সন্ধ্যা নামার পরে পর্ব ২৩+২৪

#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#তেইশ

রাতের অন্ধকার ভেদ করে ভোরের আকাশে সূর্যেরকিরণ ধরনীকে আলোকিত করেছে। ভোরের আলো এত মিষ্টি আর নরম হয় যা আমার খুব প্রিয়। সারারাত কোনো এক অজানা অস্বস্তিতে ঘুম হয়নি।
আমার পাশে ডক্টর ঘুমাচ্ছে। তাকে ডাকতে ইচ্ছে করছে না। চুপচাপ উঠে এলাম বারান্দায়। একটুপর বের হবো গ্রামের উদ্দেশ্যে। বাবার সাথে দেখা করাটা জরুরি। ডক্টরকে রাতে বলেছিলাম আমি একাই বাবার সাথে দেখা করতে যাব। সে বলেছে একা ছাড়বে না। কিন্তু আমি জোর করায় সে রাজি হয়েছে। তবে তার গাড়িটি নিয়ে যেতে হবে।

নিচে নেমে নিজের জন্য চা করে উপরে উঠছিলাম এমন সময় ডক্টর আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে বলল। আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, “আর একটু পরে বের হলে কী সমস্যা?”

“যা বলছি শোনো নিরা। আমিও যাব তোমার সাথে।”
ডক্টরের কপালে তখন চিন্তার ভাঁজ।

“আপনি বলেছিলেন আপনি যাবেন না। তাহলে?”

“বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন নিরা। আমাদের এক্ষুনি যেতে হবে।”

বাবার অসুস্থতার কথা শুনে আমার হাত থেকে কাপটা পড়ে গেল। এ জীবনে আপন বলতে আমার বাবাই তো আছে। যদি তার কিছু হয়ে যায়! না ভাবতে পারছিলাম না আমি। চোখের কোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে নিচে পড়ছিল।

ডক্টর তখন সন্তপর্ণে আমার হাতটা তার হাতের মুঠোয় বন্দী করে বলেছিল, “আই হেইট টিয়ারস নিরা। প্লিজ ডোন্ট ডু দিস।”

আমি জানি না কিয়া তার কথায় কী ছিল। শুধু জানি আমার চোখের বৃষ্টির বেগ তখন আরও বেড়ে গিয়েছিল। রুমে এসে আমি বিছানায় বসে যখন ডক্টরের তৈরি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখন সে এসে একটা ভেজা টুকরো কাপড় এনে আমার জামার উপরটা মুছে দিচ্ছিল। আমি কোনো বাধা দিলাম না। চায়ের কাপ হাত থেকে পড়ার সময় ছিটকে আমার জামায় এসে পড়েছে সেটা আমি তখনই খেয়াল করলাম। তারপর বেরিয়ে পড়লাম গ্রামের উদ্দেশ্যে। পুরো রাস্তায় আমি বোধহয় হাজার বার ডক্টরকে জিজ্ঞেস করেছি ‘বাবা ঠিক হয়ে যাবে তো?’

ডক্টর আমাকে চিন্তা করতে বারন করেছে। বাড়ির সামনে এসে আরও অবাক হলাম। মানুষের ভিড়। ভাবলাম আমার বাবা ঠিক আছে তো! এত মানুষ কেন? কোনো এক অজানা আশংকায় ভেতরটা কেঁপে কেঁপে ওঠেছিল। সামনে এগুনোর শক্তিটুকু পাচ্ছিলাম না। বারবার মনে হচ্ছিল ভেতরে গিয়ে যদি দেখি সব শেষ! তবে আমার কী হবে! আমি কীভাবে বাঁচব! তারপর নিজের ভাবনা দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। আমি এত নেগেটিভ কেন ভাবছি। ডক্টর তখনই আমার হাত ধরে বলেছিল, “ভেতরে চলো নিরা।”

আমি ছোট্ট বাচ্চার মতোন তাকে অনুসরণ করে ঘরে ঢুকলাম। হঠাৎ আমার সামনে অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখতে পেলাম। মাটিতে পাতানো একটা পাটিতে কাউকে সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। আমার পুরো শরীর তখন হিম হয়ে আসছিল। বুকের ভেতরটা কবুতরের দূর্বল সিনার মতোন হয়ে আসছিল। মস্তিষ্ক তখন শূন্য! পাশের বাড়ির চাচি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “তোর আর কেউ রইল নারে মা। অভাগী মাইয়া তুই। এতিম হইয়া গেলি তুই।”

