শূন্যতায় পূর্ণতা পর্ব – ০১+২

★আচমকা ব্রেক কষলো আরশ। আর একটু হলেই এক্সিডেন্ট হয়ে যেত। গাড়ি থামিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। কয়েকজন মেয়ে গাড়ির সামনে এসে গিয়েছিলো। আরশ গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই একটি মেয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। গায়ে কলেজ ইউনিফর্ম দেখে আরশের বুঝতে বাকি রইলো না মেয়েটি স্টুডেন্ট। মেয়েটি আরশ কে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। আরশের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল-

“-একি! আপনার হাত থেকে তো রক্ত পড়ছে।

আরশ নিজের হাতের দিকে তাকালো। ব্যান্ডেজ মোড়ানো হাতটা থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। রাগের মাথায় দেওয়ালে ঘুষি দেওয়াতে হয়তো হাতের ক্ষত তে আবারো চাপ পরেছে। আরশ কিছু বলার আগেই মেয়েটি আরশের হাত ধরে নিজের রুমাল বের করে বেধে দিলো। আর বলল-

“-রুমালটা অনেক্ষণ কভার দিবে। দেরী না করে আশে পাশের কোনো হাসপাতাল বা ফার্মেসী তে যান।

আরশ চুপ করে রইল। মেয়েটি আরশের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল-

“-শুনেছেন? কি বলেছি আমি?
“-হ্যাঁ।
মেয়েটি গাড়ির দিকে তাকিয়ে বলল-
-আপনার গাড়িতে তো ড্রাইভার নেই! এই হাত নিয়ে কেন গাড়ি চালাচ্ছিলেন? এই ব্যাথা যুক্ত হাতে গাড়ি চালাতে গিয়েই এক্সিডেন্ট করতে যাচ্ছিলেন। আর একটু হলেই তো গাড়িটা আমার উপর উঠিয়ে দিতেন।
আরশ চুপ করে রইলো। মেয়েটি বলল –
“-দাঁড়িয়ে না থেকে যান। বেশিক্ষণ থাকলে ইনফেকশন হতে পারে। রক্তে ভেজা ব্যান্ডেজ নিয়ে বেশিক্ষণ থাকবেন না। আর হ্যাঁ দেখে শুনে গাড়ি চালাবেন। আমি মাফ করলেও অন্য কেউ কিন্তু মাফ করবেনা।

কথা শেষ করেই মেয়েটি হাটা দিলো। আরশ মাটির দিকে তাকাতেই দেখলো মাটিতে একটা সিলেবাস পড়ে আছে। মাটি থেকে সিলেবাসটি তুলে আরশ চোখের সামনে ধরলো। রুমাল বের করতেই হয়তো সিলেবাসটি পড়ে গেছে৷ আরশ গাড়িতে বসলো। দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো।

★পড়তে বসে সিলেবাস না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠলো ফারহিন। বান্ধবীকে ফোন করলো ভুলে তার ব্যাগে চলে গেল নাকি কিন্তু না সেখানেও নিরাশ হলো। সিলেবাস না পেয়ে মুখটা গোমড়া করে বসে রইল ফারহিন। মা এসে পাশে বসতেই ফারহিন বলল-

“-সিলেবাসটা পাচ্ছি না মা।
“-ব্যাগে দেখো, শেল্ফে দেখো।
“-নেই মা। আমি পুরো খুঁজেছি নেই কোথাও। হয়তো পড়ে গেছে কোথাও।
“-আচ্ছা কালকে একটা নিয়ে নিয়ো।
“-দিবেনা মা। তুমিতো জানোই। কলেজের এত কড়া রুলস। এত মাস পর এসে সিলেবাস চাইলে আমাকে ঘাড় ধরেই বের করে দেবে।
“-আচ্ছা কারো কাছ থেকে কপি করে নিও। ঠিক আছে?
“-আচ্ছা।
“-এখন পড়া শেষ করে নাও। আমি কাজ শেষ করে আসছি।
“-ওকে।

