শ্যামারঙা,পর্ব:২১+২২

#শ্যামারঙা
লেখিকাঃ বৃষ্টি সরকার অধরা
পর্বঃ ২১

—- আমার ভালো লাগা বা খারাপ লাগায় কেউ তো দাম দেয়নি কখনো। আর আমার এখান এগুলো সয়ে গেছে রে…
বাদ দে..অন্য কিছু বলার থাকলে তাই বল…

—- হুমম বলার আছে তবে আমার নয়….
কাল বিকেলে কী একটু সময় দিতে পারবি।

— কাল কেন?

— দরকার আছে…পারবি?

— আচ্ছা…..

সকালে সাতটার সময় বাস থেকে নেমেই সবার সাথে একটু কথা বলেই একটি রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে এলাম..যদিও মা যাবার দিন নীলাদ্রি দাকে বলেছিলেন আসার পর তিনি যেন আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসেন…..

বাসায় এসে সারাদিন খুব ঘুমালাম। দুপুরে খাবার খেয়ে বসেছি মাত্র।তখনই নবু ফোন দিয়ে বললো দেখা করার কথা।
অনিচ্ছা থাকার পরেও রেডি হয়ে ওর বলা রেস্টুরেন্টে গেলাম।নবু কে না পেয়ে আমি সেখানেই বসে ওয়েট করতে লাগলাম।
হঠাৎ দেখলাম মুগ্ধ দা আমার সামনের চেয়ারে এসে বসলেন….

—-আপনি এখানে।নবু কোথায়?

— নবু তো আসে নি..

— আসেনি মানে..ও নিজেই তো আমাকে এখানে আসতে বলেছে…

—- হুম বলেছে তবে তার নিজের জন্য নয় আমার জন্য…

—- আপনার জন্য?কিন্তু কেন….

—- অনেক গুলো বছর তো কেটে গেল মেঘা এখন ও কী আমি তোমার মনে জায়গা করে নিতে পারি নি???

—- দেখুন, আমি আপনাকে আগেও বলেছি আর এখনও বলছি।আপনাকে আমি সেভাবে কখনো দেখিনি। আর আমার মনে হয় আবেগের বয়সটা এখন আর না আমার আছে না আপনার……

—- তুমি একবার বলে দেখো আমি সবকিছু সবাইকে ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসবো।প্লিজ…

—- আজ আপনি বলছেন আমার জন্য সবাইকে ছাড়তে পারবেন কাল যে সেই সবার জন্য আপনি আমাকে ছাড়বেন না। তার ভরসা কতটুকু?

আমার কাজ আছে আমাকে যেতে হবে আসছি….

— জানো মেঘা তোমার এই ব্যবহারের জন্য তোমাকে আমার বেশি ভালো লাগে।তবে আমাকে আর একটু সময় দিলে আমি একজনের সাথে তোমার আলাপ করিয়ে দিতে চাই….
একটু সময় দেবে কী আমায়?

—- আচ্ছা, ঠিক আছে।

মুগ্ধ দা তখন তার ফোনটা বের করে কাকে যেন কল করলেন। এবং এখানে আসতে বললেন।

ফোন করার পাচ মিনিটের মাথায় একটি মেয়ে সেখানে উপস্থিত হলো। আমি মাথা তুলে মেয়েটিকে দেখে বেশ অবাক হলাম….
কারন মেয়েটি মহিমা……

এবার আমি খুব অবাক হয়ে ওদের দুজনের দিকে তাকালাম।
ওরা আমার প্রশ্ন হয়তো বুঝতে পেরেছিলো তাই মুগ্ধ দা বললেন….

— তোমাকে যার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব বলে অপেক্ষা করালাম এই যে। ওর নাম মহিমা….

—– হ্যা জানি।কিন্তু এসবের মধ্যে আমার কাজ কী?

— কাজ আছে বৈকি।তাই তো বলছি।
ও আমার হবু স্ত্রী। ওর সাথে আমার বিয়ে। এই তো কিছু দিন বাদে।

—- ও,আপনাদের অনেক শুভেচ্ছা…..

এবার মহিমা বলে উঠলো…..

— মেঘা সেদিনের ওই কাজের জন্য আর ব্যবহারের জন্য আমি সরি গো।

—- ইট’স ওকে।তবে সেদিনের ওই ব্যপারে কথা না বলাই কী ভালো নয়..

