শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব -৬৪

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Sarprise_Part
#Writer_NOVA

কেউ খুব যত্ন সহকারে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। স্পর্শটা খুব চেনা লাগছে। কানে ইঞ্জিনের শো শো শব্দ আসছে। কিন্তু কিসের ইঞ্জিন তা বলতে পারবো না।পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম এনাজের কাঁধে আমার মাথা।সে এক হাতে জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে মাথায় হাত বুলাচ্ছে। আশেপাশে তাকিয়ে আরেকটু চমকে উঠলাম। আমরা একটা ট্রলারে আছি। চারিদিকটা বেলুনে সাজানো। ছোট ছাউনির নিচে বসে আছি আমি ও এনাজ। নদীতে ঢেউ বেশি নেই। শো শো শব্দ করে ট্রলার এগিয়ে যাচ্ছে তার নিজস্ব গতিতে।আমি শক্ত করে এনাজকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে উঠলাম। এনাজ ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে তোমার? ভয় পেয়েছো? আমি আছিতো। একটু শান্ত হও।

— ঐ আবির নামের ছেলেটা….

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বলা শুরু করতেই পাশ থেকে কেউ বলে উঠলো,

— আমি কিছু করিনি। যা করার সব তোমার জামাই করছে। বুদ্ধিও তোমার জামাইয়ের।

আবিরের গলা পেয়ে চমকে তাকালাম। সত্যি তো আবির এখানে।আমি গুটিসুটি মেরে দুই হাতে এনাজকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকালাম। এ ছেলে এখানে কি করে? আমাকে ভয় পেতে দেখে এনাজ বললো,

— ওকে ভয় পেয়ো না। আবির আমাদের বন্ধু।

আমি একদফা অবাক হয়ে এনাজের মুখের দিকে তাকালাম। এনাজ আমাকে চোখ দিয়ে আশ্বস্ত দিলো। কিন্তু তাকে ছাড়লাম না আমি। আবিরের দিকে একটা রাগী লুক দিয়ে ভেংচি কাটলাম।

— হ্যাপি বার্থডে টু ইউ!

একসাথে সবাই চেচিয়ে ইউশ জানিয়ে এগিয়ে এসে হামলে পরলো আমার ওপর। সারা শরীর পার্টি স্প্রে ও জরি দিয়ে মাখামাখি আমার। তায়াং ভাইয়া, তন্বী, রওনক, শারমিন, তওহিদ ভাইয়া, ইমরান হাশমি ভাইয়া, শাহেদ, রায়হান ভাইয়া। সবাইকে একসাথে দেখে এনাজের দিকে তাকালাম। এনাজ আমার মুখের স্প্রে মুছে দিতে বললো,

— আমার একটা মাত্র বউ। তার বার্থডে-এর কথা কি আমি ভুলে যেতে পারি বল তো? ম্যানি ম্যানি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্যা ডে। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। মে আল্লাহ ব্লেইস ইউ মাই ডিয়ার।

আমি অভিমানী সুরে বললাম,
— এই ছিলো আপনাদের মনে? আর আমি ভেবেছি সবাই আমার বার্থডে-এর কথা ভুলেই গেছেন।

এনাজ শব্দ করে হেসে বললো,
— কিডন্যাপের প্ল্যানটা আমাদেরি ছিলো। আমার সব বন্ধুকেই তো তুমি চিনো। একমাত্র আবিরকে ছাড়া। তাই এক্ষেত্রে আবিরকে কাজে লাগিয়েছি আমরা।

— তায়াং ভাইয়া মাঝে মাঝে যে আবিরের কথা বলতো উনি কি সেই আবির? চট্টগ্রামে কাজ করে।

— হ্যাঁ, ওর কথাই বলতো।

— কিডন্যাপ করে এনে বার্থডে সারপ্রাইজ। সত্যি অনেক বড় সারপ্রাইজ আমার জন্য। কিন্তু অজ্ঞান করেছে কে?

এনাজ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
— এনাজ ছাড়া তার বউকে ছোঁয়ার অধিকার অন্য কারো আছে নাকি? কেউ ধরলে তার হাত ভেঙে ফেলবো। আমিই সেই ব্যাক্তি। যে তোমাকে অজ্ঞান করেছে।সরি টিডি পোকা! তোমাকে অজ্ঞান করে, কিডন্যাপের অভিনয় করেছি শুধুমাত্র সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য।

— এভাবে কেউ সারপ্রাইজ দেয়? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে মনে বলেছিলাম এই আবিরকে একবার সামনে পেলে চাটনি বানাবো।

আবির অভিযোগের সুরে এনাজকে বললো,
— দেখ ভাই, আমি কিছু না করেও তোর বউয়ের কাছে কত কথা শুনেছি। এখন আবার বলছে চাটনি বানাবে। এমনি যেই ধানি লঙ্কা। আমি ওর সাথে যেই ভয়ে ভয়ে কথা বলেছি।

তায়াং ভাইয়া তাড়া দিয়ে বললো,
— বাকি কথা পরে হবে। এখন কেক কেটে নে।

শারমিন ও তন্বী এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে একসাথে বার্থডে উইশ করলো। আমি ওদের দুটোকে সরিয়ে দিয়ে রাগী গলায় বললাম,

