সন্ধ্যা নামার পরে পর্ব ৬+৭

#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#ছয়

বিকেলের শেষ সময়ে সূর্যটা অস্তমিত হওয়ার সময় হয়ে এসেছে। আকাশের পশ্চিম দিকটায় সোনালী আভায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নিরা এই প্রথম অর্নবদের বাসার ছাদে উঠেছে। ছাদটা ভীষণ সুন্দর করে সাজানো। অনেক গুলো ফুল গাছ পরপর লাগানো হয়েছে। একটা দোলনা রয়েছে। দোলনা থেকে একটু দূরে এক সেট বেতের সোফা সেট। সোফা সেটের উপর বড় একটা ছাতা দেয়া। হয়তো রোদ বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যই এ ব্যবস্থা। নিরা হঠাৎ মনে হলো এত সুন্দর ছাদ সে আগে কখনো দেখেনি।

আজ মনটা ভীষণ খারাপ তার মাকে খুব মনে পড়ছে। তার বাবা আজ গ্রামে চলে গেছেন। এই এক মাস তার চিকিৎসা চলেছে। এখন অনেকখানি সুস্থ তিনি। অর্নব অনেক বলার পরও তিনি থাকতে নারাজ। তার মতে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে এতদিন থাকা ভালো দেখায় না। নিরাও চেয়েছিল বাবার সাথে যেতে কিন্তু তিনি জানালেন গ্রামের মানুষ তাকে সেখানে বাঁচতে দেবে না। তাই তার জন্য এখানে থাকাই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ।

বাবা চলে যাওয়ার পর নিরার মন ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। তাই কিছু না ভেবেই ছাদে চলে আসল। অনেকটা সময় এখানে দাঁড়িয়ে আছে সে৷ দৃষ্টি শুন্যে নিজের জীবনের পরিনতি নিয়ে ভাবলেই ভয় হয় তার। প্রতিটি মেয়ের বিয়ে নিয়ে কিছু আশা থাকে কিন্তু তার জীবনটা হঠাৎ এতটা এলোমেলো হয়ে যাবে সে বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠল। সে দেখল প্রকাশকের কল। একটা পান্ডুলিপি জমা দেয়ার কথা এ মাসের ১৫ তারিখে। কিন্তু সে মাত্র অর্ধেক শেষ করেছে। বিয়ের পর আর হাত দেয়নি। কী করবে কিছুই মাথায় ধরছে না। এখন ২০১৯ চলছে। এ বছর বইমেলায় তার ‘আঁধারে আলো’ বইটা বের হয়েছে। এই বইটা খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রকাশকের মতে খুব শীঘ্রই সে বেস্টসেলার লেখক হতে যাচ্ছে। তার ক্ষুরধার লেখনীতে মানুষের জীবনের নানা দিক সুস্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠে। যা মানুষকে হাসাতে, ও কাঁদাতে বাধ্য করে।

নিরা প্রকাশকের সাথে কথা বলল। বাবার অসুস্থতার কথা বলে আরও একমাস সময় চেয়ে নিল। ভাবল জীবনে এমন উত্থান পতন তো হতেই থাকবে। তাই বলে পিছিয়ে থাকলে হবে না। লেখা শেষ করতে হবে। একজন লেখকের কাছে অনেক প্রত্যাশা থাকে পাঠকের। লেখকের ব্যাক্তি জীবন যতই সমস্যায় থাকুক। পাঠকের প্রত্যাশা পূরণের জন্য তাকে লিখতেই হবে।

কথা শেষ করে দোলনায় এসে বসতেই পশ্চিম দিকে একটা রুম দেখতে পেল। কৌতূহলী হয়ে সেদিকে গিয়ে দেখল। এখানে আলাদা একটা ঘর রয়েছে। ঘরটায় তালা লাগানো হলেও সে তালার সাথে চাবি লাগানো রয়েছে। হয়তো কেউ তাড়াহুড়ায় চাবিটা খুলে নিতে ভুলে গেছে। সে ভাবল ভেতরে যাওয়া যাক। তারপর মনে হলো কাউকে জিজ্ঞেস না করে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা। অনেকটা সময় ভেবে ঠিক করল এ ঘরটা দেখবেই সে। তাই খুব সাবধানে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। অস্ফুটে বলল, “এত বই!”

