সন্ধ্যা নামার পরে পর্ব ২+৩

#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#দুই

পুরোটা পথ বাবাকে নিয়ে নানা চিন্তায় কেটেছে। লোকটার সাথে একটা কথাও হয়নি। অর্নব কাকে যেন কল করে গাড়ি থামিয়ে কথা বলে নেয়। আমার শুধু এই মুহূর্তে এটাই মনে হচ্ছে বাবার কিছু হবে নাতো? আমার জীবন এই একটা দিন আগে যেমন ছিল, তেমন হয়ে যাবে তো? হয়তো আমি চাইলেও আর অনেক কিছুই আগের মতো করতে পারব না। সবচেয়ে বেশি যেটা আগের মতো হবে না। সেটা আমার নাম। এখন আমি একজনের স্ত্রী সে মানি আর না মানি। সমাজ কখনো এই ট্যাগ থেকে আমাকে পালাতে দেবে না। যদি অর্নবের সাথে আমার ডিভোর্সও হয়ে যায় তাও আমার নামের পাশে তার স্ত্রী ট্যাগটাই থাকবে। হয়তো তখন স্ত্রীর সাথে প্রাক্তন শব্দটা জুড়ে যাবে।

★★★

চট্টগ্রাম এসে সবার প্রথমে হাসপাতালে এসে বাবার টেস্ট গুলো করানো হলো। রিপোর্ট তিনদিন পর দেবে তাই আমি ডাক্তার সাহেবকে বললাম, “আমরা এখন বাড়ি চলে যাই। তিনদিন পর আসা যাবে। এ পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।”

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সে আমাকে আরেকটি ধমক দিয়ে বলল, “তোমার কী মনে হচ্ছে তুমি আবার অসুস্থ মানুষটাকে টেনেহিঁচড়ে বাড়ি নিয়ে যাবে? যদি তোমার ইচ্ছে হয় তবে চলে যাও। উনি কোথাও যাচ্ছেন না। কারণ একজন ডক্টর হয়ে আমার রোগীর ক্ষতি আমি কাউকে করতে দেব না। যদি সে রোগীর মেয়েও হয় তাও না।”

লোকটা আমায় আবার আটকে দিল। সে জানে বাবাকে আটকে রাখলে আমিও থাকতে বাধ্য হব। তাই সেটাই করল। ইচ্ছে করছিল মুখের উপর কয়টা কথা শুনিয়ে দেই। কিন্তু বাবার কথা চিন্তা করে সেটা আর করা হলো না। আমার উপর রাগ করে যদি বাবার কোনো ক্ষতি করে দেয়! কিন্তু অন্য একটা বিষয় আরও অদ্ভুত লাগল তার সাথে আমার প্রায় চার বছরের চেনা-জানা হতে পারে তা খুব বেশি নয়। তাও সবসময় গ্রামে আসলেই আমাকে পড়াশোনার কথা বলতেন। জীবনে বড় হওয়ার জন্য অঅনুপ্রেরণা দিতেন কিন্তু এখন কেন এমন করছেন। আমি তো তার জীবন থেকে সরে যাব বলেছি। কিন্তু সে কেন আমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে। নানা ভাবনায় কান্না যেন দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আসছিল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম।

★★★

একটা দো’তলা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামল। বাবাকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে অর্নবের পিছুপিছু সামনে এগুতে লাগলাম। বাড়িতে ঢুকতেই দেখলাম একজন প্রোঢ়াসহ চারজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। বয়স্ক ভদ্রমহিলাটির পরনে সাদা জামদানী শাড়ি। চুলগুলো পাট করে আঁচড়ানো। চোখ জোড়া ভীষণ সুন্দর। বয়সের ভারে গায়ের চামড়া কুচকে গেলেও যৌবনে যে তিনি কতটা সুন্দরী ছিলেন তা আজও দেখলে পরখ করে বলা যায়। আজও তার চেহেরায় সেই উজ্জ্বলতা রয়েছে। এক দেখায় চোখ আটকে গেল আমার। বুঝতেই পারলাম না আরও কয়েকজন আমার সামনে দাঁড়িয়ে। অর্নব এক এক করে সবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। বাবা ইশারা করল বড়দের সালাম করতে। বৃদ্ধার ডানদিকে দাঁড়ানো অর্নবের মা। তার পাশে অর্নবের বাবা। আর বামপাশে আমার বয়সী পুতুলের মতো দেখতে তার বোন। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “ওয়েলকাম হোম ভাবী।”

