শেষ বিকেলে তুমি আমি-২৪

#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_২৪

খবরটা জানার পর ভেঙে গুড়িয়ে যেতে চাওয়া বুক নিয়ে ছুটতে শুরু করলাম। ছোঁয়া আমার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। ও প্রশ্ন করে বসলো কেন আমি এতো ব্যাস্ততা নিয়ে ছুটছি। অগত্যা মনের দশা লুকিয়ে জবাব দিলাম

— আজকে তোমার দাদাভাইকে দেখতে যাবো। তুমি তো দুদিন আমার কাছে থাকলে। তোমার দাদাভাইয়ের সাথে দেখা করতে হবে আজ।

কথাটা মিথ্যা ছিলো না। বাবার কাছেই যাচ্ছি আমি। স্মরণের বাসায়। রোদের তেজ অত্যধিক। ঘামে ভেজা কপাল আর অশ্রু ভরা চোখ মুছতে গিয়ে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি আমি। হাত পা কাঁপছে। জাহিনকে ফোন করে যাচ্ছি অনবরত। কিন্তু তার কোনো হদিস নেই। সর্বক্ষণ আমার পিছু গাড়ি নিয়ে ঘুরলেও আজ সে নেই। এক হাতে ছোঁয়াকে শক্ত করে ধরে রেখে চাতক পাখির মতো চেয়ে রইলাম একটা রিকশার জন্য। কিন্তু দূর্ভাগ্য আমার! একটাও যেন খালি রিকশার দেখা মিলছে না।

.
প্রায় দশ মিনিট পর একটা রিকশা মিলল। তাও প্রিয়ার জন্য। বাসা থেকে প্রিয়া রিকশা নিয়ে এই পথেই যাচ্ছিলো। প্রিয়ার রিকশাতেই উঠে পরলাম। ভেতরে যে এক ভয়ংকর ঝড় বইছে আমার তা সম্পর্কে প্রিয়া বুঝি অবগত ছিলো। রিকশা চলতি দশায় ও আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলতে চাইলো

— স্মরণ ভাইরার কিছু……..

আমি ঝট করে চোখ জোরা বন্ধ করে যেমন লুকিয়ে ফেললাম কষ্ট তেমনই থামিয়ে দিলাম প্রিয়াকে। কোলে শান্ত হয়ে বসে থাকা ছোঁয়ার দিকে দৃষ্টি রেখে বললাম

— স্টপ।

প্রিয়া চুপ হয়ে গেলো। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। যেন হৃদপিণ্ডটা থমকে যেতে চাইছে। তাকে হারানোর ভয় বুক কাপিয়ে দিচ্ছে। এই পথটাও বেজায় দীর্ঘ মনে হচ্ছে। অসহায়ত্ব অনুভব করছি যেন আকাশছোঁয়া।

.
রিকশা যখন স্মরণের বাসার গেইটে প্রবেশ করলো তখন আমি হুড়মুড় করে নেমে পরে এক প্রকার দৌড়ে চলে গেলাম ভেতরে। সদর দরজা খোলা ছিলো। ড্রয়িং রুমেই পেয়ে গেলাম চিন্তিত, থমথমে মনোভাবে কপালে হাত রেখে বসে থাকা বাবাকে৷ কাছে গিয়ে ডেকে উঠলাম

— বাবা.. উনি…

কথার মাঝে থমকে যেতে হলো আমার। ছোয়ার কথা মনে হলো। ছোট মেয়েটার জন্য আমার কষ্ট বেড়ে দ্বিগুণ হলো। এমন সময় প্রিয়া এসে ছোঁয়াকে সরিয়ে নিলো। বাবার দিকে দৃষ্টি রাখতেই উনি বলে উঠলেন

— আমার সব কিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে রে মা।

একথা বলেই তিনি চাপিয়ে রাখা কষ্ট গুলো দুচোখের অশ্রু করে ঝাড়িয়ে দিলেন। আমিও ভেঙে গুড়িয়ে গেলাম। ভাঙা গলায় প্রশ্ন করলাম

— শেষ মানে কি বাবা? উনি কোথায়? ওনার খোঁজ পাওয়া যায়নি?

