সবটাই_তুমিময় পর্ব ১০+১১

#সবটাই_তুমিময়
#লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ১০

-এএসএ!

তানহার কথাটা শুনে আস্তেধীরে পিছন ফিরলাম।গ্রে শার্টের উপর গাঢ় নীল কালারের ব্লেজার,শার্টের হাতা ফোল্ড করা,হাতে ঘড়ি,চোখে কালো সানগ্লাস আর ঠোটে টেডিস্মাইল নিয়ে অঙ্কুর দাড়িয়ে।বলিষ্ঠ দেহে আটকে রয়েছে শার্টটা।হাতের পেশিগুলো নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।মুঠোতে থাকা কালো স্মার্টফোনে রোদ পরেছে,সেটার প্রতিফলন সোজা চোখে এসে লাগছে আমার।অঙ্কুর সানগ্লাসটা খুলে এগোলেন আমাদের দিকে।একদম আমার সামনে এসে দাড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বললেন,

-জীবনের সবচেয়ে আপন মানুষটা পেয়ে গেছো তুমি অদ্রি।আর সেটা আমি!বর হই‌ তোমার।আর তাই তোমার সব সিচুয়েশনে তুমি আমাকেই ডাকবে।অন্য কাউকে নয়!

হাত মুঠো করে দাড়িয়ে রইলাম।বাকিসবের কথা মনে পরতেই আবারো পিছন ফিরলাম আমি।তানহা এখনো বিস্ময় নিয়ে দাড়িয়ে,আস্থার হা হওয়া মুখ এখনো বন্ধ হয়নি।তিহান অবিশ্বাসের চোখে অঙ্কুরকে দেখে চলেছে।মাথা নিচু করে নিলাম আমি।অঙ্কুর একটু জোরে হেসে দিয়ে বললেন,

-আরে,এতো সিরিয়াসনেস কেনো?অদ্রি?চুপ কেনো তুমি?পরিচয় করিয়ে দাও ওদের সাথে আমার?তোমার…বরের সাথে!

চুপই রইলাম।তানহা একটু এগিয়ে বললো,

-এসব…এসব কি আন্নু?

অঙ্কুর বললেন,

-আসলেই অদ্রি,এসব কি বলোতো?এএসএ কে তো সবাই চেনে।নিজের বরকে তো চেনাও এবার!

তানহা বললো,

-আন্নু?কিছু তো বল?এএসএ এভাবে….

তিহান শক্ত গলায় বললো,

-দেখুন স্যার?হতে পারেন আপনি একজন বিখ্যাত ক্রিকেটার।তা বলে আমাদের মতো সাধারন মানুষজনদের নিয়ে এভাবে কথা বলার অধিকার আপনার নেই।

-আরে,আমার বউ হয় অদ্রি!আর কিভাবে কি বলবো?স্ট্রেইন্জ!

এবার তিহান চেচিয়ে বলে উঠলো,

-উনি এসব কি বলছেন আন্নু?আর এই অদ্রি?তোকে অদ্রি কেনো বলছেন উনি?

অঙ্কুর যা করেছেন,তাতে এভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে আমাকে।আর এখান থেকে অস্বীকারের কোনো উপায়ও নেই।চোখ বন্ধ করে বলে দিলাম,

-উনি ঠিকই বলছেন।আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে।আমাকেই অদ্রি বলে ডাকেন উনি।

-কিহ্?

তানহার বিস্ময়।চোখ মেলে তিহানের দিকে তাকালাম।ওর এসব কথা যে এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তা বোঝাই যাচ্ছে।অঙ্কুর বললেন,

-হ্যাঁ গাইস,এটাই তো বলছি কতোক্ষন হলো আমি!চলো এবার অদ্রিও বলে দিয়েছে!এবার বিশ্বাস হলো তো?আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে।আসলে কি বলোতো,লাভ এট ফার্স্ট সাইট।প্রেমের প্রস্তাব না দিয়ে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি।আর অদ্রিও হ্যাঁ বলে দিয়েছে।তাই আর দেরি করি নি।তবে হ্যাঁ,ধুমধাম করে বিয়ে করে তোমাদের পেটপুর্তি করাতে না পারার জন্য সরি হ্যাঁ?আসলে,বোঝোই তো লাইফের প্রথম ভালোবাসা।কোনো রিস্ক‌ নিতে চাইনি।

