শেষ বিকেলে এলে তুমি পর্ব -০৫

#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#সিজন_২
#Tahmina_Akhter

(৫)

-আদিল,আজকের ঠিক এমন দিনে আপনাকে পেয়েছিলাম অপরিকল্পিতভাবে। কে জানতো সেদিন আপনার স্ত্রী আমি হবো!তিনবছর আগের এই দিনটি ছিল আমার জন্য এক কালো রাত কিন্তু আপনি এলেন আমার জন্য একমুঠো জোনাকির আলো নিয়ে। ইশশ্ ,আপনি যদি সেদিন ঠিক সময়ে না পৌঁছাতেন তবে কি হতো? এখনও এই কথাটি ভাবলে গায়ে কাটা দিয়ে উঠে আমার।

আদিলের একহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে, কাঁধে মাথা রেখেই বললো রুশা। আদিল রুশার কপালে নিঃশব্দ চুমু দিয়ে বললো,

-সবই তাকদির। নয়তো, আমিই বা কেন সেদিন রিধিমার কাছে মিসবাহর নাম্বার এবং ঠিকানা চাইতে গেলাম। তোমাকে সেদিন আমার করে পাবো বলে এতকিছু ঘটেছে নয়তো এগুলো কি কো-ইনসিডেন্স!

-হুম।

অদূরে দেখা যাচ্ছে মেঘনা গোমতী নদী, চাঁদের আলোয়ে নদীর পানিগুলো যেন ডায়মন্ডের মতো চিকচিক করছে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে ট্রলারের শব্দ কিংবা ছোট ছোট বালু বাহি তরীর।

রুশা আদিলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে এবং ভবছে,

-কি আছে এই পুরুষটির মাঝে যতই জানতে চাই তাকে ঠিক ততটা হারিয়ে যাই তার হৃদয়ের গহীনে

আদিল আর রুশাকে দেখে ওই যে দূর আকাশের চাঁদটাও যেন বলতে চাইছে,

-আমার রুপের আলোর চাইতে তোমাদের ভালোবাসার দ্যুতি ছড়াচ্ছে বেশি। এভাবে থেকো যতজনম এই ধরনীতে শ্বাস-প্রশ্বাস চলবে তোমাদের।

————————–

রুশা তখনও ঘুমিয়ে আছে আর আদিল চুপিচুপি তার মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে আছে।

এই যেমন এখন রুশা ঘুমের মাঝে কি যেন দেখছে আর বারবার ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁদতে চাইছে? আদিল ভেবে পায় না এতবড়ো মেয়ে ঘুমের মাঝে কি দেখে কাঁদতে চাইছে। সে তো আরিশকে দেখেছে এভাবে ঘুমের মাঝে ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁদতে।

আজ শুক্রবার বলে এখনও ঘুম থেকে জাগেনি রুশা। ফজরের নামাজ পরে ঘুমিয়ে পরেছে। পুরো সপ্তাহে হসপিটালে দৌঁড়ঝাপ করতে করতে অনেকটা কাহিল হয়ে যায়।

আদিল রুশার বেশ কয়েকটা ছবি মোবাইলে তুলে রাখলো পরে এগুলো দেখিয়ে বেশ পঁচানো যাবে তার পাখিটাকে।

আদিল খাট থেকে নেমে ওয়াশরুম চলে গেলো। একেবারে গোসল সেড়ে বের হলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল মুছে রুমে থেকে বের হয়ে গেলো তবে যাওয়ার আগে দরজা ভেজিয়ে এলো।

আদিল হাঁটতে হাঁটতে রায়হান সাহেবের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভেতর থেকে তার আব্বার কন্ঠে কুরআন তেলাওয়াত শোনা যাচ্ছে। আদিল দরজায় নক করতে ওপাশ থেকে বললো,

-দরজা খোলা আছে, রুশা।

আদিল মুচকি হেসে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলো। রায়হান সাহেব চোখ তুলে তাকিয়ে অবাক হলেন কারণ তিনি ভেবেছিলেন রুশা এসেছে কিন্তু আজ দেখি আদিল এলো।

আদিল তার আব্বার পাশে বসে আছে চুপটি করে। ঠিক যেমন আগে বসে থাকতো স্কুল যাওয়ার আগে।

রায়হান সাহেব ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন, ছেলেটাকে তিনি সপ্তাহের মাঝে ভালোভাবে একঘন্টাও দেখতে পান না।সকালে হসপিটালে চলে যায় ফিরে আসে রাতে চেম্বার থেকে।তিনি এতরাত অব্ধি জেগে থাকতে পারেন না।

-কিছু বলবি,বাবা?

-সবসময় কিছু বলতে আপনার কাছে আসতে হবে আব্বা?

-না তা তো বলিনি। রুশা কোথায়? আজ এখনও এলো না আমার জন্য চা নিয়ে!

