শ্যামারঙা,পর্ব:১৭+১৮

শ্যামারঙা
লেখিকাঃ বৃষ্টি সরকার অধরা
পর্বঃ১৭

আমার তখন সারাদিনই নবুদের বাড়িতে কাটতো।
আমার ইচ্ছে বা মন না চাইলে আমি আমাদের বাড়িতে যেতাম না…
আর কেউ আমাকে এখান থেকে যাবার জন্য বলতোও না।।।

সে সময় এ বাড়িতে আমাকে সবাই ভালোবাসতেন।শুধু পিসিমনি আমাকে কেন জানি সহ্য করতে পারতো না।
আমাকে দেখলেই তিনি নাক সিটকা তেন।
ছোট বেলায় বুঝতাম না কিন্তু বড় হবার সাথে সাথেই বিষয় গুলো বুঝতে পারি।

আর এই বিষয়টা আরও পরিষ্কার হয় সেবার নীলাদ্রি দার জন্মদিনের পর….

সেবার নীলাদ্রি দা অনার্স প্রথম বর্ষে হয়েছেন মাত্র।নতুন কলেজে নতুন বন্ধুদের সাথে তারও দিনকাল ভালোই যাচ্ছিলো….

সেই সাথে তার জন্মদিন হওয়ায় তার বন্ধুরাও তাকে পার্টির জন্য চাপ দেয় কিন্তু বড়বাবা বলেন….

—- যদি কোন অনুষ্ঠান করতেই হয় তবে এই বাড়িতে করতে হবে…
বাইরে করা চলবে না….

সবার মতামত অনুযায়ী বাড়িতেই অনেক বড় করে তাদের কাছের পরিচিত অনেক মানুষদের নিমন্ত্রণ করা হয় সেই অনুষ্ঠানে….

আমরাও নিমন্ত্রিত ছিলাম সেই অনুষ্ঠানে….
যেহেতু নীলাদ্রি দার জন্মদিন তাই ছোট বোন হিসেবে আমার আর নবুর ওপরে দায়িত্ব পড়লো বাড়ির সাজানোর। আর আমরাও সেই দায়িত্ব মাথা পেতে সাদরে নিয়েছিলাম…..

ছোটবেলা থেকে যেহেতু আমরা এক সাথেই বড় হয়েছি আর নীলাদ্রি দা আমাদের থেকে বড় তাই আমরা তাকে তুমি বলে সম্বোধন করতাম…

বেশ মিলছিল তখন আমাদের। সব সময় সব জায়গায় আমরা একসাথে যেতাম খুব মজা করতাম ।।।।

যেদিন নীলাদ্রি দার জন্মদিন ছিলো তার আগের দিন সকালে পিসিমনি এবাড়িতে আসেন।
তার সাথে আসেন তার দুই ছেলে মেয়ে মুগ্ধ হা আর কনা দি..
মুগ্ধ দাও সেবার অনার্স প্রথম বর্ষে পরতেন আর কনা দি ছিলেন মাধ্যমিকের ছাত্রী।।

অনেক দিন পর একসাথে হওয়ায় সবাই মিলে সেদিন খুব আড্ডা দিয়েছিলাম।
সারাদিন সারারাত আমাদের গল্প আর মজাতেই কেটেছিল…

পরদিন নীলাদ্রি দার জন্মদিনেও আমরা সাবাই খুব মজা করি।
যেহেতু বড়বাবা,বড়মা আর দাদু ভাই আমাকে অনেক ভালো বাসতেন তাই আমাকে দিয়েই নীলাদ্রি দা তার বেশির ভাগ কাজ হাসিল করিয়ে নিতেন….

জন্মদিনের অনুষ্ঠানের পর সবাই মজা করে এক সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম.. পরদিন সকালে আমাদের কাজ হয় সব গিফট বক্স গুলো খুলে দেখা…

আমরা সবাই যখন গিফট দেখতে ব্যস্ত আর মজা করছি তখন পিসিমনি বেশ বড় সর একটি গিফটের প্যাকেট নিয়ে এলেন….
আর বললেন…

— নীল।
এটা তোর পিসাই ইংল্যান্ড থাকে সেখান থেকে গিফট আসতেও তো সময় লাগে বল।তাই আমি গিয়ে এখন কুরিয়ার অফিস থেকে নিয়ে আসলাম ।
দেখতো তোর পছন্দ হয় কি না…..

— কি যে বল পিসি মনি পছন্দ না হবার কি আছে।
আর গিফটের কি দরকার ছিল। আর পিসাইয়ের বা এত কষ্ট করে এগুলো পাঠানোর কি দরকার ছিলো…

— হয়েছে হয়েছে।
শুধু তার কষ্টটাই দেখলি আর আমি যে নিয়ে আসলাম

আচ্ছা এবার খুলে দেখতো পছন্দ হয় নাকি…

নীলাদ্রি দা এবার প্যাকেটটা থেকে দুটো বক্স বের করলেন।
একটি ছোট আর একটি বেশ বড় আর লম্বাটে টাইপের…..

