমার কাছে রেখে দিবো।

ইমরান ভাইয়া এনাজের পিঠে জোরে চাপর মেরে বললো,
— কি দোস্ত হাব-ভাব তো ভালো ঠেকছে না ঘটনা কি?

এনাজ বললো,
—কোন ঘটনা নেই দোস্ত। টিডি পোকার মন পেলে বৈয়ামে ভরে রাখতাম।আর মনটাকে ওয়াশ করে তার থেকে সব শয়তানি বুদ্ধি বের করে ফেলতাম।একবার শুধু হাতে তো পাই।তারপর কি করে সোজা করতে হবে তা আমি দেখে নিবো।

ইমরান ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—তা নোভা,মনটা কোথায় হারিয়ে ফেলছো? আমাদের এনাজের মাঝে নাকি?আমাদের এনাজ তো সেই কবে তো……

ইমরান ভাইয়া পুরো কথা শেষ করার আগেই এনাজ তার মুখ চেপে ধরলো।আমি তাদের কান্ড দেখে চোখ, মুখ কুঁচকে তার দিকে তাকালাম।এনাজ ইমরান ভাইয়ার মুখ ছেড়ে মাথায় একটা মৃদু থাপ্পড় মেরে ওকে চোখের ইশারায় কি জানি বলতে মানা করলো।আমি কিছুই বুঝলাম না। তায়াং ভাইয়া মুখ টিপে হাসছে। আমি ইমরান ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,

—কি বলতে চাইছিলেন ইমরান হাশমি ভাইয়া?

ইমরান ভাইয়া একবার তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আরেকবার এনাজের দিকে তাকালো। এনাজ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ করতে বলছে।আমি বেকুবের মতো তিনজনের দিকে তাকিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছি।কিন্তু আমি ব্যর্থ হলাম।তাই তাদের জিজ্ঞেস করলাম,

—আপনারা একে অপরকে ইশারা করে কি বলতে মানা করছেন?

ইমারান ভাইয়া সবগুলো দাঁত দেখিয়ে হে হে করে হেসে বললো,
—কিছু না।

—জলদী বলেন ইমরান হাশমি ভাইয়া।আপনারা আমার থেকে কিছু একটা তো অবশ্যই লুকাচ্ছেন।

—আমার নাম ইমরান হোসেন। হাশমি নয় রে বোইন।তুমি আমার নামটার তেরটা বাজায় দিলা।এতই যখন আমাকে অন্য নামে ডাকার ইচ্ছে তোমার তাহলে ইমরান মাহমুদুল বলতা।তাহলে নিজেকে সিঙ্গার সিঙ্গার মনে হতো।তা না করে ইমরান হাশমি!!!

—আপনার চেহারা আমার কাছে ইমরান হাশমির মতোই লাগে।তাই আমি এই নামে ডাকি🤭।

কথাটা বলেই মুখ টিপে হাসতে লাগলাম।আমার হাসির সাথে এনাজ ও তায়াং ভাইয়াও যুক্ত হলো।ইমরান ভাইয়া আমাদের সবার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।আমরা কেউ সেটা গায়ে মাখলাম না।ইমরান ভাইয়া ও এনজিও সংস্থা দুজনেই তায়াং ভাইয়ার অনেক বিশ্বস্ত ।তাই তায়াং ভাইয়া এখনো আমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়েছে। অন্য কেউ থাকলে তায়াং ভাইয়া কবেই এক রামধমক দিয়ে এখান থেকে বিদায় করতো।খালামণি কিচেন থেকে ডাকতেই আমি সেদিকে দৌড়ালাম।

💖💖💖

ছোট তিনটা রুম,একটা ছোট ড্রয়িংরুম,একটা কিচেন নিয়ে তায়াং ভাইয়াদের ছোট ফ্ল্যাট। এখানে গত কয়েক বছর ধরে তারা ভাড়া থাকে।এক রুমে তায়াং ভাইয়া, আরেক রুমে খালামণি আর তন্বীর রুমে আমি ও তন্বী থাকি।প্রত্যেকটা রুমে এডজাস্ট করা বাথরুম। তন্বী ও তায়াং ভাইয়ার রুমে ছোট করে বারান্দা আছে। খালু প্রবাসে থাকে।সবাই কত করে বলে এই বয়সে আর বিদেশ করতে হবে না। কিন্তু তিনি শুনেন না।বলেন তায়াং ভাইয়ার একটা গতি করে তারপর দেশে আসবেন।গতকাল শুনলাম তায়াং ভাইয়া ও এনাজ পার্টনারশিপে ব্যবসা শুরু করবে।কিন্তু কিসের ব্যবসা তা জানি না।

