শেষটা সুন্দর পর্ব ১

বিয়ের পরের দিন সাত সকালে উঠে লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে নাস্তার প্লেইট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি নূর ভাইয়ার রুমের দরজার সামনে। অনেকক্ষন ধরে ডাকাডাকির পরে ও নূর ভাইয়া দরজা খুলছে না। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে দরজা ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম হয়েছে, সাথে আমার কোমল হাতটা ও লাল বর্ণ ধারন করেছে। কিন্তু উনার কোনো হেলদুল নেই। অন্যদিন এতক্ষনে উঠে দরজা খোলে উনার নীলাভ চোখ দুটো লাল করে আমার দিকে শকুনের দৃষ্টিতে তাকাত। না হয় বাঘের মতো গর্জন দিতো। কিন্তু না, আজ উনার কোন রিয়েকশান ই নেই। ব্যাপারটা আমার মোটে ও স্বাভাবিক লাগছে না।

মনটা কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু এক্টা খারাপ হয়েছে। সমাজে এক্টা কথা প্রচলিত আছে,,,,,

–“প্রিয় মানুষদের কোনো বিপদ আসলে নাকি আগে থেকেই এক্টা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মনটা কেমন কুহ গায়। সবকিছুই নাকি তখন অসহ্যকর লাগে। শরীর, মন দুটোই অস্থির হয়ে উঠে।”

আমার ক্ষেএে ও ঠিক এমনটাই হচ্ছে। মনটা কেমন আন চান আনচান করছে। ভয়ে বুকের ভিতরটা বার বার কেঁপে উঠছে। শরীরটা কেমন ঝড়ো হাওয়ায় হেলতু দুলতে থাকা গাছের মতো খটখট করে নড়ছে। এমনটা কি সারা রাত নির্ঘুমের কারণে হচ্ছে নাকি আসন্ন ভয় থেকে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। নাস্তার প্লেইট টা ও কেমন থরথর করে কাঁপছে। ভূমিকম্প হলে যেমন কাঁপন উঠে ঠিক তেমনি আমার পুরো দুনিয়াটা কেঁপে উঠছে। কিছুতেই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছি না। ভয়টা যেনো চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েই চলছে। প্রেসার ল হয়ে গেছে। সমানে ঘাম পড়ছে শরীর থেকে। লাল শাড়িটা ঘামে চুপচুপ হয়ে শরীরের সাথে চিপকে গেছে।

এই মুহূর্তে পুরো বাড়িটা ফাঁকা। আমাদের পুরো পরিবার রোজ আপুদের বাড়িতে গেছে। নিয়ম করে মৃত্যু ব্যক্তির চল্লিশ দিন পালন করতে।বাড়িতে শুধু আমি আর নূর ভাইয়া আছি। তাই খারাপ কিছু হওয়ার ভয়টা মাথায় ঝেঁকে বসেছে। কিছুতেই শরীরে জোর পারছি না।

আচ্ছা… খালি বাড়ি পেয়ে নূর ভাইয়া কিছু উল্টো পাল্টা করে বসবে না তো? না না এসব আমি কি অলুক্ষনে কথা ভাবছি। আমার নূর ভাইয়া কখনো খারাপ কিছু করতে পারে না। আমার নূর ভাইয়া খুবই স্ট্রং।

চাঁদনী এসব বলে নিজেই নিজেকে শান্তনা দিচ্ছে।

চাঁদনী আবার কপালে হাত দিয়ে কপালটা কুঁচকে দরজার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,,,,,

–“নূর ভাইয়া এখনো দরজাটা খুলছে না কেনো? উফফফ….. এই মুহূর্তে কে এসে আমাকে হেল্প করবে? ছেলে হলে না হয় এতক্ষণে দরজাটা ভেঙ্গে ফেলতাম। মেয়ে বলে কিছুই করতে পারছি না। এই মুহূর্তে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ বলে মনে হচ্ছে।”

