শেষটা সুন্দর পর্ব ২

#শেষটা_সুন্দর
#সিজন_২
#পার্ট_২
#নিশাত_জাহান_নিশি

–“প্লিজ ম্যাম আপনি শান্ত হোন। আপনি ও কিন্তু ইনজোরড। হাত, পা থেকে রক্ত পড়ছে আপনার। এভাবে আর কিছুক্ষন রক্ত গড়াতে থাকলে, আপনার শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। আপনার ইমেডিয়েট ট্রিটমেন্টের দরকার।”

হুট করে চাঁদনী নার্সটার হাত দুটো ওর হাতের মুঠিতে আবদ্ধ করে ভাঙ্গা গলা আর চোখে জল নিয়ে বলল,,,,,

–“প্লিজ ম্যাম, আপনি ডক্টরস দের বলুন আমার নূরকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দিতে। এই ভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় আমি ওকে দেখতে পারছি না। ভিতরটা চিনচিন করছে। কেমন এক্টা অসহ্যকর ব্যাথা হচ্ছে। আমার ও খুব ইচ্ছে করছে এই ভাবে ওর মতো চোখ দুটো বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তে। দেখুন না… কেমন নিথর হয়ে পড়ে আছে সে। আচ্ছা সে কি বুঝে না? ওর চাঁদ ওর জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছে।”

চাঁদনী কয়েকটা নিশ্বাস একসাথে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল,,,,,,,,

–“আপনি এক কাজ করুন… আমাকে ও কয়েকটা স্লিপিং পিল এনে দিন। সাথে এক গ্লাস পানি ও দিবেন। আমি ও ওর মতো ঘুমিয়ে পড়তে চাই। দুজনে এক্টা বেড শেয়ার করে থাকব। এরপর আপনারা একসাথে আমাদের দুজনের ট্রিটমেন্ট করবেন।”

নার্সটার চোখে পানি চলে এসেছে। এই অবস্থায় চাঁদনীকে উনার কি বলে শান্তনা দেওয়া উচিত উনি ঠিক বুঝে পাচ্ছে না। তবে উনি এটা বুঝতে পেরেছে,,,,,,

–“ভালোবাসা মানেই এক্টা প্রখর উন্মাদনা। যে এই উন্মাদনার শিকার হয়েছে কেবল সে ই বুঝেছে, ভালোবাসার মানুষটার মতো মূল্যবান কোনো বস্তু পৃথিবীতে দুটো হয় না। ভালোবাসাটার মানুষটাকে আকাশের দুর্লভ চাঁদের সাথে তুলনা করা যায়। শুধু দুর্লভ চাঁদ কেনো বলছি…. পৃথিবীতে যা কিছু আমাদের ধরা ছোঁয়ার মধ্যে থাকে এই সবকিছুর সাথেই ভালোবাসার মানুষটাকে তুলনা করা যায়। যেমন ধরুন চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষএ, তাঁরা, রংধনু, আকাশ, বাতাস, মরিচীকা। ভালোবাসা যেমন সরলতা শেখায়। তেমনি দুর্বলতা ও শেখায়। দুর্বলতার কারণেই এক্টা মানুষের মধ্যে এতো শতো উন্মাদনার সৃষ্টি হয়। যেটা চাঁদনীকে দেখে উনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।”

চাঁদনীর অবস্থা দেখে নার্স বুঝে গেছে, এই মুহূর্তে চাঁদনীকে কিছু বলাটাই বেকার। ভালোবাসার মরণে মরেছে সে। সম্পূূর্ণ হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য এক্টা জড় পদার্থে পরিণত হয়েছে। এখন চাঁদনীর শক্ত এক্টা শান্তনার হাত প্রয়োজন। তাই উনি কথা না বাড়িয়ে চাঁদনীর পিঠে উনার এক হাত দিয়ে চাঁদনীকে আবদ্ধ করে কেবিনের এক্টা কোণায় দাঁড়িয়ে পড়ে। এরপর চাঁদনীর কানে ফিসফিসিয়ে বলে,,,,,

–“আমরা দুজন এখানে চুপটি করে দাঁড়িয়ে সব দেখব। তুমি কিন্তু মুখ দিয়ে এক্টা ওয়ার্ড ও উচ্চারণ করবে না। না হয় তোমার বরের ট্রিটমেন্টের প্রবলেম হবে। ইস দেট ক্লিয়ার?”