কলেজ থেকে ফিরে দুপুরে না খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলাম।প্রচুর মাথাব্যথা উঠেছিলো।আর আমার মাথাব্যথার ঔষধ একমাত্র ঘুম।পুরো রুম অন্ধকার করে ঘন্টাখানিক ঘুমালে আমার মাথাব্যথা কমবে।মাথাব্যথা হলে আমাকে কেউ ডাকে না।কারণ ঘুম পরিপূর্ণ না হলে আরো বেশি মাথা ধরে।বারান্দার দরজাটা হালকা করে ভিড়ানো ছিলো।যার কারণে পড়ন্ত বিকেলের চিকচিক করা উপচে পরা রোদ অবাধ্য হয়ে আমাদের রুমে ঢুকে পরেছে।সেই আলোতেই জেগে গেছি।আমার ঘুম ভাংতে এতটুকু আলোই যথেষ্ট। পাশে তাকিয়ে দেখি তন্বীও ঘুমে।মাথাটা অনেকটা ঝিমঝিম করছে। আসরের নামাজ পরে কিচেনে চলে গেলাম।গিয়ে দেখি খালামণি এঁটো থালাবাসনগুলো পরিষ্কার করছে।আমাকে দেখে বললো,

—মাথাব্যথা কমেছে।

—অনেকটা কমেছে। কিন্তু এখনো ঝিমঝিম করছে।

—খাবার খেয়ে একটা ঔষধ খা।দেখবি ভালো লাগবে।

—ঔষধ খেতে ভালো লাগে না।

—ভালো না লাগলেও খেতে হবে।

—আমার গলায় বেজে থাকে খালামণি।

—পিঠে দুই-চার ঘা দিলে এমনি গলা থেকে নেমে যাবে।

—তুমিও আম্মুর মতো কথা শুরু করলে।যাও কথা নেই তোমাদের সাথে।

আমি ঠোঁট ফুলিয়ে অন্য দিকে ঘুরতেই খালামণি ফিক করে হেসে উঠলো। আমি তার দিকে কপাল কুঁচকে তাকালাম।খালামণি ঠোঁটের কোণায় হাসি রেখেই বললো,

—সেই ছোটবেলার মতো করিস এখনো।

আমি খালামণিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
—আমি তো এখনো তোমাদের কাছে ছোটই।যদি ছোট না হতাম তাহলে কি এতবড় ভুলটা করতে যেতাম বলো।এখন ভেবে দেখি কতবড় বোকামি করতে গিয়েছিলাম।তাও একজন বৈঈমান মানুষের জন্য।

আমার কথা শুনে খালামণির মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে গেলো।কিছুটা রুক্ষ স্বরেই বললো,
—বাদ দে এসব কথা। যা চলে গেছে তাতো গেছেই।নিশ্চয়ই তোর জন্য এর থেকে হাজার গুণ ভালো কিছু আছে।

—এগুলো আমার বিষাক্ত অতীত খালামণি।আমি চাইলেও ভুলতে পারিনা। এখনো মাঝরাতে মনে হলে
আৎকে উঠি।

খালামণি হাতের কাজগুলো রেখে আমার দুই বাহু ধরে আমাকে তার বরাবর ঘুরালো।তারপর এক হাত আমার গালে রেখে বললো,
—আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে।তুই না সবসময় এই কথাটা বলিস।তাহলে এখনো কেন পুরাতন নিয়ে পরে আছিস।

—সারাদিনতো দুষ্টামী,ফাইজলামিতে নিজেকে ব্যস্ত রেখে তো সব ভুলে থাকি কিন্তু মাঝে মাঝে মনে এলে নিজের মধ্যে থাকি না আমি।

—সব ঠিক হয়ে যাবে।আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ।

—তাই যেনো হয় খালামণি।

—নে এবার ভাত খেয়ে ঔষধ খা।

আমি খালামণির সামনে থেকে সরে চুলোয় ছোট পানির পাতিল বসাতে বসাতে বললাম,

—এখন ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না।এক মগ কফি খাবো।

—ভাত খেয়ে তারপর খা।

—পরে ভাত খাবো।এখন কফি খেয়ে নেই। তাতে যদি মাথাটা একটু ঠিক হয়।

—তোর যা ইচ্ছে হয় কর।আমার কথাতো শুনিস না।তিন ভাই-বোন নিজেদের মনমতো চলিস।কফির মগ নেই এখানে।তায়াং-এর রুমে শোকেসের মধ্যে পাবি।সেখান থেকে নিয়ে আসিস।

—কেন মিটসেফে না ছিলে একটা?

