শ্রাবণ রাতের বর্ষণ পর্ব ২

‘শ্রাবণ রাতের বর্ষণ’- ০২
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা❤
_________________

— “বিবাহ করেছি বলে ভেবো না আমার উপর তোমার কোনো অধিকার খাটানোর সুযোগ আমি তোমায় দেবো। তুমি নিত্যান্তই আমার জন্য একজন রক্ষীতা। এর বেশি কিছু হওয়ার চেষ্টা করবে না কখনও। নতুবা নিজের গর্দান সহিসালামত থাকবে না। যাও নিজের কক্ষে গিয়ে এভাবে বসে থাকো। আমার কক্ষে জায়গা নেই তোমার।”

শেষের কথাটা অনেকটাই ধমকের সুরে বলে উঠলেন সম্রাট রুদ্রদীপ। নিজের কক্ষে প্রবেশ করতেই নিজ শয্যায় রত্নমাকে বসে থাকতে দেখে অনেকটাই মেজাজ বিগড়ে যায় তার। তার দুই বৌয়ের মধ্যে কেউই তার কক্ষে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করার ক্ষমতা রাখে নি কখনও। সেখানে এই মেয়ের এত দুঃসাহস! ভেবেই অবাক হচ্ছেন রুদ্র। ক্ষাণিকটা সময় পার হলেও রত্নমাকে একই স্থানে একই ভাবে বসে থাকতে দেখে রুদ্র আরও রেগে যান। হাত দিয়ে কক্ষে সাজানো ফুলগুলো এক এক করে ছিঁড়ে ফেলেন। তপ্ত কণ্ঠে বলে উঠেন রত্নমাকে,

— “তুমি কি মৃত্যুকে ভয় পাও না? কি চাইছো তোমার গর্দান আমার তলোয়াড়ে ক্ষত-বিক্ষত হোক?”

এবার অনেকটাই ভয় পেল রত্নমা। চরম ভয়াবহ উত্তেজনায় একবার সম্রাট রুদ্রের পানে তাকালো সে। সাথে সাথে কেঁপে উঠল। রুদ্রের রক্তিম চোখ দু’টো আর সহ্য করা সম্ভব নয় তার। এতক্ষণ নিজের ভয়কে সংযত রেখে বসে থাকলেও এখন তা মোটেও সম্ভব নয়। ভারি পোশাক পায়ের দিক থেকে একটু উঁচু করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো রত্নমা। ধীর পায়ে বেড়িয়ে গেল কক্ষ থেকে। প্রায় সাথে সাথেই রুদ্র ‘ধপ’ করে শুয়ে পড়লেন শয্যায়। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠল রাজকুমারী চন্দ্রপ্রভার ভয়ার্তক মুখশ্রী। হাসি ফুটে উঠল রুদ্রের মুখে। বিড়বিড় করে বলে উঠলেন উনি,

— “খুব শীগ্রই তুমি আমার হবে রাজকুমারী। খুব শীগ্রই!”

০১.

রাণী রূপার কোলে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছেন চন্দ্রপ্রভা। ভয়ে হাত-পা কাঁপছে তার। জিবনে প্রথম কারো মৃত্যু নিজ চোখে নিজেরই অগ্যে দেখেছেন উনি। ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক! তবে রাজা সম্রান্ত চন্দ্রার এমন ভয়ে কাঁপাকাঁপি দেখে বরাবরই হতাশ হচ্ছেন। চন্দ্রপ্রভা! কূঞ্জনরাজ্যের পরবর্তী রাণী। সে-ই কিনা সামান্য মৃত্যু দেখে এত ভয় পাচ্ছে? এটা তো মোটেও কাম্য ছিল না রাজা সম্রান্তের। তিনি জানেন তার কন্যা অধিক ভীতু ও সরল। তবে জেদ আর তেজও আছে বটে। কিন্তু সরলতা থেকে কম। এই ভীতু ভাব এবং সরলতা কাটাতেই নানা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চন্দ্রাকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করছিলেন রাজা সম্রান্ত। কিন্তু তার আগেই এমন ঘটনা ঘটে গেল…! তারওপর যেই সেই সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাত হয় নি চন্দ্রার। সয়ং সিংহদীপ সম্রাজ্যের সম্রাট রুদ্রদীপের সাথে হয়েছে। সবচেয়ে নির্মম, নির্দয়, পাষাণ সম্রাটের সাথে দেখা হয়েছে। যার সাথে রাজা সম্রান্তের তুলনা করলে দেখা যাবে রাজা সম্রান্ত সম্রাট রুদ্রদীপের সামনে কিছুই না। একটি মাত্র পিঁপড়ে মাত্র! চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠলো রাজা সম্রান্তের কপালে। নিজ সৈনিক থেকে রুদ্র আর চন্দ্রার কথোপকথন শুনেছেন তিনি। আর তার ভয় সেখানটাই। কি চাইছে রুদ্র? চন্দ্রার ক্ষতি করতে চাইছে না তো?