হাতে থাকা রুমালটার দিকে তাকিয়ে রইলো আরশ। জীবনে কত রক্ত ঝরিয়েছে হিসেব নেই। কখনো কেউ এত যত্ন করেনি। একটা অচেনা মেয়ের কাছ থেকে হুট করেই এমন আচরণ পাওয়াতে আরশ বুঝতেই পারছেনা কি করবে। ইতিমধ্যে আরশ মেয়েটির নামে অনেক খোঁজ নিয়েছে। মেয়েটির কলেজ, এড্রেস সব জানা। অন্য হাতে থাকা সিলেবাসটির দিকে তাকালো আরশ৷ এই সিলেবাস কি করবে? ফেলে দেবে? নাকি ফেরত দেবে? মেয়েটির সামনে যাওয়া কি উচিত? এসব ভাবতে ভাবতেই রুমের লাইট জ্বলে উঠে। আরশ দ্রুত সোজা হয়ে বসে। আরশের বাবা এসেছে। বাবাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। কাদের শিকদার এগিয়ে এসে সোফায় বসলেন। আরশকে বললেন-

“-তোমার হাতে আবার কি হলো?
“- কিছু না।
“-অফিস কেমন চলছে?
“-ভালোই।
“-ভালো চললে ভালো। আর কোনো সমস্যা হলে জানিও!
“-আমার সমস্যা নাকি অফিসে কোনো সমস্যা?
“-অবশ্যই তোমার। অফিসের সমস্যা কেন হবে?
“-আমি ছাড়া দুনিয়ার সব জিনিসের প্রতিই তোমার খেয়াল থাকে, তাই বলা।
“-তুমি এমন ভিত্তিহীন কথা বলা কবে বন্ধ করবে?
“-ভিত্তিহীন না বাবা।
“-ওকে ফাইন।
বলেই কাদের শিকদার উঠে চলে গেল। যাওয়ার সময় দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। আরশের দিকে ফিরে বলল-

“-হাতের খেয়াল রেখো। কয়েকদিন নিজের রাগটা অন্তত দমিয়ে রাখো। নাহলে ঘায়ের উপর ঘা হবে।
আরশ তাকিয়ে রইলো। তার বাবা কথা শেষ করেই চলে গেল। আরশ বসে পড়লো। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো৷ হাত দুটোতে কাটাছেঁড়ার অভাব নেই। এত এত দাগের মাঝেও নতুন ক্ষতের উদয় হয়।

★অনবরত কলিং বেল বেজেই চলছে। দিদার হাসান বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতেই কাউকে পেল না। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলো দরজায় একটি বিশাল ফুলের তোড়া। ফুলের তোড়া তুলে হাতে নিলো দিদার হাসান। কার্ড টা খুলে দেখলো বড় বড় অক্ষরে লেখা ””good morning farheen”!
ফুলের তোড়া নিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখলো। ফারহিন তাকাতেই দেখলো বাবার হাতে লাল গোলাপের তোড়া। চোখ মুখে উত্তেজিত ভাব। হাসি মুখে প্রশ্ন করলো-
“–কে দিয়েছে বাপি?
“-আমাকে তো কেউ দেয়নি। তবে তোমাকে হয়তো কেউ দিয়েছে।
“-আমাকে? ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো ফারহিন। দ্রুত উঠে এসে হাতে নিলো। কার্ডটিও দেখলো। নাহ্ কোথাও কোনো নাম বা ঠিকানা নেই। ভ্রু কুঁচকে বলল-
“-বাপি হয়তো কেউ প্র‍্যাংক করেছে। ডোন্ট ওয়ারি।
“-তাই যেন হয় ফারহিন।
“-উফফ বাপি ডোন্ট বি সিরিয়াস। কলেজ গেলেই জেনে যাবো কে দিয়েছে।
“-হুম।

প্রেম ভালোবাসার চরম বিরুদ্ধে দিদার হাসান। মেয়েকে এসব থেকে বিরত রাখতে গার্লস স্কুল, গার্লস কলেজেই আজীবন পড়িয়েছে। মেয়ের আশেপাশে কোনো ছেলের ছায়া তিনি সহ্য করেন না। ফারহিন আজ পর্যন্ত কোনো ছেলের দিকে চোখ তুলেও তাকায়নি এই ভয়ে পাছে বাবা জেনে গেলে কেয়ামত হয়ে যাবে। ফুলের তোড়া পেয়ে ফারহিন নিজেও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো৷ কারণ ফ্রেন্ড সার্কেলের কেউ যে এটা দেয়নি তা ও খুব ভালো করেই জানে। তবে এসেছে কোথা থেকে এই তোড়া? তাও ফারহিনের পছন্দের ফুল দিয়ে বানানো। তরতাজা লাল গোলাপ দিয়ে।

