সন্ধ্যা নামার পরে পর্ব ২৫+২৬

#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#পঁচিশ

রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। ভোর রাতের দিকে পৃথিবীতে অপার্থিব আলো, আর মিষ্টি বাতাস পৃথিবীকে কেমন শান্ত মনে হয়। কোলাহলপূর্ণ পৃথিবীটাকে মুহূর্তের জন্য মনে হয় এক টুকরো সুখের স্বর্গ। আমি রাত জাগছি বলে ফ্লাস্কে চা করে এনেছিলাম। অর্নবসহ বারান্দায় সোফায় পাশাপাশি বসলাম। নিজের জন্য এক কাপ আর অর্নবকে এক কাপ চা দিলাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আমি বললাম, “আপনার গল্পটা বলুন না?”

অর্নব আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলেছিল, “জানো নিরা আমি ছোট থেকে খুব আত্মকেন্দ্রিক। নিজের মতো করে থাকতেই পছন্দ করতাম। যেখানে আমার বাকি কাজিনরা সারাক্ষণ প্রেম নিয়ে ফ্যান্টাসিতে থাকত, সেখানে আমি ছিলাম নিজের মতো করে। অন্যদের সাথে মেশা আমার খুব একটা ভালো লাগত না। তাই সবাই আমায় বোর বলত। স্কুল থেকে কলেজে যখন আসি তখন বন্ধুদের অহরহ প্রেমের গল্প শুনেছি, নিজের চোখেও দেখেছি কীভাবে ধীরে ধীরে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এসবকিছুর বাইরে আমি ছিলাম আলাদা হয়ে। যেন একসাথে থেকেও একটা অদৃশ্য দেয়াল আমাকে তাদের থেকে দূরে করে দিয়েছে। সবসময় বইয়ে মুখ গুঁজে সময় চলে যেত।

কলেজে যখন প্রথম দিয়া আমায় জানায় সে আমাকে বন্ধু বা কাজিন থেকে একটু বেশি চোখে দেখে তখন আমি তাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেই যে, আমার জীবনে প্রেম বলে কিছু নেই। সে আমার জন্য যা ফিল করে, আমি তা করি না। তাই আমাদের জন্য ভালো হবে পড়াশোনায় মন দেয়া। সেটাই করি। তারপর যখন মেডিক্যালে পড়তে যাই তখন দেখি কিছু কিছু ছেলে শুধু প্রেম নয় নারীসঙ্গের অসৎ ব্যবহার করছে। আমাকে সাগ্রহে তাদের দলে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। সেখানেও আমি সফল হলাম না। তাদের মতো না হওয়ায় আমার কপালে জুটলো বিদ্রুপ, ঠাট্টা। তাই বলে আমি কখনো নিজের লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাইনি। কখনো খারাপ কোনো খাতে নিজেকে বাজে খরচ করিনি। সবসময় আমার মনে হত ভালোবাসা অত ঘটা করে হওয়ার কিছু নয়। যা হবার তা হবেই। এর কিছুদিন পর যখন মা জানালেন আমার আর দিয়ার বিয়ে ঠিক করতে চান। আমি মায়ের কাছে সময় চেয়েছি। মা জানতে চেয়েছিলেন কেউ আমার আছে কিনা। তখন আমার কেউ ছিল না। তাই ঠিকঠাক অজুহাত দেখাতে ব্যার্থ হওয়ায় মায়ের কথা মেনে নিতে হলো।

এর কিছুদিন পর দিদান আমাকে তোমাদের গ্রামে পাঠান। তখন আমি ছাত্র ছিলাম। পড়াশোনা চলছে মাত্র। দিদানের বাবার বাড়ি বলেই যেতে হয়েছিল। সেখানে দু’দিন থাকার পর যখন আমার মন টিকছিল না, তখন ঠিক করি চট্রগ্রাম ফিরে যাব।

