সমাপ্তির প্রহরে সন্ধি পর্ব -১৪+১৫

#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ১৪

রাতের খাওয়া দাওয়া চুকিয়ে বড়রা সব ঘুম। আর আমরা বসে আছি ভাইয়ার বাসর ঘরে। মিম আপুকে ঘরে বসিয়ে ভাইয়াকে ঘরের বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। দাবি পাঁচ হাজার টাকা না দিলে আজকে বাসর ঘরে ঢুকতে দিবো না। ভাইয়া চিৎকার করছে আর বলছে– সকালে না তিন হাজার দিলাম। কিন্তু ওটা কি আমরা কাজে লাগিয়েছি নাকি? ভাইয়াকে বললাম,কিন্তু ভাইয়া শুনলো না। সে তো দেখেনি তাঁর ঘরটা আমরা কতো সুন্দর করে সাজিয়েছি। অবশেষে প্রায় আধা ঘন্টা পর ভাইয়া চার হাজার দিতে রাজি হলো। তাঁর কাছে নাকি এর বেশি আর নেই। আমরা সবাই ভেবেচিন্তে রাজি হয়ে গেলাম। যা পেয়েছি এটাই ঢেড়। ভাইয়াকে ঘরে ঢুকিয়ে বাহির থেকে আমরা দরজা লাগিয়ে দিলাম। যে যাঁর রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

———————

সাগর গুটিগুটি পায়ে মিমের দিকে এগিয়ে গেলো। ঘরটা কিছুটা আলো কিছুটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। মিমের পাশে গিয়ে বসতেই মিম নড়েচড়ে উঠলো। সাগর মিমের হাতটা নিজের হাতের মধ্যে আঁটকে ধরলো।

_ জানো মিম আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তুমি পুরোপুরি আমার হয়ে গেছো। তুমি সেদিন ফোন করে যখন বললে সব শেষ, তখন আমি তো মনে করেছিলাম আর বোধহয় তোমায় পাওয়া হলো না। কিন্তু দেখো আমার ছোট্ট বোনটা কীভাবে আমাদের মিলিয়ে দিলো।

_ কিন্তু, ও তো মায়ের কাছে আরো খারাপ হয়ে গেলো। মা তো এমনই ওকে পছন্দ করে না৷ আমার আর আপনার বিয়ের পর আরো অপছন্দ করবে।

_ যখন দেখবে তাঁর মেয়ে এই বাড়িতে সুখে আছে, তখন সব ভুলে যাবে।

_ আমি মা’কে কমবেশি চিনি। দেখবেন নদীর কোন না কোন ভাবে ঠিক ক্ষতি করবে।

_ চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে। আর তুমি তো আছো সামলে নিও।

_ আল্লাহ ভরসা। আমাকে যখন নদী বললো– শুকরিয়ার নামাজ আদায় করার জন্য তৈরি হও! তখনও আমি বোকা মেয়ে বুঝতে পারিনি। অথচ দেখুন ছোট্ট মেয়েটা একটু আচ করেই সবটা বুঝে নিয়েছে।

_ বাবা এই জন্যই ওকে বুদ্ধিমান বলে।

_ এতো ভালো মেয়েটাকে সবার কাছে কটু কথা শুনতে হয়।

_ কথায় আছে ভালো মানুষের কদর্য কম। ঠিক আমার বোনটাকেও কেউ চিনতে পারে না।

_ দেখবেন ও একদিন সবার খুশির কারণ হবে?

_ অন্য কারো খুশির কারণ হবে কিনা জানি না। কিন্তু আমাদের পরিবারের খুশির কারণ হয়ে সারাজীবন আমাদের সাথে থাকুক।

_ ইনশাআল্লাহ, এটাই দোয়া করি।

_ ওকে তুমি তোমার ছোট বোন ভেবো,আর পাঁচটা ননদ ভাবিদের মতো সম্পর্ক যেন তোমাদের না হয়। আমাকে যেন কখনোই দ্বিধায় পড়তে না হয়,বউয়ের পক্ষে কথা বলবো না বোনের।

_ ছি্ হ আপনি আমায় এতো খারাপ ভাবেন।

_ না মিম,তুমি খুব ভালো। তবুও বলে রাখলাম কেন জানি না?

