সন্ধ্যে নামার পরে পর্ব -০১

#সন্ধ্যে_নামার_পরে 🔞
ফাতেমা তুজ জোহরা
পর্ব-০১

নদীর পাড় ঘেঁষে একটা ছনের ঘর। ঘরে এক পাশে বসে চারজন ম-দ্য পানে ব্যস্ত। ঘরের মেঝেতে খড় বিছানো। তার উপর হাত পা বাঁধা অবস্থায় কাতরাচ্ছে এক তরুণী। দেহে একটা সুতোর ছিটেফোঁটাও নেই। এমতাবস্থায় শরীরে চুলকোনি হচ্ছে খড়ের জন্য। ব্যথাতুর দেহখানা শীতকালীন নদীর বাতাসে ঠান্ডায় নীলচে হয়ে আসছে। “এই বুঝি মরন আসবে” এই ভেবে কাতরায় তরুণী। তবে দেহে আওয়াজ করার মতোও শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। মনে মনে সে চাচ্ছিলো মৃ-ত্যুকে আলিঙ্গন করতে। কিন্তু তা আর পারছে কই ? ছেলেগুলোর নামগুলো যতটা না সুন্দর, এরা নামের থেকেও কয়েকগুণ বিভিষিকাময়। এরা একেজন কোনো হা-য়ে-নার থেকেও কম নয়। ছেলেগুলোর মধ্যে কেউ একজন ম-দ্য পান রেখে উঠে এসে নিজের গায়ের একখানা শীতবস্ত্র তরুণীর গায়ের উপর ছুড়ে ফেলে আর তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,

“এত তারাতাড়ি মূর্ছা গেলে হবে নাকি ? শীতের রাত বে…শ লম্বা। আর রাত এখনো দুই প্রহর বাকি। মধ্য প্রহর হতে হতে একটু বিশ্রামের সুযোগ দিলাম তোকে।”

___________

সন্ধ্যা হয়ে এলো। বিকেল শেষ হতে না হতেই কুয়াশার আবরণে ঢাকা পড়তে শুরু করে চারপাশে। ফাইজা কলেজ শেষ করে তার বান্ধুবী চারুর বাসায় গিয়েছিল প্রেকটিক্যাল খাতা আনতে। যেকারণে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যের কাছাকাছি। ফাইজাদের বাড়ি ফেরার মাঝপথে রাস্তার দুপাশে শাল-সেগুন গাছের বাহার। এমন সময় এই রাস্তায় তেমন কেউ থাকেনা বললেই চলে। তারউপর শীতকালীন সময় মানুষের চলাচল সন্ধ্যে হওয়ার আগেই কমে আসে। এলাকার বড়লোক বাপের বখে যাওয়া ছেলেদের ছাড়া অন্য কাউকে তেমন চোখে পড়ে না। মাঝেমধ্যে এই রাস্তায় ডাকাতিও হয়। এই ভয়ে সহজে কেউ একা এই রাস্তায় হাটেও না। বিশেষ করে সন্ধ্যা ঘনালে। বিকেল বেলা অন্য ক্লাসমেটদের সাথে বাসায় ফেরে ফাইজা। তখন এসব বখাটের দল তাতের লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে ভুল করেনা। মাঝেমধ্যে কিছু তিক্ত বাক্য কানে পচন ধরায়। এদের ভয়ে ফাইজা একা চলাচল করে না কখনো। কিন্তু আজকে দেরি হওয়াতে নিজের কপালে নিজেই দুটো চড় দিয়ে দ্রুত হাটতে হাটতে নিজেকে নিজে বলল,

“কেন যে ছুটির পর চারুর বাসায় গেলাম। এরচেয়ে না হয় একদিন লেট করে স্যারের বকাটাই খেতাম। একটু বুদ্ধি খাটালে এখন একা একা ফিরতে হতো না, ধুর। কোনো শেয়াল শকুনের চোখে যেন না পড়ি।”

