শেষ প্রান্তের মায়া পর্ব -০৮

#শেষ_প্রান্তের_মায়া (৮)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_______________

১ মাসের মতো কেটে গেছে। ভাইকে অনেক বুঝিয়ে আমি গার্মেন্টেসের কাজটা করছি। এ মাসের কিছুদিন আগে ভাইও বেতন পেয়েছে আর আজ আমিও পেলাম। নিজের পরিশ্রমের প্রথম বেতন পেয়ে নিজের মধ্যে অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করতেছে। টাকা টার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই কখন যে চোখের এক কোণা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে তা নিজেও টের পাইনি। টাকা টা নিজের ব্যাগে নিয়ে হাঁটা লাগালাম। এতগুলো দিনে রাস্তা পার হওয়া শিখে গেছি। আজকে ওই অনাথ আশ্রমে যাবো৷ ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে গিয়ে সেই পিচ্চি ছেলেটার সাথে দেখা। প্রায় দিনই আমার দেখা হয়। সকালে ফুল বিক্রি করে আর বিকেলে বেলুন, খেলনা এগুলোই। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য কত লড়াই করে! আমি পিচ্চিটাকে ডেকে বললাম,

‘এদিকে আয় পিচ্চি!’

এতদিনের সখ্যতায় পিচ্চি ছেলেটা এক দৌড়েই আমার কাছে আসে। ওর থেকে একটা বেলুন নিয়ে টাকা দিলাম। পিচ্চিটা হেঁসে বলে,

‘আপনার পোলা মাইয়া নাই আপা?’

আমি ওর হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘নাহ রে। আল্লাহ আমাকে দেয় নাই।’

‘আপনার বিয়া হয়ছে?’

‘হয়েছিলো। তুই এসব ছাড়। দুপুরে খেয়েছিস?’

বিনিময়ে মাথা দোলালো। যার অর্থ সে খেয়েছে। ওকে বললাম আমার সাথে অনাথ আশ্রমে যাওয়ার কথাটা। এক লাফেই রাজি হয়ে গেলো। আমার কেনো জানি ওর মতো পিচ্চিদের হাসি দেখতে খুব ভালো লাগে। মনের মধ্যে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায়। পিচ্চিটার হাত থেকে কিছু জিনিস নিজের হাতে নিয়ে আরেক হাতে ওর হাত চেপে ধরলাম। দুজনে গাড়ি দেখে একসাথে পার হয়ে সরাসরি ঢুকলাম অনাথ আশ্রমে। খুব বড় মাত্রার না আবার খুব ছোট মাত্রারও না। এখানকার বাচ্চাদের দেখলে অদ্ভুত এক শান্তি পাওয়া যায়। আমি যেমন শূণ্য হাতের মানুষ ঠিক তেমনই এরাও শূণ্য হাতের মানুষ। এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর মধ্যে নেই অ’হং’কারের ছিটেফোঁটা। আমি আর সেই পিচ্চিটা এগোলাম। ওহ হ্যাঁ পিচ্চি ছেলেটার নাম বলতে ভুলে গেছি। ওর নাম সিহাব। যেদিন ওকে নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম আমাকে বলেছিলো ওকে সবাই টোকাই বলে ডাকে। অদ্ভুত ভাবে এখানেও সে হাসতে হাসতেই বলেছিলো। আমি কিছু বলতে পারিনি শুধু চুপচাপ ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। অবশ্য পরেরদিন আমি ওর নাম দিয়েছিলাম। সিহাব! চারপাশে বাচ্চাদের ছড়াছড়ি। সবাই কি সুন্দর করে খেলছে৷ একজন মহিলা সবাইকে সামলাচ্ছে। আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে আর সিহাবকে দেখে বললো,

‘কিছু বলবেন?’

‘নাহ। আসলে বাচ্চাগুলোর সাথে একটু থাকা যাবে?’

মহিলাটি প্রথমে কেমন করে তাকালেন। তারপর হাসি মুখে বললেন, ‘জ্বি থাকুন। সমস্যা নেই।’

সিহাব আমার হাত টেনে ধরে মাথা নিচু করতে বলে। আমিও মাথা নিচু করতেই ফিসফিস করে বলে, ‘আমি ওগো এই বেলুন, খেলনা গুলা দিলে কিছু কইবো?’

আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম, ‘এগুলো দিয়ে দিলে তুই কাল ফুল কিনবি কি দিয়ে? রাতে খাবি কি?’

