সন্ধ্যা নামার পরে পর্ব ২৭+২৮

#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#সাতাশ

রাত ঘনিয়ে এসেছে। নিরা উঠে গিয়ে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। কফি করতে যাবে এমন সময় কিয়ারা তার হাত ধরে বলল, “তুমি বসো লিরা। আমি কফি করে আনছি।”

নিরা আর অমত করল না। আজ তার মন এমনিতেই বিক্ষিপ্ত, বিছিন্ন হয়ে আছে। অর্নবের কথা খুব মনে পড়ছে। বারবার চোখের সামনে ভাসছে তার অশ্রুভেজা চোখদুটো। আজও সেই দৃশ্য মনে হলে হৃদপিণ্ডের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে আসে। এ মানুষটা তাকে কতটা ভালোবেসেছে সেই শুধু জানে। সেই সন্ধ্যা নামার পরের মুহূর্তগুলো আজও সজীব হয়ে আছে তার হৃদয়ে। জীবনের নানা জটিলতায় কোথাও এতটুকু মরচে পড়েনি। কিয়া কফি এনে নিরার সামনে রাখল।

“আজ অনেক কফি খাওয়া হয়ে যাচ্ছে কিয়া।”

“হোক লিরা, আজ আমি সারারাত কফি খাব আর তোমার গল্প শুনব।” কিয়ার মুখে ম্লান হাসি।

কফিতে চুমুক দিয়ে কিয়া বলল, “তারপর অর্নব কী করেছিল?”

নিরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমার যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমার মাথার কাছে ওহি, দিদান, মা বসে আছেন। আমার মাতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে দিদান। মা একপাশে বসে মুখে আঁচল চেপে কাঁদছেন। আমি অবাক হলাম এ বাড়িতে এসেছি পর্যন্ত মা একমাত্র আমায় প্রথমে মেনে নেননি। অথচ আজ তিনি আমার জন্য কাঁদছেন। কী অদ্ভুত তাই না! মমনুষ্য জনমের এই এক সমস্যা। তুমি ভাববে এক, আর হবে আরেক। জ্ঞান ফেরার পর যখন সেই সত্যিটার কথা মনে হলো তখনই আমার সমস্ত শরীর অসহ্য এক যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। ভেতরটা যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। দরজার সামনে বুকে হাত ভাঁজ করে অর্নব দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ নত। আমি উঠে বসলাম। উঠে খাট থেকে নামলাম। সবাই বাধা দিল আমি শুনলাম না। আলমারি থেকে সেদিন স্টোর রুন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ছবিটা দিদানের সামনে ধরে প্রশ্ন করলাম,

” এরাই কী আমার বাব-মা?”

দিদান অস্ফুট স্বরে বললেন, “হ্যাঁ।”
আমি ছবিটা বুকে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। অথচ আমার ভেতরটা ভেঙে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। নীরবে চোখের পানি ঝরছে।

আমি কিছু না বলে আমার জামা-কাপড় গোছাতে লাগলাম। মা উৎকন্ঠা হয়ে বললেন, “ও কী মা জামা-কাপড় কেন গোছাচ্ছো?”

“আমার যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে মা। এখানে আমার আর কোনো প্রয়োজন নেই। বাবাকে বলবেন সম্পত্তির দলিল গুলো আমাকে দিতে আমি এখনই সাইন করে দিচ্ছি।”

মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। কোনো রকম বললেন, “যেও না মা। যেও না।”

আমি শুধু কাঁদলাম কিছুই বলতে পারলাম না। সেদিন সত্যি সত্যি আমি মায়ের বুকে ছিলাম বলে মনে হয়েছিল। আমার তো কখনো মা ছিল না। সেই প্রথম মায়ের ভালোবাসা বুঝতে পারলাম। অথচ আমার কী ভাগ্যে দেখো কিয়া তখন যে আমার যাওয়ার সময় এসে গেছিল।