চাঁদনী ও নার্সের কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,,,

–“আমি কখনো চাইব না, আমার জন্য আমার বরের ট্রিটমেন্টে প্রবলেম হোক। এই দেখো, আমি মুখে তালা ঝুলিয়ে দিলাম। আমি শুধু আমার নূরকে দুচোখ ভরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব।”

কথাগুলো বলেই চাঁদনী ঠোঁটে এক আঙ্গুল দিয়ে ঠোঁট দুটো আবদ্ধ করে রাখল। নার্সটা চাঁদনীর ছেলে মানুষী দেখে মনে মনে হেসে দিলো।

ডক্টররা নূরের মুখে মোটা এক্টা পাইপ জাতীয় নল ঢুকিয়ে দিলো। নলটা অনেক বড়। দেখে মনে হচ্ছে পেট পর্যন্ত যাবে। হাতে থাকা এক্টা মেশিন দিয়ে ডক্টররা অনবরত মুখের নলটায় চাপ দিচ্ছে। নূর ভাইয়ার পেটের ভিতর থেকে কেমন এক্টা গড়গড় আওয়াজ আসছে। পেটের ভিতর থেকে কিছু এক্টা বের হয়ে সোজা মেশিনটায় এসে পড়ছে। নূর ভাইয়া কিছুক্ষন পর পর নড়ে চড়ে উঠছে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। মুহূর্তেই বিবর্ণ মুখটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। নলের একেক টা চাপে নূর ভাইয়া লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে উঠছে। দেখে মনে হচ্ছে নূর ভাইয়া খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমার গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে। চোখের সামনে এসব দেখতে পারছি না। শরীরটা কেমন হিম শীতল হয়ে আসছে। দুর্বল লাগছে খুব। ঘুম, খাওয়া, ক্লান্তি, বিষন্নতা, ভয়, যন্ত্রনা এই ছয়ের মিশ্রণে আমার শরীরটা আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ছে। হয়তো এখনি দিশা ভুলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ব।

হুট করে নার্সটা উনার হাতের বেড়িতে চাঁদনীকে আরো জোরে আবদ্ধ করে মিনমিন করে বলল,,,

–“ভয় পাবেন না। স্লিপিং পিল গুলো ওয়াশ করে ভিতর থেকে বের করা হচ্ছে। তাই আপনার হাজবেন্ড এমন লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। পিল গুলো শরীরের ভিতর বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে তাই নল দিয়ে টেনে বের করা হচ্ছে। এক্টু পরেই আপনার স্বামী সুস্থ হয়ে উঠবে।”

চাঁদনী ওর মাথায় হাত দিয়ে চোখ মুখ কুচকে নার্সকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,

–“আপু….. আমি যদি হুট করে সেন্সলেস হয়ে যাই, তাহলে প্লিজ… আপনি আমার বরকে দেখে রাখবেন।”

চাঁদনী কিছুটা থেমে আবার বলল,,,,

–“জানেন আপু…আমি কিছুতেই চোখ বুজতে চাইছি না বাট আমার শরীরের দুর্বলতা আমাকে আস্তে আস্তে মিইয়ে দিচ্ছে।”

চাঁদনীর কথা গুলো শুনে নার্স চাঁদনীকে আরো টাইট করে হাতের বন্ধনীতে আবদ্ধ করে রাখল।

চাঁদনী নার্সটার হাত ধরে নিভু নিভু চোখ নিয়ে বেডে শোয়ে থাকা নূরের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল,,,,