নীলাদ্রি দা এবার প্রথমে ছোট বক্সটি খুললেন সেটা তে ছিলো বেশ দামি একটি স্মার্ট ফোন তারপর অন্যটি খুললেন সেটাতে ছিলো বেশ সুন্দর কারুকাজ করা একটি ফুলদানি।

যেটা দেখে আমাদের মুখ থেকে অনায়াসে বের হয়ে গেল” অনেক সুন্দর “….

সবার মুখে একই কথা শুনে পিসিমনি খুশি হলেও আমার মুখ থেকে কথাটি শুনে তিনি বেশ রেগে গেলেন সাথে অখুশিও হলেন।

এর কিছু দিন পর পিসুমনিরা আবারও এ বাড়িতে এলেন।
অনেক দিন আবার সবাই একসাথে হওয়ায় আমরা সবাই মজায় মেতে উঠলাম…

এরই মধ্যে ডাক এলো আমাদের দুপুরের খাবারের জন্য…

সবাই যখন খাবার খেতে যাচ্ছিলো তখন আমি তাদের বললাম…

— তোমরা যাও নিচে…
আমি আসছি….

বিকেলে যখন সবাই ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছি। তখন হঠাৎ নিচ থেকে চিল্লাপাল্লার আওয়াজ কানে আসে।
আওয়াজ শুনে আমরা সবাই নিচে গিয়ে দেখি পিসিমনি নীলাদ্রি দার রুমে আর সেখান থেকেই খুব চিৎকার চেচামেচি করছেন….

আমরা সবাই তখন দৌড়ে নীলাদ্রি দার রুমে যাই।
রুমের সামনে গিয়ে দাড়াতেই পিসিমনি আমাকে খুব বকতে শুরু করেন এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে টেনে রুমের ভেতর নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন….

পরে যাবার সাথে সাথেই নিচে ফ্লোরে পরে থাকা ধারালো কোন বস্তুর টুকরোয় আমার হাত কেটে যায় আর পায়ে তার ছোট ছোট টুকরো গুলো গেথে যায়…..

চলবে…..

#শ্যামারঙা
লেখিকাঃ বৃষ্টি সরকার অধরা
পর্বঃ১৮

পরে যাবার সাথে সাথেই নিচে ফ্লোরে পরে থাকা ধারালো কোন বস্তুর টুকরোয় আমার হাত কেটে যায় আর পায়ে তার ছোট ছোট টুকরো গুলো গেথে যায়…..

একেই কি হচ্ছে বুঝে না উঠতে পারা এবং সেই সাথে পড়ে গিয়ে হাত পায়ের অসহ্য যন্ত্রণায় আমার চোখ থেকে জল পড়ছে….

পিসিমনির এমন পাগলের মতো চিৎকার ও আমার সাথে এমন ব্যবহারের কারণ যখন তার কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তখন তিনি বলেন….

—- এমন করছি কি আর সাধে,তোমার জামাই (দাদুভাইকে বললেন) ইংল্যান্ড থেকে যে ফুলদানি টা নীলের জন্য পাঠিয়েছিলো ওর জন্মদিনে সেটা এই দেখ নিচে ভেঙে পড়ে আছে….

—– তাতে তুই এখানে মেঘার দোষ কি করে দেখছিস….

—- ওইতো এসব করেছে। সেদিন উপহারটা দেখার পর থেকি ওর হাবভার আমার ভালো ঠেকছিলো না।
মনে হয় চুরির মতলব ছিলো কিন্তু তাতে সফল না হতে পেরে এটা ভেঙে ফেলেছে……

—- অনু ( পিসিমনির নাম) মুখ সামলে কথা বল।
এভাবে বলিস না কিন্তু।

—- কেন বাবা। একটি বাইরের মেয়ের জন্য এত দরদ কেন তোমাদের উতলে পরছে….

একটু আগেই তো সবার পড়ে খাবার খেতে নেমেছিল। তাই এটাই প্রমান হয় না যে ওই ( আমার দিকে তাকিয়ে)
একাজ করেছে…..

এখন জিজ্ঞেস করো ওকে কেন একাজ করেছে…..

—- না, ঠাকুরঝি(ননদ) মেঘা এমন টা করবে না।
এটা আমার জানি তাই এই বিষয় নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করার কোন প্রশ্নই আসে না…
( বড়মা)….