তার ভাবী ডাকে তাজ্জব বনে গেলাম। এ বিয়েটাকে আমি মানি না। তার সাথে কোনো সম্পর্কেও আমি মানি না। ভাবলাম বলব এই মেয়ে তুমি সুন্দর। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে কিন্তু একদম এসব ভাবী বলে ডাকবে না। আমি মোটেও তোমার ভাবী নই। কিন্তু বলতে পারলাম না। কিছু বলতে যাব তার আগেই পায়ে কেউ এত জোরে চাপ দিল যে ব্যথায় কুকড়ে উঠলাম। বুঝলাম ওই বজ্জাত ডাক্তারের কাজ। ধৈর্য ধরে চুপ করে রইলাম।

বৃদ্ধা মহিলাটি রাশভারি গলায় আমাকে বললেন, “জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে বলেই আমি বিশ্বাস করি। আমার দাদু ভাইয়ের বউ দেখার অনেক শখ ছিল আমার। কিন্তু তার বিয়েটা এমন অদ্ভুতভাবে হবে বুঝতে পারিনি। বউ হিসেবে তোমাকে পছন্দ হয়েছে কিনা সেটা এত অল্প সময়ে বুঝতে পারছি না। খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারব আশাকরি।”

উনার কথার মাঝখানে মধ্যবয়সী মহিলাটি হনহনিয়ে উপর তলায় চলে গেলেন। বৃদ্ধা আবার বললেন, “তোমার শাশুড়ি রাগ করেছেন। সে এমনি হুটহাট রাগ করে আবার সে রাগ চলেও যায়। আসলে তার বড় একটা আশায় জল ঢেলে দিয়েছো তুমি। তাই একটু শক্ত হবে তার রাগ ভাঙানো। তবে চেষ্টা করলেই পেরে যাবে। আমার বউমা ভালো মানুষ। আশাকরি বুঝতে পেরেছো।” তিনি এটুকু বলে দম নিলেন।

তারপর আবার বললেন, “আর হ্যাঁ আমাকে অর্নব দিদান বলে ডাকে। তুমিও তাও ডেকো। এখন যাও ওহি তোমাকে ঘরে নিয়ে যাবে। তোমার বাবাকে জাফর মানে তোমার শ্বশুর নিয়ে যাবে। উনার দিকে আমরা সবাই খেয়াল রাখব। তুমি চিন্তা করো না।”

সবার এত সহজভাব দেখে আমি শুধু অবাকই হচ্ছি। ভেবেছিলাম এরা আমাকে মেনে নেবে না। কিন্তু এখানে এসে দেখছি সব উল্টো। এই অসভ্য ডাক্তার তাহলে তখন ফোনে এদের সাথেই কথা বলছিল। আমি তো তাকে বলেছি ডিভোর্স দেব। তাহলে বাড়িতে বিয়েটার কথা না জানালেই পারত। কেন জানাল! ইচ্ছে করছে লোকটার মাথা পাঠিয়ে দিতে। এসব ভাবতেই ওহির কথায় হুস ফেরে।, “চলো ভাবী তোমার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি।”

ওহিকে অনুসরণ করে সামনের দিকে যেতে নিলেই দিদান পিছু ডেকে বললেন, “তোমার ঘরে খাটের উপর শাড়ি রেখে এসেছি। গোসল সেরে পরে নিবে। আমি আসছি একটুপর।”

আমি উপর নিচ মাথা দোলালাম। ওহি আমাকে দোতলার দক্ষিণের একটা রুমে নিয়ে আসল। রুমটার চারপাশ দেখলাম একটা খুব সুন্দর খাট। চারপাশের দেয়াল গুলো নীল, জানালার পর্দা থেকে শুরু করে বিছানার চাদর সবকিছু সাদা। মনে হলো আমি নীল সাদার দুনিয়ায় এসে গেছি।

