সবটাই_তুমিময় পর্ব ৮+৯

#সবটাই_তুমিময়
#লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ৮

-আজ আমি তোর ন্ নিজের…নিজের মা হলে তুই এমন্…এমনটা করতে পারতি না আন্নু!

জোরে জোরে দম নিয়ে কথাগুলো শেষ করলো মনিমা।হুহু করে কেদে দিলাম।গাড়িতে বসে সারাটা রাস্তা নিশব্দে কেদেছি।হসপিটালে এসেই সোজা ইমারজেন্সিতে ঢুকে পরছিলাম।ডক্টর,নার্স বাধা হয়ে দাড়ালেন।পরে অঙ্কুর যখন তাদের বললেন মনিমা আমার সাথেই দেখা করবে বলে ব্যস্ত হয়ে পরেছে,আর কেউ আটকায় নি আমাকে।অঙ্কুরকে বাইরেই দাড়াতে দেখলাম।তার চোখমুখেও চিন্তা,অস্থিরতা।উনি ইশারায় তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকতে বললেন আমাকে।বিয়েটার কথা মনে পরতেই ঘৃনাদৃষ্টি ছুড়ে ভেতরে ঢুকলাম।

মনিমা অজ্ঞান ছিলো।হসপিটালে আসার পর থেকে তার পাশে হাত মুঠো করে বসে থেকে কেদেছি শুধু।অনেকটা সময় পর জ্ঞান ফিরলো তার।আমাকে দেখেই তারও চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগলো।মুখ ফিরিয়ে নিলো মনিমা।নার্স বললো,

-আপনি কে হন ওনার?

-আ্ আমি আহানিতা।মনিমার মেয়ে।

-ও।আপনিই তাহলে এনার আন্নু?কেমন মেয়ে আপনি?মাকে এভাবে অসুস্থ্য রেখে কোথায় চলে গিয়েছিলেন?থ্যাংক গড ওনাকে কাল ঠিকসময়ে এডমিট করানো হয়েছে।নইলে বড়সড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো ওনার।ইভেন আজ সকালেও ওনার সিচুয়েশন খুব খারাপ ছিলো।প্লিজ টেক কেয়ার অফ হার!আর হ্যাঁ,ওনাকে বেশি উত্তেজিত করবেন না!

ফুপাতে ফুপাতে ডাক লাগালাম মনিমাকে,

-ম্ মনি…..

-তোমার মনিমা মরে গেছে আহানিতা!

-না!না মনিমা!ওভাবে বলো না প্লিজ!প্লিজ ওভাবে বলো না!তোমার কিছু হলে যে আমিও মরে‌ যাবো!শেষ হয়ে‌ যাবে তোমার আন্নু!এমন কথা আর কোনোদিনও বলবে না প্লিজ!

-আমার কিছু হলে তোমার কিছু যায় আসে?

-মনিমা?

-হ্যাঁ,তাইতো!তোমার কিছু আসা যাওয়ার কথা না তো!আমি…আমি তো তোমার আপন মা নই।আমিতো শুধু বড় করেছি তোমাকে।

কান্নার বেগ বাড়লো‌ আমার।
যতোদুর মনে পরে,মনিমাই‌ আমার সব।অন্যকোনো আত্মীয়স্বজন কোথায়,আদৌও আছে কি না,কিছুই জানি না।মনিমা বলে আমার বয়স যখন পাঁচ বছর,একটা‌ গাড়ি বিস্ফোরনে আমার বাবা মা দুজনেই মারা যায়।তারপর থেকে মনিমার কাছেই আমি।সে কোথায় থেকে কিভাবে,কেনো আমার জীবনে এসেছিলো এ নিয়ে কিছুই জানি না।মনিমাও বলতে চাইনি কোনোদিন।শুধু এটুকো বলতো,আমাকে নিয়েই তার পৃথিবী।তাই তাকে বারবার প্রশ্নতাক করতে ভালোলাগতো না আমার।একটা‌ এনজিওতে কাজ করে আমার পড়াশোনা আর সংসারটাকে ঠিক চালিয়ে‌ নিতো মনিমা।তার কাছে হয়তো এতোএতো টাকা ছিলো না,কিন্তু ভালোবাসারও কোনো অভাব ছিলো না।তাই তাকে ছাড়া আমিও আমার পৃথিবী কল্পনা করতে পারি না।কান্না করতে করতেই বললাম,

-মনিমা প্লিজ!এসব বলো না!যাই হয়ে যাক না কেনো,তুমিই আমার মা!এটা তো তুমিও জানো,আমিও মানি।তাহলে কেনো আবার এসব বলছো?এসব সহ্য হয় না তো আমার।জানো তো তুমি!