দিদান এসে বললেন, “আমাকে ক্ষমা কর বোন। আমার পাপ যে ক্ষমার অযোগ্য।”

দিদানের বাড়িয়ে দেয়া হাত দুটো নিজের মাথায় ঠেকিয়ে বললাম, “আমায় আর পাপের ভাগি করবেন না দিদান। আমি কেউ নই আপনাকে ক্ষমা করার। ক্ষমা তো আল্লাহ করেন। যদি মনে হয় ভুল করেছেন তবে আল্লাহর কাছে চান।”

ওহি এসে বলল, “ভাবি প্লিজ যেও না। আমার ভাইয়া মরে যাবে।”

এ কথাটা আমার বুকে তীরের মতো বিঁধল। মনে হচ্ছিল তীরের মাথায় বিষ ছিল। সে বিষ একটু একটু করে আমার পুরো শরীরে ছড়িয়ে যেতে যেতে বিষক্রিয়া শুরু করে দিল। ওহিকে শুধু জড়িয়ে ধরেছিলাম কোনো জবাবা দিতে পারিনি। কারণ এর জবাব আমার কাছে নেই। একে একে সবাই বের হয়ে গেলেন। ডক্টর তখনও দরজার সামনে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যখন কাপড় সুটকেসে ঢুকাচ্ছিলাম ও এসে আমার হাতটা ধরে ফেলে। তার দিকে তাকাতেই সে করুণ চোখে মাথা নাড়িয়ে যেতে বারন করে। তার নিশ্চুপ চোখদুটো বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি তাকে ঝাপটে ধরলাম। পোষা বেড়ালের মতো তার বুকে অঝোরে কাঁদতে লাগলাম। তার চোখের নোনাজল আমার পিঠ ভাসিয়ে দিচ্ছিল। সে আমাকে এতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিল যে, ভাবছে হয়তো ছেড়ে দিলেই বুঝি হারিয়ে যাবে। সে আমাকে কোনোমতেই হারাতে চাইছে না।

সে জড়ানো গলায় বলল, “আমাকে ছেড়ে যেও না নিরা। আমি সত্যি মরে যাব। আমাকে মেরে দিও না। আমি সবকিছু ছেড়ে তোমাকে নিয়ে অন্যকোথাও চলে যাব। আমি তোমার মাস্টার্সে জন্য লন্ডনে ভিসার জন্য আবেদন করেছিলাম। সেটা কালই হাতে এসেছে। ভেবেছিলাম আজই তোমায় জানাব। কিন্তু তেমনটা তো হলো না। আমিও চলে যাব তোমার সাথে লন্ডনে। আমাদের জীবনের কোনো অতীত আমাদের ভালোবাসাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। শুধু তুমি আমায় ছেড়ে যেও না নিরা।”

আমি শুধু কাঁদছিলাম এর থেকে বেশি কিছুই বলতে পারছিলাম না। বলো তো কিয়া? পরিবারের একমাত্র সন্তানকে আমি পারিবার থেকে আলাদা করে দেই কীভাবে? আমি জানি অর্নব এ পরিবারের প্রাণ। তাকে ছাড়া তারা থাকবে কীভাবে? আমার জীবনের অর্জিত শিক্ষা দ্বারা আমার এতটুকু জ্ঞান নিশ্চয়ই হয়েছিল যে, আমি কাউকে কষ্ট দিয়ে সুখে থাকতে পারব না। এক মায়ের বুকের থেকে ছেলেকে কী করে কেড়ে নেই বলো? ওহি-অর্নবের বন্ডিং আমি নিজে চোখে দেখেছি। কী করেই বা ওহির কাছ থেকে তার ভাইকে কেড়ে নেই! আর দিদানের জীবনই তো অর্নব। শেষ বয়সে আমি তার কাছ থেকে তার জীবনটাই কেড়ে নিতে পারি না। আর বাবা যাই করে থাকেন সন্তান কখনো তো তার বিচার করতে পারে না। একজন মানুষ যতই খারাপ হোক একজন মা অথবা বাবা কখনো তো খারাপ হয় না। তাহলে আমি বাবা থেকে ছেলেকে কীভাবে কেড়ে নেব বলো?