ওহি আমার দু’কাঁধে হাত রেখে বলল, “এটা ভাইয়ার রুম। আজ থেকে তোমারও। এ বাড়িতে সবচেয়ে সুন্দর ঘর এটা। আশাকরি এখন থেকে আরও অনেক বেশি সুন্দর হয়ে যাবে। কারণ এর দ্বায়িত্ব নেয়ার মানুষ এসে গেছে।”

ওহি মেয়েটা এত দারুণ করে কথা বলে যে শুনতে খুব ভালো লাগে। ওহি বিছানার উপর থেকে তিনটা শাড়ির মধ্যে মেরুন রঙের শাড়িটি তুলে আমাকে দিয়ে ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দিল। এ কয়দিনের ধকলের পর লম্বা সময় ধরে ফ্রেশ হতে পেরে ভালো লাগছিল।

কিন্তু আমার সাথে যা ঘটছে তা কেমন এলোমেলো লাগছিল। সব এত সহজে কীভাবে হয়ে যাচ্ছে বুঝতেই পারলাম না। আমার মতো মধ্যভিত্ত পরিবারের মেয়েকে তারা কীভাবে এত সহজে গ্রহণ করল মাথায় ধরল না। কেউ না কেউ তো ভিলেন থাকার কথা। দরজা থেকে আমাকে বের করে দেয়ার কথা। অদ্ভুত ব্যাপার এমন কিছুই হলো না। তবে যে যাই বলুক কেউ ভিলেন নেই তো কী হয়েছে আমি ভিলেন হয়ে বের হব। কারো দয়ার বিয়েতে আমি থাকতে পারব না। নানারকম চিন্তা করতে করতে শাড়ি পরে ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই অবাক হয়ে গেলাম। রুমে ছিল ওহি, এখন দেখি ওই অসভ্য ডাক্তারটা দু’হাত উপরের দিকে মেলে পা’দুটো নিচের দিকে ঝুলিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। ভাবছিলাম ওহিকে শাড়ির কুচি গুলো একটু ধরতে বলব। এখন দেখি সে নেই।

এ কয়দিন অনেক জ্বালিয়েছে এ লোক। একে একটা শিক্ষা দেব বলেই ঠিক করেছি। এখন যেহেতু একা পাওয়া গেছে সুযোগ কাজে লাগানো উচিত। তাই কাঠকাঠ গলায় বললাম, “আপনাকে আগে দেখে তো এমন ক্যাটক্যাটে মনে হয়নি। বিয়ে করেছেন মানে কী উদ্ধার করে ফেলেছেন যে প্রতি কথায় কথায় আমাকে ধমক দেন?”

সে উঠে বসে আমাকে ভালো করে দেখে শান্ত গলায় বলল, “এই তুমি না অনার্সে পড়। এতটাও বাচ্চা নও যে এমন ছেলেমানুষী করবে। তাছাড়া খুব টায়ার্ড আমি। একদম বকবক করবে না।”

কী ব্যাপার এখন একে এত শান্ত দেখাচ্ছে কেন! কোনো মতলব আছে নাকি। ওহি কোথায় গেল। এ বজ্জাত লোক আমাকে একা একটা ঘরে দেখেই সে মিষ্টি শান্ত গলায় কথা বলছে। আচ্ছা এবার বুঝতে পেরেছি। নিজে সচেতন হয়ে বললাম, “শুনুন আপনার বাসায় সবাইকে বলে দিন। এটা কোনো বিয়ে নয়। আমার খুব ইচ্ছে প্রেম করে বিয়ে করব। সব মাটি হয়ে গেল। এ বিয়ে আমি কিছুতেই মানি না। বাবা সুস্থ হয়ে গেলে চলে যাব।”

আমি কী এমন বললাম জানি না। মানুষটা আমার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বলল, “বাহ! এদিকে তো দেখি টনটনে জ্ঞান। প্রেম করে বিয়ে করবে! তা করো না কে বারন করছে। এখন অন্তত তোমার কথার মেশিনটা বন্ধ রাখো। এটা তো চলতে শুরু করলে থামে না।”

“এই শুনুন বিয়ের পর থেকে আমি যাই বলেছি ধমক দিয়ে গেছেন। কোথায় আমি বেশি কথা বলেছি?”

