সন্ধ্যে নামার পরে পর্ব -০২+৩

#সন্ধ্যে_নামার_পরে
ফাতেমা তুজ জোহরা
পর্ব-০২

রাত প্রায় দশটার বেশি বাজে। অনেক খোঁজাখুঁজি হলো ফাইজার। কিন্তু কোনো ক্লু’ই পেলো না। ফাইজা এবার এইচএসসি পরিক্ষার্থী। মিদুল ফাইজার দু’বছর এর ছোট। ছোট হলেও মিদুলের বুদ্ধি বেশ ভালোই। শান্তশিষ্ট ছেলেটা পরিবারের প্রতিটা সদস্যের ব্যাপারে খুবই প্রোটেকটিভ। বোনের নিখোঁজ হওয়াতে তার মাথায় এখন নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। বোনকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে, আশেপাশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে এসব ভাবছে মিদুল।

মিদুল তার মা-দাদিরর কাছে গিয়ে বলল,

“আম্মা; দাদি, তোমরা এই বিলাপ কেন করতাছো উঠানে বইসা ? মানুষজন আইসা আরো খারাপ খারাপ কথা ছড়াইয়াতাছে। জানোনা না, কিছু মানুষের কাজই হইলো কোনো জিনিসরে তিল থিকা তাল করা। বাইরে বইসা কান্দাকাটি না কইরা নামাজে বইসা কান্দাকাটি করো। আল্লাহয় যাতে আফারে হেফাজতে রাখেন। উপর ওয়ালা ছাড়া আর কেউ সাহায্য করেনওয়ালা নাই। এইখানে আর সময় নষ্ট কইরো না।”

তারপর দিপু চেয়ারে বসা বাপ-দাদার কাছে গিয়ে বলল,

“আব্বা, আমাগো থানায় যাওয়া উচিৎ। আমরা অন্তত জানি যে আফায় স্বইচ্ছায় অন্যকোথাও যাইয়া আড্ডা মারোনের মাইয়া না। সে সবসময়ই নিয়মের মইধ্যে চলে। মনে কুডাক ডাকতাছে আব্বা। আফার লগে ভালো কিছু হয় নাই। এখনি থানায় যাই, চলেন।”

রফিক ফিরোজকে বললেন,

“তোর পোলায় কিন্তু হক কথাই কইছে। চল বাজান থানায় যাই।”

ফিরোজ বলল,

“আব্বা, আপনার বয়স হইছে। এত দৌঁড়ঝাপের মধ্যে আপনার যাওয়া লাগবো না। আমি আর মিদুল যামু থানায়। আপনি বাড়িতে থাকেন। দুইজন মহিলারে তো একলা বাড়িতে রাইখা যাওয়া যাইবো না। কখন কি ঘইট্টা যায় তার ঠিক নাই। আমি আর মিদুল যাইতাছি, আপনি থাকেন।”

ফিরোজ তার মা আসমা এবং স্ত্রীকে “থানায় যাইতাছি” বলে মিদুলকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন থানার উদ্দেশ্যে। বউ শ্বাশুড়ি মিলে অযু করে নামাজে বসে পড়লেন। আকাশপানে দু’হাত তুলে মোনাজাতে কেউ চাইলো নাড়ি ছেঁড়া ধনের নিরাপত্তা আর কেও চাইলো নাতনীর সুস্থ্য ভাবে বাড়ি ফেরা নিয়ে। একটা গৃহে একটা মেয়ে থাকা মানে আল্লাহর রহমত। আর এই রহমতের উপর যারা লালসার হাত বাড়ায়, তাদের অন্তরাত্মা হয়তো মানুষের বৈশিষ্ট্য দিয়ে তৈরি করা হয়নি। মেয়ে মানুষের সম্মান কচু পাতায় জমে থাকা পানি মতো। পাতার একটু নাড়াচাড়াতেই যেমন সেই পাতায় আগলে রাখা জমানো পানি নিমিষেই মৃত্তিকায় বিলীন হয়ে যায়, মেয়ে মানুষের সম্মানও ঠিক আগলে রাখা কচু পাতার পানির ন্যায়। একে খুব যত্মে আগলে রাখতে হয় সবসময়। বলা যায় না, কখন কোন বাতাসে পাতা নড়ে পড়ে যাবে সম্মানের পানিটুকু।

ধর্ষনের স্বীকার মেয়েটাকেই সবসময় ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সমাজের মানুষ গুলো নকশীকাঁথা সেলাইয়ে যেমন বারবার সুচের ফোঁড়ন কাটা হয়, তেমনি সুচের মতো ফোঁড়ন কেটে খোঁচা দিয়ে মজা পায়। বারবার ম-রে যাবার উৎসাহ দেবে। কিন্তু কেন ? একটা ছেলে যে কিনা একটা মেয়ের সম্মান লুন্ঠন করে চরিত্রে দাগ লেপন করলো, তাকে কেন এসব শুনতে হয় না ?

