শেষটাও সুন্দর হয় পর্ব -০২+৩

#শেষটাও_সুন্দর_হয়
#একসাথে_কাটানোকিছু_মিষ্টি_সময়
#আমিনা_আফরোজ
# পর্ব:-০২

রাতের দ্বি-প্রহর। চারিদিক নিস্তব্ধ। শুধু অবিরত ট্রেনের ঝিক ঝিক শব্দ শুনা যাচ্ছে । শীতের রাতে বাহিরের প্রকৃতি ইতিমধ্যেই ঢেকে গেছে শুভ্র কুয়াশার চাদরে। আকাশে আজ মস্ত বড় পূর্নিমার চাঁদ উঠেছে।
সেই সাথে বইছে মৃদু মন্দ শীতল হাওয়া। চারিদিক চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। যেন আজ পথের ধারে চাঁদের হাট বসেছে। আর সেই হাটে সবাই লুটে নিচ্ছে ঝলমলে জোৎস্নার আলো। আমি তখন সেই সময় চোখ মেলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম দূরের পথের বাঁকে, যেখানে না বলা কিছু কথারা লুকিয়ে আছে ।

ঝিরঝিরি মৃদু হাওয়া আসছে আমাদের নির্ধারিত সিটে। আমি তখনও জেগে রয়েছি। আমার পাশেই বসেছে অথৈ । ট্রেনে ওঠার পরে হালকা মৃদু বাতাসে সেই কখন ঘুমিয়ে গেছে ও। বাবা-মাও ঘুমিয়ে পড়েছে মিনিট দশেক আগে। একা একা জানালার পাশে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না বলেই জানালার পাশ থেকে ওঠে ধীরে ধীরে পা ফেলে সোজা চলে গেলাম ট্রেনের দরজার সামনে। বেশ রাত হয়ে গেছে বিধায় ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রী তখন পাড়ি জমিয়েছে ঘুমের রাজ্যে।

ট্রেনের দরজার সম্মুখ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি আমি। বাতাসের গতি তখন অনেক। দমকা সেই হাওয়ার তোড়ে আমার লম্বা খোলা চুলগুলো উড়ে চলেছে বাঁধন হীন ভাবে। আমি তখনো তাকিয়ে আছি দূর সীমান্তের পানে। এমন সময় একজন আগুন্তক এসে দাঁড়ালো আমার পাশে। পরনে তার কালো রঙের পাঞ্জাবি। মাথায় ঝাগড়া কালো চুল আর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। আমার মতো তিনিও নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দূরের অপরূপ প্রকৃতির দিকে । প্রায় মিনিট পনেরো এভাবেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলাম দুজনে। একজন থেকে অপর জনের দুরুত্ব খুব বেশি ছিল না, আবার খুব একটা ঘনিষ্ঠ ভাবেও দাঁড়িয়ে ছিলাম না আমরা। হঠাৎ এই নিস্তব্ধতাকে ছাপিয়ে ভরাট এক পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম আমি।

–” এত রাতে একা একটি মেয়ে হয়ে দাঁড়িয়ে এখানে আছেন , ভয় করছে না আপনার?”

কন্ঠস্বরটি শুনেই মুখ ফিরিয়ে তাকালাম তার দিকে। গম্ভীর স্বরে বললাম,

–” সে তো আপনিও একা একা দাঁড়িয়ে রয়েছেন এখানে। আপনার ভয় করছে না বুঝি?”

আমার কথায় আগন্তুক লোকটি মুচকি হেসে বলে ওঠলেন,

–” আমাদের ছেলেদের মাঝে জন্মগতভাবেই কিছু সাহস থাকে বুঝলেন তো।”

–” মেয়েদের মাঝে বুঝি সে সাহস নেই?”

–” উহু নেই। মেয়েরা কখনো লজ্জাবতী তো কখনো কোমলমতি আবার কখনো বা অভিমানীনী হয় তবে তারা কখনো সাহসী হয় না।”

–” এইটা কি আপনার সঙ্গা নাকি?”