কথা শেষ করেই সাগর মিমকে বুকে টেনে নিলো। সাগরের বুকে লেপ্টে রইলো মিম।

———————
পরের দিন বিকেল

ঘরের মাঝে পায়চারি করছে বর্ণ। কিছুক্ষণ আগে তাঁরা নিজেদের বাড়িতে চলে এসেছে। কিন্তু যখন সে নিজের জামাকাপড় গুলো আলমারিতে রাখতে গেছে,তখন দেখতে পেলো একটা পেকেট। যে পেকেটটা সে নদীর আলমারিতে খুব গোপনে রেখে এসেছিলো সেটা কি করে তাঁর কাপড়ের ব্যাগে এলো এটাই সে ভেবে পেলো না। আর সাথে একটা চিরকুটও এসেছে। যেখানে লেখা “ভুল করে ভুল জায়গায় জিনিসটা চলে এসেছে। তাই ঠিক জায়গায় পেকেটটা ফিরিয়ে দিলাম”। কথা হচ্ছে নদী জানলো কী করে যে পেকেটটা বর্ণ দিয়েছে। সে যখন পেকেটটা ঘরে রেখেছিলো তখন নদী সাগর ভাইয়ার ঘরে ছিলো অন্য কাজিনের সাথে তাহলে? আর পেকেটটা দিয়ে আসার পরেও বর্ণ দেখেছে নদী তখনোও সাগর ভাইয়ার ঘরে। বর্ণের কাছে সব ধোঁয়াশা। সে সাত পাঁচ না ভেবে নদীর নাম্বারে কল করলো। কিন্তু ফোন বন্ধ বলছে। কিন্তু এমন তো হওয়ার নয়। সে আবারও ডায়াল করলো, কিন্তু এবারও বন্ধ পেলো। হঠাৎ বর্ণ কিছু একটা ভেবে তাঁর চাচ্চুর নাম্বারে কল করলো। কিছুক্ষণ কল বেজে একজন ভারি কন্ঠের গলা শোনা গেলো।

_ কেমন আছো,তোমরা পৌঁছে গেছো।

_ জ্বি চাচ্চু। আলহামদুলিল্লাহ আমরা পৌঁছে গেছি। ওদিকের কি খবর? সব ঠিকঠাক।

_ হ্যা বাবা সব ঠিকঠাক।

_ চাচ্চু একটু নদীর কাছে দেওয়া যাবে ফোনটা। আসলে ওর কিছু টাকা আমার কাছে রয়ে গেছে, ভুলে নিয়ে এসেছি।

_ ওকে ফোন করোনি?

_ করেছি,কিন্তু ফোন বন্ধ বলছে।

_ আচ্ছা দিচ্ছি।

মান্নান সাহেব সোফা ছেড়ে নদীর ঘরের দিকে এগোলেন। নদীর দরজার সামনে এসে টোকা দিলেন।

_ কইরে মা ঘরে আছিস।

হঠাৎ অসময়ে বাবাকে কড়া নাড়তে দেখে অবাক হলাম। আমার বাবার কিছু বিষয় আমার খুব ভালো লাগে। তাঁর মধ্যে মেয়েদের ঘরের দরজা খোলা থাকলেও নক করে তারপর ঘরে ঢোকার বিষয় হচ্ছে
একটা। আমি বিছানা থেকে উঠে বাবা-র কাছে গেলাম।

_ এভাবে বলছো কেন? মনে হচ্ছে অন্য কারো রুম।

আমার কথায় বাবা মুচকি হাসলেন। আমার দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বললেন।

_ নে কথা বল,আমি একটু তোর মায়ের কাছে যাচ্ছি।

_ কে বাবা?

_ বর্ণ,তোর কিছু টাকা নাকি ওর কাছে রয়ে গেছে সেই বিষয়ে কিছু বলবে হয়তো।

আমি ফোনটা বাবা-র হাত থেকে নিতেই বাবা চলে গেলেন। আমি ফোনটা কানে তুলে নিলাম।

_ বলেন

_ ফোন বন্ধ কেন?