ক্লাসে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে ফারহিন। হঠাৎ পিয়ন এলো। পিয়ন এসেই ফারহিন এর নাম ধরে ডাক দিলো। ফারহিনের বান্ধবী ফারহানা এগিয়ে গেল। বলল-
“-কি হয়েছে কাকা?
“-এটা নাও। তোমার জন্য।
উনি ফারহানা কে ফারহিন ভেবে বক্স দিয়ে দিলো। ফারহানা ওটা নিয়ে ফারহিনের কাছে এলো।
“-ফারহিন তোর জন্য!
“-এটা আবার কি?
“-খুলে দেখ না। পিয়ন কাকা দিয়েছে।
“-আচ্ছা ওয়েট।
বক্স খুলতেই দেখলো ফারহিনের সিলেবাস, আর পাশেই এক বক্স চকলেট। আর একটি ঘড়ি। ফারহিন রীতিমতো অবাক হলো। সিলেবাস টা কোথা থেকে এলো? কে দিলো এসব? সিলেবাসের পাতা ওল্টাতেই দেখলো ওখানে লেখা ”this is for you!! Thank you Again and again..”
ফারহিন চরম অবাক হলো। সকালের কার্ডটির সাথে মেলাতেই দেখলো দুটি হাতের লিখাই সেম। তারমানে দুজনই একজন। ফারহিন ফারহানা কে সন্দেহভাজন সুরে বলল-

“-এসব তুই করছিস না তো? দেখ এসব তুই করলে বাদ দে। বাপি কিন্তু আমাকে সন্দেহ করবে।
“-তুই সকাল বেলা ভাং টাং খেয়েছিস না কি? আমি কেন এসব দিতে যাবো? সেই স্কুল লাইফ থেকে আছি তোর সাথে কই জীবনে তো একটা চকলেট ও গিফট দিলাম না তোকে এখন আবার এসব। যত্তসব!!
“-সত্যিই তো! তুই তো কখনো এক গ্লাস পানিও খাওয়াস নি তোর মত কৃপণের কাছ থেকে এসব আশা করাটাই বোকামি। কিন্তু কে করছে এসব? কে দিচ্ছে? আমার সিলেবাস পেলো কোথায়?
“-পিয়ন কাকাকে জিজ্ঞেস কর।
“-আচ্ছা করবো। ব্রেক টাইম আসুক।
“-হুম।

★অফিসে নিজের কেবিনে বসেই আরশ হেসে দিলো। হঠাৎ কেবিনে প্রবেশ করলো তীব্র। আরশ কে হাসতে দেখে তীব্র অবাক হলো। বলল-
“- সিরিয়াসলি? তুই হাসছিস? তা কি কারণে হাসি ফুটলো বলা যাবে কি?
আরশ সোজা হয়ে বসলো। বলল-
“-হাসছিল না।
“-আমি দেখেছি আরশ। বল কেন হাসছিলি?
আরশ চুপ করে রইলো। আরশ কে চুপ থাকতে দেখে তীব্র বলল-
“-প্রেমে টেমে পড়লি নাকি?
ল্যাপটপে চলতে থাকা হাত থেমে গেল আরশের। ধীরগতিতে তীব্রের দিকে তাকালো। প্রেম? প্রেমের কথা তো মাথায় আসেনি আরশের। কঠিন গলায় বলল-
“-প্রেম আর ভালোবাসা কি এক?
“-উহু এক না। প্রেম তো আবেগে হয়। আর ভালোবাসা সেটা তো রুহ থেকে আসে, অন্তর থেকে অন্তর এ গিয়ে ডিরেক্ট আঘাত করে ঘায়েল করে দেয়।
“-হুম।
“-তুই কাউকে ভালোবেসেছিস?
আরশ আবারও থেমে গেল। ল্যাপটপ বন্ধ করে বলল-
“-কফি খাবি?
“-খাওয়া যায়।
“-লেটস গো।
“-কোথায়?
“-আগে চল।

বলেই উঠে হাটা দিলো আরশ। তীব্র চেঁচিয়ে বলল-
“-কথা ঘোরানোর মোক্ষম উপায়।
#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-২||

