সন্ধ্যা নামার পরে পর্ব ৮+৯

#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#আট

হাসপাতালে অর্নব, মায়ান মুখোমুখি বসে আছে। অর্নব একাই বকবক করে যাচ্ছে। মায়ানের তার কথায় মন নেই। তার ভাবনা জুড়ে এখন শুধু একটাই নাম সে নামটি হলো নিরা! মায়ানের নির্লিপ্ত ভাব দেখে অর্নব ভ্রুকুটি করে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “হয়েছেটা কী বল তো?”

মায়ান অদ্ভুতভাবে হেসে বলল, “কী হবে!”

“তোকে কেমন আনমনা দেখাচ্ছে!”

“আমার কথা ছাড়। তুই আগে বল হঠাৎ বিয়েটা কেন করলি? তাও আবার দিয়ার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পর?”

অর্নব এবার নিভল। হাতে থাকা কলমটা টেবিলের উপর ঘোরাতে লাগল। কিছু প্রশ্নের উত্তর হয় না। কিংবা আমাদের মন জানলেও কোনো এক সংগত কারণে সেটা বলা যায় না। অদ্ভুত মানব জনমের এ এক বৈচিত্র রূপ! হয়তো অর্নবের কাছেও এ সহজ প্রশ্নটার ঠিকঠাক উত্তর নেই। কিংবা থাকলেও তা মুখে বলতে তার বড্ড দ্বিধা!

অর্নবের নত মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ান আবার বলল, “কিছু বলছিস না কেন?”

অর্নব ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “মনে কর এটা ছাড়া আমার হাতে আর কোনো অপশন ছিল না।”

“হোয়াট ডু ইউ মিন অর্নব? তুই কী বলতে চাইছিস তোকে কেউ জোর করে বিয়ে করতে বাধ্য করেছে?”

“ভেবে নে তেমনটাই।”

“আরে ইয়ার ভাববোটা কী বল তো? তুই নিজে সত্যিটা খুলে বল আমায়। আমি তোর বন্ধু। ”

অর্নবের এ আলোচনাটা ভালো লাগছে না। তার কেবলই মনে হচ্ছে এ বিষয়টা নিয়ে অধিক প্রশ্নের উত্তর তার অজানা। কিংবা আংশিক জানা। তাই এমন অজানা বা আংশিক জানা বিষয়ে কাউকে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা যায় না। অর্নব বলল, “আমি নিজেই জানি না। তোকে কী বলব!”

“জানিস না মানে। কাউকে বিয়ে করেছিস আর বলছিস তুই জানিস না?”

“সত্যি দোস্ত জানি না। তবে যেদিন জানব সেদিন না হয় তোকে জানাব।”

“না জেনেই বিয়ে করে ফেললি? কী অদ্ভুত তোর অজানা!” মায়ানের কথায় তাচ্ছিল্যের আভাস স্পষ্ট।

অর্নব চুপ করে আছে।।কিছুক্ষণ নীরবে কেটে যাওয়ার পর মায়ান বলল, “ভালোবাসিস মেয়েটাকে?”

অর্নব চমক লাগা চোখে তার দিকে তাকাল। মনে হলো এ কথাটা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের কিছু! তার বুকের ভেতর কয়েকটি শিরা যেন অতি দ্রুত বেগে ছুটা আরম্ভ করল! কিন্তু কেন!

অর্নব হাসার চেষ্টা করে বলল, “কী সব বাজে বকছিস! এসে পর্যন্ত এসব নিয়ে পড়ে আছিস। কোথায় এ কদিন কীভাবে কাটিয়েছিস। এসব বলবি তা না। কীসব নিয়ে পড়ে আছিস বল তো?”

মায়ান তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকাল। একপেশে হেসে বলল, “বিয়েটা কোনো ছেলে খেলা নয় বলেই কী এটা নিয়ে পড়ে আছিস? দিয়া তোর জন্য কষ্ট পাচ্ছে। তোর কোনো অধিকার নেই ওকে কষ্ট দেয়ার।”

“তুই কেন এত হাইপার হচ্ছিস? আমার যা বলার আমি দিয়াকে বলে দিয়েছি।”

মায়ানের গলাটা এবার চড়ল, “তুই দুটো মেয়ের সাথে একসাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছিস! আর বলছিস আমি তোকে কিছু বলব না?”

“কী হয়েছে তোর মায়ান? হঠাৎ এভাবে কেন কথা বলছিস?”