তারচেয়ে এই তো ভালো যে মেয়েটা বছর সাতেক আগে তার জীবনে এসেছে সেই সরে যাক। সাত বছরের ভালোবাসা থেকে সাতাশ বছরের ভালোবাসার দাম তো বেশি হওয়ার কথা তাই না বলো? তাই তো সেই আমি সরে গেলাম।

অর্নবের কথার উত্তরে আমি বলেছিলাম, “প্লিজ চুপ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখবে অনেকটা সময়। প্লিজ অর্নব।”

সেই প্রথম তাকে তুমি করে বলা, সেই প্রথম নাম ধরে ডাকা। আর এটাই ছিল শেষ। আমার কথা শুনে সে আমার অধরে গাঢ় চুম্বন খেল। অনেকটা সময় জড়িয়ে ধরে রাখল আগের থেকে আরও বেশি শক্ত করে। আমি ভাবছিলাম এখন যদি আমি এভাবেই মরে যেতাম তবে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ মনে করতাম। ভালোবাসার মানুষের বুকে মরতে পারাও যে সুখের। তার উষ্ণ স্পর্শে আমি ক্ষণিকের জন্য ভুলে গেলাম সকল যন্ত্রণা। মনে হচ্ছিল এভাবেই সারাজীবন থাকি। যাতে কোনো দুঃখ-কষ্ট আমায় ছুঁতে না পারে। কিন্তু তা তো সম্ভব নয় বলো? জীবন অনেক বড়। তারচেয়ে বড় দুঃখ। আর দুঃখের সাথেই যে মানুষের বাস। তাই চাইলেও সেই দুঃখকে এড়ানো যায় না। এড়ানো যায় না ভাগ্যকে।

★★★
আমি বাবার রুমে গেলাম। তিনি চোখ বন্ধ করে রকিং চেয়ারে শুয়ে আছেন। সাইড টেবিলের উপর থেকে দলিলটা নিয়ে সাইন করে তার সামনে ধরে ডাকলাম।

“বাবা এই নিন আপনার সম্পত্তি?”
তিনি চোখ মেলে তাকালেন আমার দিকে। তার চোখে সেদিন আমি সম্পত্তি পাওয়ার খুশি দেখিনি। দেখেছি সব হারিয়ে ফেলার ভয়। এই যে তিলতিল করে গড়ে তোলা সংসার, সংসারের মানুষগুলো। এরা কী এত বড় ঘটনার পর কখনো আগের মতোন হতে পারবে? ছেলে-মেয়েরা তাকে যে সম্মানের চোখে দেখত। তেমনটা কী কখনো দেখবে? যে স্ত্রী ভালোবাসত সে কী আগের মতো করে ভালোবাসতে পারবে? আমি জানি একজন মানুষের শেষ বয়সে এসে এর চেয়্ব বড় শাস্তি আর হয় না। আমি চাইলেও তাকে এ যন্ত্রণা থেকে রেহাই দিতে পারি না। তিনি কিছুই বললেন না। আমি নীরবে চলে এলাম। হয়তো তার কিছুই বলার নেই। কিংবা অনেক কিছু বলার আছে লজ্জার জন্য বলতে পারছেন না।

★★★

আমি তখন বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কয়েকবার ঘুরে ঘুরে বাড়ির প্রতিটি জিনিস দেখছিলাম। এ বাড়ির প্রতিটি আসবাবপত্রে, প্রতিটি ইট-পাথরে আমার মায়া পড়ে গেছে। প্রতিটি জিনিস আমার ভেবেছিলাম।
এভাবে ছেড়ে যেতে কতটা কষ্ট হচ্ছে সে শুধু আমি জানি। মা, দিদান, ওহি আমায় জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদলেন।