-সত্যিটাই তো বললাম।আমি…আমি তো পেটে ধরি নি তোমাকে।আমার সাথে রক্তের সম্পর্ক নেই তোমার।তাহলে আমাকে নিয়ে কেনো এতো…এতোটা ভাববে তুমি আহানিতা?তুমি বরং তোমার কাজে যাও!

চোখ মুছলাম আমি।তারও চোখ মুছিয়ে দিলাম।অভিমান হয়েছে তার।এতোদিন তার থেকে দুরে ছিলাম,এটুকো অভিমান তো হবেই।বললাম,

-আচ্ছা বেশ,এতো কথা বলতে হবে না তোমাকে।তোমার শরীর ভালো নেই।আমি এসে গেছি তো,তুমি….

-কেনো আসলে?তোমার তো কাজটাই জরুরি!আমি মরার পরই না হয়….

-মনিমা,প্লিজ!আমি সবটা বলবো তোমাকে।তুমি একটু সুস্থ্য হয়ে যাও,সবটা বলবো।

-আর কি বলবে?এবারও নিশ্চয়ই কোনো ট্রিপে ছিলে?কারন আমি যতোদুর জানি,কোচিং কিংবা জব ইন্টারভিউয়ে এক সপ্তাহ সময় লাগে না।

-আন্নু আমার সাথে ছিলো মনিমা।

দরজায় তাকালাম।তানহা আর আস্থা এসেছে।অবাক হলাম ওদেরকে দেখে।ওদেরকে খবর দিলো কে?নাকি ওরাই মনিমাকে হসপিটালে এনেছে?হতেও পারে।আমার কলেজের বেস্টফ্রেন্ড ওরা।ওরা ভেতরে ঢুকলো।মনিমা অন্যদিক তাকিয়ে থেকেই বললো,

-আমি বাচ্চা নই তান্নু যে তোরা আমাকে যা বুঝাবি,তাই বুঝবো।

-তোমাকে বাচ্চা কেনো বলতে যাবো?আয়না দেখেছো?সামনের ঢেউতোলা ছোটছোট চুলগুলোয় কতোসুন্দর সাদা রঙ ধরেছে!একে নাকি বাচ্চা ভাববো!

আস্থার কথায় তানহা রাগ নিয়ে তাকালো ওর দিকে।আস্থা জোর করে হেসে বললো,

-ইয়ে,আ’ম জোওওওকিং!

তানহা এগিয়ে এসে মনিমাকে ওর কব্জি দেখালো।ওখানে ব্যান্ডেজ করা।কোনোভাবে কেটে গেছে বোঝাই যাচ্ছে।মনিমা ব্যস্তভাবে বললো,

-এটা কিভাবে হলো তান্নু?

-তান্নু?এটা কি কর্….

আস্থা পায়ে পাড়া লাগিয়ে দিলো আমার।আর কিছুই বললাম না।তানহা বললো,

-সুইসাইড এটেম্পট করতে গেছিলাম ছয়দিন আগে মনিমা।কপাল করে বেচে তো গেছি,কিন্তু হসপিটালাইজড্ ছিলাম তিনদিন,বাসায় আব্বু আম্মু ছিলো না।রিসোর্ট প্লানিংয়ের জন্য কক্সবাজার গেছে তারা।হাহ!জানোই তো,আমার জন্য তাদের কাছে কতো সময়।তাই আন্নুকেই….

মনিমা বললো,

-সুইসাইড?এতোবড় একটা কান্ড ঘটাতে গিয়েছিলি তুই তান্নু?কেনো?

তানহা আনমনে বলে উঠলো,

-নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিলো কারো কাছে মনিমা।

-কার কাছে?

ধ্যান ভাঙে ওর।ঠোটে হাসি টেনে বললো,

-হুম?ত্ তেমন কিছু না মনিমা!

-কিছু তো!এভাবে কষ্ট পাচ্ছিস কেনো তুই?তোকে তো….

-প্রেমে ছেকা খাওয়ার কষ্ট!তুম কেয়া জানো মনিমা?