ভেতরে ঢুকে বইগুলোতে হাত বুলাতে লাগল। সে খুব অবাক হলো যে এ বাড়িতে কেউ এত বই পড়ে! এখানে একটা পুরো লাইব্রেরি আছে সে জানতোই না।

মনে মনে খুশি হলো যে এগুলো নিয়ে পড়া যাবে। আবার পরক্ষণেই মনে হলো বইগুলো কার সেটাই তো সে জানে না। কাকে জিজ্ঞেস করবে এগুলোর কথা।

কিছুক্ষণ ঘরটা দেখে চলে আসল নিচে। মন এখনো খারাপ হয়ে আছে। অর্নব তখনই ঘরে ঢুকল। নিরা তাকে দেখে বলল, “বাবা কতদূর গিয়েছেন?”

“তুমি চিন্তা করো না এবার পৌঁছে যাবেন। আমি ড্রাইভারকে সাথে পাঠিয়ে দিয়েছি। বাসে যেতে কষ্ট হবে তাই।”

নিরা বিয়ের পর এ প্রথম অর্নবের সাথে শান্ত হয়ে কথা বলছে। সে বলল, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। বাবার জন্য যা করলেন তা হয়তো আর কেউ করত না।”

অর্নব মৃদু হাসল বলল, “নিজের মানুষদের কেউ ধন্যবাদ দেয় নাকি?”

নিরা চমকাল! মনে মনে কয়েকবার আওড়াল নিজের মানুষ, নিজের মানুষ!

অর্নব তার ভাবুক মুখ দেখে বলল, “কী ভাবছো?”

“তেমন কিছুই না।”

তখনই ঘরে দিদান আসলেন অর্নবকে বললেন, “দাদু ভাই নিরার মন খুব খারাপ হয়ে আছে। তার বাবা চলে গেছেন তাই। তুমি তাকে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে আসো। তোমাদের বিয়ের পর কোথাও যায়নি মেয়েটা। আমি ভাবছি কিছুদিনের জন্য তোমাদের কোথাও বেড়াতে পাঠাব।”

অর্নব নিরা একে অপরের দিকে তাকাল। অর্নব ভাবল মেয়েটার আসলেই মন খারাপ তাকে ঘুরিয়ে আনা দরকার। তাই সে বলল, “নিরা যেতে চাইলে অবশ্যই নিয়ে যাব।”

দিদান নিরাকে বললেন, “তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও নাত বউ। ঘুরে আসো বাইরে থেকে। দেখবে ভালো লাগবে।”

নিরা লক্ষী মেয়ের মতো ক্লোজেট থেকে একটা সুতি শাড়ি বের করে ওয়াশরুমে চলে গেল। কিছুক্ষণের ভেতর বের হয়ে আসল। অর্নব তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। তখনই আয়নায় দেখতে পেল নিরা তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। পরনে নীল শাড়ি, চুলগুলো খোলা পিঠময় ছড়ানো ছিটানো। এ প্রথম তার মনে হলো মেয়েটা অদ্ভুত সুন্দর! ছিপছিপে দেহে শাড়িটার সৌন্দর্য বেড়ে গেছে বলে তার মনে হলো। মেয়েটাকে সে কখনো সামনে থেকে এভাবে দেখেনি। হ্যাঁ প্রতিদিন ঘুমের মধ্যে দেখে তাকে। মেয়েটা হয়তো সেটা জানে না। জানলে যে তাকে আস্ত গিলে খাবে সে কি সে জানে না নাকি। বাহ-বা যে দজ্জাল মেয়ে।
নানা ভাবনায় নিরার কথায় তার সম্বিৎ ফেরে তার। নিরা বলছে, “আপনার হয়েছে। আমি তৈরি হব।”

অর্নব সম্মানের সাথে সেখান থেকে সরে আসল। এসে বিছানায় বসল। আজ কেন যেন তার চোখ বারবার নিরার দিকে চলে যাচ্ছে। আয়নায় নিরা সেটা দেখতে পাচ্ছে। তাই সে বলল, “কী দেখছেন বলুন তো?”

অর্নব অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কই কিছু নাতো?”

