সন্ধ্যা নামার পরে পর্ব ২০+২১+২২

সন্ধ্যা নামার পরে
বিশ

সে নিস্তব্ধ রাতের কিছু সুন্দর স্মৃতি আজও আমার মনের গোপন বাক্সে সযত্নে বন্দী করে রেখেছি। আমার জীবনে যদি কিছু সুন্দর মুহূর্তের কথা কেউ জানতে চায়, তবে সেই সময়টুকুর কথা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি।

আমি জানি না দাম্পত্য কী! আমি জানি না স্বামীর স্পর্শ কী! আমি জানি না শরীরের রহস্য কী! শুধু জানি সেই মানুষটার মনের পুরোটা জুড়ে আমি আছি। তার চাহনিতে আমি আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি! সে নিগূঢ় ভালোবাসা মুখে প্রকাশ না করলেও তার সুন্দর দুটো চোখ আমাকে সারাক্ষণ বলে বেড়াত। বলে বেড়াত ভালোবাসি নিরা। শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। সে কী জানত সে ধরা পড়ে গেছে আমার কাছে! আমি পড়ে ফেলেছি তার গভীর দুটো নয়নের গুপ্ত ভাষা। খাবার শেষে সে আমাকে শুইয়ে দিয়ে পরম যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল। তার সেই শীতল স্পর্শে কখন যে নিদ্রা দেবী আমার চোখে ভর করেছিল বুঝতেই পারিনি। রাতে নাকি আমার আবার জ্বর এসেছিল সে বসে বসে জলপট্টি দিয়েছে। মেডিসিন দিয়েছে। অথচ সেসবের কিছুই আমি দেখলাম না। জ্বরের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে আমি হুসে ছিলাম না। পরে সব ওহির কাছে শুনেছি। নিরা থামল। বোতলের মুখ খুলে কিছুটা পানি গলায় ঢেলে দিয়ে আবার বলা শুরু করল,

” জানো কিয়া আমার খুব ইচ্ছে করে আমাকে এতটা অসুস্থ দেখে কতটা ছটফট করেছিল সে। তার সুন্দর চোখদুটোতে কী তখন ভয় ছিল। তার সুন্দর মুখ খানায় কী দুশ্চিন্তার ছাপ ছিল! এমন আরও অনেক কিছু আমার জানতে ইচ্ছে করেছিল।

পরেরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙে তখন দেখলাম আমার পাশে খাটের হেড বোর্ডের সাথে হেলান দেয়া অবস্থায় আমার দিকে ঝুঁকে আছে অর্নব চোখদুটো বন্ধ। ঘুমাচ্ছে সে। তার একটা হাত আমার মাথার নিচে। আরেকটা হাত আমার মাথার উপর। হঠাৎ এমন একটা পরিবেশের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। অর্নবের হাতের উপর আমি কী সারারাত ঘুমিয়েছি? কিন্তু কখন এমনটা হলো! আমার তো কিছুই মনে নেই। তারপর মনে হলো সারারাত যদি আমি তার হাতের উপর ঘুমিয়ে থাকি তবে নিশ্চয়ই তার হাত ব্যাথা করছে। এ কথা মনে পড়তেই মাথাটা দ্রুত তুলতে গেলে বুঝতে পারলাম মাথাটা ভীষণ ধরে আছে। অগত্যা আবার শুয়ে পড়তে হলো। জ্বর ভেতর থেকে খুব দুর্বল করে দিয়েছে আমাকে। তাছাড়া মাথা তুলতে গেলেই অসহ্য ব্যাথা হচ্ছে। আমার নড়াচড়া দেখে অর্নবের ঘুম ভেঙেছে মাত্র। পিটপিট করে আমার দিকে তাকিয়ে উপরে থাকা হাতটা দিয়ে কপালে হাত দিয়ে উদ্ধিগ্ন গলায় বলেছিল, “খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার নিরা?”

কী জানি কী হলো। তার চোখে আমার জন্য চিন্তা আমার সব খারাপ লাগা এক মুহূর্তের জন্য বাতাসে উড়ে গেল । আমার জন্য অর্নব সারারাত চিন্তায় ছিল সেটা ভাবতেই একফাঁলি সুখ হৃদপিণ্ডের চারপাশে ওড়াউড়ি করতে লাগল। শরীরের দূর্বল রক্তকণিকা গুলো মন্ত্রবলে কী যেন ভীষণ শক্তি পেল। আমার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি খেলে গেল। আমার হাসি দেখে তার কপাল কুঞ্চিত হলো। ঠোঁট টিপে জিজ্ঞেস করল, “হাসার কী হলো?”

আমি আবারও হাসলাম। এবার হাসিটা একটু চওড়া হলো বুঝতে পারলাম। ডক্টর আমাকে দেখে কী ভেবে যেন বলল, “জ্বরের সাথে কী মাথাটাও গেছে নাকি? এভাবে হাসছো কেন?”