আস্থাকে মার লাগালাম আমি।ও বিরক্তি নিয়ে বললো,

-তান্নু ওর মা বাবার সাথে আবারো ঝগড়া করেছিলো।ওর মা রাগে বলেছে গো টু হেল!জেদের বশে হেলের দরজায় কড়া নাড়তে গিয়েছিলো।

মনিমা অন্যদিক ফিরে কাদতে লাগলো আবারো।আমাদের কাউকেই কোনঅংশে কম ভালোবাসে না সে।এখন তার বিনিময়ে যদি শুধু টেনশনটাই পায়,কান্না তো করবেই।এরমধ্যেই কেউ ডেকে উঠলো,

-মনিমা?

গলার স্বরটা চেনা।আমাদের একমাত্র ছেলেবন্ধু।তিহান।দরজায় তাকিয়ে দেখলাম হাতে একগাদা ফল,হেল্থ ড্রিংকস্ নিয়ে দরজায় দাড়িয়ে ও।আমার দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন।তারপর এগিয়ে এসে মনিমাকে বললো,

-মাতাজি?কেমন আছো?

মনিমা ভারী গলায় বললো,

-তুই‌ কেনো আসলি তিহান?তোকে কে আসতে‌ বলেছে?তোদের কারো কোনো কাজ নেই?

-সত্যিই কোনো কাজ আছে কি?হিসেবে পাইনা তো?তিনদিন আগে তান্নুর কেবিনে দৌড়দৌড়ি করলাম,তিনদিন পর তোমার এখানে।এখন আগে আগে দেখো,হোতাহে কেয়া!

-তোকে এতোসব জিনিস কে আনতে‌ বলেছে তিহান?

আমার কথায় তিহান তাচ্ছিল্যে হাসলো।বললো,

-তোর মায়ের জন্য কিছু কিনলে আমার হাত একদম খালি হয়ে যাবে,এতোটাও গরীব নই আমি।

-আমি ওভাবে বলিনি তিহান,এসব তো…

মনিমা আমাকে থামিয়ে‌ দিয়ে বললো,

-কিভাবে বললে কেউ‌ কষ্ট পায়,তিহান কষ্ট পায়,সেটা আজও বুঝলে না তুমি আহানিতা।

তিহানের দিকে তাকালাম।মাথা নিচু রেখে চাপা কষ্টের হাসি হাসছে ও।তানহা অনেকটা আগেই পিছিয়ে গিয়ে জানালার ধারে দাড়িয়েছে।একপ্রকার জোর করেই ওর ঠোটে হাসি ঝুলানো।তিহান একটা জোরে শ্বাস ফেলে বললো,

-মনিমা?কি খাবে?

-কিছুই না!

-কিছু না কিছু তো খেতেই হবে তোমাকে মাতাজি।আমি এনেছি বলে কথা!

-খাবো না।

-রাগ কেনো করছো মনিমা?আন্নু এসে গেছে তো!

-হ্যাঁ,এক সপ্তাহ পর!

-তান্নু তো বললো তোমাকে,ওর কাছে ছিলো আন্নু।এখন তান্নুর বাবা মা ওকে টাইম দেয় না,বন্ধু হিসেবে আমাদেরই তো ওকে দেখা উচিত তাইনা?

-সেটা আগে বললে কি হতো বলতো?তান্নুর সাথে থাকলে আমাকে জানাতে সমস্যা কোথায় ছিলো বল তিহান?ফোনটাও সুইচড্ অফ।আমার চিন্তা হয় না বুঝি?একটাবারও কেউ জানালি না?আন্নু,তান্নু,আস্থা ওরা না হয় ছেলেমানুষ।কিন্তু তুই?তুইও একবারও বললি না?

-তান্নুর অবস্থা খুব ক্রিটিকাল‌ ছিলো‌ মনিমা।তোমাকে জানালে আরো বেশি চিন্তা করতে তুমি।আর আন্নুর ফোন হসপিটালে হারিয়ে গেছে।এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে,কলটাও করতে পারে নি তোমাকে।তাছাড়া ধরা পরার ভয়টাও পাচ্ছিলো।তান্নুর কথা জানলে তুমি আবার বেশি হাইপার হয়ে যেতে।

মনিমা আবারো কাদতে লাগলো।বরফগলা জল!বুঝলাম অভিমানের বরফ গলছে।আর সেটা প্রতিবার তিহানের দ্বারাই সম্ভব হয়।একটু স্বস্তির কান্না বেরোলো চোখ দিয়ে।মুছে হাসিমুখ করে দাড়ালাম।মনিমা বললো,

-আমাকে জ্বালিয়ে ক্ষান্ত হস নি তোরা কোনোদিন,হবিও না।সবাই মিলে আমাকে মেরে তারপরই দম নিবি।তার আগে না।

আস্থা মনিমার কপালে চুমো দিয়ে বললো,

-আরেকটা কাজ করেও ক্ষান্ত হবো না মনিমা।তোমার এই সুইট,লিটল,ট্রায়াঙ্গল শেইপের কপালটাতে চুমো দিতে আমার না হেব্বি লাগে।মনে হয় মৌচাক আছে ওতে।কাছে যাওয়া রিস্কি,বাট ফল?হায়্ ম্যায় মারজাওয়া!

