সন্ধ্যামালতী পর্ব -১৫+১৬

#সন্ধ্যামালতী (১৫)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________
(শেষের লিখা গুলো পড়ার অনুরোধ রইলো)

গভীর রাত। শূণশান, নিরবতায় ছেয়ে গেছে পুরো গ্রাম। সবাই সবার মত ঘুমিয়ে আছে। সবার জীবনই চলছে নিয়ম মতো শুধু পাল্টে গেছে সন্ধ্যামালতী আর তার জীবন। দুদিন আগের সেই চঞ্চলতাটা আর নেই। একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। দুদিন থেকে ঠিকমতো খাচ্ছেও না, ঘুমাচ্ছেও না। বকুল আর তার মা অনেক চেষ্টা করেও ঠিক মতো খাওয়াতে পারেনি আর না পেরেছে ঘুম পাড়াতে। বাদল নিশ্চুপ দর্শকের মতো দেখা ছাড়া কিছু করতেও পারে না। সন্ধ্যা এ পর্যন্ত একটা টু শব্দও করেনি কান্না তো অনেক দুরের কথা। সন্ধ্যা এক দৃষ্টিতে মাথার ওপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে তাকায়। পাশ থেকে বকুল তাকায় সন্ধ্যার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যার গালে হাত দেয়। সন্ধ্যা তবুও আওয়াজ করে না। বকুল ভাঙা ভাঙা ভাবে বলে,

‘আর কতদিন এভাবে থাকবি? আজ দুদিন হলো তুই না ঠিক মতো খাস আর না ঘুমাস! এভাবে তো অসুস্থ হয়ে পড়বি। একটু ঘুমা সই।’

সন্ধ্যা নিশ্চুপ, নিরুত্তর। বকুল জবাব না পেয়ে হতাশ শ্বাস ফেলে। আজ মেয়েটার বিয়ের দিন ছিলো। কথা ছিলো আজই সন্ধ্যা বউ সেজে বকুলদের বাড়িতে আসবে অথচ পরিস্থিতি সব এলোমেলো করে দিলো। কে বা কারা সন্ধ্যার মা আর দাদাকে মে’রেছে এ নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তায় আছে। পুলিশের কাছে সবটা জানানো হলেও পুলিশ তাতে মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না। এ থেকে বোঝা যায় যে এর পেছনে নিশ্চয় বড় কারো হাত আছে! বাদল নিজের মতো চেষ্টা করেই যাচ্ছে। বকুল উঠে সন্ধ্যাকেও উঠে বসালো। সন্ধ্যা তখনো অনুভূতিশূণ্যের মতো তাকিয়ে আছে। বকুল ফের বলে,

‘এমন পাথরের মতো কতদিন থাকবি? কতদিন নিজের মধ্যে কষ্ট চেপে রাখবি? কান্না কর না! কান্না করলে অনেক হালকা হবি। এই সন্ধ্যা কান্না কর।’

সন্ধ্যা তবুও নিশ্চুপ। সে যেনো কোনো কথা শোনেইনি। বকুল কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। অনেক চেষ্টার পরও যখন সন্ধ্যা কাঁদে না তখন বকুল করে বসে এক অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ। ঠাস করে থা’প্পড় বসিয়ে দেয় সন্ধ্যার গালে। সন্ধ্যা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। তবুও কাঁদে না আর না কোনো কথা বলে! বকুল নিজেই কেঁদে দেয়। জড়িয়ে ধরে তার সইকে। সন্ধ্যা অদ্ভুত ভাবে হাসে।

ফজরের আযান দিবে দিবে ভাব। সন্ধ্যা বকুলের কোলে মাথা রেখে মাত্রই ঘুমিয়েছে। বকুলও ঘুমিয়ে পড়েছে। এমন সময় সন্ধ্যা স্বপ্নে দেখে তার মা আর দাদা আহাজারি করছে। কান্না করছে তাকে বার বার বলছে,

‘পালিয়ে যা সন্ধ্যা। ওরা তোকে বাঁচতে দেবে না৷ পালিয়ে যা।’

শেষ সময়ে ভেসে ওঠে ফরিদের মুখ। বিভৎস মুখ নিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। চিৎকার করে যেনো বলছে, ‘তুই আমাকে সবার সামনে অপমান করেছিস তাই না। তোর মা আর দাদাকে যেভাবে মে’রেছি তোকেও মা’রবো।’