রুম থেকে যখন বের হচ্ছিলাম অর্নব আমাকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে আবারও বলেছিল না যেতে। কিন্তু আমার পক্ষে এখানে কী করে থাকা সম্ভব।

আমার বাবা-মায়ের খুনির সাথে এক বাড়িতে আমি থাকতে পারব না। আবার অর্নবকে এ বাড়ি থেকে আলাদা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি বলো কিয়া যতই ভালোবাসা থাকুক কেউ নিজের বাবা-মায়ের খুনির সাথে একসাথে কী করে থাকতে পারে? আমিও তো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। আমারও কষ্ট হয়। তাছাড়া আমার বাবা-মা আমাকে নিশ্চয়ই দূর থেকে দেখছেন। তারা তো আমায় ক্ষমা করবেন না। আমি এখানে যত সুখেই থাকি প্রতি মুহূর্তে আমার শ্বশুরকে দেখে সেসব স্মৃতি মনে পড়ে যাবে। যা আমায় ভালো থাকতে দেবে না। তাই তো অর্নবকে বললাম, “তুমি যদি আমায় ভালোবাসো তবে আমায় যেতে দাও। আমি তোমার কাছে কখনো কিচ্ছু চাইনি। আজ চাইছি আমি এখানে ভালো থাকব না।”

আমার কথাটা শুনে তার হাতের বাঁধন আলগা হয়ে এলো। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকটা সময় ধরে। দুজনেরই চোখ ভরতি অশ্রু।
এ চারটি চোখ বলছিল আমাদের আর জীবনে সুখে থাকা হবে না। আমাদের সুখের যে অসুখ করেছে।
আমাদের ভালোবাসায় দেয়াল উঠেছে। সে দেয়াল আর এ জনমে ভাঙা সম্ভব নয়।
সন্ধ্যা_নামার_পরে
#আটাশ

আমি বাড়ি ছেড়ে মেসে উঠে আসি। অর্নবকে বলেছিলাম দুই সপ্তাহ এর মধ্যে আমার ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দিতে। তার একটাই কথা সেও আমার সাথে যাবে।

কতবার অনুনয় করেছে আর আমি পাথরের মতো তাকে আঘাত করে গেছি। আমি আসার আগের দিন রাতে আমার মেসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। শুধু একটাবার দরজা খুলতে কত-কত বার অনুরোধ করেছে। আমি দরজার এপাশে থেকে পাগলের মতো কেঁদেছি। নিজেকে বহু কষ্টে দমিয়ে রেখেছি। সকাল হলেই আমাকে আমার চেনা দেশ, চেনা মানুষ, সবচেয়ে বড় কথা নিজের মানুষটাকে ফেলে রেখে যাচ্ছি। সে রাতে আমি যদি তাকে কাছে আসতে দিতাম তবে কিছুতেই আর লন্ডনে আসতে পারতাম না। সুখের লোভ আমাকে আটকে রাখত। তাই তো কঠিন হয়ে নিজেকে সামলেছিলাম। সে রাতে আর ঘুম হলো না। একজন দরজার ওপাশে, একজন এপাশে জেগে জেগে অশ্রু বিসর্জন দিলাম।

সকালে উঠে নিজের সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে রাস্তায় নেমে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতেই একটা গাড়ি এসে সামনে থামল। চিনতে দেরি হলো না এটা কার। ডক্টর গাড়ি থেকে নেমে আসল। চোখদুটো ভয়ংকর রকমের লাল হয়ে আছে। চোখের নিচে কালি। এ অল্প কয়েকদিনেই যেন পুরো শরীর ভেঙে পড়েছে তার। যে ডক্টর নিজের শরীরের প্রতি এত যত্নবান ছিলেন। তার এমন অবস্থা! একবার তাকিয়েই আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। এ অবস্থায় বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে নিজেকে আটকাতে পারব না। অথচ এখন আমার নিজেকে আটকানোটা সবচেয়ে জরুরি। একটুপর তো চলেই যাব। যাকে ফেলে চলে যাচ্ছি তার শরীর নিয়ে কিছু বলতে যাওয়া প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়।