সেদিন ঠিক সন্ধ্যা নামার পরের মুহূর্তে আমি পথ দিয়ে হেঁটে আসার সময় একটা শিউলি ফুলের গাছের নিচে একটা মেয়েকে ফুল কুড়াতে দেখি। সবুজ সেলোয়ার-কামিজ পরনে। পিঠের উপর আঁকাবাঁকা বেনুনি পড়ে আছে। তার ওড়নার কোচায় সে ফুলগুলো কুড়িয়ে নিয়েছে। ফুলগুলো নিয়ে পেছনে ফিরতেই তার চোখে আমার চোখ পড়ল। মুহূর্তে মনে হলো এত সুন্দর চোখ বোধহয় আমি আর দেখিনি। তার ভয়ে ভয়ে তাকানোটাও যেন কোনো শিল্পীর নিখুঁত করে আঁকা কোনো চিত্র! যার দিকে এক পলক তাকাতেই নিজের করে পেতে ইচ্ছে করে। সেই প্রথম আমারও মনে হয়েছিল কারো প্রেমে পড়ার ক্ষমতা আমার রয়েছে। এবং আজ বুঝতে পারি কাউকে গভীরভাবে ভালোবাসার আশ্চর্য রকম ধৈর্য নিয়ে আমার জন্ম হয়েছে।”

অর্নব কিছুক্ষণ থামল। আমি অবাক হয়ে তার কথাগুলো শুনছিলাম। আমি জানতাম আমি লেখক। কিন্তু আমার তখন মনে হয়েছিল অর্নব চাইলে আমার মতো হাজারটা ‘ইপ্সিতা রহমানকে’ হারিয়ে দিতে পারে নিজের লেখনীর জাদুময় প্রভাবে।

সে আবার বলল, “সেদিনের সন্ধ্যার সময়টুকু আজও আমার চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠেছে। মেয়েটা আমাকে দেখে কোচা থেকে ফুলগুলো ফেলে দিল। হতে পারে সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আমি একটু একটু করে তার সামনে এগিয়ে গেলাম। ততক্ষণে সে আবার বসে ফুলগুলো কুড়াতে লাগল। আমার কী হলো জানি না। আমিও তখনই বসে তার সাথে ফুলগুলো কুড়িয়ে দিতে লাগলাম। মেয়েটা অবাক হয়ে সিটকে দূরে সরে দৌঁড়ে চলে গেল। আমি মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে তার পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে চোখের আড়াল হয়ে যাওয়ার পরও মনে হলো এই পথটায় তার পায়ের চিহ্ন রেখে গেছে। বাতাসে তার মিষ্টি ঘ্রাণ আমাকে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলছে। হঠাৎ করে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যিটা বুঝতে পারলাম। বুঝতে পারলাম আমার একাকিত্ব জীবনে অন্ধকার আকাশ থেকে একটা শুকতারা টুক করে খসে পড়েছে। সেই শুকতারা সারাজীবন আমায় আলোকিত করে যাবে।

তারপর আমি আর দু’দিন নয়, দুই সপ্তাহ সেখানে থেকে গেলাম। তার সম্পর্কে সব জানলাম। তখন সে স্কুলে পড়ত। যতদিন গ্রামে ছিলাম তাকে আড়াল থেকে স্কুলে যাওয়ার পথে লুকিয়ে দেখতাম। এরপর প্রায় ছুটিতে গ্রামে চলে যেতাম। তাকে সামনে থেকে কিছু বলার সাহস হতো না। এভাবেই চলতে লাগল। আমি ডাক্তারি পাশ করে ইন্টার্নশিপ শুরু করলাম। তারপর সে গ্রামে একজন চিকিৎসক হিসেবে যেতাম। এমনই একদিন রাতে মেয়েটা আমাকে ডাকতে আসে, আমাকে জানায় তার বাবা অসুস্থ। প্রথমে তাকে দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। এতরাতে কেন সে এসেছে ভাবতেই পারছিলাম না। পরে যখন জানলাম তার বাবা অসুস্থ তখন তার সাথে চলে গেলাম।

আমার অপেক্ষার অবসান বোধহয় সেদিন শেষ হওয়ার কথা ছিল। তাই আমাকে মেয়েটার বাবাকে দেখার জন্য রাতে থাকতে হলো তাদের বাড়িতে। ভোর হতেই এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেল। যার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। গ্রামের সবাই খারাপ কিছু ভেবে আমাদের বিয়ে পড়িয়ে দিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না খুশি হব! নাকি কষ্ট পাব! সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেল যে আমার কিছুই করার ছিল না। তাই তো মেয়েটার গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে তার থেকে বেশি কষ্ট আমি নিজেই পেয়েছি।