–“আচ্ছা…এখন যদি আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি, তবে চোখ খুলে নূর ভাইয়াকে দেখতে পাবো তো? খুব করে চাই, আল্লাহ্ যেনো নূর ভাইয়ার বদলে আমাকে নিয়ে নেয়। নূর ভাইয়া বেঁচে থাকুক হাজার হাজার বছর ধরে। আমি প্রতি রাতে সাদা কাপড় পড়ে নূর ভাইয়াকে এক্টা নজর দেখে যাবো। আর এতেই আমার শান্তি। তখন নিশ্চিন্তে চোখ বুজে ও শান্তি পাবো। ইসসসস… ঐ দিন যদি উপর ওয়ালা রোজ আপুকে না নিয়ে আমাকে নিয়ে যেতো, তবে হয়তো আজ এই দিনটা দেখতে হতো না। আমি চিরতরে চোখ বুজে ফেলতাম, আর নূর ভাইয়া চুটিয়ে সংসার করত। আমি না হয় দূর থেকে দেখে দেখে হাসতাম আর চোখের নোনাজলে নিজের মনটাকে ভাসিয়ে দিতাম।”

চাঁদনী কথা গুলো বলতে বলতেই সেন্সলেস হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। নার্সটা চিৎকার করতে নিয়ে ও মুখটা হাত দিয়ে চেঁপে ধরল। নূরের ট্রিটমেন্টে চলছে, এই কেবিনে কোনো রকম চিৎকার চেচাঁমেচি করা যাবে না। নার্সটা এদিক সেদিক তাকিয়ে ডেস্কের উপর থেকে পানির জগটা এনে সমানে চাঁদনীর চোখে মুখে ছিটাতে থাকে। অনেকক্ষন পানি ছিটানোর পরে ও চাঁদনীর হুশ আসছে না। নার্সের বুঝা হয়ে গেছে চাঁদনীকে ইমিডিয়েট স্যালাইন পুশ করতে হবে। অবিরাম হাত, পা দিয়ে রক্ত গড়ানোর ফলে এমনটা হয়েছে। সামান্য পানি ছিটিয়ে ওর হুশ ফিরানো যাবে না।

নার্সটা পড়েছে মহা ফ্যাসাদে। এ কূল ও কূল দু কূল ই বন্ধ। যতক্ষন পর্যন্ত নূরের ভেতরটা সম্পূর্ণ ভাবে ওয়াশ করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কেবিনের দরজা খোলা যাবে না। এই দিকে চাঁদনীর অবস্থা ক্রমবৃদ্ধিমান হারে খারাপের দিকে যাচ্ছে। নার্সটি এবার নিরুপায় হয়ে উনার কোলে চাঁদনীকে শুইয়ে দিলো।

*
*

প্রায় এিশ মিনিট পর,,,,,

নূর দশটা স্লিপিং পিল এক সাথে খেয়েছে। ঠিক টাইমে হসপিটালে আনা হয়েছে বলে নূরকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। ওয়াশ করার পর নূরের হাতে এক্টা স্যালাইন পুশ করে ডক্টররা রুম থেকে বের হয়ে গেলো। নার্সটা হুড় মুড়িয়ে বসা থেকে উঠে চাঁদনীর মাথাটা সাবধানে ফ্লোরের উপর রেখে কেবিন থেকে বের হয়ে আরেকজন নার্সকে নিয়ে এলো। এরপর দুজন মিলে ধরাধরি করে চাঁদনীকে নূরের পাশের কেবিনটাতে শিফট করে দিলো।

চাঁদনীর প্রতিবেশি মহিলাটি নার্সদের সাথে সাথে চাঁদনীর কেবিনে ঢুকে গেলো। উনি অলরেডি নূরের আব্বু হাবিব আবরারকে ফোন করে নূরের ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছে। ওরা সবাই হম্বিতম্বি হয়ে হসপিটালে ছুটে আসছে।

চাঁদনীর হাতে স্যালাইন পুশ করা হয়েছে। সাথে পায়ের ইনফেকশানের জন্য এ.টি.এস ও দেওয়া হয়েছে। হাত এবং পায়ের জখম গুলো স্যাভলন দিয়ে ওয়াশ করে মেডিসিন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। চাঁদনী এখনো সেন্সলেস অবস্থায় পড়ে আছে। মুখটায় কেমন কালসেটে ভাব পড়ে গেছে। খুবই বিধ্বস্ত লাগছে চাঁদনীকে।