নিরা কী ভেবে যেন বলল, “ড্রেসিং টেবিলটা অনেক সুন্দর তাই না?”

অর্নব কিছু না ভেবেই বলল, “হ্যাঁ সুন্দর!”

কথাটা বলার সময় তার চোখেমুখে মুগ্ধতা কাজ করছিল। নিরা মুচকি হাসল। অর্নব যেন আরেকটা ধাক্কা খেল। ঝগড়াটে মেয়েটা এত সুন্দর করে হাসতেও জানে! নিজেকে সামলে নিয়ে সামনের দিকে তাকাল। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মেয়েটা তাকে আবার কথা শোনাতে পারে। নিরা হালকা কাজল ও লিপিস্টিক দিল। তারপর চুলগুলো হাত খোঁপা করে বলল, “আমি তৈরি।”

অর্নব বলল, “হ্যাঁ চলো তাহলে?”

নিরা তাকে পিছু ডেকে বলল, “শুনুন ডাক্তার সাহেব?”

অর্নব থমকাল পিছু ফিরে বলল, “হ্যাঁ বলো শুনছি?”

নিরা হাসিমুখে তার চশমাটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই নিন আপনার ফেইক চোখ?”

অর্নব মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে চশমাটা নিল।

দুজনের নিচে নেমে পার্কিং লটে আসল। তাদের দেখে ড্রাইভার এগিয়ে আসলে অর্নব তাকে জানাল আজ সে ড্রাইভ করবে। তার কথা শুনে ড্রাইভার পিছিয়ে গেল। নিরা অর্নবের পাশের সিটে বসেছে। দুজনেই চুপচাপ। অর্নবই প্রথমে বলল, “তারপর তোমার পড়াশোনার কী খবর? এখন লাস্ট ইয়ার আমার মনে হয় তোমার ভালো করে পড়াশোনা করা উচিত। এখন ভালো করে না পড়লে তোমার কেরিয়ারের ক্ষতি হতে পারে।”

নিরা বলল, “সে জন্য তো আমি চাইছি বাড়ি যেতে। আপনিই তো দিচ্ছেন না।”

“দেখো নিরা আমি চাই না কেউ তোমায় খারাপ কিছু বলুক। তোমার পরীক্ষার আর আট মাস আছে। এখানে সে পর্যন্ত থেকে পরীক্ষাটা দিয়ে দাও। তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য কোচিং এর ব্যবস্থা করতে পারি। এতে তোমার পড়াশোনায় আরও ভালো হবে। এরপর তুমি চাইলে যেকোনো চাকরি করে নিজের মতো করে থাকতে পারো।”

নিরা বলল, “আমি চাই না আমার জন্য কেউ এতকিছু করুক।”

অর্নব গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে গাড়ি স্লো করে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তো কে বলছে তোমার জন্য আমি এসব এমনি এমনি করব। ধার দিচ্ছি, পরে পরিশোধ করে দিবে।”

নিরা অবাক হয়ে তাকাল অর্নবের দিকে। তারপর চুপচাপ সামনে দৃষ্টি ফিরাল।

কিছুক্ষণ নীরবে কাটার পর অর্নব আবার বলল, “গ্রাজুয়েশনের পর তোমার কী করার ইচ্ছে?”

নিরা কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে বলল, “একসময় স্বপ্ন দেখতাম দেশের বাইরে যাব মাস্টার্স করার জন্য। কিন্তু এখন আর তা হবে না। বড় হতে হতে বুঝতে পেরেছি আমাদের মতো মতো মধ্যভিত্ত পরিবারের জন্য এমন স্বপ্ন দেখার অনুমতি নেই।”

অর্নব সান্ত্বনা দেয়ার স্বরে বলল, “আমাদের দেশেও অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব। তুমি চিন্তা করো না যা হবে ভালো কিছুই হবে।”

নিরা সেটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, “আমার রাতের রাস্তায় হাঁটতে ভীষণ ভালো লাগে।”

হঠাৎ অর্নব গাড়ি থামিয়ে বলল, “চলো হাঁটি।”