আমি আবারও হাসলাম মুখে কিছুই বললাম না। আমার চুপ করে থাকা দেখে সে কী বুঝল কে জানে! নিজেও হেসে উঠে বসল। উঠে থার্মোমিটার এনে জ্বর মেপে দেখল অনেকটাই কমেছে। তারপরও বলল, “রেস্টে থাকবে। কয়েকদিন পড়াশোনা বন্ধ রাখবে।”

আমি একান্ত বাধ্যগত ছাত্রীর মতো ঘাড় কাত করে চোখ বন্ধ বন্ধ করে সম্মতি জানালাম। সেদিন আমাকে আবাক করে দিয়ে সে হাসপাতালে গেল না। আমার জন্য ছুটি নিল। চারপাশে তখন আমার সুখের ছায়া পড়েছে। সেই সুখে আমি ভাসছিলাম। অর্নবের যত্ন, ভালোবাসা মেশানো শাসন সব আমার ভালো লাগছিল। ভালো লাগছিল অতি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র কথাগুলো। আমি তখন পুরোপুরি বুঝতে পেরেছিলাম, আমি তার কাছে বাধা পড়েছি। বাধা পড়েছে আমার মন। বাধা পড়েছে আমার সমস্ত সত্ত্বা। আমি তখন প্রেমের গভীর অতল সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি জানতাম সেই সমুদ্রের অতল গহবরে শুধু সুখ পাব। শুধু জানা ছিল না আমি সেই সমুদ্রের অতল গহবর থেকে কখনো উপরে উঠতে পারব না। সেই ক্ষণিকের সুখগুলোই আমার জীবনে সবচেয়ে যন্ত্রণার কারণ হবে। জানতাম না, নিজেই জেনেশুনে নিজের জন্য একজীবন কষ্ট কিনেছি। যে কষ্ট আজও আমায় বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। বয়ে বেড়াতে হচ্ছে সব না পাওয়াকে। ”

মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো কিয়া? মনে হয় জীবনে বেঁচে থাকার জন্য কিছু স্মৃতি দরকার। তা হোক সুখের অথবা দুঃখের। মাঝে মাঝে দুঃখ বিলাসের জন্য হলেও এ টুকরো টুকরো দুঃখগুলোকে আপন করে নেয়া দরকার।

কিয়া অবাক হয়ে শুনছিল তার কথা। নিরার চোখ বারে বারে ভিজে যাচ্ছিল। বারবার সে জল মুছে নিয়ে আবার বলছে। কিয়া বলল, “তাহলে তো তোমাদের সব ভালোই চলছিল লিরা। তবে আলাদা কেন হলে?”

নিরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমিও তাই ভাবছিলাম কিয়া। আমরা হয়তো একে অপরের কাছাকাছি আসছি। কিন্তু জানা ছিল না, এই কাছে আসাটা আমাদের সারাজীবনের জন্য নয়। শুধু সারাজীবনের জন্য স্মৃতি করে রাখার জন্য। সে রাতে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আমার জ্বর অনেকটা কমেছে। সারাদিন শুয়ে থেকে থেকে আর ভালো লাগছিল না। খাওয়া শেষ করে সে শুইয়ে দিতে চাইল আমাকে, আমি বললাম, ” এখন না প্লিজ। আমার ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না।”

অর্নব আমার দিকে তাকিয়ে মধুর হেসে বলল, “ঠিক আছে একটু বোসো তাহলে। ” কথাটা বলে সে আমার পাশে বসেছে।

” একটু গল্প করবেন আমার সাথে?”

ডক্টর বোধহয় আমার এমন কথায় অবাক হয়েছে সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “সিওর।”

তারপর কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। এমন চুপ করে থাকাটা অস্বস্তি দেয়। সেই অস্বস্তিটা কাটিয়ে বলেছিল, “তোমার কী করতে ভালো লাগে?”

“বই পড়তে।”

“তুমি খুব বই পড়ুয়া তাই না?”

“হুম, খুব।”

তারপর আবার কিছুক্ষণ চুপ। তারপর হঠাৎ ডক্টর একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলেন আমাকে।

“নিরা?”

“হু।”

“কখনো কাউকে ভালোবেসেছো?”