মনিমা কান্নার মধ্যেও হেসে দিলো।আমিও ঠোট আটকে আছি।ইচ্ছে করছে সবগুলোকে জরিয়ে ধরে আদর করি একসাথে।আস্থা মনিমাকে জরিয়ে রেখেছে।তানহা বললো,

-মনিমা?আমাদের পাওনাটা?

মনিমা এগোনোর জন্য ইশারা করলো আমাদের দুজনকে।ঠোটে হাসি ফুটিয়ে এগোতেই দুহাতে দুজনের কান ধরলো সে।শক্ত করেই ধরেছে।তানহা ব্যথায় আহ্ শব্দ করলেও আমি খুশিতে কাদছি।মনিমা বললো,

-একবার বেরোই এখান থেকে,তোদের দুটোকে খুন্তি দিয়ে পিটাবো!

তিনজনে মিলে জরিয়ে ধরলাম মনিমাকে।আড়চোখে দেখলাম তিহান দুরে দাড়িয়ে হাসছে।অঙ্কুরের কথা মনে পরলো হুট করেই।মনিমাকে ছেড়ে অনেকটা দুরে সরে দাড়ালাম আমি।সবাই‌ একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে‌ রইলো।মনিমা কিছু বলতে যাবে,এরমধ্যে নার্স এসে‌ বললো,

-আপনারা এই পেশেন্টের‌ বাসার লোকজন বেশ অদ্ভুত।যখন থাকেন,তো এতোগুলো একসাথে।যখন নেই তো কেউই নেই।এখন বেরোন।ওনার রেস্ট দরকার।বেরোন!

ওরা তিনজন হাসিমুখেই বেরিয়ে গেলো।আমি মনিমার কাছে গিয়ে দাড়ালাম আবারো।মনিমা বললো,

-সিস্টার?আন্নু থাকুক।

-বেশ।

নার্সও বেরিয়ে গেলো।বেডের কাছে চেয়ারটা টেনে বসলাম।মনিমাকে জরিয়ে তার হাতের উপর মাথা রাখলাম।কতোদিন পর এই মানুষটাকে কাছে পেয়েছি।শান্তি লাগছে প্রচন্ড।মনিমা আরেকহাতে আমার মাথার চুল নাড়তে নাড়তে বললো,

-মনিমার জন্য কষ্ট হয়নি এ কয়দিন?

-অনেক!

-আজ আবারো তিহানের কথা বিশ্বাস করলাম আমি আন্নু।তোকে নিয়ে হয়তো ওর চেয়ে বেশি আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারবো না কোনোদিন।তোকেও না!
#সবটাই_তুমিময়
#লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ৯

সাদা মেঘের ভেলার ওপারে নীল আকাশের বিস্তৃতি।কোনো এক অচেনা পাখির সুর ভেসে আসছে কানে।টুকটুক করে শুকনো কদমের পাপড়ি ঝড়ছে অনবরত।হসপিটালের বড় মাঠটার এককোনে‌ কদম গাছতলায় বসেছি আমি আর তানহা।মাথা উপরদিক রেখে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিচ্ছি।কতোদিন পর এই মুক্ত আকাশ,মুক্ত বাতাস আর আমার আমিটাকে পেয়েছি।অবশ্য তা ঠিক কতোক্ষনের জন্য সেটাও জানি না।চোখের কোনা বেয়ে পানি গড়ালো।তানহা এতোক্ষন চুপ থেকে বললো,

-কোথায় ছিলি তুই আন্নু?

….

-চুপ করে থাকিস না আন্নু!বল?

….

-এবার কাকে নিয়ে রিপোর্ট লিখতে গেছিলি তুই?

…..