মায়ান এবার সতর্ক হলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলে নিল। ভাবল কাম অন মায়ান এভাবে রেগে গেলে হবে না। সবকিছুতে এখন শান্ত থাকতে হবে। এভাবে রেগে কিছুই পাওয়া হবে না।

নিজেকে যথা সম্ভব সামলে বলল, “ঠিক আছে এসব নিয়ে পরে কথা হবে। আমি এখন আসছি। বাসায় যাব ফ্রেশ হব।”

অর্নব হেসে বিদায় জানাল। মায়ান চলে যাওয়ার পর অনেকটা সময় গুমোট হয়ে বসে রইল সে। কোনো এক অজানা কারণে তার ভেতরটা বিক্ষিপ্ত, বিক্ষুদ্ধ হয়ে আছে। যার কারণটা তার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকল। মায়ানের প্রতিটি প্রশ্ন তার কাছে সহজ মনে হলো। মায়ানের জায়গায় অন্য কেউ হলেও এই একই প্রশ্ন করতো। অর্নব অনেকটা সময় ধরে নিজের মনকে একবার, বারবার, বহুবার এই সহজ প্রশ্ন করার পরও কোনো সহজ উত্তর মিলল না। শুধু মনে হলো ক্রমশ সে একটা জটিল ধাঁধায় আটকে যাচ্ছে। যার শেষটা তার অজানা।

★★★

অর্নব নিরাকে একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দিয়েছে। এখন সে নিয়মিত কোচিং করে। বাসায় সময় বের করে পড়ে। মোটামুটি সবকিছুই তার কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এই যে এতদিন কার সাথে কীভাবে চলাফেরা করবে। কার সাথে কী কথা বলবে এসব নিয়ে নানা চিন্তায় ছিল। সময়ের সাথে সাথে এখন সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিয়েছে। জীবনের নানা জটিল বিষয়ও মানুষকে সময়ের সাথে মানিয়ে নিতে শিখিয়ে দেয়। সময় সবচেয়ে বড় জাদুকর। একমাত্র সময়ই পারে একজন মানুষের ভেতরকার সব কষ্টকে লাগাব করতে। নিরাও পারছে। আজকাল তার সবার সঙ্গ ভালো লাগে। এমনকি খুঁতখুঁতে কথায় কথায় দোষ ধরা শাশুড়ীটাকেও। আর ওই যে কাঠখোট্টা ডক্টরটা তার সান্নিধ্যেও কেন যেন ভালো লাগছে তার। এটাই হয়তো সময়ের নিয়ম। সময়ের দাবি। সবকিছু নিয়ম মাফিক করাই যেন সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বায়িত্ব।

সন্ধ্যায় পড়া শেষ করে রান্নাঘরে গিয়ে রাহেলা বেগমের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। অস্ফুটে বলল, “আমি হেল্প করি আন্টি?”

রাহেলা বেগমের মেজাজ আজ সপ্তমে চড়ে আছে। একটু আগে উনার বোন মানে দিয়ার মা কল দিয়ে যাচ্ছে তাই কথা শুনিয়েছেন। উনাদের একমাত্র মেয়েকে এভাবে কেন অর্নব ঠকাচ্ছে তার কারণ জানতে চাইলেন। এমন প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারলেন না। তিনি জানেন দোষ তার ছেলের এবং তার বোনের কোনো কথাই মিথ্যে নয়। যখন কাউকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলা হয় তবে সেটা সামাজিক ও মানবিক দুই দিক দিয়েই অপরাধ হিসেবে গন্য হয়।

আজ তাই নিজের মেজাজের সবটা উগরে দিয়ে নিরাকে বললেন, “এ মেয়ে তোমার লজ্জা বলতে কিছু নেই? কতবার বলি আমার পিছুপিছু আসবে না। তাও কেন কথা শোনো না? তোমার কী মনে হয় আমার ছেলেকে যেভাবে বশ করেছো আমাকেও পারবে? কখনও না। তোমার মতো মতলব বাজ মেয়েদের আমি ভালো করে জানি। টাকার জন্যই তো আমার ছেলের পিছনে পড়ে আছো। কত টাকা চাই তোমার আমায় বলো?”

