শ্রাবণ ধারা-২ পর্ব -শেষ পর্ব

#শ্রাবণ_ধারা-২
#শেষাংশ
#সাদিয়া

শ্রাবণকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে সাথে সাথেই জ্ঞান হারায় ধারা। ধারাকে জ্ঞান হারাতে দেখে নাজমুল তাকে আগলে নেয়। নাজমুল ধারাকে নিয়ে প্রস্থান করার আগেই সেখানে পুলিশ নিয়ে রাসেল আর রকি এসে হাজির হয়। পুলিশকে আসতে দেখে ঘাবড়ে যায় নাজমুল। সে পুলিশের উপর গুলি চালানোর আগেই পুলিশ তার হাতে গুলি করে দেয় যার ফলে নাজমুলের হাত থেকে রিভলবারটা নিচে পড়ে যায় সেই সাথে ধারাও নিচে পড়ে যায়।
শ্রাবণ যে জায়গাটায় পড়ে আছে তার অনেকটা শ্রাবণের রক্তে লাল হয়ে গেছে। রকি আর রাসেল শ্রাবণের কাছে ছুটে আসলো।
—স্যার? স্যার? কথা বলুন স্যার।

শ্রাবণ তখনো জ্ঞান হারায়নি। সে অস্পষ্ট সুরে কিছু একটা আওড়ালো অতঃপর সে রকির কোলে জ্ঞান হারালো।

শ্রাবণ আর ধারাকে রাসেল আর রকি মিলে তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। শ্রাবণ আর ধারা দুজনের কারোরই জ্ঞান নেই। হাসপাতালে আনতেই ধারাকে স্যালাইন দিয়ে নরমাল কেবিনে দেওয়া হলো আর শ্রাবণকে নিয়ে যাওয়া হলো ওটিতে। যেহেতু শ্রাবণের প্রচুর পরিমাণে ব্লিডিং হয়েছে তাই ডা.সাঈদ ওদের রক্তের ব্যবস্থা করে রাখতে বলেছে। ডাক্তারের কথায় রকি গেলো রক্তের জোগাড় করতে আর রাসেল শ্রাবণের বাড়ির লোকদের জানিয়ে দিলো।
আধঘন্টার পর শ্রাবণের বাড়ির সবাই এসে জমা হলো হাসপাতালে। কান্না করতে করতে শ্রাবণের মায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। তিনি বার বার অজ্ঞান হচ্ছেন যার জন্য তাকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে শ্রাবণের বাবা মূর্তির ন্যায় বসে আছে। আজকে তার নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হচ্ছে। ছেলে নির্দোষ জানা সত্ত্বেও তিনি ছেলের জন্য কিছুই করতে পারেননি। শ্রাবণের নির্দোষ হওয়ার প্রমাণ তিনি আট বছর আগেই পেয়েছিলেন কিন্তু নিজের মেয়ে আর নাতনিকে বাঁচাতে তিনি চুপ ছিলেন। তিনি কাওকে সত্যিটা জানান নি। আজকে তার মনে হচ্ছে তার ছেলের এই দশা শুধু মাত্র তার জন্য। তিনিই তার ছেলেকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দিয়েছেন। শ্রাবণের বাবার চোখ থেকে দুফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

ঘন্টাখানেক বাদে ওটি থেকে ডা.সাঈদ বেরিয়ে আসলেন। তাকে বেরিয়ে আসতে দেখে শ্রাবণের ভাই শিহাব তার দিকে এগিয়ে যায়।
—ডাক্তার আমার ভাই কেমন আছে?

