শ্যামারঙা,পর্ব:৪১+৪২

#শ্যামারঙা
লেখিকাঃ বৃষ্টি সরকার অধরা
পর্বঃ ৪১

মানুষ কেন দূর বিয়ে করে তা আজ বুঝলাম।আর তা হারে হারে টের পাচ্ছি….

—- ভালো হয়েছে…..
আপনার যা ইচ্ছে তাই করুন আমি যাচ্ছি…

এ বাড়িতে এসে সবার সাথে খুব আড্ডা হলো।
নীলাদ্রি বাদে সবাই মিলে আমরা ছাদে আড্ড দিলাম।
অনেক কথা হলো।

বিকেলে অর্পনদা রা যশোর ফিরে গেল।
নবু আর অর্পনদার বিয়ের ডেট ঠিক হয়েছে।
আগামী মাসে তাদের বিয়ে।

রাতে খাওয়া শেষ করে রুমে গেলাম।
ঘুম আসছে না তাই ডায়েরি নিয়ে বসেছি।
আনুসাজ্ঞিক কাজে মন লাগাতে গিয়ে নিজের শখ গুলোকেই ভুলতে বসেছি।
কিন্তু ডায়েরি লিখতেও মন বসছে না।

মনে এক অন্য কথা ঘুরছে।
যার উত্তর বা কারণ এখনো আমার জানা নেই।
আজ নিজেকে খুব একা লাগছে।
বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম বাইরে শীতল হাওয়া বইছে।
চাঁদটি আজ আকাশে তার আলোতে জ্বলছে।
কিন্তু আমার মনে কোন আনন্দ নেই।

হঠাৎ কাধে কারো স্পর্শ পেলাম।
পিছনে না তাকিয়েই সেভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম।
আমার সাড়া না পেয়ে তিনিও চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

আমার আর বারান্দায় ভালো লাগছিলো না।
তাই রুমে আসার জন্য পিছনে ফিরলাম।
দেখতে পেলাম তিনি একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

তার দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে রুমের দিকে পা বাড়াতেই তিনি আমার হাত ধরলেন।
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম আর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছি।
কিছু তিনি হাত ছাড়ছেন না।
তখনই বললেন….

—– কি হয়েছে মহারানির মন খারাপ নাকি রাগ?

—-…….

—- কি হলো কথা বলছিস না কেন?

— হাত ছাড়ুন.

— রাগ করেছিস কেন?

— রাগ করিনি

— বল..

—- কি বলবো….

— যা জিজ্ঞেস করেছি।

— বলবো না…

— কেন?

—- আপনি আমায় কিছু বলেন যে আমি আপনায় বলবো।

— কি বলিনি তোকে..?

—মনে করে দেখুন

—–ও আচ্ছা।

— হাত ছাড়ুন আমি ঘুমাবো

— কি বলিনি বলবি তো….

আমি চোখ মুখ শক্ত করে ওনার দেকে তাকিয়ে বললাম…..

— আমনি নবুর বিয়ের পর দেশের বাইরে যাবেন
এটা বলেছেন আমাকে?

— আরে…
বলতাম তো তুই ইদানীং ব্যস্ত থাকিস তাই বলা হয়ে ওঠে নি।
তোকে কে বললো এই কথা?

— রাখুন আপনার বাহানা

— এত রাগ করিস না

— আমি ঘুমাবো..

—- সবটা শুনে যা

— শুনবো না

— শুনতে হবে…
একটা ট্রেনিং এর জন্য ছয় মাসের জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে।

গত দুইদিন আগেই জানতে পেরেছি।
ভেবেছিলাম তুই ফ্রী হলে সবটা বুঝিয়ে বলবো তোকে।
তবে যাই বলিস না কেন এই দূরত্বটা আমাদের মাঝে খুব
দরকার ছিলো।

আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। আমার খারাপ লাগছে জেনেও তিনি এই কথা গুলো বলছেন।
তাই বললাম…

— কেন?