অপমানে থমথমে হয়ে গেল নিরার মুখ। গাঢ় একটা ছায়া এসে পড়ল তার পুতুল মুখের উপর। এমন চুড়ান্ত অপমান কেউ কোনোদিন তাকে করেনি। নিজেকে নিজের কাছে অতি ক্ষুদ্র মনে হলো তার। অর্থের প্রতি টান তার কস্মিনকালেও ছিল না। সেখানে একটা ছেলেকে টাকার জন্য ফাঁসানো তো আরও অনেক দূরের কথা। হঠাৎ কান্না দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আসল তার। সে কান্না অশ্রু হয়ে কয়েক ফোঁটা গড়িয়ে পড়তেই পেছনে ফিরে সেটা হাতের উল্টো পিঠে মুছতে গিয়ে দেখল তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে অর্নব। কষ্টের সাথে অস্বস্তি এসে যোগ হলো। কোনোরকম রান্নাঘর ছেড়ে দৌঁড়ে উপরে নিজের রুমে আসল সে। বিছানায় উপুড় হয়ে ধলা পাকানো কান্নাটা ঝরঝর করে অশ্রু হয়ে নামতে শুরু করল।

★★★

অর্নব তার মায়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “কেউ আমাকে ফাঁসায়নি মা। আমি নিজের ইচ্ছেতে এ বিয়েটা করেছি। তুমি অকারণে মেয়েটাকে অপমান করলে। প্লিজ মা এমনটা কোরো না।”

নিজের কথা শেষ করে উত্তরের আশা না করে হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। রাহেলা বেগম ছেলের পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যে ছেলে কোনোদিন মাকে কিছু বলেনি উচ্চ শব্দে কথা বলেনি। সে ছেলে কিনা মাকে কথা শোনালো তাও অন্য একটা মেয়ের জন্য!

অর্নব বেজানো দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল ঘরটা অন্ধকার। বিছানায় একটা ছায়া দেখতে পেল। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে নিরা। অর্নব চুপচাপ এসে তার পাশে বসল । নিরা দরজা খোলার শব্দ শুনে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল।

অর্নব মৃদু গলায় বলল, “স্যরি নিরা। মা আসলে এমন না। হঠাৎ কেন এমন করছেন বুঝতে পারছি না। তুমি প্লিজ কিছু মনে করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

নিরা চুপ করে শুধু শুনল। অর্নব অনেকক্ষণ নীরবে বসে রইল অন্ধকার ঘরে। ওয়াশরুমের বাতিটা জ্বালানো থাকায় হালকা হলুদ আলো আসছে ঘরের ভেতর। সে আলোয় নিরার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল তার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ তার মনের ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেল। ভাবল মেয়েটা কাঁদছে! সে এ প্রথম বুঝতে পারল মেয়েটার কান্না তার সহ্য হচ্ছে না। একটা থমথমে অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরেছে। তার ভেতরটা কোনো এক অজানা কারণে রক্তাক্ত হচ্ছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলতে, “নিরা এভাবে কেঁদো না। তোমার কান্না আমার সহ্য হয় না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।” মনে মনে ভাবলেও এ কথাটি সে মুখ থেকে বের করতে পারল না। নিজের হাতটা নিরা র উপুড় হওয়া পিঠের উপর বার কয়েক এগিয়ে নিয়ে সরিয়ে আনল। ভাবল যদি নিরা তাকে খারাপ ভাবে। তাই হাতটা গুটিয়ে নিয়ে আলতো সুরে ডাকল, “নিরা? এ্যাই নিরা?”

অকস্মাৎ কী হলো জানে না নিরা। এ ডাকটায় তার কান্না থেমে গেল। মনে হলো মহাকালের উপার থেকে হাজার বছর অপেক্ষারত কোনো সুরের লহরীতে কেউ তাকে ডাকছে। যার তাকে প্রয়োজন, বড্ড প্রয়োজন!
#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#নয়

ঘুটঘুটে অন্ধকারে ল্যাম্পের হলদেটে আলোর ছটা এসে পড়েছে নিরার মুখে। অর্নব সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে আছে সে হলদেটে সুশ্রী মেয়েটার আদুরে মুখখানার দিকে। এ মুহূর্তে তার নিজেকে কোনো এক অদ্ভুত কারণে অচেনা লাগছে। এই যে মেয়েটা তার ডাকে সাড়া দিয়ে উঠে বসছে। এ মুহূর্তটাও যেন কোনো এক ভালো লাগার সৃষ্টি করছে। যার স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা তার কাছে নেই। মানুষের জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন হাজার ভেবেও কিছু বিষয়ের পক্ষে শক্ত কোনো যুক্তি দাঁড় করানো যায় না। না মন সে যুক্তির তোয়াক্কা করে। শুধু ভাবে এ সময়টুকু মহাকাল ধরে যদি এভাবেই আটকে রাখা যেত। এভাবে হাতের মুঠোয় বন্দী করা যেত! তবে কী ভালোই না হত, তাই না? কিন্তু আফসোস মানব হয়ে জন্ম নিয়ে এ কাজটি করা কোনোকালেই সম্ভব নয়। বরং সময়ের আবর্তে সবকিছু ছেড়ে – ছুড়ে দেয়ার নামই জীবন। কারণ না মানব জাতি গতকালকে পাল্টাতে পারে, না পারে আগামীকালকে পাল্টাতে। তারা তো শুধু আজকের এ মুহূর্তটাকে নিজের মতো করে ব্যয় করতে পারে। মানবের হাতে শুধু আজকের মুহূর্তটাই আছে। বাকিসব ধৌঁয়াশা।