বিকট শব্দে হেঁসে উঠে। লাফিয়ে ওঠে সন্ধ্যা। ঘেমে নেয়ে তার একাকার অবস্থা। নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করতেই কানে ভেসে আসে আযানের প্রতিধ্বনি। একবার বকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ আযান শুনতে থাকে। আযান শেষ হলে উঠে এসে অযু করে নামাজ পড়ে। মোনাজাত শেষ করে আরেকটু অপেক্ষা করে ভোরের। ভোরের আলো যখন আবছা আবছা ফুটে উঠেছে তখনই সে বের হয় ঘর থেকে। সবার অলক্ষ্যে চলে আসে নিজের বাড়ি। নিজের বাড়ির প্রতিটা কোণা সে চোখ ভরে দেখে। এ বাড়িতে তার কত স্মৃতি! ফের ভেসে ওঠে তার মা আর দাদার পড়ে থাকা রক্তাক্ত লা’শের প্রতিচ্ছবি। চোখ ভরে আসে সন্ধ্যার। দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেয়। নিজের জমানো কিছু টাকা তার মায়ের জমানো কিছু টাকা ছিলো সবটা নিয়ে নেয়। এ বিষাক্ত গ্রাম ছেড়ে সে অনেক দুরে হারিয়ে যাবে। যেখানে তাকে কেউ খুঁজে পাবে না। তার আর সাহেদার ছবি নিয়ে চলে আসতে গিয়ে চোখ যায় একটা কার্ডের দিকে৷ কার্ডটা হাতে নিতেই তার যেনো ভেতর থেকে আরো হাহাকার আসে। ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে আস্তে করে আওড়ায়,

‘আপনাকে আমি খুব করে চেয়েছিলাম শহুরে ডাক্তার কিন্তু পেলাম আর কই! আপনিও হারিয়ে গেলেন আর আমার শেষ সম্বল, আমার মা আর দাদাও হারিয়ে গেলো। এ পৃথিবীতে সন্ধ্যামালতীই কেনো বার বার তার প্রিয় জিনিস, প্রিয় মানুষ গুলো হারিয়ে ফেলে! কেনো এ পৃথিবী এই সন্ধ্যামালতীর প্রিয় জিনিসকে তার থাকতে দেয় না! সন্ধ্যামালতী তো নিঃস্ব, সর্বহারা তবুও কেনো তারই বার বার সব হারাতে হয়! সন্ধ্যামালতীর আর হারানোর কিছু নেই। এবার শুধু প্রাণটাই বুঝি হারানো বাকি!’

অদ্ভুত ভাবে হাসে সন্ধ্যা। তার শহুরে ডাক্তারের কার্ডটা হাতে নিয়েই ঘর থেকে বের হয়। পুরো বাড়ি আরো একবার দেখে নিয়ে বের হয়ে আসে। একটু হেঁটে আসে কবরস্থানের সামনে। কবরস্থানে যদিও মেয়েদের ঢুকা নিষেধ তবুও কেউ নেই বলে সন্ধ্যা সাহস করে ঢুকে পড়ে। নতুন দুইটা কবরের কাছে গিয়ে বসে পড়ে। মা আর দাদার কবর দেখেই তার হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। মায়ের কবর জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। মা মা একটা গন্ধ আসে নাকে। কেঁদে উঠে শব্দ করে। তার চোখের জলে যেন ভিজে যায় মায়ের কবরের সদ্য মাটি। নিজের দাদার কবরও জড়িয়ে ধরে তারপর উঠে যায়। প্রিয় কিছু কবরের দিকে তাকিয়ে যেনো বিদায় জানায়। সকালের আলো ঠিকমতো ফোঁটার আগেই সন্ধ্যা মুখে আঁচল চেপে গ্রামের বড়রাস্তার দিকে হাঁটা লাগায়। সেখান থেকে অটো রিকশা করে স্টেশন পর্যন্ত যাবে তারপর চলে যাবে এক অপরিচিত শহরে।

___________________

সকাল সকাল আয়াশ হসপিটালে এসেছে। বুকের ভেতরটা এখনো তার হাহাকার করতেছে। কাল নিশ্চয় সন্ধ্যার বিয়ে হয়ে গেছে! সন্ধ্যা নিশ্চয় এখন অন্য কারো বউ! তার সব ভাবনার মাঝেই রানা আসে। আয়াশকে অন্যমনষ্ক হয়ে বসে থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ছেলেটা নিজের মনে গুমড়ে মরতেছে অথচ কালকেও ওকে কতবার সবাই মিলে জোড় করলো একটাবার সন্ধ্যার গ্রামে যাওয়ার জন্য। রানা আনমনে ভাবে কালকের ঘটনা!

কাজে অন্যমনষ্কতা পছন্দ না আয়াশের সেই আয়াশকে যখন কাল অন্যমনষ্ক দেখেছিলো তখনই বুঝেছিলো সন্ধ্যার জন্যই তার মন খারাপ। রানা এগিয়ে আসে আয়াশের কাছে। গলা পরিষ্কার করে বলে,

‘কাজে অন্যমনষ্ক? ব্যাপার কি দোস্ত?’

আয়াশ কিছু না বলে চুপ করে থাকে। রানা আয়াশের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বলে, ‘গ্রাম থেকে আসার পর থেকেই দেখতেছি তুই কেমন অন্যমনষ্ক হয়ে গেছিস। তোর কি কিছু হয়ছে?’

আয়াশ মাথা নাড়িয়ে আস্তে করে বলে, ‘কিছু হয়নি।’

‘নিজের বেষ্ট ফ্রেন্ডকে নিজের অনুভূতি লুকাচ্ছিস?’

আয়াশ অন্যদিকে তাকায়। মৃদু স্বরে বলে, ‘আমি নিজেই নিজেকে বুঝতেছি না তোকে কি বলবো? আমি জানি না আমার কি হয়েছে!’

রানা মুচকি হেঁসে বলে, ‘সন্ধ্যাকে মনে পড়ছে?’