*
*

প্রায় এক ঘন্টা পর,,,,,,

সাবরিনা আবরার, হাবিব আবরার, নীড় আবরার ওরা তিনজনই দৌঁড়ে এসেছে চট্টগ্রাম হসপিটালে। সাবরিনা আবরার কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটো ফুলিয়ে ফেলেছে। হাবিব আবরার আর নীড়ের চোখে মুখে প্রবল উওেজনার সাথে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট ভেসে উঠেছে।

হসপিটালের রিসিপশান থেকে নূরের কেবিন নাম্বার নিয়ে ওরা তিনজনই দুতলায় ১১২ নম্বর কেবিনের উদ্দেশ্য দ্রুত পায়ে হাঁটত লাগল। কেবিনের ভিতর ঢুকতেই সবাই মুখে হাত দিয়ে কান্নায় ফেঁটে পড়ল। নূর চোখ দুটো বন্ধ করে সোজা হয়ে বেডের উপর শুয়ে আছে। হাতে ক্যানেলা লাগানো। স্যালাইন চলছে পুরো দমে। উজ্জ্বল ফর্সা মুখটা বিবর্ণ হয়ে আছে। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কোনো নড়া চড়া নেই। নির্বাক হয়ে শুয়ে আছে।

ওরা তিনজনই বেডের খালি জায়গায় বসে পড়ল।নূরের আম্মু নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে গোঙ্গিয়ে গোঙ্গিয়ে কাঁদছে আর মৃদ্যু চিৎকার দিয়ে বলছে,,,,,

–“এই তুই কি করলি বাবা? শুধু মাএ এক্টা মেয়ের জন্য নিজের জীবনের এতো বড় রিস্ক নিলি? তোর কিছু হলে আমরা কি নিয়ে বাঁচব বাবা। তুই যে আমাদের চোখের মণি। আমার কলিজার টুকরো ছেলে। আমি তোকে ছাড়া মোটে ও বাঁচব না বাবা।”

কথাগুলো বলেই উনি নূরের চোখে মুখে চুমো খেতে খেতে আবার বলল,,,,

–“আল্লাহ্ তা’আলার কাছে অশেষ শুকরিয়া, আমার ছেলেটাকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য। এবার থেকে আমি আর আমার ছেলেকে চোখের আড়াল হতে দিবো না।”

নূরের আব্বুর চোখে পানি টলমল করছে। নীড়ের চোখে হাজারো নোনাজল ভীড় জমিয়েছে তবে সে চোখের জল গুলোকে বার বার লুকোনোর চেষ্টা করছে। পরিবারের বড় ছেলেই যদি ভেঙ্গে পড়ে, তবে ঐ পরিবারকে শান্তনা দিবে কে? তাই সে নিজেকে যথেষ্ট পরিমান স্ট্রং রাখার চেষ্টা করছে।

হুট করে সাবরিনা আবরারের চাঁদনীর কথা মনে পড়ল। উনি অশ্রুসিক্ত চোখে নীড়ের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,

–“চাঁদ কোথায়? চাঁদ ঠিক আছে তো?”

নীড় আর হাবিব আবরার হম্বিতম্বি হয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। কেবিন থেকে বের হয়েই হাবিব আবরার প্রতিবেশী মহিলাটির ফোনে কল লাগাল। মহিলাটি ফোনটা রিসিভ করার সাথে সাথেই হাবিব আবরার উওেজিত কন্ঠে বলে উঠল,,,,

–“জেরিন, চাঁদ মা কোথায়? হসপিটালে এসে শুধু নূরকে পেয়েছি। কিন্তু চাঁদ মা কে কোথাও দেখতে পেলাম না। তুমি জানো চাঁদ মা কোথায়?”

মহিলাটি পাশের কেবিন থেকে বের হয়ে সোজা হাবিব আবরার আর নীড়ের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। দুজনই কিছুটা অবাক হয়ে হলো। মহিলাটি ওদের দুই জনের সামনে দাঁড়িয়ে কান্না কান্না মুখ করে বলল,,,,

–“আপনার পুএ বধূ পাশের কেবিনেই আছে। সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে। হাত, পা কেটে অঝড়ে ব্লাডিং হয়েছে। নার্সরা স্যালাইন পুশ করে রেখেছে। প্লিজ আপনারা আমার সাথে চলুন।”