-রুশা ঘুমিয়ে আছে, আব্বা। আপনি বসুন আমি কফি বানিয়ে আসি।

আদিল উঠে দাঁড়াতে রায়হান সাহেব আদিলের হাত ধরে বললেন,

-না, আজ আর চা-কফি কিছুই খাবো না। তুই বস তোর সাথে গল্প করি।কাজলটাও ওর সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তুই আর রুশা হসপিটাল নিয়ে তবে রুশা সময় পেলে আমার সাথে বসে গল্প করে কিন্তু তুই তো তেমন আসিস না।

আদিলের বেশ খারাপ লাগলো তার আব্বার এমন আকুলতা দেখে। আদিল তার আব্বার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,

-আপনি আজ যত কথা আছে আমার সাথে বলেন আব্বা।আজ আমার কোনো কাজ নেই।

-তোর কখনো জানতে ইচ্ছে হয়নি আমি কেন সেদিন রেষ্টুরেন্টে তোকে শর্ত দিয়েছিলাম?

-আব্বা, আপনি শর্তটা কেন দিয়েছিলেন তখন বুঝতে না পারলও এখন বুঝতে পেরেছি। আপনি যেভাবে হোক চেয়েছিলেন যেন আমি আবারও এই কুঞ্জবাড়িতে ফিরে আসি। তাই আপনি আমার কাছে শর্ত জাহির করেছিলেন। যদি আমি রুশাকে পেতে চাই তবে আমি যেন কুঞ্জবাড়িতে ফিরে আসি। আমি সেদিন আপনার শর্ত মেনেছি কিন্তু ফিরে এসেছি আমাদের ওয়ালিমার পর। যদি এর আগে আসতাম হয়তো রুশার পড়াশোনায় ব্যঘাত ঘটতো।

-আমি সব জানি আদিল। মেয়েটা বড্ড ভালো রে। আমি যদি তোর জন্য মেয়ে খুঁজতাম তবে কখনো এমন ভালো মেয়ে পেতাম না। কিন্তু, তুই খুঁজে এনেছিস এমন কাঁচ কাটা হিরা।
বাবা রে আমাকে ক্ষমা করে দিস আমার জন্য আজ তোর আম্মা তোদের কাছে নেই তুইও অনেক কষ্ট ভোগ করেছিস।

-কি সব বলেন আব্বা! আম্মার সেদিন হায়াত ফুরিয়ে গেছে বিধায় আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। আর রইলো আমার কথা তবে সেসময়ের যন্ত্রণাগুলো আমি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আপনিও আর সেসব কথা মনে করবেন না।

রায়হান সাহেব মাথা দুলিয়ে বসে রইলেন। আদিল বললো,

-আব্বা, আপনি বসেন আমি খাবার অর্ডার করছি।

আদিল চলে গেলো, রায়হান সাহেব উঠে গিয় কুরআন শরীফ রেখে দিলেন বুকশেলফে৷ এরপর, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবতে লাগলেন, হয়তো উনার স্ত্রীর কথা!

আদিল রুশাকে ডাকতে গিয়ে দেখে রুশা ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে হয়তো গোসলও করেছে। কারণ, তার চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে পেঁচানো।

আকাশী রঙা সুতির শাড়ি, সাদা রঙা থ্রী-কোয়াটার হাতা ব্লাউজ, ভেজা চুলে বেশ মোহনীয় দেখাচ্ছে রুশাকে।

হুট করে কেন রুশা শাড়ি পড়লো এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না আদিল।

আয়নার সামনে গিয়ে যখন রুশা তার ভেজা চুলগুলো হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকাতে যাবে ঠিক তখনি আয়নার প্রতিবিম্ভের মাঝে আদিলকে দেখতে পেলো। ওর দিকে তাকিয়ে থুতনিতে হাত রেখে কি যেন ভাবছে মহাশয়।

রুশা ড্রায়ারটি ড্রেসিংটেবিলের উপরে রেখে আদিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রুশাকে নিজের কাছে আসতে দেখে আদিল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়ালো।

-কি হয়েছে? এতক্ষণ কি ভাবছিলেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?

-ভাবছি আমার বৌ’টা আজ হঠাৎ করে শাড়ি পড়লো!

-শাড়ি! আমি আরও ভেবেছি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বোধহয়। আজ এমনি মন চাইলো তাই শাড়ি পড়লাম। কেন ভালো দেখাচ্ছে না?

-সুন্দরের পাশাপাশি আবেদনময়ী দেখাচ্ছে তোমায়।

রুশার হাত ধরে হেঁচকা টানে নিজের বুকের মাঝে নিয়ে বললো আদিল।

রুশা তো আদিলের কমপ্লিমেন্ট শুনে মাথা নিচু করে রেখেছে লজ্জায়। এভাবে কেউ বলে না-কি?