রবি ঠাকুর বলেছিলেন, “অধিকার ছাড়িয়া দিয়া। অধিকার রাখিতে যাইবার মতো বিড়ম্বনা আর নাই।”

তাই তো সে দোষে দুষ্ট হই কী করে বলো? যে আমি সবকিছুর অধিকার নিজের ইচ্ছায় ছেড়ে যাচ্ছি। যে আমি তাকে দুঃখের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। সে আমি তাকে আমার বিরহে না পুড়তে কী করেই বা বারন করি! মানব জাতি অবশ্য বড় অদ্ভুত। যাকে অত্যন্ত খারাপ ভাবে ফেলে যায়। যাকে কষ্ট দিয়ে যায়। আবার তাকেই ভালো থাকার জন্য বলে যায়। অথচ সে জানে ফেলে যাওয়া মানুষটা ভালো থাকবে না। তাও কী হিপোক্রেসিটাই না করে।

আমি গাড়িতে না উঠে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম দেখে সে বলল, “গাড়িতে উঠো নিরা। চলেই তো যাবে। আমি নিশ্চয়ই তোমায় এটুকু সময়ের জন্য খেয়ে ফেলব না।”

আমি জানি সে এ কথাটি কেন বলেছে। কালকের রাতটা তাকে আমি যে ভয়ে দূরে সরিয়ে রেখেছি তার খোঁটাই এখন দিচ্ছে। কথায় কথা বাড়ে তাই আমি চুপচাপ গাড়িতে উঠে গিয়ে বসলাম। ড্রাইভ করতে করতে একটুপর পর আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি কেমন ঘোরের মধ্যে আছি। একটুপর নিজের সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে এমনটা যেন ভাবতেই পারছি না। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি ভয় পেয়ে গেছিলে তাই না নিরা?”

অবাক হওয়ায় ভান করে বললাম, “ভয় কেন পাব?”

“এই যে কাল রাতে যদি আমি তোমার কাছে থাকতাম তুমি নিজেকে আমার থেকে দূরে রাখতে পারতে না। একবার যদি তুমি আমার কাছাকাছি আসতে। আমাকে ছেড়ে কখনোই যেতে পারতে না।”

“ওসব আপনার ভুল ধারণা।” সত্যি বলতে তার কথা শুনে আমার চোখ ভিজে আসছিল। কোনোরকম ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালাম।

“আচ্ছা ওটা না হয় ভুল ধারণা ছিল। এখন যে কান্না লুকাচ্ছো সেটাও কী ভুল?”

“হুম, সেটাও ভুল।”

ডক্টর অদ্ভুত হাসল। হাসতে হাসতে তার চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ডান হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে বাঁ হাতের উল্টো পিঠে সে জলটুকু মুছে নিল। আমি জানি তার কতটা কষ্ট হচ্ছিল। আমি জানি না আমার কী হয়েছিল। তার কান্না দেখে আমি নিজেকে আটকাতে পারলাম না। ডুকরে কেঁদে উঠলাম।

সে আর আমার দিকে তাকাল না। জড়ানো গলায় বলল, “নিয়তি এটা ঠিক করল না নিরা। আমার কাছ থেকে তোমায় কেড়ে নিয়ে, আমাকে শূন্য করে ঠিক করল না।”

আমি নীরবে কাঁদছিলাম। সে আবার বলল, “নিরা তুমি কী আর আসবে না?”

“না।”

“সত্যি আসবে না?”

“সত্যি আসব না।”

“যদি শোনো আমি মরে গেছি তাও আসবে না?”

