সন্ধ্যা নামার পরে পর্ব ১০+১১

#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#দশ

সকালে ঘুম ভাঙতেই নিরা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। গত রাতে কী হয়েছিল তা মনে করার চেষ্টা করতেই রক্ত হিম হয়ে আসে। আবছায়া একটা রাত, একটা মানুষের দুটো হাত, তার বুকে মাথা রাখা! মনে পড়তেই লজ্জায়,সংকোচে নিজেকে পৃথিবী থেকে আড়াল করে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। আবার সেই স্বপ্নটা তার পিছু নিয়েছে। গত কয়েকটি মাস বেশ ভালোই তো ছিল। স্বপ্নটা তার ঘুমের ঘোরে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। সে ভেবেছিল ছোট বেলা থেকে তাড়া করা দুঃস্বপ্নটা তার পিছু ছেড়েছে। শান্তিতে ছিল সে। এ কয়েকটি মাস রাতে ঘুমানোর আগে অন্তত এটার ভয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠত না সে। এমনও সময় গেছে রাত নামতেই ভয় করত তার। মনে হত রাত নয় তার জন্য কাল নেমে আসছে। একটা অস্পষ্ট স্মৃতি তাকে আজও তাড়া করে বেড়ায়। অথচ সেসব কিছুই তার অজানা, অচেনা!

এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আবার ফিরে এসেছে সেটা। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে তার৷ দেয়ালে ঝুলানো ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল দশটা বেজে গেছে। মাথাটা খুব ব্যথা করছে। চারপাশে তাকিয়ে অর্নবকে খোঁজার চেষ্টা করল। উঠে এসে ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে বুঝল অর্নবের ঘড়ি, ওয়ালেট কিছুই নেই। তার মানে সে হাসপাতালের চলে গেছে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। এখন যদি অর্নব তাকে রাতের কথা কিছু জিজ্ঞেস করত, কী বলত সে। তাছাড়া রাতের ঘটনাটার জন্য অস্বস্তি হচ্ছে। এ মুহূর্তে অর্নবের সামনে দাঁড়ানোটা কঠিন হয়ে যেত তার জন্য।

★★★

নিরা ফোনটা খুঁজতে লাগল এখনই বাবাকে কল দেয়া দরকার। ফোন পেল বিছানার পাশের সাইড টেবিলের উপর। ফোনটা হাতে নিতে গিয়ে খেয়াল করল ফোনের নিচে এক টুকরো কাগজে কিছু একটা লেখা আছে। সেটা হাতে নিয়ে দেখল,

“তৈরি হয়ে থেকো। আমি এসে তোমায় কোচিং-এ নামিয়ে দিয়ে আসব।”

নোটটা পড়তেই নিরার নিজের অজান্তে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল! নোটটা ভাঁজ করে ক্লোজেটের কাছে গিয়ে নিজের শাড়ির ভাঁজে যত্ন করে রেখে দিল সেটা। তারপর বাবার নম্বরে কল দিল। ওপাশ থেকে স্নিগ্ধ একটা গলা পাওয়া গেল।

নিরা বলল, “আসসালামু আলাইকুম বাবা।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম মা। কেমন আছিস?”

“ভালো আছি বাবা। তোমার শরীর এখন কেমন?”

“আমি এখন খুব ভালো আছি মা। তোর ওখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?”

“না বাবা কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আবার সেই স্বপ্নটা কাল ঘুমের ভেতর এসেছে বাবা।”

জাফর সাহেব মেয়ের কথা শুনে নিভলেন। উৎকণ্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কোনোকিছু কী স্পষ্ট হয়েছে নিরা?”

“সব আগের মতো অস্পষ্ট ছিল । কিছুই স্পষ্ট হয়নি। এটা আমার সাথে কেন হয় বলতে পারো বাবা? কেন ছোট বেলা থেকে একে বয়ে বেড়াচ্ছি?” নিররা চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

জাফর সাহেব মেয়ের কথা শুনে বুঝতে পারলেন উনার মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু কিছু বিষয় মানুষের হাতে থাকে না। সম্পূর্ন রূপে তা প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। স্বপ্ন দেখা, না দেখাটাও সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ও সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে। এতে ক্ষুদ্র মানুষের কিছুই করার থাকে না। তিনি বরাবরের মতো সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে মা। তোর জীবনের সুখের দিন শুরু হয়ে গেছে। এসব পুরনো দুঃস্বপ্ন তোর পিছু ছাড়ার সময় এসে গেছে। তুই শুধু মনে সাহস রাখ।”