নিরা অবাক হলো তবে কিছুই বলল না। দুজনে অনেকটা সময় রাস্তায় হাঁটতে লাগল। নিরা সামনে তার পেছনে অর্নব। নিরাকে আজ অন্য দিনের চেয়ে আলাদা মনে হচ্ছে। জীবনে অনেক রকম মানুষ দেখেছে অর্নব, মোটামুটি মানুষ চেনার ক্ষমতাও তার অনেক। শুধু এ মেয়েটাকে বোঝার ক্ষমতা তার নেই। কালকের নিরা আর আজকের নিরার মাঝে বিস্তর ফারাক। কেন জানে না আজ অর্নবের কাছে সবকিছু ভালো লাগছে। দুজনে একটি রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিল।
তারপর আবার বেরিয়ে আসল। স্নিগ্ধ রাত আকাশে হাজার তারার মেলা। দুজন মানব-মানবী পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। অর্নবের হঠাৎ মনে হলো এ পথ যদি না শেষ হয়। তবে কেমন হতো? তার আটাশ বছরের জীবনে সে এমন কোনো কিছু অনুভব করেনি যা এখন করছে। সে জানে না এমন অনুভূতির নাম কী। শুধু জানে ভালো লাগছে এইতো অনেক। অত নাম খুঁজে হবেটা কী!

রাত এগারোটায় দুজনে বাসায় ফিরল। নিরা রুমে এসে ঘুমের আয়োজন করছে এমন সময় অর্নব ফ্রেশ হয়ে এসে বলল, “নিরা তুমি উপরে ঘুমাও। নিচে ঘুমাও কেন?”

নিরা মৃদুস্বরে বলল, “আপনার ঘর আপনার উচিত বিছানায় ঘুমানো। আমার জন্য আপনি কেন বাইরে ঘুমাবেন?”

“তুমি তো আর সারাজীবন এখানে ঘুমাবে না। তাই আমি চাই যা কয়দিন আছো তুমি যেন কোনো কষ্ট না পাও। প্লিজ বিছানায় যাও।”

নিরা অবাক হয়ে তাকাল অর্নবের দিকে। ভাবল ছেলেটা কী বলল সে চায় না আমি কষ্ট পাই! কেন চায় না? এত আন্তরিক হয়েই বা কেন কথা বলছে! নিরা হঠাৎ অনুভব করল এ যত্নটা তার ভালো লাগছে। কেন ভালো লাগছে সে জানে না। শুধু জানে ভালো লাগছে ব্যস!

হঠাৎ সে বলল, “ঠিক আছে আমি বিছানায় ঘুমাব। কিন্তু আপনাকেও ঘুমাতে হবে। বারান্দা কোনো ঘুমের জায়গা হলো নাকি?”

অর্নব চমক লাগা চোখে তার দিকে এগিয়ে বলল, “কী বললে?”

নিরা ইতস্ততভাবে বলল, “মানে আপনাকে আমি বিশ্বাস করি। তাই কিছুটা দূরত্ব রেখে ঘুমানোই যায়।”

অর্নব হাসল তারপর বারান্দায় গিয়ে বালিশটা নিয়ে এসে দেখল নিরা বিছানায় শুয়ে আছে। সে আর কোনো কথা বলল না। চুপচাপ তার পাশে শুয়ে পড়ল।

কিন্তু কোনো এক বৈচিত্র কারণে সে-রাতে তার ঘুম আসল না। তারসাথে এটাও বুঝতে পারল তার পাশের মানুষটাও ঘুমায়নি। কিন্তু কেন ঘুমায়নি?

★★★

অর্নব হাসপাতালে ঢুকতেই লিফটে দিয়ার সাথে দেখা হয়ে গেল। দুজনেই হাসল। দিয়া বলল, “তারপর কেমন চলছে দিনকাল অর্নব?”

অর্নব আগের হাসিটা ধরে রেখে বলল, “যাচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ। তোমার কেমন যাচ্ছে?”

“যার হবু বর অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে তার যেমন দিন কাটার কথা ঠিক তেমনি।”

দিয়ার কথা শুনে অর্নবের হাসিটা বাতাসে মিলিয়ে গেল। অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “সব ঠিক হয়ে যাবে দিয়া। চিন্তা করো না।”

দিয়া শ্লেষের হাসি হাসল। অর্নব সে হাসিটাকে একেবারে অগ্রাহ্য করে বলল, “আজ কী তোমার কোনো অপারেশন আছে?”

