শূন্য থেকে আসে প্রেম পর্ব ১৫+১৬

#শূন্য_থেকে_আসে_প্রেম
#পর্ব – ১৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

এতদিন পর আমার কথা মনে পড়েছে তার। আমি কোনো কথা না বলে চুপ কর থাকলাম। ভীষণ অভিমান হয়েছে আমার। অপরপাশে সেই মানুষটা হেলো বলেই নিরব হয়ে গেছে। আর আমি তো কথা না বলার পণ নিয়ে রেখেছি। একসময় সেই মানুষটা নিরবতা ভেঙে বলে,

” কেমন আছিস ? ”

আমি কোনো উত্তর দিলাম না। আবার আওয়াজ আসে ,

” কিরে কথা বলবি না ? ”

আমি আর পারলাম না। চাপা কেদে বলি,

” কথা তাও তোমার সাথে ? তুমি এতকিছু আমার সাথে করার পর আমি আবার তোমার সাথে কথা বলবো তা তুমি কিভাবে আশা করো আপু ? ”

ফোনের মধ্যে আপুর দীর্ঘশ্বাস এর আওয়াজ ভেসে আসলো। কিন্তু আমার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কারণ ওই যে অভিমান। আপু বললো,

” জানি । কিন্তু আমি নিরূপায় ছিলাম কিউটি। ”

আমি এবার চেঁচিয়ে বললাম,

” কিসের নিরূপায় ছিলে তুমি ? তোমার রিফাত ভাইয়ার সাথে প্রেম চলছিল তুমি আমাকে জানাও নি। এখন ভাবি আমি ঘুমিয়ে গেলে কেনো তোমার ফিসফিসানি করা শুনা যেত। কেনো আপু আমাকে কি বলা যেত না এসব ? সব শেয়ার করতে পারলে এটা লুকিয়ে রাখার কারণ কি ছিল ? আজ এতসব জানলে আমার জীবনটা অন্যরকম হতো। জানো তুমি ? ”

এসব বলতে বলতে আমি পুরো কেদেই দিলাম। আপু আমার কান্না শুনে এই কথাই বললো,

” আজ দেখা করবি আমার সাথে কিউটি ? ”

আমি কাদতে কাদতে বললাম,

” না করবো না। শুনেছ তুমি ? করবো না আমি দেখা তোমার সাথে। ”

” আমি জানি তুই করবি। কারণ আজ হয়তো তোর সব প্রশ্নের জট খুলবে সেই সাথে তোর সব দুঃখ গুলা আমার সামনে উপচে পড়বে। ”

আমি কান্না চেপে বলি,

” কোথায় দেখা করতে হবে ? ”

আপু হাসল। বললো,

” মেসেজ করে জানিয়ে দিব। চলে আসিস। ”

আমি ফোনটা কেটে বুকের কাছে চেপে ধরে ভাবছি আজ আমার জীবনটা এতটা বিবর্ণ শুধুমাত্র ওই ঘৃণিত লোকটার জন্যে। তাই আমার প্ল্যান টা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে হয়তো এই অভিশাপ ময় সম্পর্ক থেকে রেহাই পাবো। ফোনটা বিছানার উপর রেখে রান্নাঘরের দিকে এগুলাম আমি। আন্টিকে হয়তো ওখানেই পাবো। রান্নাঘরে গিয়ে দেখি আন্টি মাছ ভাজি করছেন। আমাকে দেখে বললেন,

” ঈপ্সিতা , মাছ গুলা একটু দেখো তো। আমার একটু রুমে যেতে হবে। মাথাটা একটু ব্যাথা করছে। রুমে গিয়ে ঔষুধ টা খেয়ে আসবো। ”

আমি মুচকি হেসে বলি,

” ঠিক আছে। ”

আন্টি চলে গেলে আমি মাছ গুলা ভেজে একটা প্লেটে তুলে রাখলাম। সব রান্না শেষে আমি আর শেলী মিলে রান্নাঘর টা গুছিয়ে নিলাম। আর আমি লাইট ওফ করে সেখান থেকে চলে আসলাম। আন্টির রুমে গিয়ে দেখি আন্টি ফোন এ কারো সাথে কথা বলছেন। আমি যাওয়ার পর ফোনটা রেখে দেন। আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলেন,

