#’শ্রাবণ রাতের বর্ষণ’❤
#’লেখিকাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
#’পর্বঃ ১০
_________________
শ্রাবণ মাস। অথচ আকাশে রৌদ্রের তাপমাত্রা দারুণ ভাবে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছে। সঙ্গে রুদ্রের ক্রোধের পরিমাণ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তারই অগ্রে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রা। কিছু না বলেই চন্দ্রাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলেন রুদ্র। মাথায় থাকা আঁচল সরিয়ে চুলে আলতো করে হাত বোলাতে শুরু করলেন রুদ্র। শান্ত অথচ গাম্ভীর্য কণ্ঠে আওড়ালেন,
—” ওগো কমলবতী, ভালোবাসি!
ভালোবাসি তোমার কাজল রাঙ্গা আঁখি,
ভালোবাসি তোমার আলতায় রাঙ্গা হাত,
ভালোবাসি তোমার কালো রঙা কেশ,
কেশবতী, ভালোবাসবে কি এই অধমকে,
চিরদিন_________”
বলা শেষ না হতেই চন্দ্রাকে আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেন রুদ্র। চন্দ্রার হিতাহিত জ্ঞান নেই। বাবা মায়ের মৃত্যুর শোকে কাতর সে। সেও রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে নিরবে কাঁদছে। শুধু কি কাঁদছে? হাতের নখ দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলছে রুদ্রের পিঠ!
___________________
রত্নমা মাত্রই স্নান করে নিজ কক্ষে এসেছে। পোশাক পরিধান করে দর্পণের দিকে তাকাতে নিবে তার আগেই পশ্চাৎ (পেছন) থেকে কেউ একজন ফুলদানি ছুঁড়ে মারে দর্পণে। সাথে সাথে দর্পণ ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। হতম্ভব রত্নমা দর্পণের পানে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। পরপরই তড়িৎ গতিতে পেছন ফিরে তাকায় সে। রুদ্র দেওয়ালের সঙ্গে ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রত্নমা ঢোক গিলে কয়েকবার। আশেপাশে তাকাতেই দেখতে পায় দাস-দাসীর ছায়াও নেই কক্ষে। এ কিভাবে সম্ভব? একটু আগেও তো তারা রত্নমার অগ্রে ছিল। তাহলে? বড় বড় কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে রুদ্রের দিকে চোখ তুলে তাকালেন রত্নমা। সঙ্গে সঙ্গে কয়েক কদম এগিয়ে এলেন রুদ্র। রত্নমার গালে আলতো করে হাত স্পর্শ করলেন। ধীর কণ্ঠে বললেন,
—” ভালোবাসো আমায়? যা চাইবো তা করতে পারবে?”
রত্নমা চমকায়। রুদ্রের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায়। পরপরই হাসি ফুটে উঠল রত্নমার। রুদ্রের মুখে আগের সেই কাঠিন্য নেই এখন। তবে রুদ্রের চেহারা এখন কিরুপ তাও বুঝতে পারছে না রত্নমা। হাসি, রাগ, অনুভূতি বিহীন চেহারা। কিছুক্ষণ রুদ্রের চোখে চোখ রেখে আবেগী হয়ে উঠল রত্নমা। বলল,
—” আমি আপনার জন্য সকল কিছু করতে পারবো রুদ্র। সকল কিছু! মৃত্যুও সাদরে গ্রহণ করব আপনার জন্যে।”
রুদ্র বাঁকা হাসে। রত্নমা একদম কাছে এসে বলে উঠে,
—” তাহলে প্রস্তুত হও রত্নমা।”
বলেই রত্নমার কেশ মুঠ করে ধরে আগা পর্যন্ত তলোয়াড় দিয়ে কেটে দেন রুদ্র। রত্নমার চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। মাথা হাত দিতেই রুদ্রের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকায় সে। তার হাটু অব্দি কেশ কেটে ফেলেছেন রুদ্র। কেন? ততক্ষণে রুদ্রও অনেকটা দূরে এসে দাঁড়িয়েছেন রত্নমার। মুখে তার কৃত্রিম হাসি! হুশ ফিরতেই রত্নমা রুদ্রের উদ্দেশ্যে জোড়ে জোড়ে চিল্লিয়ে ওঠে,
—” আপনার এত বড় স্পর্ধা! আমার কেশ! আমার কেশ কেটে ফেলেছেন আপনি। এত বড় দুঃসাহস।”
রুদ্র চোখ-মুখ শক্ত করে ফেলেন। রত্নমার একদম কাছে এসে বলে উঠেন,
—” তুমি তো আমার জন্য মৃত্যুও গ্রহণ করতে পারবে নির্দিধায়। তাহলে সামান্য কেশের জন্য এত উগ্য হতে ওঠা? সত্যিই কি ভালোবাসো আমায়?”