“না নেই।” দিয়ার মুখভার।

“আজ আমার একটা অপারেশন আছে। তুমি চাইলে আমার সাথে জয়েন করতে পারো।”

দিয়ার মুখে হাসি ফুটল সে বলল, “ডান।”

অর্নব জানে দিয়া তার সাথে অপারেশন থিয়েটারে যোগ দিতে ভীষণ ভালোবাসে। তাই সে সুযোগটা কাজে লাগাল। সে ভাবে মেয়েটার সাথে সে অন্যায় করেছে। এটা তার করা উচিত ছিল না। কিন্তু দিয়া অনেক ভালো মেহে তাই তাকে এটা নিয়ে বেশি চাপ দিচ্ছে না। দিয়ার চেম্বার থার্ড ফ্লোরে। তাই থার্ড ফ্লোরে সে নেমে গেল। অর্নবের চেম্বার সিক্স ফ্লোরে তাই সে বিদায় জানিয়ে লিফটের ৫ নম্বরে সুইচে চাপ দিল। আজ তার মন খুব ভালো কেন জানে না সে কালকের রাতটা খুব মনে পড়ছে তার। নিরা ভালো ভালো কথা বলা। একসাথে রাতের রাস্তায় হাঁটা। সব যেন তার হৃদয়ে নতুন এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। যা চেয়েও অস্বীকার করতে পারছে না সে।
#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#সাত

ভোরের আকাশে মিষ্টি রোদের আভা ফুটে উঠছে। সে আভায় একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে রাতের অন্ধকার। একটা সোনালী দিন মানে সৃষ্টিকর্তার অশেষ নেয়ামত। জানালা গলে রোদ এসে চোখে পড়তেই ঘুম ভাঙে অর্নবের। পাশে ফিরতেই একটা স্নিগ্ধ মুখের ওপর নজর পড়ে। সে মুখে রোদের ঝিলিক পড়ছে তাই তার চোখমুখ বিরক্তিতে কুচকে আছে। অর্নব উঠে বারান্দার গ্লাসের উপর পর্দাটা টেনে দিল। তারপর আবার মুখটার দিকে তাকাতেই দেখল এখন আর তাতে কোনো বিরক্তির ছাপ নেই। বরং স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। কেন জানে না তার অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। সে হাসিতে কিছুক্ষণ নীরবে কাটার পর ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল। তখনই তার ফোন বেজে উঠল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল মায়ান কল করেছে। রিসিভ হতেই মায়ান বলল, “নিচে আয় তো অর্নব?”

অর্নব অবাক হয়ে বলল, “কই নিচে যাব?”

“তোদের বাসার নিচ তলায় আসতে বলছি।”

অর্নব হাতের টাওয়ালটা নিয়ে নিচে নেমে এলো। ড্রয়িংরুমে যেতেই দেখতে পেল মায়ান দাঁড়িয়ে আছে। সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বলল, “হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ!”

মায়ান হাসার চেষ্টা করে বলল, “রাতের ফ্লাইটে এসেছি। ভাবলাম তোর সাথে দেখা করে আসি।”

“আমাকে জানাতে পারতি একবার? এয়ারপোর্টে যেতাম।”

মায়ান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “তোর এখন অত সময় আছে নাকি?”

অর্নব তার কাছে গিয়ে পিঠ চাপড়ে বলল, “কেন থাকিবে না বন্ধু? ”

“নতুন বিয়ে করেছিস। এখন নিশ্চয়ই বন্ধুদের জন্য সময় থাকার কথা নয়?”

অর্নব কিছুটা নিভলো। ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখে বলল, “স্যরি ইয়ার তোকে বলা হয়ে উঠেনি। আসলে কী থেকে কী হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি।”

মায়ান নিজেকে যথাসম্ভব সামলে বলল, “আচ্ছা যা হওয়ার তা হয়েছে। এখন ভাবীর সাথে দেখা করাবি না?”

অর্নব বলল, “ওকে তুই চিনিস। ওদের গ্রামে দেখেছিস। নাম নিরা চিনতে পেরেছিস?”