_ সেটা আপনায় কেন বলবো? এটা জিজ্ঞেস করতেই কি ফোন করেছেন? আর বাবাকে মিথ্যা কেন বললেন?

_ সেটা আমার উপরে ছেড়ে দে। পেকেটটা তুই ফেরত দিলি কেন? আর কখন আমার ব্যাগে ওটা রেখেছিস।

_ আপনি যেভাবে সবার অগোচরে আমার আলমারিতে রেখেছিলেন,আমিও ঠিক সেভাবেই রেখেছি।

_ তুই বুঝলি কী করে জিনিসটা আমার দেওয়া,বাই এনি চান্স তুই কি—

_ আপনি কি বোঝাতে চাইছেন আমি জানি না। কিন্তু আপনি হয়তো ভুলে গেছেন,পেকেটটা নিয়ে রিক্সায় উঠার সময় আমিও পাশে ছিলাম। আপনি হয়তো রিক্সার ডান পাশে আমার উপস্থিতির কথা ভুলে গেছেন।

বর্ণের মনে ক্ষীণ পরিমাণ আশার আলো জ্বলে উঠলেও তা দপ করে নিভে গেলো কয়েক মুহূর্তেই। সে ভেবেছিলো হয়তো নদী তাঁর মনের খবর কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে। কিন্তু তাঁর আশার আলো নিভিয়ে দিতে নদী কয়েক সেকেন্ডও সময় নিলো না। কোন মতে নিজেকে সামলে নিলো বর্ণ। বারবার আহত মনটাকে এভাবে ক্ষত বিক্ষত করার কোন মানে হয় না।

_ যেহেতু তোর আলমারিতে রেখেছি তাহলে জিনিসটা তোর। তাহলে আমাকে ফেরত দিলি কেন?

_ মনে হয়েছে, কারো দয়া নিয়ে নিজেকে ঋণী না করাই ভালো।

_ আমি তোকে দয়া করেছি নদী এটা তুই ভাবলি কি করে?

_ যদি দয়া না করতেন তাহলে আমার জন্য অন্য কিছু আনতেন,চুড়ি কিনবা মেহেদী নয়।

_ আমি তো—

_ প্লিজ বর্ণ ভাইয়া আমায় এভাবে মনে করিয়ে দিবেন না আমি প্রতিবন্ধী। কেউ মনে না করালেও আমি জানি আমি কী?

_ তুই ভুল ভাবছিস।

_ ঠিক জেনেও বা কি করবো বলেন। আপনি আমার কাজিন,তাই সবটা না হলেও কিছুটা হলেও জানতেন! আমি ছোট থেকেই চুড়ি আর মেহেদী অপছন্দ করি। তাহলে আমার কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার কি মানে?

_ আমি তোকে কিছুটা না অনেকটাই জানি নদী,তাই এটাও জানি– তোর চুড়ি আর মেহেদী কতটা পছন্দ। আমি সেদিন তোর ডায়েরির প্রথম পাতায়—

_ কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাটাঘাটি করা উচিৎ নয়। আর আমার মতো মেয়েদের জীবন নিয়ে তো একদমই নয়। মনে রাখবেন,আমি মোম নই কারো একটু আগুনের ছোঁয়ায় গলে যাবো। আমি শীতল জলের মতো,হয় কাউকে তৃপ্তি দিবো,না-হয় কাউকে চুবিয়ে মারবো। তাই দ্বিতীয়বার আমাকে জানতে আসবেন না।

_ তোর রাগ হচ্ছে না তোর অজান্তে তোর ডায়েরি পড়েছি যে?