আমি জানতাম না সৃষ্টিকর্তা আমার কপালে তাকে লিখে রেখেছে। আমার এত বছরের অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। অথচ বিয়ের পর বুঝতে পারলাম আমি যাকে এতটা চাই, সে আমাকে চায় না। বরং কথায় কথায় দূরে চলে যাওয়ার কথা বলে। তার সেসব কথাগুলো আমাকে কতটা রক্তাক্ত করত সে শুধু আমি জানি। সে আমার কাছে থাকে, পাশে ঘুমায় অথচ প্রতি মুহূর্তে তাকে হারানোর ভয় আমাকে ঘুমাতে দেয় না। জানো নিরা এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা বোধহয় কাউকে হারানোর ভয়ের মধ্যে থাকে। হারিয়ে গেলে তো আশা থাকে না। কিন্তু হারিয়ে ফেলার ভয়টা খুব মারাত্মক। মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। ধীরে ধীরে যখন দেখলাম সে আমার কাছাকাছি আসছে তখন ঘটল আরেক বিপত্তি। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু আমাকে জানাল সে আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকে ভালোবাসে। আমাদের সম্পর্ক তো এমনিতেও ভালো না। তবে কেন শুধু শুধু আমি তাকে আটকে রাখব।”

অর্নবের কথাটা শুনে আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়েছিলাম কিয়া। তার প্রতিটি কথায় আমার শ্বাস আটকে আসছিল। ততক্ষণে আমি বুঝে গিয়েছিলাম অর্নবের গল্পের মেয়েটা আমি। একইসাথে তাকে এতদিন দেয়া কষ্টগুলো যেমন আমায় কষ্ট দিচ্ছিল, তেমনি আবার আমাকে এত গভীরভাবে ভালোবাসায় তীব্র সুখের আলোড়ন সৃষ্টি করছিল।

অর্নব আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, “হ্যাঁ নিরা মায়ান তোমাকে ভালোবাসে। যেবার আমার সাথে গ্রামে গিয়েছিল তখন থেকে। আমি এর কিছুই জানতাম না। এইতো কিছুদিন আগে সে নিজ থেকে সবটা বলল। তার কথা শুনে রাগ হয়েছিল আমার। যে ভয়টা নিয়ে আমি প্রতি মুহূর্ত কাটাচ্ছিলাম। তখন সে ভয়টা আরও বেশি জেঁকে বসেছিল। এবার মনে হয়েছিল তুমি চলে গেলে আমি মরেই যাব।”

অর্নব থামল। আমি তার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলাম। সে পানিটুকু শেষ করছে।

তার বলা প্রতিটি কথা আমার হৃদপিণ্ডের গতি বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আমার সামনে একে একে সব দৃশ্য ভেসে ওঠেছিল। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই শিউলিতলা। যেখানে আমি আমার জীবনের সুখ খুঁজে বেড়াতাম। যেখানে রোজ একবার না গেলে আমার ঘুম হত না। মনে পড়ে যাচ্ছে আমার বান্ধবী শিলা বলেছিল তাকে কেউ ফলো করে। আড়াল থেকে দেখে। এসব সে কখনো বিশ্বাস করেনি।

অর্নব পানি খেয়ে আবার বলল, “আমি মায়ানকে বুঝিয়েছি। জানিয়েছি আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু তার এক কথা যদি তুমি আমায় ভালো না বাসো তবে সে চায় আমি তোমার জীবন থেকে সরে আসি। আমিও তাকে বলেছি নিরা আমাকে না চাইলে এমনিতেও তার জীবনে আমি থাকব না। তাই আমি তোমায় আবার জিজ্ঞেস করছি তুমি কী আমাকে চাও নিরা?”

আমি হেসেছিলাম তার কথায়। শুধু বলেছিলাম, “আপনাকে না চাইলে স্বয়ং আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন না ডক্টর।”

ভোরের আলো ততক্ষণে পৃথিবীকে আলোকিত করে ফেলেছে। শান্ত পৃথিবী আবার অশান্ত হয়ে ওঠেছে। অর্নব আমার হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে রাখল। আমি তার কাঁধে মাথা রেখে অপার্থিব সুখের সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে আরাধ্য মানুষটা আমাকে এতটা ভালোবাসে ভাবতেই সুখে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ভাবলাম আমার সুখের এই তো শুরু, কিন্তু?