মায়ানের খুব কষ্ট হচ্ছে তাও নিজেকে সামলে বলল, “হ্যাঁ চিনি। তখন তো ভালো করে দেখিনি। এখন ডাক পরিচয় হয়ে নেব।”

“তুই বস আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি। ও এখনো ঘুমাচ্ছে।”

মায়ান সোফায় বসল। আজ প্রথম তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় বন্ধুকে তার সবচেয়ে বড় শত্রু বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে তাকে মেরে নিরাকে নিয়ে চলে যেতে। এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কষ্টের বোধহয় ভালোবাসার মানুষকে অন্যের হতে দেখা। এর থেকে মৃত্যু যন্ত্রণাও ঢের ভালো।

★★★

অর্নব রুমে এসে দেখল নিরা ঘুমাচ্ছে। তার কিছুতেই নিরার ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তার বন্ধু বাসায় এসেছে তার সাথে দেখা করতে, নাই তাকে না করা সম্ভব নয়। আলতো সুরে বার কয়েক ডাকল সে। “নিরা, এ্যাই নিরা শুনছো?”

নিরা আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল অর্নব তার উপর ঝুকে তাকে ডাকছে। অর্নবের নিশ্বাসের শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে। হঠাৎ এমন কাণ্ডে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সে। তাড়াতাড়ি উঠে বসে বলল, “আপনি কী করছেন বলুন তো?”

অর্নব ব্যাক্কল বনে গেল। ভ্রুকুচকে বলল, “কী করছি? ডাকছি তোমাকে? ”

“দূর থেকেও তো ডাকা যায়। এভাবে গায়ের উপর ঝুকে আসার কী দরকার? ”

অর্নব অবাক হয়ে বলল, “এ মেয়েটাও না সবসময় বেশি বুঝে।”

নিরা মুহূর্তে কী ভেবে যেন বলল, “এ্যাই যে শুনুন আপনি কী ভাবছেন এভাবে আমার কাছে আসা যাবে? আপনার তো চরিত্রের ঠিক নেই। ছয়মাস পর যাকে ছেড়ে যাবেন তার সাথে এখন.।”

অর্নব তার কথা শুনে যেন সাত আসমান উপর থেকে ধপাস করে মাটিতে পড়ল। ভাবল এ মেয়ে বলে কী! পাগল, নাকি মাথা খারাপ?

তারপর রাগী স্বরে বলল, “এ্যাই শোনো তোমার কাছাকাছি যাওয়ার জন্য আমি মোটেও মরে যাচ্ছি না। আমার বন্ধু এসেছে তোমার সাথে দেখা করতে তাই ডাকছি।”

নিরা বলল, “আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে। আমি আসছি। আমি তো আপনার নকল বউ আমাকে এভাবে মানুষের সাথে দেখা করিয়ে কী লাভ বলুন তো?”

“বউ, বউই হয়। আসল, নকল হয় না। যাও তো তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও।” কথাটা বলার পর অর্নব ভাবল ইশ কী বলে ফেললাম। এ মেয়ে তো এবার আমাকে আস্ত গিলে খাবে।

নিরা ঠোঁট কামড়ে অর্নবের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী যেন ভাবল তারপর কিছু না বলে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল। অর্নব ভাবছিল এখন তুলকালাম হবে। কিন্তু তা হলো না দেখে অবাক হলো। মেয়েটাকে সে বুঝে না। কেমন অদ্ভুত আচরণ করে।

বিধাতা এক মানুষকে অন্য মানুষ পড়ার ক্ষমতা দেননি। যদি দিতেন এ মুহূর্তে সে মেয়েটার ভেতরটা রিডিং পড়ার মতো পড়ে ফেলত। এতে অন্তত কোনো দ্বিধা-দ্বন্ধ থাকত না। এই তো ওয়াশরুমের দরজা দেয়ার সময় মনে হলো নিরা মুচকি হাসছে। আসলেই কী হাসছে মেয়েটা! ধুর কী ভাবছি আমি! মায়ান বসে আছে আমাকেও ফ্রেশ হতে হবে। এসব ভেবেই ওহির রুমের ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল অর্নব।