কাল রাতেই নূর ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। হ্যাঁ…. আমি চাঁদ, আমার খালাতো ভাই নূর আবরারের সদ্য বিয়ে করা বউ। এই বিয়েতে আমার কোনো আপওি ছিলো না। উল্টো রাজি থাকার পার্সেন্টেইজ ছিলো আকাশ চুম্বী। কিন্তু নূর ভাইয়ার ঘোর আপওি ছিল এই বিয়েতে। বলতে পারেন, এক প্রকার বাধ্য হয়ে উনি আমায় বিয়ে করেছে। ফ্যামিলির জোরাজুরি আর খালামনির স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে। আমার প্রতি উনার কোনো প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই। আছে শুধু এক রাশ অভিমান। আমার নাকি উচিত হয় নি এই বিয়েতে রাজি হওয়া। আমি সব জেনে শুনে ও কেনো এই বিয়েতে রাজি হলাম। তাই জনাব আমার উপর প্রচন্ড রাগ করেছে। কাল সারা রাত রুমের দরজা খুলে নি। রুমের বাইরে ঠাঁয় বসেছিলাম আমি। উনি আমাকে একদম সহ্য করতে পারে না। ফুল সজ্জার খাট থেকে ঘাড় ধরে রের করে দিয়েছে আমায়। উনি এই বিয়ে মানে না, তাই আমার মুখ ও দর্শন করতে চায় না।

আচ্ছা আপনারাই বলুন, আমার ভুলটা কোথায়? যাকে সেই ক্লাস টেন থেকে পাগলের মতো ভালোবেসে এসেছি, তার সাথেই যদি হুট করে আমার বিয়ে ঠিক হয় তাও আবার পারিবারিক ভাবে তাহলে আমি রাজি হবো না কেনো? আলবাদ হবো। হাজার বার রাজি হবো। দরকার হলে জোর করে বিয়ে করব। আমার ভালোবাসা আমি ছিনিয়ে নিবো। উনি কিছুতেই বুঝতে চাইছে না, উপর ওয়ালা উনার বাঁ পাঁজরের হাঁড় দিয়ে আমাকে বানিয়েছে। তাই তো আমি উনার বউ হতে পেরেছি!

আঠারোর কৌঠায় পা দিয়েছি মাএ। অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে আছি। নূর ভাইয়া এম.বি.এ করছে। আমরা একই ভার্সিটিতে পড়ি। নূর ভাইয়া উনার ইয়ারমিট রোজ আপুকে প্রচন্ড রকম ভালোবাসত। স্যরি ভালোবাসত বললে ভুল হবে, এখনো ভালোবাসে। পাগলের মতো ভালোবাসে। আমি উনার জন্য যতোটা উন্মাদ, উনি ও ঠিক রোজ আপুর জন্য ততোটা উন্মাদ।

সম্পর্কে রোজ আপু নূর ভাইয়ার ফুফাতো বোন। রোজ আপুদের বাড়ি আমড়া তলি। আমাদের নানুর বাড়ির পাশের বাড়িটাই রোজ আপুদের বাড়ি। নূর ভাইয়াদের বাড়িতে থেকেই রোজ আপু পড়া শোনা করত। আর এখান থেকেই ভাব, ভালোবাসা। উনাদের বিয়েটা ও প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত বিয়েটা আর হয়ে উঠে নি।

চল্লিশ দিন আগে আমরা সবাই হৈ হুল্লোড় করে রোজ আপুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার পরিবার, নূর ভাইয়ার পরিবার, জায়মার পরিবার আমরা সবাই অনেক বড় এক্টা বাস রিজার্ভ করে লম্বা ভ্রমনে বের হয়েছিলাম। রোজ আপুদের বাড়ি থেকে নানুর বাড়িতে ও গিয়েছিলাম। ঐ খান থেকে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তা পাড় হওয়ার সময় ভুলবশত রোজ আপুর কার এক্সিডেন্টে হয়। পুরো দমে থেতলে গিয়েছিলো উনার শরীরটা। নূর ভাইয়া রোজ আপুর লাশের সামনে রক্তে ভেজা সাদা শার্ট টা নিয়ে নির্বাক ভাবে বসেছিলেন। উপর দিয়ে উনাকে নির্বাক দেখা গেলে ও ভিতরে ভিতরে উনার তীব্র আর্তনাদ আর আহাজারির আওয়াজ আমার কান পর্যন্ত ভেসে আসছিলো। আমি কান পেতে শুনেছি উনার বোবা চিৎকার। আর ভিতরে ভিতরে নূর ভাইয়ার জন্য কষ্টে ফেঁটে গেছি।