ডাক্তার সাঈদের উত্তরের জন্য সকলে তার দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। সবাই মনে মনে দোয়া করছে যেন ডাক্তার সাঈদের কাছ থেকে তারা কোনো পজিটিভ সংবাদ পেতে পারে। কিন্তু ডাক্তার সাঈদ তাদের নিরাশ করে দিয়ে শ্রাবণের কোনো ভালো সংবাদ দিতে সক্ষম হয় নি।
—দেখুন গুলিটা একেবারে শ্রাবণের হার্টের খুব কাছে গিয়ে ঠেকেছে। ওখান থেকে এক ইঞ্চি সরে গিয়ে ঠেকলেও আমরা সহজে গুলিটা বের করতে পারতাম। কিন্তু গুলিটার পজিশন এমন যে আমরা যদি এটা বের করতে যাই তাহলে ওর হার্ট ইনজোর্ড হতে পারে। এমনিতেও হার্টের খুব কাছে গুলি লাগার কারণে ওর হার্ট কিছুটা ড্যামেজ হয়েছে। আরো একটা জিনিস আমরা লক্ষ করলাম শ্রাবণের মস্তিষ্কে কিছুটা রক্ত ক্ষরণও হয়েছে। এখন কেসটা ক্রমশই ক্রিটিক্যাল হয়ে যাচ্ছে। আগে তার ব্রেনে রক্ত ক্ষরণ বন্ধ করতে হবে। কারণ ওর শরীর থেকে এমনিতে অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে। যে রক্ত বেরিয়েছে তা পূরণ করতে দুই থেকে তিনদিন সময় লাগবে। তাই ব্রেনের রক্ত ক্ষরণ অতি দ্রুত বন্ধ করতে হবে। আর গুলি বের করার বিষয়টাও জটিল। ওর বাঁচার চান্স ফিফটি ফিফটি।
এতটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ডাক্তার সাঈদ। শ্রাবণ তার ছাত্র ছিলো। খুব মেধাবী ছেলে ছিলো শ্রাবণ। কখনো কথার অমান্য করে নি। ডাক্তার সাঈদ শ্রাবণকে অনেক স্নেহ করতেন।
—এখন বলুন অপারেশনটা কি আপনারা করাতে চান। ভেবে বলবেন কারণ অপারেশন টেবিলেই শ্রাবণের মৃত্যু হতে পারে।

অনেক ভেবেচিন্তে শিহাব অপারেশনের জন্য রাজি হয়। ডাক্তার সাঈদও চলে যায় নিজের কর্তব্য পালন করতে।
শ্রাবণের অপারেশন শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই জ্ঞান ফেরে ধারার। জ্ঞান ফেরার পর থেকে শ্রাবণ শ্রাবণ করে তার অবস্থা পাগল প্রায়। যার জন্য তাকেও ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে।
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। সবাই আল্লাহ্ কে ডাকছে। সবার প্রার্থনাতে আজ শ্রাবণ। এতোক্ষণে হাসপাতালে ধারার বাবা-মা ও চলে এসেছে। অদ্ভুত হলেও এটাই সত্যি যে তারাও আজ শ্রাবণের সুস্থতার জন্য দোয়া করছে। এসব দেখে রাসেল আরও রকি তাছ্যিলের হাসি দিলো। তাদের কাছে এসব ন্যাকামি ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। মানুষের স্বভাবটাই এমন শুধু তাদের কৃতকর্ম দেখে কর্মের পেছনের আসল মটিভটা তারা কখনো দেখবে না বিবেচনা করবে না। কোনো কিছু বিবেচনা না করেই তারা দোষারোপ করবে, কটুবাক্য প্রয়োগ করবে। আরো কতো কি করবে সেটা তারাই ভালো জানে।

সাড়ে চারঘণ্টা পর আবারো বেরিয়ে আসলেন ডাক্তার সাঈদ। এবার আর তিনি কাউকে নিরাশ করেননি। ভালো সংবাদ না দিলেও খুব একটা খারাপ সংবাদ তিনি দেন নি। ডাক্তার সাঈদ বলেছেন যদি ৭২ ঘন্টার মধ্যে শ্রাবণের জ্ঞান না ফেরে তবে সে কোমায় চলে যাবে। এখান এটাই দেখার পালা ৭২ ঘন্টার মধ্যে শ্রাবণের বডি কোনো মুভমেন্ট করতে সক্ষম হয় কি না।
শ্রাবণের মায়ের ঘুম ভাঙ্গলো অপারেশন শেষ হওয়ার এক ঘন্টা পর। তিনি অশ্রু সিক্ত চোখে আই সি ইউর বেডে পড়ে থাকা শ্রাবণের নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে আছেন। এতোগুলা বছর পর ছেলেকে এই অবস্থায় দেখতে হবে তা তিনি কোনো দিন স্বপ্নেও কল্পনা করেন নি। শিহাবের চেয়ে তিনি শ্রাবণকে বেশি ভালোবাসেন আর তাই অভিমানটাও শ্রাবণের উপরই বেশি। তার শরীরটা খুব একটা ভালো না থাকায় শিহাব তাকে আর বাবাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। তারা যেতে চায়নি শিহাব তাকে অনেক জোরাজুরি করে বাসায় পাঠাতে সক্ষম হয়।