★★★

সিড়ি বেয়ে পাশাপাশি নামছে অর্নব আর নিরা। তাদের পায়ের শব্দ শুনতেই তাদের দিকে তাকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল মায়ান। তার দৃষ্টি নিরার দিকে। মেয়েটাকে আগে থেকে অনেকখানি বড় দেখাচ্ছে। একটা নারীত্ব ভাব এসেছে। বিয়ের পর কী সব মেয়ের এমন পরিবর্তন হয়! এই তো এর দু’পা ফেললেই একদম কাছে এসে যাবে। এই তো নিরা হাসছে অপূর্ব সেই হাসি। মায়ান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

নিরা স্মিত হেসে বলল, “আসসালামু আলাইকুম আমি নিরা?”

“মায়ান যেন কিছুই শুনছে না। কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছে। অর্নব তার দিকে তাকিয়ে দেখল কিছু একটা বুঝে তাকে হাত দিয়ে খোচা দিয়ে বলল, ” কীরে পরিচয় দিবি? নাকি আমি দেব?”

মায়ানের সম্বিৎ ফেরে সে কোনোরকম হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমি মায়ান। আগে থেকেই চেনো নিশ্চয়ই?”

“জি আমার মনে আছে আপনি একবার ডক্টর অর্নবের সাথে আমাদের গ্রামে গিয়েছিলেন।”

নিরা, অর্নবকে ডক্টর অর্নব ডাকায় মায়ান খুশি হলো। মনে মনে ভাবল দিয়া ঠিকই বলেছে এদের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক হয়ে উঠেনি। তাই নিরাকে পাওয়া আমার জন্য সহজ হবে।

অর্নব বলল, “নিরা আমাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করতে পারবে?”

নিরা হেসে জবাব দিল, “অবশ্যই নিয়ে আসছি।”

অর্নব এ প্রথম তাকে কোনোকিছু নিয়ে আসার কথা বলেছে। বন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। জানে না কেন আজ নিরার নিজেকে সত্যি সত্যি অর্নবের বউ বলে মনে হলো।

নিরা জটপট টোস্ট, ডিমসেদ্ধ, কলা আর দু’কাপ কফি নিয়ে আসল। সে দেখেছে অর্নব সকালে এসবই খায়। ডক্টররের সবসময় স্বাস্থ্যের দিকে নজর। তাই তো এতটা সুদর্শন রয়েছেন। হঠাৎ নিরার মনে হলো আমি এই কাঠখোট্টা ডক্টরকে সুদর্শন কেন ভাবছি! মানুষ যতই সুদর্শন হোক আগে তার মন সুন্দর হতে হয়। এ লোকের মন মোটেও সুন্দর নয়।

অর্নব বলল, “কফি দু’কাপ যে তোমার চা নিয়ে আসোনি?”
নিরা চমক লাগা চোখে তাকাল তার দিকে। সে যে কফি খায় না। চা খায় এটা কী করে জানল ডক্টর! এতকিছু কখন খেয়াল করেন তিনি নাকি বন্ধুর সামনে অভিনয় সুখী দম্পতির অভিনয় করছেন।
নিরা মৃদু হেসে বলল, “নিয়ে আসছি।”

নিরা চলে গেলে মায়ান বলল, “বেশ সুখে আছিস বলে মনে হচ্ছে?”

অর্নব একটু থমকাল তারপর হাসার চেষ্টা করে বলল, “সে আছি। এখন তোর কনফারেন্স কেমন ছিল বল? কেমন সময় কাটিয়েছিস?”

“এই তো মোটামুটি ভালোই। স্যার তোর কথা জিজ্ঞেস করেছেন।”

“তাই নাকি। আসলে আমিও সবাইকে খুব মিস করি।”

তখনই নিরা চা নিয়ে আসল। অর্নবের পাশের চেয়ারটায় বসতে নিলেই মায়ান বলল, “এক মিনিট নিরা। তোমার উচিত আমার পাশে বসা।”

মায়ানের কথা শুনে নিরা অর্নব দুজনেই দুজনের দিকে অবাক হয়ে তাকাল। কী বলছে এ ছেলে! মায়ান জোরে হেসে বলল, “কী চমকে দিলাম তো? আসলে তোর বউ তো সবসময় তোর পাশে বসবে। আজ দেবর এসেছে তার পাশে না হয় একটু বসল।”