দপ করে নিচে বসে গেলাম আমি। ভয়ে ভয়ে কাঁপা – কাঁপা হাতে সাদা কাপড়টা মুখ থেকে সরাতেই দম বন্ধ এসেছিল আমার। মনে হচ্ছিল বাতাসে অক্সিজেনের পরিবর্তে কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেশি হয়ে গেছে। আমার জীবনের একমাত্র সম্বল, একমাত্র আপনজন, একমাত্র ছায়া, একমাত্র অবিভাবক, আমার বাবা শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছেন। হুট করে আমার চোখের সামনে কতগুলো স্মৃতি ভেসে ওঠল। ছোট্ট নিরার অবিরাম ছুটে চলা। তার পেছনে ছুটে চলেছে তার বাবা। রাগ করলে বাবার রাগ ভাঙানো, অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদলে বাবার বুকে জড়িয়ে নেয়া, এলোমেলো চুলগুলোতে তেল দিয়ে বেঁধে দেয়া, যখন শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ করেছে তখন সে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য বসে বসে কাঁদছিল। কিন্তু বাবাকে বলতে লজ্জা পাচ্ছিল, ঠিক তখন বানা এসে একজন অসাধারণ মায়ের মতোন বুঝিয়ে দিলেন ভয়ের কিছু নেই। একজন মেয়ের পরিপূর্ণতাই হলো এই বয়ঃসন্ধি কালের বিষয়টা। বলেছিলেন একজন মেয়ে এই কষ্টটা সহ্য করে বলেই সে পৃথিবীর সবচেয়ে মহান কাজটি করতে পারে। সেই জন্যই সে মা হতে পারে। আজ সেই অসাধারণ বাবাটা তার কাছ থেকে চলে গেল। চলে গেল আমাকে ছেড়ে কিয়া। আমার জীবনে আর কেউ রইল না, যাকে আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমার ছায়া।

একটা বিকট চিৎকার করেছিলাম বাবা বলে। এরপর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল তততক্ষণে বাবাকে বরই পাতা, উষ্ণ গরম জলে, গোসল করে সাদা কাপড়ে সাজিয়ে ফেলা হয়েছে। আমার শ্বশুর বাড়ির সবাই দেখলাম। এমনকি মাকেও। বাবাকে শেষ বারের মতোন দেখার জন্য ডক্টর আমাকে পাঁজাকোলে করে নিয়ে গেলেন। দেখলাম বাবাকে, বাবাকে আকড়ে ধরতে চাইলাম। বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতে চাইলাম, যাতে এ মানুষগুলো আমার বাবাকে আমার কাছ থেকে আর কোথাও নিয়ে যেতে না পারে। কিন্তু পারিনি আমাকে তারা তা করতে দিল না। নিয়ে গেল আমার বাবাকে সারাজীবনের জন্য।

নিরার চোখে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে। কিয়া উঠে এসে তার মুখটা ধরে জল মুছে দিল। নিজের বুকে টেনে নিল। কিয়ার জড়িয়ে ধরা যেন নিরার কান্নার বেগ আরও বাড়িয়ে দিল। হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে। কিয়া বুঝতে পারছে তার বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। কতটা সময় নিরা কাঁদল জানি না। তারপর আবার বলল, “আমি জানতাম না কিয়া তখন শুধু আমার বাবা চলে যায়নি, তারসাথে চলে গেছে আমার জীবনের সকল শান্তি। আমি বুঝতে পারিনি আমার জন্য এমন কিছু সত্য অপেক্ষা করছে যার জন্য না মননে, না মস্তিষ্কে, কোথাও আমি তৈরি ছিলাম না।