ধারার ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে সে শ্রাবণের পাশেই বাসে আছে। তাকে শিহাব অনেক অপমান করেছে কিন্তু ধারা সেসব কানে তুলেনি। কারণ শিহাব খুব একটা ভুল বলেনি। তার জন্যই তো আজ শ্রাবণের এই অবস্থা। তাকে যদি শ্রাবণ ভালো না বাসতো তবে তো এতো কিছু ঘটতো না। সবাই সুখে থাকতে পারতো। ধারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রাবণের হাতে হাত রাখলো।
—উঠে পড়ুন না শ্রাবণ। দেখুন সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। কখন আপনি উঠবেন চোখ খুলে তাকাবেন। উঠুন না শ্রাবণ। আপনাকে কেউ আর কষ্ট দেবে না শ্রাবণ। কেউ আপনাকে চরিত্রহীনও বলবে না। কেউ আপনাকে কোনো দোষ দেবে না। আপনি শুধু একবার উঠে পড়ুন।
ধারা কান্নায় ভেঙে পড়লো। তার কান্না বাঁধ মানছে না। সব কিছুর জন্য তার নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে।
শ্রাবণের এমন গুরুতর অবস্থায় শ্রাবণের বাবার মাইনর হার্ট এট্যাক করেছে। শ্রাবণের মাও প্রচন্ড ভেঙে পড়েছে। এখন সকলের মনে হচ্ছে আট বছর আগে যদি তারা প্রথমেই শ্রাবণের উপর রাগারাগি না করে শ্রাবণের এমন একটা পদক্ষেপ নেওয়ার কারণ খুঁজে বের করতো তাহলে হয়তো এমন একটা তাজা প্রাণ এখানে নিথর হয়ে পড়ে থাকতো না। আজ তাদের সকলের আফসোস হচ্ছে। শ্রাবণের এমন পরিণতির জন্য সবাই এখন সবাই নিজেদের দায়ী করছে! তবে এখন আর আফসোস করে তো লাভ নেই।

ওইদিকে ঘটনার দুইদিন পর নাজমুলকে কোর্টে তুলা হয়েছে। নাজমুল বাঁচার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে সক্ষম হয় নি। অর্গান স্মাগলিং আর এট্যামট টু মা’র্ডারের কেসে তার যাবত জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। শ্রাবণ নাজমুলের বাঁচার কোনো পথ খোলা রাখেনি। নাজমুল ভাবে,
—নিজে মরতে মরতে আমার মরার ব্যবস্থাও করে দিয়ে গেছে সে। বলতে হবে এলেম আছে ছেলের।
এই জীবনে নাজমুলের আর জেল থেকে ছাড়া পাওয়া হবে না। জেলে যাওয়ার সাথে সাথে নাজমুল তার পাওয়ার সব হারিয়েছে যার জন্য এখন তার জেলে পঁচে ম’রা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

.
ডাক্তার সাঈদের দেওয়া ৭২ ঘন্টা শেষ হতে আর মাত্র দুই ঘন্টা বাকি। এই সত্তর ঘন্টায় শ্রাবণের বডিতে কোনো রকমের মুভমেন্ট দেখা যায়নি। এই ৭০ ঘন্টায় ধারা শ্রাবণের কেবিনে শ্রাবণের হাত ধরে আহার নিদ্রা ছেড়ে ঠায় বসেছিলো। শত বলেও কেউ তাকে এখান থেকে সরাতে পারেনি। কেবিনের বাইরে লোকের সমাগম। সবাই শ্রাবণের সুস্থতা কামনা করছে।