” ইনায়া ফোন দিয়েছিল। তোমাকে নাকি ওর সাথে আজ দেখা করতে হবে ? মেয়েটা তোমাকে অনেক বেশি মিস করছিল তাই আমাকে রাজি করানোর জন্যে ফোন দিল। ”

আমি ক্ষীণ আওয়াজে বলি,

” আমি কি যাবো , মা ? ”

আন্টি বিছানা থেকে উঠে দাড়ালেন। আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

” এটা আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে। বোনের সাথে দেখা করতে যাবে এটার আবার পারমিশন নেওয়া লাগে নাকি ? আর একটা কথা বিয়ের আগে এই বাড়িতে যেরকম নিজের মনমত চলতে এখনও ঠিক সেইভাবেই চলবে। মাঝেমধ্যে টুকটাক বউয়ের নিয়ম পালন করবে এইটুকুই। ঠিক আছে ? ”

আমি হালকা হেসে মাথা নাড়ালাম। আসলেই এই বাড়ির সবাই অনেক ভাল । শুধু ওই বজ্জাত টা ছাড়া। তাই তো আমি এই প্ল্যান টা সাজালাম। যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙ্গে।

বিকেলে খাওয়া দাওয়া শেষে আমি রেডী হয়ে আপুর বলা রেস্টুরেন্টে যাই। গিয়ে দেখি আপু আগে থেকেই আমার জন্যে বসে আছ। আমি মুখ ফুলিয়ে গিয়ে উনার বিপরীত চেয়ারে বসি। আপু আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। আর আমি অন্যদিকে তাকিয়ে আছি। ওয়েটার কে ডেকে আপু আমার জন্যে চা আর উনার জন্যে কফি অর্ডার করলো। আর আমি এখনও মুখ ফুলিয়ে বসে আছি। শেষ পর্যন্ত নিরবতা ভেঙে আপুই বললো,

” কতসময় চলবে এসব মান অভিমান ?? ”

আমি কিছু বললাম না। আপু আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে বলতে শুরু করলো ,

” কিউটি , আমার কথা মন দিয়ে শুনলে হয়তো তোর এসব অভিমান গুলা ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে। তো শুনবি না।না শুনলে বল। ”

আমি একটু নড়েচড়ে বসে বললাম,

” হুম। বলো। শুনছি। ”

আপু বলতে লাগলো,

” আসলে রিফাতের কথা আমি কাউকে বলি নি। তার ২ টা কারণ। ১ম টা হচ্ছে বাবা। তুইতো জানিস বাবা কোনোকালেই এসব প্রেম ভালোবাসা সাপোর্ট করে না। আর মা ত আমাদের সবসময়ই বলতো যে কখনো যদি বাবা জানতে পারে তার মেয়েরা প্রেম করছে দেন বাবা সেটা সহ্য করতে পারবে না। হয়তো কোনো একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে তাতে। তাই এটা আমি লুকিয়ে রেখেছি। কারণ ভিতর ভিতর আমাকে অপরাধবোধে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। ২য় হলো তুই। যখনই আমাকে তুই জিজ্ঞেস করতি যে আমি কোনো রিলেশন করি কিনা আমি না করতাম। বলতাম যে আমি এসব পছন্দ করিনা। আসলে আমি তখন ভালোবাসার মানে জানতাম না। তাই বলতাম। কিন্তু রিফাত আমার জীবনে আসার পর আমি বুঝেছি যে ভালোবাসার অনুভুতি টা কতোটা মধুর। তাই তোকে বলতে একটু বাঁধছিল আমার। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি তোকে বলতাম ওর কথা। কিন্তু তার আগেই বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে দিলো সৌরভ এর সাথে। আর আমি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে মানা করতে পারিনি। তুই জানিস রিফাত আমার হাত ধীরে সেদিন প্রথম কান্না করেছিলো। আমি যদি সৌরভ এর সাথে বিয়েটা করতাম তাহলে ও নির্ঘাত মরে যেত। ”

বলেই আপু থামলো। আর আমি এখনও প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার প্রশ্নের ঝুলি সমাধান করতে আমি জিজ্ঞেস করি,

” তাহলে রিফাত ভাইয়ার ব্যাপারটা উনি জানলেন কি করে ? “.