সেটাই হলো, যেটা ফাইজা ভয় পাচ্ছিলো। চারজন বাইকের উপর একেকজন একেক স্টাইলে বসে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। কুয়াশা আর ধোঁয়া মিলে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ফাইজার পা যেন সামনে চলতে চায়না। মাঝেমধ্যে ভাবছে উলটে দৌড়ে চলে যাবে কিনা। বক্ষপিঞ্জরের ভেতর ভিত হৃদয়ের স্পন্দনটা এত তারাতাড়ি উঠানামা করছে যে, ফাইজার মনে হচ্ছে এই বুঝি হার্ট ছিড়ে বের হয়ে আসবে। ফাইজা খুব দ্রুত ওদের এড়িয়ে চলে যেতে চেষ্টা করলো। পিয়াস নামের ছেলেটা বলল,

“রাদিন, শীততো অনেক পড়লো। এই শীতে শরীর গরম না হলে চলে নাকি ?”

মাহিম দাঁত কেলিয়ে বলল,

“আরেহ এসব আর বলতে হয় নাকি। দেখিস না হটপট সামনে আছে। জাস্ট গরম হয়ে যা। হা হা হা…”

ফাইজার কানে এই কথাগুলো স্পষ্টই এসে পৌঁছালো। তার অন্তরাত্মা যেন এই বুঝি থেমে যাবে। মাহিম নামটা যত সুন্দর, তার হাসিটা তারচেয়ে কয়েক গুণ বিশ্রি লাগলো ফাইজার কাছে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নাম জপা যেন আরো কয়েকগুলো বেড়ে গেলো।

ফাহাদ বলল,

“তোরা আসলেই একেকটা গাধা। খাবার সামনে রেখে কথা বলতে নেই, জানিস না ? বিরিয়ানির স্বাদ গরম গরমই মজা, বুঝলি !”

রাদিন বলল,

“পাখি তো উড়ে যাচ্ছে। এলাকার পোষা পাখি মাম্মা। এভাবে বসে থাকবি নাকি ?”

পিয়াস এক বিশ্রি হাসি দিয়ে বলল,

“আরে মাম্মা…”

পিয়াস শুধু বাকি তিনজনকে ইশারা করলো। বাকিরা বুঝে গেলো তাদের কি করতে হবে। ফাইজা এতক্ষন দ্রুত পা চালাচ্ছিলো। এবার প্রাণপনে বাড়ির দিকে দৌঁড় শুরু করলো। এই গাছগাছালী পেরিয়ে লোকালয়ে পৌঁছাতে পারলেই বুঝি আজকের মতো বেঁচে যাবে। মনে মনে শপথ করছে ফাইজা, আজকে ভালোই ভালোই পার পেলে আর এই ভুল জীবনেও করবে না।

_________

ভুলতো ভুলই, সেটা একবার হোক বা বারবার। ভুলের নাম বরাবর “ভুল” ই থাকে এবং থাকবেও। এই অনিচ্ছাকৃত ভুলটা ফাইজা করে ফেলেছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে এলো। তবুও ফাইজা বাড়ি ফিরলো না। ফাইজার বাবা-মা, দাদা-দাদি আর ছোট ভাইও চিন্তায় পড়েছে ফাইজার বাড়ি না ফেরা নিয়ে। ফাইজার হাতে কোনো ফোনও নেই যে যোগাযোগ করে জানতে চাইবে কোথায় আছে। ফাইজার বাবা আর দাদা মিলে ফাইজাকে খুঁজতে বের হয়ে গেলো। এই এলাকায় ফাইজার সাথে যারা পড়ে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফাইজার খোঁজ নেয় দুজন মিলে। কিন্তু কেউ তেমন কোনো তথ্য দিতে পারলো না। শেষমেশ ফাইজার আরেক সহপাঠী রনি ফাইজার বাবাকে বলল যে,

“ফাইজা ওর বান্ধুবীর বাসায় যাবে প্রেক্টিক্যাল খাতা নিতে এমন কিছু শুনেছিলাম আমি। তবে আমি পুরোপুরি শিওর না। আপনি চারুকে কল করে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”