নিরা বাবার এসব কথা শুনে অভ্যস্ত। প্রায় তার মনে হয় এ স্বপ্নটার সম্পর্কে বাবা অনেক কিছুই জানে। শুধু কোনো এক গুপ্ত কারণে সেটা প্রকাশ করতে চান না। যখনই সে স্বপ্নটা দেখে তখনই বাবাকে খুব চিন্তিত দেখায়। বাবার চোখেমুখে অন্ধকার নামে। সেদিনগুলোতে নিরার অনেক যত্ন করলেও কোনো এক অজানা কারণে তিনি নিরার সব কথাকে এড়িয়ে চলেন। নিরার প্রায় অবাক লাগে বাবা এমন কেন করে!

নিরা বলল, “বাবা আমার স্বপ্নটার সাথে কোনোভাবে আমার অতীত জড়িত নয় তো?”

জাফর সাহেব অপ্রতিভ হলেন। বললেন, “এমন কিছু হলে আমি তোকে বলতাম মা। আচ্ছা শোন বৃষ্টি আসছে উঠোনে জামা কাপড় ভিজে যাবে। সেগুলো নিয়ে আসি। পরে কথা হবে মা।”

“ভালো থেকো বাবা।”

নিরা ফোনটা কেটে চুপ করে অনেকক্ষণ বসে রইল। সে বুঝতে পারল আজও বাবা তাকে এড়িয়ে গেলেন। গুমোট হয়ে আছে ভেতরটা। তখনই দিদান আসলেন তার পিছুপিছু মর্জিনার হাতে খাবার। নিরা উঠে দাঁড়াল দিদান কাছে এসে নিরার গায়ে হাত দিয়ে দেখলেন জ্বর আসছে কিনা। তারপর বললেন, “এখন কেমন লাগছে তোমার? শরীর ঠিক আছে তো?”

নিরা কিছু না বুঝে ইতস্ততভাবে বলল, “আমি ঠিক আছি দিদান। নাস্তা এখানে কেন? আমি তো এখনই নিচে যেতাম।”

দিদানের মুখের ভাঁজে ভাঁজে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। তিনি বললেন, “তোমার নাকি রাতে শরীর খুব খারাপ হয়েছিল? অর্নব যাওয়ার সময় বলে গেল। তোমার খেয়াল রাখতে। আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। কী হলো আমার নাত বউয়ের?”

নিরা মৃদু হেসে বলল, “আপনার নাতি একটু বেশি বলেছে দিদান। আমি একদম ঠিক আছি। আসুন আপনি বসুন তো?”

দিদাদন রসাত্মক গলায় বললেন, “যদি সত্যি আমার নাতি বেশি বলে থাকে তবে বুঝতে হবে সে তোমার বিষয়ে খুব যত্নশীল। যাকে মানুষ বেশি ভালোবাসে তার জন্য বেশি চিন্তা হয় বুঝলে?”

নিরার দৃষ্টি নত হলো। চোখমুখ লাল হলো। সেটা কী লজ্জায় না রাগে বোঝা গেল না। নিরা বলল, “দিদান একটা প্রশ্ন করি?”

দিদান তার চিবুকে হাত রেখে আদর করে বললেন, “হাজারটা বলো?”

নিরা স্মিত হেসে বলল, “আচ্ছা দিদান ঘুমের ভেতর দেখা স্বপ্ন কী কখনো সত্যি হয়?”

“কখনো হয় কখনো হয় না। কেন বলো তো?”

নিরা কী ভেবে যেন বলতে গিয়েও বলল না। কথা কাটাতে বলল, “পায়ের ব্যথাটা এখন আছে?”

দিদান হেসে বললেন, “না এখন খুব ভালো আছি। আচ্ছা শোনো তোমরা তো বিয়ের পর কোথাও বেড়াতে যাওনি। কোথায় যেতে চাও হানিমুনে?”

দিদানের কথাটা শুনে বুক ধড়ফড় করে উঠল নিরার বলল, “আমার সামনে পরীক্ষা দিদান তাই পরে গেলে হয় না?”