— দেখ সেদিনের ওই ব্যবহারের জন্য আমি লজ্জিত।

আসলে মুগ্ধর সাথে সম্পর্ক হবার পর ও সব সময় তোমার কথা বলতো।প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও আস্তে আস্তে খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো। সেই সাথে মায়ের (পিসিমনি) সাথে যখন তোমাকে নিয়ে কথা বলতাম সববারই তিনি আমার সামনে তোমাকে খারাপ ভাবে প্রকাশ বা উপস্থাপন করতেন তাই রাগে আমি এই কাজ করেছি….
প্লিজ মাফ করে দাও….

— এভাবে বলবেন না।

— এই কয়দিনে তোমাকে দেখে আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি তুমি কেমন।
তাই তো আজ তোমার সাথে দেখা করতে এলাম।

— আপনাদের নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভেচছা, ভালোবাসা আর শুভকামনা রইলো….

—- একটা রিকুয়েষ্ট করবো রাখবে।।

— চেষ্টা করবো..

—- আমাদের বিয়েতে তোমাকে নিমন্ত্রন করলাম।
আসতে হবে কিন্তু।
— কিন্তু পিসিমনি…..

—তুমি আমার বন্ধু হয়ে যাবে।তাহলে আমি ভাববো তুমি আমাকে মাফ করে দিয়েছো…
আর আপনি করে বলছো কেন তুমি করে বলো…..

— ঠিক আছে….

দুই সপ্তাহ পর মুগ্ধ দার বিয়ে।আমার তার বিয়েতে যাবার কোন ইচ্ছে নেই। আমি জানি আমি সেখানে গেলে পিসিমনি নানাভাবে আমাকে অপমান করবেন…..

কিন্তু মহিমার ফোনে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠছি।বিভিন্ন বাহানা করছি কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না।

সকালে ঘুম থেকে উঠেছি মাত্র। বেশ কিছু দিন লেখালেখি করা হয় না তাই বারান্দায় বসে নিজের মনে লিখছি। ডাইরি লেখা আমার ছোট বেলার থেকে শুরু। সেই সাথে আজ কাল যোগ হয়েছে গল্প লেখা।

মা এসে বললেন আমার সাথে দেখা করতে নাকি কে একজন এসেছেন।
আমি ভাবলাম মা হয়তো মজা করছেন।কিন্তু বসার ঘরে গিয়ে দেখি সত্যি কেউ একজন আমার জন্য বসে আছেন।কিন্তু তিনি যে আমার কাছে এসেছেন এবং আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

আমি বসার রুমে এসে তার সামনা সামনি বসলাম। আমার সামনে যিনি বসে আছেন।
তিনি স্বয়ং পিসিমনি…..

—- আপনি এখানে এই সময়ে কোন সমস্যা…

—- তুমি কী আমার ওপর এখনো রেগে আছো।

—- এটা স্বাভাবিক নয় কী??

— আমি জানি মা,বিনা কারণে সময়ে – অসময়ে সবার সামনে তোমাকে অনেক অপমান করেছি।তখন বিষয় গুলো অন্যরকম লাগলেও এখন বিষয় গুলো আমাকে খুব পীড়া দেয়।আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি….

—- প্লিজ পিসিমনি আপনি এভাবে বলবেন না,
আপনি আমার গুরুজন। আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে পাপী করবেন না….

—- আজ আমি তোমার কাছে একটি আবদার নিয়ে এসেছি।রাখবে??

— এভাবে লজ্জা দিবেন না।গুরুজনেরা ছোটদের কাছে আবদার করেন না আদেশ করেন।
বলুন কী বলবেন….?

— তুমি নিশ্চয়ই জানো পনেরো দিনপর মুগ্ধের বিয়ে।।

— হ্যা, জানি

— আমি চাই তুমি সেই বিয়েতে উপস্থিত থাকো এবং আমি আগামি কাল আমাদের বাড়িতে যাবো তুমিও আমার সাথে যাবে।

—- আমি? কাল?

— প্লিজ না করো না।

আমি মায়েত দিকে তাকালাম। তিনি আমাকে চোখের ইশারা দিলেন হ্যা বলার জন্য।

— আচ্ছা, ঠিক আছে।

এরপর পিসিমনি মায়ের সাথে কিছু সময় কথা বলে চলে গেলেন….