সিহাব হেঁসে বলে, ‘আপনি যেই টেকা দিছেন ওইডি দিয়াই রাইতে খাওয়া হইয়া যাইবো৷ আর ফুল কিনোনের টাকা আছে মোর কাছে। ওগোরে দেই? ওরা তো আমার ভাই বইনের মতো।’

উত্তর দেওয়ার মতো কিছু পেলাম না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। এতটুকু একটা পিচ্চি ছেলে অথচ তার ভাবনা গুলো কত বড়! আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম ওকে সব দিতে। খুশিতে এক ছুটে গিয়ে বাচ্চাদের ডেকে ডেকে যতটুকু পেরেছে দিয়ে দিয়েছে সব। মহিলাটি নিজেও আমার দিকে আর সিহাবের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। আসলে এই বাচ্চা ছেলেটার মধ্যে ‘আরো চাই আরো চাই’ স্বভাবটা নেই। সে যা পাই তাতেই সন্তুষ্ট। অথচ মানুষ এদেরকে মানুষই মনে করে না। সিহাবও বাকি সবার মতো সবার সাথে খেলতে শুরু করে দিয়েছে। আমি শুধু তাকিয়ে দেখে গেলাম পুরোটা। এত ভালো ছেলেটার মা যে মহিলা সে থাকলে গর্ব হতো তার। এতো পরিষ্কার মনের সন্তান সবার হয় না।

_______
বাড়িতে এসে দেখি মাহিদ এসে পড়েছে৷ আমি দ্রুত গোসল করে রান্না বসিয়ে দিলাম। বাড়িওয়ালি দাদীর কাছ থেকে যা যা নিয়েছিলাম তার সবটাই উনাকে ফেরত দিয়েছি। তিন্নি আর সোহান ভাইয়ের সাথেও আমাদের সখ্যতা বেড়েছে। সোহান ভাই মাহিদকে নিজের ভাইয়ের মতো আগলে রাখে। কোনো বাজে ছেলের সাথে মিশতে দেয় না, একা একা কোথাও যেতে দেয় না। এতে অবশ্য মাহিদ নিজেও বিরক্ত হয় না। আমি রান্না বসিয়ে সবজি কাটছিলাম সে সময় হাজির মাহিদ, তিন্নি। সোহান ভাই বোধহয় কাজ থেকে এসে রেস্ট নিচ্ছে। তিন্নি আর মাহিদ দুপাশে দুজন বসে। তিন্নি বলে,

‘মায়া আজ এতো দেড়ি হলো যে!’

‘তোমাকে বলেছিলাম না অনাথ আশ্রমের কথা। সেখানেই গেছিলাম।’

তারপর তিনজনে মিলে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলাম। গল্প জুড়লেও আমার মাথায় চলছে অন্য কিছু। কিন্তু সেইটাা কিভাবে মাহিদকে বলবো বুঝে উঠতে পারতেছি না। ভয় হচ্ছে। হাজার হলেও ওর টাকাতেও এই সংসার চলে। গল্পের মধ্যেই তিন্নির ডাক পড়ে। তিন্নি চলে যায়। আমারও রান্না প্রায় শেষের মধ্যে। মাহিদ আমার অন্যমনষ্কতা খেয়াল করে বলে,

‘বুবু! কিছু ভাবতেছো?’

আমি তাকালাম ওর দিকে। ফাঁকা ঢোক গিলে বললাম, ‘তোকে একটা কথা বলবো? রাগ করবি না তো ভাই!’

‘রাগ করবো কেনো বুবু? বলো কি হয়ছে!’

আমতা আমতা করে বললাম, ‘আসলে তোকে সিহাবের কথা বলেছিলাম না?’

‘হ্যাঁ। সিহাবের কিছু হয়েছে?’

‘নাহ। আমি ওকে আমাদের বাড়িতে আনলে তুই কি রাগ করবি ভাই?’

ভাই আমার মুখের দিকে তাকালো। আমি ব্যস্ত গলায় বললাম, ‘ছেলেটার অনেক কষ্ট করতে হয় রে। রাতে ঠান্ডার মধ্যেও ফুটপাতে কাটাতে হয়। সারাদিন ফুল, বেলুন, খেলনা বিক্রি করলে খাবার জোটে নয়তো জোটে না। সিহাব যদি আমাদের সাথে থাকে তোর কি অনেক সমস্যা হবে? রাগ করবি? আমি জানি আমাদের কিছুই নেই কিন্তু যতটুকু আছে তাতে কি ওই বাচ্চা ছেলেটার হবে না?’

মাহিদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মুখের দিকে। আমি হয়তো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। কিন্তু ছেলেটার জন্য আমার মায়া হয় খুব। আমিও তো ৪ টা বছর এভাবেই কষ্ট করেছি। হয়তো ফুল বিক্রি করতে হয়নি বা বেলুনও বিক্রি করতে হয়নি, রাস্তায়ও হয়তো ঘুরতে হয়নি তবে এর থেকেও বেশি য’ন্ত্রণা দিয়েছে ওরা। কত রাত শীতে কাতরে কাতরে মেঝেতে পড়ে থেকেছি মা’র খেয়ে। কত দিন খেতে পাইনি। সেসব দিনের কথা ভাবলেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। আমার ভাবনার মাঝেই মাহিদ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘আমার কেনো সমস্যা হবে বুবু? আমি যদি ওমন রাস্তায় কষ্ট করতাম তুমি কি আমাাকে ওভাবে ফেলে রাখতে? উহু কখনোই না। তাহলে এখন অন্য একটা ছেলেকে, অন্য একটা ভাইকে যখন বাড়িতে আনতে চাচ্ছো তখন আমি রাগ করবো! নাহ কখনোই না। ওই বাচ্চা ছেলে আর খায়-ই বা কতটুকু! তাছাড়া রিজিকের মালিক আল্লাহ। তিনি ঠিকই ব্যবস্থা করে দিবে। আর এই সংসার শুধু যে আমার টাকা দিয়ে চলে এমন তো না। বরং আমার চেয়েও বেশি বেতন তোমার। আর ওমন একটা বাচ্চা ছেলে থাকলে খুব ক্ষ’তি তো আর হবে না। তুমি ওকে নিয়ে আইসো কাল।’