“আমি জানি সামনে তোমার পরীক্ষা তাই চাচ্ছি এখনই গিয়ে ক’টা দিন ঘুরে এসো। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। পাঁচদিনের সফরে যাবে।”

নিরা অনেক রকমভাবে বুঝাতে চেষ্টা করেও পারল না। বেশি কিছু বলতেও পারল না যদি দিদান তাদের সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ করে। তাই শেষ পর্যন্ত বলল, “ডক্টর অর্নব জানে এ কথা? ”

দিদান রহস্যময় হেসে বললেন,”তার জন্য সারপ্রাইজ থাকল। তুমি কিন্তু বলবে না কেমন?”
নিরা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল।

★★★

নিরা লিখতে বসেছে হাতে সময় খুব কম। খুব তাড়াতাড়ি পান্ডুলিপির কাজ শেষ করতে হবে। তাই আজকাল সে খুব একটা অন্য কাজে মন দিতে পারছে না। অর্নব অফিসে থাকাকালীন সে লেখা শেষ করে। অর্নব আজকাল বই বা যেকোনো অজুহাতে নিরা সাথে কথা বলতে চায়। নিরাও খুব সহজভাবে কথা বলে। এ কয়দিনে অন্তত এটা মনে হয়েছে মানুষটা খারাপ নয়। স্বামী না হোক একজন ভালো বন্ধু তো ভাবাই যায়। নিরা নোট বুকে লিখছে এমন সময় অর্নব ঘরে ঢুকল। নিরা স্বাভাবিক হয়ে বলল, “চলে এসেছেন?”

অর্নব হেসে বলল, “এসেছি।”

অর্নব ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাত ঘড়ি খুলছে নিরা বিছানায় বসে আড়চোখে সেটা দেখছে। আজ সে খেয়াল করল ডক্টর বেশ স্মার্ট। হলুদাভ ফর্সা গায়ের রঙ। ঘন পল্লবযুক্ত চোখ জোড়া যেন হাসছে। সবচেয়ে বেশি যেটা সুন্দর সেটা হচ্ছে তার হাসি। সে হাসিতে ঠোঁট হাসে, যে হাসিতে চোখ হাসে। ঠিক তেমন সুন্দর হাসি। অর্নব আয়নায় খেয়াল করল নিরা তাকে দেখছে। পেছনে ফিরে নিরার দিকে হেসে জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবে নিরা?”

নিরা থমকাল নিজের বোকামির জন্য নিজেই লজ্জা পেল। স্মিত হেসে জবাবা দিল, “কাল রাতে আপনাকে জ্বালিয়েছি। তার জন্য দুঃখিত।”

অর্নব তার সেই সুন্দর হাসিটা হেসে বলল, “নিজের মানুষদের কাছে কেউ দুঃখিত হয় নাকি?”

নিরা চমক লাগা চোখে তার দিকে তাকাল। আবারও সেই শব্দ ‘নিজের মানুষ!’ সত্যি কী তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা তার? পরক্ষণেই ভাবল না তার কী করে হয়! এ মানুষটা তো ডক্টর দিয়ার। যার সাথে অনেক বছরের সম্পর্ক তার। এত বছরের সম্পর্ক বাদ দিয়ে হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসার নিরার নিজের মানুষ তিনি কেনই বা হতে যাবেন। নিরার ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। তারপর চুপচাপ নিচে চলে এলো।

অর্নব একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটার হলো কী! একটু আগে মনে হলো কতটা আপন সে। আপন হয়ে কথা বলছে। আর এখন মনে হচ্ছে এ মেয়েটা তার বড্ড অচেনা। যার সাথে তার পরিচয় পর্যন্ত নেই। সে আরও খেয়াল করল মেয়েটা এক এক সময়, এক এক রকম আচরণ করে। তাই তাকে সহজে বোঝা যায় না। কিন্তু কেন! কী লুকিয়ে আছে সহজ, সরল দেখতে মেয়েটার আড়ালে?
#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#এগারো

নিরা কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল। আজ অর্নব তাকে নামিয়ে দিতে পারবে না। আজ তার একটা ইমারজেন্সি অপারেশন আছে। নিরা একা যেতে পারবে বলে জানাল। অর্নব তাও মানল না। গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। নিরা তৈরি হয়ে নিচে গেল দিদান তাকে বলল, “তাড়াতাড়ি এসো। আজ তোমার আর অর্নবের সাথে দরকার আছে।”

নিরা তাড়াতাড়ি আসবে বলে জানাল। গাড়িতে যেতেই নিরা অবাক হয়ে গেল। ড্রাইভারের জায়গায় মায়ান বসে আছে। নিরা বিস্ময় জড়ানো গলায় বলল, “কী ব্যাপার আপনি?”