–” উহু এইটা সাহিত্যের ভাষা। ”

–” তো আপনার সাহিত্যের ভাষায় মেয়েদের আর কি কি বলে শুনি।”

–” সাহিত্যে মেয়েদের বলে প্রেয়সী, বলে প্রিয়তমা আবার কখনো বলে রাগিনী। ”

–” আমাকে আপনার সাহিত্যের ভাষায় কি বলে মনে হচ্ছে এখন?”

লোকটি আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

–” সত্যি বলবো নাকি মিথ্যা বলবো?”

–” আগে নাহয় মিথ্যা দিয়েই শুরু করুন, সত্যিটা না হয় অন্তিম পাতায় শুনলাম।”

–” যদি মিথ্যে বলি তবে এখন আপনাকে এলোকেশি লাগছে, যার এলোমেলো চুলে যে কেউ হারিয়ে যাবে ক্ষনিকের মাঝেই।”

–” তাই বুঝি।”

আগন্তুক লোকটি আমার দিকে এগিয়ে এসে কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠলেন,

–” নিশি রাত, বাঁকা চাঁদ
তিমির নেমেছে সবে
দক্ষিনা হাওয়ায় , এলোকেশি চুলে
মাতিয়া রাখিয়াছো তারে।”
~আমিনা আফরোজ

লোকটির কথা শুনে কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। দুজনেরই দৃষ্টি ছিল একে অপরের দিকে। এভাবেই কেটে যায় মিনিট পাঁচেক সময়। আমি তখনো সেই মানুষটির পানে তাকিয়ে আছি। আচমকা লোকটি হেসে আমার থেকে দূরে দাঁড়ালেন। অতঃপর চোখের মোটা ফ্রেমের চশমটা হাত দিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরিয়ে রাশ ভারী কন্ঠে বলে ওঠলেন,

–” এখানে এভাবে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাউকে পাগল না করে ভেতরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। ”

কথাগুলো বলেই পিছন ফিরে ট্রেনের ভিতরে চলে যাচ্ছিলেন। আমিও তগনোই বলে ওঠলাম,

–” সত্যিটা না বলেই চলে যাচ্ছেন?”

তিনি আমার কথা শুনে আবারো পিছন ফিরে বললেন,

–” সত্যিটা না হয় আজ অজানাই থাক। যদি জীবনের অন্তিম পাতায় আবার কখনো আমাদের দেখা হয় সেদিন না হয় বলবো।”

–” না আপনি আমার নাম জানেন আর না আমি আপনার পরিচিত। কোন এক নিশি রাতে আপনি আমাকে দেখছেন , আমাকে আপনার জীবনের অন্তিম পাতায় চিনতে পারবেন তো?”

–” আপনাকে ভুললে তবে তো চেনার কথা আসতো। আপনাকেই যখন ভুলবো না তখন না চিনে উপায় আছে কি?”

–” আচ্ছা আমাকে মনেই বা রাখবেন কিভাবে?”

–” আপনার এলোকেশি চুল , গায়ে বেলি ফুলের সুমিষ্টি সুগন্ধি আর আপনার মায়াবী কন্ঠস্বর এই তিনটি নিজেই চিনিয়ে দিবে আপনাকে। আজ চলি তাহলে । জীবনের কোন এক অন্তিম পাতায় আবারো দেখা হচ্ছে দুজনের।”

লোকটি চলে যাবার পর আমিও আর বেশিক্ষণ থাকি নি সেখানে । একা একা ভালো লাগছিল না আমার। কেমন যেন একটা শূন্যতা অনুভব করছিলাম। দূরের ঝোপঝাড়ের আড়ালে তখন জ্বলে ওঠেছে জোনাকির আলো। আমি দরজা থেকে ওঠে আমার নির্দিষ্ট সিটে গিয়ে বসে পড়লাম। বাবা-মা, অথৈ তখনো ঘুমে। আমিও এবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।