এটুক শুনে তানহার দিকে তাকালাম।ও তিহানের দিকে তাকিয়ে।তিহানের ছলছল করতে থাকা চোখজোড়া যেনো চেচিয়ে বলছে,এটা হতে পারে না।চোখ সরিয়ে নিলাম আমি।আস্থার হেলদোল নেই।আগের মতোই কিঞ্চিত হা হওয়া চেহারা নিয়ে মুগ্ধ চোখে অঙ্কুরকে দেখতে ব্যস্ত ও।

-বুঝেছি।অদ্রি চায় আ‌মি নিজে থেকে পরিচিত হই তোমাদের সাথে।মেবি চেক করতে চায়,ওর বর্ননা শুনেই আমি তোমাদের‌ চিনি কি না।ওয়েট,লেট মি গেইস!

অঙ্কুর তানহার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,

-তুমি তানহা।রাইট?তোমার কথা অনেক বলেছে অদ্রি।তান্নু তান্নু করে একদম পাগল করে রেখেছে এ কয়দিন আমাকে।

অঙ্কুরের এতো সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলা দেখে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম।তানহাও তারদিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে।অঙ্কুর তুড়ি বাজিয়ে বললেন,

-তানহা?

তানহা ধ্যান ভেঙে বললো,

-হুম?জ্ জ্বী।জ্বী স্যার।

-নাইস টু মিট ইউ!

-থ্ থ্যাংক ইউ স্যার।

-আরে আরে,স্যার কেনো বলছো?স্যার বলতে হবে না।জীজু হই তোমাদের।ভাইয়াই ডাকো।

-জ্ জ্বী স্যার।আইমিন ভ্ ভাইয়া।

অঙ্কুর তিহানের দিকে এগিয়ে বললেন,

-তুমি তিহান।রাইট?

তিহান আমার দিকে তাকিয়েই‌ মাথা দুলালো।ওর চোখ ভরে আছে পানিতে।কিভাবে আটকে রেখেছে তা ওই জানে।অঙ্কুর বললেন,

-তোমার কথাও অনেক শুনেছি।

-আমার কথা বলেছে আন্নু আপনাকে?

-হ্যাঁ।বলেছে তো!অদ্রির একমাত্র ছেলেবন্ধু বলে কথা!

তিহান আমার দিকেই তাকিয়ে পুরোটা সময়।চোখ ‌মেলাতে পারিনি ওর সাথে।ও বললো,

-তারমানে এ কয়দিন তুই এএসএ’র সাথে ছিলি আন্নু?

অঙ্কুর বললেন,

-রাইট ইউ আর!আমার কাছেই ছিলো ও!তুমি বেশ ইন্টেলিজেন্ট তিহান।

তিহান তাচ্ছিল্যে হাসলো।বললো,

-বুদ্ধিমত্ত্বা কাজে লাগানোর জায়গাটা আর রইলো কই?কি করবো আর ইন্টেলিজেন্সি দিয়ে?মনিমাকে আন্নুর জন্য জবাবদিহি করার জন্য মানুষ এসে গেছে যে!এনিওয়েজ,কনগ্রাচুলেশনস্।উইশ ইউ আ ভেরি হ্যাপি ম্যারিড লাইফ।দোয়া করি,খুব ভালো থাকুন আপনারা।

-থ্যাংক ইউ।

-ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম স্যার।

-স্যার কেনো বলছো তিহান?তানহা তো….

-ভাইয়া বলার জন্য আমাকে জোর করবেন না প্লিজ।তানহার বিষয় আলাদা।আমি বিশ্বাস করি আমার মতো নিম্নবিত্তের আপনাকে ভাইয়া ডাকার যোগ্যতা নেই।স্যারেই কম্ফোর্টেবল আমি।

অঙ্কুর কিছু বলতে যাচ্ছিলেন,আস্থা এগিয়ে এসে একদম সামনে দাড়ালো তার।মুগ্ধচোখে দেখেই চলেছে ওনাকে।তানহা ইতস্তত করে বিরবিরিয়ে বললো,

-আস্থা?বিহেভ ইয়োরসেল্ফ!