নিরা অর্নব এবার একটু স্বাভাবিক হলো। তারাও হাসল। কিন্তু নিরা একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল বলল, “আমি আমার বরের পাশেই বসতে চাই। দেবরদের অত কাছে বসতে নেই।”

নিরার কথা শুনে বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে গেল অর্নবের। এ দেখি ভুতের মুখে রাম রাম! সামনে থাকা এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে পান করল সে। কেন জানে না আমার বর কথাটা শুনে তার অদ্ভুত এক ভালো লাগায় মনের একোণ-সেকোণ ছড়িয়ে পড়ল। নাস্তা শেষ করে অর্নব মায়ানকে বলল, “আমি উপর থেকে আসছি তুই বোস।”

নিরাও তার পিছুপিছু গেল। মায়ানের এ মুহূর্তে টেবিলে রাখা সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। এ ঘরটায় আগুন লাগিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। সে ভাবল আমার নিরা অন্যকাউকে তার বর বলছে! না এটা কিছুতেই মেনে নেয়া সম্ভব নয়। আমি কিছুতেই তাকে আমার থেকে আলাদা হতে দেব না। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে নিরাকে আমার চাই। যেকোনো কিছুর! সে যদি আমার বন্ধুও হয় তবে তাই হবে!

★★★

রুমে এসে নিরা খাটের উপর বসে পা দোলাতে দোলাতে বলল, “আপনি কিন্তু দারুণ অভিনেতা। সিনেমার জন্য কেন চেষ্টা করেননি বলেন তো?”

অর্নব অবাক হয়ে বলল, “যেটা আমার তোমাকে বলার কথা সেটা তুমি আমায় বলছো?”

“আমি আবার কী করলাম?”

“কিছু করোনি বলছো? আমার বরের পাশে ছাড়া বসব না। এ কথা কী তবে সত্যি ছিল?”

নিরা ঠোঁট কামড়ে বলল, “এটা ১০০% মিথ্যা ছিল। আপনার সম্মান রক্ষার্থে মিথ্যা বলেছি।”

“ধন্যবাদ মহারানী আমাকে আপনারা উদ্ধার করে ফেলেছেন।”

“আপনি কী নিজেকে মহারাজা বলছেন নাকি?”

অর্নব কপাল কুচকে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী বলছো তুমি?”

“আমাকে যে মহারানী বলছেন। তাই ভাবলাম মতো মহারাজার বউই তো মহারানী হয়।”

অর্নব চোখ বড়বড় করে নিরার দিকে চেয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় চোখ পাকিয়ে গেল।

★★★

অর্নব হাসপাতালের চলে যাওয়ার পর নিরা দিদানের কাছে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হলো। দিদানের ঘরের সামনে আসতেই দুটো গলার আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়াল। নিরা বুঝতে পারল বাবা আর দিদান কথা বলছে।

দিদান বলছেন, “আমি চাই মেয়েটাকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে। তোর অপরাধের বোঝা কেন আমাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে?”

“মা তুমি বুঝতে পারছো না। মেয়েটা যেদিন সবটা জেনে যাবে সেদিন আমাদের হাতে কিচ্ছু থাকবে না। তোমার কী মনে হয় সে আমাদের এত সহজে ক্ষমা করে দেবে?”

দিদান আকুল গলায় বললেন, “আমার এক পা কবরে বাবা। এবার তুই আমাকে রেহাই দে। আমি সারাজীবন এ গ্লানি বয়ে বেড়য়েছি। আর পারব না। তুই আমাকে হয় মেরে ফেল, নয়তো মেয়েটাকে তার সব ফিরিয়ে দে।”

হঠাৎ ওহির ডাকে নিরা ভয় পেয়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে সেখান থেকে চলে যায়। যেতে যেতে ভাবে এরা কার কথা বলছে! কোন মেয়ের সাথে তারা অন্যায় করেছেন! কী লুকিয়ে আছে এ সুন্দর পরিবার, সুন্দর বাড়ি, আর সুন্দর মানুষগুলোর আড়ালে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here