সকালের মিষ্টি আলোয় ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। আমাদের ট্রেনটা তখন কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে থেমেছে। পাশে তাকিয়ে দেখলাম মা-বাবা ব্যাগগুলো সাজিয়ে একে একে হাতে নিচ্ছে । বাবা দুইটা ব্যাগ আর আমরা তিনজনে তিনটে ব্যাগ হাতে নিয়ে নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। ট্রেনে তখন হুলস্থুল কান্ড। সবাই ছুটোছুটি করে ট্রেন থেকে নামতে ব্যস্ত। কে যে কাকে পিছনে ফেলে নামছে তার ঠিক নেই। তবে আমার দৃষ্টি কিন্তু তাদের দিকে নেই। আমি এই ভিড়ের মাঝে খুঁজে চলেছি এক জোড়া মোটা ফ্রেমের চশমা। কিন্তু আমার নজরে তা এখনো তিনি পড়েন নি। স্টেশন থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি ঠিক করে চলে এলাম ফুপুর বাসায়। ফুপুরা তখন জেগেই ছিলেন। বাবাকে দেখে তো ফুফু কেঁদে একাকার। আমরা সবার সাথে দেখা করে চলে এলাম নিজ নিজ ঘরে। আমার ঠাঁই হলো অহনার ঘরে। অহনা তখনো কুম্ভকর্নের মতো ঘুমাচ্ছিল। আমি চুপি চুপি অহনার কাছে বসে ওর চোখের পাতার টেনে খুলে দিলাম। অহনার ঘুম ততক্ষণে ভেঙে গেছে। আমাকে পাশে বসে থাকতে দেখে হাতের বালিশ দিয়েই কয়েকটা মারল আমার পিঠে। আমি তো গো বেচারি। চুপচাপ মাইর খেলাম অহনার হাতে। তারপর দুই বোন মিলে বসে গেলাম গল্পের ঝুড়ি নিয়ে।

এভাবেই আনন্দের স্রোতে কেটে গেছে দুই দিন। আজ আমাদের বই মেলায় ঘুরতে যাওয়ার কথা। সকাল থেকেই আমি নীল রঙের শাড়ি পড়ে বসে আছি। মাথায় পড়েছি বেলি ফুলের গাজরা। অহনা পড়েছে আকাশি রঙের শাড়ি আর আমার মতোই চুলে লাগিয়েছি বেলি ফুলের গাজরা। পরিবারের সবাই যাচ্ছে বইমেলায়। যখন বই মেলায় পৌঁছালাম ঘড়িতে তখন এগারোটা বাজে। আমি আর অহনা দুজনে একস্টল থেকে অন্য স্টলে ঘুরে ঘুরে বই দেখছি । এমন সময় আমার চোখ আটকে গেল দূরের একটা স্টলে। যেখানে চেয়ারে বসে একজন সুদর্শন পুরুষ হেসে হেসে অন্য কারো সাথে কথা বলছেন। লোকটি আমার পরিচিত শুধু পরিচিতই নয় যাকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি গত দুই দিন ধরে। অহনা ইশারায় তাকে দেখাতেই বলে ওঠলো,

–” তুই জানিস কে ওনি?”

–” আরে জানার সময় পেলাম কখন, তার আগেই তো জনি কাব্যিক কথা বলে চলে গেলেন?”

–” ওনি আরশান মাহমুদ নিদ্র। একজন জনপ্রিয় লেখক তিনি।”

–” বাহ নামের সাথে সাথে দেখি গুনটাও অনেক ভালো। চল দেখা করে আসি।”

–” আরে দাড়া। ওনি তো কোন মেয়েকে সহ্য করতে পারেন না। তুই নিশ্চিত তো ইনিই তোর সেই ট্রেনওয়ালা ?”