—কারন,
আমাদের সম্পর্কে সময়ের দরকার।

— ও

— হুম…
আজ একটা কথা না বলে পারছি না।

— কি

— তুই কিন্তু আমার পরিবারকে খুব অল্প সময়েই আপন করে নিয়েছিস।

— যারা আপন তাদের আর নতুন করে আপন করে নিতে হয় না।

— আমি খুব লাকি আমার জীবনে আমি তোকে পেয়েছি। কিন্তু তুই তো তা বুঝিস না।
না বৌয়ের মন পেলাম না শ্বশুর বাড়িতে জামাই আদর পেলাম।

— কে মানা করেছে আপনাকে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে জামাই আদর খেতে।
মা বাবা তো প্রতিদিন বলে আপনিইতো কাজের ছুতো দিয়ে যেতে চান না।

— যাবো যাবো,
তখন তোর বাবা ঠেলেও বের করতে পারবে না।
ওই সময় কিন্তু এত দিনেরটা সব পুষিয়ে নেব।

—- এত হ্যাংলা কেন আপনি।

— পরে বুঝবো।

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি নীলাদ্রি পাশে ঘুমাচ্ছেন।
বেশ অবাক হলাম।
কারণ এ বাড়িতে এত বেলা অব্দি ঘুমুতে দেখিনি।
ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে গিয়ে খাবার বানাবো তখন বড়মা বললেন…

—- আজ সকালের খাবার আমি বানাবো।তুই বরং গিয়ে নীল কে কফি করে দেয়ার ওকে তুলে দে।
বেরোতে হবে তো।

— কেন?

— কেন আবার
নীল বলেনি আজ তো তোরা যশোর যাবি।

— আবার যশোর কেন?

— ঠাকুরঝি তোদের যেতে বলেছে।
বিয়ের পর তো এখনও গেলি না।
আর আজ মুগ্ধ- মহিমা,কনা- অয়ন সবাই যশোর ফিরে যাচ্ছে তাই তোদেরও যেতে হবে।

—- না গেলে হয় না বড় মা।

—- না হয় না,যেতে বলেছি যেতে হবে।

— এমন করোনা।
তুমি জানো না আমি জার্নি করতে পারি না।
জানা থাকতেও ভিলেন শাশুড়ীদের মতো কেন করছো?

—- মা বললে তো করতাম না।
তুই তো এখনো আগের মতো বড়মা না।তুই তো এখনো আগের মতো বড়মা করে ডাকিস।

—- তোমারা এমন কেন?
এতদিনের অভ্যাস কি এত তারাতাড়ি যায়…

তাহলে তো ভিলেনই ভালো….

কফি নিয়ে নীলাদ্রি কে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম।
সকালের খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা তিন কাপল তিনটি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলাম যশোরের উদ্দেশ্যে…………

চলবে….

#শ্যামারঙা
লেখিকাঃ বৃষ্টি সরকার অধরা
পর্বঃ ৪২

কফি নিয়ে নীলাদ্রি কে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম।
সকালের খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা তিন কাপল তিনটি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলাম যশোরের উদ্দেশ্যে…………

এর আগেও আমি তার সাথে যশোর গিয়েছি আজও যাচ্ছি।
তবে সেদিন আর আজকের মধ্যে কত পার্থক্য।

পথে যাবার সময় তিনি আগের বারের মতো এবারেও মাঝপথে গাড়ি থামালেন।
গতবার কারণ না জানা থাকলেও এবার জানি।
তিনি এবারেও নৌকা ভ্রমণে নিয়ে যাবেন।

নৌকা ভ্রমণের জন্য নৌকাতে উঠতেই আমি অবাক।
গতবারের সেই মাঝি,সেই নৌকা।
তবে আরো বেশি অবাক হলাম সেখানকার সাজসজ্জা দেখে।
আমি নীলাদ্রির দিকে তাকালাম।
তিনি আমার তাকানো দেখেই বললেন…

—- কেমন লাগলো সারপ্রাইজ?

— কিসের সারপ্রাইজ এটা।

—- কেন তুমি জানো না?

— না।

তখনই মাঝিদের মধ্যে একজন বলে উঠলেন….