প্রশ্নটা করার সময় তার গলায় এমন কিছু একটা ছিল যা আমাকে কেঁপে উঠতে বাধ্য করল। বুকের নিচে হৃদপিণ্ডটা তখন কবুতরের দূর্বল সিনার মতো হয়ে গেছে। শ্বাস আটকে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এমন কঠিন প্রশ্ন বোধহয় পৃথিবীতে আর নেই। অন্ধকার ঘরের ল্যাম্পের হলদেটে নিভু নিভু আলোয় তার সুকুমার মুখখানা তখন আমার দিকে তাক করা। তার ওমন সুন্দর চোখদুটোতে আমার কাছ থেকে উত্তর জানার আকুলতা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কোনো ঐশ্বরিক বলে শুনতে পাচ্ছি তার হৃদয়ের দ্রুত বেগে ছুটে চলা। আমার মনে হচ্ছিল তার হৃদয় আমাকে বারবার বলছে, “বলো নিরা? তাড়াতাড়ি বলো? আমি যে ক্ষণিকের অপেক্ষাও সহ্য করতে পারছি না।”

বলাই বাহুল্য মানুষ নিজের জন্য অন্যকে ছটফট করতে দেখলে একটা পৈশাচিক আনন্দ পায়। সে আনন্দের কিছুটা আমিও পাচ্ছিলাম। তাই সেটা আরও বাড়িয়ে দিতেই বললাম, “ডক্টর?”

“হু?”

“আমি একজনকে ভালোবাসি।”

সেই আবছা হলদেটে আলোয় তখন আমি স্পষ্ট দেখছিলাম মানুষটার সুশ্রী মুখখানায় তখন আমবস্যার গ্রহণ লেগেছে। একটা চাপা উত্তেজনা মেশানো যন্ত্রণা তার মুখের আদলে ফুটে উঠেছে। আমার বেশ লাগছিল। মনে হচ্ছিল এই ছেলেকে রাগলেও দারুণ লাগে। তারপর আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে সে অদ্ভুত হেসে বলল, “আমি বিশ্বাস করি না নিরা।”

“কী বিশ্বাস করেন না?”

“তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারো।”

“কেন পারি না?”

“কারণ তুমি আমার বউ। এতদিনে আমি এতটুকু জেনেছি তুমি রাগী, জেদি হতে পারো, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক নও।”

“এত বিশ্বাস!”

“হু, এতটাই বিশ্বাস।”

জানি না কিয়া তার কথায় কী ছিল শুধু জানি আমার হৃদ স্পন্দন থমকে আসছিল। শুধু ভয় হচ্ছিল সে কী আমার ভেতরটা পড়ে ফেলল? ধরে ফেলল যত্ন করে লুকিয়ে রাখা ভালোবাসা! দ্বিতীয় বারের মতো সে আমাকে তার বউ বলে সম্মোধন করল। তখন মনে হলো সত্যি তার নামের সাথে আমার নামটা জুড়ে গেছে। আমি সত্যি তার হয়ে গেছি। এবার শুধু সব প্রকাশের পালা। কিন্তু বুঝতে পারিনি কী অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#একুশ

অর্নবের কথাটা শুনে চকিতেই আমি তার দিকে তাকালাম। তার সুন্দর চোখদুটো তখন আমার দিকে নিবদ্ধ। সেই চোখে প্রগাঢ় মায়া। তার পাতলা ঠোঁটের কোণে তখন রহস্যময় হাসি খেলা করছে।
আমি তাকে বললাম, “এতটা বিশ্বাস করলে ঠকতে হয় জানেন তো?”

“না, জানি না।”

“কেন জানেন না?”

“তাও জানি না।”

“আচ্ছা, তা কী জানেন?”

“কিছুই জানি না।” তার ঠোঁটে বাঁকা হাসি।

আমি কপাল কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কী ‘জানি না’ এ শব্দ দুটোর উপর কোর্স করেছেন?”

“তাও জানি না।” এবার তার হাসিটা চওড়া হলো।

“আপনি কিন্তু সুবিধাবাদি শব্দ ব্যবহার করছেন
ডক্টর।”

“সুবিধাবাদি শব্দও আছে নাকি?” তার কপালে ভাঁজ।

“আছে বৈ কী! যখন কেউ কোনো কথাকে এড়িয়ে যেতে চায় তখন সবকিছুর উত্তর হিসেবে জানি না শব্দটা ব্যবহার করে। যখন মানুষ নিজের প্রয়োজনে এসব শব্দ ব্যবহার করে তখন সেটা সুবিধাবাদি শব্দ হয়ে যায়।”

“বাহ, তোমার তো কমন সেন্স আশ্চর্যজনক বেশি! ”

“এতদিন লাগল কেন তা বুঝতে, শুনি?”

সে হাসল। তারপর মিষ্টি করে বলল, “তাও জানি না।”

আমিও হাসলাম। বুঝতে পারলাম সে এখন আর আমার কোনো প্রশ্নের উত্তরই দিবে না। কিছুক্ষণ নীরবে কেটে গেল। তারপর আবার প্রশ্ন করল, “তুমি যাকে ভালোবাসো সে দেখতে কেমন নিরা?”