— কথা নেই তোদের সাথে। তোরাও আমাকে ছেড়ে আমার জামাইয়ের দলে ভর্তি হয়েছিস।

তন্বী মুখ কুচোমুচো করে বললো,
— আমার কোন দোষ নেই। সব তোমার জামাইয়ের প্ল্যান। উনার কারণে বার্থডে উইশটাও করতে পারিনি।

শারমিন এক হাত চেপে ধরে বললো,
— প্লিজ রাগ করিস না। আমরা চেয়েছি সবাই একসাথে তোকে সারপ্রাইজ দিবো।

— হ্যাপি বার্থডে আপু।

কলেজ পড়ুয়া বয়সী একটা মেয়ে এগিয়ে এসে আমার দিকে গোলাপ ফুল এগিয়ে দিয়ে বার্থডে উইশ করলো। আমি হাত বাড়িয়ে ফুলটা নিয়ে মিষ্টি হেসে বললাম,

— শুকরিয়া আপু। কিন্তু তোমাকে তো চিনতে পারলাম না।

ইমরান হাশমি ভাইয়া জোরে চিৎকার করে বললো,
— উনি আমাদের শাহেদের গার্লফ্রেন্ড। ওর নাম মোহনা।

আমি বিস্মিত চোখে বললাম,
— শাহেদ ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ডও আছে?

রায়হান ভাইয়া টিটকারির সুরে বললো,
— সে তো কবের থেকেই। শুধু আমরাই সিঙ্গেল রইলাম। বাকি সব মেয়ে পটিয়ে বিয়েও করে ফেলছে।

আমি মুখ শুকনো করে বললাম,
— আমি শাহেদ ভাইয়াকে এসব থেকে দূরে ভাবছিলাম। আর উনি একটা পিচ্চি মেয়েকে পটিয়ে ফেলছে। জিও শাহেদ ভাইয়া জিও।

আমি মোহনাকে ডেকে আমার পাশে বসালাম। হাসিমুখে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে এটা সেটা জিজ্ঞেস করতে লাগলাম।

— কেমন আছো মোহনা?

—এই তো আপু ভালো আছি তুমি।

— আলহামদুলিল্লাহ এখন অনেক ভালো আছি।

— তোমার সারপ্রাইজটা কিন্তু দারুণ হয়েছে আপু।

— হ্যাঁ, তাতো অবশ্যই। তোমার নাম ও আমার এক চাচাতো ভাইয়ের বউয়ের নাম এক। ঐ ভাবীর নামও মোহনা।

— ওহ আচ্ছা।

— কোন ক্লাশে পড়ো?

— ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার।

— ওহ্ তাহলে আমাদের ছোট।

— হ্যাঁ আপু।

আমরা দুজন কথা বলছি।বাকিসব কেক ডেকোরেশন করছে। কেকের ওপরের ফুল নষ্ট হয়ে গেছে। তা নিয়ে ওদের মধ্যে চেচামেচি। সবার একটা কথা ফুল নষ্ট হলো কি করে? রওনক আমার সামনে এসে মাথা চুলকে লাজুক ভঙ্গিতে বললো,

— ভাবী, চুড়ির বক্সটা কি তোমার কাছে?

আমি মোহনার সাথে কথা বলা থামিয়ে রওনকের দিকে শান্ত দৃষ্টি দিয়ে বললাম,

— কোন চুড়ির বক্স?

— সকালে যে তোমাদের বাসার দরজার সামনে রেখে গিয়েছিলাম। গিফট পেপারে পেঁচানো ছিলো। তন্বীকে জিজ্ঞেস করলাম তন্বী বললো ও পায়নি। তাহলে নিশ্চয়ই তুমি পেয়েছো।

আমি কিছু সময় ভাবতেই চুড়ির বক্সের কথা মনে পরে গেলো। আমি চোখ গোল গোল করে বললাম,

— ঐটা আপনি রেখেছিলেন?

— হুম, আমি ভেবেছিলাম আজ তন্বীর জন্মদিন। তাই ওর জন্য গিফট পাঠিয়ে ছিলাম। ওর তো চুড়ি খুব পছন্দ তাই। পরে তায়াং ভাইয়ার থেকে শুনলাম আজ তোমার জন্মদিন আর আগামী মাসের ১৫ তারিখে তন্বীর।

— আমি আরো টেনশনে পরে গিয়েছিলাম বেনামি গিফট বক্সটা কে পাঠালো? তাও আমার অপছন্দের জিনিস। কিন্তু “নয় নাম্বার বিপদ সংকেত” শব্দটা কেন লিখছেন?

— সবসময় তোমার বোন আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ায়। এবার ওকে আমার খাঁচায় বন্দী করবো। তাই বিপদ সংকেত পাঠিয়েছি।

— আপনি তন্বীকে ভালোবাসেন তাই না?