রত্নমা থমকায়। কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না। রুদ্রের এরুপ আচরণের অর্থ বুঝতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তার। তবুও নিজেকে শান্ত করে হাসার চেষ্টা করে সে। রুদ্রের বুকে হাত রেখে বোলাতে বোলাতে বলে উঠে,
—” আমার সৌন্দর্য তো আপনি কেড়ে নিলেন সম্রাট। ইহা তো উচিত নয়। তবুও আমি যা করেছি তার জন্য ক্ষমা প্রার্থি। আমার আপনার ওপর উচ্চস্বরে কথা বলা উচিত হয় নি। কিন্তু তাই বলে আমার ভালোবাসার ওপর কোনো ধরণের সন্দেহ করবেন না।”
রুদ্র রত্নমার ছোট ছোট চুল কানে গুঁজে দিতে দিতে বলে উঠলেন,
—” এটা তো শুধু শুরু রত্নমা। ভালোবাসলে যে কষ্ট পেতেই হবে।”
এর মধ্যে একজন দাসী তাদের শিবিরে এসে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানায়। স্থলের দিকে চক্ষু রেখে বলে উঠে,
—” সম্রাট, ক্ষমা করবেন আমায়। রাজকুমারী চন্দ্রা নিজ কক্ষের সবকিছু ভেঙ্গে ফেলছেন। আহার গ্রহণও করছেন না।”
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকান দাসীর পানে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠেন,
—” আমি আসছি। তুমি এখন যেতে পারো।”
আদেশ মতে দাসী চলে যায়। রুদ্র আবারও তাকান রত্নমার দিকে। বাঁকা হেসে বলেন,
—” তোমাকে কিন্তু অনেক সুন্দর লাগছে রত্নমা। একদম আবেদনময়ী।”
রত্নমা নির্দিধায় বলে উঠে,
—” তাহলে আজকে রাতে আপনার সেবা করতে গ্রহণ করুন আমায় রুদ্র।”
সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন রুদ্র,
—” সম্রাট! রুদ্র নয়। আর হ্যাঁ! আমার ইচ্ছে আমি কার সঙ্গে রাত্রি যাপন করব। তুমি বলবে না আমায়। স্মরণ থাকে যেন!”
বলতে বলতেই রত্নমাকে থাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন রুদ্র। তারপর বের হয়ে যান কক্ষ থেকে। রত্নমা বুঝতে পারছেন না রুদ্রের হঠাৎ রাগার কারন। সম্রাট না বলে রুদ্র বলায় এমন রাগ? ভাবতেই ‘চ’ এর মতো বিরক্তি নিয়ে একটা শব্দ বের করল রত্নমা। কেন যে রুদ্রকে নাম ধরে ডেকেছে সে! নাহলে তো রুদ্রের সঙ্গে আরও কিছু সময় কাটাতে পারতো সে। কিন্তু আফসোস তা কি আর হওয়ার! পরক্ষণেই আবার মাথায় হাত রাখলো রত্নমা। যেমন হোক, তার হাঁটু অব্দি কেশ কেটে দিয়েছে রুদ্র। যাতে কষ্ট হচ্ছে রত্নমার। কান্না আসছে প্রচুর। আবার মনে হচ্ছে হয়তো তাকে সুন্দরই লাগছে। নতুবা যে সম্রাট কারো প্রসংশা করে না সে আজকে তার করলো কেন? এ ভাবনায়ই মনটা একটু হলেও স্থীর হলো তার। তবে পুরোপুরি ভাবে না। দর্পণও ভেঙ্গে ফেলেছেন রুদ্র। নিজেকে নিজে দেখবার উপায়ও নেই।
______________________
কক্ষের জিনিসপত্র একেরপর এক ভেঙ্গে চলেছেন চন্দ্রা। নিজ মাতা-পিতার হত্যাকারীকেই সে তার দুর্বলতা প্রকাশের মাধ্যম করে নিয়েছে। যেখানে তার উচিত ছিল রুদ্রকে আঘাত করা সেখানে সে রুদ্রের বুকে মাথা রেখে কাঁদছিল। ছিঃ নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা হচ্ছে চন্দ্রার। ইচ্ছে করছে সব ধ্বংস করে ফেলতে। সব! এমন সময় এক ধরণের বিকট শব্দ কানে এলো চন্দ্রার। অগ্রে তাকাতেই দেখলো তারই সঙ্গে রুদ্রও কক্ষের সব কিছু ভেঙ্গে ফেলছেন। চন্দ্রা রুদ্রের দিকে তাকাতেই রুদ্র হাতে থাকা মাটির জিনিস স্থলে ফেলে খানিকটা হাসলেন। চন্দ্রার দিকে এগোতে এগোতে বলে উঠলেন,
—” তোমার কষ্ট কমাচ্ছিলাম। তো, সবকিছু ভেঙ্গে শান্তি লাগছে এখন?”
রুদ্র কাছে এসে দাঁড়ান চন্দ্রার। চন্দ্রা এক কদমও পিছু হটেন না। বরং চোখে জল এবং মুখে রাগ ফুটিয়ে কঠিন কণ্ঠে বলে উঠেন,
—” এত নিষ্ঠুর কেন আপনি? আমার মাতা-পিতাকে হত্যা করে একটুও অনুতপ্ততা অনুভব হচ্ছে না আপনার? অমানুষ! কিভাবে নির্লজ্জের মতো হাসছেন!”