আমি এক পলক তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “জানি না।”
তারপর ঠোঁট টিপে হাসলাম। সেও হাসল বলল, “আমাকে নকল করছো কেন?”

“জানি না।”

“প্রতিশোধ নিচ্ছো তাই না?”

“হুম নিচ্ছি।

দুজনেই হাসলাম।

★★★

কথার মাঝখানে হঠাৎ নিরার ফোন বেজে উঠল। হাতে নিয়ে দেখল প্রকাশকের নম্বর। সে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ” কেমন আছো মাই ডিয়ার?” মাই ডিয়ার শব্দটা শুনতেই নিরার মন ভালো হয়ে গেল। প্রকাশক মানুষটা বেশ ভালো। তার বাবার বয়সী। সবসময় তাকে স্নেহ করেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকাশনী এখন তার। একসময় অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে এই প্রকাশনীকে দাঁড় করাতে। কিন্তু এখন বেশ নাম হয়েছে। তাই তিনি কঠোর পরিশ্রমীদের পছন্দ করেন। প্রায় নিরার সাথে পান্ডুলিপি ছাড়াও নানা বিষয়ে কথা বলেন। সৎ মানুষ স্যারের পছন্দ। অসৎসঙ্গ তিনি পছন্দ করেন না। নিরাকে পছন্দ করার অন্যতম কারণ সে সৎ ও মেধাবী। নিরার প্রথম বই তার প্রকাশনী থেকেই প্রকাশিত হয়েছে। এখনো যদি অন্য প্রকাশনী তার কাছে পান্ডুলিপি চেয়ে মেইল করে। তবে সে আগে স্যারকে জানায় তারপর সিদ্ধান্ত নেয়।

“ভালো স্যার। আপনি ভালো আছেন?”

“বেশ আছি।”

“তারপর বলো লেখা কতদূর?”

“প্রায় শেষের পথে স্যার। এন্ডিং নিয়ে কনফিউশানে আছি। আমার মনে চাচ্ছে স্যাড এন্ডিং দিতে। কিন্তু পাঠক কীভাবে নেবে সেটা নিয়ে বেশ চিন্তায় আছি। কী করব বুঝতে পারছি না। আপনার যদি সময় হয় একদিন আমি আপনার ও সম্পাদকদের সাথে কনফারেন্সে বসতে চাই। এটা নিয়ে আলোচনা করাটা জরুরি।”

“অবশ্যই মাই ডিয়ার। পাঠকের জন্য তোমার এত ভাবনা দেখে আমার ভালো লাগে। তবে আমি চাই তুমি মনের কথা শোনো। যাতে তোমার লেখায় স্বতন্ত্রতা থাকে।”

“জি স্যার অনেক ধন্যবাদ। আপনি আমার পথ সহজ করে দিলেন।”

“নিরা মা, উপন্যাসের নাম ঠিক করেছো?”

“করেছি স্যার।”

“গুড। তা কী নাম ঠিক করেছো?”

“সন্ধ্যা নামার পরে।”

“বাহ! বেশ নাম তো! নামটার মধ্যে একটা দুঃখী, দুঃখী ভাব আছে। থিমটাও যা শুনলাম তাতে নামের সাথে মিলছে। এবার তুমি ডেট ফিক্সড করে আমাকে জানাও কবে কনফারেন্সে বসতে পারবে। আমি সম্পাদকদের সাথে কথা বলে সময় জানিয়ে দেব।”

“জি স্যার ঠিক আছে।”

“ঠিক আছে মাই ডিয়ার। আজ তোমার ম্যামকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছি। আজ আমাদের ম্যারেজ এ্যানিভার্সেরি। তাই একটু ঘুরতে গিয়ে পুরনো স্মৃতিচারণ করব এই আর কি।”

স্যার যেভাবে কথাটা বললেন নিরা শব্দ করে হেসে ফেলল। “হ্যাপি ম্যারেজ এ্যানিভার্সেরি স্যার। হাজার বছর একসাথে থাকুন।”

“নো মাই ডিয়ার এত বছর তো একসাথে থাকা যাবে না। ইউ নো মেয়েরা কেমন হয়। তাই একসাথে হাজার বছর থাকাটা রিস্ক হয়ে যায়।” কথাটা বলে স্যার উচ্চ শব্দে হেসে উঠলেন।

নিরা এবার শব্দ করে হাসল। “স্যার আপনি এত রহস্য করে কথা বলেন না! আমার মনটা খারাপ ছিল আপনার ফোনটা দরকার ছিল। এখন মন ভালো হয়ে গেছে। ঠিক আছে স্যার, আজ আর আমি সময় নেব না। ভালো থাকবেন।”

“তুমিও ভালো থেকো মাই ডিয়ার।”

“হেভ আ নাইস ডে স্যার।”

“টু ইউ মাই ডিয়ার।”

ফোন ছেড়ে নিরা আনমনে কিছু একটা ভেবে হাসছে। তারপর কিয়ারার দিকে চোখ পড়তেই দেখল সে ফোনে ডুবে আছে। এতক্ষণ সে যে বসেছিল মনেই ছিল না।

“কিয়া দুঃখিত আসলে। প্রকাশক স্যার কল করেছেন।”

“কোনো সমস্যা নেই লিরা। তোমার পান্ডুলিপির কাজ শেষ?”