আয়াশ তাকায় রানার দিকে। রানা হেঁসে বলে, ‘দোস্ত তুই তো গেছিস মনে হয়। ভালোবাসিস সন্ধ্যাকে তাই না!’

আয়াশ কিছু বলে না। রানার চোখ মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠে। দ্রুত আয়াশের কাছে এসে আয়াশকে জড়িয়ে ধরে। হেঁসে বলে, ‘বুঝছি তো আমি। দেখ আজকেই সন্ধ্যার বিয়ে তুই তাড়াতাড়ি গিয়ে ওকে নিয়ে আয়। তাহলেই সব মিটমাট।’

আয়াশ রানাকে ছাড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলে, ‘সব কিছু চাইলেই সম্ভব না।’

ব্যাস তারপরই আয়াশ বেরিয়ে যায়। সত্যি আয়াশ গ্রামে যায়নি সন্ধ্যাকে আনতে! কাল হয়তো সন্ধ্যার বিয়েও হয়ে গেছে এমনটাই সবার ধারণা। ফোনের শব্দে ঘোর কাটে দুজনেরই। আয়াশ রানাকে নিজের কেবিনে দেখে খানিকটা অবাক হয়। বলে,

‘তুই কখন আসলি?’

রানা কল কেটে ফোন সাইলেন্ট করে এগিয়ে আসে আয়াশের কাছে। বলে, ‘যখন তুই ভাবনায় বিভোর তখন এসেছি আমি।’

আয়াশ কিছু বলে না৷ দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ থাকে। দুজনের নিরবতার মাঝেই লিজা, জেরিন, তমাল, আকাশ, সাফি আসে। সবারই মন খারাপ। লিজা একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,

‘সন্ধ্যার কি বিয়ে হয়ে গেছে রানা?’

রানা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় লিজার দিকে। রাগী কন্ঠে বলে, ‘তুই যেখানে আমিও সেখানে। তাই আজাইরা প্রশ্ন করে মাথা নষ্ট করিস না।’

জেরিন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘তোর কি সমস্যা? রেগে কথা বলতেছিস কেন?’

রানা মলিন কন্ঠে বলে, ‘এমনিতেই। তোরা এখানে কেন?’

আকাশ আয়াশকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘তুই আর কবে নিজের অনুভূতি বুঝবি? কাল আমরা তোকে কতবার বুঝিয়ে বললাম যে যা সন্ধ্যাকে আনতে কিন্তু তুই তো তুই-ই! গেলি না। আজকে কেন মন খারাপ করে আছিস?’

‘তোরা সবাই একই কথা কানের কাছে না বলে নিজেদের কাজে যা। আমারে একা থাকতে দে।’

রানা এবার চরম রেগে যায়। রেগে বলে, ‘কি সমস্যা তোর? তুই একা থাকবি তো থাক। একাই থাক।’

তারপর বেড়িয়ে যায়। সাথে বাকি সবাইও যায়। আয়াশ চুপচাপ বসে থাকে। বললেই তো আর সব করা সম্ভব না! গ্রামের মেয়েদের সম্মান প্রখর হয়। গ্রামের মেয়েদের বিয়ের দিন বিয়ে ভেঙে যাওয়া মানে অনেক কিছু। সন্ধ্যার সম্মানের সাথে সাথে সাহেদার সম্মানও থাকতো না। এটা এদের কিভাবে বুঝাবে? সন্ধ্যা নাা হয় তার সাথে চলে আসতো তাই বলে কি সাহেদাও আসতো! যতটুকু তাদের চেনা হয়েছে তাতে তাদের আত্মসম্মান প্রখর।
পুরোটা সময় আয়াশের কাটে ছটফট করতে করতে। দুপুরের দিকে হসপিটাল থেকে বের হয়ে আসে। গাড়ি নিয়ে আপন মনে চলতে থাকে।