-হু।

হু বলেও হুশ নেই ওর।অঙ্কুর একটু ঠোট টিপে হেসে বললেন,

-হ্যালো আস্থা।

এতোক্ষনে যেনো মাটিতে আসলো ও।লাফিয়ে চারপা পিছিয়ে গিয়ে চেচিয়ে বলে উঠলো,

-ওরেএএএএ!আন্নু তান্নু!কার হাতের‌ চিমটির জোর বেশি?আমাকে চিমটি লাগা কেউ!নইলে চুল ছেড় আমার!নইলে কিছু একটা কর যাতে আমি স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসি!আল্লাহ গো!আমি কই গো!তিহানের বাচ্চা!কই তুই?সার্কেলে তুইই একমাত্র পোলা!একটু এনশিওর করতো,এএসএ ‘র মতোন দেখতে এইটা কে?

তানহা মার লাগালো ওকে।দাতে দাত চেপে বললো,

-ওভারএক্টিংয়ের দোকান!এইটা এএসএ ই!থাম ইয়ার!উনি আসার পর থেকেই চোখ দিয়ে গিলে চলেছিস ওনাকে।প্লিজ স্টপ ইট!

আস্থা রোবটের মতো একপলক ওরদিক তাকালো।পরপরই হাত ছড়িয়ে একদৌড় লাগালো অঙ্কুরের দিকে।যেনো জরিয়ে ধরবে এমন ভাবে এগোচ্ছিলো ও।তানহা ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

-থাম আস্থা!ইয়ার!কি করছিস তুই!ওনার আর আন্নুর ব্ বিয়ে হয়ে গেছে।আন্নুর বর হন উনি!

আস্থা থেমে গেলো।গাল ফুলিয়ে ওরদিক তাকিয়ে কাদোকাদো গলায় বললো,

-ইউ আর জোওওওকিং!

তিহান একটা জোরে শ্বাস নিয়ে বললো,

-তান্নু?তুই যাবি?আমি বাসায় যাবো।আব্বুর ঔষুধ কিনতে হবে।এখন না গেলে লেইট হয়ে যাবে।

তানহার কিছুটা অবাক চাওনি।সাথে আমিও।কিছুক্ষন আগ অবদিও ও রাজি ছিলো না ওকে নিয়ে যাওয়া নিয়ে।এখন ওর সাথে যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করছে।অঙ্কুর বললেন,

-তানহা?তুমি চলে যাও।অদ্রির কাছে আমি আছি তো!ডোন্ট ওয়ারি।বাকি কথা পরে হবে?

তিহান হনহন করে চলে আসলো ওখান থেকে।তানহার বিস্ময় তখনও কাটেনি আমি জানি।অঙ্কুরের সাথে আমার সম্পর্ক,তিহানের ওকে নিয়ে যেতে চাওয়া দুটোই কতোটা শকিং ওর জন্য তা আন্দাজ করতে পারছি।এগিয়ে গিয়ে বললাম,

-এখন আয় তুই তান্নু।

তানহা ঘাড় নাড়ালো।সৌজন্যের হাসি হেসে অঙ্কুরের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আ্ আসছি স্যার।

-ভাইয়া!

-জ্ জ্বী।আ্ আসছি ভাইয়া।

-এসো।

ওরা চলে গেলো।দুজনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।ওদেরকে একসাথে দেখে এতোসব অশান্তির মধ্যেও অদ্ভুত শান্তি লাগছে।আস্থা ফিসফিসিয়ে বললো,

-ইয়ে আন্নু,আমি বলছিলাম কি….

-বাসায় চলে যা!পরে কথা হবে।মনিমার কাছে যাচ্ছি আমি।

চলে এলাম ওখান থেকে।একবারও আর পিছন ফিরে তাকাইনি।বিয়ের কথাটা ওদের অঙ্কুর নিজে জানিয়েছেন।তাই এরপর কি হবে,উনি কি করবেন সবটাই ভেবে রেখেছেন নিশ্চয়ই।যা করার করুক উনি।আপাতত মনিমার সুস্থ্য না হওয়া অবদি অন্য কিছুই ভাবতে পারবো না আমি।কিছুই না!

.

মনিমাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে বেরিয়ে এলাম কেবিন থেকে।বাইরে বেরোতেই দেখি করিডোরে রাখা চেয়ারে মাস্ক পরিহিত কেউ বসে।চিনতে খুব একটা সময় লাগেনি।এটা অঙ্কুর।চলে আসছিলাম।উনি উঠে দাড়িয়ে মাস্ক খুলে সামনে দাড়ালেন আমার।ব্যস্তভাবে বললেন ,

-খাইয়েছো?

-হুম।

-খেয়েছো?