শ্রাবণের কেবিনে শ্রাবণের সাথে গল্প করায় ব্যাস্ত ধারা। জার্মানিতে ধারার দিন কেমন কেটেছে তাই সে বলছে শ্রাবণকে। এর মাঝে ডাক্তার সাঈদ আসলেন শ্রাবণের চেকাপের জন্য। ডাক্তার সাঈদ কিছুক্ষণ শ্রাবণকে দেখে চলে গেলেন। ডাক্তার সাঈদ চলে যেতেই ধারা টুল টেনে বসলো। শ্রাবণের বা হাতের উপর নিজের ডান হাতটা রাখলো।
—আমাদের শ্রাবণ-ধারার কাহিনী এখনো তো শুরুই হয়নি শ্রাবণ। আপনাকে উঠতে হবে। আপনাকে সুস্থ হতে হবে। আমার জন্য সুস্থ হতে হবে। আমাদের ভালোবাসার জন্য আপনাকে সুস্থ হতে হবে শ্রাবণ। আমাদের শ্রাবণ-ধারার কাহিনীকে পূর্ণতা না দিয়ে আপনার রক্ষে নেই শ্রাবণ। আমাদের ভালোবাসা নাজমুল নামের নষ্ট কিটের কাছে হেরে যেতে পারে না শ্রাবণ। আজ যদি আপনি না উঠেন তাহলে ভালোবাসা হেরে যাবে শ্রাবণ। কেউ আর ভালোবাসতে সাহস পাবে না। সবাই ভালোবাসাকে অভিশাপ মনে করবে। আপনাকে উঠতে হবে শ্রাবণ। আপনাকে উঠতে হবে। বাইরে বসে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের জন্য আপনাকে উঠতে হবে। আপনাকে আপনার মায়ের জন্য উঠতে হবে। আপনাকে আপনার বাবার ঢাল হতে হবে শ্রাবণ। আপনি একবার বলেছিলেন না আপনি আপনার ভালোবাসার মানুষের সাথে নিজের জীবনের শেষ ষাট বছর আনন্দে কাটাতে চান। ভুলে গেলেন সব? আপনি ভুলে যেতে পারেন না শ্রাবণ। আপনাকে উঠতে হবে। আপনি উঠতে বাদ্য শ্রাবণ।
ধারা শ্রাবণের হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে মৃদুস্বরে বললো,ভালোবাসি! খুব ভালোবাসি শ্রাবণ!
কথাগুলো শ্রাবণের কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো কিনা তা ধারা জানে না। ধারার মনে হচ্ছে আজকে ভালোবাসার পরীক্ষা। এই দুই ঘন্টায় শ্রাবণের বডি যদি মুভমেন্ট করে তবে জিতে যাবে ভালোবাসা। আর যদি না করে তবে হেরে যাবে ভালোবাসা। ধারা বুকে পাথর চাপা দিয়ে শ্রাবণের চোখ খোলার অপেক্ষায় বসে আছে। তার শ্রাবণ স্যারের অপেক্ষায় বসে আছে।
#শ্রাবণ_ধারা-২
শেষাংশের বোনাস
#সাদিয়া

★পাঁচ বছর পর★
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে ধারা। সে আজকে নিজেকে শুভ্র রঙে সাজিয়েছে নিজেকে। এই শুভ্র রঙ শ্রাবণের অনেক পছন্দ।
—ধারা এই ধারা হলো তোমার?

—উফ চেচামেচি করছেন কেন এত?

—আর কতক্ষণ লাগবে তোমার তৈরি হতে। আমরা অলরেডি অনেক লেইট ধারা।

—কার জন্য লেইট হলো বলুন? বলুন কার জন্য লেইট হলো?

শ্রাবণ ভ্রু কুঁচকে বললো,
—কার জন্য?

—আপনার গুনধর মেয়ের জন্য। ওকে তৈরি করাতে গিয়েই তো আমার দেরি হয়েছে।

—এতো মিথ্যে কিভাবে বলো গো তুমি? মুখে বাঁধে না তোমার। আত্মা সায় দেয় এতো মিথ্যা বলতে। কিভাবে দেয়?

—কি মিথ্যা বললাম আমি?

—এই যে বললে আমার গুনধর মেয়েকে তুমি তৈরি করালে। এটা কি মিথ্যা নয়? ওকে তো আমি তৈরি করালাম।

ধারা কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,
—ওহ্ আচ্ছা তাই বুঝি?