নতুন শহরের কিছুই চেনা নয় সন্ধ্যার। এতো শতো গাড়িও সে কখনো দেখেনি। কত বড় বড় বিল্ডিং, কত বড় বড় রাস্তা ঘাট। আজ ৩ দিন সে তেমন কিছুই খায়নি তারওপর এতো দুরের রাস্তায় জার্নি করে এসে বড্ড ক্লান্ত সে। একটা ফাঁকা রাস্তায় বসে পড়ে। শুনশান রাস্তায় তেমন কেউ নেই। সন্ধ্যা কিছুক্ষণ বসে উঠে পড়ে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে ঠিকই কিন্তু এতো বড় শহরে সে যাবেই বা কোথায়? এসে তো পড়েছে কিন্তু যাওয়ার মতো তো কেউ নেই। আল্লাহর যখন এতদুর এনেছেন তখন তিনিই কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিবে। চোখ মুখ মুছে উঠে হাঁটা লাগায়। কিছুটা দুর যেতেই ৩-৪ টা ছেলের দেখা মিলে। সন্ধ্যা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে হাঁটতে থাকে। কিন্তু কথায় আছে না বিপদ যখন আসে সব দিক থেকেই আসে! সন্ধ্যা পাত্তা না দিলেও বখাটে গুলো ঠিকই পাত্তা দেয়। সন্ধ্যার পিছু পিছু আসতে থাকে। সন্ধ্যা বুঝতে পারে তার পেছনে কেউ আছে তাই একবার পিছনে তাকিয়ে দেখে। ছেলেগুলোকে তার পেছনে আসতে দেখেই বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। পুরোনো কিছু আবছা স্মৃতি ভেসে ওঠে। হাতের ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরে। মনে মনে স্মরণ করতে থাকে আল্লাহকে। চোখ বুজে মায়ের মুখটা মনে করেই ছুট লাগায়। ছেলেগুলোও পেছন পেছন ছুটতে থাকে। গ্রামের মেয়েরাা মাত্রাতিরিক্ত দৌড় ঝাপ করে বলে তেমন সমস্যা হয় না সন্ধ্যার দৌড়াতে। কিন্তু ৩ দিন ধরে ঠিক মতো না খাওয়া মানুষের আর কতটুকুই শক্তি থাকে শরীরে! সন্ধ্যা যখন দেখে সে আর দৌড়াতে পারবে না তখন দুইদিকে দুটো গলি যায় সেটার একটাতে ঢুকে পড়ে। একটু আড়ালে লুকিয়ে চোখ মুখ খিচিয়ে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। হয়তো সন্ধ্যার প্রতি আল্লাহর দয়া ছিলো তাই সে বেঁচে যায়। ছেলেগুলো অন্য রাস্তায় চলে গেছে৷ কিছুক্ষণ সেখানে বসেই আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকে। জানা নেই কোথায় যাচ্ছে তবুও তার যেতে হবে। কিছুটা দুর আসতেই সে মেইন রোডে পৌছে যায়। শরীর দুর্বল বলে আর হাঁটতে পারে না। কোনোরকমে রাস্তা পার হতে গেলে ধাক্কা খায় একটা বাইকের সাথে। ছিটকে পড়ে দুরে। লোকজন ভীর জমায় সেখানে। নিভু নিভু চোখ খোলা অবস্থায় দেখতে পায় আরেকটি মুখ। ঠোঁটের কোণে ভেসে ওঠে এক টুকরো হাসি। আস্তে করে আওড়ায়, ‘শহুরে ডাক্তার!’

চলবে…#সন্ধ্যামালতী (১৬)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

রাস্তায় ভিড় দেখে গাড়ি রেখে একপ্রকার বিরক্তি নিয়েই আয়াশ দেখতে এসেছিলো কি হচ্ছে! কিন্তু এরকম একটা দৃশ্য দেখতে পাবে তা সে কল্পনাও করেনি। মুহুর্তেই যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো সন্ধ্যার রক্তে মাখা মুখ দেখে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না। সন্ধ্যা কিভাবে ঢাকায় আসবে! ‘ও’ তো এখানকার কিছুই চিনে না। লোকজনের চেঁচামেচিতে ধ্যান ভাঙে আয়াশের। নিজের চোখ ডলে ভালো করে। যখন বুঝতে পারে এটা সত্যিই সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি সন্ধ্যাকে আগলে নেয়। বার বার ডাকার পরও সাড়া পায় না। পাশ থেকে একজন বলে উঠে,

‘আপনি চিনেন উনাকে!’

আয়াশ ‘হ্যাঁ’ বলেই কোলে তুলে নেয় সন্ধ্যাকে। দ্রুত পায়ে হেঁটে গাড়িতে সন্ধ্যাকে শুইয়ে দিয়ে নিজে এসে ড্রাইভিং সিটে বসে। পাশের একটা হসপিটালে নিয়ে আসে। ডক্টর সন্ধ্যাকে দেখে দ্রুত ভর্তি করায়। মাথায় আঘাত পেয়েছে আর রক্ত প্রচুর বেড়িয়ে গেছে। আর সন্ধ্যার তো হুটহাট জ্ঞান হারানোর অভ্যাস। আয়াশ একবার এখানে ছুটছে তো একবার ওখানে। A+ রক্ত জোগাড় করে এসে একটু বসে।

পুরো বিকালটা হসপিটালেই কেটে যায়। সন্ধ্যার জ্ঞান ফেরে সন্ধ্যার আগে। অচেনা একটা জায়গায় নিজেকে দেখেই খানিকটা ভড়কায়। পাশে তাকিয়ে দেখে তার হাতে এখনো স্যালাইন চলছে। হুট করেই মনে পড়ে যায় রাস্তায় ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা। সে যখন পুরোপুরি সেন্সলেস হয়েছিলো তখন আয়াশকে দেখেছিলো কথাটা মাথায় আসতেই আশে পাশে তাকায়। মাথায় ব্যাথার দরুন কিছুটা সমস্যা হলেও চারপাশে ভালো করে দেখে। আয়াশকে দেখতে না পেয়ে হতাশ শ্বাস ফেলে। তখনই রুমে প্রবেশ করে একজন নার্স। সন্ধ্যার জ্ঞান ফিরেছে দেখে মিষ্টি করে হেঁসে বলে,

‘বাহ আপনার জ্ঞান ফিরে গেছে ম্যাম! এখন কেমন ফিল করছেন?’