এদিকে চন্দ্রার ভয়ের মাত্রা বেড়েই যাচ্ছে। সম্রাট রুদ্রের রক্তিম চক্ষু, হত্যা, তাকে ভয় দেখানো, তারওপর রুদ্রের কিসব অদ্ভুদ কথাবার্তা! বরাবরই সেগুলো স্মরণ করে ভয় তীব্র হচ্ছে তার। পরক্ষণেই মনে হলো, সে কেন ভয় পাচ্ছে? সে তো একজন রাজকুমারী! কূঞ্জনরাজ্যের পরবর্তী রাণী। তার তো এভাবে ভীতু হলে চলবে না। মোটেও না! সে যে রাণী হবে কয়েকদিনবাদ। এসব মৃত্যু তো অহরহ দেখতে হবে তার। তখনও কি এভাবে ভীতু হয়ে চুপসে যাবে সে? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললেন চন্দ্রা। মনের মাঝে অসীম সাহস সঞ্চয় করতে লাগলেন তিনি। সাথে সাথে মায়ের কোলে আরেকটু ভালোভাবে শুয়ে পড়লেন চন্দ্রা।

০২.

এরপর কেটে যায় দুটো দিন। নতুন দিনের, নতুন ভোরের প্রথম আলো এসে চন্দ্রার মুখশ্রীতে পরতেই নিদ্রা ছুটে গেল তার। আড়মোড়া ভেঙ্গে নিজ কক্ষে চোখ বুলাতেই দেখলেন কিছু দাসী তার কক্ষ পরিষ্কার করছেন আর কিছু চন্দ্রার পোশাক নির্বাচন করছেন। রাজকুমারী চন্দ্রপ্রভাকে নিদ্রা থেকে উঠতে দেখেই চন্দ্রার সবচেয়ে প্রিয় দাসী কিরণ এসে দাঁড়ালো তার অগ্যে। মুচকি হেসে বলে উঠেল,

— “শুভ সকাল রাজকুমারী।”

বিনিময়ে চন্দ্রাও হেসে জবাব দেন,

— “শুভ সকাল।”

— “আপনার স্নানাগার তৈরি করা হয়েছে রাজকুমারী। আসুন স্নান করবেন।”

চন্দ্রা মুচকি হেসে কিরণের কথায় সায় দিলেন। এগিয়ে গেলেন স্নানাগারের দিকে।

রাজা সম্রান্ত নিজ কক্ষে বসে কাগজে-কলমে কিছু লিখছিলেন। সম্ভবত কোনো কবিতা। তার পাশেই বসে আছেন রাণী রূপা। নিজের প্রেয়সীকে পাশে বসিয়ে নানা কবিতা লিখেছেন তিনি। এমনটা প্রায়ই করেন তিনি। আজও তার ব্যতীক্রম নয়। কবিতা লেখার এক পর্যায়ে একজন দাসী ঢুকে পরেন কক্ষে। মাথা নুইয়ে সম্মান জানালেন রাজা সম্রান্তকে। অপরাধী কণ্ঠে বলে উঠলেন,

— “বিনা অনুমতি নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করায় ক্ষমা করবেন প্রভু।”

রাজা সম্রান্ত একটু বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ করলেন না। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,

— “কি প্রয়োজনে এসেছ তুমি?”

— “প্রভু আপনার সাথে দেখা করতে সয়ং সিংহদীপ সম্রাজ্যের সম্রাট রুদ্রদীপ এসেছেন। তিনি এখন রাজদরবারে অপেক্ষা করছেন আপনার।”

বিস্ময় নিয়ে দাসীর দিকে তাকালেন রাজা সম্রান্ত। একবার রাণী রূপার দিকে তাকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে দাসীকে নিয়ে বেড়য়ে যান রাজদরবারের উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছাতেই রুদ্রদীপকে তার সিংহাসনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখেন রাজা সম্রান্ত। গলা খাকিয়ে কাশি দিতেই রুদ্র শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন রাজা সম্রান্তের দিকে। মুচকি হেসে বলে উঠেন,

— “কেমন আছেন রাজা সম্রান্ত?”

রুদ্রের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে বসলেন রাজা সম্রান্ত,

— “আপনি এখানে হঠাৎ কি প্রয়োজনে?”