“আর তিন অধ্যায় বাকি আছে। তোমাকে সেটা বেটারিড করতে হবে।”

“অবশ্যই করব। এখন তুমি আমায় তোমাদের বাকি গল্পটা শোনাও তো। আমি অধৈর্য হয়ে যাচ্ছি।”

“সে রাতটা আমরা নানা গল্পে কাটালাম। দুজন দুজনের খুব কাছে চলে আসলাম। এত এত কথা বলেছি যে মনে হয়েছে আমরা একে অপরের খুব কাছের কেউ। তারপর যখন আমার মনে হচ্ছিল আমাদের মাঝের দেয়ালটা আমরা সরিয়ে দিতে পারছি। কিন্তু আমার ভাবনাকে ভেঙে দিয়ে এরপর দিন সকালে দিয়া আপু এসে আমাকে নানা কথা শুনিয়ে গেলেন। বলে গেলেন তার দুরবস্থার জন্য আমি দায়ী। আমি তার কাছ থেকে ডক্টরকে কেড়ে নিচ্ছি। তাছাড়া আরও অনেক বাজে কথা। সবচেয়ে খারাপ যে কথাটা ছিল সেটা হচ্ছে আমি নাকি শরীর দিয়ে ডক্টরকে কাবু করেছি। বিশ্বাস করো কিয়া এ কথাটা শুনে মনে হচ্ছিল কেউ আমার কানে গরম শিসা ঢেলে দিয়েছে। আরও একটা অদ্ভুত কাণ্ড সেদিন ঘটে। আমার শাশুড়ি মা হঠাৎ কোত্থেকে এসে দিয়ার গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। যে মানুষটা দিয়াকে বউ করে আনার জন্য আমাকে নানা কথা শুনিয়েছে সে আমার জন্য দিয়ার গায়ে হাত তুলেছে!”

শাশুড়ি মা দিয়াকে বলেছিলেন, ” ছি! দিয়া তুই শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এমন বাজে কথা বলতে পারলি? তুই কোন সাহসে আমার বাড়িতে ড্রিংকস করে এসেছিস? ঠিক করে তো নিজের পায়ে দাঁড়াতেও পারছিস না। আবার অন্যকে কথা শোনাচ্ছিস! তোর এত অধপতন কবে থেকে হলো!”

দিয়া তখন নিজের হুসে ছিল না। অকারণ হাসছিল আবার অকারণ কাঁদছিল। অতিরিক্ত ড্রিংকসের ফলে সে এমন ব্যবহার করেছে সেটা বুঝতে পারলাম। তাকে ধরে আমার রুমে শুইয়ে দিলাম। আমার শাশুড়ি বললেন, “গেস্ট রুমটা ঠিক করে দাও তো বউমা। দিয়াকে সেখানেই শুইয়ে দিবে। সবসময় নিজের বেডরুমে কাউকে ঘুমাতে দেয়া ঠিক না।”

এ কথাটা শুনে আমি চমক লাগা চোখে মায়ের দিকে তাকালাম। তিনি এ প্রথম আমায় বউমা বলে সম্মোধন করলেন। শব্দটা অতি সাধারণ তারপরও কেন যেন আমার দু’চোখ জলে ভরে গেল। বুকে ভেতর সুক্ষ্ম একটা অনুভূতি হলো। যা সম্পূর্ণ নতুন, সম্পূর্ণ অচেনা। আমার মনে হলো আমার জীবনে একাদশে বৃহস্পতি শুরু হয়েছে। একদিকে ডক্টরের চোখে আমার জন্য ভালোবাসা, অন্যদিকে শাশুড়ির মনে আমার জন্য মায়া। সবমিলিয়ে খুশিতেই মরে যাব এমন মনে হচ্ছিল। আমার ভাঙাচোরা জীবনটা যে গোছানো হতে চলেছে তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। বুঝতে পারছিলাম আমার জন্য সুখ অপেক্ষা করছে। শুধু বুঝতে পারিনি সুখের খামে মোড়ানো তা দীর্ঘ পৃষ্ঠার সম্পূর্ণ একটা দুঃখের বই ছিল। যার প্রতিটি লাইনে লেখা হচ্ছে আমার জন্য এক জীবন যন্ত্রণা।