__________

থানায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় বারোটা ছুঁইছুঁই। কেননা মিদুলদের এলাকা থেকে বেশ অনেকটাই দূরে। মিসিং ডাইরি করার জন্য কর্মরত পুলিশের কাছে মিদুল সব সুন্দর করে গুছিয়ে বলল। মিদুল পুলিশকে এটাই বুঝাতে চাইলো যে, ফাইজা নিজ থেকে নিখোঁজ হয়নি। তাকে নিখোঁজ করা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তা যেন মিদুলদের কথা কানেই তুলছেন না, ডাইরি করাতো দূরে থাক। ফিরোজ আর মিদুল মিলে অনুনয় বিনয় করছে এই মিসিং ডাইরি করতে এবং ফিজাকে খুঁজতে তাদের সাহায্য করতে। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তা বারবার বলছে যে, চব্বিশ ঘন্টা না হওয়া অব্ধি মিসিং ডাইরি তিনি লিখবেন না। লিখতে পারে তবে একটা শর্তে। পুলিশ কর্মকর্তার শর্ত এমন ছিল যে, যদি তার পকেট এই মুহুর্তে গরম করে দেয়া হয় তবেই তিনি এখন মিসিং কমপ্লেইনে হাত দেবেন। নয়তো আগামী চব্বিশ ঘন্টার আগে কোনো কার্যক্রমই তিনি করবেন না। পুলিশ কর্মকর্তার এমনতর শর্ত শুনে মিদুলের ইচ্ছে হচ্ছিল যে, আগ্নেয়গিরি থেকে এক বালতি লা-ভা এনে পুলিশ কর্মকর্তার মাথায় ঢেলে দিতে। তাহলে শুধু পকেট না, সব কিছুই যথার্থ গরম হবে।

ফিরোজকে নিয়ে মিদুল থাকা থেকে বের হয়ে আসে। এত রাত হওয়ায় বাড়ি ফেরার জন্য কোনো গাড়িও পাচ্ছিলো না। উপায়ান্ত না পেয়ে পুলিশ স্টেশনের সামনেই এক বেঞ্চিতে বসে রইলো বাবা-ছেলে। এমন সময় রফিক কল করলেন ফিরোজের ফোনে। ফিরোজ একটু আগের ঘটনা তার বাবার কাছে স্পষ্ট করে বললেন। আজকে রাতে আর বাড়ি ফিরতে পারবেন না এটাও ফিরোজ জানিয়ে দিলো তার বাবা রফিককে। কল কাটার পর রফিকের মগজ যেন ঘুর্ণিপাকের মতো ঘুরতে লাগলো। কয়েক সেকেন্ডেই রফিক চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন। বারান্দায় পড়ে যাওয়ার শব্দে বউ-শ্বাশুড়ি ছুটলেন সেদিকে। বারান্দায় স্বামীকে বেহুস অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করলেন আসমা। দ্রুত বারান্দাতেই পাটি বিছিয়ে শ্বশুরের মাথায় পানি ঢালা শুরু করলেন মিনা।

________

মাঝরাতে উপনিত হলো সময়। পিয়াস এক গ্লাস ম-দ নিয়ে ফাইজার মাথার কাছে হেলে দুলে এসে বসলো। গ্লাসটা ফাইজার মুখের সামনে ধরে খেতে বলল পিয়াস। কিন্তু ফাইজা নাচোক করলো খেতে। পিয়াসের রাগ উঠে গেলো ফাইজার নাকোচ করাতে। ফাইজার মুখে চেপে ধরে জোর পূর্বক ঢেলে দিলো। বিশ্রি এক স্বাদে ফাইজার পেটের নাড়িভুড়ি যেন সব পাকিয়ে যাচ্ছিলো। বেশ কিছুক্ষণ কেশে থামার পর পিয়াস ফাইজাকে হেঁচকা টানে তুলে বসায়। তারপর মুখোমুখি হয়ে পিয়াস ফাইজাকে বলল,