–” এই তোর কি আমরা চোখ খারাপ বলে মনে হয় । চল তোকে এখনি প্রমান করে দিচ্ছি।”

কথাগুলো বলেই অহনাকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম স্টলের দিকে। স্টলের সামনে তখন অনেক ভীর । তবুও সবাইকে ঠেলে-ঠুলে এগিয়ে যেতে লাগলাম সামনের দিকে।
#শেষটাও_সুন্দর_হয়
# কিছুটা অভিমান কিছুটা খুনসুটি
#আমিনা_আফরোজ
#পর্ব:-০৩

( গল্পে ব্যবহৃত সব নাম, চরিত্র সম্পূর্ন কাল্পনিক। তাই এ নিয়ে কেউ কোন অহেতুক কথা বলবেন না আমাকে।)

কলি প্রকাশনির স্টলটার সামনে একা দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি। অহনা এতক্ষণ আমার পাশেই ছিল কিন্তু হঠাৎ কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল আর এদিকে মি. ট্রেনওয়ালা ক্যাবলাকান্তকে সেই কখন থেকে ডেকেই চলেছি কিন্তু তার কোন খোঁজ নেই। উনি ব্যস্ত আছেন ওনার পাঠকদের নিয়ে। এমন সময় অহনা পাশে এসে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো নীল রঙা মোলাটের একটা বই। বইটির কভারের ওপরে কালো রঙের কালিতে মোটা মোটা অক্ষরে লেখা আছে “বিষাদের নীল চিরকুট” । লেখকের নাম আরশান মাহমুদ নিদ্র। নামটা দেখতেই হঠাৎ আমার দু চোখে দ্রুতি খেলে গেল। অহনা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

–” এবার তোকে তোর মি.ট্রেনওয়ালার কাছে যেতে কে আটকায় দেখি।”

–” থ্যাংকু বোইনা। এত এত গুলা থ্যাংকু।”

কথাগুলো বলেই আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম অহনাকে। অহনা বরাবরই এমন। যে কোন সমস্যা সহজ উপায় পাওয়া যায় ওর কাছে ।

–” হয়েছে হয়েছে আমাকে আর আহ্লাদ দেখাতে হবে না। এবার তোর ক্যাবলাকান্তকে সামলা গিয়ে।”

–” আরে আমি একা যাবো নাকি । তুইও সাথে চল। ব্যাটাকে আজ মজা দেখাবো দুজন মিলে।”

–” ঠিক আছে চল তবে।”

” বিষাদের নীল চিরকুট” বইটি নিয়ে আমি ওনার সামনে এসে দাঁড়াতেই ওনি চোখ মেলে তাকালেন আমার দিকে। আমি তখন মিষ্টি হেসে বললাম,

–” একটা অটোগ্রাফ চাই।”

ওনি হাত বাড়িয়ে আমার থেকে বইটি নিয়ে বললেন,

–” নাম কি আপনার?”

মি.ট্রেনওয়ালার কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম । ওনি একরকম অপরিচিতের মতো কথা বলছেন কেন আমার সাথে? তবে কি ওনি কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ভুলে গেছেন আমাকে? কিন্তু গতকাল রাতে তিনি যে বললেন এ জীবনে তিনি কখনোই ভুলবেন না আমাকে। তবে কি আমার এলোকেশী চুল আর বেলি ফুলের সুমিষ্টি সুগন্ধি সবটাই ভুলে গেছেন ওনি। কথাগুলো ভাবতেই বিষন্ন হয়ে গেলে আমার হৃদয়ের যত্নে রাখা মনিকোঠা, যেখানে গতকাল তাকে ঠাঁই দিয়েছিলাম আমি।

–” মিস আপনার নামটা বললে খুশি হতাম।”

আমি কিছুটা বিষন্ন হয়েই বলে ওঠলাম,

–” অদ্রি ইসলাম।”