★দিদার হাসান রোজ সকাল বেলা ছাদে ব্যায়াম করতে বের হয়। ডায়বেটিস থাকায় তিনি নানান রকম ব্যায়াম, হাটাহাটি করেন। খুব ভোরেই উঠে পড়েন। আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না। এক ঘন্টা হাটাহাটি করার পর রেলিংয়ের কিনারায় এসে দাঁড়ালো তিনি। সকালের ঠান্ডা,স্নিগ্ধ বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে বারবার। হঠাৎ গেইটের দিকে তাকাতেই দেখলো গেইটে দারোয়ান নেই। হয়তো এখনো ওঠেনি। দিদার হাসান বাসায় আসার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই থেমে গেল। পেছনে ফিরে বাগানের দিকটায় তাকালো। লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে কিছু একটা লেখা। রেলিংয়ের আরো কাছে যেতেই পুরো লেখাটা দেখতে পেল। শক্ত হলো চোয়াল। হাতের মুঠোয় থাকা টাওয়াল শক্ত করে চেপে ধরলো। ত্রস্তপদে ছাদ ত্যাগ করলো। স্বামীর চেহারা স্পষ্ট রাগের আভা দেখে সালমা হাসান পেছনে পেছনে গেল। দিদার হাসান সোজা ফারহিনের রুমে প্রবেশ করলো। ফারহিন ঘুম। গভীত ঘুমে আচ্ছন্ন। মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেলেন। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই পেছনে সালমা গিয়েও দাঁড়ালো। সালমা কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। বারান্দার ঠিক নিচেই বাগানে লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লেখা, ‘ good morning sweetheart’! কলিজা মোচড় দিলো সালমার। ধীর গতিতে স্বামীর দিকে তাকালো। স্বামীর চেহারা দেখে আরো ভয় পেল। নিজেকে কোনোমতে শান্ত রাখার প্রয়াস চালিয়ে স্বামীকে যেই কিছু বলতে যাবে তার আগেই দিদার হাসান বারান্দা ত্যাগ করলো। মেয়ের মাথার পাশে গিয়ে বসে পড়লো। এলার্ম-ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো মাত্র ৭টা বাজে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মৃদুস্বরে ডেকে উঠলেন তিনি।

“-ফারহিন! ফারহিন…
ঘুম ঘুম চোখে আধোভাবে তাকালো ফারহিন। বাবাকে দেখেই উঠে বসে পড়লো। দুহাতে মুখ ঘষে বাবার দিকে তাকালো। দিদার হাসান মৃদু হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। এলোমেলো হয়ে থাকা চুল ঠিক করতে করতে বলল-
“-চলো ছাদে যাবো।
“-কিন্তু বাপি হঠাৎ..?
“-চলো তারপর দেখতে পাবে। কাম অন!!
ফারহিন বিছানা ছেড়ে নামলো। সালমা স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলো। তার শান্ত ভাব যে কতটা ভয়ংকর তা সালমা ভালো করেই জানে। কিছু বলার সুযোগই পাচ্ছেনা। দিদার হাসান মেয়েকে নিয়ে ছাদে গেল। ছাদের ঠান্ডা আবহাওয়ায় ফারহিন এর ঘুম সম্পূর্ণ কেটে গেল। হাটতে হাটতে রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে গেল সে। দিদার হাসান থামালো। বলল-
“-এদিকে এসো। একটা জিনিস দেখবে।
বলেই মেয়েকে নিয়ে অন্যপাশে নিয়ে গেল। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে ইশারায় নিচে তাকাতে বলল। ফারহিন হাসি মুখে একরাশ আগ্রহ নিয়ে তাকাতেই বড়সড় ধাক্কা খেল। ঠোঁট জোড়া পরস্পরকে ছেড়ে আলাদা হয়ে গেল। বড় বড় হয়ে গেল চোখ। বাবার দিকে দ্রুত গতিতে ফিরে তাকালো ফারহিন। বাবার চেহারায় আগের মত হাসিটা আর নেই। ফারহিনের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। ফারহিন জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। আর মৃদুস্বরে বলল-
“-এসব..
“-আমারও একই প্রশ্ন প্রিন্সেস। এসব কি? হোয়াট ইজ দিস?
ফারহিন ঢোক গিলল। মায়ের দিকে তাকাতেই দেখল মা নিজেই ভয়ে চুপসে আছে। ফারহিন বলল-
“-বাপি আমি সত্যিই জানিনা। আই ডোন্ট নো বাপি।
“-প্রিন্সেস! ইটস নট এ নরমাল। তুমি জানোনা অথচ কেউ তোমার বাড়ির এড্রেস জানে আর তার উপর এসব.. এসব আসলেই সাধারণ না।
“-বাপি প্লিজ ট্রাস্ট মি।
“-ওকে। ওকে ফাইন। আই ট্রাস্ট ইউ বাট…
“-বাট..? ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো ফারহিন। দিদার হাসান হাসল বলল-
“-নাথিং স্পেশাল। তুমি রুমে যাও। ফ্রেশ হয়ে নাও।
“-আচ্ছা।
বলেই ফারহিন কয়েক কদম এগিয়ে গেল। পেছন থেকে দিদার হাসান বলে উঠলো-
“-ফারহিন! আমি যা আন্দাজ করছি তা যেন সত্যি না হয়। মিথ্যে বলার পরিনাম ভালো হবেনা বেইবি।
ফারহিন দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো। দিদার হাসান হাসলো ইশারায় যেতে বলল। ফারহিন এক মুহুর্ত ও দাঁড়ালো না রুমে চলে এলো।