উফফফ…এখন এসব ভাবলে হবে না, যেকোনো মূল্যেই হোক রুমের ভিতর ঢুকতে হবে আমায়। যেকোনো এক্টা উপায় বের করতেই হবে।

চাঁদনী খাবারের প্লেইটটা হাত থেকে ছুড়ে মেরে উন্মাদের মতো দরজায় একের পর এক লাথি, কিল, ঘুষি মেরেই যাচ্ছে। এতে কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না, উল্টো চাঁদনীর হাত কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এই নিয়ে চাঁদনীর মাথা ব্যাথা নেই। চাঁদনীর এখন এক্টাই মাথা ব্যাথা, দরজা খুলে নূরের কাছে যাওয়া। যতোক্ষন পর্যন্ত নূরের কাছে যেতে না পারবে ততক্ষন সে শান্তি হবে না।

চাঁদনীর চোখ দিয়ে সমানে পানি পড়ছে আর জোরে চিৎকার দিয়ে বলছে,,,,

–“নূর ভাইয়া…প্লিজ দরজাটা খুলো। আমার খুব টেনশান হচ্ছে । আমাকে এভাবে আর কষ্ট দিও না। তুমি যা চাইবে তাই হবে। আমি আর কখনো তোমার চোখের সামনে আসব না। তারপর ও তুমি দরজাটা খুলো ভাইয়া। প্লিজ দরজাটা খোল।”

কথা গুলো বলে কান্না করতে করতে চাঁদনী নিচে লুটিয়ে পড়ল। তারপরে ও নূরের কোনো খবর নেই। চাঁদনী এবার বসা থেকে উঠে চোখের পানি গুলো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে বাড়ির মেইন গেইটে চলে এলো। হাত থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত গুলো চাঁদনীর পুরো মুখে লেপ্টে গেছে। মেইন গেইটের সামনে এসেই চাঁদনী দৌঁড়ে পাশের দুতলা বিশিষ্ট বাড়িটায় ঢুকে পড়ল।

ক্রমাগত দরজা ধাক্কানোর পর দরজা খুলে একজন মহিলা বের হলো। চাঁদনী মহিলাটির হাত ধরে কান্নাসিক্ত চোখে বলে উঠল,,,,

–“আন্টি আমি আপনাকে তেমন চিনি না। তবে আমি আপনার প্রতিবেশী। প্লিজ আমাকে এক্টা হেল্প করুন। আপনার বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ থাকলে আমার সাথে আমার বাড়িতে আসতে বলুন, প্লিজ।”

চাঁদনীর হাতের প্রবাহমান রক্ত দিয়ে মহিলাটির হাত রঙ্গিন হয়ে গেলো। চাঁদনীর মুখে ও রক্ত লেগে আছে। চাঁদনীকে এই অবস্থায় দেখে মহিলাটির চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।

মহিলাটি চিন্তিত হয়ে চাঁদনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,,,,

–” কি হয়েছে মা? তোমাকে এতো বিভৎস দেখাচ্ছে কেনো? হাতে, মুখে রক্ত লেগে আছে। কি হয়েছে তোমার আমাকে বলো?”

চাঁদনী এবার হেচকি তুলে বলল,,,

–“সকাল থেকে আমার হাজবেন্ড দরজা খুলছে না আন্টি। বাসায় কেউ নেই। বাসার সবাই অনেক দূরে আমাদের এক আত্নীয়ের বাড়িতে গেছে। আমার অনেক ভয় লাগছে আমার হাজবেন্ডের জন্য। প্লিজ আন্টি আপনার বাসায় কোনো পুরুষ মানুষ থাকলে আমাকে হেল্প করতে বলুন।”

মহিলাটি আর কথা না বাড়িয়ে সোজা রুমে ঢুকে গেলো। চাঁদনী সদর দরজার সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর মহিলাটি দুজন পুরুষ নিয়ে রুম থেকে বের হলো। একজন উনার বর, আরেক জন উনার দেবর।