আপু বলল,

” রিফাত বলেছে। রিফাত তো সৌরভ এর ফ্রেন্ড। তাই ওই বলেছে। আর সৌরভ ও মেনে নিয়েছে। ”

আমি ভাবলাম তাহলে উনি আমাকে বিয়ে কেনো করেছে ?? আপু বলল,

” আচ্ছা রিফাত এর কাছ থেকে একট কথা জেনেছি। তুই কিছু মনে করিস না প্লিজ। তোর আর সৌরভ এর মধ্যে কি কোনো সমস্যা চলছে ? ”

আমি আপুর কথায় থতমত খেয়ে গেলাম। বললাম,

” আরে না। তেমন কিছু না। ”

আপু তবুও কপাল কুচকে বললো,

” না আসলে সৌরভ কে নাকি রিফাত বলছিল তো কথা। তখন সৌরভ বলেছে যে ও তোকে ঘৃনা করে তাই যাতে তোর কথা না জিজ্ঞেস করে। তাই বললাম। প্লিজ কিউটি আমাকে বল। আমার টেনশন হচ্ছে তোর জন্যে। ”

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি,

” হুম। উনি আমাকে পছন্দ করেন না। এই বিয়েটা নামের বিয়ে। এর কোনো মর্মার্থ নেই। ”

” কেনো ? কিসের জন্যে তোকে ও পছন্দ করে না ? ”

” জানিনা আমি। বলেন নি আমাকে কখনো। ”

” তাহলে তুই ও বাড়িতে এখনও পড়ে আছিস কেন ? ফিরে চল । ”

“না তা সম্ভব নয়। বাবা আমাকে ও বাড়িতে জায়গা দিবে না। মা দিলেও বাবা মাকে আটকে রাখবে। আর তুমি তো জানোই এতকিছু হওয়ার পর বাবার আমার প্রতি কিরূপ বিতৃষ্ণা জন্মেছে। আর আমি চাই না আমি ও বাড়িতে গিয়ে বারবার অপমানিত হই। ”

” তাহলে যে দিনের পর দিন তুই সৌরভ এর কাছ থেকে অপমানিত হচ্ছিস তার বেলায় ? তুই এক কাজ কর আমার সাথে আমার বাড়িতে চল। ও বাড়িতে তোর থাকার কোনো দরকার নেই। ”

আমি আপুর কথা শুনে তাড়াতাড়ি করে বলি,

” না না। আমার কাছে আরেকটা প্ল্যান আছে। ”

আপু খানিকটা অবাক হয়ে বলে,

” কি প্ল্যান ? ”

আমি নিজের জায়গায় আরো শক্ত করে বসে বলি,

” আমি একেবারে চলে যাবো এই দেশ থেকে। ”

আপু আমার কথা শুনে আতকে উঠে বলে,

” কেনো ? আর কিভাবে ?? ”

” ILTS করে। কিন্তু তার জন্যে আমাকে ও বাড়িতে আরো ভালোভাবে থাকতে হবে। সবার মন যুগিয়ে চলতে হবে। কারণ আমি চাই না যখন আমি উনাকে ডিভোর্স পেপার পাঠাবো তখন যাতে কেউ কোনোভাবে আমায় দোষারূপ করে। আর যাওয়ার আগে আমি উনার দোষ সবার সামনে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিব। আর এটাও বলে যাবো আমি এই সম্পর্ক কে ঠিকিয়ে রাখতে কম চেষ্টা করিনি। কিন্তু আমি ব্যার্থ হয়েছি উনার জন্যে। তাই এখনও কোনোরূপ প্রতিবাদ ছাড়াই আমি ও বাড়ির মাটি আকড়ে এখনও পর আছি। ”

আপু বিস্মিত হয়ে বলে,

” সিরিয়াসলি কিউটি। তোর মাথায় এতকিছু চলছে। আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু তোর যখন কোনো দরকার হবে সবসময়ের মত তুই আমায় বলবি। ঠিক আছে ? ”

” হুমম। এখন আসি। ”

আমি কথাটা বলেই চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালাম। আপুকে অনেকক্ষন জড়িয়ে ধরে বাই জানিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে চলে আসলাম।
#শূন্য_থেকে_আসে_প্রেম
#পর্ব – ১৬
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