-বরাবরের মতো,বলবি না তাইতো?বেশ!তবে একটা কথা শুনে রাখ আন্নু,আজ অবদি তোর এই অদ্রি নামের সব কাজকর্ম আমি সাপোর্ট করেছি।কিন্তু এখন থেকে আর না!তুই ভোরের বাংলায় সিক্রেট রিপোর্টার হিসেবে আর কোনো আর্টিকেল লিখবি না!

চোখ মেলে তাকালাম ওরদিক।ও বললো,

-শোন আন্নু,তুই না বললেও আমি কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি,কোনো বড়সড় বিপদ থেকে বেচে ফিরেছিস তুই এবার!

-বেচে ফিরেছি?কি জানি!

ও কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন।তারপর আবারো বললো,

-তোকে কতোবার মানা করেছি আন্নু,শুনিস নি তুই!কিন্তু আর না!তুই আর ওসবে জড়াবি না নিজেকে।একটা স্বাভাবিক লাইফ লিড করবি এবার থেকে।মনিমার অবস্থা দেখেছিস?তোর চিন্তায়….

-মনিমাকে হসপিটালে কে এডমিট করিয়েছে তান্নু?

-জানি না।কেনো বলতো?রিসেপশনিস্ট তোকে কিছু বলেনি এ নিয়ে?সেই তো আমাদের তিনজনকে ফোন করেছিলো,তোর মোবাইল থেকে নাকি আমাদের নাম্বার পেয়েছে।

তারমানে অঙ্কুর করেছেন সবটা।উনিই মনিমকে হসপিটাইজড্ করিয়েছেন,তারপর পেশেন্টের বাসার লোকের সাথে যোগাযোগ করার জন্য আমার মোবাইলটা রিসেপশনে দিয়ে দিয়েছেন।এই লোকটাকে কোনোদিনও কি বুঝতে পারবো আমি?নাকি বোঝার চেষ্টাই করিনি।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

-কিরে?কি হলো?

-হুম?কিছু না।আস্থা,তিহান ওরা কোথায় গেছে?

-আস্থা নাইমের সাথে দেখা করতে গেছে।নিব্বার মতো চিপকে থাকে ছেলেটা।কখন যেনো কপাল পোড়ে ছেলেটার।আর তিহান….

-তিহান?

-যখন তুই আর আমি কথা বলছি,তিহান যে আসবে না,সেটা তো তুই জানিসই আন্নু।আফটার অল,তুই মানা করেছিস ওকে!

তানহা তাচ্ছিল্যে বললো কথাটা।মুখ ফিরিয়ে শক্ত গলায় বললাম,

-এতো বোঝে তবুও এমন বিহেভ করে কেনো?

তানহা অবাক চোখে তাকালো।জোর গলায় বললো,

-কেমন বিহেভ করে আন্নু?কেমন বিহেভ করে?তুই না বলার পর কোনোদিনও কি ভালোবাসার দাবী নিয়ে তোর কাছে এসেছে ও?কোনোদিনও দ্বিতীয়বার ভালোবাসি বলেছে ও তোকে?কখনো জোর করেছে,বন্ধুত্ব থেকে সম্পর্কটা আরো এগোনো নিয়ে?বলেনি।শুধু বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে তোর ভালো থাকাটা কামনা করেছে।তোর পাশে থাকতে চেয়েছে।এটা থেকে তুই ওকে বঞ্চিত করতে পারিস না আন্নু!

-এসব কথা আমার ভালো লাগছে না!

-কেনো ভালো লাগে না বলতে পারিস?তোর কাছে ওর ফিলিংসয়ের কেনো কোনো দাম নেই আন্নু?পাগলের মতো ভালোবাসে ও তোকে।এতোটা ভালোবাসা তো মানুষ কয়েকজন্ম তপস্যা করেও পায়না।আর তুই কিনা….

-তুই হাত কেটেছিলি কেনো?

হুট করেই এমন প্রশ্ন করায় ও থেমে গেলো।চোখ ভরে উঠতে লাগলো ওর।বললাম,

-কি হলো?বল?কেনো কেটেছিলি হাত?

তানহা কোনোমতে চোখের জল আটকে দিয়ে বললো,

-আ্ আস্থা বললো না তোকে,মাম্মির সাথে ঝ্ ঝগড়া…মাম্মি বলেছিলো….

-মিথ্যে বলিস না তান্নু!