“এত দেমাগ কিসের তোর ? এত দেগাম কার থেকে সাপ্লাই করিস বলতো ? তাকে আমার একটু দেখার আছে”

ফাইজা ক্লান্ত, ধীর এবং কিছুটা রাগ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,

“এত প্রশ্ন কেন করেন ? আমাকেতো খুবলাইয়া খাইতে আনছেন। খাইয়া ফেলেন একেবারে। মাইরা ফেলেন আমাকে। বিনা দোষে আমার গায়ে আপনাদের নোংরা হাতের কালিমা লেপন করে দিয়েছেন। এইখান থেকে যদি একবার বের হইতে পারি, কসম… আমি আপনাদের একটাকেও দুনিয়ার এক বিন্দু বাতাসও নিতে দেবো না।”

পিয়াস খুব মনোযোগ দিয়ে ফাইজার চোখাচোখি হয়ে এই কথা গুলো শুনলো। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর পিয়াস একটা অট্টহাসি দিলো। পিয়াসের হাসির আওয়াজে রাদিন, মাহিম আর ফাহাদ সেদিকে ঘুরে তাকায়। হাসতে হাসতে পিয়াস হুট করেই চোয়াল শক্ত করে ফাইজার গালে চড় বসিয়ে দেয়। দুগালে পরপর কয়েকটা চড় পড়াতে ফাইজা মাথা ঘুরে পড়ে যায়। মাড়ি, ঠোঁট, দাঁতের চাপে গাল কেটে ফাইজার মুখ বেয়ে র-ক্ত বেয়ে পড়া শুরু করলো। পিয়াস ফাইজাকে আবার তুলে বসায়। ফাইজা বসতে পারছিলো না। পিয়াস এক হাতে ফাইজার ঘাড়ে চেপে ধরে আরেক হাতে র-ক্তা-ক্ত মুখে চেপে ধরে বলল,

“জমের ঘর বেঁধে আসিস নাই। বেশি চাপা চালাবি তো এখানেই খু-ন করে দেবো। মশার মতো দু’আঙ্গুলে চাপ দিলেই পি-ষে যাবি। আমি কে চিনিস ? আমি হলাম রাঘব বোয়াল। আর তুই হলি পানির পোকা, চিংড়ি মাছ। তুই আমার একটা চুলও ছুঁতে পারবি না। আবার সাহস দেখানো হচ্ছে। বেঁচে থাকতে চাস তো একটা কথাও বলবি না।”

ফাইজার গাল বেয়ে ঝড়ছে অশ্রুধারা। এই অশ্রুসিক্ত মায়াভরা নেত্রযুগল দেখেও যেন এদের হৃদয় কাঁপে না। যে অঙ্গে কখনও ফুলের টোকাও পড়েনি, সেই পরম যত্মে সংগ্রহীত অঙ্গখানা আজ একদল হায়েনার ভোগদখলে। ফাইজা পিয়াসাকে বলল,

“আল্লাহই ভালো জানেন যে আমি কতটা পবিত্র ছিলাম। তোরা আজ সেইটা অপবিত্র করলি। তুই বোয়াল হোস বা রুই-কাতলা, এর হিসেব তোদের প্রত্যেককেই চুকাতে হবে। এক চুল পরিমাণও ছাড় পাবি না তোরা।”

পিয়াস ছুঁড়ে ফেললো ফাইজাকে। বাকী সঙ্গিদের ডাক দিলো। শুরু হলো শকুনের মাংসপিণ্ড খুবলে খাওয়ার আনন্দ। ফাইজার আর্তনাদ এই ঘরেই আটকে রইলো। কি দোষ ছিল ফাইজার ? বিনা কারণে কেন এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হলো তাকে ? এই প্রশ্নের উত্তর কি দেবে সমাজ ? বখে যাওয়া সমাজ থেকে এমন কয়েক ডজনকে ডজন বখে যাওয়া ছেলের উৎপত্তি। একটা সুন্দর মার্জিত, শিক্ষিত পরিবারের ছেলে কেন এমন করবে ? বখে যাওয়া ছেলে আর বখে যাওয়া সমাজ, উভই ভিষণ ভয়ঙ্কর।
#সন্ধ্যে_নামার_পরে
ফাতেমা তুজ জোহরা
পর্ব-০৩