মায়ান রহস্যময় হেসে বলল, “কেন আসতে পারি না?”

নিরা থমকে যাওয়া গলায় বলল, “না, না তা কেন হবে! আসলে আপনি আসবেন অর্নব বলেনি। তাই অবাক হলাম।”

“আসলে অর্নব যখন তোমাকে কল দিচ্ছিল তখন আমি তার কাছে ছিলাম। তাই সে আসতে পারবে না ভেবে। ভাবলাম আমি তোমাকে নামিয়ে দেই।”

“আচ্ছা।” নিরা ছোট্ট করে বলল।

নিরা ড্রাইভারের পাশের সিটে বসতে গিয়েও মায়ানকে দেখার পর পেছনের দিকে এগিয়ে আসল। মায়ান তাকে বলল, “তুমি কী আমাকে তোমার ড্রাইভার ভাবো?”

নিরা বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী যা তা বলছেন?”

“তাহলে পেছনে কেন যাচ্ছো? আমার পাশের সিটে বসো। যদি না বসো তবে ভাববো। আমার ভাবনাই ঠিক।”

অগত্যা নিরাকে সামনে বসতে হলো। কয়েক মুহূর্ত নীরবে কেটে যাওয়ার পর মায়ানই প্রথম কথা বলল, “নিরা একটা প্রশ্ন করব?”

মায়ানের তার নাম ধরে ডাকাটা ভালো লাগল না। অর্নবের বন্ধু বলেই যে তাকে নাম ধরে ডাকবে এমনটা তো নয়। সে নির্লিপ্তভাবে বলল, “জী করেন?”

“আমি জানি তোমাদের বিয়েটা আর দশটা বিয়ের মতো স্বাভাবিক নয়। তবে খুব জানতে ইচ্ছে করে তুমিও কী অর্নবের মতো এ সম্পর্কটা নিয়ে উদাসীন?”

নিরা গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, “উদাসীন বলতে আপনি কী বুঝাতে চাচ্ছেন?”

মায়ান বসে আছি অদ্ভুত হেসে বলল, “অর্নব বলেছে তোমাদের বিয়েটা আদৌতে কোনো বিয়ে নয়। এটা কয়েকদিনের জাস্ট সমঝোতা।”

কথাটা শুনে নিরার হৃদয়যন্ত্রটায় অকস্মাৎ একটা শিরশির ব্যাথা অনুভব করল। কিন্তু এর কারণটা তার অজানা রয়েই গেল। সে ভাবল সে জানে এ বিয়েটা শুধু মাত্র সমোঝোতা কিন্তু সেটা অন্য কোনো মানুষের কাছে শুনে, কেন যেন ভালো লাগছে না। কোথাও একটা কষ্ট হচ্ছে। এতদিন ডক্টর অর্নবের আচার আচরণে এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল এ সম্পর্কটা সত্যিকারের কোনো সম্পর্ক। অন্তত বাইরে থেকে সেটাই বোঝা যায়। অর্নবের মতো সেও চেয়েছে বাইরের কেউ ঘরের কথা না জানুক। এখন যখন অর্নব মায়ানকে সব বলে দিয়েছে সেটা তার ভালো লাগছে না।

নিরা অপ্রস্তুত হয়ে কোনোরকমে বলল,”আমার কোচিং এসে গেছে। এখানে নামিয়ে দিলেই হবে।”

মায়ান খেয়াল করল সত্যি তাই। এত তাড়াতাড়ি এসে গেছে দেখে তার খারাপ লাগল৷ হঠাৎ কী ভেবে যেন সে বলল, “তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে নিরা। তোমার কাল সময় হবে? তোমার কোচিং শেষ হলে আমি এখানেই অপেক্ষা করব।”

নিরা চমকাল। মায়ান আরও বলল,”প্লিজ অর্নবকে এ নিয়ে কিছু বলবে না। আগে আমার সব কথা শুনবে৷ তারপর যদি তোমার মনে হয় তুমি তাকে বলবে, তবে বলতে পারো।”

নিরা কোনোরকম বলল, “ঠিক আছে।”

এটুকু বলেই সে চলে গেল। তার ভীষণ বিরক্ত লাগছে।
বারবার মনে হচ্ছে অর্নব তাকে বলেছে এসব বিষয়ে কাউকে কিছু না বলতে অথচ সে নিজেই দিব্বি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে! না চাইতেও নিরার রাগ হলো।