— খোজ পাওয়া গেছে। প্লেন খুলনার মেহেরপুরের মধ্যে পরেছে। দশজন অফিসারের মধ্যে সাতজনের খোঁজ পাওয়া গেছে। আর তিনজন….

আমার প্রশ্নের জবাব পেছন থেকে পরিচিত কন্ঠস্বর হতে এলো। ঘুরে তাকালাম। এটা অঙ্কন ছিলো। আমাকে পাশকাটিয়ে বাবার দিকে অগ্রসর হয়ে অঙ্কন ব্যাস্ত হয়ে বলল

— আমি মেহেরপুর যাচ্ছি আঙ্কেল। চিন্তা করবেন না। একটু শান্ত হন।

বাবা উঠে দাড়িয়ে গেলেন। তাড়া দিয়ে বললেন

— চলো চলো। আমিও যাবো। তাড়াতাড়ি চলো অঙ্কন।

— আঙ্কেল আপনি অসুস্থ। আপনি ধীরে সুস্থে আসুন। আর ছোঁয়ার বিষয়টাও…..

বাবা থমকে গিয়ে নতমস্তকে ভাবলেন। অতঃপর আবারও বসে পরলেন। অঙ্কন পা বাড়ালো বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। আমি তখন পেছন ডেকে ঝট করে বললাম

— আমি যাবো।

অঙ্কন হাঁটার গতি রোধ করে পেছন ফিরে চাইলো। আমি অণুরোধ করে আবারও বললাম

— প্লিজ না করবেন না। আমি যাবো।

অঙ্কন সেকেন্ড দুয়েক আমার দিকে কেমনতর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর বলল

— প্রিয়ার সাথে আসুন। আমি গাড়িতে ওয়েট করছি। আর অজান্তাকে বলে দিচ্ছি, আই মিন আমার বোনকে বলে দিচ্ছি ছোঁয়াকে এসে নিয়ে যাবে।

অঙ্কনের কথায় এমন পরিস্থিতিতেও আমি অভিভূত না হয়ে পারলাম না। প্রিয়া নিঃসন্দেহে একজন বেস্ট মানুষ পেয়েছে। আমার অস্বস্তি হবে ভেবে সে প্রিয়াকে সঙ্গে নেওয়ার প্রস্তাব রাখলো। সেই সাথে ভাবলো প্রিয়ার যেন অন্যকিছু মনে না হয়। সে যেন দুঃখ না পায়।

.
গাড়ির সামনের দু’টো সিটে বসলো ওরা নব দম্পতি। বিয়ের পরদিনই যাদের দু’জনে দু’দিকে চলে চলে গেছে। এক ছদের নিচে এখনও সংসার জোড়া দেয়নি তারা।

প্রিয়া আমাকে ছেড়ে গাড়ির সামনে বসতে চাইলো না। এ নিয়ে অঙ্কনের সাথে ওর চোখ পাকাপাকি হয়ে গেছে। মনে মনে হয়তো ছোটখাটো এক যুদ্ধও হয়ে গেছে। আমি তখন গাড়িতে বসে অপেক্ষার প্রহর গুণছি। কখন তার কাছে পৌঁছাবো? ভাবছি অনেক কিছু। সে আছে তো? হদিস না পাওয়া তিনজনের তালিকায় যেন স্মরণ না থাকে। ভাবনা গুলো যেন কলিজায় ব্যাথার সন্ধান করছে। চিন্তা গুলো ডুকরে কাদাতে চাইছে। চোখে ভাসছে স্মরণের মুখ। কিছু স্মৃতি বড্ড পোড়াচ্ছে। এবার আমার নিজেকে দমিয়ে রাখা একটু নয় অনেক বেশি কঠিন হয়ে গেলো। আঁচলে মুখ গুঁজে দিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে উঠলাম। গাড়ির পাশের কাচ তখন কেউ নামিয়ে দিলো। গাড়ি চলতি দশায় হাওয়া এসে আমাকে ঘিরে ধরলো যেন। আমার দুঃখ কষ্ট গুলো তখন আকাশ ছেড়ে সপ্তম আকাশে পারি জামালো। আমি সত্যিই পারবো না তাকে অন্যভাবে দেখতে। আমি মানতে পারবো না তার নিথর দেহ বা নিস্তব্ধ বুক।