শ্রাবণ নিজের পাঞ্জাবির কলারটা একটু উঁচিয়ে ভাব দেখিয়ে বললো,
—অফকোর্স।

—তা তো আমি দেখেইছি আমি কেমন তৈরি করেছেন মেয়েকে। মাথায় তিন ধরণের তিন ক্লিপ। সাদা জামার সাথে টকটকে হলুদ মালা। বাহ্ খুব সুন্দর।

—এমন করে বলছো কেন? আমি কি শ্রাবণীকে আর কখনো তৈরি করাই নি নাকি।

—হ্যাঁ করিয়েছেন তো। তারপর তো আমাকে ওটা আবার এক ঘন্টা সময় ব্যয় করে ঠিকঠাক করতে হয়েছে সবসময়। অকর্মা একটা।

—তুমি আমাকে অকর্মা বললে?

—কেন আপনি বুঝি তা নন?

—অবশ্যই আমি নই। আমি একজন ওয়েলনোন ডাক্তার ধারা। তুমি আমাকে এভাবে অকর্মা বলতে পারো না।

ধারা কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে মিহি কণ্ঠে ভেসে আসে,
—আব্বু-আম্মু তোমরা কি ঝগড়া করছো?

শ্রাবণীর কথায় শ্রাবণ মেকি হেঁসে বললো,
—তওবা তওবা আস্তাগফিরুল্লাহ্। এইসব কি বলছো মা আমরা কেন ঝগড়া করবো। আমরা তো কথা বলছিলাম।
শ্রাবণী কোমড়ে হাত দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললো,
—সত্যি তো।

শ্রাবণ এবার শ্রাবণীকে কোলে তুলে নিয়ে ওক গাল টেনে দিয়ে বললো, সত্যি।

—তাহলে ঠিক আছে।

—এই যে কালা ডাক্তার হলো আপনার?

—জ্বী গলা ভাঙা ডাক্তার হলো। চলুন।

—চলুন। চলো মা।

—চলো বাবা।

ধরিত্রী রহমান শ্রাবণী। শ্রাবণ আর ধারার এক মাত্র মেয়ে। সেদিন শ্রাবণ মুভমেন্ট করেছিলো। ধারার ভালোবাসা জিতে ছিলো। নির্ধারিত সময় পর যখন ডাক্তার সাঈদ শ্রাবণকে চেক করে তখনও শ্রাবণের বডি কোনো মুভমেন্ট করেনি। অগত্য ডাক্তার সাঈদ বাহিরে গিয়ে সবাইকে বলে শ্রাবণ কোমায় চলে গিয়েছে। সকলে যখন কান্নায় ভেঙে পড়ে তখনই নার্স দৌড়ে এসে ডাক্তার সাঈদ কে বলে শ্রাবণ হাত পা নাড়াচ্ছে। ডাক্তার সাঈদ গিয়ে চেক করে দেখে শ্রাবণ প্রায় অনেকটা ইম্প্রুভ করেছে। শ্রাবণের হঠাৎ ইম্প্রুভমেন্ট মিরাক্কেলের থেকে কিছু কম ছিলো না। হয়তো সকলের দোয়া আর ভালোবাসাতেই শ্রাবণ সুস্থ হয়ে উঠেছিলো।

—শ্রাবণ ধারা হলো তোদের?

—আমাদের তো অনেক আগেই হয়ে গেছে কিন্তু তোমার ব উ মা-র তো হয় না এখনো। সে তো গরিবের দীপিকা তার কি এতো সহজে হয়।

—তুই কি কোনোদিন ভালো হবি না শ্রাবণ?

—আমি খারাপ ছিলাম কবে যে তুমি আমাকে ভালো হতে বলছো ভাইয়া?

—তোর সাথে কথা বলাই বেকার। তোর ডাক্তার না হয়ে উকিল হওয়ার উচিত ছিলো।

—হয়েছে তোমাদের? আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

—হয়ে গেছে চলো চলো।

সবাই বেরিয়ে গেলো রুশাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। আজকে রুশার বিয়ে। রুশার স্বামীও একজন ডাক্তার। রুশা বিয়ে করতে চায়নি। শ্রাবণ রুশাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে। রুশা বিয়ে না করলে শ্রাবণ কখনই নিজেকে ক্ষমা করতে পারতো না। তার জন্য রুশার জীবনটা নষ্ট হয়ে যেত। অনেক কাঠ খর পুড়িয়ে শ্রাবণ রুশাকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়েছে। ধারাও রুশাকে বুঝিয়েছে। এক জনের জন্য তো আর জীবন থেমে থাকে না। জীবন প্রবাহমান। সে নিজের মতো চলমান। সে কারো জন্য থামে না। সে কারো ইচ্ছেতে চলে না। বরং সকলকে তার ইচ্ছাতেই চলতে হয়।