“আচ্ছা স্যরি তোমাকে বকার জন্য। বিশেষ করে গায়ে হাত তোলার জন্য। আসলে সবকিছু নিয়ে এত চিন্তায় ছিলাম যে কোনোকিছুই তখন মাথায় ছিল না।”

“আচ্ছা ঠি আছে। কিন্তু আমাকে একটা কথা দেন আপনি সবাইকে আজই বলে দিবেন আমাদের বিয়ে হয়নি।”

“বিয়ে হয়নি বলছো?” আমার দিকে ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বলল।

“গ্রামের মানুষ জোর করে বিয়ে দিলেই বিয়ে হয়ে যায় নাকি। তাছাড়া আমি আপনার যোগ্য না।”

“প্লিজ নিরা একটু চুপ করবে? পরে এসব নিয়ে কথা হবে। এখন শাড়ি ধরে দাঁড়িয়ে না থেকে ঠিক করে পরো। আমি ওহিকে ডেকে দিচ্ছি। ঠিক করে শাড়িটাও পরতে শিখনি।”

আমার আর কোনো কথা না শুনে সে হনহনিয়ে বেরিয়ে চলে গেল। ওহি এসে বলল, “ভাবী আমাকে ডেকেছো?”

“হুম কুচিগুলো ধরে দেয়া যাবে?”

“কেন যাবে না ভাবী সাহেবা। কিন্তু এটা তুমি আমাকে দিয়ে না করিয়ে তোমার বরকে দিয়ে করালেই বেশি ভালো হত। ভেবে দেখো তো কী রোমান্টিক হত। উফ আমার তো ভাবতেই ভালো লাগছে।”

আমি অবাক হয়ে ওহির দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, “কী সব বলছো? উনি কেন আমার শাড়ি ঠিক করে দিবেন!”

“সে তোমার বর বলে।”

এ মেয়ে কী পাগল নাকি বুঝলাম না। কী সব বলে যাচ্ছে। তাই আর কথা বাড়ালাম না। চুপ করে শাড়ি ঠিক করলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলাম। ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ায় শাড়ি খুব একটা পরা হয়নি। আজ যেন আমাকে অনেকটা আলাদা দেখাচ্ছে। এমন সময় দিদান আসলেন আমাকে কাছে টেনে চিবুক ধরে বললেন, “তুমি বেশ রূপবতী। আশাকরি আমার দাদু ভাইকে সামলে রাখতে পারবে।” ভদ্রমহিলার কথা শুনে বার কয়েক ঢোক গিললাম। এ পরিবারের সবাই পাগল কিনা আমার সন্দেহ হলো। উনি আমার হাত টেনে এক জোড়া মোটা বালা পরিয়ে দিয়ে বললেন, “আমাদের খানদানি বালা। বিয়ের সময় আমার শাশুড়ি আমাকে দিয়েছিলেন। আমি তোমাকে দিলাম। অযত্ন করবে না। ”

দিদানের কথায় আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো এরা এত ভালো কেন! শুনেছি বড়লোকেরা ভালো মানুষ হয় না। কিন্তু এরা সবাই খুব ভালো। শুধু এক ওই ডাক্তার ছাড়া। হঠাৎ দেখলাম একটা সুন্দরী মেয়ে ঘরের ভেতর ঢুকল। দিদানের দিকে তাকিয়ে বলল, “অর্নব কোথায় দিদান?”

দিদান হেসে বললেন, “আরে দিয়া যে। এসো বসো। অর্নব আমার ঘরে আছে। এখনি চলে আসবে।”

মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “বাহ! মেয়েটা তো খুব সুন্দর দেখতে। কে ও দিদান?”