পুরুষ দুটো দৌঁড়ে চাঁদনীদের বাড়িতে ঢুকে গেলো। চাঁদনী ও ওদের পিছু পিছু দৌঁড়াচ্ছে। খালি পায়ে হাঁটার কারণে চাঁদনীর পায়ে লোহা জাতীয় কিছু এক্টা ঢুকে গেছে। চাঁদনী আহ্ বলে এক্টা চিৎকার দিয়ে ধপ করে নিচে বসে পড়ল। চাঁদনীর পিছনে থাকা মহিলাটি দৌঁড়ে এসে চাঁদনীর পাশে বসে পড়ল। চাঁদনী পা টা এক্টু উঁচু করে নাক মুখ খিঁচে লোহাকে পা থেকে টান দিয়ে বের করে নিলো। সাথে সাথে পা দিয়ে বাঁধ ভাঙ্গা রক্ত গড়াতে আরম্ভ করল। মহিলাটি চাঁদনীর পা চেপে ধরে চাঁদনীর দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে বলল,,,,

–“ইসস অনেক খানি কেটে গেছে। রক্ত গড়িয়ে ভেসে যাচ্ছে। এখনি তোমার পায়ে এন্টিসেপটিক লাগাতে হবে। না হয় পরবর্তীতে অনেক প্রবলেম হবে। এক্টা এটিএস ও দিতে হবে। লোহার আঘাত কিন্তু খুব মারাত্নক।”

চাঁদনী ওর পা থেকে মহিলার হাতটি সরিয়ে কান্না সিক্ত কন্ঠে বলে উঠল,,,,,

–“আন্টি, এখন আমাকে নিয়ে ভাবার সময় নেই। আমার স্বামী সেইফ আছে কি না আগে আমার ঐটা দেখতে হবে।”

চাঁদনী বসা থেকে উঠে যেই না পা টা নিচে রাখল অমনি সে ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠল। মহিলাটি চাঁদনীকে খপ ধরে ফেলল। চাঁদনী এক্টা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে মহিলাটির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চোখ বুজে সামনে কদম বাড়াল। এরপর যতো স্পিডে পারল দৌঁড়াতে লাগল।

চাঁদনীর পায়ের প্রতিটা ছাপ রক্ত দিয়ে রঙ্গিন হয়ে আছে। চাঁদনী দৌঁড়াচ্ছে আর রক্ত গড়িয়ে পায়ের ছাপ গুলো আরো স্পষ্ট হচ্ছে। সনাতন ধর্মে যেমন নতুন বউদের আলতা রাঙ্গা পায়ের ছাপ এক্টা সাদা কাপড়ে নেওয়া হয় ঠিক তেমনি চাঁদনীর রক্তে রঙ্গিন হওয়া পায়ের ছাপ মাটি তার গায়ের উপর মাখিয়ে নিচ্ছে।

মহিলাটি হতবাক হয়ে যাচ্ছে চাঁদনীর এমন অদ্ভুত উন্মাদনা দেখে। মহিলাটি আর দাঁড়িয়ে না থেকে চাঁদনীর পিছু পিছু দৌঁড়াতে লাগল।

*
*

পুরুষ দুটো নূরের রুমের দরজাটা ইচ্ছে মতো ধাকাচ্ছে। চাঁদনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে আর কান্না করছে। এই মুহূর্তে ওর কিছু করার নেই। আয়মন ও বাড়িতে নেই। ঢাকা গেছে অফিসের কাজে। চাঁদনীর বাড়িতে এখন খবরটা দিলে ওদের আসতে আসতে অনেকটা লেইট হয়ে যাবে। চাঁদনী কিছুতেই লেইট করতে চায় না। তাই সে প্রতিবেশীদের ডেকে এনেছে।

প্রায় দশ মিনিট পর পুরুষ দুটো সক্ষম হয়েছে রুমের দরজাটা ভাঙ্গতে। দরজা ভাঙ্গার সাথে সাথেই পুরুষ গুলো আর চাঁদনী হুড়মুড়িয়ে রুমের ভিতর ঢুকে গেলো। রুমে ঢুকেই চাঁদনী নূর ভাইয়ায়ায়ায়ায়া বলে এক বুক ফাঁটা চিৎকার দিয়ে উঠল।