মশার জ্বালাতন আর শীতের হীম শীতল বাতাসের সাথে মাথা ভর্তি চিন্তায় ফিরোজের চোখ ভাড় হয়ে আসছে। মেয়ের চিন্তায় কি করবেন তা ভেবে কুল-কিনারা পাচ্ছেন না। মিদুল সামনের দিকে কিছুটা ঝুকে বসে দুহাতের আঁজলায় মুখ ঢেকে রেখেছে। মিদুল চায় না যে, বাবার সামনে অনিচ্ছায় নেত্র থেকে গড়িয়ে পড়া দুফোঁটা অশ্রু দেখুক। কারণ ফিরোজ একদিন মিদুল কান্না করা অবস্থায় বলেছিল,

“তুমিতো পুরুষ মানুষ, তাইলে কানতাছো কেন মাইয়া মাইন্সের মতো ? পুরুষ মানুষ পরিস্থিতি ভেদে হইতে হয় পাথরের মতো শক্ত আবার কখনো ডিমের কুসুমের মতো নরম। পুরুষ মানুষ হইলো গিয়া ঘরের খুঁটি। খুঁটি ঝড়তুফানে শক্ত অবস্থানে না থাকলে ঘর ভাইঙা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শক্ত অবস্থানে থাইকা ঝড় থামার অপেক্ষা করা লাগে। তুমিও ঠিক সেই খুঁটির মতো হইবা। বিপদে ভাইঙা পড়বা না। তুমি ভাইঙা পড়লে তোমার সাথে জড়াইয়া থাকা মানুষগুলাও ভাইঙা পড়বো।”

মিদুল চাইছে নিজেকে শক্ত রাখতে। কিন্তু বোনের সাথে কাটানো সুখকর স্মৃতিগুলো বারবার সুচের মতো স্মৃতি স্পটে খোঁচা দিচ্ছে। মানুষের মস্তিষ্ক খুবই রহস্যময়। যখন আমরা খুব প্রিয় কাউকে হারানোর ভয় পাই, তখন মস্তিষ্ক আমাদের সামনে সেই প্রিয় মানুষটার সাথে কাটানো সুন্দর মুহুর্তগুলো আয়নার প্রতিচ্ছবির মতো চোখে প্রতিফলন ঘটায়। এতে কিন্তু আমরা শান্তনা পাইনা। বরং হারানোর অনুভূতিটা প্রবলভাবে আমাদের গ্রাস করে। ফাইজার পরিবারের প্রতিটা সদস্য এখন এই মারাত্মক অনুভূতির মধ্যে এখন বিরাজ করছে।

রফিকের মাথায় প্রায় আধঘন্টা যাবত পানি ঢালা শেষে তার জ্ঞান ফিরে আসে। আসমা স্বামীর পাশেই বসে আল্লাহকে ডাকছিলেন। বুড়োটা কি তাকে রেখেই পরপারে পাড়ি জমাবে ? এই চিন্তায় আসমার প্রাণ ওষ্ঠাগত অবস্থা হয়েছিল। স্বামীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অশ্রু বিসর্জন করছিলেন। জ্ঞান ফিরলে মিনা পানি ঢালা বন্ধ করে। আসমা স্বামীর মাথাখানা নিজের উরুর উপর নিয়ে নিজ আঁচল দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিলেন। মিনা নারকেল তেলের বোতল নিয়ে ছুটে এসে আসমার হাতে দিলো। আসমা সযত্নে রফিকের মাথায় তেল মেখে দিলেন। মিনা পাশে থেকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছিলো। রফিক সুস্থতা বোধ করার পর পুলিশ স্টেশনের ব্যাপারটা আসমা এবং মিনাকে বলে। এটা শোনার পর মিনা হুঁহুঁ করে কেঁদে উঠলো। মিনার বারবার মনে হচ্ছে, তার কলিজার ধনের বড় বিপদ। এত বড় বিপদ যে সেখান থেকে রক্ষা পাওয়া মুশকিল। মায়ের মন সবচেয়ে সংবেদনশীল জায়গা। সন্তানের বিপদআপদ যেন তাদের মন আগে খোঁজ পায়।

_________

শেষ রাতের দিকে পিয়াস, রাদিন, মাহিম আর ফাহাদ সেই জায়গা পরিত্যাগ করলো। ফাইজা এখনো বেঁচে আছে কিনা সন্দেহ। চারজন একসাথে ফাইজার উপর যেই পাশবিক নির্যাতন করে এটা সহ্যের লিমিট ক্রস করে। ফাইজার কথায় ওদের যেই ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল, তা পুরোটাই ফাইজার উপর প্রয়োগ। ফাইজার বাঁচা মরা নিয়ে তারা ভাবেনি। ওরাতো বদ্ধ উন্মাদের থেকেও ভয়ঙ্কর। র-ক্তা-ক পুরো দেহ ফাইজার। এতটাই পাষণ্ড ওরা। ফাইজার দেহ নিথর হয়ে গেলে তারা চারজন ভেবেছে যে ফাইজা মারা গিয়েছে। রাদিন সবার উদ্দেশ্যে বলল,