দিদান বললেন, “অর্নবের বউ।”

হঠাৎ মেয়েটার হাসি মুখটায় অন্ধকার নামল। চিৎকার করে বলল, “হোয়াট?”

মেয়েটার চোখেমুখে স্পষ্ট ব্যাথার ছাপ দেখতে পেলাম। আমার বুঝতে দেরি হলো না এ কে। তারপরও নিশ্চিত হতে ওহিকে জিজ্ঞেস করলাম, “উনি কে?”

উত্তরটা এলো দরজার সামনে থেকে অর্নব উত্তরে বলল, “আমার বাগদত্তা।”
#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#তিন

দিয়া মেয়েটা অর্নবের বাগদত্তা শুনে আমার খুশি হওয়ায় র কথা নাকি কষ্ট পাওয়ার কথা আমি জানি না। নিজের অনুভূতিটুকু তখনও আমার কাছে অস্পষ্ট। শুধু এটাই মনে হচ্ছে আমার বাবার আমি ছাড়া আর কেউ নেই। তাকে দেখে রাখার জন্য আমাকে পড়াশোনা করতে হবে। ভালো চাকরি করতে হবে এর থেকে বেশি কিছু আমি ভাবতেও চাই না। দিয়া মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখের কোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। নিজেকে সে মুহূর্তে অপরাধী মনে হচ্ছে। মতো নে হচ্ছে অন্যকারো সম্পদে আমি অযাচিত হয়ে ঢুকে পড়েছি। অর্নব দিয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। দিদান আর ওহি দুজনেই চুপ করে রইলেন। বুঝতে পারলাম এমন অবস্থার জন্য তারা কেউই প্রস্তুত ছিলেন না।

দিদান আমাকে বিছানায় তার পাশে বসিয়ে বললেন, “তুমি ভেবো না সব ঠিক হয়ে যাবে। আসলে দিয়া অর্নবের খালাতো বোন। অর্নবের মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল তাদের বিয়ে হোক। সে অনুসারে বিয়েটা ঠিকও হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের কথা কে বলতে পারে বলো? তুমি যার ভাগ্যে ছিলে অন্যকেউ সে জায়গায় কী করে আসবে।”

আমি দিদানকে বললাম, “ডাক্তার অর্নব চাইলে উনাকে বিয়ে করতে পারে৷ আমার কোনো সমস্যা নেই।”

দিদান আর ওহি দুজনেই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন। দিদান রাগী স্বরে বললেন, “পাগল হয়ে গেছো? কী বলছো! ভাগ্যের জোরে যা পেয়েছো, তা নিজের দোষে পায়ে ঠেলে দিও না। যা নিজের তা শক্ত করে ধরে রাখো। অন্যকেউ সেটা যেন কেড়ে নিতে না পারে।”

আমি বললাম, “যা আমার, যা নিজের তা কীভাবে কেউ কেড়ে নিতে পারে না দিদান?”

আমার কথা শুনে চমক লাগা চোখে তাকালেন তিনি। বললেন, “বিয়ে এমন একটা বন্ধন যা স্বয়ং আল্লাহর রহমত। সেখানে অন্য কোনো কিছুই কাজে আসে না। আমার দাদু ভাই হিরা তাকে জয় করে রেখো। হারাতে দিও না।”

দিদান চলে যাওয়ার পর চুপ করে অনেকক্ষণ বসে রইলাম। উনার প্রতিটি কথা আমার কানে বাজতে লাগল। কিন্তু আমি কী করে অন্য কারো ভালোবাসায় ভাগ বসাতে পারি! ডাক্তার অর্নবকে পাওয়ার অধিকার শুধু দিয়ারই। আমি তো উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো। আমাকে কেন উনি এভাবে সম্পর্কের বেড়াজালে বাঁধতে চাইছেন! আমি তো এভাবে কোথাও থাকতে চাই না। নানা চিন্তায় অসহ্য লাগছে সবকিছু। বারবার এটাই মনে হচ্ছে কেন সেদিন রাতে লোকটাকে ডাকতে গেলাম। কেন সেদিন তাকে জোর করে আমাদের বাড়ি থেকে চলে যেতে বললাম না। তাতে অন্তত আজকের দিনটা দেখতে হত না। আমার ছোট্ট জীবনটা শুরু থেকেই সোজা ছিল না। আজও নেই৷ শুধু মনে হয় সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার জন্যই আমার জন্ম হয়েছে। চারদিকের চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার।

