‘শ্রাবণ রাতের বর্ষণ’ – ০৩
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
____________________
রুদ্র ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন চন্দ্রার দিকে। ভয়ে চন্দ্রা পিছিয়ে গেলো কয়েক কদম। তবুও রাগী কণ্ঠে বলে উঠল,
— “আমার কাছে আসবেন না আপনি। আপনি একজন বিশ্বাসঘাতক, বেইমান।”
সম্রাট রুদ্র চোয়াল শক্ত করে বললেন,
— “কি করেছি আমি?”
রুদ্রের এহেন অভিনয় দেখে রেগে যান চন্দ্রা। লম্বা একটা শ্বাস টেনে বলে উঠেন,
— “কি করেছেন আপনি জানেন না? আপনি পরিকল্পনা করেই আমাদের রাজ্যে এসেছেন। নতুবা এভাবে আমার পিতা-মাতা, আমার রাজ্য দখল করেছেন কেন?”
রুদ্র চন্দ্রপ্রভার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
— “তুমি দেখছি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। তাহলে এত বোকা হয়ে থাকো কেন? এত ভীতু কেন তুমি?”
— “আমি কেমন তা আপনাকে আপনার রুদ্ধে রুদ্ধে বঝাবো আমি। শেষ করে ফেলবো আপনাকে। একেবারে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবো।”
রাজকুমারী চন্দ্রা ক্রমশই রেগে যাচ্ছেন। তার চেয়েও অধিক রেগে আছেন রুদ্র। ভ্রু দু’টো কুঞ্চিত করে বলে উঠলেন,
— “আমি তোমার প্রেমে শেষ হতে চাই রাজকুমারী। তবে তাই বলে আমার মরণ হোক এমন কিছু করতে দেবো না তোমায়। আর যদি এমন কিছু করার চেষ্টা আমার অজান্তেই করে থাকো তুমি তাহলে নিজের শাস্তির জন্য প্রস্তুত থেকো।”
কথা বলা শেষ হতেই রুদ্রের একজন সৈন্য সেখানে এসে হাজির। মাথা নুইয়ে রুদ্রকে সম্মান জানিয়ে বলে উঠে সে,
— “ক্ষমা করবেন সম্রাট। রাজা সম্রান্তকে কাবু করা যাচ্ছে না। উনি কিছুতেই রাজকারাগারের পথে যেতে চাইছেন না৷ মৃত্যুর ভয়ও তার জন্য তুচ্ছ। এমতাবস্থায় কি করা উচিত সম্রাট?”
সৈন্য থেকে আঁখি সরিয়ে চন্দ্রার দিকে তাকালেন রুদ্র। চন্দ্রা করুণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যা সম্পূর্ণ রুপে উপেক্ষা করে কক্ষ থেকে বেড়িয়ে যান রুদ্র। যাওয়ার আগে কিছু সংখ্যক দাসী ও সৈন্যদের রাজকুমারী চন্দ্রাকে পাহারা দেওয়ার জন্য রেখে যান।
০৩.
সম্রাট রুদ্রদীপ রাজা সম্রান্তের রাজপ্রাসাদে আজকের দিবা থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই হিসেবে রাজকুমারী চন্দ্রাকে তারই কক্ষে আটকে রাখা হয়েছে এবং রাজা সম্রান্ত, রাণী রূপা ও তাদের কিছু বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের বন্দী করা হয়েছে রাজকারাগারে। সম্রাট রুদ্র রাজা সম্রান্ত এবং অন্যান্যদের রাজকারাগারে বন্দী করে দ্রুত পদে এগিয়ে যান চন্দ্রার কক্ষের উদ্দেশ্যে। এদিকে রাজকুমারী চন্দ্রপ্রভা কক্ষের সমস্ত কিছু ভেঙ্গেচুড়ে ফেলছেন। হাতে ফুল দানি নিয়ে কক্ষের প্রবেশ দুয়ারে ছুঁড়ে মারবেন তার আগেই সম্রাট রুদ্র এসে তার সামনে দাঁড়ালেন। চন্দ্রা ক্রোধে ফেঁটে উঠলেন। তবে তার ভয়ও করছে প্রচুর। কিছু না করে হাতের ফুল দানি যথা স্থানে রেখে মাথা নুইয়ে রইলেন। ‘টু’ শব্দটিও করলেন না। সম্রাট রুদ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। ক্ষাণিক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন চন্দ্রার দিকে। চন্দ্রপ্রভা পিছু হঁটলেন না, না মাথা উঁচু করে তাকালেন। সম্রাট রুদ্র তার কাছে এসে থুতনিতে চাপ দিয়ে উঁচু করলেন তার মুখমন্ডল। সঙ্গে সঙ্গে থমকে গেলেন কিছু মুহুর্তের জন্য। চন্দ্রার চোখে জল স্পষ্ট। মনে হচ্ছে এখনি টপটপ করে বেড়িয়ে আসবে বিন্দু বিন্দু জল। শুকনো ঢোক গিললেন রুদ্র। শান্ত স্বরে বলে উঠলেন,
— “ভয় নেই রাজকুমারী। আমি তোমার পিতাকে কিছু করব না। তবে… তিনি যদি তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে পাঠানোর কোনো সরযন্ত্র করে থাকেন তবে তার ফলাফল নিশ্চয়ই ভালো হবে না। তার জান কঁবচ করতেও পিঁছু হঁটবো না আমি।”
চন্দ্রা এবারও কিছু বললেন না। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলেন। ইতোমধ্যে চোখ থেকে গড়িয়ে পানি পরা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। যা দেখে কষ্ট পাচ্ছেন রুদ্র। আলতো হাতে চন্দ্রার গালে হাত বুলাতেই দু’কদম পিছিয়ে গেলেন চন্দ্রা। ব্যাপারটা ভালো লাগলো না রুদ্রের। ক্রুদ্ধ চোখে একবার চন্দ্রার পানে চেয়ে দ্রুত পদে বেড়িয়ে গেলেন কক্ষ থেকে।
রুদ্র যেতেই কক্ষের দর্পনে(আয়না) তাকালেন চন্দ্রা। নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হলেন। কেমন লালচে রঙ ধারণ করেছে তার পুরো মুখশ্রী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেদারায় বসলেন চন্দ্রা। এখন দুর্বল হলে চলবে না৷ নিজ পিতা-মাতাকে রক্ষা করতে হবে তার।
০৪.