★★★

সন্ধ্যায় নিরা লিখতে বসেছে আজ তার মন খুব খারাপ। মন খারাপ মানে ভালো কিছু লিখতে পারা। তার হঠাৎ করে মনে হলো যখনই তার মন খারাপ হয়, তখনই তার লেখক মন অধিক সজাগ হয়ে উঠে। কিছু জটিল শব্দ সহজেই তার মস্তিষ্ক থেকে কলমে এসে ধরা দেয়। এটা কী তার মানব মনের বিপরীত দিক নয়! মানব মন খারাপ হলে মুখ দিয়ে ভালো কথা আসে না। সবকিছু এলোমেলো লাগে। অথচ একই মানুষের লেখক মন সম্পূর্ণভাবে তার ঋনাত্মক কী করে হতে পারে! তারপর ভাবল মানব জন্মই তো একটা ধাঁধা এখানে সেসব কিছুই ঘটে যা অন্য প্রানীদের সাথে ঘটে না। সে পেজে একটা গল্প লিখছে গল্পটার নাম ‘অন্তরালে ভালোবাসা’ পাঠক মহলে ভালোই সাড়া পাচ্ছে। আজকে একটা পর্ব পোস্ট করার কথা। সেটাই এখন লিখতে বসেছে। গল্পটা মোটামুটি ট্রায়াংগেল লাভ স্টোরি। তার সাথে দুই মায়ের ভিন্ন ভিন্ন রূপ গল্পের নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে। যা পাঠককে টানছে।

নিরা লিখতে লিখতেই খেয়াল ছিল না। কেউ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

“কোচিংয়ের নোটস তৈরি করছো?”

চমকে তাকাল নিরা। বলল, “আপনি কখন এলেন?”

অর্নব বলল, “কিছুক্ষণ। দিদান বললেন তাড়াতাড়ি ফিরতে তাই চলে আসলাম৷ তাছাড়া আমার মাথাটা বড্ড ব্যাথা করছে। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। এক কাপ কফি করে দিতে পারবে নিরা?”

নিরা অবাক হলো। অর্নব এতটা আন্তরিক ভাবে তার কাছে কিছু চাইছে। সে চাইলে সরাসরি আদেশ করতে পারত। কিন্তু ছেলেটা তা করে না। সবসময় অনুরোধ বা জিজ্ঞেস করে নেয়। এ বিষয়টা নিরার দারুণ লাগে। তবে নিরার মনে হলো আজকের বলাটা একটু অন্যরকম। কেমন একটা দরদ মেশানো ছিল। হয়তো ক্লান্ত বলে গলাটা এতটা আদুরে শোনাচ্ছে।
নিরা কফি আনতে নিচে চলে গেল।

এমন সময় দিদান ঘরে ঢুকলেন বললেন, “দাদু ভাই এসেছো?”

অর্নব ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসে বলল, “এসেছি মিসেস। আজ হঠাৎ আমার জরুরি তলব কেন?”

দিদান অর্নবের পাশে বসে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “সে আছে একটা খবর। কিন্তু আমার দাদু ভাইকে এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন?”

“আজ কাজের চাপ বেশি ছিল দিদান। তাই এমন দেখাচ্ছে।”

“আচ্ছা তাহলে আমার কথাগুলো তাড়াতাড়ি শেষ করেই চলে যাই।”

দিদান দুটো টিকিট বের করে অর্নবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “দাদুভাই আমি তোমাদের জন্য কাশ্মীরের দুটো এয়ার টিকেট কেটেছি। আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য বিয়ের উপহার।”

অর্নব বিস্মিত চোখে দিদানের দিকে তাকাল। বলল, “কী বলছো দিদান এ সময় আমি ছুটি নিতে পারব না।”

“সে ব্যবস্থাও আমি করে ফেলেছি দাদু ভাই। আমি সাদের সাথে কথা বলে নিয়েছি। সে বলেছে তুই খুব বেশিদিনের জন্য না হলেও পাঁচ দিনের জন্য ঘুরে আসতে পারিস।”

অর্নব বলল, “দিদান নিরার পড়াশোনার ক্ষতি হবে।”

“হবে না। আমি নিরার সাথে কথা বলে নিয়েছি।”
এরপর অর্নবের কাছে আর কোনো অজুহাত অবশিষ্ট রইল না। দিদানের কথা তাকে মানতেই হলো। তবে অবাক হলো এই ভেবে যে নিরা যেতে রাজি হয়েছে! অদ্ভুত! দিদান উঠে চলে গেলেন।

★★★

অর্নব গোসল সেরে বারান্দায় বসতেই নিরা কফি নিয়ে হাজির হলো। নিরার হাতে দু’কাপ কফি দেখা গেল। অর্নব বলল, “কফি খাচ্ছো?”