আচমকা কথাটা শুনে আমি তার শার্টের কলার চেপে ধরে বলেছিলাম, “একদম বাজে কথা বলবে না।”

অকস্মাৎ আমার আক্রমণে গাড়ি চালাতে সমস্যা হচ্ছিল। আল্লাহর অশেষ রহমতে সেদিন অনেক বড় এক্সিডেন্ট থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম আমরা। ভাগ্যিস সে সামলে নিয়েছিল।”

সে অশ্রুসিক্ত চোখে হেসে বলল, “পাগল হয়েছো নাকি? এখন যদি এক্সিডেন্ট করতাম?”

আমি গর্জে উঠে বলল, “ভালো হতো। দুজন একসাথে মরে যেতাম। বাঁচতে না পারলে মরতে তো পারতাম।”

“ম্যাচিউরড নিরার মুখে ইমম্যাচিউরড কথা?”

“ভালোবাসলে সব মানুষই ইমম্যাচিউরড হয়ে যায়।”

“তাহলে আর একটি ইমম্যাচিউরড হয়ে যাও না নিরা। আমাকে ছেড়ে যেও না।” তার গলায় আকুলতা স্পষ্ট শুনেছিলাম আমি।

তার কথাটা শুনতে দূরে ছিটকে চলে এলাম। সে হাসল। কিন্তু কিছুই বলল না। এয়ারপোর্টে এসে আমার সবরকম কাজ শেষ করে ডক্টরের সাথে বসে আছি। তাকে বললাম, “একটা কথা বললে রাখবে?”

“দিয়াকে বিয়ে করা ছাড়া সবরকম কথাই রাখব।”

“সবকিছু আগে থেকে কীভাবে বুঝে যান বলেন তো?”

“ভালোবাসলে বোঝা যায়।”

“কি রকম?”

“এই যে যেভাবে আমি এখন বুঝতে পারছি তোমার মন যেতে চাইছে না। ডক্টরকে ছেড়ে তুমি ভালো থাকবে না।”

“আপনি খুব বাজে জানেন তো?”

“জানি।” বলেই হাসতে হাসতে চেয়ারের হাতলের সাথে মাথা রাখল।

“একটা কথা বলব নিরা?”

“বলুন?”

“আমি জানি তুমি ফিরে আসবে। আমার সাথে থাকার জন্য নয়, আমাকে কবর দেয়ার জন্য।”

“আবার একই কথা?” আমি রাগ করে উঠে চলে যাচ্ছিলাম। এমন সময় সে ডেকে বলল, “চলেই তো যাবে। এত রাগ করলে চলে বলো?”

“আমি কখনো আর আসব না। কোনোদিন না।”

“সে দেখা যাবে। অদ্ভুত ব্যাপার কী জানো নিরা! তুমি আমার ভালো করতে গিয়ে সবচেয়ে খারাপটাই করে যাচ্ছো।”

সে সত্যি বলেছিল কিয়া। জানতাম তাকে আমি অকূল সমুদ্রের ফেলে যাচ্ছি। সেখান থেকে উঠা তার পক্ষে কতটা কঠিন। কিন্তু সময় তো সব ঠিক করে দেয়। তাই সময়ের উপর সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে এসেছি।

তার কথার উত্তরে কিছু না বলে আবার তার পাশে গিয়ে বসলাম। ঠিক তখন দেখলাম দিদান, মা, ওহি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দিদান আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি তাকে ঝাপটে ধরলাম। দিদান কাঁদছিলেন। তারপর মাকে, তারপর ওহিকে।

দিদান বললেন, “তোর ডক্টরকে তোর কাছে পাঠিয়ে দেব। সারাজীবন শুধু কষ্টই ফেলি। বাকি জীবনটা কষ্ট পাস আমি চাই না।”