_ ওটা তিন বছর আগের লেখা বদ্ধ ডায়েরি! তখন ভুলভাল অনেক কিছুই লিখে রেখেছি। সময় এগিয়েছে সেই সাথে আমিও এগিয়ে গেছি। সেই তিন বছর আগের ডায়েরি পড়ে যদি মনে করেন আপনি আমায় পড়ে ফেলেছেন, তাহলে ভুল। আমি না গল্পের শুরুতে আছি, না শেষে। আমি গল্পের মাঝে বসবাস করছি। আমাকে বুঝতে হলে পুরো বইটা শেষ করতে হবে। আর জীবন নামের এই বইটা কখন কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ হবে কেউ জানে না। তাই পড়তে পারবেন না আমায়।

_ আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, তুই অনেকটাই সিরিয়াস। মনে হচ্ছে কাউকে তুই এটা বুঝাচ্ছিস! নদীর স্রোতে ঝাপ দিও না তলিয়ে যাবে।

_ আপনি বুদ্ধিমান, তাই বুঝে নিয়েছেন।

_ এক সপ্তাহ এতোটা কাছাকাছি থেকেও তোকে এতোটা বুঝতে পারিনি,যতোটা এখন বুঝতে পারছি। আমি তোর সাথে দেখা করতে চাই।

_ কিন্তু আমি তো চাই না।

_ তোর চাওয়ায় কিছুই যায় আসবে না এই বর্ণের। তুই কিছু না বলেও অনেক কিছুই বলে দিয়েছিস সেটা কি তুই জানিস? যখন আমি বুঝে নিয়েছি তাহলে আর দেরি কীসের?

_ আপনার মনে হচ্ছে না একটু দ্রুতই সব বুঝে নিলেন?

_ দ্রুত নয়,একটু দেরিতে বুঝতে পেরেছি।

_ রাখছি

_ রেখে আর পালাবি কোথায়,বর্ণের জালে তোকে যে ধরা দিতেই হবে।

_ হা হা হা সময় না-হয় কথা বলবে।

_ তুই আমায় চ্যালেঞ্জ করছিস।

_ না,কিন্তু সাবধান করছি।

_ আমি বর্ণ,সামনে এগিয়ে যাওয়ার আরেক নাম। পিছু সরে দাঁড়ানো আমার রক্তে নেই! সেটা তোর বড় চাচ্চুকে দেখে শেখা উচিত। যদি মনে করে থাকিস,মোবাইল সিম পাল্টে ফেললে আমার থেকে আড়াল হতে পারবি! তাহলে বলবো– তুই বড্ড বোকা। কারণ নিজের থেকে নিজের ছায়াকে কখনোই আড়াল করা যায় না। এমন কি মৃত্যুর পরে-ও ছায়া কিন্তু সঙ্গ ছাড়ে না।
#সমাপ্তির_প্রহরে_সন্ধি
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ১৫

ব্যাগের ফোনটা অনবরত ভাইব্রেশন করছে। বিরক্ত তখন আমার আকাশ সমান। একে তো আমি ক্লাসে আছি তারউপর ক্লাস চলছে,এর মধ্যে একাধারে ফোনটা বেজে চলছে। ICT সাবজেক্ট বিষয়ে আমরা সবাই কমবেশি জানি। আমার খুব পছন্দের একটা সাবজেক্ট। আমার ভালো লাগে এই বিষয়ে জানতে বুঝতে। মনোযোগ দিয়ে স্যারের কথা শুনছিলাম হঠাৎ ফোনটা বাজতেই খেয়াল হারিয়ে গেছে। লুকিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই একটা নাম জ্বলজ্বল করলো চোখের সামনে। বর্ণসুখ। হ্যা আমি বর্ণ ভাইয়ার নাম্বারটা বর্ণসুখ দিয়েই সেভ করে রেখেছি। সিম চেঞ্জ করলেও নাম্বারটা তো ফোনে সেভই আছে। এই মুহূর্তে মানুষটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। গত তিনদিন ধরে সে আমায় অনেকবার কল করেছে। যখন থেকে সে বুঝতে পেরেছে,আমি তাঁর মনের গোপনতা আগে থেকেই জানতাম। তখন থেকে যেন তাঁর সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। হঠাৎ স্যারকে সবাই দাঁড়িয়ে সালাম জানাতেই আমার খেয়াল ফিরলো। স্যার চলে যাচ্ছে। আমি বাহিরে এসে কলব্যাক করলাম।

_ কি সমস্যা আপনার বলবেন একটু?