— হুম অনেক। কিন্তু তোমার বোন বুঝে না।

— সোজা বিয়ে করে ফেলেন।

— তাই করবো৷ এর জন্য তো নয় নাম্বার বিপদ সংকেত লিখে পাঠিয়েছি।

— সমস্যা নেই গিফট বক্সটা আমার কাছে। আমি ওকে দিয়ে দিবো।

— ঠিক আছে।

তায়াং ভাইয়া রওনককে ডেকে বললো,
— শাঁকচুন্নিকে সাথে নিয়ে আয়। এবার কেক কাটি।

💖💖💖

আমি গুটি গুটি পায়ে ট্রলারের মাঝে চলে গেলাম। এনাজ আমার দিকে প্লাস্টিকের ছুরি এগিয়ে দিলো।আমার হাতের ওপর এনাজ হাত রাখলো। আমি কেক কেটে প্রথম টুকরোটা এনাজকে খাইয়ে দিলাম। এনাজ আমার হাত থেকে বাকি অংশটুকু নিয়ে আমার মুখে পুরে দিলো। একে একে সবাইকে খাইয়ে দিলাম। আবিরের সামনে যেতেই আবির মুখ কুচোমুচো করে বললো,

— তুমি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ো না। আমার ভয় করে।

তার কথা শুনে ফিক করে হেসে উঠলাম। তার দিকে কেকের টুকরো এগিয়ে দিতেই ভয় পাওয়ার ভান করে মুখে নিলো। রায়হান ভাইয়া শুরু করলো ক্রিম মাখামাখি। একেকজনের মুখ ক্রিমে ভর্তি। সবাই রায়হান ভাইয়াকে বকা শুরু করলো।এনাজ সবাইকে থামিয়ে দিয়ে আমার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পরলো। সবার নজর এখন তার দিকে। এনাজ কি করতে চাইছে তা আমারও বোধগম্য নয়। এনাজের দেখাদেখি তওহিদ ভাইয়া শারমিনের সামনে, রওনক তন্বীর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পরলো। আমরা মেয়ে তিনজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে তাকালাম।তিনজনের চোখে,মুখে বিস্ময়। এনাজ পকেট থেকে একটা ছোট বক্স বের করলো। বক্সটা খুলে একটা স্বর্ণের আংটি বের করে আমার হাতে পরিয়ে দিয়ে বললো,

— জন্মদিন উপলক্ষে আমার তরফ থেকে এই ছোট্ট উপহার তোমার জন্য।

আমার জন্য আরেকটা সারপ্রাইজ।আমি এক হাতে মুখ ঢেকে বিস্মিত চোখে বললাম,

— এটা ছোট উপহার! এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া এনজিও সংস্থা। আমার জীবনের বেস্ট মোমেন্ট এগুলো। এতবড় সারপ্রাইজ আমি জীবনেও পাইনি।

এনাজকে দাঁড় করিয়ে সবার সামনে জড়িয়ে ধরলাম। চোখ দিয়ে পানি পরছে আমার। ইমরান হাশমি ভাইয়া আফসোসের গলায় বললো,

— ভাই, এবার ছাড়। সিঙ্গেল ছেলেগুলোর বুকে আর কত আগুন ধরাবি তোরা? বুকটা ফাইট্টা যায়। আজ একটা গার্লফ্রেন্ড নেই বলে, তোরা এমন করতে পারিস না।

আমি লজ্জা পেয়ে এনাজকে ছেড়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম। আবেগে ভুলেই গিয়েছিলাম এখানে মানুষ আছে। তওহিদ ভাইয়া ও রওনক হিরোর স্টাইলে পকেট থেকে রিং বের করে সমস্বরে বললো,

— উইল ইউ ম্যারি মি?

তন্বী একবার আমার দিকে তাকায় আরেকবার তায়াং ভাইয়ার দিকে। বোঝায় যাচ্ছে বেচারী অনেক ভয় পাচ্ছে। শারমিন দুই হাতে মুখ ঢেকে রেখেছে।লজ্জায় নাকি ভয়ে তা বুঝতে পারছি না। তায়াং ভাইয়া তন্বীকে আশ্বস্ত গলায় বললো,

— আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। রওনককে আমি অনেক আগের থেকে চিনি। তোর যদি ওকে পছন্দ হয় তাহলে হ্যাঁ বলে দে। পছন্দ না হলে না বলে দিস। আমি কিছু বলবো না। শারমিন তোমাকেও এক কথাই বলি। তওহিদও ভালো ছেলে। আমার প্রত্যেকটা বন্ধু ছেলে হিসেবে বেস্ট। এটা আমি চোখ বন্ধ করে বলতে পারি। এবার কি ডিসিশন নিবে তা তোমরাই ভাবো।

আমিও ওদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
— সারাজীবন তোরা সংসার করবি। আমরা নই। তাদের তোদের মনের কথাটাই বলে দে।