.
শ্বাস রুদ্ধ করা পরিস্থিতি পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছে গেলাম মেহেরপুর। একটা হসপিটালের সামনে এসে গাড়ি দ্বার করলো অঙ্কন। মানুষের ছোটাছুটি, বিধ্বস্ত অবস্থা। কারো কারো হাহাকার ধ্বনি। কারো চিৎকার করা কান্না আমার কানে এসে যেন প্রতিধ্বনি তুলছিলো। বুকটা মুচড়ে মুচড়ে উঠছিলো। অঙ্কনের গাড়ির সামনে দাড় করানো ছিল একটা এম্বুলেন্স। নামতে হলো আমাদের। অঙ্কন গাড়ি অন্য পথে ঘুরিয়ে পার্ক করতে চাইলো। আমি আর প্রিয়া দাড়িয়ে রইলাম একটা জায়গায়। আমার দৃষ্টি পরে ছিলো এম্বুলেন্সের দিকে। হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু চোখে পরলো। স্মরণের মুখটা চোখে ভেসে উঠলো। তার বন্ধ চোখ, মাথা চুইয়ে পরা রক্ত, ঠোঁটের কোণে ক্ষত দেখে আমি এক প্রকার দৌড়ে গেলাম এম্বুলেন্সের নিকট। প্রিয়া পেছন থেকে ডেকে উঠলো। আমি শুনেও সারা দিতে পারলাম না। ওকে এটুকু বলার সাধ্য বা ধ্যান ছিলো না যে, আমি স্মরণের কাছে যাচ্ছি। শুধু সব ভুলে আমার কন্ঠ হতে ডুকরে কান্না বেরিয়ে এলো। থরথর করে কাঁপন ধরা হাতে পায়ে সকালকে ঠেলে সরিয়ে স্মরণের নিকট গিয়ে তার মাথায় হাত রাখলাম। অবিরত আসা রক্তগুলোকে মনে মনে মিনতি করে করলাম না আসার জন্য। কিন্তু তারা শুনলো না। স্মরণের বন্ধ চোখে দু’টো আমাকে ভীষণ কষ্ট দিলো। আমার চোখ বাধভাঙ্গা নদীর মতো অশ্রুকণা ছেড়ে দিলো। এমন সময় অঙ্কন দৌড়ে এলো স্মরণের নিকট। স্মরণের মাথার ক্ষতস্থানে আমি হাত চেপে দাড়িয়ে ছিলাম। অঙ্কনকে দেখেই ডুকরে কেঁদে দিয়ে বললাম

— ওনার কিছু হবে না তো? সুস্থ হবে তো?

অঙ্কন আমাকে আশ্বাস দিতে চাইলো। তারও গলার স্বর ছিলো কম্পমান। স্মরণের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল

— কিছু হবে না। আপনি সরুন।

আমার মন না চাইতেও সরে এলাম। এক বুক শূন্যতা নিয়ে তাকিয়ে রইলাম স্মরণের দিকে। প্রিয়া আমাকে পাশ থেকে জড়িয়ে নিতেই আমার কান্নার বেগ বেড়ে গেলো। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি মানতে পারছি না, সহ্য করতে পারছি না স্মরণের রক্তে ভেসে যাওয়া দেহ। থেঁতলে যাওয়া কপালের বাঁপাশ।

.
কান্নাগুলো অনেক চেষ্টায় তালাবদ্ধ করে দাড়িয়ে আছি ওটির সামনে। মানুষের গুঞ্জন চারিপাশে। কেউ কাঁদছে কেউ আমার মতো বুকে কালবৈশাখীর ঝড় নিয়ে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়াও আমার পাশে দাঁড়ানো। মিনিট দুয়েক পর পর আমার চোখের অবাধ্য জল নিঃশব্দে গাড়িয়ে পরতেই প্রিয়া মুছে দিচ্ছে। আমাকে শান্ত করার এক মিথ্যা প্রচেষ্টা চালিয়েছে ও।