-হয়েছে হয়েছে ভীষণ প্রশংসা করেছেন আমার অসভ্য লোক একটা। ছাড়ুন আমায় বাবাকে সকালে চা এখনে দেইনি। না জানি কি ভাবছে, বাবা?সকালের খাবারও তৈরি করতে পারলাম না।

-তোমার এসব নিয়ে আজ চিন্তা করতে হবে না। খাবার আজ বাইরে থেকে আসবে অর্ডার করে দিয়েছি। কিছুক্ষণের মাঝে চলে আসবে।

রুশার কপালে লেপ্টে থাকা ভেজা চুলগুলো সরিয়ে বললো আদিল।

– আরে বাহ্ আজ দেখি বলার আগে সব রেডি!

-কারণ, আজ আমরা সবাই মিলে ঘুরতে যাবো শহরের যে কোনো প্রান্তে।

————————-

নিত্যদিনের মতো সেদিনও আদিল বাড়িতে যাওয়ার জন্য ওর চেম্বার থেকে গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছিল। এমন সময় কেউ ওর নাম ধরে ডাক দিলো?

আদিল পিছনে ফিরে তাকাতে দেখতে পেলো, ক্যাজুয়াল ড্রেস পড়া একটি যুবক ওর দিকে এগিয়ে আসছে। আদিলের মনে হচ্ছে এই যুবকটিকে সে চিনে না। তবুও ভদ্রতার খাতিরে যুবকটি সামনে এসে দাঁড়াতে বললো,

-আপনি কি আমাকে ডেকেছেন?

-অবশ্যই আপনাকে। এখানে আপনি আদিল রহমান ছাড়া অন্য আদিল আছে না-কি?

যুবকটির উত্তরে কিছুটা লজ্জা পেলো আদিল। এবার যুবকটি আদিলকে বলছে,

-আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন? আসলে চিনতে পারার কথাও না। আমি রওনক মির্জা। মনে আছে আপনার স্ত্রীকে নিয়ে কক্সবাজার গিয়েছিলেন। সেখানে একটি ছেলের সাথে আপনার স্ত্রীর কথা হয়।

-হ্যা হ্যা মনে পড়ছে। আপনি রাফসানের বড়ো ভাই রওনক মির্জা, রাইট?

-ইয়েস ম্যান। আই এম রওনক মির্জা। কেমন আছেন?

আদিলের দিকে হাত বাড়িয়ে। আদিল রওনকের সাথে হ্যান্ডশেক করে বললো,

-ভালো আছি। আপনি ঢাকায়! আর এখানে কিভাবে?

-আসলে ব্যবসার কাজে ঢাকায় এসেছি। তো আপনার ভিজিটিং কার্ড আমার ওয়ালেটে ছিল তাই ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে যাই।

-বেশ ভালো করেছেন। তবে চলুন আমাদের বাড়িতে।

-না না আমার সময় নেই। রাত এগারোটায় আমার চট্টগ্রামের ফ্লাইট। চলি তবে ভালো থাকবেন আর আপনার স্ত্রীকে আমার সালাম জানাবেন।

-জি জি, অবশ্যই। তবে চলুন আপনাকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি সময় আর দু’ঘন্টা আছে।

-আপনি কষ্ট করতে যাবেন না, প্লিজ। আমি ক্যাব ভাড়া নিয়েছি।

-ক্যাবকে মানা করে দিন আমি পৌঁছে দিয়ে আসবো আপনাকে।

-ওকে ওকে।

রওনক ক্যাবকে আসতে বারণ করলো এরপর আদিলের কারে বসতে আদিল কার স্টার্ট করলো।

গাড়িতে বসে বিভিন্ন কথা বলছিল কিন্তু কিছুদূর যাবার পর একদল মানুষ এসে আদিলের কার আটকে ফেললো।

এরকম সিচুয়েশনে আদিল আর রওনক কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়লো।কার থেকে দু’জন বের হয়ে আসতেই, দলের একলোক এগিয়ে এসে বললো,

-যা কিছু সব বাইর কইরা দে নয়তে এই চাপাতি দিয়া তোগো শেষ কইরা দিমু।

আদিল তার পকেটে থাকা মোবাইল, ওয়ালেট সবকিছু বের করে দিলো বাট রওনক যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো সেভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

দলের আরও একটি লোক এসে রওনককে তাগাদা দিতে লাগলো সবকিছু বের করার জন্য।

রওনক এবার তার আইফোন 11 প্রো-ম্যাক্স বের করে দিলো।ছিনতাইকারি দল ভীষণ খুশি হলো কিন্তু যখন উনারা ওয়ালেট বের করতে বললো,কিন্তু রওনক দিচ্ছে না ঠিক তখনি ওদের মাঝে হাতাহাতি পর্যায়ে চলে গেলো।

আদিল বেশ অবাক হয়ে গেলো রওনাকে কান্ড দেখে কারণ যে লোক দামি মোবাইল দিয়ে দিলো সে সামান্য ওয়ালেট দিতে চাইছে না কেন?

আদিল দৌঁড়ে গেলো রওনক আর দলের লোকটাকে থামাতে।

একপর্যায়ে কারো আর্তনাদে পুরো এলাকা কেঁপে উঠলো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here