সেদিন বাবাকে মাটির ঘরে রেখে এসে ডক্টর যখন আমার সামনে এসে দাঁড়াল তখন পাগলের মতো আমি তাকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম৷ ডক্টরও কাঁদছিল তার নীরব চোখের জল আমার পিঠ ভাসিয়ে দিচ্ছিল। ছোট্ট একটা বাচ্চার মতোন করে সে আমাকে যত্ন করছিল। আমার যত্ন নেয়াই যেন তার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। তারপর থেকে শুরু হলো আমার সেই দুঃস্বপ্নটা দেখা। ঘুমাতে পারতাম না সেই স্বপ্নটা আমার সামনে চলে আসত। বিকট চিৎকারে উঠে বসতাম। ভয়ে ভয়ে কাঁদতাম ডক্টরের বুকে পোষা বেড়ালের মতোন ডুকরে কাঁদতাম। তখন বুঝেছিলাম আমার বাবার নির্ভরতার হাত আমার মাথার উপর থেকে চলে গেলেও, অন্য একজন অনায়াসে সেই দ্বায়িত্বটা নিজেই নিয়ে নিল। তার হাত যখন আমার মাথায় রাখত তখন মনে হতো এই হাতটা পৃথিবীর সব বিপদ থেকে আমাকে রক্ষা করবে। সব যন্ত্রণা থেকে আমাকে মুক্তি দেবে। কিন্তু জীবন তো আমায় নিয়ে আমার ভাবনার চেয়ে বেশি ভেবে রেখেছিল। আমায় বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়ে, মনের ভেতর আশা জাগিয়ে সবকিছু কেড়ে নেয়াই জীবনের সবচেয়ে বড় নিয়ম হয়ে গেছে। আমার বাবা চলে যাওয়ায় আরেক বাবা এসে আমার হাত ধরলেন। আমার শ্বশুর, দিদান, ওহি এমনকি আমার শাশুড়ি পর্যন্ত আমার খেয়াল রাখতে শুরু করলেন। দিনদিন আমি সহজ হয়ে উঠছিলাম। পড়াশোনায় আরও বেশি ফোকাস করতে শুরু করলাম। মনে হচ্ছিল আমার সব ঠিকঠাক চলছে। আমার বাবা চলে গেলেও আমার একটা পরিবার হয়েছে। যেই পরিবার আমার ছায়া হয়ে থাকবে। কিন্তু বুঝতে পারিনি এই পরিবারই একদিন আমার কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়েছে। এমনকি আমার ছায়াটুকুও!
#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#চব্বিশ

সেই সময়গুলো এত সুন্দর কেটে যাচ্ছিল যে আমি বুঝতে পারছিলাম না, কীভাবে দিন গিয়ে রাত আসছে, রাত শেষে দিন! তাছাড়া আমার ফাইনাল পরীক্ষা ছিল বলে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে হচ্ছিল। বাবার এভাবে চলে যাওয়া আমার জন্য বড় একটা ধাক্কা ছিল। ডক্টরের পরিবারের সবার যত্নে আমি সবকিছু সামলে নিচ্ছিলাম। এর মাঝে একদিন ডক্টর হাসপাতাল থেকে তাড়াতাড়ি এসে আমায় বলল, “তৈরি হয়ে নাও নিরা। তোমাকেই আমার সাথে যেতে হবে।”

“কোথায় যাব?”

“তুমি আমায় বিশ্বাস করো তো নিরা?”

“নিজের থেকেও বেশি।” কথাটা বলে আমি নিজেই চমকে গিয়েছিলাম কিয়া। এমন একটা কথা আমি কেন বললাম ভাবতেই লজ্জা লাগছিল। ডক্টর আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। চশমার আড়ালেও তার সুন্দর চোখদুটো হাসছিল। তীক্ষ্ণ হাসিটা আমার বুকের ভেতর এসে লাগছিল। আমি ক্লোজেট খুলে একটা মেরুন রঙের শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। তৈরি হতেই তাকে দেখলাম। সেও মেরুন রঙের শার্ট পরেছে হাতা কনুই পর্যন্ত গুটানো। মুখে কয়েকদিনের খোঁচা – খোঁচা দাড়ি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। খেয়াল করে দেখলাম চশমাটা পাল্টেছে। আগের মতো মোটা ফ্রেম নয়। এটায় বেশি সুন্দর লাগছে। আমার তখন হুট করে মনে হয়েছিল ছেলেদের ফরমাল ড্রেসআপে যতটা স্মার্ট লাগে ততটা বোধহয় অন্য ড্রেসআপে লাগে না। আবার এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়েছিল এত সুন্দর মানুষ আমি আর কখনো দেখিনি। তার মায়া, মায়া চোখ, হাসি, হাসি মুখ। সবকিছু যেন পৃথিবীর অনিন্দ্য সুন্দর! এত সুন্দর বুঝি আর হয় না। নির্লজ্জের মতো কতক্ষণ আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম জানি না। সে যখন দুই আঙুলে তুড়ি মেরে আমাকে বলল, “আমি জানি আমি সুন্দর এভাবে তাকিয়ে থাকলে নজর লেগে যাবে।”
কথাটা বলেই সে মিটিমিটি হাসছে। তার হাত দুটো ভাঁজ হয়ে তখন বুকের উপর উঠে এসেছে।

তার কথা শুনে আমি বললাম, “ইশ কী আমার সুন্দর মানুষরে। নিজেকে কখনো আয়নায় দেখেছেন? দেখলে জানতেন, কী বাজে দেখতে আপনি। এত বাজে দেখতে মানুষ হয় নাকি!”