আর আমি সারারুমে পায়চারি করছি আর ভাবছি কি করবো….
তখনই ফোনে কল এলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখি নবু কল দিয়েছে…….

— কি হয়েছে বল

— কাল যাবি তো..

— এই কাজ টা তোরা না করলেই পারতি রে।তিনি তো আমার গুরুজন।

— হয়েছে ছাড় তো,এখন বল যাবি কিনা।

— পিসিমনি নিজে এসে বলে গেলেন। না গিয়ে কী পারবো আমি…

—- আচ্ছা ঠিক আছে,তোর এত কথা বলতে হবে না,।
কাল সকাল দশটায় তৈরি থাকিস। তোদের বাড়ির সামনে গিয়ে তোকে আমরা তুলে নেব…

— ঠিক আছে….

চলবে…..

#শ্যামারঙা
লেখিকাঃ বৃষ্টি সরকার অধরা
পর্বঃ ২২

—- আচ্ছা ঠিক আছে,তোর এত কথা বলতে হবে না,।
কাল সকাল দশটায় তৈরি থাকিস। তোদের বাড়ির সামনে গিয়ে তোকে আমরা তুলে নেব…

— ঠিক আছে….

বিকেলে শুয়ে আছি।তখন মা আমার রুমে এলেন সাথে নিয়ে এলেন একগাদা শপিং ব্যাগ।

— এগুলো কী মা।

— এগুলো ব্যাগ দেখতে পাচ্ছিস না।নাকি চোখের মাথা খেয়েছিস।ওহ আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম তুই তো আবার চশমা পরিস।

—- হেয়ালি রাখো মা,রাগ হচ্ছে কিন্তু আমার।

— — তোর এই রাগ আমাকে দেখাস না। এই তুই কী আমার মেয়ে।মাঝে মাঝে আমার বেশ চিন্তা হয়।

—- আমার মাথা ব্যথা করছে। দরকারী কিছু বলার থাকলে বলো না হলে আমাকে ঘুমুতে দাও।

—– আমিও না এখানে কাজে এসেছি। আমি আগে জানতাম যারা লেখালেখি করে তাদের মধ্যে নাকি অনেক রস থাকে তারা নাকি খুব রোমান্টিক হয়।
আর তুই……

—– মা……..

—- আচ্ছা, যা বলেতে এসেছিলাম।এখানে তোর জন্য আনা কয়েকটি নতুন ড্রেস আছে আর সাথে মুগ্ধ – মহিমার জন্য বিয়ের উপহার রয়েছে।।।।।

সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভাংলো।
এত সকালে ডাকার কথা জানতে চাইলে মা বললেন..
তা শুনে আমার ঘুম উবে গেল…

নীলাদ্রি দা নাকি আমার জন্য বসার ঘরে অপেক্ষা করছেন। তাও আবার প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেল।আর তিনি নাকি মাকে বলেছেন আমাকে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে।

কাহিনি কেন জানি আমার হজম হচ্ছে না। এখন সকাল আটটা বাজে। আর নীলাদ্রি দা আমাকে নিতে এখানে এখন কেন এসেছেন। নবু তো কাল বললো আমি ওদের সাথে যাবো। তাহলে এখন এগুলো কী হচ্ছে….

—- কী রে বসে আছিস কেন।যা তৈরি হয়ে নে।
ছেলেটা বসে আছে তো…

— যাচ্ছি, মা তুমি ওনাকে খাবার দিয়েছো…

— দেওয়ার কথা বলেছিলাম কিন্তু খাবে না বললো।

—- না বললেই হবে নাকি। যাও গিয়ে ওনাকে খাবার খেতে দাও।আর গিয়ে কথা বলো।
ততোক্ষণে আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি….

—- আচ্ছা, যা
ভাগ্যিস কাল ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলি না হলে দেখা যেত আজ কাপড় না নিয়েই যেতে হতো তোকে….

আধা ঘন্টার মধ্যে তৈরি হয়ে কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বসার ঘরে গেলাম।নীলাদ্রি দা আর মা যেন কি নিয়ে কথা বলছিলেন কিন্তু আমাকে দেখে থেমে গেলেন।

বেশ অনেক দিন পর তাকে দেখলাম।কেন জানি মনে হচ্ছে তার চেহারায় অনেক পরিবর্তন এসেছে।
কুয়াকাটা থেকে আসার পর আর তার সাথে আমার দেখা হয়নি।
তাই হয়তো এমন মনে হচ্ছে….