ওনি আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ অটোগ্রাফ দিয়ে বইটা ফেরত দিলেন আমাকে। আমিও আর আগ বাড়িয়ে কথা বলি নি তার সাথে। যে ভুলে যায় তাকে আর অযথা মনে করিয়ে দিয়ে কি লাভ। স্টল থেকে এবার বেশ কিছুটা দূরে এসেই দাঁড়ালাম। অহনা এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখেছে পুরো ব্যাপারটা। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও বলে ওঠল,

–” আমি তোকে আগেই বলেছিলাম এ তোর মি.ট্রেনওয়ালা হতেই পারে না। আরে একে আমি আরো বছর তিনেক আগে থেকেই চিনে। আজ পর্যন্ত এনাকে নিয়ে কম লেখালেখি হয় নি। তবে সবগুলো আর্টিকেলে একই লিখেছে সবাই,লোকটা নাকি ভীষন অদভুদ। মেয়েদের খুব একটা সহ্য করতে না পারলেও তিনি কিন্তু জনপ্রিয় হয়েছেন রোমান্টিক জনরার হাত ধরেই। ওনার লেখায় নাকি জাদু আছে।”

অহনার কথা শেষ না হতেই আমাদের সামনে এক বছর আট বয়সের একটি ছেলে এসে দাঁড়ালো। মনে হচ্ছে বেশ খানিকটা পথ দৌঁড়ে এসেছে সে। কিছুটা স্থির হতেই আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো একখানা নীল রঙের কাগজ। সেই সাথে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠল,

–” এই লন ভাবী আপনার চিঠি। ভাইজান আপন্যারে দিতে কইছে?”

–” কোন ভাইজান পাঠিয়েছে তোমাকে?”

–” এত কতা কওন যাইতো না ভাবি। মেলা কাম আছে আমার। এতক্ষণ দেরি করন যাইবো না। দেরি হইলে মহাজন পিটাইবো আমারে।”

কথাগুলো বলেই আমার হাতে সেই নীল চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে ছেলেটি আবারো ছুটে মিশে গেল জন স্রোতের মাঝে। আমি নিরুপায় হয়ে কাগজটির ভাঁজ খুলে মেলে ধরলাম। সেখানে মোটা মোটা অক্ষরে লেখা আছে,

” এই যে এলোকেশী , মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে না থেকে হাতে রাখা বইটা খুলে দেখুন আর হ্যা আপনাকে না এমন এলোকেশী হয়ে ঘুরতে না করেছি আমি। কারো নজর লেগে যাবে তো। চুলটা বেঁধে ফেলুন। ”
ইতি
আপনার মি.ট্রেনওয়ালা

চিঠিটা দেখেই আমার মনটা ক্ষনিকের মাঝেই আবারো ভালো হয়ে গেল। মনে স্বস্তি হলো মি.ক্যাবলাকান্ত তাহলে ভুলে যায় নি আমাকে। চিঠিটা অহনাকে দিয়ে বললাম।

–” পড়ে দেখ একবার চিঠিটা। খুব তো বলেছিলি তোদের নিদ্র মহাশয় কোন মেয়েকেই নাকি সহ্য করতে পারেন না , তাহলে এসব কি?”

আমার কথা শেষ না হতেই অহনা আমার হাত থেকে চিঠিটা একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়েই পড়তে শুরু করল। পড়া শেষ হতেই নিজের হাতে কপাল চাপড়িয়ে বলে ওঠল,

–” এসব কি দেখছি আমি। এই আমার চোখ ঠিক আছে তো? যে ছেলেটা আজ পর্যন্ত কোন মেয়েকে তার পাশে ঘেঁসতে দেয় নি ,সেই নাকি আজ তোকে এসব লিখেছে। দেখ দেখ চিঠির নিচে আবার লিখেছে ইতি তোমার মি.ট্রেনওয়ালা। বোইন আমি এবার নিশ্চিত এইটা আরশান মাহমুদ নিদ্র হতেই পারে না। এই ব্যাটা নিশ্চয় অন্য কেউ।”