নূর চিৎ হয়ে খাটের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। মাথাটা ডান দিকে হেলে আছে। দুই হাত দুই দিকে ছিটকে রয়েছে। এক হাতে স্লিপিং পিলের ছোট্ট এক্টা কাঁচের বোতল দেখা যাচ্ছে। চোখ জোড়া আবদ্ধ হয়ে দু এক ফোঁটা জল চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে।

চাঁদনী দৌঁড়ে গিয়ে নূরের পাশে ধপ করে বসে পড়ল। চাঁদনী ওর দুহাত দিয়ে নূরকে টেনে সোজা করল। নূরের নেতিয়ে যাওয়া বিবর্ণ মুখটা দেখে চাঁদনী নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারল না। নূরের বুকে মাথা ঠেকিয়ে ইচ্ছে মতো হাউ মাউ করে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল চাঁদনী। রাগে, জেদে চাঁদনী ওর চুলগুলো উন্মাদের মতো টানতে লাগল। হাত, পা দিয়ে অঝড়ে রক্ত পড়ছে চাঁদনীর। চোখের সামনে হাজবেন্ডকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখলে কোনো স্ত্রী ই নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না।

মহিলাটি দৌঁড়ে এসে চাঁদনীকে জড়িয়ে ধরল। চাঁদনী হাত পা ছুড়া ছুড়ি করে কান্না করছে। পুরুষ দুটো জলদি করে এ্যাম্বুলেন্সে কল করল। আর বেশিক্ষণ এভাবে পড়ে থাকলে নূরকে হয়তো বাঁচানো সম্ভব হবে না। চাঁদনী চিৎকার করছে আর বলছে,,,,

–“কেনো আপনি এটা করলেন নূর? উপর ওয়ালার ইচ্ছে হয়েছে তাই উনি রোজ আপুকে নিয়ে গেছে। আপনি কেনো ইচ্ছে করে আপনার জীবন খোঁয়াতে চাইছেন? একবার ও আমাদের কথা মনে পড়ে নি আপনার? আমি না হয় আপনার কিছু না। আপনি আমাকে বউ হিসেবে মানেন না। কিন্তু আপনার পরিবার? ওরা কি দোষ করেছে? কেনো আপনি ওদের শাস্তি দিতে চাইছেন?”

কাঁদতে কাঁদতে চাঁদনীর গলা ফেটে গেছে। শরীরটা ও আস্তে আস্তে অসাড় হয়ে আসছে। চাঁদনীর হাত পা থেকে এখনো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মহিলাটি কিছুতেই চাঁদনীকে দমিয়ে রাখতে পারছে না। চাঁদনী আগের মতোই ভাঙ্গা গলা নিয়ে হাত পা ছুড়া ছুড়ি করে কাঁদছে।

প্রায় দশ মিনিট পর এ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছে গেলো চাঁদনীদের বাড়ির মেইন গেইটের সামনে। লোক দুটো ধরাধরি করে নূরকে খাট থেকে নামিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে বাড়ির মেইন গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এ্যাম্বুলেন্সটায় উঠিয়ে দিলো। চাঁদনী ও ওদের পিছু পিছু চলে এলো। শাড়ির আঁচলটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। খুড়িয়ে খুড়িয় হাঁটছে চাঁদনী। পায়ের ক্ষতটা ক্রমাগত ইনফেকশনের দিকে চলে যাচ্ছে। মুখে লেগে থাকা রক্ত গুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর পর আবার নোনাজলে রক্ত গুলো ধুয়ে মুছে বুকের ভিতর ঘাম হয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