★★★

ওহি আমাকে তার ঘরে নিয়ে আসল। দিদানের সাথে একটা মেয়ে খাবার নিয়ে আসে। সে আমার সামনে খাবার রেখে বলল, “নতুন ভাবী আমি মর্জিনা এ বাসার সব কাজ করি। আপনের যা দরকার হইব আমারে বলবেন। এই বান্দা সব হাজির কইরা দিমু।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।” আমি বললাম।

দিদান আমার পাশে বসে বললেন, “খাবারগুলো খেয়ে নাও। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। একটু রেস্ট করো।”

সত্যি আমার খুব শরীর খারাপ করছিল খেয়ে ওহির বিছানায় হেলান দিয়ে বসতেই কখন ঘুম এসে গেল বুঝতেই পারলাম না। দিদানের ডাকে যখন ঘুম ভাঙল
তখন রাত এগারোটা। ওহি আমাকে সুতি শাড়ি পাল্টে নীল রঙের বেনারসি পরিয়ে সাজাতে লাগল। তাদের ভাষ্যমতে আজ আমাদের বাসর। কথাটা শুনেই গলা শুকিয়ে আসল। যে বিয়েই মানি না। তার আবার বাসর! এটা তো কিছুতেই সম্ভব নয়। ওহিকে বললাম তার ভাইকে ডেকে দিতে তার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। ওহি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঠাট্টার সুরে বলল, “একটু সবুর করো ভাবী। একটুপর তো সারারাতের জন্য তাকে পাবে। তখন না হয় তোমার জরুরি কথা বলে নিবে।”

মেয়েটার কথা শুনে মেজাজ খারাপ আসছে আমার। জানি না কেন খুব কান্না পাচ্ছে। অসহায় লাগছে নিজেকে। এভাবে কেন ফেঁসে যাচ্ছি আমি। আমার জীবনে অনেক কিছু করা বাকি বিয়ে করে বসে থাকলে হবে না। আমি কোনো বন্ধনে আটকে যেতে চাই না।

★★★
ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। বড়লোক হলে যা হয়। অল্প সময়েও কত আয়োজন করতে পারে তারা। আসলে টাকা কথা বলে। আমাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে সবাই চলে গেল। এত এত ফুলের মাঝে বসে থাকতে বিরক্ত লাগছিল আমার। বিছানা থেকে নিচে আসতেই দেখলাম ডাক্তার রুমে ঢুকল। আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তখনই আমার হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে গেল। সেটা তুলতে গেলেই তিনি বললেন, “বাহ! খুব তো বলছিলে বিয়ে মানো না। এখন দেখছি সালাম করতে বসে যাচ্ছো। আচ্ছা সালাম করতে হবে না। আমি দোয়া করে দিচ্ছি স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকো।”

“এই যে আমি ফোন উঠাতে নিচু হয়েছি। আপনাকে সালাম করতে নয়। নিজের ভুল ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসুন। আপনাকে সালাম করতে আমার বয়েই গেছে। অসহ্যকর একটা লোক।”

“আচ্ছা তুমি কী ধীরে সুস্থে কথা বলতে পারো না?”

“না পারি না। আপনার মতো চরিত্রহীনের সাথে তো আরও নয়। বাগদত্তা থাকতে আবার বিয়ে করেছেন। ছিঃ একটুও লজ্জা নেই আপনার।”

“ঠিকভাবে কথা বলো নিরা। তুমি জানো এ বিয়ে আমি নিজের ইচ্ছাতে করিনি। তোমার গ্রামের মানুষ জোর করে দিয়েছেন।”

“তো আপনি কী বলতে পারতেন না আপনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?”