–” এসব কি আবল-তাবল বকছিস বল তো। এইটা ঐ ব্যাটায়। তবে যাই বলিস মি.ক্যাবলাকান্ত কিন্তু একটা মিচকে লোক। লোককে দেখায় অন্য কিছু আর করে তার বিপরীত।”

–” এইডা তুই এক্কেবারে আমার মনের কথা কইছোস। এখন এত বকবক না করে বইটা খুলে দেখ ,সেখানে এমন কি লিখেছেন তোর মি. ট্রেনওয়ালা ক্যাবলাকান্ত। ”

–” ঠিক কথা মনে করেছিস। চল তো দেখি কি লিখেছে।”

নীল রঙের বইটা খোলার আগেই হঠাৎ বাবার ডাক শুনতে পেলাম আমরা। অগত্যা তখন আর বইটা খুলে দেখার সুযোগ হলো না আমাদের । তখনি ছুটে চলে গেলাম বাবাদের কাছে। বাবাদের কাছে পৌঁছে দেখলাম বাবা,মা আর ফুপিদের সামনে নীল রঙের পাঞ্জাবি পড়া এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে আর বাবা সেই ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। আমাকে দেখেই বাবা বলে ওঠলেন,

–” এই অদ্রি ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এদিকে আয় ,দেখে যা কে এসেছে?”

আমি আর অহনা দুজনে মিলে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম কিন্তু সামনে তাকিয়ে আমরা দুজনেই অবাক। আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং মি. ট্রেনওয়ালা ক্যাবলাকান্ত। আমি আর অহনা হা করে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। বাবা আমাদের এমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে ওঠলেন,

–” কি রে এভাবে হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কেন? চিনতে পারলি না তো?”

বাবার প্রশ্নে আমি আর অহনা দুজনেই মাথা নাড়িয়ে না বোধক ইঙ্গিত দিলাম। আসলে এখন সব কিছুই যেন আমাদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এইবার বাবা হাসতে হাসতে বলল,

–” আরে এইটা আমাদের নিদ্র। আমার ছাত্র আবার সেই সাথে আমাদের প্রতিবেশিও ছিল। ছোটবেলায় তুই যাকে নিদ্রদা বলে ডাক তি।”

এইবার সম্পূর্ণ ঘটনাটা খোলসা হলো আমার কাছে। ইনিই তাহলে নিদ্র দা ,যে ছোটবেলায় আমার জীবনটাকে তেজপাতা বানিয়ে ফেলেছিল। তারমানে ব্যাটা ক্যাবলাকান্ত আমাকে আগে থেকেই চিনেন। আর এই জন্যই সেদিন ট্রেনে তিনি এমন ব্যবহার করছিলেন আমার সাথে। আমি বাবার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এইবার সোজাসুজি তাকালাম মি.ক্যাবলাকান্তের দিকে। ওনি তখন আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন। তখন আমার সাথে ক্যাবলাকান্তের কথা না হলেও বার দুয়েক চোখাচোখি হয়েছিল আমাদের। তারপর বাবার থেকে বিদায় নিয়ে ওনি আবারো ওনার প্রকাশনীর স্টলের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমরাও আরো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রওনা দিলাম আমাদের গন্তব্যের দিকে। সময় তখন সন্ধ্যা হবে হবে এমন। আর কিছুক্ষণ পরেই পুরো শহরটাকে গ্রাস করবে নিকষ কালো অন্ধকার। অবশ্য এই ঝলমলে ঢাকা শহরে অন্ধকারের আধিপত্য নেই বললেই চলে। রাত যত বাড়তে থাকে, এই ঝলমলে ঢাকা শহরের জৌলুস ততটাই বাড়তে থাকে। সেই সাথে বাড়তে থাকে নানা রকমের মানুষের আনাগোনা, যাদের পুরো জীবনেই রয়েছে কোন না কোন গল্পের ঝুলি।

হ্যাপি রিডিং। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here