সম্রাট রুদ্র কূঞ্জনরাজ্যে এসেই রাজা সম্রান্তের সকল সৈন্য বন্দী করে ফেললেও কিছু গুপ্তসৈন্যদের বন্দী করতে পারেন নি৷ তারা বরাবরই চালাক-চতুর হওয়ায় পালিয়ে গেছে। তবে সে সকল সৈন্যরা যে রুদ্রের ওপর পাল্টা আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে সে সম্পর্কে সম্রাট রুদ্র খুব ভালো ভাবেই জ্ঞাত। তাই তিনিও প্রস্তুত হয়ে আছেন যুদ্ধের জন্যে। আর ঠিক মাঝরাতেই গুপ্তসৈন্যরা আক্রমণ করেন রাজপ্রাসাদে। উদ্দেশ্য তাদের রাজা সম্রান্তকে বাঁচাবেন তারা। আক্রমন করার কিছু সময়বাদই সম্রাট রুদ্র ও তার সৈন্য বুঝতে পারেন তাদের শত্রু আক্রণ করেছে রাজপ্রাসাদে। রুদ্র তার তলোয়াড় নিয়ে বেড়িয়ে যান যুদ্ধ করতে। এদিকে চন্দ্রার চোখ মাত্রই নিদ্রা গ্রহণ করেছিল। মাঝরাতে মানুষের কোলাহল এবং অর্তনাদ শুনে বিচলিত হোন চন্দ্রা। কক্ষে চোখ বুলাতেই দেখেন কেউ নেই কক্ষে। এটাই সুযোগ! পালাতে হবে তার। তবে কিভাবে পালাবে সে? আর কিভাবেই বা নিজ পিতা-মাতাকে রক্ষা করবে? তাছাড়া বাহিরে এত কোলাহল কিসের? শুকনো ঢোক গিলে গায়ে চাদর জড়িয়ে নিলেন চন্দ্রা। কক্ষের বাহিরে উঁকিঝুকি দিয়েও কাউকে দেখতে পেলেন না তিনি। মনে সাহস যুগিয়ে এগোতে লাগলেন রাজ্যের পেছন দুয়ারের দিকে। পথিমধ্যে দাসী কিরণের সাথে দেখা। চন্দ্রা দ্রুত পায়ে এগিয়ে যান তার দিকে। কিরণও তাই। কিরণের কাছে আসতেই চন্দ্রা বলে উঠেন,
— “কিরণ? তুমি ঠিক আছো? বাইরে এত কোলাহল কিসের? আমার পিতা-মাতা ঠিক আছেন তো?”