সন্ধ্যা আস্তে করে বলে, ‘জ্বি ভালো।’

‘আচ্ছা আপনি রেস্ট করুন। আমি আপনার বাড়ির লোককে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

সন্ধ্যা থতমত খায়। তার বাড়ির লোক আসবে কোথা থেকে? তার মা আর দাদা তো! কথাটা মাথায় আসতেই বুকে চিনচিনে ব্যাথা হয়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ততক্ষণে নার্সটি বাহিরে গিয়ে আয়াশকে পাঠিয়ে দিয়েছে। দরজা খোলার শব্দে সন্ধ্যা সেদিকে তাকাতেই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। অনেকগুলো দিন পর তার শহুরে ডাক্তারকে দেখে চোখ ঝাপসা হয়। মানুষটা কে খুতিয়ে খুতিয়ে দেখে সে। নেভি ব্লু কালার শার্টে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ তেমন বোঝা গেলো না। আয়াশ সন্ধ্যার বেডের পাশে বসে শান্ত গলায় শুধায়,

‘এখন কেমন আছো?’

সন্ধ্যা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘ভালো।’

আয়াশ থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে। সন্ধ্যাও নিরব। বাইরে থেকে মাগরিবের আযান কানে আসতেছে। আযান শেষ হওয়া পর্যন্ত দুজনে নিরবই থাকে। নিরবতা ভেঙে আয়াশ বলে,

‘তুমি এখানে কেন সন্ধ্যা? কাল তো তোমার বিয়ে ছিলো! সাথে কেউ এসেছে? বাদল ভাই! আন্টি!’

মায়ের কথা মনে হতেই ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকায় সন্ধ্যা। কোনো রকমে মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বোঝায় তার সাথে কেউ আসেনি। আয়াশ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। মেয়েটা আগে কিছুটা সুস্থ হোক তারপর না হয় জিজ্ঞেস করা যাবে সব। আয়াশ সন্ধ্যাকে থাকতে বলে উঠে দাঁড়ায়। কিছুটা সামনে এগিয়ে কি মনে করে আবার পেছনে তাকায়। শ্বাস আটকে কোনোরকমে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার কি বিয়ে হয়ে গেছে সন্ধ্যা?’

সন্ধ্যা চমকে তাকায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আয়াশের দিকে। আয়াশ যেনো অস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জবাবের আশায়। মন চাইছে সন্ধ্যার উত্তর হোক ‘না’ কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে ‘তোর মন চাইলেই তো হবে না। ওর বিয়ে ছিলো কাল হয়তো হয়েও গেছে বিয়ে!’ মন আর মতিষ্কের যুদ্ধর মাঝেই সন্ধ্যা মৃদু কন্ঠে বলে উঠে, ‘বিয়ে হয়নি।’

ব্যাস! বুক থেকে যেনো একটা বিশাল পাথর নেমে গেলো। আয়াশ দ্রুত পায়ে বের হয়ে যায় রুম থেকে। সন্ধ্যার বিয়ে হয়নি বিষয়টা যেনো তার কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। আসলেই! ভালোবাসার মানুষকে পাওয়াটা হাতে চাঁদ পাওয়ার মতোই। সবার ভাগ্যে কি আর ভালোবাসার মানুষ জোটে!

_____________

রাত ৮ টার দিকে আয়াশের বন্ধুমহল হাজির হলো। কেউ জানে না তাদের এখানে কেন আসতে বলা হয়েছে! সন্দিহান দৃষ্টিতে আয়াশের দিকে তাকাতেই আয়াশ সবাইকে নিয়ে সন্ধ্যার কেবিনে আসে। সন্ধ্যাকে শুভ্র বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখেই সাফি চেঁচিয়ে ওঠে,

‘ওমাগো! সন্ধ্যার ভুত!’

আকাশকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে। সাফির এহেন কান্ডে সবাই অবাক। সন্ধ্যাও চমকে ওঠে সাফির চেঁচানোতে। রানা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘শা’লা ভুতের চা’মচা সব জায়গায় কি তোর ভুত দেখা লাগে!’

আকাশ সাফির চাপে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে। কোনো রকম শ্বাস আটকে বলে, ‘ভাই রানা বাঁচা আমারে। আমি এখনই এই মোটার চাপে পাপড় ভাজা হয়ে যাবো।’

রানা আর তমাল মিলে কোনো রকমে সাফি আর আকাশকে আলাদা করে। সাফি তো ভুতের ভয়ে চোখে মুখে অন্ধকার দেখতেছে। আয়াশ বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

‘তোদের ড্রামা শেষ হলে এখন চুপ কর। এটা হসপিটাল।’

সবাই চুপ করে যায়। লিজা আর জেরিন সন্ধ্যার কাছে এসে আস্তে করে বলে, ‘তুমি এখানে কিভাবে সন্ধ্যা? কাল না তোমার বিয়ে ছিলো! আর হসপিটালেই বা কিভাবে আসলে!’

সন্ধ্যা কিছু বলার আগেই আয়াশ বললো, ‘আমি এনেছি!’