-হ্যাঁ।মনিমা জোর করে…

-আমি খাইনি।

ভ্রুকুচকে তাকালাম।কি বোঝাতে চাইছেন উনি?অঙ্কুর করুনভাবে বললেন,

-কবে যাবে ও বাসায়?

এমন অসহায়ভাবে প্রশ্ন একদমই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো আমার।একবারের জন্য মনে হলো আমাকে ছাড়া এমনই অসহায় উনি।পরক্ষনেই ওনার বেবি চাওয়ার কথা মনে পরতেই নিজেকে সামলে নিলাম।আমার আবেগ এএসএ’র জন্য নয়।যেখানে আমাকে শুধুই তার স্বার্থের জন্য ব্যবহার করতে চাইছেন উনি।

-কথা বলছো না কেনো অদ্রি?কিছুতো বলো?কবে আসবে ও বাসায়?

-মনিমা স্….

-ডক্টর বলেছে তোমার মনিমা কালই বাসায় যেতে পারবে।

-আ্ আমার একটু সম্….

-সময় চাই তাইতো?বেশ।টেক ইউর টাইম।বাসায় যাও,মনিমার সাথে সময় কাটাও।ঠিক সময়মতো আমার বউকে নিতে পৌছে যাবো আমি।

মাথা নিচু করে চুপ করে রইলাম।এগুলো অবিশ্বাস্য লাগছে।অঙ্কুর জোর করা,বাধ্য করা ছাড়াও আমার কথাকে দাম দিচ্ছেন,মানতে কষ্ট হচ্ছে আমার।অঙ্কুর আবারো বললেন,

-বিয়েটা নিয়ে এখনই কাউকে কিছু বলো না।কথাটা পাব্লিক হলে প্রেস মিডিয়া তোমাকে তোমার বাসায় থাকতে দেবে না।যদিও আমার তোমাকে ঘরে তুলতে কোনো সমস্যা নেই।ইউ নো,তোমার মনিমা….

-কেউ কিছুই জানবে না।কিন্তু তানহা,তিহান বা আস্থা….

-ওরা কাউকে কিছুই বলবে না।

-আপনি আগে থেকেই চেনেন ওদের?

অঙ্কুর মাথা নিচু করে রহস্যময় হাসি দিলেন একটা।বললাম,

-কি হলো?বলুন?আগে থেকে চেনেন ওদের?

-তোমার জন্য চিনে নিয়েছি।

আমার বিস্ময় সীমা ছাড়াচ্ছে বারবার।উনি বললেন,

-তিহান এখানে…

-মনিমা ওকে পছন্দ করে।তাই…

-আর ও তোমাকে।

চুপ করে গেলাম।সবটাই জানেন উনি।খুব ভালোমতোই চিনে গেছেন আমার আশেপাশের সবাইকে।অঙ্কুর বললেন,

-ডাজেন্ট ম্যাটার।তুমি আমার বউ!আর তাই তোমার রাগ,ঘৃনা সবটা আমার প্রাপ্য।আমারই।কাল বাসায় ফিরে ভার্সিটি জয়েন করো।মন দিয়ে ক্লাস করো।এখন থেকে তুমি কোনো সিক্রেট রিপোর্টার নও।সাধারন একটা স্টুডেন্ট।আর হ্যাঁ,বাসার বাইরে সবসময় মুখ ঢেকে বেরোবে।

-মানে?মুখ ঢেকে কেনো?

-আমি বললাম তাই!

-দেখুন,এসবের কোনো মানে….

-কোনসবের কি মানে তোমাকে তা বুঝতে হবে না অদ্রি!যা বলেছি,তাই করবে।নইলে আস্তে করে তুলে নিয়ে যাবো।

আবারো ঘৃনায় বুক ভরে উঠলো।হুট করেই অঙ্কুর আরেকটু এগিয়ে এসে আমার দুগাল ধরলেন।ওড়না খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলাম।উনি বললেন,