_ গত তিনদিন তোকে কম হলেও পাঁচশবার ফোন করেছি,ফোন ধরিসনি কেন?

_ ইচ্ছে করেনি তাই।

_ এতো দায়সারাভাবে উত্তর দিচ্ছিস,মনে হচ্ছে আমি পাড়ার বখাটে ছেলে,আর তুই পাড়ার সুন্দরী মেয়ে

_ বখাটের থেকে এই মুহূর্তে কম নন আপনি। আমি তো সুন্দরী মেয়ে নই,তাই তো জিজ্ঞেস করছি আমাকে বিরক্ত কেন করছেন?

_ তোকে কিছু প্রশ্ন করার আছে।

_ করুন

_ দেখা কর।

_ কোন মতেই না। যা বলার ফোনে বলুন।

_ দেখা করবি না,এটা কি তুই প্রতিজ্ঞা করে রেখেছিস।

_ যদি বলি হ্যা

_ তাহলে আমি বলবো,আমাকে বাধ্য করিস না এমন কিছু করতে! যেটা তোর ভালো লাগবে না।

_ করেই দেখুন।

_ তোর প্রত্যেকটা চ্যালেঞ্জ আমি একসেপ্ট করলাম।

_ ভালো

_ আমি তোকে ভালোবাসি,এটা কবে থেকে জানিস?

_ কেন?

_ ঠিক আছে বলতে হবে না। আমি তোকে ভালোবাসি এটা জানতিস যখন,তাহলে আমাকে এরিয়ে যেতিস কেন? আর এরিয়ে যাওয়ার বিশেষ কোন কারণ ছিলো কী তোর কাছে?

_ আমার আপনাকে পছন্দ ছিলো না।

_ কলেজের সামনে যে রেস্টুরেন্টে আছে,সেখানে আমি বসে আছি চলে আয়। বাকি কথা সামনা-সামনি হবে।

_ আপনি—-

_ হ্যা আমি যশোর থেকে তোদের
এখানে এসেছি। এখন এই মুহূর্তে আমার সাথে দেখা কর।

_ কোন মতেই না। এসেছেন যেভাবে সেভাবেই চলে যান চেনা পথ ধরে।

_ আমি জানতাম তুই এটাই বলবি,তাই–

_ তাই কী?

_ পিছনে তাকা

আমি ফোন কানে নিয়েই পিছু ফিরলাম। আল্লাহ কিছুটা দূরে বর্ণ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। আকাশী রঙের টিশার্ট,চোখে চশমা আর কানে ফোন। চোখে চশমা থাকায় তাঁর চোখ কোথায় স্থীর হয়ে আছে বোঝা যাচ্ছে না! কিন্তু যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে তাতে যে কারোই মাথা খারাপ হওয়ার মতো ভালো লাগবে। কিন্তু আমি এসব কি ভাবছি। এসব আমার ভাবা নিষেধ। আমি কোনমতে এদিক ওদিকে তাকালাম। তারপর ভৌ-দৌড়। এবার কে ধরে আমায়। দৌড়াতে দৌড়াতে কলেজের গেট পাড় করে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। জোরে শ্বাস নিয়েই একটা রিক্সা দাঁড় করালাম। কোনো দিকে না তাকিয়ে যে-ই না রিক্সায় উঠতে যাবো, ওমনি আমার হাতে বাঁধা পরলো। পিছনে না ফিরেও বুঝতে পারলাম,ধরা পরে গেছি। বর্ণ ভাইয়া ইশারায় রিক্সা-ওয়ালাকে চলে যেতে বললো। রিক্সা-ওয়ালা চলে গেলেন। আমি উনার হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম।

_ মাঝ রাস্তায় এভাবে অসভ্যতা করার কি মানে? এটা কোন ভদ্রলোকের ব্যবহার হতে পারে না।

_ তুই গত তিনদিন ধরে যেটা করছিস,সেটার থেকে এটা কম বৈ বেশি না।

_ আমি কিছুই করিনি।

_ সিরিয়াসলি, তুই কিচ্ছু করিসনি।

_ না

_ ওকে মেনে নিলাম,চল আমার সাথে।

_ কোথায়?