নীড় কপাল কুচকে কপালে হাত দিয়ে রেখেছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারছে না সে। হাবিব আবরার মহিলাটির সাথে চাঁদনীর কেবিনে ঢুকে গেলো।

চাঁদনীকে সেন্সলেস অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে হাবিব আবরারের বুকটা কেঁপে উঠল। চোখে জল ভরে এলো। উনি দৌঁড়ে গিয়ে চাঁদনীর বেডের পাশে চেয়ার পেতে বসে পড়ল। চোখ জোড়া বন্ধ করে চাঁদনী পৃথিবীর মায়াজাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অচেতন অবস্থায় বেডে পড়ে আছে। অন্ধকার এক্টা জগতে নিজেকে আবিষ্কার করছে সে। যে জগত টা শুধু ধোয়াশায় ভরা। আশার ছিটি ফুটা ও নেই।

নীড় এসে চাঁদনীর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল। চাঁদনীর কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম গুলো নীড় ওর পকেটে থাকা টিস্যু দিয়ে মুছে দিলো। খালাতো বোন হিসেবে নীড় চাঁদকে প্রচুর স্নেহ করে। তাছাড়া চাঁদনীর বড় বোন সোহানীকে নীড় প্রচন্ড রকম ভালোবাসে। সোহানী ও ভালোবাসে, তবে প্রকাশ করতে চায় না।

নীড় আর চাঁদনীর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। কেবিন থেকে বের হয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে আয়মনের নম্বরে কল লাগাল। রিং বাজার সাথে সাথেই আয়মন কলটা পিক করে ফেলল। নীড় এক নিশ্বাসে বলতে লাগল,,,,,

–“আয়মন…এক্টা বেড নিউজ আছে।”

নীড় কিছুটা থেমে আবার বলল,,,,

–“চাঁদ আর নূর দুজনই হসপিটালে ভর্তি। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি হসপিটালে চলে এসো। মেঝো খালামনি রা এই ব্যাপারে কিছুই জানে না। আমি এখনি ফোন করে ওদের জানিয়ে দিচ্ছি। তুমি চট জলদি হসপিটালে চলে এসো।”

আয়মন অফিসের কেবিনে বসে কফি খাচ্ছিলো। কথা গুলো শোনার সাথে সাথেই আয়মনের হাত থেকে কফির মগটা ফ্লোরে পড়ে তার জীবন হারাল। আয়মন চেয়ার থেকে উঠে চোখে মুখে সাংঘাতিক ভয় নিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে নীড়কে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,

–“চাঁ…দ আর নূ…র হস..পি..টা..লে মানে? কিকিকি হ..য়ে..ছে ওদের?”

–“এসব কথা তুমি পরে ও জানতে পারবে। প্লিজ তাড়াতাড়ি হসপিটালে চলে এসো। নূর আর চাঁদের জ্ঞান ফিরলে ওরা দুজনই পাগলামি শুরু করবে। একজন করবে রোজের জন্য, আরেক জন করবে নূরের জন্য। তখন আমার একার পক্ষে ওদের দুই জনকে সামলানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে।”

নাকে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম গুলো আয়মন ওর হাত দিয়ে মুছে বলল,,,,,

–“ভাইয়া আপনি আমাকে দেড় ঘন্টা সময় দিন। আমি এখন ঢাকা আছি। এখনি রওনা হচ্ছি আমি।”

নীড় কিছুটা অবাক হয়ে বলল,,,,,

–“ঢাকা কখন গেলে?”

–“কাল রাতে আব্বুর সাথে অফিসের কাজে ঢাকা আসতে হয়েছে। আপনি চিন্তা করবেন না আমি কিছুক্ষন বাদেই চলে আসছি।”

–“আয়মন শুনো তোমার এতো তাড়াহুড়ো করে আসতে হবে না। আমি বরং সাব্বিরকে ফোন করে বলি হসপিটালে চলে আসতে।”

–“সাব্বির কখনো নূর আর চাঁদকে সামলাতে পারবে না। ঐ দুইটাই পাগল। স্বয়ং আমাকে এসেই দুই পাগলকে সামলাতে হবে। আমি রাখছি ভাইয়া। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