“তোমার কী মনে হয় যারা তোমার বাবার অসুস্থতা না দেখে তোমার আমার এক ঘরে থাকাকে খারাপ ভাবে দেখেছে। তারা আমি যদি দশটা বিয়েও করি আমাকে ছেড়ে দিত?”

তার কথায় সত্যি যুক্তি আছে ভেবে চুপ করে রইলাম।

সে বলল, “তুমি মনে করো তোমার বিয়ে হয়নি। তুমি আগে যেভাবে থাকতে সেভাবে থাকো। পড়াশোনা করো। শুধু বাইরে কাউকে এসব বুঝতে দিও না।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী বলছেন এসব আপনি? বাবা সুস্থ হয়ে গেলেই আমি এখান থেকে চলে যাব। আর ছাড়াছাড়ির আইনি সব কাগজপত্র পাঠিয়ে দেব।”

সে রেগে আমার দিকে তেড়ে এসে বলল, “বিয়ের দু’দিনে তুমি বোধহয় দু’শবার ডিভোর্সের কথা বলেছো। এখন একটু চুপ থাকবে? বিয়ে কোনো পুতুল খেলা না। বিয়ের সাথে সাথে ডিভোর্স হয় না। অন্তত ছয়মাস পর ডিভোর্স দিতে হয়। এ ছয়মাস তুমি, আমি না চাইলেও একসাথে থাকতে হবে। বুঝেছো তুমি? আমার তো এটা ভেবেই বিরক্ত লাগছে যে ছয়টা মাস তোমাকে সহ্য করতে হবে।”

তার কথা শুনে আমি বিছানায় বসে গেলাম। কী ছয়মাস একসাথে থাকতে হবে! ছয়দিনেই তো মানুষের জীবন বদলে যায়। সেখানে ছয়মাস তো অনেক সময়। খুব কান্না পাচ্ছে আমার তাই চুপচাপ বারান্দায় চলে গেলাম। ওহি তখন বারান্দাটা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। একটা বেতের সোফা রয়েছে। গ্রীলের সাথে নানারঙের লাইট লাগানো। সুইচটা কোনদিকে জানি না। তাই জ্বালাতে পারলাম না। তাছাড়া এ মুহূর্তে অন্ধকারে থাকতেই বেশি ভালো লাগছে। গ্রীলে হাত দিয়ে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়ালাম। নিস্তব্ধ রাত চারদিকে মানুষের কোলাহল নেই। শুধু কয়েকটি কুকুর এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। ঘেউঘেউ শব্দে জানান দিচ্ছে তাদের উপস্থিতি। মাকে খুব মনে পড়ছে। মা থাকলে কী আমার জীবনটা এমনই হত?
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। সেখানে কী আমার মা আছে! আমাকে সে কী দেখছে? হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছতেই। বারান্দার আলো গুলো জ্বলে উঠল। পেছনে ফিরতেই দেখলাম ডাক্তার অর্নব দাঁড়িয়ে আছে। চুপচাপ সামনে ফিরে রইলাম।
বুঝতে পারলাম তিনি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। অনেকটা সময় নীরবে কেটে গেলে সে বলল, “ঘুমিয়ে পড়। গত দু’রাত ঘুমাতে পারোনি। শরীর খারাপ হয়ে যাবে।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “হলেই বা আপনার কী?”
সে বলল, “তোমার বাবাকে দেখে রাখার জন্য তোমাকে সুস্থ থাকতে হবে। তাই বললাম।”

আমি আর কিছুই বললাম না। কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না আমার। আমার যখন খুব কষ্ট হয় একেবারে নীরবে বসে থাকতে ভালো লাগে। মনে হয় সেই নীরবতায় নিজের সাথে অনেক কথা বলতে পারি। অনেক বোঝাপড়া করতে পারি।

আবার কিচ্ছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলল, “দিয়াকেই আমি বিয়ে করব তুমি চিন্তা করো না। এ সম্পর্কটা কখনো পূর্নতা পাবে না। তুমি তোমার পড়াশোনায় ফোকাস করো। দিয়ার সাথে আমার কথা হয়ে গেছে ছয়মাস পর আমরা বিয়ে করছি। সে পর্যন্ত তোমাকে এখানে থাকতে হবে। তোমাকে এখানেই একটা কলেজে বদলি হয়ে আসতে হবে। এখানে থেকেই পড়বে তুমি।”

আমি তখনো চুপ করে রইলাম। সে হয়তো আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর আশা করেছিল। কিন্তু আমি কিছুই বললাম না।

সে আবার কেউ অদ্ভুত ভাবে আমায় ডাকল, “নিরা?”