তাকে বললাম, “চলো ফজরের নামাজ পড়ে আসি?”
দুজনে নামাজ শেষ করলাম। আমি নিচে কফি বানাতে গেলাম। কফি নিয়ে উপরে উঠে আসছিলাম হঠাৎ দিদানের গলা কানে এলো। এত সকালে তিনি কার সাথে কথা বলছেন! ভাবলাম দেখি চা, কফি কিছু খাবে কিনা জিজ্ঞেস করে আসি। যখনই তার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। তখন দুজন মানুষের গলা পেলাম।

অন্যজন বলছেন, “তুমি মেয়েটার থেকে দলিলে সাইন করিয়ে নাও। আর কতদিন অপেক্ষা করব এই সম্পত্তির জন্য?”

“তোর জন্য আমি অনেক কিছু চাপা দিয়েছি। এই শেষ বয়সে এসে নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে শান্তি পাচ্ছি না। আমি নিরাকে সব জানাতে চাই। লোভ মানুষকে কতটা অন্ধ করে ফেলে তোকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। তুই আমার একমাত্র ছেলে বলেই সব চেপে গেছি। এখন আর না। আমার বিশ্বাস নিরা সব শুনে আমাদের ক্ষমা করে দেবে।”

কিয়া আমি ভেবেছিলাম সেদিন আমার জীবনের সুখের মুহূর্ত শুরু হয়েছে। কিন্তু দিদান আর বাবার কথা শুনে মনে হলো আমার সুখের অসুখ তো সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে। এরপর দিদান যা বললেন তাতে আমি নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। আমার পুরো শরীর কাঁপছিল। মস্তিষ্ক তখন শূন্য। মনে হচ্ছিল আমি শূন্যে ভাসছি। এতবড় ধোকা!
#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#ছাব্বিশ

জীবনের খেলায় আমাদের সবসময় পুতুল হয়েই থাকতে হয়। অনেক সময় সব জেনেও আমাদের হাতে কিছুই করার থাকে না। কারণ, আমাদের নিয়তিতে যা লেখা আছে তা তো হবেই। তাই আমিও সব মেনে নিয়েছি কিয়া। মেনে নিয়েছি আমার ভবিতব্য। মেনে নিয়েছি এক জীবনে ডক্টর অর্নবের সাথে সংসার করা আমার হবে না।

সেদিন বাবাকে দিদান বলেছিলেন, “তোর অপরাধ কখনো ক্ষমার যোগ্য না। তোর বন্ধুর মৃত্যুর জন্য তুই দায়ী। আর তার একমাত্র মেয়ে এতিম হওয়ার জন্য তুই দায়ী। তুই কীভাবে ভুলে যাচ্ছিস তোর জন্য নিরা নিজের আসল বাবা – মায়ের পরিচয় পর্যন্ত জানে না।”

বাবা প্রতিবাদ করে উঠলেন, “মা এখন কেন এসব বলছো? এসব বলে কী কোনো লাভ হবে?”

দিদানের গলা চড়ল। বললেন, “একটা জীবন পার করে দিয়েও তুই লাভ – ক্ষতি হিসাব করছিস? হ্যাঁ রে তোর একটুও মৃত্যুর ভয় নেই? আমি নিরাকে বলে দেব সে যাকে তার বাবা বলে এতকাল জেনে এসেছে, আসলে সে তার বাবাই না। তার সাথে নিরার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। সে শুধু মাত্র নিরার বাবার গাড়ির ড্রাইভার ছিল। তুই তাকে বাধ্য করেছিস নিরার থেকে সব সত্যি গোপন করতে।”

“মা তুমি এটা করতে পারো না। তুমি একবার ভেবে দেখো তখন যদি এটা না করতাম তাহলে মেয়েটার কী হতো? তাছাড়া নিরা এখন আমাদের পরিবারের বউ। ওর যা সব আমাদের। আবার আমাদের যা সবকিছু ওঁরই তো। আমার কথামতো সেদিন শফিক ড্রাইভার যদি নিরা আর অর্নবের বিয়ে ঠিক না করত তবে কী মেয়েটা এ বাড়ির বউ হতে পারত?”