খুশিতে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম৷ ভাইটা আমার এতো বুঝদার কেনো? অন্য কেউ হলে ঠিকই হয়তো আমাকে ধমকে থামিয়ে দিতো। আমি আমার ভাইকে বুঝতে পারি। ওর মনে যা মুখেও তা। যেটা ভালো লাগবে না তা মুখের ওপরই বলে দিবে। দু ভাই বোন মিলে রান্না শেষ করতে করতে সন্ধ্যার আযান দিয়ে দেয়। ভাই নামাজে গেলে আমিও ওজু করে নামাজে বসি।

রাতের বেলা খেতে খেতে ভাইকে বললাম, ‘তোর ইয়ার চেঞ্জ এক্সাম কবে?’

‘কেনো?’

‘কেনো আবার? তুই এক্সাম দিবি না?’

‘নাহ! ভাবছি এবার আর দিবো না।’

আমার খাওয়া থেমে যায়। ভাই চুপচাপ খেয়েই চলেছে। আমি বললাম, ‘দিবি না মানে কি? একটা বছর কোন শখে গ্যাপ দিবি তুই?’

‘দেখো বুবু আমি তোমাকে এত বড় শহরে একা ফেলে এক্সাম দিতে যেতে পারবো না ব্যাস।’

‘কিসের ব্যাস? দেখ ভাই সব কিছুতে জিদ করবি না। আর সিহাব, তিন্নি, সোহান ভাই ওরা তো আছে। আমি একা কই?’

ভাই কি যেনো ভাবলো। কিন্তু কিছু বললো না৷ নিজের মতো খেতে থাকে। আমি ফের বললাম, ‘পড়ালেখা না শেষ করলে জীবনে দাম পাবি না ভাই। আর আমার জন্য পড়ালেখা ছেড়ে দিলে আমি অনেক কষ্ট পাবো।’

ভাই একবার আমার মুখের দিকে তাকায়। বলে, ‘ নতুন কাজ করতেছি। এই সময় ছুটি দেবে না বুবু।’

‘আমি সোহান ভাইয়ের সাথে কথা বলবো।’

দুজনের কথার মধ্যেই হুট করে সোহান ভাইয়ের ডাক। টিনের গেইটে ধুপধাপ শব্দ করছে আর ডেকে চলেছে। আমি আর ভাই খাওয়া রেখেই ছুটলাম সেদিকে। সোহান ভাই কে দেখে দুজন চমকে গেছি। চোখ মুখ লাল হয়ে আছো কখন যেনো কেঁদে দেয় এমন অবস্থা! ঘামে পুরো শরীর লেপ্টে গেছে। মনে হচ্ছে কোনো কিছু নিয়ে প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। মাহিদ ব্যস্ত কন্ঠে বলে,

‘কি হয়েছে সোহান ভাই? আপনার এই অবস্থা কেন?’

সোহান ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপু দেখেন না তিন্নি কেমন করছে! বার বার বমি করতেছিলো এখন আর সাড়া দিচ্ছে না। আমার অনেক ভয় করতেছে!’

আমি আর ভাই দ্রুত ছুটলাম তিন্নির কাছে। সোহান ভাই কোনো রকমে হেলেদুলে ভেতরে আসলেন। তিন্নিকে কয়েকবার ডাকার পরও সাড়া না পেয়ে আমরা দুজনও ঘাবড়ে গেছি। মাহিদ আর সোহান ভাইকে ডাক্তার ডেকে আনতে বলে আমি তিন্নির জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করতে থাকলাম। কিন্তু সোহান ভাই যাবে আর কি! উনার পা-ই নড়তেছে না। সোহান ভাইকে দেখে আরো একবার অবাক হলাম। কতটা ভালোবাসলে স্ত্রীর এই অবস্থায় মানুষের এমন অবস্থা হয়! তিন্নির মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম। মেয়েটা কি দারুণ ভাগ্যবতী! ভালোবেসে বিয়ে করেও মানুষের অভিযোগের শেষ নেই অথচ এই জুটিকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে আসে। সবাই যদি এমন হতো তবে আমাদের মতো মায়াদের কষ্ট পেতে হতো না।

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ছোট করে দেওয়ার জন্য দুঃখিত। আজ আমার রেজাল্ট দিবে এই নিয়ে প্রচুর টেনশনে আছি। কোথা থেকে কি লিখছি নিজেও জানি না। রিচেক করা হয় নাই তাই একটু মানিয়ে নিবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here