অঙ্কন ওটির মধ্যে। এক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে স্মরণের ট্রিটমেন্ট চলছে। কোনো আপডেট জানা যায়নি। আমি দোয়া পড়তে শুরু করলাম। খুব করে দোয়া করতে লাগলাম, স্মরণের যেন কিছু না হয়। কোনো খারাপ খবর যেন না আসে। এই ভাবনা গুলোর মাঝে যখন ডুবে ছিলাম তখন হঠাৎ নজরে এলো বাবাকে। উনি এসেছেন। সাথে দেখতে পেলাম চাচি আম্মা, ছোট আাব্বুকে। জাহিনকে। বাবার চোখ টলমলে। তিনি অস্থির হয়ে এগিয়ে গেলেন অপারেশন থিয়েটারের খুব নিকটে। চাচি আম্মা এসে আমার নিকট দাঁড়াতেই আমি শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে নিলাম কান্না লুকানোর আশায়। চাচি আম্মা আমার এ অবস্থা দেখে৷ আর কিছু বলতে পারলেন না। আমি ওভাবেই রইলাম। মিনিট তিনেক পর হঠাৎ জাহিনের কন্ঠ কানে এলো। বলল

— সরি ম্যাম। আমি স্যারের খবর পেয়েই এখানে চলে এসেছি। আপনাকে জানাতে পারিনি আসলে চাইনি জানাতে। সরি।

আমি চুপটি করে দাড়িয়ে রইলাম। এরপর কাটলো আরো একটা ঘন্টা। দুপুর হয়ে এলো। এরমধ্যে আগমন ঘটলো ছোঁয়ার নানা- নানিরও। হঠাৎ দেখি অঙ্কন বেরিয়ে এলো ওটি থেকে। বাবা কিছু জিজ্ঞেস করতেই বলল

— এতো তাড়াতাড়ি কিছু বলা যায় না। বারো ঘন্টা গেলে বলতে পারবো আঙ্কেল। তবে আমার বিশ্বাস কিছু হয়নি। শুধু রক্ত লাগবে। একটু বেশি রক্তক্ষরণ হয়েছে।

কথাগুলো বলেই অঙ্কন একটা নার্সের সাথে চলে গেলো। আমি অঙ্কনের পিছু নিলাম। সে একটা রুমে প্রবেশ করে অন্য এক ডাক্তারের সাথে আলোচনা শুরু করলো। দরজার এপাশ হতে আমি শুনতে পেলাম, স্মরণের মাথার ক্ষত থেকে প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। রক্ত লাগবে অনেক। অঙ্কন দুই ব্যাগ রক্ত দেবে। বাকিটুকু খুব জলদি ম্যানেজ করবে বলেও কথা দিলো। আরো কিছু কথা বলল তারা। আমি অশান্ত মন নিয়ে শুনে গেলাম। একসময় তাদের কথার ইতি ঘটলো। অঙ্কন রুম থেকে বেরোনোর উদ্দেশ্যে পিছু ঘুরতেই আমাকে দেখে যেন থমকে গেলো। সেকেন্ড দুই স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থেকে রুম থেকে বেরোলো। আমাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে আমি করুণ সুরে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম তার দিকে

— সত্যি করে বলুন তো উনি ঠিক আছে তো? ভয়ের কিছু নেই?

অঙ্কন দাড়িয়ে গেলো। শুকানো মুখে যেন মিথ্যা হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল

— ঠিক আছে।

— কতটুকু ঠিক আছে?

অঙ্কনের মুখ শুকিয়ে গেলো। আমি তাকে বলার জন্য অনুরোধ করলাম স্মরণের ব্যাপারে। অঙ্কন বলতে এক প্রকার বাধ্য হলো

— সত্যি বলতে ট্রমাটিক ব্রেইন ইনজুরি হয়েছে। অনেক বেশি রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। ডান পায়ে আঘাত লেগেছে খুব। মাথার বিষয়টা ওর রেসপন্স দেখে বোঝা যাবে, জ্ঞান ফিরলে। আর পায়ের হাড় ফেটে গেছে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here