“আয়নায় দেখছি তো নিজেকে নিরা। সেই আয়না বলে আমি তার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ।”

“তা সে আয়না কোথায় শুনি?”

“এই যে তোমার সুন্দর দুটো চোখ। যা আমায় সবসময় কিছু না কিছু বলে যায় নিরা। তুমি নিজেকে আড়াল করলেও তোমার চোখদুটো নিজেকে কখনো আড়াল করতে জানে না। কখনো অবহেলা করতে জানে না। এ চোখ দুটো খুব বিশ্বস্ত, খুব পবিত্র।”

জানো কিয়া তার বলা প্রতিটি শব্দ আমার হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করছিল। আমার শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকায় বিক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। কোনোরকম তাকে এড়ানোর জন্য বলেছিলাম, “আপনার না দেরি হয়ে যাচ্ছে! এখন কী এসব বাজে বকা বন্ধ করবেন?”

“তুমি এখনো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছো নিরা।” তার গলা কেমন শান্ত অথচ ধারালো মনে হলো।

“আপনি যদি এমন করে, আমি কোথাও যাব না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে চলো তাহলে।”

আমি তার পিছুপিছু এগিয়ে গেলাম। সে সত্যি বলেছিল আমি তাকে এড়াতে চাচ্ছিলাম। এমন ধারালো দৃষ্টি, এত সুন্দর করে কথা বলা সবকিছু আমাকে বিবশ করে ফেলছিল। যদি তার সামনে ধরা পড়ে যাই তাই তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছিলাম। এই পৃথিবী উল্টে যাক তবুও ডক্টরের কাছে আমি আমাকে প্রকাশ করব না। যদি না সে নিজে থেকে করে।

★★★
আমাকে পতেঙ্গা সমুদ্র পাড়ে নিয়ে গেল। গাড়িতে আমার চোখদুটো কালো একটা কাপড়ে বেধে দিল। তারপর হাত ধরে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছিল। চোখের বাঁধন যখন খুলল, তখন সবকিছু আমার কাছে স্বপ্ন হয়ে দেখা দিল। সময়টা ঠিক ‘সন্ধ্যা নামার পরে’ চারপাশে নানা রঙের আলো দিয়ে সাজানো। লাভ শেপের একটা গেট, সেই গেটের সামনে ডক্টর দাঁড়িয়ে আছে হাতে একগুচ্ছ হলুদ গোলাপ নিয়ে। আমি তার সামনে যেতেই সে নিল ডাউন করে বলল,

“মিসঃ আফরা মেহেজাবি নিরা! ইউ নো? আই কান্ট ইমাজিন আ সিঙ্গেল মোমেন্ট ইন মাই লাইফ উইদআউট ইউ! আই লাভ ইউ মোর দেন মাইসেল্ফ। ডু ইউ লাভ মি?”

আমার ছোট্ট জীবনে সুখের মুহূর্ত খুব কমই আছে কিয়া। এর মধ্যে থেকে সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত সেদিনের, সেই সন্ধ্যা নামার পরের মুহূর্তটা আজও আমার মনে দাগ কেটে আছে। তার বলা প্রতিটি শব্দ আমার হৃদপিণ্ডের কম্পন বাড়িয়ে দিচ্ছিল। শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকা বলে বলে উঠছিল, “তুই পেয়েছিস নিরা। তোর জীবনের সেই আরাধ্য মানুষটাকে পেয়েছিস।” আমার শরীর, মনকে একফাঁলি তীব্র সুখ ক্রমশ অবশ করে দিচ্ছিল। যেন কোনো সমুদ্রের তলদেশে হাজার বছর ধরে খোঁজার পর আমি সেই অমূল্য মুক্তো পেয়ে গেছি। মানুষের জীবনে এমন কিছু সময় আসে যখন বলার মতো উপযুক্ত কথা খুঁজে পায় না। আমারও তেমন অবস্থা হয়েছিল। শুধু একটা কথাই তখন বলেছিলাম কাঁপা কাঁপা গলায়,

“ডক্টর, আপনি আমায় একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরবেন প্লিজ?”

ডক্টর আর আমার মাঝখানে তিন হাতের মতো দূরত্ব ছিল। সে দৌঁড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরল। তার উষ্ণ স্পর্শে আমি বিভোর হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়াতে লাগল। মনে হচ্ছিল এত সুখে বুঝি মরেই যাব। আমার সব চিন্তা, সব দ্বিধার এখানেই বুঝি সমাপ্ত হলো। সে আমার হলো, আর আমি তার। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেল আমি জানি না। শুধু জানি ওই মুহূর্তটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত ছিল। দূর থেকে ওহি ছবি তুলছিল। বলছিল, “এবার একটু অন্য পোজে দাঁড়াও লাভ বার্ডস। এভাবে আর কত ছবি তুলব?”