সবাই একসাথে চেচিয়ে বলছে, “সে ইয়েস”। এখন দেখার বিষয় ওরা কি বলে।একসময় সবার উৎকন্ঠা শেষ করে ওরা দুজন ইয়েস বলে হাত এগিয়ে দিলো। রওনক, তওহিদ ভাইয়া খুশিতে আংটি পরিয়ে দিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো। সবাই হৈ-হুল্লোড় করে হো করে চেচিয়ে উঠলাম। আমি ও তন্বী এগিয়ে গিয়ে তায়াং ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলাম। ভাইয়া দুই হাতে আমাদেরকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। তার চোখে পানি। এনাজ এগিয়ে এসে ভাইয়ার পিঠে চাপর মেরে বললো,

— কাঁদিস না। আজ তো তোর আনন্দের দিন।

রওনকের হাতে তন্বীকে আর এনাজের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে ভাইয়া কান্না জড়ানো কন্ঠে বললো,

— আমার দুই বোনকে আমি তোদের হাতে তুলে দিলাম। এদেরকে এখন আগলে রাখার দায়িত্ব তোদের।

আমি মন খারাপ করে ভাইয়াকে বললাম,
— ভাইয়া নূর আপিকে নিয়ে আসতি। সবাই ছিলো শুধু আপি ছাড়া। আপিকে অনেক মিস করছি আমি।

ভাইয়া বললো,
— আমি জানলাম সকালে এতকিছু। এর আগে এনাজ কিডন্যাপের প্ল্যানটা আমাকে বলেছিলো। কিন্তু খেয়াল ছিলো না। এদিকে সব জোগাড় করতে গিয়ে আর সময় হলো না। নয়তো ওকে নিয়ে আসতাম।

হঠাৎ ঘড়ির কথা মনে হতেই আমি মুখ কুচোমুচো করে এনাজকে বললাম,

—আপনার জন্যও আমার পক্ষ থেকে একটা উপহার আছে। আমার ব্যাগ কোথায়?

এনাজ তায়াং ভাইয়াকে ডেকে বললো,
— ওর ব্যাগ কোথায়?

তায়াং ভাইয়া বললো,
— ছাউনির নিচের মাচায়।

এনাজ দৌড়ে গিয়ে সেখান থেকে আমার ব্যাগ নিয়ে এলো। আমি ব্যাগ থেকে গিফট পেপারে পেঁচানো ঘড়ির বক্সটা বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিলাম। সে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

— কি এটা?

— খুলে দেখুন। আচ্ছা এই ট্রলার কোথায় যাবে?

এনাজ গিফট পেপারে ছিঁড়ে বাক্সটা খুলতে খুলতে বললো,
— কোথাও না।

— বুঝলাম না।

— আমরা এই নদীতেই ঘুরবো। সেদিন তো নৌকা চালাতে পারি নি বলে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে পারিনি। তাই আজ ট্রলার ভাড়া করেছি। আর সকল সারপ্রাইজ প্ল্যান এখানে করেছি।

এনাজ বক্সটা খুললো।মুখে তার এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে। চোখ দুটো রসগোল্লা করে আমাকে বললো,

— এটা আমার জন্য?

— জ্বী। পছন্দ হয়েছে?

— হুম অনেক।নাও হাতে পরিয়ে দাও।

আমি ঘড়ি বের করে তার হাতে পরিয়ে দিলাম।এনাজ ঘড়িটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তার পছন্দ হয়েছে। যাক, আমি স্বার্থক। আমার পছন্দ তার পছন্দ হয়েছে বলে। এসব কিছু রায়হান ভাইয়া ভিডিও করে নিলো।এত সুন্দর মুহুর্তগুলোকে ক্যামেরাবন্দী না করা মানেই বোকামী।শাহেদ ভাইয়া সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— এবার খাবারের পালা শুরু করা যাক। দুপুর তো গড়িয়ে গেছে সেই কবে। পেটে ইদুর দৌড়াচ্ছে।

তায়াং ভাইয়া বললো,
— হ্যাঁ, এখন সবাই একসাথে খেয়ে নেই।

এনাজ আমার পাশ থেকে তাদের সামনে গিয়ে বললো,
— চল এবার খাওয়া-দাওয়ার পর্বটা শেষ করি।

তওহিদ ভাইয়া বললো,
— হাতে হাতে সবাই মিলে সার্ভ করবো। তাহলে তাড়াতাড়ি হবে।

চুপচাপ আমরা গোল হয়ে বসলাম। বিকেলবেলায় আমরা দুপুরে খাবার খাবো। একসাথে হৈচৈ করে চলন্ত ট্রলারে খাবার খেয়ে নিলাম। তারপর সবাই একসাথে বসে রুমাল লুকানো খেললাম। সাথে গানের কলি। আমার ইমরান ভাইয়ার সাথে গান গাইতে হয়েছিলো। ইমরান ভাইয়া গান গাওয়ার থেকে মজা বেশি করেছে। অনেক মজা, হৈ-হুল্লোড় করে সন্ধ্যায় আমাদের ট্রলার নদীর কিনারে থামলো। এবার পালা বাসায় ফিরে যাওয়ার।