রুদ্র ভ্রু কুঁচিকে বলে উঠলেন,
—” আমি তোমাকে বলেছি আমি তোমার মাতা-পিতাকে হত্যা করি নি। তবুও এতো সন্দেহ? ভালো লাগলো! মনে সন্দেহ রাখা ভালো। আর শুনো চন্দ্রপ্রভা, আগে ভাবো আমাকে তুমি কি ডাকবে। নিষ্ঠুর, নির্লজ্জ নাকি অমানুষ। তারপর নাহয় যেকোনো একটা ডেকো। তাছাড়া সব নামেও ডাকতে পারো। এতে ভালোবাসা বাড়ে।”
বলেই চোখ মারলো রুদ্র। চন্দ্রা ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো। অতীব রাগী কণ্ঠে বলল,
—” কোনো প্রমাণ আছে কি আপনার?”
রুদ্র চন্দ্রার একদম কাছে এসে বলল,
—” প্রমাণ ছাড়া সম্রাট রুদ্রদীপ কোনো কথা বলে না। তবে কিছুদিনের সময় নিচ্ছি। দোষী নিজে সিকার করবে তার ভুল।”
থেমে থেমে রুদ্র আবারও বললেন,
—” পরশু কিন্তু আমাদের বিবাহ চন্দ্রা।”
চন্দ্রা চট করে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—” এ বিবাহ হচ্ছে না।”
—” হবে! অবশ্যই হবে। তুমি নিজেই করবে সেটা।”
—” কখনও না!”
রুদ্র শান্ত স্বরে বললেন,
—” তুমি সেটা বিবাহের দিনই দেখো। এবং হ্যাঁ, বিবাহ কিভাবে হবে, তুমি কিভাবে এসব থেকে পালাবে এসব না ভেবে আমাদের ফুলশয্যার কথা ভাবো। কেননা, এ জনমে পালানোটা ঠিক সম্ভব হবে না তোমার। এ রুদ্র হতে দিবে না।”
বলতে বলতেই চন্দ্রার মুখের একদম কাছে এসে দাঁড়ালেন রুদ্র। একটু ঝুঁকে চন্দ্রার কানের কাছে এসে বললেন,
—” আমি কিন্তু একদম ভালো নই চন্দ্রা। তোমার ভাষায় নিষ্ঠুর, নির্মম, অত্যাচারী! তোমাকে পেতে মৃত্যু ছাড়া সব কিছু করতে পারবো। ছাড় পাবে না কিছুতেই।”
চন্দ্রা ‘টু’ শব্দটিও করলেন না৷ ঘৃণার সঙ্গে চেয়ে রইলেন রুদ্রের পানে মাত্র।
_________________
রত্নমাকে তৈরি করছে দাসীগণ। বারংবার রত্নমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে তারা। যা বোধগম্য হচ্ছে না রত্নমার। এবার খানিকটা বিরক্ত হয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠল,
—” কি হলো। এভাবে হাসছো কেন তোমরা?”
সাথে সাথে চুপসে গেল সবাই। আমতা আমতা করে বলে উঠল একজন,
—” ক্ষমা করবেন। আমরা নিজেরা নিজেরা একটা বিষয় নিয়ে হাসছিলাম।”
রত্নমা আর কিছু বলল না৷ সবকিছু বিস্বাদ লাগিছে তার। কেশ কাঁটার পর তাকে কেমন লাগছে তা দেখার ভীষণ ইচ্ছে তার। তাই চটজলদি তৈরি হয়ে রাণী অমরার কক্ষে প্রবেশ করেন রত্নমা। রত্নমাকে দেখতেই চেঁচিয়ে উঠলেন রাণী অমরা। রত্নমার কাছে এসে বলে উঠলেন,
—” এ কি হাল তোমার কেশের রত্নমা? এ অবস্থা কে করেছে তোমার?”
—” আপনার ছেলে রুদ্র। কেন রাণীমা? আমাকে কি দেখতে ভালো লাগছে না?”
—” অবশ্যই না। কুৎচিত লাগছে তোমাকে।”
—” কিন্তু রাণীমা, রুদ্র যে বললেন?”
রাণী অমরা খানিকটা হাসার চেষ্টা করে বললেন,
—” তোমাকে বোকা বানিয়েছে ও।”
রত্নমা কথা বাড়ালো না। দ্রুত পদে দর্পণের অগ্রে গিয়ে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়ে উঠল সে। কেশ বিহীন কেমন দেখাচ্ছে তাকে। চেহারায় পুরুষ পুরুষ ভাব এঁটে গেছে। কান্না পাচ্ছে তার। এমন কেন করল রুদ্র তার সঙ্গে? জিদে সব কিছু ধ্বংস করতে ইচ্ছে করছে রত্নমার। এর প্রতিশোধ তো সে নেবেই। আলবাদ নেবে!
.
____________চলবে____________
{ মনে তেমন কারো মন্তব্য ধরে নি। তাই কারো নাম উল্লেখ করতে পারি নি দুঃখীত। রি-চেক করিনি। তাই ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং ধরিয়ে দেবেন। ধন্যবাদ….}
Ishanur Tasmia