টলমলো চোখে তাকালো ও।আমি একটু আশ্বাসের মাথা দোলাতেই তৎক্ষনাৎ আমাকে জরিয়ে ধরে হুহু করে কেদে দিলো।শক্তভাবে জরিয়ে ধরলাম ওকে।তানহা ফুপাতে ফুপাতে বললো,

-তিহানকে আবারো জবের কথা বলেছিলাম আমি আন্নু।তুই এভাবে লাপাতা হওয়ার আগে জানতে পারি ওর বাবার এজমাটা বেড়েছে।চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার দরকার।আমি দিতে চাইলে কখনোই নেবে না ও।তাই তোর সাথে কনসাল্ট করে…এরমাঝেই তুই উবে গেলি।আস্থাকে তো জানিসই।ওর জোকসের জন্য তেমন পছন্দই করে না তিহান ওকে।ওর কথা এমনিতেও মানবে না।

তাই সাহস করে আবারো আমিই বলেছিলাম তিহানকে।পাপার অফিসে জয়েন করতে।একবার দেখা করতে পাপার সাথে।ও আবারো আমাকে অপমান করেছে আন্নু।আবারো আমার একটু বড়ঘরে জন্ম নেওয়া নিয়ে কথা শুনিয়েছে আমাকে।আমি নাকি দয়া করতে চাই ওকে।আমি জবটা নাকি ভিক্ষা দিতে চাই ওকে।শুধু এগুলো…এগুলো বললে তাও ঠিক ছিলো আন্নু,প্রতিবারের মতো সয়ে যেতো।কিন্তু এবার ও আরো কঠিনভাবে আঘাত করেছে আমাকে আন্নু!আমি…আমি নাকি টাকা দিয়ে ওর ভালোবাসা কিনতে চাই!টাকার বিনিময়ে ওকে কিনতে চাই!জব অফার করে ওর সত্ত্বাকে আমার দাস বানাতে চাই!

এটুক শেষ করে আরো জোরে কাদতে লাগলো ও।আমারো কান্না আসছে।আর তীব্র আফসোস হচ্ছে ওর জন্য।হয়তো এসবের জন্য আমিই দায়ী।যদি তিহানের মনে আমাকে নিয়ে কোনো দুর্বলতা না থাকতো,হয়তো এভাবে দুরে ঠেলে দিতে পারতো না ও তানহাকে।কিন্তু আমিও তো কোনোদিন তিহানকে সুযোগ দেই নি।ওর বন্ধুত্বও চাইনি।শুধুমাত্র ও কষ্ট পাবে বলে তানহাই আমাকে জোর করেছে ওর সাথে বন্ধুত্বটা রাখার জন্য।এই মেয়েটা কোনদিকে কম?বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে,দেখতে সুন্দরী,পড়াশোনাতেও ভালো,তিহান ছাড়া আজ অবদি কোনো ছেলের দিকে চোখ তুলেও তাকায় নি।

আর তিহান?আত্মসম্মান,আর আমার প্রতি দুর্বলতার দেয়ালে বাধা পরে তানহার ভালোবাসাকে অস্বীকার করেছে।তবে হয়তো বন্ধুত্বের জোরটা একটু বেশিই ছিলো আমাদের।তিনজনের বলা না বলা কথার ভীড়ে সবাই একে অপরকে ভালো থাকতে দেখতে চেয়েছি।এ পর্যন্ত তাই হয়তো,এই বন্ধুত্বই হয়তো এক করে রেখেছে আমাদের তিনজনকে।তানহা আমাকে ছেড়ে দিয়ে আবারো বলতে লাগলো,

-তুইই বল?তুইই বল আন্নু,আমার ভালোবাসার এতোবড় অপমান কি করে মেনে নেবো আমি?কি করে?হোক তা একতরফা,তবুও!ভালোবাসি তো!ওকে আমি কোনোদিনও কিছু বলতে পারবো না!আবার এই কষ্ট সহ্যও হচ্ছিলো না।তাই নিজেকেই….

-এতোবড় একটা কাজ কি করে করলি তুই তান্নু?

আবারো তাচ্ছিল্যে হাসলো ও।নাক টেনে বললো,

-আমার নামের অর্থ কি জানিস আন্নু?তানহা!একাকীত্ব!এটা পার্ফেক্ট আমার জন্য।ছোটবেলা থেকেই মাম্মি পাপাকে শুধু বিজনেস সামলাতে দেখেছি।আমার জন্য সময়টা কমই ছিলো তাদের।এখনও কম।জানিস তো আন্নু?মনে হয়,যদি আমি রাস্তায় মারাও পরি,তারা সময় করে আমার ডেডবডি দেখতে আসবে তো?সন্দেহ হয় আমার!