আজকের বার্থডে আমার জীবনের স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতে আমার নাতি-নাতনিদের গল্প শুনাবো। তাদের নানা/দাদা আমাকে কিডন্যাপ করে বার্থডে সারপ্রাইজ দিয়েছে। যাওয়ার সময় মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সময় যে এতটা দ্রুত চলে যাবে ভাবতেই পারিনি। বাইকে এনাজকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে স্মৃতিগুলো নিয়ে বাসার দিকে যাচ্ছি। একটা বিকেল আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগলো। কখনও ভাবিনি আমার জন্মদিনটা এতটা আকর্ষণীয় হবে। সাথে এত সারপ্রাইজে ভরপুর। বা হাতের সামনে এনে অনামিকা আঙুলে থাকা আংটিতে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। তারপর আবার এনাজকে জড়িয়ে ধরে পিঠে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_64
#Writer_NOVA

সকালের নামাজ পরে আর ঘুমায়নি। আজ বাসায় চলে যাবো। আর কখনো খালামণিদের বাসায় আসা হবে না। ঝগড়া করা হবে না তায়াং ভাইয়ার সাথে। তন্বীর সাথে মশারী টানানো নিয়ে মন খারাপ করতে হবে না। অর্ধেকের বেশি গুছিয়ে নিবো। বাকিগুলো বিয়ের পর এসে নিয়ে যাবো। তায়াং ভাইয়া, তন্বী, খালামণির মনটা ভার। সবার চোখ লাল হয়ে আছে। নিশ্চয়ই কান্না করেছে। আমারও ভীষণ খারাপ লাগছে। তবে তাদের সামনে কান্না করা যাবে না। তাহলে তারা আরো ভেঙে পরবে। একটা বছরে মনে হচ্ছে কত যুগ ধরে তাদের সাথে আছি। ওয়াশরুম থেকে একদফা কান্না করে বের হলাম। এনাজকে তন্বীর শিয়রের কাছে বসে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,

— কি করছেন এখানে?

এনাজ আমার কন্ঠস্বর পেয়ে চমকে উঠলো।হাতে থাকা ছোট কাগজাও লুকিয়ে ফেললো। একবার আমার দিকে তাকিয়ে আরেকবার কম্বল মুড়ি দিয়ে খাটে শুয়ে থাকা তন্বীর দিকে তাকালো। তারপর বিস্মিত চোখে বললো,

— তুমি এখানে তাহলে এটা কি তন্বী?

— জ্বি হ্যাঁ।

এনাজ জিহ্বায় কামড় দিয়ে অপরাধী গলায় বললো,
— আমি ভেবেছিলাম এটা তুমি। ভাগ্যিস কিছু করিনি। তাহলে কি একটা বাজে পরিস্থিতি হয়ে যেতো। আল্লাহ তুমি বাচিয়েছো।

এনাজের কথা শুনে আমি মুচকি হেসে বললাম,
— হঠাৎ এখানে কেন?

— সপ্তাহখানেক তোমাকে দেখতে পাবো না। তাই দেখা করতে চলে এলাম।

— কফির মগের সাথে কি রাখলেন?

— কোথায়?

— আমি কিন্তু দেখেছি। জলদী দেন।

— দেখেই যখন ফেলেছেন তাহলে আর লুকিয়ে কি লাভ। এই নাও।

গোলাপি রঙের একটা ছোট চিরকুট আমাকে এগিয়ে দিলো। সেখানে নিম্নোক্ত লেখাগুলো ছিলো।

❝ভোরের শিশির মন ছুঁয়ে যায়,
আদরে মেখেছে সবুজ ঘাস।
ভোরের স্নিগ্ধতা মুগ্ধ করেছে,
রোদ্দুরে ছুঁয়েছে নীল আকাশ।❞

আমি লেখাগুলো পড়ে কাগজ হাতে এনাজের দিকে খুশিমনে তাকালাম। তারপর তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

— এতদিন চিরকুটগুলো আপনি দিয়েছেন তাই না?

— এই রে ধরা পরে গেলাম।

— আপনাকে আমি বহু আগেই ধরে ফেলেছি। শুধু হাতেনাতে ধরার অপেক্ষায় ছিলাম। আপনি যেদিন বাসায় আসতেন সেদিনই আমার রুমে কফির মগ ও ছোট চিরকুট পেতাম। তাই আমার প্রথমে আপনাকেই সন্দেহ হয়েছে। তাছাড়া মিলনায়তনের দিন আকাশি রঙের শাড়িটাও আপনি দিয়েছেন তাও আমি জানি।

— কি করে জানলে?

— দ্যাটস সিক্রেট।

— তুমি অনেক রহস্য রেখে কথা বলো।

— ভালো লাগে।

— কখন রওনা দিবে?

— সাড়ে সাতটার দিকে।

— আমার কাছে মনে হচ্ছে সাত বছর তোমাকে দেখতে পারবো না।

— সবুর করুন এনজিও সংস্থা। সাতদিন পর আপনার ঘরে থাকবো। তখন যত ইচ্ছে দেখে নিয়েন।

— নো প্রবলেম। ভিডিও কল আছে কি করতে?

— হ্যাঁ, তাও ঠিক।

— চলুন ছাদে যাই।

— হুম চলো।

দুজন কফির মগ হাতে নিয়ে ছাদে চলে গেলাম। কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাইরের ব্যস্ত কোলাহলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এনাজ নিচুস্বরে বললো

— আজ গ্রামে থাকলে শিশির ভেজা রোদ্দুর উপভোগ করা যেতো।

— হুম।

— মন খারাপ?