ফাইজার বাবা রনির এতটুকু কথাতে যেন মেয়ের খোঁজ পাবার আশার আলো দেখলেন। কিন্তু তবুও কোথাও যেন কিছু একটা স্পর্শেন্দ্রি কাজ করছে যে, মেয়েটার কিছু বুঝি হয়েছে। সন্তানের উপর বিপদ আসলে বাবা মায়ের মনে যেন সেই খবর সৃষ্টিকর্তা প্রেরণ করে দেয়। এ যেন সন্তানদের আগলে রাখার এলার্ট। আদরিনী মেয়ের খোঁজ নিতে এখন বাবার মস্তিষ্ক এখন অনেক কিছু মনের ভেতর নিক্ষেপ করছে। ফাইজার বাবা রনির কাছ থেকে চারুর নম্বর নিয়ে চারুকে কল করে ফাইজার খোঁজ নিতে। বেশ কয়েকবার কল করার পরেও যখন চারু কল রিসিভ করছিল না তখন ফাইজার বাবার চিন্তা যেন মগজের ভেতর টগবগিয়ে উঠছিল। তবুও তিনি থেমে চিলে না। শেষ কল রিসিভ করে চারু। ফাইজার বাবা তার পরিচয় দেয়ার পর ফাইজার কথা জিজ্ঞেস করলে চারু জানায় যে, ফাইজা অনেক আগেই চারুর বাসা থেকে চলে এসেছে। ফাইজার কোনো খোঁজ পেলে যাতে চারু ফাইজার বাবাকে জানায় এটা বলে ফাইজার বাবা ফিরোজ কলের লাইন কেটে দেন।

ফাইজার বাবা-দাদা বাড়ি ফিরে গেলেন। ফাইজার কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো নাকি এই বলে ছুটে আসে ফাইজার মা, দাদী আর ছোট ভাই। ফিরোজ আর দাদা রফিকের মুখাবয়বের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছোট ছেলে মিদুল বলে উঠলো,

“বাপ-দাদায় আফার খোঁজ পায়নাই আম্মা। খোঁজ পাইলে চেহারা দুইখান এমন অমাবস্যা রাইতের মতো লাগতো না।”

ফাইজার মা মিনা বেগম আর দাদি আসমা বেগম কান্নার রোল ফেলে দিলো। “ফাইজাকে পাওয়া যাচ্ছেনা” এই কথা এক কান দুই কান করে যেন পুরো এলাকা ছড়িয়ে গেলো। কেউ কেউ এসে ফাইজাদের বাড়ির উঠানে এসে কোলাহল করছে। দুই একজন শান্তনা দিলেও বাকি আর দশবারো জনই যত সব উল্টাপাল্টা কথা বলছিল। ফিরোজের কানে সেসবে পৌঁছালেও তেমন কিছু বলছে না।

একজনের কথা কানে পৌঁছালো মিদুলের। একজন বলছিল,

“যেই রঙচঙে মাইয়া, দেখো গিয়া কোন নাগরের লগে মনে অয় ভাঙছে।”

বোনের নামে কালির দাগ লাগানো মিদুলের সহ্য হলো না। মিদুল এবার চেঁচিয়ে উঠলো এই কথাটা বলা মহিলার উপর। কয়েক কদম এগিয়েও গেলো সেদিকে। চেঁচিয়ে বলল,

“আপনাগো বাড়ির মাইয়ার মতো কি আর সবার বাড়ির মাইয়াগোরে মনে করেন ? নিজের মাইয়াতো বিয়ার আগেই এক বাচ্চা পয়দা করলো। বাচ্চা রাইখা বিয়া দিছেন, স্বামী রাইখা বিয়ার রাইতে প্রেমিকের লগে ভাগছে। নিজের মাইয়াই ঠিক নাই আবার অন্যের বাড়ির মাইয়ার গায়ে কাদা ছিটাইবার আইছেন ? বাইর হন এক্ষন এই বাড়ি থিকা।”

মহিলাটা মিদুলের কথার উত্তর দেবে এই সময়টুকু মিদুল তাকে দিলো না। একপ্রকার ঠেলেই বাড়ি থেকে বের করে দিলো। ইনি মহিলা না হয়েভ একজন পুরুষ হলে নির্ঘাত এতক্ষণ মিদুল তাকে ধো-লা-ই করে দিতো। বাকিরাও ধীরে ধীরে চলে যায়। মিদুল মাঝ উঠানে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। দু’হাতের আঁজলায় চোখ মুখ ঢেকে কান্না লুকিয়ে মনে মনে বলল,

“আফা, কই আছো তুমি ? কই খুজবো তোমারে আমি ?”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here