— “জ্বী রাজকুমারী। তবে রাজ্যে যুদ্ধ হচ্ছে। সম্রাট রুদের সাথে আমাদের কিছু গুপ্তসৈন্যদের সাথে। এটাই সুযোগ রাজকুমারী। আপনি পালিয়ে যান এখান থেকে। রাজা সম্রান্ত আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে পালাতে সাহায্য করতে।”
— “কিভাবে? পিতাকে তো বন্দী করা হয়েছে।”
— “আজ্ঞে হ্যাঁ রাজকুমারী। তবে আমাদের সৈন্যরা রাজ্যে ঢুকেই প্রথমে রাজা সম্রান্তকে রেহা করেছেন। তারপর আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে পালাতে সাহায্য করতে।”
— “কিন্তু কিভাবে কিরণ? পিতাকে ছেঁড়ে কিভাবে চলে যাবো আমি।”
— “রাজকুমারী বোঝার চেষ্টা করুন৷ এখানে রয়ে গেলে আপনার বন্দী জীবন কাটাতে হবে। পরে হয়তো নিজের রাজ্য, নিজের মাতা-পিতাকেও বাঁচাতে পারবেন না। তাই আপনার যেতে হবে রাজকুমারী। নিজের রাজ্য, নিজের মাতা পিতার জন্য যেতে হবে। এখন চলুন রাজকুমারী। কেউ এসে পড়বে এখানে।”
কিরণের কথায় চন্দ্রা সায় দিলেন। দ্রুত পদে এগিয়ে গেলেন রাজপ্রাসাদের পেছনের দুয়ারের দিকে। এবং এদিকটায় কেও না থাকায় নিশ্চিন্তে পৌঁছে গেলেন সেখানে। একটা কালো রঙের ঘোড়ায় চড়ে বসলেন চন্দ্রা। একবার নিজের রাজপ্রাসাদের নিকট চেয়ে দ্রুত গতিতে ঘোড়া নিয়ে ছুটিতে লাগলেন চন্দ্রা।
_______________________
যুদ্ধ শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ। বরাবরের মতো সম্রাট রুদ্রই বিজয়ী হয়েছেন। তবে চারপাশে বিজয়ের কোনো উল্লাস নেই, জয় লাভের কোনো আনন্দ নেই। শুধু আছে ভয়। রুদের ভয়ে সবাই জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রক্তে রঞ্জিত তলোয়াড় নিয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হাঁটছেন রুদ্র। তার অগ্রে তিনজন সৈনিক দাঁড়ানো। এবং তাদের পাশেই হাঁটু গেড়ে বন্দী অবস্থায় বসা রাজা সম্রান্ত, রাণী রূপা ও দাসী কিরণ। রুদ্র প্রথমে তিনজন সৈনিকের সামনে দাঁড়ালেন। কঠিন কণ্ঠে বললেন,
— “তোমাদের আমি যুদ্ধের সময় রাজকুমারী চন্দ্রার কক্ষ পাহারা দিতে বলেছিলাম। কোথায় ছিলে তোমরা? রাজকুমারী পালালো কিভাবে?”
সৈনিকগণ আমতা আমতা করতে লাগলেন৷ ঠিক উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। অবশেষে প্রচন্ড ভয় নিয়ে বলে উঠলেন,
— “ক্ষমা করবেন সম্রাট। আমরা যখন উনার কক্ষে গিয়েছিলাম তখন উনি উনার কক্ষে উপস্থিত ছিলেন না।”
সম্রাট রুদ্র গর্জে উঠলেন এবার,
— “আমাকে জানাও নি কেন তখন?”
তিনজন সৈনিক একসাথে বলে উঠলেন,
— “ক্ষমা করুন সম্রাট। এমন ভুল আর হবে না।”
রুদ্র চোয়াল শক্ত করে ফেললেন৷ পরক্ষণেই বাঁকা হেসে উত্তর দিলেন,
— “পরেরবার এমন ভুল করার সুযোগও পাবে না তোমরা।”
চমকে উঠল তিনজন সৈনিক। কিছু বলবে তার আগেই একে একে তিনজনেরই গর্দার উড়িয়ে দেন রুদ্র। সাথে সাথে তাদের দেহ লুটিয়ে পরে স্থলে। রুদ্র এবার কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন কিরণের দিকে। ধমকে বলে উঠেন,
— “কোথায় আমার চন্দ্রা?”
কিরণ সাহস নিয়ে বলে উঠে,
— “আমার মৃত্যু ঘটলেও আমি আপনাকে বলব না সম্রাট।”
রুদ্র রেগে বলে উঠেন,
— “তাহলে বেশ। মৃত্যুই গ্রহণ করো।”
সাথে সাথে কিরণের চিৎকার ভেসে ওঠে কানে। পরপরই সে লুটিয়ে পরে মাটিতে। সবশেষে এবার রাজা সম্রান্তের দিকে তাকালেন রুদ্র৷ হাসলেন তিনি। এদেরকে জিজ্ঞেস করলে যে এরা উত্তর দেবেন না সেটা জানেন রুদ্র। তাই অহেতুক প্রশ্ন করলেন না আর। তবে রাজা সম্রান্তের পানে রুদ্র রাগ ও শান্ত মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসছেন৷ কেননা রাজা সম্রান্ত যুদ্ধে তার ডান পা হারিয়ে ফেলেছেন। যা শান্তি দিচ্ছে সম্রাট রুদ্রকে। প্রচন্ড শান্তি! বাঁকা হেসে রাজা সম্রান্তের উদ্দেশ্যে সম্রাট রুদ্রদীপ বলে ওঠেন,
— “চন্দ্রার ঠিকানা তো আমি বের করেই ছাড়বো। আপনি বললেই কি আর না বললেই কি? আমার ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চয়ই জ্ঞাত আপনি।”
.
.
_______________চলবে_______________