জানো তো কিয়া অর্নব তখন খুব তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসত। যতক্ষণ বাসায় থাকত আমার চারপাশে ঘুরঘুর করত। ইশারায় বুঝাতে চাইত সে আমাকে চায়। কিন্তু মুখ ফুটে কখনো বলত না। অথচ আমি অপেক্ষা করছিলাম সে এসে আমায় বলুক ‘ভালোবাসি নিরা।’ কিন্তু গাধাটা কিচ্ছু বলত না। চারপাশে সারাক্ষণ যে ঘুরঘুর করত তা দেখে বেশ মজা লাগত আমার। গাম্ভীর্য সম্পূর্ণ একজন মানুষ কেমন বোকা বোকা আচরণ করছিল। আমি শুধু তা দেখে হাসতাম। আসলে প্রেম – ভালোবাসা অতি বুদ্ধিমান মানুষকেও বোকা বানিয়ে দেয়। যেমনটা ডক্টর হয়েছে।

প্রায় রাতে আমি দেখতাম সে বারান্দায় বসে ঘন্টার পর ঘন্টা নিকোটিনের ধোঁয়ায় নিজের যন্ত্রণাকে উড়িয়ে দিচ্ছে। প্রথম প্রথম এত স্মোক করতে দেখিনি। কিন্তু পরে পরে এসব দেখে আমি বুঝতে পারতাম সে আমার থেকে দূরে থাকতে পারছে না। অথবা বোকা, গাধা লোকটা মুখ ফুটে বলতেও পারছে না। তার কষ্টগুলো আমায় স্পর্শ করত। অথচ আমি নিরুপায় ছিলাম আমার পক্ষে সবকিছু নিজ থেকে বলা সহজ ছিল না। আজ বুঝি কিয়া যদি সেদিন অপেক্ষা না করে নিজের মনের সব কথা তাকে বলে দিতাম। যদি সিগারেটের পরিবর্তে নিজেকে তার কাছে সঁপে দিতাম তবে আজ হয়তো এমন কিছু স্মৃতি থাকত। যা আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত হত। না আমাদের শরীর মিলিত হয়নি এই নিয়ে কোনো আফসোস নেই। কিন্তু কেউ কারো ভালোবাসা কাউকে জানাতে পারছিলাম না এই নিয়ে বেশ আফসোস হচ্ছিল।

জানো কিয়া সব ঠিকঠাক চলছিল তখন। সেদিন শাশুড়ি মায়ের কথায় যখন গেস্ট রুম ঠিক করতে গেলাম। তখন স্টোর রুমে একটা জিনিস লাগবে বলে গিয়েছিলাম। সেটা খুঁজতে খুঁজতে ধূলো মাখা একটা ছবি দেখতে পেলাম। জানি না কেন সেটা আমায় টানছিল বারবার। তুলে নিয়ে শাড়ির আঁচলে মুছে নিয়ে অবাক হলাম। ছবিতে তিনজন পুরুষ দুজন নারী। এদের মধ্যে তিনজনকে আমি চিনি। বাকি দুজনকে কখনো দেখিনি তাও মনে হচ্ছিল দেখেছি। এই ছবিতে আমার শ্বশুরের পাশে আমার শাশুড়ি। তাদের পাশে আরও দুজন নারী পুরুষ। হতে পারে তারাও স্বামী – স্ত্রী। সব ঠিকছিল, অবাক হলাম এদের পাশে যে গাড়িটা তার সাথে দেখা যাচ্ছে আমার বাবাকে। এ ছবিটি বেশ কয়েক বছর আগের তা বুঝা যাচ্ছে। এ ছবির সবার বয়স খুব কম দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলাম না। এদের মাঝে আমার বাবা কেন! আর বাবা যদি আগে থেকেই তাদের জানতেন তবে আমাকে কেন কখনো বলেননি! আমি তো কখনো বাবার মুখে তাদের কথা পর্যন্ত শুনিনি। তবে কী এই পরিবারের সাথে আমার পরিবারের কোনো সম্পর্ক আছে যা আমার অজানা। সেটা কী হতে পারে! যা এত বছরেও বাবা সুকৌশলে গোপন করে রেখেছেন। আমি তখন কিচ্ছু জানতাম না। জানতাম না আমি কীভাবে প্রতিনিয়ত ঠকেছি। জানতাম না আমার সবচেয়ে কাছের মানুষগুলো আমাকে সবচেয়ে বেশি ঠকিয়েছে!
#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#বাইশ