“হেই ব্রো, এর প্রাণ পাখি কি উড়াল দিলো নাকি ? ”

পিয়াস বলল,

“ওর প্রাণ পাখি উড়ে যাক বা ধরাশায়ী হয়ে যাক, তাতে কার কি ?”

মাহিম বলল,

“আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়া উচিৎ। শেষ রাত এখন।”

ফাহাদ বলল,

“একে কি করবি ? এভাবেই থাকবে নাকি এখানে ?”

রাদিন বলল,

“বোতল একটা ভেঙে ওর মখমলের মতো পে-টে ঢু-কি-য়ে দিই। তারপর পাশের নদীতে ফেলে দেবো। কারো নজরে পড়লে ভাববে খু-ন করেছে কেউ। আমরা বেঁচে যাবো।”

পিয়াস বলল,

“এত পণ্ডিতি করার দরকার নাই। বনের শেয়ালগুলো দেখবি মাংসের লোভে এসে একে শান্তির ভোজন করে যাবে।”

মাহিম বলল,

“আমরাই বা শেয়ালের থেকে কম কিসে ? মজা পুরোই লুটে নিয়েছি হা হা হা…”

ফাইজার দেহ সেভাবেই ফেলে চারজন চলে গেলো। ফাইজার এমন করুন অবস্থা কোনো স্বাভাবিক মানুষ দেখলে ভয়ে কেঁপে উঠবে। আচ্ছা ফাইজা কি বেঁচে যাবে, নাকি মৃত্যুর কাছে হার মেনে নেবে ? আদৌও কি কেউ তাকে খুঁজে পাবে ? মিলবে কি কোনো আশার আলো ? পাবে কি শাস্তি এই হায়েনার দল ?

________

ভোরের দিকে গাড়ি চলাচল শুরু হলে মিদুল তার বাবাকে নিয়ে থানা থেকে ফিরে আসে। বনের রাস্তার মোড় থেকে হেঁটেই বাড়ি পৌঁছাতে হয়। ফিরোজ আর মিদুল ক্লান্ত দেহে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলো। তখনো ভোরের আলো ফুটেনি। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটের আলো যেন কুয়াশা গিলে খাচ্ছে। এতই কুয়াশাছন্ন আজকে যে দেখে মনে হচ্ছে কুয়াশারও মন খারাপ। সেই মন খারাপটা অন্য কোনো এক মন খারাপের দেহের সাথে লেপ্টে গিয়ে বন্ধুত্ব করতে চাইছে। দু’তিন কদম দূরে লাইটের আলো পৌঁছায় না। রাস্তার এক পাশে দুজন হাঁটছে। হঠাৎ মিদুলের মনে হলো কিছু একটায় সে পা ফেলেছিলো। ভাবতে ভাবতে দু’কদম এগিয়ে গেলেও আবার পিছিয়ে যায় কিসে পা পড়লো তা দেখার জন্য। দেখতে পেলো একটা হিজাব ব্রোঞ্জ। ব্রোঞ্জটা দেখে মিদুলের বুকের ভেতর ধুক করে একটা আঘাত এলো। কারণ ? কারণ, ব্রোঞ্জটা কুইন লেখা। হুবহু একই ব্রোঞ্জ মিদুল ফাইজাকে জন্মদিন উপলক্ষে উপহার দিয়েছিলো। ফাইজার ব্রোঞ্জ ভিষণ পছন্দের। বেশি পছন্দের বলে প্রায় অনেকগুলো ব্রোঞ্জ ফাইজা সংগ্রহ করেছে। ফাইজাকে খুশি করতে ফাইজার পছন্দ অনুযায়ীই মিদুল এই ইংরেজিতে কুইন লেখা হিজাব ব্রোঞ্জটা গিফট করে। অনেক দোকান ঘুরে এই কুইন লেখাটা পছন্দ করে কিনেছে মিদুল। কারণ প্রতিটা ভাইয়ের কাছেই তাদের বোন এক মহা সম্মানিতা রানী।