ঘুমন্ত অবস্থায় ফারহানা ফোন রিসিভ করলো। কয়েকবার অনবরত বেজেই গেছে। ফারহানা এলার্ম ভেবে কেটেও দিলো। পরে বার বার বাজতে দেখে ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো। ঘুম ঘুম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো-

“-কে?
“-কে মানে? তুই আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি ফারহিন।
“–কোন ফারহিন? ঘুম ঘুম কন্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করলো ফারহানা।
“-ফারহা তুই উঠবি নাকি? এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।
ফারহিনের রাগান্বিত সুরে বলা কথাটায় ফারহানার ঘুম ছুটে গেল। উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকালো। তারপর বলল-
“-৭ঃ৩০ বাজে ফারহু। তুই এত সকালে কেন ডাকলি আমাকে?
“-আরে আমি আরো উঠেছি, এবার তুই ওঠ..
“-চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়, কলেজ এলে কথা হবে।
“-আরে শোন!!
“-ঘুমটা চোখ থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগে তাড়াতাড়ি শেষ কর।

কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা সবই ফারহিন ফারহানা কে বলল। সবটা শুনে ফারহানার চোখের ঘুম নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল। বিচলিত কন্ঠে বলল-
“-কিহহহ?
“-আস্তে..
“-ফারহু আমি বলছি শোন তুই, এটা যেই হোক ইচ্ছে করেই তোর এমন ক্ষতি করছে। বাসার সামনে এসব লোক দেখানো ভালোবাসা দেখিয়ে তোর কপালেই শনি ডেকে আনছে।
“-আমি বুঝতে পারছিনা ফারহা। বাপি আমাকে সন্দেহ করছে। কিন্তু আমি কীভাবে বোঝাবো আমি জানি না এসব কে করছে।
“-কি জ্বালায় পড়লি বল তো?
“-বুঝতে পারছিনা রে…
“-ফারহু ছেলেটার কিন্তু গাটস আছে বলতে হবে।
“-তুই আমার বন্ধু না শত্রু? আমার বন্ধু হয়ে অচেনা ওই আপদটার নামে সুনাম করছিস কেন?
“-তুই দেখ, যেখানে কেউ কোনোদিন তোর বাবার ভয়ে তোর দিকে চোখ তুলে তাকালো না সেখানে সে তোর বাড়ির সামনেই এসব। তোর বাবাকে এটা এক প্রকার চ্যালেঞ্জ করা।
“-মাঝখানে পড়ে আমিই ভর্তা হচ্ছি।
“-চিন্তা করিস না। তুই ফ্রেশ হয়ে নে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়িস। আমিও ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে বের হবো।
“-ওকে বাই।

ফোন রেখে দিলো ফারহানা। ফারহিন ফোন রেখে উঠে দাঁড়ালো৷ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। লেখাটা বারান্দা বরাবর একদম। ফারহিন অজান্তেই হেসে দিলো। নিজমনে বলে উঠলো-
“-আসলেই গাটস আছে মিস্টার আপনার। নাহলে বাঘের গুহায় পা রাখার সাহস সবার হয় না। আমি আপনাকে একটি বার হলেও দেখতে চাইবো।