-সাবধানে থেকো।

এটুক বলে আমার কপালে ঠোট ছুইয়ে দিলেন উনি।শরীরজুড়ে এক অদ্ভুত শিহরন।টের পেলাম,যেনো কেপে উঠলাম মৃদ্যু।হাতের মুঠো করা ওড়না আলগা হয়ে আসলো।কেমন এক দুর্বলতা ঘিরে ধরলো চারপাশ থেকে।গাল ছেড়ে দিয়ে মাস্কে মুখ ঢেকে‌ নিলেন উনি।পকেটে দুহাত গুজে আমার দিকে তাকিয়েই পেছোতে লাগলেন।মাস্কের জন্য তার অদৃশ্য মুচকি হাসিটা ওই গভীর চোখজোড়াতেই ফুটে উঠছিলো যেনো।হাসছিলেন উনি?কেনো?বরাবরের মতো আমার প্রশ্ন উত্তরহীনই রয়ে যায়।উনি বেরিয়ে গেলেন।
#সবটাই_তুমিময়
#লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ১১

কেবিনের জানালার ওপারে পুকুর দেখা যায়।মনিমাকে নার্স ঘুমের ঔষুধ দিয়ে গেছে।ঘুমোচ্ছে সে।জানালার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বাইরে দৃষ্টিস্থির করে আছি।পুকুরের স্বচ্ছ পানির অনেকটা জুড়ে ক্ষুদিপানা।সবুজ হয়ে আছে উপরের দিকটা।কোথথেকে এক মাছরাঙা উড়ে এসে ছো মেরে মাছ তুলে নিয়ে গেলো।টনক নড়লো আমার।ওই ক্ষুদিপানার আড়াল থেকেও মাছরাঙাটা ঠিক খুজে নিয়েছে মাছটাকে।যাকে বলে শিকারী ঠিক তার শিকার খুজে নেয়।অজান্তেই বিরবিরিয়ে বলে উঠলাম,

-কিভাবে খুজে পেলো?

-সত্যিই আন্নু,দেশ বিদেশের এতো মেয়ের ভীড়ে এএসএ তোকেই কিভাবে খুজে নিলো?

খুজে নেওয়া।শিকারীর শিকার খুজে নেওয়া।কথাটা ভুল নয়।সত্যিই আমি শিকার।অঙ্কুরের স্বার্থের শিকার।তার শাস্তির শিকার।চোখ বন্ধ করে কান্না আটকালাম কোনোমতে।পিছনে না তাকিয়েই বললাম,

-তুই বাসায় যাসনি?

তানহা এগিয়ে এসে আরো জানালা ঘেষে দাড়ালো একদম।মাথা নিচু করে মৃদ্যু হাসলো।বললো,

-পার্কিং এরিয়া পাস করে যাওয়ার সময় তিহান দেখলো আমার গাড়ির টায়ার ঠিকাছে।বললো গাড়ি ঠিক আছে তোর,ওতেই চলে যা!রিকশা নিয়ে চলে গেছে ও।আমিও চলে যাচ্ছিলাম।কিন্তু গাড়ি স্টার্ট দিতেই এএসএ’র মতো কাউকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম বলে মনে হলো।আস্থা তো দাত ক্যালাতে ক্যালাতে আগেই বেরিয়ে গেছে।তুই একা,তাই…

…..

-বিয়েটা কিভাবে হলো আন্নু?

…..

-কথা বলছিস না কেনো?

-সব নিয়মকানুন মেনেই হয়েছে।

-প্রশ্নটা এটা ছিলো না।যাই হোক,সোজা প্রশ্ন করছি।তুই কেনো করলি বিয়েটা?

…..

-স্পিক আপ আন্নু!

-ওনার প্রোপোজাল ফেলতে পারি নি।

-কেনো?

একটা জোরে শ্বাস নিয়ে গরগর করে বলতে লাগলাম,

-এএসএ এতো ফেমাস একজন ক্রিকেটার,গুড লুকিং,অনেক বড়লোক আর….

-স্টপ ইট আন্নু!এইসব বুলশিট অন্তত আমার কাছে বলিস না!আমি চিনি তোকে!

-তান্নু আস্তে,মনিমা জেগে যাবে!

-গেলে যাক!সেও তো জানুক,তার আন্নু সবাইকে না জানিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে।

-নাহ্!

-হ্যাঁ,জানুক মনিমা।শুনুক সবটা।তুই তো জানতি আন্নু,মনিমা তিহানকে পছন্দ করে।তারপরেও তুই….

তানহাকে টেনে কেবিনের বাইরে নিয়ে আসলাম।বিরক্তি,রাগ নিয়ে বুকে হাত গুজে অন্যদিক ফিরে তাকালো ও।ওর হাত মুঠো করে বললাম,

-তুইও তো জানিস তান্নু,মনিমা চাইলেও তিহানকে কোনোদিনও আমি মানতে পারতাম না!তবে কেনো তিহানকে এসবে জড়াচ্ছিস?