নিজ প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে ক্ষাণিকটা রেগে গেলেন রুদ্র। তবে প্রকাশ করলেন না সেটা৷ আগের নেয় শান্ত স্বরে বলে উঠেন,

— “আমি ঘুড়িয়ে-ফিড়িয়ে কথা বলতে পছন্দ করি না৷ সোজাসোজি বলছি, আমি আপনার একমাত্র কন্যা রাজকুমারী চন্দ্রাকে বিবাহ করতে চাই। সে প্রস্তাব দিতেই সয়ং এসেছি আমি।”

মুহুর্তেই গম্ভীর হয়ে উঠলেন রাজা সম্রান্ত। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

— “আপনার তৃতীয় বিবাহ হয়েছে মাত্র কয়েকদিন হলো। এর মধ্যেই আমার কন্যাকে বিবাহ করতে চাইছেন আপনি। আপনার কি মনে হয় আমি আপনার সঙ্গে আমার কন্যা চন্দ্রাকে বিবাহ দিবো? মোটেও না! তাছাড়া আপনার মতো নির্মম, অত্যাচারী, নিষ্ঠুর সম্রাটের সাথে তো একদমই না।”

বাঁকা হাসলেন রুদ্রদীপ। পরপরই চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলেন,

— “তাহলে আপনি আপনার কন্যার সাথে আমার বিবাহ দিতে চাইছেন না? অপমান করছেন আমায়?”

রাজা সম্রান্ত কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠেন,

— “আপনার যা মনে হয়।”

সঙ্গে সঙ্গে রুদ্র হাত দিয়ে কিছু ইঙ্গিত করতেই তার সৈনিকগণ রাজা সম্রান্ত এবং তার বিশ্বস্ত মন্ত্রী ও অন্যান্যদের বন্দী করে ফেলে নিজ তলোয়াড় দিয়ে। এরই মধ্যে রাজকুমারী চন্দ্রপ্রভা রাজদরবারে এসে হাজির। নিজ পিতাকে এভাবে বন্দী হতে দেখে চিৎকার করে ওঠেন চন্দ্রা। সেদিকে রুদ্রের চোখ যেতেই সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চন্দ্রপ্রভার দিকে। এদিকে চন্দ্রা ভয়ে কাঁপছে। রাজা সম্রান্ত গভীর ক্ষোপ এবং রাগ নিয়ে বলে উঠেন,

— “আপনি বিশ্বাস ঘাতকতা করছেন রুদ্র। এভাবে আমাদের বন্দী করার কথা ছিল না। আপনি আমাদের অজান্তেই নিজ সৈনিক নিয়ে এখানে যুদ্ধ করতে এসেছেন? তবে পার পাবেন না রুদ্র। আমার সৈনিকগণ এখনি আসছেন আমাদের রক্ষা করতে।”

রুদ্র হাসলেন। চন্দ্রার দিকে এগোতে এগোতে বলে উঠলেন,

— “আমি এমনটা চাই নি রাজা সম্রান্ত। আপনি বাধ্য করেছেন। আর রইল আপনার সৈনিক আপনাদের রক্ষা করার কথা। এখানে এসেই আপনার সকল সৈনিকদের বন্দী করে ফেলেছে আমার সৈনিকরা। তাই স্বপ্ন দেখা বন্ধ করুন।”

রাজা সম্রান্ত আরও কিছু বলতে নিলে রুদ্র বিরক্তি প্রকাশ করলেন। হাতের ইঙ্গিত করতেই রাজা সম্রান্তের মুখ চেপে ধরে রুদ্রের সৈনিক। এদিকে সম্রাট রুদ্রদীপ ক্রমশই এগিয়ে যাচ্ছেন চন্দ্রপ্রভার দিকে। তা দেখে ভয়ে কাঁপছে চন্দ্রা। এবং পিছিয়ে যাচ্ছে এক’পা এক’পা করে। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠে সে,

— “আ..মা..র পিতা..কে ছেড়ে দি..দিন। দয়া করু..ন সম্রা..ট।”

রুদ্র চোখ ছোট ছোট করে তাকালো চন্দ্রার পানে৷ হুট করে চন্দ্রার একদম কাছে গিয়ে তাকে কাঁধে তুলে নিলেন। সাথে সাথে চন্দ্রা চেঁচিয়ে উঠলেন। হাত-পা ছোটাছুটি করতে শুরু করলেন উনি। রুদ্র বাঁকা হেসে কণ্ঠে সুর এনে বলে উঠলেন,

-‘ কোমল চরণ আলতা ধোয়া,
কমলবতীর লজ্জায় সজ্জা। ‘-
.
.
_______________চলবে_______________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here