এই যে এই মুহূর্তে নিরার তো উঠে বসার কথা নয়। অর্নব নামের মানুষটাই বা কে! সে ডাকলেই যে উঠে বসতে হবে এমন তো নয়। তবে তাকে কে টেনে তুলল! সে কী তার মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেই গুপ্ত অনুভূতি নয়! যার হদিস সে আজও পায়নি। কিংবা পেলেও যার সত্যতা স্বীকার করতে সে অপরাগ।

নিরা হাঁটুগুজে তার উপর দু’হাত ঠেস দিয়ে বসেছে। অস্ফুটে স্বরে বলল, “ডাকছেন কেন?”

অর্নবের কাছে সহজ কোনো উত্তর তখন তৈরি ছিল না। এ প্রথম সে কোনো শব্দ সংকটে পড়েছে। তার মতো স্মার্ট একটা ছেলে কিনা শেষ পর্যন্ত নিরা নামক মেয়েটার সামনে কথা খুঁজে পাচ্ছে না! অনেক খুঁজে সে একটা শব্দই বলতে পারল, “কাঁদবে না নিরা। কান্না মানুষকে দূর্বল প্রমাণ করে।”.

নিরা ম্লান হাসল। অন্ধকারে সে হাসিটা দেখা গেল কিনা বোঝা গেল না। দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর অর্নব বলল, “তুমি যদি নেগেটিভ কথার কোনো উত্তর না দাও তবে এটাই প্রমাণ হবে যে তুমি ভেতর থেকে কতটা শক্তপোক্ত। যদি কেউ তোমায় আঘাত করে কথা বলে আর তুমি সে আঘাতে কষ্ট পেয়ে রিয়াক্ট করো তবে তো যে মানুষটা তোমায় কষ্ট দিতে চেয়েছে সে সফল।”

নিরা চুপ করে অর্নবের কথা শুনছে। কিছুই বলছে না। অর্নব আবার বলল, “দেখো তুমি রিয়াক্ট করলে এটাই প্রমাণ হয় যে তুমি আসলে তার বলা কথাগুলোকে মেনে নিচ্ছো। যদি তুমি চুপ করে থাকো কিংবা হেসে চলে আসো তার সামনে থেকে তবে সে ভবিষ্যতে তোমাকে ঘাটাতে অন্তত দু’বার ভাববে। আমার কথা বুঝতে পেরেছো নিরা?”

নিরা এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে অর্নবের কথাগুলো শুনছিল। তখনই তার মনে হলো এভাবে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলার কাউকে বুঝি সে পায়নি। অর্নব আবার উত্তর না পেয়ে বলল, “তোমার কী এখনো কষ্ট হচ্ছে নিরা?”

দূর্বল একটা গলা পাওয়া গেল, “না।”

অর্নব সে শব্দটা শুনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। এখানে বসে থাকাটা বিপজ্জনক মনে হলো তাই সে উঠে বারান্দার চলে গেল। বারান্দায় গিয়ে বেতের সোফায় বসে মনে হলো এ মুহূর্তে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়ানো খুব দরকার। সে তাই করল। বুকের ভেতর আকস্মিকভাবে যে যন্ত্রণাটা উঁকি দিয়েছে সেটাকে দূর করতে চাইল। তাতে অবশ্য কাজ বিশেষ কিছু হলো না। গুমোট হয়ে রইল ভেতরটা।

নিরা চুপচাপ আবার শুয়ে পড়ল। এখন কেন যেন পূর্বের অপেক্ষা আরও প্রবল বেগে কান্নার দল চোখে ভিড় করেছে। চুপচাপ সে জল বিসর্জন দিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল নিজেই টের পেল না।

★★★

ঘন্টা দু’য়েক পরে রুমে এসে অর্নব দেখতে পেল নিরার ঘুম এসে গেছে। তার সাদা তুলতুলে নরম বিছানাটায় ছোট্ট একটা পরী ঘুমিয়ে পড়েছে। যার ঘুম ভাঙাতে ভিনদেশী কোনো রাজকুমার সোনার কাঠি-রূপার কাঠি নিয়ে আসবে। সে রাজকুমার পরীর ঘুম ভাঙিয়ে তাকে তার ভালোবাসার রাজ্যে নিয়ে যাবে। সে রাজ্যে কোনো অশ্রু থাকবে না। শুধু থাকবে সুখ,শান্তি আর ভালোবাসা।