-বেশ।জড়ালাম না।কিন্তু তাই বলে এভাবে বিয়ে করে নিবি তুই?এসবের কি মানে?মনিমা জানতে পারলে কি হবে ভেবে দেখেছিস?নিজের মা না হলে কি?তার সবটা তো তোকে ঘিরে।তোকে নিয়ে তারও কিছু আশা আকাঙ্ক্ষা,সাধ আহ্লাদ আছে ইয়ার!এখন যদি সে জানতে পারে এভাবে বিয়ে করে নিয়েছিস,তাকে সামলানো…আর এএসএ কে তুই পার্সোনালি কতোটুকোই‌ বা চিনিস?হুট করে সেই বা কেনো প্রোপোজ করে বসলো তোকে?আর তুইও…মানে ডিরেক্ট বিয়েতে রাজি হয়ে গেলি?রাজি হলেও সেটা একপর্যায়ের ছিলো।তোরা তো বিয়েটাও করে নিয়েছিস আন্নু!

আর সহ্য হলো না আমার।ওকে জরিয়ে ধরে হুহু করে কেদে দিলাম।ফোপাতে ফোপাতে বললাম,

-তান্নু,আ্ আমি বাধ্য হয়ে….

আমাকে ছাড়িয়ে সামনে দাড় করিয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো ও।বললো,

-মানেহ্?বাধ্য হয়ে মানে কি আন্নু?

আরো জোরে কাদতে লাগলাম আমি।ওউ বাধা দেয়নি।অনেকটা সময় পর চোখ মুছিয়ে দিলো ও আমার।বললো,

-সবটা বল আমাকে আন্নু।কি হয়েছিলো?

চোখমুখ মুছে নাক টেনে নিজেকে সামলে নিলাম।তারপর প্রদীপ সরকারের ওখানে যাওয়া,অঙ্কুরের ম্যাচ ফিক্সিং,আমার ধরা পরে যাওয়া,শাস্তি হিসেবে সেরোগেশনের জন্য আমাকে অঙ্কুরের আটকে রাখা,মনিমার অসুস্থ্যতার কথায় বিয়েটা করতে বাধ্য করা সবটা বললাম ওকে।পাথর হয়ে গেছিলো অনেকটা সময় ওউ।একসময় আস্তে করে বললো,

-এ কেমন শাস্তি?

-ওই যে,ওনার আসল রুপটা জেনে গেছি আমি।উনি প্রদীপ সরকারের মতো জঘন্য একটা মানুষের,মানুষ কেনো বলছি?জুয়ারু!জুয়ারুর সাথে চলাফেরা করেন।টাকার বিনিময়ে ম্যাচ হারবেন।নিজেও খারাপ খেলবেন,টিমকেও মিসলিড করবেন উনি।

-কিন্তু তোর কাছে তো কোনো প্রমান নেই আন্নু।তুই কিচ্ছু প্রমান করতে পারবি না তার বিরুদ্ধে।তবুও কেনো তোকে শাস্তি দিতে যাবে সে?

-হয়তো ভয়।সবটা জেনে অদ্রি কখনোই চুপ থাকবে না।এই চিন্তায়।তার বাচ্চার মা বানিয়ে,তারপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে,চরম শাস্তি দিয়ে নিস্তেজ করে দিতে চান আমাকে।

-আন্নু?

-ওনার দ্বারা সব সম্ভব।সব!

-এএসএ এতোটা খারাপ একজন লোক?এতো বাজেভাবে অপমান করতে চাইছে তোকে?আর যদি অপমানই করবে,তাহলে বিয়েটা কেনো?জোর করতে পারতো তোকে!কি জানি?তোর থেকে লুকোতে পারবো না।তাই বলছি।আজ অবদি তোর সব কাজে,সিদ্ধান্তে একমত ছিলাম তোর সাথে।কিন্তু আজ কেনো যেনো মানতে পারছি না শুধুমাত্র তোর মুখ বন্ধ করবেন বলে এএসএ এসব করছেন।একদমই মানতে পারছি না!