বাসায় যেতে যেতে প্রায় ৪:৩০ টা বেজে যায়। গিয়ে দেখি সৌরভ ভাইয়া অফিস থেকে এসে গেছেন। আমি রুমে উনাকে দেখেও না দেখার ভান করে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসি। বের হয়ে দেখি উনি সোফায় বসে ল্যাপটপ চালাচ্ছেন। আমি উনাকে এক ঝলক দেখে আলমারির কাছে গিয়ে জায়নামাজ টা বের করে আসরের নামাজ টা পড়ে নিলাম। নামাজ শেষে আমি উনার দিকে ফিরে দেখি উনি আমার দিকে কিরকম ভাবে তাকিয়ে আছেন। খুব অপরিচিত এক চাহনি। আমি একটু ইতস্তত বোধ করে উনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। মুনাজাত শেষ করে জায়নামাজ টা ভাজ করে আবার আলমারিতে রেখে দিলাম। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে উনি আমাকে নরম গলায় ডাক দেন। আর এতে আমি খানিকটা অবাক হই। এত নরম স্বরে ডাকার কারণ কি ? আমি উনার দিকে ফিরে তাকালে উনি কোমল গলায় আমাকে বলেন,

” মুনাজাতে কি চাইলে ? ”

আমি একটু অবাক হলাম উনার কথায়। হটাৎ আমার মুনাজাত নিয়ে পড়লো কেনো ? পরক্ষণে আমি চোখ মুখ শক্ত করে বলি,

” সবসময় যেটা চাই। আপনার থেকে মুক্তি। ”

উনি আমার কথা শুনে আমার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকান। আমি আবার বলি,

” কি হয়েছে ? এরকম তাকিয়ে আছেন কেনো ? কথাটা ভালো লাগে নি ? ”

উনি কিছু না বলে মুখ ফিরিয়ে ল্যাপটপে মন দিলেন। উত্তর না দিলে নাই। আমার কি ? আমিও আর কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।

৩ সপ্তাহ পর …

আজ সকাল থেকে বাড়িটা কেমন যেনো নিস্তেজ হয়ে আছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই যেনো চুপ থাকার পায়তারা করছে। আর এই জিনিসটা আমার ঠিক হজম হচ্ছে না। সকাল থেকে আঙ্কেল নিজেকে স্টাডি রুমে বন্দী করে রেখেছেন। কিন্তু কেনো ? কিরকম যেনো রহস্য রহস্য গন্ধ আসছে। আমি না পারতে শেলি কে জিজ্ঞেস করি,

” আচ্ছা শেলি ,সবার কি হয়েছে আজ ? এত মনমরা কেনো সবাই ? তুমি জানো কিছু ? ”

শেলি আমার কাছে খানিকটা ঘেঁষে বললো,

” কাউকে বলিয়েন না। আজ ফুপাজি এর মন খারাপের দিন। তাই সবাই এরকম হয়ে আছে। ”

আমি অবাক হলাম তার কথায়। মন খারাপের দিন বলতে ? আমি ফিসফিস করে বলি,

” মন খারাপের দিন মানে ? ”

” আজ সারাদিন ফুপাজী ওই পড়ার ঘর থেকে বের হইবেন না। মানে ওই বলতে গেলে ঘর বন্দী তাহবেন সারাদিন। ”

আমি ওর কথা শুনে প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে বলি,

” কেনো কেনো ? ঘর বন্দী কেনো ? কি হয়েছে উনার ? ”

শেলি কপাল কুঁচকে বলে,

” তা আমি কি জানি। প্রত্যেক বছর উনি ঠিক এই দিনটায় এইরহম ঘর বন্দী হয়ে তাহেন। আর বাড়ির সবাই তখন এরহম চুপ করে থাকে। উনারে এই দিনটায় কেউ কিছু কইতে বা জিজ্ঞেস করতে পারে না। ”

” এটা আবার কি নিয়ম। আজ তো কোনো বিশেষ ডেট না তাহলে এরকম ঘর বন্দী বিষয়টা কি ? ”

” আমিও জানি না। আর আমার মনে হয় খালাম্মাও জানে না কিয়ের জন্যে উনি এরহম করেন। ”

আমি আর কিছু বললাম না। হটাৎ সুরভী হেলেদুলে এসে আমার পাশে বসে পড়লো। অতন্ত দুঃখি দুঃখী গলায় বললো,

” এরকম আর কত বছর ধরে চলবে কে জানে? বাবার এই দেবদাস রূপ আর ভালো লাগছে না। সহ্যের বাহিরে যাচ্ছে একদম। এইজন্যেই বোধহয় ভাইয়া এইদিন ঘরে আসেনা। যত্তসব। ”