— না তো।

— আমার তো মনে হচ্ছে।

— এক বছরে সবকিছু কতটা আপন হয়ে গিয়েছিল। আজ সব ছেড়ে চলে যাবো তাই একটু খারাপ লাগছে।

— কি বলে সান্ত্বনা দিবো তা আমার জানা নেই। তাই কিছু বললাম না।

আমি বিশাল এক দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কফির মগে চুমুক দিলাম। এনাজ ইচ্ছে করে আমার সাথে দাঁড়িয়ে সুরৎ করে কফিতে চুমুক দিলো। আমি চোখ গোল করে তার দিকে তাকাতেই দুজন ফিক করে হেসে উঠলাম। তারপর আবার নীরবতা। এনাজ জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে ছাদের রেলিঙের সাথে দাঁড়িয়ে আমার দিক ফিরে হেলান দিলো। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,

— তুমি একবার আমাকে ভালোবাসার সঙ্গা দিয়েছিলে। মনে আছে তোমার? সেদিন ছিলো বৃষ্টির দিন। আমি তোমাকে আনতে গিয়েছিলাম।

— হ্যাঁ, মনে আছে।

— তুমি ভালোবাসাকে তুলনা করেছিলে একটা রাবার ব্যান্ডের সাথে। “ভালোবাসা হলো একটা রাবার ব্যান্ডের মতো।যার দুপাশে দুজন ধরে থাকে।যদি কেউ একজন একপাশ থেকে ছেড়ে দেয় তাহলে অবশ্যই অপরপাশের জন আঘাত পাবে।যাকে আপনি ভালোবেসেছেন তাকে আঘাত দেয়া আর নিজের সাথে প্রতারণা করা দুটোই সমান।” এটাই তো ছিলো তাই না?

— হুম এটাই ছিলো।হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?

— এমনি মনে হলো। আমি প্রথমে তোমার এই কথাটা শুনে হেসেছিলাম।

— হ্যাঁ, আমি কারণ জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন কিছু না। তারপর আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।

— তখন কথাটা আমার বিশ্বাস হয়নি। তাই হেসেছিলাম। কিন্তু তায়াং-এর সাথে যখন তোমার বিয়ে প্রায় হয়ে যাবে, যাবে ভাব। তখন তোমার ভালোবাসার সঙ্গাটা আমি বাস্তবে উপলব্ধি করতে পেরেছি। কারণ তখন আমি সেই পরিস্থিতিতে পরেছিলাম। এর আগে কিন্তু আমার কাছে ভালোবাসার উদাহরণ অন্য ভাবে ছিলো।

— ভালোবাসার বিবরণ অনেকভাবে দেওয়া যায়। তা আপনারটা কি ছিলো।

—❝ভালোবাসা হচ্ছে এক ধরনের পাগলামি। এখানে ঢুকে গেলে হারাতে চাইলেও হারানো যায় না।ফিরাতে চাইলেও ফিরানো যায় না।❞

— একদম ঠিক।খুব সুন্দর কথা।

— এখনও আমি এটা মানি। কিন্তু তোমার ভালোবাসার সঙ্গাটাও আমি উপলব্ধি করে বুঝতে পেরেছি।

আমি তার চোখের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললাম। উনি এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ পেছন থেকে ইফাতের গলা পেয়ে সামনের দিকে ঘুরলাম।

— নুবা, তোমার বলে বিয়ে🥺?

ওকে আজকাল দেখা যায় না।মাস খানিক আগে ওর একটা বোন হয়েছে। অবসর সময়ে দুই ভাই বোনকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমাকে কোন বিরক্ত করে না।ইফাত প্রশ্নবোধক চিহ্ন কপালে একে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ বুঝালাম। ইফাত সামনে এগিয়ে এসে ছলছল নয়নে বললো,

— তুমি আমারে একটুও ভালোবাসো না। তুমি আমাকে ভালোবাসলে এই বিয়েটা করতে পারতা না।

— এদিকে আয় আমার কথা শোন।

আমি হাত বাড়িয়ে ইফাতকে ডাকলাম। ইফাত নাক টেনে চোখের পানি মুছে বললো,

— কোন কথা শুনবো না তোমার। তুমি এই ভাইয়াকে বিয়ে করছো। কারণ তুমি এই ভাইয়াকে ভালোবাসো। আমাকে কারো ভালোবাসতে হবে না।

দৌড়ে ছাদের থেকে চলে গেলো। আমি ও এনাজ একে অপরের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম। ইস, ওদের সাথে কত সময় কাটিয়েছি। এদেরও খুব মিস করবো। চোখ দুটো টলমল করে উঠলো। এনাজ এগিয়ে এসে চোখের পানি মুছে দিতেই তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পরলাম আমি।