“বিয়েটা সাধারণ ভাবেও দেয়া যেত। কিন্তু তুই খুব জঘন্য একটা পন্থা বের করে তাদের বিয়ে দিয়েছিস।”

“মা আমরা যদি সাধারণভাবে এ বিয়েটা দিতে চাইতাম তবে নিরার মনে সন্দেহ আসত। আমাদের মতো বড় পরিবারে নিরা কখনো আসতে চাইতো না। তুমি জানো মেয়েটার ইগো কতটা বেশি।” বাবা তখন দিদানকে বুঝিয়ে যাচ্ছিলেন। আর আমার পায়ের নিচ থেকে একটু একটু করে মাটি সরে যাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার জীবনটাই আগাগোড়া মিথ্যা দিয়ে মোড়ানো।

তারপর দিদান বললেন, “ঠিক আছে সব মানলাম। কিন্তু সেদিন নিরার পরিবারসহ তোরা পিকনিকে গিয়ে কীভাবে জাফর আর শিরিনকে মেরে ফেললি? তাদের গাড়ির ব্রেক ফেল কে করে দিয়েছিল? তুই করে দিয়েছিস। ভাগ্যিস নিরাকে নিয়ে তখন শফিক ড্রাইভার চিপস কিনতে গিয়েছিল। নয়তো তারাও মারা যেত। তুই মিথ্যে অসুস্থতার বাহানা দিয়ে তোর গাড়ির ড্রাইভারকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলি। জাফরকে অনুরোধ করেছিলি যাতে সে নিজে তার গাড়ি চালায় যেহেতু সে ড্রাইভিং পারে। এবং সে তাই করে শফিককে তোর গাড়ি চালানোর জন্য পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন নিরাকে শফিক চিপস কিনে দিতে দোকানে নিয়ে যায়। জাফর তোকে বলে শফিকের সাথে আর অর্নবের সাথে নিরা থাকবে সমস্যা নেই। তারা গাড়ি নিয়ে তোদের আগে বেরিয়ে যায় আর এক্সিডেন্ট করে স্পটেই মারা যায়। ভাগ্যের ফেরে বেঁচে যায় নিরা।”

দিদান কথা বলতে বলতে হাঁপাচ্ছিলেন। বাবা বারবার তাকে বারন করছেন কথা না বলতে তাও তিনি থামছেন না। আজ তিনি বেশ উত্তেজিত। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। হঠাৎ বজ্রপাতে যেমন শব্দ হয় আমার বুকের ভেতর তেমন করে ওঠল। মাথার ভেতরটা অনেকগুলো পোকা ভনভন করছে।

একটু থেমে দম নিয়ে তিনি আবার বললেন, “জাফর, শিরিন মারা গেলে তুই নিরাকে শফিকের কাছে দিয়ে গ্রামে পাঠিয়ে দিস। প্রতিমাসে একটা বড় অংকের টাকা দিয়ে তাদের সাহায্য করতে চাস। কিন্তু যে ক্ষমতা তোর নেই। সেটা সামান্য ড্রাইভার শফিকের ছিল। সে তোর একটা পয়সাও কখনো নেয়নি। নিজের খেটে মেয়েকে মানুষ করেছে। পরে নিতান্ত বাধ্য হয়ে অর্নবের সাথে নিরার বিয়ে দিয়েছে। কারণ তুই তাকে হুমকি দিয়েছিলি এই বিয়ে না হলে তুই নিরাকে সেভাবেই মারবি, যেভাবে তার বাব-মাকে মেরেছিলি। তাই শফিক সবসময় ভয়ে থাকত তুই না, নিরার কোনো ক্ষতি করিস। প্রায় আমায় কল দিয়ে বলত যাতে আমি তোকে বুঝাই। নিরার খেয়াল রাখি। নিরা মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখ তোকে ভালো মানুষ ভেবে কতটা সম্মান করে। সে কী করে জানবে তুই তার বাবার বন্ধু ছিলি। জাফরের সাথে তোর শেয়ারে ব্যবসা ছিল। সেই ব্যবসার পুরোটা তোর নিজের করে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার জন্য তুই তাদের খুন করেছিস। তুই একটা খুনি। আমার পেটে একটা খুনির জন্ম হয়েছে। হায়! আল্লাহ আমি কীভাবে সব জেনে চুপ করে রইলাম। কীভাবে!”