নূরকে স্ট্রেচারে করে এ্যাম্বুলেন্সে ঢুকানোর সাথে সাথেই চাঁদনী এ্যাম্বুলেন্সের ভিতর ঢুকে গেলো। স্ট্রেচার ধরে চাঁদনী নূরের বুকে মাথা রেখে অঝড়ে কাঁদছে। গলা দিয়ে সাউন্ড বের হচ্ছে না। শুধু চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। লোক দুটো ও এ্যাম্বুলেন্সে বসে পড়ল সাথে মহিলাটি ও। চাঁদনী নূরকে টাইট করে ধরে রেখেছে। অথচ নূর চোখ দুটো বন্ধ করে গভীর তন্দ্রায় আছে। চাঁদনীর আহাজারি দেখার মুখ্য মানুষটাই এখন চোখ বুজে রেখেছে। চাঁদনী ভাঙ্গা গলা নিয়ে কিছুক্ষন পর পর হেঁচকি তুলছে।

এ্যাম্বুলেন্স রওনা হলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে। ড্রাইভার এ্যাম্বুলেন্সের স্পিড সর্বোচ্চ বাড়িয়ে দিয়েছে। মহিলাটি চাঁদনীর পাশে বসে চাঁদনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

প্রায় পনেরো মিনিট পর এ্যাম্বুলেন্স এসে চট্টগ্রাম হসপিটালের সামনে পৌঁছে গেলো। দুটো নার্স এসে এ্যাম্বুলেন্সের ভিতর ঢুকে স্ট্রেচার ধরে নূরকে বের করল। চাঁদনী ও পাগলের মতো নূরের স্ট্রেচার ধরে নার্সদের পিছু পিছু ছুটল। চাঁদনীর স্ট্রেট লম্বা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে বদ্ধ উন্মাদের মতো হয়ে আছে। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ মুখটা নেতিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। গোলাপী ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে।

নূরকে এক্টা বড় কেবিনে ঢুকিয়ে নিলো নার্সরা। চাঁদনী ও আছে ওদের সাথে। হুট করে দুজন ডক্টর এসে কেবিনে ঢুকে পড়ল। এদের মধ্য থেকে একজন ডক্টর চাঁদনীকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,

–“প্লিজ ম্যাম, আপনি এই কেবিন থেকে বের হয়ে যান। আউট পার্সন এখানে এলাউড না। আপনি থাকলে আমাদের ট্রিটমেন্টে অসুবিধা হবে।”

চাঁদনী ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে চোখে হাজারো নোনা জল নিয়ে ডক্টরের কাছে হাত জোর করে বলল,,,,,

–“প্লিজ স্যার, আমি আপনার কাছে হাত জোর করছি। আমাকে নূর ভাইয়ার কাছে থাকতে দিন। কথা দিচ্ছি আমার কারণে আপনাদের ট্রিটমেন্টের কোনো অসুবিধা হবে না।”

ডক্টর রা চাঁদনীর কথা মানতে নারাজ। উনারা কোনো রকমেই চাঁদনীকে কেবিনে এলাউড করছে না। চাঁদনী শেষ মেশ বেডের পাশে থাকা ডেস্কের উপর থেকে পানির গ্লাসটা দেয়ালের সাথে আঘাত করে ভাঙ্গা গ্লাসের এক্টা টুকরো নিয়ে ওর ডান হাতের কব্জিতে ধরে জোরে চিৎকার দিয়ে বলল,,,,

–“আপনারা যদি আমার শর্তে রাজি হন তাহলে আমি এখনি এই মুহূর্তে আমার হাতের রগ কেটে ফেলব। তখন এর দায় ভার কিন্তু আপনাদের নিতে হবে।”

দুজন ডক্টরই শুকনো ঢোক গিলে এক জন আরেক জনের দিকে তাকাল। এক পর্যায়ে ওরা বাধ্য হয়ে চাঁদনীর শর্ত মেনে নিলো। হুট করে একজন নার্স এসে চাঁদনীকে ঝাঁকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,,,,

–“প্লিজ ম্যাম আপনি শান্ত হোন। আপনি ও কিন্তু ইনজোরড। হাত, পা থেকে রক্ত পড়ছে আপনার। এভাবে আর কিছুক্ষন রক্ত গড়াতে থাকলে, আপনার শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। আপনার ইমেডিয়েট ট্রিটমেন্টের দরকার।”

#চলবে,,,,,,,

#শেষটা_সুন্দর
#সিজন_টু
#সূচনা_পর্ব
#নিশাত_জাহান_নিশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here