নিরা মৃদু হেসে বলল, “হুম।”

“তুমি না কফি পছন্দ কর না?”

“আজ কেন যেন ইচ্ছে করল।”

অর্নব হেসে বলল, “চিয়ার্স।”

দুজনে বারান্দায় পাশাপাশি বসে এ প্রথম এক সাথে কফি খাচ্ছে। অর্নবের মাথা ধরাটা মনে হলো অনেকটাই চলে গেছে। নিরার এত সহজ ব্যবহার তার ভালো লাগছে। সে জানে এটা ভালো লাগার মতো কিছুই নয় তাও তার ভালো লাগছে। কারণ কিছু কিছু বিষয় মানুষের হাতে থাকে না। তাই এ মুহূর্তে তার সুক্ষ্ম ভালো লাগাটাকেও সে আটকাতে পারছে না। কিংবা পারলেও সে চাইবে না। কারণ তার মনে হয় কিছু অনিয়ম মাঝে মাঝে জীবনটাকে সুন্দর করে তোলে। পূর্নতা দেয়। এমন নিয়মের ভাঙন সে হাজার বার করতেও রাজি।

দুজনে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। আজকের পরিবেশটা ভীষণ মিষ্টি। এলোমেলো বাতাস বইছে। বাতাসের ঝাপটা এসে শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে একটা শিরশির অনুভূতির সৃষ্টি করছে। শীতলতা শরীরের কামড় বসাচ্ছে। সে অনুভূতিটা হয়তো আরও সুন্দর কিছু মুহূর্ত তাদের উপহার দিতে পারত যদি তারা বাইরের জগতের মতো এ বদ্ধ ঘরটায়ও নিজেদের স্বামী স্ত্রী হিসেবে মানতে পারত। বাতাসের ঝাপটা এসে নিরার চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। অর্নব ড্রিম লাইটের নীল আলোয় নিরার দিকে তাকিয়ে রইল। বাতাসের তোপে কয়েক গাছি চুল মুখের সামনে এসে তাকে বড্ড জ্বালাতন করছে। নিরা বারবার কানের পাশে সেগুলো গুঁজে দিচ্ছে, কিন্তু অবাধ্য এলো চুল সে কথা শুনছেই না। বারবার তাকে জ্বালাচ্ছে। সে জ্বালাতনটা দেখতেও কেন যেন সুখ সুখ কিছু একটা অনুভব করছে অর্নব। হাসল নিজের অজান্তেই। নিরা হঠাৎ তার দিকে তাকাতেই চমকে গেল। বলল, “আরে হাসছেন কেন?”

“বাতাসের দুষ্টুমি দেখে।”

“বাতাসও দুষ্টুমি করে বুঝি!” নিরার চোখ কপালে উঠল।

“হুম করে তো। দেখছো না তোমার চুল নিয়ে কেমন খেলায় মেতে উঠেছে।” নিরা হাসল।

” বড্ড হিংসা হচ্ছে নিরা।”

নিরা অবাক হয়ে বলল, “কাকে?”

“ওই অবাধ্য অদেখা বাতাসকে।”

নিরা অবাক হলো! কথাটা তার হৃদয়ে নতুন একটা অনুভূতির সৃষ্টি করল। সে বুঝল তার হৃদযন্ত্রটা স্বাভাবিকের চেয়ে অতি দ্রুত বেগে দৌঁড়াচ্ছে। সে ভাবল, কী বলল কাঠখোট্টা ডক্টরটা! কেনই বা বলল! এ কথাটার গভীর মর্মার্থ বুঝেই কী বলেছে! নাকি শুধু বলার জন্য বলেছে। তার কেন মনে হচ্ছে এমন সুন্দর কথা সে এ জীবনে আর শুনেনি। বারবার বাতাসের সাথে তার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটা লাইন, “বড্ড হিংসা হচ্ছে নিরা, ওই অবাধ্য বাতাসকে।”

চলবে

প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here