—সেটা সেদিন ধুতে গিয়ে ডাট ভেঙে ফেলেছি।তাই তো নতুন নিয়ে আসতে বললাম।

—আচ্ছা তাহলে নিয়ে আসি।

তায়াং ভাইয়ার রুমের সামনে গিয়ে দেখলাম দরজা ভিড়ানো।গুটিগুটি পায়ে দরজাটা হালকা খুলে কচ্ছপের মতো মাথা ভেতরে ঢুকিয়ে দেখলাম খাটের ওপর উপুড় হয়ে কেউ শুয়ে আছে। সে নিশ্চয়ই ঘুমে।তারমানে এখন আমাকে চোরের মতো ভিতরে প্রবেশ করে খুব সাবধানে শোকেস খুলে মগ বের করতে হবে। খুব সাবধানে পা টিপে টিপে ভেতরে ঢুকলাম। তারপর যথাসম্ভব শব্দ না করে শোকেস খুললাম।কিন্তু শোকেস খোলার পরই ঘটলো বিপত্তি। ভেতর থেকে শো করে উড়ে একটা তেলাপোকা বের হলো।সেটা গিয়ে উড়ে বসলো উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা মানুষটার পিঠের ওপর।এটাকে এখন না মারলে তো কাঁথা, বালিশ কিংবা জামা-কাপড় কেটে ফেলবে।তাই আমি পা টিপে টিপে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। মানুষটা তায়াং ভাইয়া নয়।গালের চাপ দাড়ি দেখে বুঝলাম এনজিও সংস্থা। পাশ থেকে বালিশটা নিয়ে ধরাম করে তার পিঠের ওপর যেখানে তেলাপোকা বসেছে সেখানে দিলাম এক বারি।বেচারা আহ শব্দ করে ধরফর করে উঠে বসতে নিলে আমি তাকে থামিয়ে দিলাম।

—প্লিজ, প্লিজ উঠবেন না। একটা তেলাপোকা।

বেচারা আর উঠলো না।আমি ততক্ষণে বালিশ ছেড়ে তেলাপোকা খোজার মিশনে নেমেছি।তেলাপোকাটাকে খুঁজে পাচ্ছি না। তাই এদিক সেদিক খুঁজে এনাজের পাশে গিয়ে একহাতে ওর টি-শার্ট তুললাম।আমি আসলে দেখতে গিয়েছিলাম তার শরীরের ভেতরে তেলাপোকাটা ঢুকেছে কিনা।এনাজ চোখ, মুখে বিস্ময় নিয়ে আবারো পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো।তেলাপোকার পায়ের মতো কিছু একটা দেখতেই আমি টি-শার্ট ছেড়ে আবার বালিশ নিয়ে একের পর এক এনাজের পিঠে বারি দিতে লাগলাম।এনাজ চেচিয়ে বললো,

—টিডি পোকা কি করছো?আমার লাগছে তো।আহ্ আউচ, ও মাগো।

তার কথায় আমার হুশ ফিরলো। আসলে যে বালিশটা দিয়ে এতক্ষণ একের পর এক বারি মারছিলাম সেটা অনেক শক্ত। এটা দিয়ে ব্যাথা পাওয়াটা স্বাভাবিক। আমি বারি থামিয়ে এক হাত মুখে দিয়ে বিস্মিত চোখে এনাজের দিকে তাকালাম।এনাজ পিঠে হাত দিয়ে বললো,
—আহ্ আমার পিঠ।আটার ডো পেয়েছো নাকি।এত জোরে কেউ বারি দেয়।

এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলাম তেলাপোকা নিচের ফ্লোরে ঘাপটি মেরে বসে আছে। আর এতক্ষণ আমি শুধু শুধু বেচারার ওপর বালিশ অভিযান চালিয়েছি।বালিশটাকে ছুঁড়ে ফেলে সেখান থেকে পলাতক আসামী হলাম।এখানে আর আমি নেই।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here