—-দিদিমনি কাল নাকি আপনার জন্মদিন।
তাইতো দাদাবাবু আমাদের সাথে মিলে আপনাকে অবাক কইরা দেবার জন্য এই কাজ করছে।
নৌকার ছই এর ভিতরে আরো মেলা জিনিস আছে।
জান গিয়ে দেখেন।

আমি অবাক হয়ে একবার মাঝির দিকে তাকাচ্ছি আর একবার নীলাদ্রির দিকে তাকাচ্ছি।
তখনই নীলাদ্রি বলে উঠলো…

— আহা….
মাঝিভাই তুমি কি সব বলে দিবে নাকি।
মেঘা চল ভিতরে চল।

আমি নীলাদ্রির সাথে ছইয়ের নিচে গিয়ে আরো বেশি অবাক হলাম।
উপহারে ভরা সম্পূর্ণ স্থানটি।আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম..

— এগুলো কেন করেছেন?

— কেন করেছি মানে।
তোর পছন্দ হয় নি?

— সেটা কিন্তু আমি বলিনি।

— এই শোন আমি আমার বৌকে ভালোবেসে এই গুলো দিচ্ছি।
তাতে তোর কি?

— এই আপনার কি মুখে কিছু আটকায় না।

— না।

এবার গিফট গুলো খুলে দেখ।

সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বিকেলে আমরা পিসিমনিদের বাড়িতে এলাম।
আমাদের দেখে পিসিমনি নতুন স্বামী স্ত্রী কে বরন করে ঘরে তুললেন।
আমাকে দেখে ‘মেঘা’ নাম বাদ দিয়ে “ছোট বউ” বলে ডাকা শুরু করলেন।

সত্যি আমি অনেক ভাগ্যবতী।
যে মানুষটা আমাকে কিছুদিন আগেও সহ্য করতে পারতেন না।সেই মানুষটা আজ আমাকে নতুন বৌয়ের মত বরন করে ঘরে তুললেন।

সারাদিন ঘোরার ফলে আমরা খুব ক্লান্ত।
তাই রাতের খাবারটা তাড়াতাড়ি খেয়ে যে যার মতো রুমে চলে গেলাম ঘুমাতে।
তবে আগের মতো আলাদা রুমে নয়।
এবাড়িতে আসলে নীলাদ্রি যে রুমে থাকেন সেই রুমটা এখন আমাদের দুজনের।

রাতে ঘুমিয়ে আছি।
ওমনি হঠাৎই কোন কিছুর আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল।
খেয়াল করে শুনতেই বুঝতে পারলাম কেউ দরজায় নক করছে।
পাশে তাকিয়ে দেখি নীলাদ্রিও রুমে নেই।
তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘুম ঘুম চোখে দরজা ওপেন করলাম।
সাথে সাথেই পার্টি স্প্রে তে আমি পুরোই ভূত বনে গেছি।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে সবাই হাসিতে মত্ত আর আমি সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছি।

আমার কোন হেলদোল না দেখে দিদিভাই আর কনাদি রুমে নিয়ে গিয়ে আমাকে পরিস্কার করে দিলো।
তারপর একটি টকটকে লাল জামদানী শাড়ি পরিয়ে দিলো যার ভেতরে সোনালী সুতার কাজ করা।
চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে তাতে ওরা দিয়ে দিলো বেলি ফুলের মালা।
আমি অবাক হয়ে বসে তাদের কর্মকাণ্ড দেখছি আর ভাবছি তাদের এমন অদ্ভুত কাজের কারণ কি মাঝরাতে।

আমাকে রেডি করে তারা ছাদে নিয়ে গেল।
ছাদে গিয়ে আমি আরও অবাক।
পুরো ছাদ বিভিন্ন রংয়ের লাইটে সাজানো হয়েছে।
সাথে ছাদের মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে লাল রংয়ের লাভ সেপের বেলুন।
একটি টেবিলে বেশ কয়েকটি মোমবাতি জ্বলজ্বল করছে।

আমি যখন এই সব নিয়ে ভাবনায় মশগুল।
তখনই সবাই একসাথে চেচিয়ে বলে উঠলো….
” Happy birthday our new family member ”

আরে তাইতো আজতো আমার জন্মদিন।
দুপুরেও তো নীলাদ্রি আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছিল।
ধুর আমি ভুলে গেলাম কেন?
আর তারা এই গুলো করলো কখন, কিভাবে….