-তান্নু!

-তুই চিন্তা করিস না আন্নু।আমি আর এসব ভাববো না।মৃত্যুকে একদম কাছ থেকে দেখে এসেছি তো,আর উল্টাপাল্টা ভেবে নিজের ক্ষতি করবো না।নিজেকে আর ছোট করবো না।

-সর সর সর!বসতে দে আমাকে!

আস্থা এসেছে।তানহা তাড়াতাড়ি চোখ মুছে নিলো।তিনজনের পিঠ একসাথে করে তিনদিক মুখ করে বসলাম।আস্থা বাদাম এগিয়ে দিয়ে বললো,

-একটা কথা বল আমাকে তান্নু?তোর এই একতরফা প্রেমের চিপায় বেচারা সুইসাইড পরলো কেনো?মানে এত্তো সিরিয়াস মামা?তিহান তো বরাবরই মাথামোটা।ওর ওই মোটা মাথায় আন্নুর মতো চিকনা চিজ পোষাবে না!আর তোকে তো বলেছিই আমি তান্নু,আজ হোক বা কাল,তিহান তোরই।তুই আমাকে বিশ্বাস করিস না?

……

-আর আন্নু?তুই মাঝেমধ্যে এভাবে গায়েব হয়ে যাস কেনো?

…..

-কেউ কিছু বলবি?নাকি?আজব!

…..

-আচ্ছা শোন,আই হ্যাভ আ প্লান!তোরা দুটো তো একে ভালোবাসিস!তো তোরা দুজনে মিলে বিয়ে করে নে না!এতে তোদের দুটোর ভালোবাসা অন্তত পূর্নতা পাবে!তোরা দুটো খোয়া গেলে,দেখবি,আমাকেই প্রোপোজ করে বসবে ও!আমি কিন্তু ওকে ফিরিয়ে দেবো না!আফটার অল,আমারও লাইফে বিয়েশাদীর ইচ্ছা আছে।

এতোক্ষনে আমি আর তান্নু তাকালাম ওর দিকে।ও একটা মেকি হাসি দিয়ে বললো,

-আ’ম জোওওওওকিং!

দুজনে মিলে ওড়নায় গলা আটকে ধরলাম ওর।টাল সামলাতে না পেরে ঘাসের মধ্যে শুয়ে পরেছে ও।চেচিয়ে বললাম,

-কুত্তি!তোর নাম আস্থা রেখেছে কে রে?তোর বলা একটা বর্নেও একবিন্দুও আস্থা নেই।তোর নাম তো আখরি পাস্তা হওয়া উচিত ছিলো।আ’ম জোওওওওকিং এর বাচ্চি!

তান্নু বললো,

-ঠিক বলেছিস!এই হারামীর কোনো বিষয়েই সিরিয়াসনেসের স টাও নেই!

-আ্ আবে আমার গ্ গলাটা তো ছাড়!

ছেড়ে দিলাম।উঠে জোরেজোরে শ্বাস নিয়ে আমাদের দুজনের চুল টেনে দিয়ে বললো,

-তো তোরা জীবনে সিরিয়াস থেকে কি পেয়েছিস বলতে পারিস?একটা তো ঠিকঠাকমতো প্রেমও করতে পারলি না!আমাকে দেখ!ইনস্পায়ার হ!মাত্রই নাইমকে ব্রেকাপ বলে ছুড়ে ফেলে এসেছি।এটা কিন্তু আট নম্বর ছিলো!

কপাল চাপড়ালাম দুজনেই।আবারো ব্রেকাপ করে এসে গর্ব করছে।আই লাভ ইউ শুনে আগে শর্ত দেবে,আমার মুড সুইং হ্যান্ডেল না করতে পারলে ব্রেকাপ।আর ঠিক তাই ঘটেছে আটজনের সাথেই।তানহা বললো,

-তুই কবে সিরিয়াস হবি আস্থা?

-কোনোদিনও না।

-তোর লাইফে সিরিয়াস কেউই আসবে দেখিস।তখন পস্তাবি,কেনো সিরিয়াস হতে শিখিস নি এ নিয়ে।

আমার কথাটা হাওয়াতেই ভাসলো।আস্থা একদমই কানে তুললো না।বরং কানটা চুলকে আবারো বাদাম চিবোতে লাগলো ও।

-আন্নু?

তিহানের গলা শুনে তানহা অন্যদিক ঘুরে বসেছে।চোখ মুছছে ঠিকমতো।আস্থা বিরবিরিয়ে বললো,

-এসেছে!বেটা গর্দভ!