_ রেললাইনে। একটু হাঁটবো।

_ কেন?

_ গেলেই বুঝবি।

_ আমি কোথাও যাবো না।

এই কথা বলেই আমি উল্টো পথে হাঁটতে রইলাম। কিছু পথ যেতেই বর্ণ ভাইয়া আমার হাত টেনে ধরলেন।

_ এটা পাবলিক প্লেস, মজা করার মঞ্চ নয়।

_ জানি সেটা

_ তাহলে আমার হাতটা ছারুন।

_ যদি না ছাড়ি।

_ ভদ্রতা বজায় রাখুন। এই অভদ্রতার চরিত্রে আপনায় মানাচ্ছ না।

_ তোর সাথে ভদ্রতা নিয়ে কথা বা অন্য কিছু ,উঁহু যাচ্ছে না। তাই কোন সিনক্রিয়েট না করে যেটা বলছি সেটা কর।

_ আপনি আগে আমার হাত ছারুন।

আমি হাতটা মোচড়ামুচড়ি করলাম। কিন্তু বর্ণ ভাইয়ার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে পারলাম না। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে লোকজনের সমাগম একটু কম। নাহলে আল্লাহ জানে কি হতো হাত ধরার ব্যপারটা নিয়ে। আমি যতো চাইছি,কোন ভাবেই আমি এই মানুষটার কাছে ধরা দিবো না। ততোই যেন মানুষটা কাছে চলে আসছে বিনা নোটিশে। এক তরফা কখনোই কাউকে এভাবে দূরে সরিয়ে রাখা যায় না।

_ কি ভাই এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত টানাটানি করছেন কেন? আর মেয়েদের ডিস্টার্বই বা করছেন কেন?

হঠাৎ একজন পথচারীর কথা শুনে আমরা দু’জনেই ফিরে তাকালাম। আমাদের তাকাতে দেখে লোকটা আবারও বলে উঠলো —

_ আপুর হাতটা ছাড়বেন আপনি,নাকি মানুষ জড়ো করবো। গণধোলাইয়ের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই! সেটা খেতে না চাইলে হাতটা ছেড়ে মানেমানে কেটে পরুন।

লোকটার কথায় বর্ণ ভাইয়া হাতটা ছাড়ার বদলে আরো শক্ত করে ধরলো। লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো–

_ আসলে ভাই হয়েছে কি? বাপের বাড়ি যেতে চেয়েছে বউ,কিন্তু না করেছি সেই জন্য বউ রাগ করেছে। এখন রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছি। কিছুতেই পারছি না। উল্টো পাল্টা রাস্তায় যেন যেতে না পারে,তাই হাত ধরে রেখেছি। যদি কোন টিপস দিতে পারেন রাগ ভাঙানোর।

বর্ণ ভাইয়ে কথায় আমি বিষম খেলাম। কাশতে কাশতেই আমি উনার দিকে চোখ গরম করে তাকালাম। আমার দিকে একপলক তাকিয়ে লোকটার উদ্দেশ্য আবার বললো।

_ দেখলেন ভাই রাগ ভাঙানোর টিপস চাইতেই কেমন রেগে যাচ্ছে। বড়োই বিপদে আছি বউটাকে নিয়ে। এই জন্যই বলে, জীবনে আর যাই করো না কেন? বিয়ে করো না। মাঝে মাঝে শ্বশুরের প্রসংশা না করে পারি না! কি মেয়ে তৈরি করেছে মা*ই*রি। পুরাই বুম্বাই-মরিচ। আপনি বিয়ে করেছেন ভাই। করলে নিশ্চয়ই এমন একটা বউ আপনারও। আচ্ছা বউ পাল্টানোর কোন দোকান আছে কী? মানে? থাকলে এই বউটা চেঞ্জ করে নতুন বউ আনতাম। আপনি জানেন না ভাই বউটা আমায় কতো প্যারা দেয়।