সবাই প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালে আয়াশ সবাইকে পুরো ঘটনাটা বলে। কিন্তু কারোরই জানা নেই আসলে সন্ধ্যা ঢাকায় কেন এসেছে! এক্সিডেন্টের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেও পরে তেমন কিছু না হওয়ায় সবাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছে। সন্ধ্যাকে চুপচাপ দেখে কেউ আর তেমন প্রশ্ন করেনি। মেয়েটা না হয় আগে সুস্থ হোক তারপর সব জানা যাবে। লিজ সন্ধ্যাকে বলে,

‘তুমি থাকো কোথায় সন্ধ্যা?’

সন্ধ্যা মাথা নিচু করে জবাব দেয়, ‘আজকেই ঢাকায় এসেছি আপু। এখানে আমার কেউ নেই। কোথায় থাকবো জানিনা।’

‘আন্টি কোথায়? সে আসেনি?’

সন্ধ্যা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকায়। মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বোঝায় তার মা আসেনি৷ জেরিন চিন্তিত কন্ঠে বলে, ‘একা কিভাবে আসলে? আর থাকবেই বা কোথায়?’

এবারও সন্ধ্যার জবাবের আগেই আয়াশ গম্ভীর কন্ঠে বলে, ‘কোথায় থাকবে আবার! আমার বাড়িতে থাকবে৷ একটু সুস্থ হলে না হয় আমিই গ্রামে দিয়ে আসবো।’

রানা ঠোঁট চেপে হাসে। সন্ধ্যা চমকে তাকায় আয়াশের দিকে। সে শহুরে ডাক্তারের বাড়িতে থাকবে! আকাশ বলে, ‘কিন্তু বাড়ির বাকি সবাই কি ভাববে? যদি কোনো প্রবলেম হয়? সন্ধ্যা না হয় লিজা বা জেরিনের বাড়িতে…

আকাশকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই থমথমে স্বরে আয়াশ বলে, ‘সন্ধ্যা আমাদের বাড়িতেই থাকবে৷ একবার হারাতে গিয়েও ফিরে পেয়েছি। আর হারাতে দিবো না।’

কথাটা যেনো সন্ধ্যার মাথায় আকাশ পড়ার মতো অবস্থা হলো৷ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো আয়াশের মুখপানে। বাকি সবাই মিটমিট করে হাসছে। আয়াশ কাউকে পাত্তা দিলো না। শান্ত কন্ঠে লিজা আর জেরিনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘তোরা আজ রাতে একটু থাকতে পারবি! আমি একাই থাকতে পারতাম কিন্তু তোরা থাকলে সন্ধ্যাও কমফোর্ট ফিল করবে।’

লিজা হেঁসে বলে, ‘সমস্যা নাই। আমরা থাকতে পারবো।’

জেরিন সন্ধ্যার কাছে বসতে বসতে বলে, ‘এবার তুই বের হ। আমাদের জন্য খাবার আনতে যা।’

আয়াশ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘বাই এনি চান্স বের করে দিচ্ছিস!’

জেরিন ভাব নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ দিচ্ছি। এবার ভাগ।’

আয়াশ কিছু বলে না। তার একটু বাড়িতেও যেতে হবে৷ সেই দুপুর থেকে এই রক্তে মাখা শার্ট পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফ্রেশও হতে হবে। লিজা, জেরিন, আকাশ আর রানা থেকে যাবে৷ তমাল আর সাফি চলে যাবে এখন৷ আয়াশ আসলে আকাশ আর রানাও রাতে বাড়ি চলে যাবে। যতক্ষণ আয়াশ না আসে ততক্ষণই থাকবে শুধু। পুরো বিষয়টাতে একবারও সন্ধ্যা হ্যাঁ/না কিছুই বলেনি। আয়াশ সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রানাকে বলে,

‘তুই আমার সাথে আয়। খাবার নিয়ে আসিস। আমি বাইরে থেকেই একটু বাড়ি যাবো।’

রানা আর আয়াশ বের হয়ে আসে। তমাল আর সাফি আগে আগে যাচ্ছে। রানা হেঁসে বলে, ‘তোর কপালটা ভালো বলতে হবে দোস্ত। নয়তো হারিয়ে যাওয়া জিনিস কি কেউ পায়!’

আয়াশ নিঃশব্দে হাসে। চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয়। বলে, ‘হারাতে হারাতেও হারায়নি তাই তো ফিরে পেয়েছি। তবে এবার ভীষণ যত্নে রেখে দিবো যাতে আর হারাতে না পারে।’

রানা প্রশান্তির হাসি হাসে। এক মুহুর্তে দুজন ভুলে যায় আয়াশের ফিয়ন্সে সানজিদা আর বাদলের কথা। যেনো আয়াশ সন্ধ্যার জীবনে ৩য় কোনো ব্যাক্তিই নেই।

আয়াশ আর রানা বের হতেই লিজা আর জেরিন চেপে ধরে সন্ধ্যাকে। আকাশ সোফায় বসে ফোন হাতে তাকিয়ে থাকে লিজা, জেরিন আর সন্ধ্যার দিকে। লিজা আর জেরিন একটার পর একটা প্রশ্ন করতেছে অথচ বেচারী সন্ধ্যা না কিছু বুঝতেছে আর না কিছুর উত্তর দিচ্ছে! আকাশ বিরক্ত হয়ে ধমক লাগায় লিজা আর জেরিনকে। দুজনেই চমকে ওঠে। সন্ধ্যাও ভয় পায়। লিজা রাগী গলায় বলে,

‘দুই মুখা বা’ন্দর আমাদের ধমক দেস ক্যান?’