আমি কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাই। আন্টিও জানেন না আঙ্কেল কেনো এরকম করেন ? কি অদ্ভুদ বিষয়টা। মাথার উপর দিয়ে গেলো সব।

আজ বাড়িতে কিছুই রান্না হয়নি। কালকের খাবার দিয়ে সবাই খেয়ে নিয়েছেন। আর সৌরভ ভাইয়া তো সারাদিন বাড়িতেই ছিলেন না। কিন্তু প্রত্যেকদিন তো ঠিক টাইম মত বাড়ি আসেন। আজ একবারও আসেন নি। অফিস তো সেই বিকেলেই শেষ। তাহলে এতক্ষণ উনি বাইরে কি করছেন ? কি জানি। আজ সবাই একটু অদ্ভুত ব্যাবহার করছে। কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না।

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ। এখনও উনি বাসায় আসেন নি। আর আঙ্কেল কে দেখলাম উনি স্টাডি রুমে সোফায় ঘুমিয়ে গেছেন। সারাদিন কিছু ফল আর পানি খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন উনি। কি ব্যাপার আল্লাহ ভালো জানেন। আংকেলের এই রহস্যময় ব্যাবহার টা ঠিক ধরতে পারছি না আমি। রাত বেশি হাওয়ায় আমি রুমে এসে ঘুমিয়ে গেলাম।

রাত প্রায় ১২:১১ বাজে। সৌরভ এর কাছে থাকা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে বাড়িতে ঢুকে ও। এই বাড়িটা ওর কাছে এখন একটা রঙ্গমঞ্চ লাগছে। বাবার এই অতিমাত্রার বাড়াবাড়ি কোনোকালেই তার পছন্দ নয়। মনে হচ্ছে সবকিছু গুড়িয়ে দিতে। তার নিজের বাবা কি করে এতটা চরিত্রহীন হতে পারে তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে সে ক্লান্ত। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের রুমে যায় সৌরভ। রুমের দরজা টা খুলে বিছানার উপর ঈপ্সিতা কে এলোমেলো হয়ে ঘুমাতে দেখে একধরনের শক খেলো ও। দূর থেকে এতটা সিগ্ধ লাগল কাছ থেকে কিরকম লাগবে ঈপ্সিতা কে। না আর লোভ সামলাতে পারলো না সৌরভ। নিজের পা টাকে দ্রুত চালিয়ে ঈপ্সিতার কাছে যায় ও। ঈপ্সিতা একপাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে। মাথার নিচে এক হাত আর আরেক হাত দিয়ে কম্বল টাকে আকড়ে ধরে আছে। আচ্ছা আজ কি একটু বেশিই সুন্দর লাগছে না ইপ্সিতা কে ? না শুধু ওর চোখেই তাকে পুরো এক মায়াপরির মত লাগছে।
” মায়াপরি “” শব্দটা বেশ কয়েকবার আউড়ে নিল সে। কপালের উপর লেপ্টে থাকা চুলগুলো পড়ে থাকতে দেখে সৌরভ একটু ঝুঁকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে আবার অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে ইপ্সিতার দিকে। কেনো যেনো এই মুখটা দেখে ওর আজকের সব ক্লান্তি আর মন খারাপেরা পালিয়ে গেছে। কিন্তু এই মেয়েটাই তো সব ক্লান্তি আর মন খারাপের কারণ। তাহলে ওকে দেখেই কেনো সব পালিয়ে গেলো তা সৌরভের কাছে ধোঁয়াশা লাগছে। পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে এই মুহূর্ত টাকে ক্যামেরাবন্দি করে নিল সে। মাঝেমধ্যে ক্লান্তি দূর করতে ছবিগুলা তার ভীষণ প্রয়োজন। কিন্তু হটাৎ করেই তার মনে হলো তার এই আচরণের কারণ কি ? আর মনে হতেই চট করে দাড়িয়ে গেলো সে। বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। আর সেই নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে ভাবতে লাগলো তার এইসব অদ্ভুত আচরণের কারণ কি ? সেদিন মেয়েটার বানানো পায়েস না খাওয়ায় তার সারাটাদিন আফসোস হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল হয়তো ওই পায়েস টা দুনিয়ার বানানো সবচেয়ে বেস্ট পায়েস হবে । তাই বিকেলে এসে চুপিচুপি রান্নাঘরে এসে ফ্রিজে চেক করেছিল। কিন্তু কোথাও পায়েস নেই। মনে হয় সকালেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো পায়েস টা। বারবার মনে হচ্ছিল কেনো ও এটা করতে গেলো ও ? ইদানিং মেয়েটাকে কষ্ট দিতে ওর কেমন যেনো বাঁধে। মনে হয় ও নিজে কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু এরকম হওয়ার কারণ কি ? ও বিষয়টা ধরতে পারছে না। ওতো ওকে বিয়ে করেছিল শুধু এবং শুধুই কষ্ট দেওয়ার জন্যে। তাহলে এখন ওর সাথে কি হচ্ছে ? মেয়ে টাকে দেখলে আগের মত জিদ চাপে না ওর মাথায়। এই অনুভতির নাম কি? ওর মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে ও মেয়েটার মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। তাহলে ও ঈপ্সিতা কে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারবে না। না সৌরভ , তোকে মেয়েটা থেকে দূরে থাকতে হবে। এখন কষ্ট দেওয়ার চিন্তা না করে দূরে থাকার চিন্তা করতে হবে। কারণ কষ্ট দিতে গেলে ওর কাছাকাছি থাকতে হবে। আর ও সেটা করতে পারবে না। তাহলে আরো মায়ায় পড়ে যাবে ও। মেয়েটা থেকে ওর একটু সাবধানে থাকতে হবে। কারণ ধীরে ধীরে ওর পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে মেয়েটা জড়িয়ে যাচ্ছে।