আমি উঠে দাড়ালাম।তিহান মাথা নিচু করে জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বললো,

-তোদের কথার মাঝে আসার জন্য সরি।আসলে মনিমার খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।নার্স ডাকছে।

-ওহ্!আচ্ছা এক কাজ কর,তানহাকে বাসায় পৌছে দিয়ে তুইও বাসায় চলে যা।

তানহা বললো,

-ও কেনো পৌছে দেবে?আমি একাই যেতে পারবো।

-কিন্তু আমি তোকে একা ছাড়বো না।

তিহান বললো,

-ওর তো গাড়ি আছে।

-আস্থা ওর গাড়ির টায়ার পাঞ্চার করে দিয়েছে।

আস্থা হা করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে।তানহা পার্কিং এরিয়ার দিকে দৌড় লাগাতে যাচ্ছিলো,আটকে দিলাম ওকে।আমার শান্ত দৃষ্টি দেখে আস্থা ফোকলা হেসে বললো,

-হ্যাঁ রে তিহান!নাইমের সাথে ব্রেকাপ করে রাগটা তান্নুর গাড়ির টায়ারের উপর ঝেড়েছি।

তানহা বললো,

-আখরি পাস্তা!তুই এই রাগে টায়ারটা পাঞ্চার করে দিলি?

-শোন তিহান,তান্নুকে রিকশায় পৌছে দে!মনিমার জন্য এতো খরচ করলি,আর তান্নুকে রিকশাভাড়া দিয়ে পৌছে দিতে পারবি না?ওউ তো অসুস্থ্য।

আমার কথায় তানহা জ্বলে উঠলো যেনো।চেচিয়ে বললো,

-আমি বলেছি তো একাই যেতে পারবো!

-তুই থাম!আর তিহান?তুই বল আমাকে।ওকে নিয়ে যাবি কি না তুই?শুধু এটুকো জানতে চাই আমি।

তিহান আহত দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে।বললো,

-আমার তবে কেনো কিছুই জানার নেই আন্নু?এটুকো জিজ্ঞাসা করারও অধিকার নেই,তুই কোথায় ছিলি।তাই জিজ্ঞাসাও করি নি।শুধু এটুকো ভেবে শান্তি লাগছে,তোকে আবারো এতোগুলো দিন,ঘন্টা,সেকেন্ড পরে দেখতে পারছি!

-হ্যাঁ।অধিকার নেই তোর!নিজের সীমাটায় নিজেকে এভাবেই আয়ত্বে রাখ।এতেই সবার ভালো।

-আমার নিজের সীমাটা তো আমার আকা নয়।সেটা তো তুই একে দিয়েছিস আন্নু!

তানহার দিকে তাকালাম।অন্যদিক তাকিয়ে বারবার চোখের পলক ফেলে কান্না সংবরন করছে ও।নিজেকে যতোবার দোষারোপ করেছি,ততোবার ও সামলেছে আমাকে।আমাকে ভালোবেসে তিহান ওকে অস্বীকার করছে,কখনো ভাবতে দেয়নি এমনটা।ওর মতে,ভালোবাসাটা আল্লাহ্ প্রদত্ত্ব।যেখানে কারো কোনো হাত থাকে না।আর তাই আমার প্রতি তিহানের অনুভূতির জন্য যেমন আমি দায়ী নই,তিহানের প্রতি ওর অনুভূতিগুলোর জন্যও তেমন তিহান দায়ী নয়।এভাবেই নিজেকে বুঝিয়েছে ও।আবারো তিহানের দিকে তাকিয়ে বললাম,

-শুনলাম আঙ্কেলের এজমা বেড়েছে?তাকে সময় দে!মনিমার কাছে আমি আছি।কিছু লাগলে ফোন করে নেবো তোকে।এখন তুই আয়!

-ওকে কেনো ফোন করবে?এখন তো তোমার বর আছে অদ্রি!বরকে ফোন করবে!আমাকে ফোন করবে!

গলাটা শুনে কলিজা কেপে উঠলো আমার।তানহা তিহানের দিকে‌ তাকালাম।বোঝাই যাচ্ছে বড়সড় শকে আছে ওরা।আর আস্থা হা করে তাকিয়ে আছে আমার পিছনদিক।তানহা মিনমিনে গলায় বলে উঠলো,

-এএসএ!

#চলবে….
#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here