তখনই কনাদি বলে উঠলো…

— কিরে নীলাদ্রি আর কত দেখবি এবার তো চোখের পলক ফেল.

— আমি তো চিনতেই পারছি না।

— হয়েছে ঠাকুরপো( দেবর)আর ঢং করতে হবে না।
ছোট চল এখন কেক কাটবি( দিদিভাই)

আমাকে টেবিলের কাছে যেতে দেখে দাদাভাই বললেন…

— আমাদের পরিবারে তোমাকে স্বাগতম।

— ধন্যবাদ দাদাভাই…

কেক কাটা শেষে সবাই একসাথে গোল হয়ে ছাদের মেঝেতে বসেছি আড্ডা দেবার জন্য।
আড্ডার একপর্যায়ে দিদিভাই বলে উঠলো…

— মেঘা,
তোকে অনেক ধন্যবাদ।
আমার জীবনে মুগ্ধকে দেবার জন্য।
নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে জীবন সাথী হিসেবে পাবার ভাগ্য সবার হয়না।
কিন্তু তোর কাছে আমি ঋনি তুই আমায় মুগ্ধকে ফিরিয়ে দিয়েছিস।
তোর ভালোবাসা না পাবার কষ্টে আর মায়ের তোকে নিয়ে বলা কটুকথাগুলো সহ্য করতে না পেরে যে ছেলে মনের কষ্টে বিদেশে পারি জমালো।
তাকে আমি সামলেছি এত গুলো বছর।
তখন তো মায়ের কথা অনুযায়ী আমিও তোকে ভুল বুঝতাম।

জানিস মুগ্ধ আমাকে কখনোই বিয়ে করতে চায়নি।
বলতে গেলে আমি একপ্রকার জোর করেই বিয়েতে ওকে রাজি করিয়েছিলাম।
তবে ও আমাকে একটি শর্ত দিয়েছিলো।
বিয়ের আগে ও তোর সাথে একবার একা দেখা করবে।
সেখানে ও পুনরায় তোকে ওর মনের কথা বলবে।
তুই যদি তখন ওকে মেনে নিস তবে আমাকে আর বিয়ে করবে না।
আর যদি মানা করিস তবে তোর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে।

সেদিন তুই না করে খুব ভালো করেছিলি।
যার কারণে আজ আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে পেয়েছি আর আমরা সুখে আছি।

দিদিভাইয়ের কথায় সবার মতো আমিও অবাক হলাম।
তারপর বললাম…
—- দিদিভাই তুমি যেমন তোমার ভালোবাসার মানুষের সাথে আজ ভালো আছো।
তেমনি আমিও আমার ভালোবাসার মানুষের সাথে ভালো আছি।
আমার কথায় সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো।
আমি তখন বললাম…

—- অবাক হবার কিছু নেই।
তবে আমি আর কিছু বলবো না।
কারণ এখানে আমার ভাসুরঠাকুর, জা,ননদ, নন্দাই রয়েছেন।
এখানে এসব কথা বললে বেয়াদপি হবে।

তবে ভালো থাকা না থাকা, পাওয়া না পাওয়া কোনোটাই আমার হাতে নেই দিদি ভাই।

— হুম তবে তোর জন্যই তো আমি এ পরিবার পেয়েছি।

— আর আমি তোমার মতো দিদিভাইকে পেয়েছি।
যে পিসিমনি আমাকে অপছন্দ করতেন তোমার জন্য এখন তিনি আমায় মেয়ের মতো ভালোবাসেন।
এখন তো পুরো পরিবারে আমার আমার কারোর কমতি নেই।
এখন তোমরা সবাই আমার।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here