সবাই যখন আমার দোষ খুজতে আর ঢাকতে ব্যস্ত তখন সবাই কে অবাক করে দিয়ে নীলাদ্রি দা এমন একটা কথা বললেন যা শুনে সবাই চুপ হয়ে যায়……

নীলাদ্রি দা বললেন…

—– মেঘা
তোর যদি জিনিসটা এতোই পছন্দ হবে। আমাকে বলতে পারতি।
আমি তোকে দিয়ে দিতাম কিন্তু আমার পছন্দের জিনিস এভাবে নষ্ট না করলেও পারতি।
আর এটা তো পিসাই আমার জন্য বিদেশ থেকে পাঠিয়েছেন আমাকে ভালোবেসে….
কারোর ভালোবাসার দাম দেয়াটা তো অন্তত এখন শেখা উচিত…..

কথাটি বলেই নীলাদ্রি দা চলে গেলান আর তার কথা শুনে আমি কোন কথা বলার সুযোগই পেলাম না……

এরপর বড়মা আর কনা দি আমাকে সেখান থেকে নিয়ে যায় এবং ব্যথা ও রক্ত পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দেয়।
তখন আমি কাদতে কাদতে শুধু বড়মা ক্ব বলেছিলাম……

—- বড়মা,
আমি এই কাজটা করিনি গো….
কেন করবো বল।তোমরা কি আমাকে কম ভালোবাসো যে এমন একটা জঘন্য কাজ করবো….

—- জানি তো রে না…
আমার মেঘা এমন কাজ করতেই পারে না।সেই ছোট বেলা থেকে তোকে আমরা চিনি,জানি।
যে যাই বলুক না কেন আমরা কেউই এই কথা বিশ্বাস করি না….

এখন চুপটি করে এখানে বসতো। আমি রান্নাঘরে গিয়ে হলুদ – দুধ গরম করে আনছি..
যাতে ব্যথা একটু কমে…..

বড়মা যাবার পর আমিও তখন সেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাই….

এরপর আমাকে বাড়িতে এসে অনেক কিছু সামলাতে হয়।সবাইকে বোঝাতে হয় আমি কিছুই করিনি..
তারপর আমি নবুদের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দেই।তবে আমাকে দেখতে বড়মা মাঝে মাঝেই আমাদের বাড়িতে আসতেন…..

আর আমি সব সময় চাইলাম চাইতাম আমার জন্য যেন এই দুই পরিবারের সুসম্পর্ক যেন নষ্ট না হয়….

এর বেশ কিছু দিন পর আমার একজন কাজিনের বিয়েতে আমি ঢাকায় যাই।বিয়ের শপিং করার সময় মলের সাইডের একটি শো-পিসের দোকানে চোখ গেল।
চোখ ধাধানো সব শো- পিস আর সাথে চোখ ধাধানো অনেক রকমের জিনিস রয়েছে…..

প্রথমে আমি দোকানটায় যেতে চাইনি কিন্তু পরে কাজিনের জোড়াজুড়িতে গেলাম….

বিয়ের পর বেশ কিছুদিন ভালো সময় কাটিয়ে অনেক উপহার নিয়ে খুলনায় ফিরলাম…
খুলনায় এসে জানতে পারি আগামী সপ্তাহে নীলাদ্রি দার জন্মদিন…

আমার সেই গত বছরের কথা মনে পড়ে যায়।তবুও নিজেকে সামলে নেই…

আমার খুলনায় ফেরার খবর শুনে তার পরদিনই বড় মা আমাদের বাড়িতে আসেন।
আমাকে দেখতে আর বিশেষ করে নীলাদ্রি দা র জন্মদিনে যেতে..যাতে গত বছরের ভুল বোঝাবুঝি মিটে যায়…

আমিও সেদিন বলেছিলাম যে যাবো…

জন্মদিনের দিন আমার বাড়ীতে নীলাদ্রি দাকে দেবার জন্য যে উপহার গুলো নেওয়া হয় সেখানে আমিও একটি উপহার যোগ করি।
যেটা আমি ব্যক্তিগত ভাবে নীলাদ্রি দাকে দিতে চাই।

জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সবাই আমাকে দেখে যেমন খুশি হয় হয়েছিল। সেই সাথে সবাই আরো বেশি অবাক হয়েছিল আমার দেয়া ব্যক্তিগত উপহারের প্যাকেটটি দেখে….

প্রথমে নীলাদ্রি দা সবার সামনে গিফট টি খুলতে আপত্তি জানান।
হয়তো ভেবেছিলেন আমি মজা করার জন্য কোন ছেলেমানুষী উপহার তাকে দিচ্ছি…..

তখন তাকে অভয় দিলে সে প্যাকেট টা খোলে এবং উপহারটি দেখে সবাই মানে যারা গত বছরের ঘটনাটি জানে তারা অবাকের শীর্ষে পৌঁছে যায়….

আর আমার মুখে ফোটে বিজয়ের হাসি….

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here