ছবিটি দেখে মনে অনেকগুলো প্রশ্ন জাগল। সে প্রশ্নের উত্তর একমাত্র বাবাই দিতে পারেন। তাই ছবিটা লুকিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলাম। দিয়ার জন্য রুম ঠিক করে তাকে যখন গেস্ট রুমে আনতে যাব তখন দেখলাম দিয়া অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ডক্টরকে তখন কল দিলাম। সে এসে দিয়াকে দেখল।সে জানালো মানসিকভাবে খুব স্ট্রেস যাচ্ছে। অধিক চিন্তার এবং অধিক মদ্যপানের কারণে তার শরীর দূর্বল হয়ে পড়েছে। তাছাড়া খাওয়ায়ও অনিয়ম করছে খুব। সবটা শুনে আমি বললাম, “ও আজকে আমাদের রুমে থাকুক।” ডক্টর আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। মুখে কিছু বলল না। মা তখন রুমে আসলেন। এসে ওহিকে বললেন দিয়াকে ধরে গেস্ট রুমে নিয়ে যেতে। মা বলায় আমি আর কিছু বললাম না। ওহি ও আমি মিলে দিয়াকে নিয়ে গেলাম। তাকে শুইয়ে দিয়ে নিজের রুমে এসে বাবাকে কল দিলাম। আমার মাথায় এখন ছবির ব্যাপারটা ঘুরছে। আমার পরিবারের সাথে এই পরিবারের সম্পর্ক কী তা না জানা পর্যন্ত আমার শান্তি লাগছে না।

বাবা প্রথমবারে কল ধরলেন না। আবার দিতেই তার গলার স্বর শুনতে পেলাম, “কেমন আছিস মা?”

“ভালো বাবা। তুমি কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ, মা।”
“তোমার শরীর এখন কেমন?”

“মোটামুটি ভালোই।”

তারপর কিছুটা সময় নিলাম কথা গোছাতে। বললাম, “বাবা তুমি কী ডক্টর অর্নবদের পরিবারকে আগে থেকে জানতে? কোনোভাবে তাদের পরিবারের সাথে তোমার কোনো পূর্ব সম্পর্ক রয়েছে?”

বাবা কিছুক্ষণ সময় নিলেন। হয়তো কী বলবেন আগে তা গুছিয়ে নিলেন। বললেন, “তাদের সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই মা। হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন করছিস?”

“আমার প্রয়োজন আছে বাবা। আমি জানি এই দুই পরিবারের সাথে কোনো সম্পর্ক রয়েছে যা আমার অজানা। তাই আমি সত্যিটা শুনতে চাই বাবা?”

“তুই ভুল ভেবেছিস মা। এমন কিছু হলে তুই কী জানতি না?”

“আমি সেটাই তো বুঝতে পারছি না বাবা। তুমি বা তোমরা আমার কাছ থেকে কেন লুকিয়েছো সেটাই তো জানতে পারলাম না।”

“নিরা তুই কী আমাকে অবিশ্বাস করছিস?” বাবা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। আমার বাবা খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ। তাকে আমি জীবনে খুব কম সময় রাগতে দেখেছি। কিন্তু আচমকা তার রেগে যাওয়া আমার মনে সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিল। মানুষ ঠিক তখনই রেগে যায়, যখন কোনো প্রশ্নের উত্তর সে দিতে চায় না। কিংবা এমন কোনো সত্য আছে যা জানাতে চায় না বলেই রেগে যায়। আমি বুঝতে পারলাম বাবা এখন কিছুই বলবেন না। শুধু শুধু তাকে রাগিয়ে লাভ নেই। তাই বাবাকে বললাম কাল আমি বাড়িতে আসছি। তোমার সাথে কাল কথা হবে। কিছু দেখাতে চাই তোমায়।

“কী দেখাতে চাস?” বাবা অস্থিরতা ভরা গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

“কাল দেখা হলে বলব বাবা। আমি এখন রাখছি ভালো থেকো।”

বাবা আরও কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু আমি শুনলাম না। আমি আমার বাবাকে চিনি। তার শরীরের অবস্থা ভালো নয়। তাই উত্তেজিত হোক আমি চাইনি। তাই কল কেটে দিলাম। এবং ঠিক করলাম সকালেই বাবার কাছে চলে যাব। আমি জানি আমি গেলে বাবা আমাকে সব না বলে পারবেন না।

★★★

সন্ধ্যা নামতেই আমার মন খারাপ হয়ে গেল। নানা চিন্তায় মন, মেজাজ দুটোই খারাপ হয়ে আসছিল। দিয়ার বলা কথাগুলো তখনও আমার কানে বাজছিল। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। সন্ধ্যা হতেই নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। ডক্টর এসে আলো জ্বালাতেই আমি চোখের উপর হাত রাখলাম। ডক্টর বোধহয় আমার দিকে তাকিয়ে দেখেছিল। তারপর বলেছিল, “কাঁদছো কেন নিরা?”