খুলনা থেকে যশোর বেশি দূরের পথ নয় আবার কাছেও নয়।আমি ভেবেছিলাম হয়তো উনি আমাকে নিয়ে ট্রেনে করে যশোর পিসিমনি র বাড়িতে যাবেন…

কিন্তু গেটের কাছে এসে দেখি তার বাইক রাখা।বেশ অবাক হলাম। এই গরমের মধ্যে কি উনি আমাকে নিয়ে বাইকে জার্নি করবেন।
আজ মনে হয় না আমার মাথা আস্ত থাকবে তীব্র গরমের উষ্ণ চাপে মাথা ভেঙে ভাগ হয়ে যাবে সাথে মাথার ভেতর যে গুলো আছে যেগুলো রৌদ্র তাপে শুকিয়ে যাবে।

আমার ভাবনা ভাংলো তার কথায়…..

— কিরে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি। যেতে হবে না?
এমনিতেই এক ঘন্টা লেট করে দিয়েছিস।।

আমি ওনার কথায় জবার না দিয়েই বাইকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।তখন আবারও তিনি ধমক দিয়ে বললেন …..

—- ওই দিকে যাস কেন?
ওই বাইক কী আমার নাকি।আর তোর মাথায় কী কিছু আছে,এই পরিবেশে আর অসহ্য আবহাওয়ায় কেউ এতপথ বাইকে যায়।
সমনে মস্ত বড় গাড়ি রাখা আছে সেটা দেখতে পাস না???

তাই তো গাড়িটাকে তো আমি খেয়ালই করি নি।বাইকে যত্তে হবে না শুনে যেন আমার মাথা ব্যথা অনেক টাই কমে গেল….

নীলাদ্রি দা আমার হাত থেকে কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে গাড়ির ডিকিতে রাখলেন।আর নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলেন।

এবার আমি পরলাম মহাবিপদে।
সামনে বসবো নাকি পিছনে.। সামনে বসলে ওনার পাশের সিটে বসতে হবে আর পিছনে বসলে ওনাকে ড্রাইভার বলে গন্য করা হবে।

কি করবো চিন্তা করতে করতেই পেছনে বসার সিদ্ধান্ত নিলাম। যেই না আমি পিছনের ডোর টা ওপেন করেছি।
ওমনি তিনি ঝাঝালো গলায় বলে উঠলেন….

—- কেউ যদি আমাকে মানে সেনাবাহিনীর ২য় লেফটেন্যান্ট কে ড্রাইভার বলে গন্য করে তবে এটা কিন্তু তার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য মোটেও ভালো হবে না…

ওনার কথাটা কানে আসার সাথে সাথে আমি ওনার পাশের সিটে এসে বসলাম…..
এরপর আবার দেখি তিনি কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছেন…

— কি হয়েছে…

—- সিট বেল্ট টা কি আমি বেধে দেব??

ওনার কথায় এবার রাগছিলো না হয়তো অন্যকোন ভাব ছিলো তাই আমাকে লজ্জা পেতে হলো।

গাড়ি তার ড্রাইভারের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে আপন গতিতে জানার পথে।
গাড়ি স্টার্টের পর আমাদের মধ্যে আর কোন রকম কথা হয়নি।তবে তার মধ্যে একবার নবু ফোন দিয়েছিলো…

চারিদিকে সবুজ অরন্য আর নিল আকাশ দেখে আমার খুব ভালো লাগছিলো। তাই তো মনে মনে অনেক গুলো ছন্দ আওরাচ্ছিলাম।কিন্তু সব গুলো কেমন যেন তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো। তাই তো ব্যাগ থেকে ডাইরিটা বের করে কবিতাটি লিখে ফেললাম…..

প্রাপ্তি তো সেখানেই
যেখানে কোন কিছু দিয়ে ভালো থাকা যায়।
তাই তো আমি
আমার মন খারাপের,
কারণ গুলো নীলচে আকাশকে দিয়েছি….

আর সে দিয়েছে আমায় ভালো থাকার সুখ।।।।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here