একঘন্টা পর তারা রুশাদের বাড়িতে পৌঁছালো। ততক্ষণে বর যাত্রীও পৌঁছে গেছে। শ্রাবণী শ্রাবণের কোল থেকে নেমে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে।
—শ্রাবণী আস্তে আস্তে হাঁটো। নয়তো পড়ে যাবে।
কাঠ কাঠ গলায় কথাটা বললো ধারা। শ্রাবণী ইনোসেন্ট ফেস করে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বললো,
—আব্বু আম্মু বকে।

—যার যা হেবিট।
বলেই মুখ বাঁকা করলো শ্রাবণ। ধারা রাগি দৃষ্টিতে তাকালো শ্রাবণের দিকে। ধারার তাকানো দেখে শ্রাবণ শ্রাবণীকে তাড়া দিয়ে বললো,
—তাড়াতাড়ি পা চালা রে মা আমার।
ধারা একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। শ্রাবণ আর শ্রাবণী দুজনে একই ধরনের। ধারাকে জ্বালিয়ে তন্দুরি বানিয়ে দেয়। এদের জ্বালায় ধারার জীবন অতিষ্ঠ। ধারা বাড়ির ভেতরে ঢুকে রুশার কাছে গেলো। রুশাকে বেশ সুন্দর করে বধু বেশে সাজানো হয়েছে। তাকে দেখতে একদম পুতুলের মতো লাগছে।
—ইশশ আমার যে কবে এমন অনুষ্ঠান করে বিয়ে হবে। বুঝলে ধারা তোমার বাপ একটা কিপ্টে লোক। তার একমাত্র মেয়ে তুমি আর তোমার বিয়ে এমন ভাবে দিলো যে কাকপক্ষীও টের পেলো না।
বেশ আসফোসের সুরেই কথাটা বললো শ্রাবণ। ধারা রেগে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বললো,
—আমার বাবাকে আপনি অনুষ্ঠান করার সুযোগ দিয়েছেন? প্রথমবার তো অঘটন ঘটিয়ে বিয়ে করেছেন। আর দ্বিতীয় বার কি করলেন? গায়ে হলুদের দিন আমাকে কিডন্যাপ করে সোজা বান্দরবান নিয়ে চলে গেলেন! নিজে এতো উল্টা পাল্টা কাজ করে এখন আমার বাবাকে কিপ্টে বলা হচ্ছে?

—আমার কি দোষ? সব দোষ তো তোমার বাপের। তোমার বাপ বিয়ের ডেট এতো দেরিতে কেন দিলো? সে কি জানে না বউ ছাড়া থাকা কতো কষ্টের? এমনিতেই আট বছর বউ ছাড়া বিধবা জামাইয়ের মতো ছিলাম। তোমার বাপতো আমার বিরুদ্ধে আরো ষড়যন্ত্র করেছিলো। সে আমি তোমাকে কিডন্যাপ করেছিলাম বলে তার প্ল্যানটা ফ্লপ করলো।
শ্রাবণের কথায় ধারা প্রচন্ড রেগে গেলো। শ্রাআণ সবসময় তার বাবাকে নিয়ে খোঁচা দেয় তাকে। ধারা প্রচন্ড রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই শ্রাবণ তাকে ঠেলে ঠুলে স্টেজে পাঠিয়ে দেয় ছবি তুলতে।

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে তারা রাত দশটায় বাসায় আসে। শ্রাবণী ঘুমিয়ে গেছে ততক্ষণে। শ্রাবণ শ্রাবণীকে কোলে করে নিয়ে এসে সুন্দর করে বিছানায় শুইয়ে দিলো। শ্রাবণী অনেক বাবা পাগলী একটা মেয়ে। শ্রাবণের সাথে থাকলে ধারার কথা সে মনেও করে না। এতে বেজায় মন খারাপ হয় ধারার। মেয়ে কেন এত বাবা বাবা করবে? মেয়ে তো সে কষ্ট করে জন্ম দিয়েছে। তবে মেয়ের কেন শুধু বাবার জন্য ভালোবাসা থাকবে? উত্তর নেই কারো কাছে।

বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে আছে ধারা। ব্যস্ত শহরের শান্ত রূপ দেখায় মত্ত সে। শ্রাবণ আর শ্রাবণী গভীর ঘুমে মগ্ন। ধারা একবার বিছানায় থাকা বাবা মেয়েদের দিকে তাকিয়ে আবারো অন্ধকার দেখায় মন দিলো। কোন যেন অন্ধকার দেখতে তার অনেক ভালো লাগে। কিয়ৎক্ষণ পর ধারা নিজের পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব করলো। ধারা বুঝলো এটা শ্রাবণ।
—এখানে কি করছো ধারা? ঘুমাবে না?

—ঘুম আসছে না। আপনি গিয়ে ঘুমান।
শ্রাবণ গেলো না। দাঁড়িয়ে রইলো ধারার পাশে। তারা দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
—আচ্ছা ধারা আমি যদি ওইদিন ওভার কাম না করতাম তাহলে কি করতে তুমি?

—অপেক্ষা করতাম।

—চাল ঝুটি। তুমি ডাক্তার বলদা রাফিকে বিয়ে করতে আমি জানি।

—সে বিবাহিত না থাকলে ভেবে দেখতাম।
বলেই হাসলো ধারা। শ্রাবণ বললো,
—আহা শখ কত মেয়ের। লাগে আমি তোমাকে ওর কথা ভাবতে দিতাম।

—দিতেন না বলছেন?

—অবশ্যই।

—কিন্তু আপনি তো কোমায় থাকতেন।

—আরে ধুর কে বলেছে আমি কোমায় থাকতাম। কোমা কি মামার বাড়ি নাকি যে চাইলেই যাওয়া যায়। কোনো কোমা টোমার বিষয় নেই আর ছিলোও না কখনও।

—মানে?

—ওইদিন গু’লিটা আমি ইচ্ছে করেই শরীরে লাগিয়েছিলাম।

ধারা বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো শ্রাবণের দিকে।
—মানে? কেন?

শ্রাবণ বাঁকা হাসলো।
—ওই নাজমুল যাতে কোনোদিন গারদ থেকে রেরুতো না পারে সেই জন্য। শ্রাবণকে মা’রা এতো সহজ নয়। আর ওই নাজমুলের পক্ষে তো তা একেবারেই সম্ভব নয়। ওকে আমি সব দিক থেকে দূর্বল করে তবেই ওর সামনে গিয়েছিলাম। আমি তো এটাই চেয়েছিলাম যে ও আমাকে গুলি করুক আর ও তাই করলো। সেই সাথে নিজের বরবাদিও পাকা করে দিলো।

—আপনি এমন কেন করলেন শ্রাবণ? যদি আপনার কিছু হয়ে যেত?

—কি আর হতো মরে যেতাম।
নির্লিপ্ত কণ্ঠে কথাটা বললো শ্রাবণ। ধারা ছলছল চোখে তাকালো শ্রাবণের দিকে।
—আপনি এখনও আমাদের ক্ষমা করেন নি তাই না?

—তোমাদের আমি ক্ষমা কেন করতে যাবো? তোমরা ভুল করেছো কোনো অন্যায় তো করোনি। আমি যাদের বাঁচাতে নিজের জীবনের আটটা বছর কুরবান করলাম তাদের উপর রাগ করে থাকবো? এটা কেমন কথা? যদি রাগই করে থাকবো তাহলে তাদের বাঁচাতে এত কিছু কেন করলাম।
বলে আলতো হাসলো শ্রাবণ।
—আপনার আমাদের উপর অভিমান হয় না?

—হয় তো। অনেক অভিমান হয়। কিন্তু কি বলো তো আমার ভালোবাসার পাল্লাটা অভিমানের পাল্লা থেকে বেশি ভারি।

—ভালোবাসি।
শ্রাবণ আলতো হেঁসে বললো,
—আমিও বোধহয় বাসি।

ধারা মুচকি হেঁসে অন্ধকারে মন দিলো। শ্রাবণ ধারার হাতের উপর হাত রেখে সেও অন্ধকার দেখতে লাগলো। পূর্ণ হলো তাদের শ্রাবণ-ধারার কাহিনি!

★সমাপ্ত★

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here