আমি অবাক হলাম। সে কী করে বুঝল আমি কাঁদছি! আমি কাঠকাঠ গলায় বলেছিলাম, “কই কাঁদছি নাতো।”

“তোমার চোখের কোণে এখনো স্পষ্ট জলের দাগ দেখা যাচ্ছে নিরা।”

তার শীতল কণ্ঠে কথাটা শুনে আমি চমকে উঠি। এখন আর লুকিয়ে লাভ নেই৷ তাও তাকে এড়িয়ে যেতে বলেছিলাম, “আমার মাথা ধরেছে ডক্টর। আমি একটু ঘুমাতে চাই।”

“চলো তবে ওষুধ খেয়ে নাও।”

“লাগবে না। এমনিতেই সেরে যাবে।”

“ডক্টর ডাকছো আমাকে। আর ডাক্তারি করছো তুমি, অদ্ভুত তো! ”

“কেন বিরক্ত করছেন বলুন তো?”

“আমি সবটা শুনেছি নিরা। তুমি উঠে বসো তোমার সাথে আমার কথা আছে।”

“প্লিজ ডক্টর আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই।” আমার গলার স্বর চড়ল।

অর্নবের আমার কাছে এসে তার কাঁধ ধরে তুলে বসিয়ে দিল। অগত্যা আমাকে উঠতে হলো। বুঝতে পারলাম এ মানুষটা আজ আমার কোনো কথাই শুনবে না। বিছানায় হাঁটুর উপর চিবুক রেখে চুপটি করে বসে রইলাম। সেও কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমায় বলল, “অন্যের কথায় কষ্ট পাওয়ার কোনো মানে হয় না নিরা।”

“আমি কারো কথায় কষ্ট পাইনি।”

“পেয়েছো সেটা তোমার চোখ দেখলেই বোঝা যায়। দিয়া সুস্থ হলেই আমি ওর সাথে কথা বলব।”

আমি জানি না আমার কী হয়েছিল। রাগান্বিত গলায় বলেছিলাম, “বিয়ে করে ফেলুন না তাকে। তাহলেই তো সব ঝামেলা মিটে যায়। আপনিও আপনার ভালোবাসা পেয়ে গেলেন। দিয়া আপুও আপনাকে পেয়ে গেল।”

“দিয়া আমার ভালোবাসা?” ডক্টরের কপালে ভাঁজ পড়ল।

“হ্যাঁ, তাই তো। আপনাদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। নিশ্চয়ই ভালোবাসা ছাড়া হয়নি?”

“চুপ করো নিরা। আমি দিয়াকে ভালোবাসি না। দিয়ার সাথে আমার বিয়ের কথা পরিবার ঠিক করেছে। আমি নই।”

“বারণও তো করেননি!” আমার গলার স্বর তখনও চড়ে যাচ্ছিল।

“বারণ করিনি কারণ তখন আমার জীবনে কোনো রাগী পাগল, জেদি, আর একগুঁয়ে মেয়ে ছিল না তাই।” ডক্টরের চোখে রহস্য খেলা করছে, ঠোঁটের কোণে হাসি।

“প্লিজ! এত রহস্য করবেন না তো।”

“আমি কোনো রহস্য করছি না নিরা।”

আমি জানি না কিয়া কেন আমার এত রাগ হচ্ছিল। ডক্টর সাধারণভাবেই কথা বলছিল। আমি কেন যেন চিৎকার করে উঠেছিলাম। বলেছিলাম, “আপনি দিয়াকে বিয়ে করে নিন না। আমি বেঁচে যাই। কেন আপনার জন্য আমাকে মানুষের কথা শুনতে হবে। কেন মানুষ বলে আমি আপনাকে আমার শরীর দিয়ে বেঁধে রেখেছি। কেন এসব বাজে কথা আমাকে শুনতে হবে।” কথাগুলো বলতে বলতে আমি কখন ডক্টরের শার্টের কলার চেপে ধরেছি বুঝতেই পারিনি। আমি তখন রাগে, ক্ষোভে সাপের মতো ফোপাঁচ্ছিলাম। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছিল। তখন ডক্টর একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। আমার মুখটা তার দু’হাতে আঁজলা ভরে ধরে আমার অধরে নিবিড়ভাবে গাঢ় চুম্বন বসিয়ে দিল। আচমকা এমন আক্রমণের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমার শীরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। বুঝতে পারলাম আমার চোখের কার্ণিশ বেয়ে জলের ধারা নামছে। এটা বুঝতে পারছিলাম সে জল দুঃখের ছিল না। ছিল প্রাপ্তির। আমার প্রতিটি রক্তকণিকায় তখন সুখের বৃষ্টি নেমেছে। কোনো এক অপার্থিব সুখ আমায় ঘিরে ধরছিল চারপাশ থেকে। সেদিনের সন্ধ্যা নামার পরের সেই ক্ষণিকের মুহূর্তটি আমার মনে আজও গেঁথে আছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here