💖💖💖

ম্যাসেজের টুং শব্দে অতীতের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলাম।এতখন সপ্তাহখানেক আগের ভাবনায় বিভোর ছিলাম।সারা বাড়িতে হৈ-হুল্লোড়। কিন্তু আমার মনটা বিষাদে ভরে আছে। দেখতে দেখতে দেড় মাস কেটে গেলো। আজ আমার হলুদ সন্ধ্যা। অথচ আমার মাঝে কোন আনন্দ নেই। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। বিয়েটা তো আমার ভালোবাসার মানুষের সাথে হচ্ছে। তাহলে এতো খারাপ লাগছে কেন? সবাইকে ছেড়ে চলে যাবো বলে কি? ছাদে একা দাঁড়িয়ে আছি। পূর্ব দিগন্তে সূর্য মামা তার লাল আভা নিয়ে উদিত হচ্ছে। গায়ে একটা শাল জড়ানো থাকা সত্বেও ভালোই শীত করছে।ঘাসের মধ্যে শিশির বিন্দুগুলো মুক্ত দানার মতো চিকচিক করছে। আজকের সকালটাকেও শিশির ভেজা রোদ্দুর বলা যায়। কথাটা মাথায় আসতেই ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। এতখন ডুবে ছিলাম সপ্তাহখানেক আগের অতীতে। যেদিন বাসায় আসবো সেদিনের ঘটনা এগুলো। সেই রেশ কাটলো ম্যাসেজের শব্দে।

মোবাইল ওপেন করতেই দেখলাম এনাজ দুই মিনিটের একটা ভিডিও পাঠিয়েছে। ভিডিও ওপেন করতেই আমার চোখ ছানাবড়া। এই ভিডিও সে পেলো কোথা থেকে? নিশ্চয়ই তায়াং ভাইয়ার কাজ। একদিন জামার ভেদ করে পিঠের মধ্যে কিভাবে জানি একটা টিডি পোকা ঢুকে পরেছিলো। আমি সেটা বের করার জন্য লাফাচ্ছিলাম আর বলছিলাম টিডি পোকা, টিডি পোকা। সেটা সুযোগ বুঝে তায়াং ভাইয়া ভিডিও করে নিয়েছিলো। টিডি পোকা হলো ছোট কালো চ্যাপ্টা জাতীয় এক ধরণের পোকা। যেটা অনেক লাফায়। এই পোকার কাজই হলো সারাক্ষণ লাফানো।আমি কতগুলো এংরি রিয়েক্ট দিয়ে তাকে ম্যাসেজে জিজ্ঞেস করলাম,

— এটা কোথা থেকে পেয়েছেন?

— বলবো না।

—জলদী বলুন।

— মোবাইলের প্রাইভেট ফাইল ঘাটছিলাম। তখন সামনে এটা পেলাম। তাই তোমাকে পাঠিয়ে দিলাম।

— তায়াং ভাইয়া দিয়েছে তাই না?

— হুম।

— কবে দিয়েছে?

— বছর খানিক আগে।

— ডিলিট করেন।

— করবো না।

— ভালো হবে না কিন্তু।

— না হোক।

— এবার কিন্তু বেশি হচ্ছে।

অপরপাশ থেকে ম্যাসেজ এখনো সিন হয়নি। তায়াং ভাইয়াকে আগে আলুভর্তা করবো। আমি পিঠে হাত দিয়ে লাফাচ্ছিলাম সেটা ওকে দেওয়ার কি দরকার ছিলো। অবশ্য এখন আর রাগারাগি করার কি দরকার? সে তো আমার জামাই।তার কাছে থাকলে কোন সমস্যা নেই। সে ম্যাসেজ সিন করলো। টাইপিং- এ আছে। সে লিখলো,

— এই ভিডিওটার দেখেই তোমার নাম আমি টিডি পোকা রেখেছি।

— আমাকে উদ্ধার করে ফেলছেন।

— তুমি তো বাস্তবেও টিডি পোকার মতো লাফাও।

— কে বলছে আপনাকে?

— আমি তো দেখছি।

— আমাকে রাগানোর ধান্দায় আছেন?

— হুম অনেক।

— কথা নেই আপনার সাথে।

— কথা না বলে যাবে কোথায়?

— হু কালকে নিতে আসলে যাবো না তো আমি।

— কোলে করে নিয়ে যাবো।

— আমি গেলে তো নিয়ে যাবেন।

— তোমাকে জাপ্টে ধরে কোলে নিয়ে দৌড় দিবো। তারপর দেখবো তুমি কিভাবে আমার থেকে পালাও।

— ওয়েট তায়াং ভাইয়া কল দিচ্ছে। তার সাথে একটু কথা বলে নেই।

— ওকে।

এনাজের ম্যাসেজ সিন করে তায়াং ভাইয়ার কল রিসিভ করলাম। ভাইয়াকে বড় করে একটা সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম। তায়াং ভাইয়া আক্ষেপের সুরে বললো,

— আমি আসতে পারবো না বলে মন খারাপ করিস না। এনাজের দিকও তো আমাকে দেখতে হবে। যেহেতু তোদের বিয়ের রিস্ক আমি। আম্মুও আসবে না। সে তো ছেলের মা হিসেবে আছে। এখানে না থাকলে বিষয়টা খারাপ দেখায়। তুই মন খারাপ করিস না। আগামীকাল তোর জামাইয়ের সাথে বরযাত্রী হিসেবে চলে আসবো। হাতের কব্জি ডুবিয়ে খেতে হবে তো।

— থাক, সমস্যা নেই। তবে হলুদে তুই এলে খুব খুশি হতাম। আমার তো আর আপন ভাই নেই। তুই থাকলে মনে হতো আমার নিজের ভাই আছে।

— দুইপক্ষের মানুষ হলে এই একটা জ্বালা। এইদিকে গেলে ঐদিকের মানুষ মন খারাপ করে। ঐদিকে গেলে এদিকের মানুষ মন খারাপ করে। আমি কোন দিকে যাবো বল তো?