চুপ রইলাম।আর কোনোভাবেই বাইরে থেকে তাকে বিচার করার ভুলটা আমি করছি না।তার সবটা বোঝা শেষ আমার।তানহা আমার কাধে হাত রেখে বললো,

-ডোন্ট ওয়ারি ইয়ার!যা কিছু হয়ে যাক,আমি সবসময় তোর পাশে ছিলাম,আছি,আজীবন থাকবো।মনে রাখবি,আহানিতা দুর্বল ছিলো,অদ্রি নয়।ইউ আর‌ স্ট্রং।হুম?

আবারো জরিয়ে ধরলাম ওকে।তানহা আলতোভাবে কাধে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

-কি করবি এবার?কিছু ভেবে দেখেছিস?

কাটকাট গলায় বললান,

-নিজেকে বিসর্জন দেবো।

-মানে?

ওকে ছেড়ে হাত মুঠো করে অন্যদিক ঘুরে দাড়ালাম।ও আবারো সামনে এসে দাড়িয়ে বললো,

-নিজেকে বিসর্জন দিবি মানে?কি বলতে চাইছিস তুই?

-অঙ্কুরের বেবি চাই তাইতো?দেবো তাকে বেবি।হবো তার বাচ্চার মা।ওই বাসায় যাবো আমি।তাকে বিশ্বাস করাবো,আমি হার মেনে নিয়েছি তার কাছে।আত্মসমর্পন করেছি তার কাছে।ওই বাসায় থেকেই তার বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমান যোগাড় করবো।আর তারপর তার ভালোমানুষির মুখোশ সবার সামনে টেনে খুলে দেবো আমি।তার সবটা এক্সপোজ করে দেবো!বিধ্বস্ত করে‌ দেবো তাকে।যেমনটা আমার সুন্দর,সরল,স্বাভাবিক জীবনটার সাথে করতে চেয়েছেন উনি।ঠিক সেভাবে তাকে ভেঙে গুরিয়ে দেবো আমি তান্নু!ক্ষতবিক্ষত করে দেবো তাকে আমি!ক্ষতবিক্ষত করে দেবো!

কাদতে লাগলাম আবারো।তানহা কিছু না বলে শুধু শক্তহাতে জরিয়ে রইলো আমাকে।

____________

মাঝে একটা পুরো দিন কেটে গেছে।মনিমাকে বাসায় নিয়ে এসেছি আগেরদিন।এরমধ্যে অঙ্কুরের কোনো খোজ পাইনি।চাইনিও।মনিমা মোটামুটি সুস্থ্য।তবুও কিচেনে যেতে দেইনি তাকে।তানহাই সকালসকাল ওর বাসায় সার্ভেন্টদের করা রান্না নিয়ে এ বাসায় চলে এসেছিলো।সারাদিন সেগুলোই খাওয়া হয়েছে।আস্থা এসে ফিসফিসিয়ে অঙ্কুরের কথা বলেছে বারবার।তানহা সামলেছে ওকে।সন্ধ্যার কিছুটা পর খাবারসহ তানহার ড্রাইভার এসেছিলো।রাত আর সকালের খাবারটা প্যাক করে দিয়ে তানহাকে নিয়ে গেছে।এ নিয়ে মনিমা বা আমি কেউই কিছুই বলি নি ওকে।ওর এক কথা,আমরাই ওর ফ্যামিলি।রাতে মনিমাকে নিয়ে খাবার খেয়ে শুয়ে পরলাম তাকে জরিয়ে।মনিমা বললো,

-আন্নু?তিহান আসলো না যে?ওকে কিছু বলেছিস তুই?

-না।কিছুই বলিনি।

-এলো না কেনো ছেলেটা?

-ওর বাবা অসুস্থ্য।এজমা বেড়েছে।

-বলিস কি?তাহলে তো….

-তুমি এতোটা হাইপার হয়ো না মনিমা।ঘুমোও।আমি ভার্সিটি থেকে যাবো কাল ওনাকে দেখতে।

মনিমা মুচকি হেসে কপালে চুমো দিলো আমার।তারপর চোখ বন্ধ করে নিলো।অনেকটা সময় পর দেখলাম মনিমা ঘুমিয়ে পরেছে।আস্তেধীরে উঠে আসতে যাবো,সে হাত ধরে ফেললো।চোখ বন্ধ করেই বললো,

-কোথায় যাচ্ছিস?

-পাশের ঘরে।কাল ভার্সিটি যাবো,বইখাতা একটু ছুয়ে দিয়ে আসি?তুমি ঘুমোও নি?