“-আমারই বাড়িতে এসে আমার বাড়ির সামনে এমন কাজ করার দুঃসাহস করলো কে?
“-তা তো আমি বলতে পারবোনা। তবে আমার মেয়ে এসব সম্পর্কে জানেনা কিছুই।
“-তুমি এত শিওর কি করে? ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো দিদার হাসান।
“-নিজের মেয়ের প্রতি এইটুকু বিশ্বাস আমার আছে।
স্বামীর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল সালমা।
“-আমিও দেখি বাড়ির আশেপাশে কেউ কিভাবে আসে।
“-একটা কথা কি জানেন?
“-কি?
“-চোর যদি চুরি করার কথা চিন্তা করে তাহলে সে যেকোনো ভাবে তার স্বার্থ হাসিল করেই ছাড়ে।
“-মানে?
“-মানে এটাই যে, এত বছর পর আপনার মেয়ের উপরও কারো নজর পড়েছে।
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল সালমা।
“-তোমার কি খোঁচা দেওয়া ছাড়া আর কাজ নেই? বিরক্তি নিয়ে বলল দিদার হাসান।
“-উহু! খোঁচা না। তবে আমি এটাই দোয়া করবো সে যেন আপনার মত না হয়।
ত্রস্ত নয়নে স্ত্রীর দিকে তাকালো দিদার হাসান। এগিয়ে এসে শক্ত কন্ঠে বলল-
“-আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে আমার মর্জি ছাড়া কেউ নিয়ে যেতে পারবেনা। আর আমার চেয়ে বেশি ভালো তাকে কেউ বাসতেই পারবে না। আমি দিদার হাসান বেঁচে যতদিন আছি ততদিন আমার প্রিন্সেস এর গায়ে কারো ছায়াও পড়তে দেব না।
“-মানুষ যা চায় তা কী পায়? না তো..
তাহলে এসব বলেও লাভ নেই। একবার ভাবুন যে আপনার বাড়ি অবধি চলে এসেছে সে আপনার মেয়ে অবধি পৌঁছাতে কতক্ষণ?
আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন একটি কথা।
“-কি?
“-আপনিই বলেছিলেন, কোনো তীব্র জেদি মানুষ যদি একবার কোনো প্রতিজ্ঞা করে নেয় তাহলে তা পূরণ না করা পর্যন্ত শান্ত হয়না। আর আপনাকে টেক্কা দেওয়ার মত হয়তো কেউ চলে এসেছে।

বলেই সালমা চলে গেল। ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে রাগ হলো দিদার হাসানের। হাতে থাকা ফোন আয়নাতে ছুড়ে মারতেই আয়নায় ফাটল ধরলো। রাগে থরথর করে কাঁপছে দিদার হাসান। নিজের একমাত্র শখের জিনিসকে তিনি কখনোই কোনো খারাপ ব্যাক্তির কবলে পড়তে দেবেন না। ফাটল ধরা আয়নায় নিজের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলল-
“-দ্বিতীয় কোনো দিদার হাসান আমি আমার জীবনে চাইনা।

★হসপিটালের করিডরে কারো সাথে প্রচন্ড বাজে ভাবে ধাক্কা খেল আরশ। হাত থেকে পড়ে যাওয়া ফোন তুলে উপরে তাকাতেই দেখলো ফারহিন। ফারহিন এর পরনে থাকা কমলা রঙের ড্রেসটা রক্তে মাখামাখি। চেহারা টা মলিন। হালের এক পাশে রক্ত লেগে আছে। আরশ দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। ফারহিন কে একবার পুরোপুরি দেখে জিজ্ঞেস করলো-
“-আপনি এখানে?
“-আসলে আমার…
প্রচন্ড হাপাচ্ছে ফারহিন। আরশ তাকিয়েই রইলো উত্তরের আশায়। ফারহিন বলল-
“-আমার ক্লাসমেট এক্সিডেন্ট করেছিলো।
“-এখন কেমন আছে?
“-জানিনা ইমার্জেন্সিতে আছে।
“-আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন, আপনার পুরো শরীর রক্তে মেখে আছে।

‘রক্ত’ শব্দটা শুনেই ফারহিন নিজের দিকে তাকালো। ড্রেসে রক্ত দেখে ফারহিন থরথর করে কাঁপতে থাকে। প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কমে গেল। চোখের সামনে সবকিছুই ঝাপসা হয়ে এলো। মাটির বুকে ঢলে পড়ার আগেই আরশ হাতে থাকা ফোন ছেড়ে দিয়ে ফারহিন কে আগলে নিলো। ফারহিনের রক্তে মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফর্সা চেহারায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। মায়াবী মুখটির দিকে তাকিয়ে আরশ একজন নার্সকে ডেকে ফারহিন কে ইমার্জেন্সি তে এডমিট করিয়ে দিলো।