দিদান তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। মনে হয় শেষ বয়সে এসে মৃত্যুর ভয়ের সাথে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার ভয়ে এতদিন পর উনার সুমতি হয়েছে। দরজার সামনের পর্দাটা ফ্যানের বাতাসের উড়ছিল। তার আড়ালে দেখা যাচ্ছে দিদান মদ্যপায়ীর মতোন টলছেন। উত্তেজনায়, রাগে তার শরীর কাঁপছে। বাবা তাকে ধরে খাটে বসিয়েছেন। সাইড টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস এনে দিয়েছেন। তিনি কিছুতেই পানি খেতে চাইছেন না। আমি তখন পাথরের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে আছি। কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল। মনে হচ্ছিল কেউ গরম শিসা আমার কর্ণকুহরে ঢেলে দিয়েছে।

শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল যে সুখের সন্ধান আজ আমি পেয়েছি সে তো সুখ নয়, মরিচীকা মাত্র। যে স্বপ্ন আর ভালোবাসা দিয়ে আমি সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখেছি, সে ভালোবাসার সংসার নয়, বরং চোরাবালির সংসার মাত্র। যা যেকোনো মুহূর্তে সমুদ্রের হালকা জোয়ারে সমস্ত অস্তিত্ব বিলীন করে শুধু শূন্যতাই রেখে যাবে। যার খুটি বড্ড নঁড়বঁড়ে। আমার হাত থেকে কফির কাপ পড়ে গেল।

আমি দূর্বল পায়ে পেছনে ফিরতেই দেখি ডক্টর দাঁড়িয়ে আছে আমার থেকে ঠিক এক হাত দূরত্বে। হয়তো আমার দেরি হচ্ছে দেখে খুঁজতে এসেছে। তার চোখে চোখ পড়তেই আমি আশ্চর্যভাবে আবিষ্কার করলাম যে জল আমার চোখ থেকে গড়ানোর কথা ছিল। সে জল তার চোখ থেকে গড়াচ্ছে। জীবনের প্রথম অত্যন্ত গাম্ভীর্যপূর্ণ, স্মার্ট, শক্তপোক্ত, মানুষটার চোখের জল দেখে আমার কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল অনেকগুলো তীরের বাণ আমার বুকের ভেতরটা ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমি পাড়ে উঠা মাছের মতো শুধু ছটফট করছি। তার চোখের জলও বোধহয় সেদিন বুঝে গিয়েছিল। যে মিলনের মালা একটু আগে আমরা একটা একটা করে ফুল দিয়ে গেঁথেছিলাম তা আর এ জীবনে আমাদের গলায় পরা হবে না। তার চোখও সেদিন বুঝে গিয়েছিল একসাথে বসে দেখা সুখের স্বপ্নটাও এইমাত্র কাঁচের মতো ঝনঝনিয়ে ভেঙে গেল। যা এ পৃথিবীর কোনো আঠা জোড়া লাগাতে পারবে না।

তার জল উপচে পড়া সুন্দর আঁখি দুটো তখন আমায় হাজার, লক্ষ, কোটি কথা অনায়াসে বলে গেল। কিন্তু আমার মন শুধু একটা কথাই বলল আপনার সাথে যে আমার আর সংসার করা হবে না ডক্টর। এ জীবনে নিরা, অর্নবের ভালোবাসার পূর্ণতা কখনোই সম্ভব নয়। আমার জীবনের আনাচে-কানাচে এই পরিবারটি যে জায়গা দখল করে নিয়েছে তার এতটুকু দাম যে আর রইল না। আমার সমস্ত জীবনের রঙের খেলা যে আজ ধূসর বিষন্ন হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর রক্তচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

কিয়া আমার দিকে বিস্ময় চোখে তাকিয়ে আছে। তার মুখেও কোনো কথা নেই। আমার জীবনের এমন অপ্রত্যাশিত ইতিহাস কারোই কাম্য নয়। তাই অবাক হবে সে তো জানা কথা। কিয়া অস্পষ্ট স্বরে আমায় বলল, “লিরা তুমি বেঁচে আছো কী করে? ওই পরিবারটাকে ক্ষমাই বা করলে কীভাবে?”