চোখ বন্ধ রেখেই মনিমা হাত ছেড়ে দিলো আমার।বললো,

-বেশি রাত জাগিস না।

গায়ের চাদরটা টেনে দিয়ে চলে এলাম পাশেরুমে।দরজা লাগিয়ে দিলাম।টেবিলের হিডেন ড্রয়ার থেকে নন ট্র্যাকার ফোনটা বের করলাম।কল লাগালাম ভোরের বাংলার এমডি স্যারকে।কল রিসিভ করে ঘুমোঘুমো কন্ঠে উনি বললেন,

-হ্যালো?

-স্যার আমি অদ্রি।

-অ্ অদ্রি?ত্ তুমি?কোথায় তুমি?

-বাসাতেই।আমার কিছু প্রশ্ন আছে স্যার।

-কোথায় ছিলে তুমি?আইমিন এ কয়দিন….

-প্রশ্ন আমি করবো স্যার।বেশি সময় নেবো না আপনার।শুধু এটুকো বলুন,দীপক তালুকদারের নিউজটা ভোরের বাংলা ছেড়ে টিভি চ্যানেলে দেখানো হলো কেনো?

…..

-চুপ করে থাকবেন না স্যার!ওই রিপোর্ট আমি নিজে কভার করেছি।ওটা শুধু আপনার কাছেই থাকার কথা!তাহলে?ভোরের বাংলায় না এসে চারদিন পর ওটা টিভি চ্যানেলে কেনো প্রচার হলো?ওরা কোথায় পেলো রিপোর্টগুলো?

-রিপোর্টগুলো আমিই ওদের দিয়েছি অদ্রি।

-জানি।নইলে আমার করা রিপোর্ট ওরা আর কোথায় পাবে?আপনিই দিয়েছেন এটা বুঝতে বাকি নেই আমার।কিন্তু প্রশ্নটা সেখানেই!কেনো?

…..

-উত্তর আশা করছি আপনার।

-তোমার করা আর কোনো রিপোর্ট ভোরের বাংলা প্রিন্ট করবে না অদ্রি।

-মানেহ্?

-ইটস্ সিম্পল।তুমি আর কোনো রিপোর্ট ভোরের বাংলার জন্য লিখবে না।ইনফ্যাক্ট কোনো রিপোর্টই লিখবে না তুমি।

-কেনো?

-এতে তোমার লাইফরিস্ক আছে অদ্রি!

-এটা আজ নতুন জানছি না আমি স্যার।এটা জেনেই এ প্রফেশনে জরিয়েছি আমি।এ কারনে পিছিয়ে আসার মেয়ে অদ্রি নয়।সত্যিটা বলুন।

-বেশ।তবে এটাই ধরে নাও,এতে আমার লাইফরিস্ক আছে।

-তারমানে কেউ আপনাকে আবারো থ্রেট দিয়েছে?

…..

-কিন্তু স্যার,সত্যিটাকে সামনে আনা নিয়ে আপনি তো কোনোদিনই আপোষ করেননি।আজ কেনো এভাবে….

-ভয় পেতে শেখো অদ্রি।এতেই সবার ভালো।ভোরের বাংলা কেনো,কোনো নিউজেই আর জড়িও না নিজেকে।এসব…এসব থেকে দুরে থাকো।আমার সাথে আর কন্টাক্ট করো না।দোয়া রইলো তোমার জন্য।ভালো থেকো।

কলটা কেটে গেলো।তব্দা মেরে দাড়িয়ে রইলাম খানিকটা সময়।মানুষ এতো অল্প সময়ে এভাবে পাল্টে যায় কিভাবে ভাবতেও অবাক লাগে।এবার আমার ফোনটা বেজে উঠলো।নাম্বার না দেখেই রিসিভ করলাম কলটা।ওপাশ থেকে শান্ত আওয়াজ এলো,

-ব্যালকনির দরজাটা খোলো অদ্রি।

ফোন কান থেকে নামিয়ে নাম্বারের দিকে তাকিয়ে রইলাম।সেইভড্ না,আননোন নাম্বার।কিন্তু গলার স্বরটা অচেনা নয়।কাপাকাপা গলায় বললাম,

-ক্ কে?

-অঙ্কুর।

#চলবে…
#চলবে….

[ গ্যাপ পরে যাওয়ায় দুঃখিত।আজকের পর্ব অনেক বড় করে দিয়েছি।ভুলত্রুটি মাফ করবেন।
হ্যাপি রিডিং❤ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here