অর্নব কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে নিরার দিকে চেয়ে থেকে বাইরে পা বাড়াল। নিজেকে তার বড্ড এলোমেলো, অগোছালো লাগছে। তার জন্য মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে ভেবে সে কষ্টটা সে নিজেই পাচ্ছে। উপরে তার প্রিয় লাইব্রেরি ঘরটায় সে ঢুকল। রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটা হাতে নিয়ে সে এগিয়ে আসল নিজের ঘরের দিকে। বারান্দায় বসে বইটি চতুর্থ বারের মতো পড়তে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা বিকট চিৎকারে ছুটে গেল রুমে। নিরা চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে বসেছে। পাগলে মতো কী সব বকে যাচ্ছে। “আমাকে মেরো না। আমাকে মেরো না। মা,মা মা?।”

এ কয়েকটি শব্দই পাগলের মতো বারবার বলে যাচ্ছে। অর্নব পাগলের মতো ছুটে এসে তার পাশে বসল। বলল, “কী হয়েছে নিরা? খারাপ স্বপ্ন দেখেছো?”

নিরা এখন নিজের মধ্যে নেই। সে শুধু বারবার এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে আর কিসব বলে যাচ্ছে। অর্নব ঘাবড়ে গেল দুঃস্বপ্ন দেখে কেউ এমন করতে পারে? মেয়েটা কী কিছু নিয়ে ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে, বা সেটা নিয়ে ভয় পাচ্ছে? যার ধরুন সেটা তার ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দিচ্ছে! নিরাকে অনেক বলেও চুপ করানো যাচ্ছে না। অর্নব বুঝতে পারল মেয়েটা এখন হুসে নেই। তাই ইতস্তত করে দু’হাত এগিয়ে নিয়ে নিরা দু’কাঁধ ধরে ঝাকিয়ে বলল, “কিছু হবে না নিরা। আমি আছি তো।”

নিরা হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ অর্নবের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ কী যেন হলো অর্নবকে ঝাপটে ধরে কান্না শুরু করল। অর্নব মুহুর্তটা যেন কিছুই টের পেল না। নিরা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে! যে নিরার দিকে তাকানো দোষ এ কী সেই নিরা! এ প্রথম কোনো নারী তার বুকে মাথা রাখল। তার ভেতরটা ক্রমশ অবশ হয়ে আসছিল। বিছানায় আলগা হয়ে পড়ে থাকা তার হাত দুটো ধীরে ধীরে নিরাকে জড়িয়ে ধরল। নিরা কেঁদেই যাচ্ছে। আবার বিড়বিড় করে কী যেন বলছে! অর্নব অনুভব করল মেয়েটার সংস্পর্শে তার কোনোরকম অস্বস্তি হচ্ছে না। কিংবা কোনো খারাপ লাগা কাজ করছে না। বরং কোথাও একটা সুক্ষ্ম সুন্দর অনুভূতি তার মনের ভেতর আলগোছে বয়ে চলেছ। এ প্রথম কোনো নারীর সান্নিধ্যে তার কাছে ভালো লাগছে। নিরা আদুরে বেড়ালের মতো গুটিসুটি হয়ে অর্নবের বুকের ভেতর লুকিয়ে আছে। অর্নব ভাবল হয়েছেটা কী নিরার? কেন এমনভাবে কাঁদছে! কোনো স্বাভাবিক স্বপ্ন হলে তো এমন করার কথা নয়। যতদূর জানি সে অনেক সাহসী আর শক্ত একটা মেয়ে। তবে কী এমন স্বপ্ন দেখল যার জন্য নিজের চেতনাই ভুলে গেল।

কিছুক্ষণ নানা ভাবনায় কেটে গেল। নিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে অর্নব ভাবছে সকালে উঠে যখন মেয়েটা সবটা ভাববে তখন কী তুলকালামটাই না করবে! এমন বাচ্চা হয়ে ঘুমানো মেয়েটা তখন রণমূর্তি ধারণ করবে! অর্নব হাসল। তার মনে হলো এ সময়টা থমকে যাক। ঘড়ির কাঁটা থেমে যাক। এই যে নিরা নামের মেয়েটা এভাবে অবুঝ হয়ে যাক! সবকিছু থেমে যাক শুধু এ মুহূর্তটার জন্য। এ সময়টা তার জীবনে অনাদিকাল পর্যন্ত চলতে থাকুক। তার শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরায় তখন একটাই নাম বইছে, নিরা, নিরা আর নিরা!

চলবে

প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা
চলবে

প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here