আমি চমকে উঠি! কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল তার গলাটা। সে আবার বলল, “জীবনে অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হয়। আমি চাই না তুমি ভেঙে পড়ো। আমার দিক থেকে একজন মেয়ে হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মান তুমি পাবে। বদ্ধ ঘরে তোমার কোনো অসম্মান কখনো হবে না।”

তখনও আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল। আমি শুধু বললাম, “বাইরে আমরা যতটা স্বামী-স্ত্রী থাকব। এ ঘরটায় ততটাই অপরিচিত হয়ে থাকব। এ মুহূর্তে আমার অন্য কোনো পথ নেই। তাই আপনাকে বিশ্বাস করলাম। আশাকরি সে বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবেন।”

আমি বুঝতে পারলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার দৃষ্টি তখন সামনের দিকে। আরও কিছুক্ষণ নীরবে কাটার পর সে বলল, “তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারো।”

আমি চুপচাপ এসে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়লাম। বারান্দা থেকে নিকোটিনের গন্ধ আসছিল। ভাবলাম ডাক্তার হয়ে নিকোটিনের ধোঁয়ায় কী করে কেউ নিজের হৃদপিণ্ডকে অসুস্থ করতে পারে! সে রাতে আমার ঘুম হলো না। শুধু এপাশ-ওপাশ করে গেছি। ভোর রাতে কখন ঘুম এসেছে জানি না। তখনও সে ঘুমাতে আসেনি।

★★★

নির্ঘুম রাত কাটছে দিয়ার কারো সাথে কথা বলে নিজেকে হালকা করতে ইচ্ছে করছে। ঠিক তখনই তার আর অর্নবের কমন ফ্রেন্ড মায়ান কল দিল৷

রিসিভ করতেই মায়ান উদ্ধিগ্ন গলায় বলল, “দোস্ত একটা কথা অনেকদিন ধরে তোকে বলব ভাবছি। কিন্তু বলতে পারিনি। আজ তোকে বলতেই কল দিয়েছি। তুই ছাড়া আর কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবে না।”

দিয়া অবাক হয়ে বলল, “আমারও তোকে অনেক কিছু বলার আছে। আচ্ছা আগে তোরটা শুনি?”

মায়ান বলল, “তুই তো জানিস গতবছর অর্নবের সাথে আমি তার দাদুর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখন ওই গ্রামে একটা মহামারি দেখা দিয়েছিল। তাই অর্নব একা সামলাতে পারবে না বলে আমিও গেলাম৷ তখন একটা মেয়েকে দেখে তাকে আমার খুব ভালো লেগে যায়। বলতে পারিস ‘লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইড’ সেখান থেকে আসার পর শুধু তাকেই ভেবে গেছি। ভেবেছি তাকে বলে দেব আমার মনের কথা। কেন যেন সাহস হলো না।”

দিয়া অবাক হয়ে শুনছে আর ভাবছে তার সব ডাক্তার বন্ধু গ্রামে গিয়েই কেন প্রেমে পড়ে! মায়ান একটু থেমে আবার বলল, “দোস্ত তুই প্লিজ অর্নবকে একটু বল। আমি চাইলে ওকে বলতে পারি। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। নয়তো মেয়েটার নম্বরটা সংগ্রহ করে দিতে বল?”

দিয়া ভ্রুকুচকে জিজ্ঞেস বলল, “এক মিনিট মায়ান। মেয়েটার নাম কী বল তো?”

“নিরা।”

দিয়ার হাত থেকে ফোনটা আলগা হয়ে নিচে পড়ে গেল।

চলবে

প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা
চলবে

প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here