ভাইয়া আফসোস করে কথাগুলো বললো। তায়াং ভাইয়া ও খালামণি বর্তমানে ছেলেপক্ষের লোক। তন্বীকে পাঠিয়ে দিয়েছে আমাদের বাড়িতে। ভাইয়া, খালামণি আমার হলুদে থাকবে না তাতে আমারও খারাপ লাগছে। কিন্তু এনাজের দিকটাও আমার বিবেচনা করতে হবে। তাই আমি ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

— তুই ঐদিকে থাক। এদিক সামলানোর জন্য অনেক মানুষ আছে। কিন্তু ঐদিকটা সামলানোর জন্য তোর থাকা প্রয়োজন। আর শোন, তওহিদ ভাইয়াকে বলিস বিকালের মধ্যে শারমিনকে যেন দিয়ে যায়। আর শাহেদ ভাইয়াকে বলিস বিয়ের দিন মোহনাকে নিয়ে আসতে।

—আচ্ছা, আমি বলে দিবো। তন্বী কোথায়?

— ঘুমে দেখেছিলাম। এখন কি করছে জানি না। রওনক কি তোদের সাথে?

— হু সব একসাথে আমরা। বিকেলে এনাম,তওহিদ ওরা আসবে।

— কেন?

— তোর হলুদের জিনিসপত্র দিয়ে যেতে। সাথে বিয়ের জিনিসপত্রও দিয়ে যাবে। যাতে আগামীকাল কোন দেরী না হয়। অনেক সময় তো দেখা যায় বরপক্ষ আসতে দেরী হওয়ায় শাড়ি,গহনার কারণে মেয়ের সাজ কমপ্লিট হয় না তাই আরকি।

— আগামীকাল শুক্রবার। কোন সমস্যা হওয়ার তো কথা নয়।

— সাবধানের মার নেই। তাই আগে আগে জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিবো।

— আচ্ছা তাহলে তাদের সাথে শারমিনকে পাঠিয়ে দিস। মোহনাকে তো আনতে পারবি না। তাই ওর কথা বললাম না। তবে আগামীকাল মোহনাকে আনতেই হবে।

— ওকে এখন বেরুতে হবে। শাহবাগ যাবো ফুল কিনতে। আমরা বন্ধুরা মিলে ছাদে স্টেজ করে এনাজকে হলুদ ছোঁয়াবো।

— ভিডিও কল দিয়ে দেখাস।

— এত শখ কেন? যা ভাগ।

— আমার জামাইয়ের হলুদ ছোঁয়ানো আমি দেখবো তোর কি?

— তোকে দেখতে দিবো না। আগামীকাল মন ভরে দেখে নিস। ওকে ফোন রাখ।

— আল্লাহ হাফেজ।

শারমিন ও তওহিদ ভাইয়ার বিয়ে ঠিক। জানুয়ারিতে ভাইয়ার এক মামা আসবে। তখন বড় করে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শারমিনকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। রওনক ও তন্বীর বিয়ের কথা চলছে। এখনো পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে আশা করা যাচ্ছে মাস দুইয়ের মধ্যে এদের বিয়েও হয়ে যাবে। আমি কল কেটে দূরের আলু খেতের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কচি সবুজ রঙের আলুপাতায় সারা খেত ভরপুর। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ।

— বোইনে আম্মু তোমাকে ডাকে।

আলু খেত থেকে চোখ সরিয়ে ইভার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় বললাম,

— তুই যা, আমি আসছি।

ইভা দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। আমি একবার সবুজ খেতের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীর পায়ে নিচে চলে গেলাম। বারবার কানে একটা কথা বারি খাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ ফিসফিস করে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলছে, “আজ তোর হলুদ সন্ধ্যা নোভা। আগামীকাল তোর এই বাড়িতে শেষ দিন। তুই সবকিছু ছেড়ে নতুন জীবনে পা রাখবি।” হ্যাঁ, সত্যি তো তাই। আমি সিঁড়ি বেয়ে যেতে যেতে কয়েক লাইন মনে মনে আওড়ালাম,

“মেয়ে হয়ে জন্মেছি যখন,
পরের ঘর তো করতে হবে এখন।
মন যে কিছুই মানছে না,
ইচ্ছে করছে, ছেড়ে যেতে না।
তবু,মানতে না চাইলেও মানতে হবে,
সব ছেড়ে আমায় যেতেই হবে।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here