আমি হাসলাম। বললাম, “সৃষ্টিকর্তা কখনো কোনো হিসাব শোধবোধ বাকি রাখেন না কিয়া। মানুষের পাপের পরিমাণ যত বাড়ে তার সাথে চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়ে শাস্তির পরিমাণ। লোভ যখন কোনো মানুষের অন্তরে জায়গা করে নেয়, তখন তার সমস্ত জীবন অন্ধকারে তলিয়ে যায়। যার হদিস পেতে পেতে সেই ব্যাক্তির সময় ও সুযোগ দুটোই থাকে না। কালের ব্যবধানে যখন তুমি পাপিষ্ঠকে ক্ষমা করে দেবে তখন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা তোমার হয়ে তাকে শাস্তি দেবেন। এইতো নিয়ম। এইতো মানুষের মন। বাবাকে আমি সত্যিকার অর্থেই বাবা বলে মেনেছি। কখনো মনে হয়নি তিনি আমার বাবা নন। কিছুদিনের জন্য হলেও তিনি আমায় যে স্নেহ, যে ভালোবাসা দিয়েছেন তা তো অস্বীকার করতে পারি না বলো? হোক না সে ভালোবাসা কোনো স্বার্থের জন্য। আমি যে ছোট বেলা থেকে ভালোবাসার কাঙাল। হয়তো কাঙাল বলেই আমাকে জীবনে ভালোবাসা ক্ষনিকের সুখের মুহূর্ত হয়ে আবার স্মৃতি হয়ে যায়। যেখানে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ভালো- মন্দের বিচার করার জন্য রয়েছেন সেখানে আমি কে!

জানো কিয়া সবচেয়ে বেশি অবাক লেগেছে আমার বাবা মানে পালিত বাবার আচরণে কোনোদিন এ মানুষটি আমাকে বুঝতে পর্যন্ত দিলেন না যে, আমি তার কেউ নই! বরং তার সমস্ত জীবন পার করে দিয়েছেন শুধু আমাকে লালন-পালনের জন্য। তার কী দায় বলো! সে কেন তার মৃত মনিবের মেয়েকে বাঁচানোর জন্য এভাবে অমূল্য একটা জীবন শেষ করে দেবেন। নিজের সংসার, স্ত্রী সুখ, সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিত হবেন? দেখো তো কিয়া। এ পৃথিবী একদিক দিয়ে যেমন আমার অপূরনীয় ক্ষতি করে দিয়েছে, তেমনি এতবেশি ভালোবাসা স্নেহ দিয়েছেন যে, যা আমার ক্ষতির তুলনায় কোনো অংশে কম নয়।

এ পৃথিবীতে যেমন আমার শ্বশুরের মতোন মানুষ রয়েছে, তেমনি আমার বাবার মতো মানুষও রয়েছে, নয়তো পৃথিবীর অস্তিত্ব কবেই বিলীন হয়ে যেত।
নয়তো আমি নিরা পৃথিবীতে কীভাবে থাকতাম।

কিয়া অবাক হয়ে বলল, “তুমি কী জানো লিরা? তুমি একটা অসাধারণ মেয়ে!”

“এইতো এখন জানলাম।”

কিয়া ম্লান গলায় বলল, “তারপর কী হয়েছিল? বলো না?”

“তারপরের কাহিনীটুকু আরও মর্মস্পর্শী। আমার হাত থেকে পড়ে যাওয়া কাপের শব্দে তখন পুরো বাড়ি সজাগ হয়ে উঠেছে। মা, ওহি সবাই যার যার রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। দিদান আর বাবাও।

আমার শরীরে তখন এতটুকু শক্তি নেই। ক্রমেই মনে হচ্ছিল আমি হয় মারা যাচ্ছি নয়তো জ্ঞান হারাচ্ছি। এর মাঝে একটা বিষয় আবছা চোখে দেখলাম আমাকে কারো দুটো বাহুবন্ধনী আটকে ফেলেছে। ঝিমঝিম চোখে একবার তাকিয়ে দেখেছিলাম ডক্টর।
তার নয়নে তখন আমাকে হারানোর ভয়। তার জীবনে আমার আয়ু যে শেষ হয়ে এসেছে। আমাদের একসাথে থাকাটা যে আর হবে না। ততক্ষণে এতটুকু নিশ্চিত আমি ছিলাম। কখনো কখনো সমুদ্রের গভীরে গিয়েও মুক্তোর সন্ধান পাওয়া যায় না। কখনো কখনো অধিক ভালোবাসাও একসাথে বেঁধে রাখতে পারে না। আমাদেরও পারেনি। কারণ অর্নব, নিরার পথচলা যে এতটুকুই।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here