বর্ণ ভাইয়ের কথাগুলো হয়তো লোকটার বেস পছন্দ হয়েছে। তাই সে হাসিমুখেই বললো–

_ ভাই আপনি তো আপনার বউয়ের বদনাম তাঁর সামনে বলার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছেন,বা দেখাচ্ছেন। আর আমার বউয়ের বদনাম পিছনেও বলার মতো শত সাহস আমার নেই। তাহলে বুঝতেই পারছেন,আপনার থেকেও আমার অবস্থা কতোটা খারাপ। এই মেয়ে জাত বড়োই ডেঞ্জারাস।

কথা শেষ করেই লোকটা বিরবির করতে করতে চলে গেলেন। আর আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এতো ভয় পায় সে তাঁর বউকে। আর আমি কি করলাম! আমার এতোগুলা বদনাম কেন বর্ণ ভাইয়া করলো। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে আমি তাঁর বউ কবে হলাম। আমি বর্ণ ভাইয়াকে কিছু বলতে নিলেই,তিনি আমার হাত ধরে একটা রিক্সায় উঠে পড়লো। পুরো রাস্তা শুধু আমি এটাই ভাবলাম, একটা মানুষ কি করে এতো মিথ্যা বলতে পারে আল্লাহ।

———————-

রেললাইনে যাওয়ার কথা থাকলেও বর্ণ ভাইয়া গেলেন না। আমাকে নিয়ে সোজা আমাদের বাড়িতে চলে এলেন। কলিং বেল বাজাতেই মা দরজা খুলে দিলেন।

_ বর্ণ, বাবা তুমি হঠাৎ?

_ এমন-ই, একটা কাজে এসেছিলাম। তাই ভাবলাম দেখা করে যা-ই।

_ ভালো করেছো,এসো ঘরে এসো।

আমরা ঘরে প্রবেশ করলাম। আমাকে দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন।

_ কিরে তুই এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি।

_ আরে চাচি ক্লাস বাদ দিয়ে দেখলাম বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারছে। তাই সাথে করেই নিয়ে এলাম।

_ আচ্ছা, তুমি বসো আমি আসছি। কি খাবে বলো।

_ আপাতত কিছু না।

_ দুপুরে খেয়ে যাবে তো।

_ ভাবছি আজ থেকে যাবো চাচি,আপনাদের কোন অসুবিধা নেই তো?

_ আল্লাহ এটা কেমন কথা।একদিন কেন যতোদিন ইচ্ছে থাকো,কেউ বারন করবে না। হুট করে আমাদের বাড়িতে তো কখনোই আসো না,তাই একটু অবাক হয়েছি। সে যাইহোক তুমি বসো,আমি তোমার জন্য চা পাঠাই।

_ এখন চা খাবো না চাচি,পারলে একটু মুড়িমাখিয়ে দিন।

_ ঠিক আছে। আমি তো রান্না করবো,মুড়িটা না-হয় নদী মাখিয়ে দিবে।

_ ও কি আপনার মতো এতো সুন্দর করে মুড়ি মাখাতে পারবে। আপনি কতো সুন্দর করে মুড়ি,চানাচুর, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ,আচারের তেল সাথে ভালোবাসা মিশিয়ে মুড়ি মাখান!ও কি সেটা পারবে?

_ আরে পারবে,শিখতে হবে না। তুমি বসো আমি যাচ্ছি। নদী বোরকা খুলে রান্নাঘরে আয়। আমি ততোক্ষণে কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ কেটে রাখছি।

মা চলে গেলেন। মা যেতেই পা তুলে সোফায় গা ভাসিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো বর্ণ ভাইয়া। চোখ বন্ধ করে বললো–

_ কেন জানি ভেতর থেকে একটা জামাই জামাই ফিল হচ্ছে। আহ্ এমন আদর যত্ন সারাজীবন পেতে হলেও আমার তোকে বিয়ে করা উচিৎ নদী। কি বলিস তুই? এখন ছেলে তাই কতো আদর যত্ন,না জানি রাজ্যসমেত রাজকন্যাকে বিয়ে করলে কতো আদর,যত্ন করে। ইসস ভাবলেই আমার গা শিরশির করছে।