ওহিকে দেখে লজ্জায় আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। আমার মুখটা তখন বুকে এসে ঠেকেছে। এসব কিছুতে তাহলে ওহিও আছে। ইশ! কী ভাবছে সে!

ডক্টর আমার সামনে নিল ডাউন করে বসল। তার হাতে ছোট একটা লাল রঙের সুন্দর বক্স। সে বক্সটা খুলতেই দেখলাম সুন্দর একটা আংটি, পাথর চিকচিক করছে। আমি হাতটা বাড়িয়ে দিতেই সে সেটা পরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি তোমার সাথে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকতে চাই নিরা। তুমি থাকবে তো?”

আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম, ” থাকব ডক্টর।”

তখন সে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “উঁহু! তুমি আমায় অর্নব বলে ডাকবে।”

আমি হেসেছিলাম বলেছিলাম, “আপনাকে ডক্টর বলতেই বেশি ভালো লাগে।”

সেদিন একসাথে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমরা। আজ দেখো কিয়া আমি আমার কথা কী রাখতে পেরেছি! আমি কী তার সাথে থাকতে পেরেছি। বরং আজ আমাদের মাঝে যোজন – যোজন দূরত্ব। আমরা একে অপরের চেয়ে কতটা দূরে আছি। সেদিনের সেই সুন্দর মুহূর্তটা পার করে যখন আমরা বাড়ি ফিরলাম। ভাবলাম আজ রাত থেকে আমাদের জীবনের সুন্দর একটা অধ্যায় শুরু হবে। কিন্তু এমন কিছুই হলো না। দুজনের মনের সব আকাঙ্খাকে শেষ করে দেয়ার জন্য হাসপাতাল থেকে কল এলো। মায়ানের কল রাতে ওটি আছে। অন্য ডক্টররা আজ ছুটিতে। শুধু অর্নবই পারে সেটা করতে। যখন কথা বলে ফোনটা রাখছিল সে। আমি তার চেহেরাটা দেখেছি কীভাবে নিভু নিভু হয়ে যাচ্ছিল। তাকে স্বাভাবিক করতেই আমিই বলেছিলাম, “যেতে হবে?”

“হুম।” জোর করে হাসার চেষ্টা করেছিল সে।

“কোনো ব্যাপার না। একজন ডক্টরের কাছে সবকিছুর আগে রোগীর সেবা করা। আজকে আপনি হয়তো আল্লাহর রহমতে কারো প্রাণ বাঁচাবেন। আর তাদের দোয়ায় আমাদের জীবন আরও সুন্দর হবে।”

সে হেসে বলেছিল, “তুমি কী জানো? তুমি যে খুব মিষ্টি একটা মেয়ে নিরা?”

“উঁহু! এখন জানলাম।” এটা বলতেই সে আমায় জড়িয়ে ধরে কপালে একটা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে চলে গেল। আমি তার চলে যাওয়া দেখলাম। সে আমার চোখের আড়াল হতেই অসম্ভব রকম একটা ব্যাথা আমায় ঘিরে ধরল। সে রাতের আমার ঘুম হলো না। প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি সেকেন্ড আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। অপেক্ষা মান সময় মৃত্যুর চেয়ে কষ্টকর’ সেদিন আমি জ্ঞানীদের এই উক্তির তাৎপর্য বুঝতে পেরেছিলাম। একটা মুহূর্ত আমার কাছে হাজার বছর মনে হচ্ছিল।

রাত তিনটায় আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকে ভাবছিলাম। ঠিক তখন বুঝলাম কারো দুটো হাত আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরছে। চমকে উঠলাম আমি তখনই পারফিউমের মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে আসতেই বুঝলাম এ তো আমার মানুষ! মুহূর্তেই সমস্ত খারাপ লাগা বাতাসে মিলিয়ে গেল। তার জায়গায় দখল করে নিল মিষ্টি এক অনুভূতি। যার নাম ভালোবাসা। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে। সে আমায় বলল, “আজকের রাত তো ভোর হয়ে গেল। চলো একটা গল্প শোনাই তোমায়। একটা ছেলের জীবনের গল্প। যেটা শোনা তোমার জন্য খুব জরুরি নিরা।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “গল্প!”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here