ফারহিনের হোমোফোবিয়া আছে। ডাক্তার জানালো রক্ত দেখলেই আতংকিত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা মানুষ রা হোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত। ডাক্তারের কথা শুনে আরশ বলল-
“-ওকে একটু ক্লিন করে দিন। ড্রেসএ রক্ত লেগে আছে পরে সেন্স আসার পর আবার অজ্ঞান হয়ে পড়তে পারে।

ডাক্তার নার্সকে ফারহিনের পোশাক বদলে দিতে বলে আরশ কে নিয়ে বের হয়ে যায়। আরশ বের হতেই ফারহানা দ্রুত সামনে এসে দাঁড়ালো।
“-কেমন আছে ও?
“-এখন ঠিক আছে।
“-ওহ্। কলেজ টাইম তো শেষ হয়ে গেল। ওর বাবা ওর জন্য চিন্তা করবে। এতক্ষণে হয়তো….
আরশ থামিয়ে দিলো ফারহানা কে। বলল-
“-তোমাদের ক্লাসমেট না কে যেন এক্সিডেন্ট করেছিলো? ওর কি অবস্থা?
“-ওর বাসায় ইনফর্ম করে দিয়েছি। ওর ফ্যামিলি মেম্বার আছে, ওনারা দেখছেন।
“-ওহ্! তুমি তাহলে বাসার দিকে রওনা দাও। কলেজ টাইম তো শেষ!
“-কিন্তু ফারহিন?
“-ওকে আমি পৌঁছে দেব। সেন্স ফিরুক।
“-কিন্তু…
“-কিন্তু কিন্তু করো না। তোমার ফ্রেন্ড কে আমি বাসায় পৌঁছে দেব। তুমি এসো তোমাকে আমার ড্রাইভার পৌঁছে দেবে।
“-না না। থ্যাংক ইউ ভাইয়া। আমি পারবো।
“-তর্ক করো না। কাম উইথ মি।
বলেই আরশ হাটা দিলো। ফারহানা বাধ্য মেয়ের মত আরশের পিছু পিছু গেল। আরশ তার গাড়ির ড্রাইভার কে বলল ফারহানা কে পৌঁছে দিতে। গাড়িতে ওঠার আগে ফারহানা আরশ কে বলল –
“-থ্যাংক ইউ ভাইয়া।
“-ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।

★বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ফারহিন বাসায় ফিরলো না। মেয়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে সালমা। দিদার হাসান আসার আগেই ফারহিন বাসায় না এলে কি যে হবে তা ভেবেই শিরদাঁড়া কেঁপে উঠছে বার বার।
হাতে চকলেট বক্স নিয়ে ফারহিন কে ডাকতে ডাকতে বাড়িতে প্রবেশ করলো দিদার হাসান। ড্রয়িংরুমে বসে থাকা সালমা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। যেই মেয়ে কলেজ ছুটির ৩০মিনিটের মধ্যে বাসায় হাসির থাকে সে মেয়ে এখনো পর্যন্ত বাসায় ফেরেনি এই কথা যদি দিদার সাহেব জানে বাড়ি মাথায় তুলবে। এই ভেবে ঢোক গিলল সালমা। দিদার হাসান হাসি মুখে বলল-
“-ফারহিন কে ডাকো বেগম। আমি ওর জন্য ওর পছন্দের চকলেট এনেছি।
“-ফারহিন…
“-যাও ডেকে নিয়ে এসো। আচ্ছা আমিই যাচ্ছি। বলেই সিড়ির দিকে পা বাড়ালো দিদার হাসান।
“-ফারহিন বাড়ি ফেরেনি দিদার সাহেব।
চোখ মুখ খিচে বলে দিলো সালমা। সালমার বলা কথা শুনে দিদার হাসানের মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেল। চলতে থাকা পা থেমে গেল। দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো দিদার হাসান। হাতে থাকা চকলেট বক্স মাটিতে পড়ে গেল। দ্রুত গতিতে এগিয়ে এসে সালমার বাহু চেপে ধরলো-
“-আমার মেয়ে বাড়ি ফেরেনি আর তুমি এখন বলছো এটা আমাকে?

চলবে……???
চলবে???

#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম
||পর্ব-১||

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here