মা-ও দিদানের কথায় সায় দিলেন। আমি একহাতে দিদান, আরেক হাতে মায়ের একটা হাত ধরে বললাম, “এটা কখনো করবেন না। এটা করলেই বরং আমি খারাপ থাকব।”
দিদান আমার হাত ধরে বললেন, “আমার একটা কথা রাখবি বোন? আমি মরে গেলে তুই শেষ দেখাটা দেখে যাস। আমার খাটিয়া ধরে মন থেকে বলিস তুই আমায় ক্ষমা করে দিয়েছিস।”

আমি কিছুই বললাম না। মা বললেন, “আমি তোর পথ চেয়ে বসে থাকব।” ওহি বলল,”আমার বিয়েতে তোমামে আসতে হবে কিন্তু ভাবী।”

সবার চোখে জল। সময় চলে এসেছে। আমাকে ভেতরে চলে যেতে হবে। একে একে সবাই থেকে বিদায় নিলাম। সবাইকে হাত জোর করে একটা কথা বললাম বাবাকে যেন তারা ক্ষমা করে দেন।

ইমিগ্রেশন পর্যন্ত ডক্টর আমার পিছুপিছু আসল। সুন্দর সুরেলা কণ্ঠে ভেসে আসছে তাড়াতাড়ি ভেতরে যেতে। আমার অনেক কথা বলার ছিল কিন্তু বলতে পারলাম না। জীবনে কিছু কিছু সময় আসে যখন চেয়েও কিচ্ছুটি বলা যায় না। শব্দেরা সহজে ধরা দেয় না। তাই তো তাকে বললাম, “আসছি?”

“সত্যি আসবে তো?” তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে।

এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আমি দিতে পারিনি। ডুকরে কেঁদে উঠল সে। সাথে আমিও। ট্রলি নিচে ফেলে দিয়ে তাকে ঝাপটে ধরলাম। সে তো এমন ভাবে ধরল যেন আমাকে যেতেই দেবে না। সেই মুহূর্তটা আমরা জাগতিকজ্ঞান পৃথিবীর সব ভুলে গেলাম। ভুলে গেলাম আশেপাশে লোকজন আছে। হয়তো তারা আমাদের দেখছে। দুজন পাগলের মতো কাঁদতে লাগলাম। অস্ফুটে সে শুধু একটা বাক্যই বলল, “যেও না নিরা। আমি শেষ হয়ে যাব?”

মা, দিদান, এসে তাকে ছাড়িয়ে নিল। সে কিছুতেই আমাকে ছাড়তে চাইল না। ওহি ফ্লোরে বসে কাঁদছিল।

ওহির পাশে আমি আরও দুজন মানুষকে দেখলাম। মায়ান ভাইয়া, আর দিয়া আপু। অদ্ভুত লাগল এটা দেখে যে, যারা চেয়েছিল আমরা আলাদা হয়ে যাই। তারাই আজ আমাদের বিচ্ছেদে কাঁদছে। এ দুনিয়া এক আজব জায়গা!

ডক্টরকে তখনও মা, দিদান ধরে রাখতে পারছিল না। তখন মায়ান এসে তাকে আটকাল। আমি ততক্ষণে পেছনের সব বন্ধনকে ছেড়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। একটা কথাই আমার কানে আসছিল।

“মায়ান নিরাকে বল আমাকে ছেড়ে না যেতে।”

জাগতিক কোনো শব্দ তখন আমার কানে আসছিল না। শুধু এই বাক্যটা আমার কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। প্লেন ছেড়ে দিয়েছে। একটু একটু করে আমার সব ভালোবাসা, সব টান ফেলে আমি চলে যাচ্ছি। মনে হচ্ছিল আমার বুকের ভেতর কেউ অনেকগুলো বিষাক্ত তীর ছুড়ে দিয়েছে। যার বিষে আমার পুরো শরীর বিষক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। প্লেনের সিটের হেড বোর্ডের সাথে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছি। বারবার আমার কানে বাজছিল, “যেও না নিরা। আমি শেষ হয়ে যাব।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here