‘হ্যাঁ তাই তো৷ একদম ঘাড় ম’টকে দেবো।’

আকাশ ভেংচি কেটে বলে, ‘তোরা দুইটা পে’ত্নীর থেকে কম না। প্রমাণ করলি! এখন সন্ধ্যাকে স্পেস দে। মেয়েটাকে ছাড়। এমনিই ‘ও’ অসুস্থ তারপর তোদের প্রশ্নের ঠ্যালায় চ্যাপ্টা হয়ে যাবে৷ আর তোরা যা প্রশ্ন করছিস তার একটার উত্তরও বেচারী জানে বলে মনে হয় না।’

লিজা আর জেরিন মুখ বাকায়। তবুও সন্ধ্যা অসুস্থ বলে আর কথা বাড়ায় না। দুজনেই চুপচাপ থাকে। সন্ধ্যাও চুপ করে চোখ বন্ধ করে নেয়। ভীষণ মনে পড়ছে মায়ের সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলো। ভীষণ মনে পড়ছে দাদার সাথে খেলার সময় গুলো। ভীষণ মনে পড়ছে নিজের গ্রাম। চোখের সামনে অস্পষ্ট ভাবে ভেসে উঠে মা আর দাদার মৃত র’ক্তাক্ত দেহ। সন্ধ্যার চোখ বেয়ে টুপ করে গড়িয়ে পড়ে এক ফোটা অশ্রু।

_________________

সারা রাত নির্ঘুম কাটে আয়াশের। সন্ধ্যা, লিজা, জেরিন ঘুমালেও সে ঘুমাতে পারেনি। সন্ধ্যাকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিলো। আয়াশ সারা রাত বসে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে ছিলো। অদ্ভুত ভাবে তার একটুও বিরক্ত লাগেনি৷ অদ্ভুত প্রশান্তিতে ছেয়ে গেছে মন। এই ক’দিনের অস্থিরতা কমে পুরো মন, মস্তিষ্ক জুড়ে এক শীতল হাওয়া বয়ে গেছে। মন মেজাজ তার দারুণ রকমের ফুরফুরে। আসলেও ভালোবাসার মানুষটার মধ্যে অন্য রকম প্রশান্তি আছে। যাকে দেখলেও মানসিক শান্তি লাগে।
সকাল ১০ টাই সন্ধ্যাকে রিলিজ দেয়। সকাল সকাল আবার আয়াশের বন্ধুদল চলে আসছে। লিজা আর জেরিনের একবারে সন্ধ্যার রিলিজের পরই বাড়ি ফিরবে। সন্ধ্যার খাবার কেবিনে আনলেও বাকি সবাই বাহিরে খেয়েছে। রানা আর আকাশ লিজার বাড়ি থেকে শাড়ি আনছে। লিজা শাড়ি দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় রানার দিকে। বলে,

‘তোদের কি বুদ্ধি সুদ্ধি সব আউট হয়ে গেছে?’

‘মানে কি! আমরা কি করলাম?’

লিজা ফোস করে শ্বাস করে। বলে, ‘শাড়ি ছাড়া কি অন্য কিছু পাস নাই? বল’দের দল সন্ধ্যা এখন অসুস্থ ‘ও’ এখন শাড়ি পড়বে কিভাবে!’

আকাশ বলে, ‘এতে আমাদের কি দোষ? আন্টিই তো দিলো।’

‘তোরা গিয়ে কি চাইছিস?’

রানা আর আকাশ থতমত খায়। আমতা আমতা করে বলে, ‘সন্ধ্যাকে সব সময় শাড়িতেই দেখছি তো তাই ভুল করে আর কি..

‘হয়ছে ঢং থামা। তোরা বাহিরে যা।’

সবাই বের হয়ে গেলে লিজা আর জেরিন সন্ধ্যাকে শাড়ি পড়িয়ে দেয়। সন্ধ্যা চুপচাপ পড়ে নেয়। পায়ে ব্যাথা থাকার কারণে ঠিক মতো দাঁড়াতেও পারছে না। কোনোরকমে শাড়ি পড়া শেষ করে। সন্ধ্যা আবার বেডে হেলান দিয়ে বসে। আয়াশরা কেবিনে ঢুকতেই লিজা চিন্তিত কন্ঠে বলে,

‘আয়াশ সন্ধ্যা তো ঠিক মতো দাঁড়াতেই পারছে না। ‘ও’ যাবে কিভাবে?’

আয়াশ ভ্রু কুঁচকে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। গম্ভীর কন্ঠে বলে, ‘পায়েও ব্যাথা পেয়েছো?’