কথা গুলো বলেই আয়মন ফোনটা কেটে অফিসের কেবিন থেকে পাগলের মতো ছুটাছুটি করে অফিসের মেইন গেইটে পার্ক করে রাখা গাড়িটায় বসে দ্রুত বেগে গাড়িটা স্টার্ট করে দিলো।

নীড় আয়মনের কলটা কেটে সোহানীর নাম্বারে কল লাগালো। প্রথম রিং বেজে উঠার সাথে সাথেই সোহানী কলটা রিসিভ করে নরম স্বরে বলে উঠল,,,,,

–“হ্যালো…”

নীড় কিছুটা উওেজিত হয়ে বলল,,,,

–“মেঝো খালামনি আর খালুকে নিয়ে তোমরা জলদি করে গ্রীন ল্যান্ড হসপিটালে চলে এসো। নূর আর চাঁদ হসপিটালে এডমিট আছে।”

সোহানী কান্নাসিক্ত কন্ঠে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই নীড় বলে উঠল,,,,

–“ফোনে ডিটেলসে কিছু বলা যাবে না। তোমরা তাড়াতাড়ি করে হসপিটালে চলে এসো। তখন চোখের সামনে সব দেখবে এবং শুনবে।”

কথা গুলো বলেই নীড় কলটা কেটে দিলো। ঐদিকে সোহানী চিৎকার চেঁচামেচি করে নিচ তলায় নেমে ওর আম্মু আর আব্বুকে সোফার রুম থেকে টেনে হিচড়ে গেইটের কাছে পার্ক করে রাখা গাড়িটার ব্যাক সিটে বসিয়ে দিলো। ওরা দুজনেই টাশকি লেগে বসে আছে। কি হচ্ছে না হচ্ছে সবটাই ওদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সোহানী ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করে গ্রীনল্যান্ড হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। সোহানী গাড়ি ড্রাইভ করছে আর হাউ মাউ করে কাঁদছে। সামিয়া আহমেদ কিছুটা কাঁপা কাঁপা হাতে সোহানীর কাঁধে হাত রেখে বলল,,,,,

–“কি হয়েছে সোহা? তুমি এভাবে কান্নাকাটি করছ কেনো? আর…আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?”

সোহানী চোখের পানি গুলো হাতের উল্টো পিঠ মিয়ে মুছে বলল,,,,

–“চাঁদ আর নূর দুজনেই হসপিটালে ভর্তি। আমরা এখন ওদের কাছেই যাচ্ছি আম্মু।”

সামিয়া আহমেদ নিবার্ক হয়ে জামান আহমেদের দিকে তাকাল। জামান আহমেদ হুট করে ব্যাক সিটে মাথাটা এলিয়ে কপালে হাত দিয়ে রাখল। দুজনেই চুপ হয়ে ভিতরে ভিতরে তুষের আগুনের মতো জ্বলছে।

*
*

অন্যদিকে,,,,,,

জায়মা আর লাবিবা এসে হসপিটালে হাজির। ওরা দুজনই চাঁদনীর দুপাশে বসে আছে। চাঁদনী এখনো সেন্সলেন্স হয়ে পড়ে আছে। স্যালাইন প্রায় শেষের দিকে। আর পাঁচ মিনিট পরেই স্যালাইনের মেয়াদ ঘনিয়ে আসবে। লাবিবা আর জায়মা দুজনেই চাঁদনীর মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর কাঁদছে।

হিমেল কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে দৌঁড়ে এসে নূরের কেবিনে ঢুকে পড়ল। সাবরিনা আবরার নূরের মাথার কাছে ঠাঁয় বসে আছে। নীড় আর নীড়ের আব্বু মিলে ডক্টরের চেম্বারে নূরের ট্রিটমেন্টের ব্যাপারে কথা বলছে।

হিমেল কেবিনে ঢুকেই ধপ করে নূরের পায়ের কাছে বসে পড়ল। সাবরিনা আবরার হিমেলকে দেখে আবার মরা কান্না জুড়ে দিলো। হিমেলের চোখে ও পানি চলে এসেছে। নূর এমন এক্টা জঘন্য স্টেপ নিবে হিমেল স্বপ্নে ও ভাবে নি।

#চলবে,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here