মিদুল ব্রোঞ্জটা হাতে তুলে ভালো করে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখলো। ফিরোজ মিদুলকে যখন জিজ্ঞেস করলো যে, মিদুল কেন পিছনে ফিরে গেলো তখন মিদুল হাতে তুলে নেয়া ব্রোঞ্জটা দেখায় আর বলে,

“আফায় বাড়িতে ফিরতেছিল আব্বা। আমি একশো ভাগ নিশ্চিত যে, এই ব্রোঞ্জটা আফার। আমি নিজ হাতে তারে উপর দিছিলাম।”

ফিরোজের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। মিদুল আরো কোনো তথ্য পাওয়া যায় কিনা সেটাই খোঁজ করছিলো। তেমন কিছু পেলো না। কিন্তু বনের ভেতরের দিকে যাওয়া বাইকের চাকার দাগগুলোগে মিদুলের নজর পড়ে। মনের ভেতর আপাতত বিশ্রি হলেও এই পরিস্থিতিতে খাপ খায় এমন সব চিন্তা মিদুলের মাথায় ঘুরছিলো। যেতে যেতে বনের অনেকটা গভীরে চলে গেলো। তবুও এখনো শেষ গন্তব্য পেলো না। এক বুক আশা নিয়ে মিদুল গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো। একটা কুড়ে ঘর দেখে থেমে গেলো মিদুল আর ফিরোজ। ঘরের দরজার কাছাকাছি এসে মিদুল নিজের গায়ের চাদরটা (শাল) খুলে হাতের সামনে মেলে ধরে। ছেলের এরূপ কান্ডে ফিরোজ অবাক হয়ে মিদুলের এমন কাজ করার কারণ জানতে চাইলে মিদুল ফিরোজকে বলল,

“আব্বা, ভেতর থেকে বাজে গন্ধ আসছে। গন্ধগুলো নতুন। আমরা জানিনা ভেতরে এই মুহুর্তে আফায় আছে কিনা, বা থাকলেও কেমন অবস্থায় আছে। মগজ অন্য কিছু কইতাছে আব্বা। চোখ বাচাইতে চাইলে আমার মতো চাদরখানা হাতে মেলাইয়া ধইরা আগাইয়া আসেন।”

মিদুল ভেতরে পা রাখতেই গন্ধটা যেন ধুপ করে এসে নাকে বাড়ি খেলো। ধীরে আরো দু’পা এগিয়ে তাকালো সামনের দিকে। সেকেন্ডেই রকেট গতিতে সামনে এগিয়ে গিয়ে চাদরখানা দিয়ে ঢেকে দিলো ফাইজাকে। মিদুলের ফোকাস ছিল ফাইজার মুখমন্ডলে। নিজের বোনকে চিন্তা এক মুহুর্ত সময় অপচয় করেনি সে। ফাইজার সাথে এমন কিছু ঘটে গিয়েছে এরকম তার মস্তিষ্ক বারবার খুঁচিয়ে বলছিল। তাই দরজার সামনে এসেই শরীর থেকে শীতের চাদরখানা খুলে হাতে নিয়েছিল। ছেলের দেখাদেখি ফিরোজও দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে চাদরের আবরণে ঢেকে দিলেন। ফাইজার অবস্থা দেখে সে বেঁচে আছে নাকি মারা গিয়েছে তা বুঝতে পারছেন না। বুক ফেটে কান্না আসছে। বাবা-ছেলে এবার নিজেদেরকে সংযত রাখলেন না। আওয়াজ করে কেঁদে উঠলো দুজন। মিনিটখানেক কান্নার পরেই হঠাৎ মিদুল তার বাবাকে বলল,

“আব্বা, দাদাকে কল করে কন যে তারাতাড়ি বাড়ি থিকা ভ্যান গাড়ি নিয়া এইখানে আসতে। মুসল্লিরা নামাজ শেষ কইরা বের হওয়ার আগেই আফারে এইখান থাইকা নিয়া যাইতে হইবো। নয়তো…”

মিদুলের কথা শেষ হওয়ার আগেই ফিরোজ তার বাবাকে কল দিয়ে ভ্যান গাড়ি নিয়ে আসার কথা বললেন। পুরো ঘটনা বললেন না কিছুই। পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুর্বল দেহে ভ্যান নিয়ে হাজির হয় রফিক। কিন্তু ভ্যান এত গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে নেয়া সম্ভব না।

মিদুল সাবধানের সহিত পাঁজা কোলে তুলে নিলো ফাইজাকে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here