সন্ধ্যা মাথা নিচু করেই মাথা নাড়ায়। এক্সিডেন্টের কারণে সে হাতে, পায়ে, মাথায়, শরীরের বিভিন্ন জায়গাতেই ব্যাথা পেয়েছে। অনেক জায়গায় কেটেও গেছে। ব্যান্ডেজ করা হলেও ব্যাথা টা ভালো রকমেরই আছে। আয়াশ শান্ত গলায় বলে, ‘আচ্ছা সব কমপ্লিট তে!’

সবাই মাথা নাড়ায়। আয়াশ এগিয়ে এসে সন্ধ্যার দিকে হাত বাড়াতেই সন্ধ্যা তড়িঘড়ি করে বলে, ‘আমি একা যেতে পারবো।’

আয়াশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। সন্ধ্যা শুকনো ঢোক গিলে আবারও মাথা নিচু করে নেয়। বাকি সবাই তো মিটমিটিয়ে হাসার জন্যই আছে। আয়াশ বিরক্ত নিয়ে বলে, ‘বেশি কথা বললে থা’প্পড় দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিবো। চুপচাপ থাকো৷’

এমন কড়া ধমকের সামনে সন্ধ্যার আর কথা আসে না। আয়াশ সন্ধ্যাকে পাজা কোলে তুলে নেয়। সন্ধ্যা ভয়ে আয়াশের গলা জড়িয়ে ধরে। মাথা ঘুরিয়ে বাকি সবার দিকে তাকাতেই দেখে সবাই হা করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় মিইয়ে যায় সন্ধ্যা। মুখ লুকায় আয়াশের প্রশস্ত বুকে। আয়াশ ঠোঁট কামড়ে হাসে। তারপর এগোতে এগোতে সবার উদ্দেশ্যে বলে,

‘হা গুলো বন্ধ কর নয়তে আস্ত হাতি ঢুকে যাবে তোদের মুখে।’

সবাই তবুও হা করেই তাকিয়ে থাকে। একসময় আকাশ রানাকে চিমটি কেটে বলে, ‘দোস্ত এটা আয়াশ তো!’

রানা আর্তনাদ করে গাট্টা মারে আকাশের মাথায়। কর্কশ স্বরে বলে, ‘চোখে দেখোস না শা’লা? এইটা আয়াশই। ব্যাটা প্রেমে পড়ছে তাই চেঞ্জ। এখন তোরাও নিজেরা রিয়েকশন চেঞ্জ করে হাঁটা লাগা।’

______________
আয়াশের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। কলিং বেল দিলেও এখনো দরজা খোলেনি। সন্ধ্যা এখনো আয়াশের কোলে। আয়াশকে পিঞ্চ মেরে সবাই কথা বললেও লজ্জা পাচ্ছে সন্ধ্যা। এর মধ্যেই দরজা খুলে আয়াশের মা আফরা। ছেলের সাথে একটা অজ্ঞাত মেয়ে আর তার বন্ধুদল কে দেখে খানিকটা অবাকই হয়। ভাগ্যক্রমে সন্ধ্যার পড়নে শাড়ি দেখে আফরা ভাবে তার ছেলে বুঝি বিয়েই করে ফেলেছে। আয়াশ কিছু বলতে যাবে তার আগেই আফরা চোখ বড় বড় করে বলে,

‘এটা তুই কি করলি আয়াশ? তুই বিয়ে করে ফেললি! একটা বার বাবা মা কে জানালিও না! হায় আল্লাহ। বিয়ে করেছিস ভালো করেছিস তাই বলে লুকিয়ে করবি!’

আয়াশ কিছু বলতে নিলে ফের তার মাা থামিয়ে দেয়। খুশিতে গদগদ হয়ে বলে, ‘জীবনে প্রথম একটা কাজের কাজ করলি। দাঁড়া দাঁড়া আমি বরণ করে ঘরে তুলতেছি!’

সন্ধ্যার লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যাওয়ার মতো অবস্থা৷ আয়াশ মায়ের দিকে কপালে ভাজ ফেলে তাকায়। তার মা টা যে কবে একটু বুঝবে আল্লাহ মালুম। আফরা সত্যি সত্যিই রান্নাঘরের দিকে যেতে নিলে আয়াশ ব্যস্ত গলায় ডাক দেয়। আফরা পেছনে তাকাতেই আয়াশ দ্রুত বাড়ির মধ্যে ঢুকে সন্ধ্যাকে সোফায় বসিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বলে,

‘আরেহ মা আমি বিয়ে করিনি। তুমি কি পাগল হয়ে গেলে!’

পেছন থেকে আয়াশের বন্ধুপার্টি শব্দ করে হেঁসে দেয়। আয়াশ আফরাকে পুরো বিষয়টা ক্লিয়ার করে বলে। শুধু ভালোবাসার কথাটা গোপন করে যায়। আফরা ফ্যালফ্যাল করে ছেলের দিকে তাকিয়ে সন্ধ্যার কাছে আসে। সবাই আগ্রহী চোখে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা তখনো মাথা নিচু করে বসে আছে। আফরা সন্ধ্যার পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলে, ‘মাশাল্লাহ!’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে সন্ধ্যার থুতনীতে হাত দিয়ে মুখটা উপরে তোলে। তারপর আফসোসের সুরে বলে, ‘আহারে এতো সুন্দর মাইয়াডা আমার ছেলের বউ না!’

চলবে..

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here