বর্ণ ভাইয়ের কথায় আমার গা জ্বলে উঠলো। টি-টেবিল থেকে খবরের কাগজটা বর্ণ ভাইয়ার মুখের উপর ছুড়ে দিয়ে বললাম–

_ বা****লটা পাবেন। ফের যদি এই বাড়িতে অকারণে এসেছেন! খুব খারাপ হবে বলে রাখলাম।

—————-

হুট করেই বর্ণ ভাইয়া আমাদের বাড়িতে চলে আসায়,নিজের কোন পোষাক আনতে পারেনি। তাই দুপুরে গোসল করে বাবার একটা লুঙ্গি আর ভাইয়ার গেঞ্জি পড়েছে। অবশ্য ভাইয়া বলেছিলো তাঁর একটা জিন্স পড়তে। কিন্তু তিনি নিজে থেকেই বাবা-র লুঙ্গি পড়ার দাবি জানিয়েছেন। তো এখন আমরা সবাই মিলে খাবার খেতে বসেছি। মা বর্ণ ভাইয়ার জন্য হাঁসের মাংস রান্না করেছে। বর্ণ ভাইয়ার হাঁসের মাংস খুব পছন্দ। আমার বাবা-মা আমাদের পরিবারের সকলের কি পছন্দ অপছন্দ তার সম্পর্কে কমবেশি জানে। তাই বর্ণ ভাইয়ের ব্যপারেও জানেন।

_ তা বর্ণ শুনলাম কোন কাজে এসেছিলে?কি কাজে এসেছিলে?

_ চাচ্চু যে কাজে এসেছি সেটা কমপ্লিট হোক তারপর বলি।

– আচ্ছা। তোমায় লুঙ্গিতে কিন্তু বেস লাগছে।

_ আপনার লুঙ্গিটা পড়ে কেন জানি আমার অন্যরকম একটা ফিল হচ্ছে।

_ অন্য রকম অনুভূতি, তা কেমন বলো তো শুনি।

_ ওই যে শ্ব—

_ আল্লাহ গো কি ঝাল। আম্মু পানি দাও। আমার জিহ্বা জ্বলে যাচ্ছে।

বর্ণ ভাইয়ের পুরো কথা শেষ করতে দিলাম না,তাঁর আগেই ঝাল লেগেছে এমন ভাব ধরলাম। আমার কান্ডে সবার নজর এখন আমার দিকে। কিন্তু নীরবে মুখে ভাত তুলে নিচ্ছে বর্ণ ভাই। এই ছেলে দেখি আমায় কেস খাওয়ানোর জন্য উঠে পরে লেগেছে। আমি সবাইকে না বলেই উঠে পড়লাম খাবার টেবিল থেকে। খেয়াল করলাম আমার পিছনে বর্ণ ভাইয়াও উঠে আসছে। আমি দ্রুত নিজের ঘরের দিকে দৌড় দিলাম! ঘরের দরজা আঁটকে দেওয়ার আগেই এক হাত দিয়ে সেটা আঁটকে দিলো বর্ণ ভাইয়া। মুচকি হেঁসে বললো–

_ বিশ্বাস কর,চাচ্চুর লুঙ্গি পড়ে নিজেকে তাঁর জামাই ভাবতে বসা এই আমিকে কেন জানি অন্য রকম লাগছে। শ্বশুরের মেয়ে কি আমায় তাঁর বর হিসেবে মেনে নিবে,তুই কি বলিস? আমার এই দাবি কি তাঁর মানা উচিত নয় বল। এমন সুন্দর সুদর্শন ছেলে কোথাও সে পাবে কী? এমন ছেলের পিছনে হাজার মেয়ের বাবা-রা লাইন দিয়েছে। আর এই আমি তো এই লুঙ্গির মালিকের মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি।

_ ছি্ হ কি বিচ্ছিরি ভাষা। তিনি না আপনার বড় চাচা। বিয়ে তো দূর, আমার বিয়েতেও আপনায় দাওয়াত দেওয়া হবে না।

চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here