রাত প্রায় ২টার দিক সৌরভ বারান্দা থেকে রুমে আসে। ঈপ্সিতার উপর নজর গেলে তারাতারি করে নিজের নজর সরিয়ে ফেলে ও। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। হটাৎ তার মনে হলো ঈপ্সিতা কে বুকে নিলে হয়তো আরো ভালো ঘুম হতো ওর। আবার ভাবে সৌরভ মেয়েটার থেকে দূরে থাক। যত দূরে থাকবি ততই তোর মনের জন্যে মঙ্গল ।

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি উনি ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল ঝারছেন। ভাগ্যিস সেদিনের মত শুধু টাওয়েল পড়া নেই। আজ একটা কালো টিশার্ট আর জিন্স পরে আছেন। আমি আড়মোড়া ঘুম ভেংগে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াই। আর তখনই মনে হলো পায়ে একটা কাঁচ ফুটেছে। আমি ব্যথায় “আহ্ ” বলে কুলিয়ে উঠি। সাথেসাথে আমি বিছানায় বসে পড়ি। আমার চিৎকার শুনে সৌরভ ভাইয়া তরিগরি করে আমার কাছে এসে ব্যস্ত হয়ে বলেন,

” কি কি হয়েছে ? Are you ok ?? এরকম কুকিয়ে উঠলে কেনো ? ড্যাম say something …”

আমি উনার ধমক শুনে পায়ে হাত দিয়ে আস্তে করে বলি,

” পায়ে কিছু একটা ঢুকেছে। আমার মনে হয় কাঁচ হবে হয়তো। ”

উনি জলদি আমার পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত দেন। পায়ের তলা টা চেক করে কিছু একটা দেখে বললেন,

” শিট। কাঁচ টা তো অনেক বেশি ভিতরে ঢুকে গেছে। Wait আমি বের করছি। শুনো তুমি একটু সহ্য করো ওকে ? আমি এক্ষুনি বের করছি। চিৎকার করবে না। ”

আমি শুধু অবাক হয়ে উনাকে দেখছি। কি হলো উনার আজ ? এত দরদ ঠিক হজম হচ্ছে না আমার। উনি পা টা আলতো হতে ধরে ধীরে ধীরে কাঁচ টা বের করে নিলেন। আর আমি সঙ্গে সঙ্গে জোড়ে চিৎকার দিয়ে উঠি। উনি পা টাকে হালকা মালিশ করে বলেন,

” খুব বেশী ব্যাথা করছে ? ”

আমি উনার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষন। তারপর ভারী গলায় বলি,

” আপনার দেওয়া ঘা থেকে অনেক কম। ”

উনি আমার কথা শুনে করুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আর আমি এক তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে উনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেই। ভালো হয়েছে। একদম সত্যি কথা বলেছি।

চলবে…
চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here