সমুদ্র বিলাস পর্ব ১

সমুদ্র বিলাস

এক.

তোহা পুরো বিকেল বাড়ি জুড়ে ভূতের মতো ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যায় রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তোহার জন্মদাত্রী ফাহিমা বেশ কিছুক্ষণ ডেকেছেন। তোহা জবাব দিল না। সে ফ্লোরে বসে মাথা দেয়ালে ঠেকিয়ে রেখেছে। জীবনটা যেন থেমে গিয়েছে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই কান্না আসছে না। জীবনটাকে তুচ্ছ মনে হচ্ছে তাঁর। দু’হাতে মুখ ঢেকে বড় করে বার পাঁচেক নিঃশ্বাস নিল। দু’মিনিটের মাথায় হেঁচকি তুলে কান্না আসে। নাকের পাটা হয় লাল। ছোট ছোট চোখ দু’টি জলে সমুদ্র। সেকেন্ড কয়েক পর পর টি-শার্টের কোণা দিয়ে জল মুছে যাচ্ছে। বুকে অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে। এই যন্ত্রণা এতোটাই বেদনাদায়ক যে এর কোনো কঠিন নাম দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তোহার। যাতে শোনা মাত্রই মানুষের কষ্ট হয়। নাকের পানি চোখের পানি এক হয়ে গলা, বুক ভিজে যাচ্ছে। যেন বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে সে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। তোহা সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ভাবে, এখানে ওড়না বেঁধে ফাঁস দিয়ে আজ মরবো আমি। তোহা বিছানায় উঠে। শক্ত দেখে একটা ওড়না নেয়। এরপর আবার কি ভেবে ওড়নাটা রেখে দেয়। সেফটিপিন নিয়ে চেয়ারে বসে। বাম হাতের দিকে ঝিম মেরে তাকিয়ে থেকে ভাবে,সেফটিপিন দিয়ে রগটা কেটে ফেললে কেমন হয়?
সে সেফটিপিন তাঁর সেনসেটিভ ত্বকে স্পর্শ করতেই ছ্যাঁত করে উঠে। না সেফটিপিন দিয়ে হবে না। কষ্ট হবে খুব। কষ্ট করে মরা যাবে না। এমনিতেই বুকে অনেক কষ্ট। তোহা গুগলে সার্চ দেয়, সুইসাইড করার সহজ উপায় কি?

নাহ কোনো উপায় নেই। কিছু ওয়েবসাইটে বদমাশ কিছু ছেলে এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছে, ছাগলের দড়ি আর কচু গাছ দিয়ে চেষ্টা করুন।

তোহার জীবনটা নিরামিষ হয়ে গেছে সেখানে এদের মশকরা দেখে অন্তর্জ্বালা আরো বেড়ে যাচ্ছে। তোহা তাঁর ফেইক আইডিতে স্ট্যাটাস দেয়, সুইসাইড করার সহজ উপায় কি? কষ্ট হবে না এমন উপায় বলুন।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ত্রিশ-চল্লিশটা কমেন্ট পড়ে। তোহা আশা নিয়ে প্রতিটা কমেন্ট মনোযোগ দিয়ে পড়ে। কেউ উপদেশ দিচ্ছে তো কেউ মজা নিচ্ছে। নাহ! এরা কেউ তোহার কষ্ট বুঝবে না। তোহা ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দূরে। ভাবতে থাকে। কীভাবে কষ্ট ছাড়া সুইসাইড করা যায়।রাত নয়টার দিকে ছাদে চলে আসে। ছাদের কর্ণারে দাঁড়িয়ে নিচে তাকায়। সাথে সাথে বুক কেঁপে উঠে। এই রাস্তায় একবার পড়লে মগজ,নাড়ীভুঁড়ি বেরিয়ে একসাথে খিচুড়ি হয়ে যাবে। তোহা ঢোক গিলে রুমে ফিরে আসে। পায়চারি করে ঘর জুড়ে। এই পৃথিবীর মানুষ বড়ই নিষ্ঠুর। কেউ কারো না। তোহার দৃঢ় সংকল্প আজ সে মরবেই। ধীর পায়ে হেঁটে এসে বৃদ্ধা নাহারের রুমে ঢুকল। সম্পর্কে তোহার দাদি হয়। নাহার তোহাকে দেখতে পেয়ে বললেন, ‘কিরে ছেমড়ি? সারাদিন নাকি খাস নাই? কি হইছে তোর?’

‘অতসব তোমার জানতে হবে না। তোমার ঔষধের বক্সটা কই?’

‘কেন? কি দরকার? আমার ঔষধের বক্সে তোর কি দরকার?’

নাহারের প্রশ্নে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকাল তোহা। নিজেই খুঁজতে থাকে গোলাপি বক্সটা। নাহার সূক্ষ্ম চোখে তা পর্যবেক্ষণ করেন। তোহা বক্সটি পেলেও কাঙ্খিত ঘুমের ট্যাবলেট পেল না। ব্যার্থ মন নিয়ে নিজ রুমে ফিরে আসে। কিছু ভালো লাগছে না। মাথাটা ধরেছে খুব। ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে কিছু একটা দেখে। মুখ দেখে বোঝা গেল যা দেখতে চেয়েছিল তা দেখতে পায়নি। প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খেয়ে ক্লান্ত গা এলিয়ে দেয় নরম বিছানায়।

ফোনটা বেজে উঠলো। তোহা চোখ বন্ধ রেখেই বিছানায় হাতড়ে খুঁজে ফোন। নাগালও পেয়ে যায়।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে অঞ্জলির কণ্ঠ,’তোহা বলছিস?’
তোহা অঞ্জলির ফোনে ভারী বিরক্ত হয়েছে।এমনভাবে অবহেলা স্বরে বলল,’তো আমার ফোন কি তোর জামাই ধরবো?’
‘রেগে আছিস?’
‘না খোশ মেজাজে আছি।’
‘একটা খবর দেওয়ার ছিল।’
‘বলে ফেল।’
‘আগামীকাল বিকেলে কক্সবাজার ট্যুরে যাচ্ছি। তুই যাবি?’

তোহা চোখ খুলে। হ্যাঁ, এইতো সুযোগ। নিজের ডিপ্রেশন, একাকীত্ব কাটানোর সুযোগ। তোহা স্বাভাবিকভাবে বলল,’কবে প্ল্যান করলি? আর কারা যাচ্ছে?’
‘ভাইয়ার অফিস কলিগরা মিলে যাচ্ছে। সবাই নিজের পরিবারের সদস্যকেও নিতে পারবে। তোরও ইচ্ছে সমুদ্র দেখার আমারও।তাই ভাইয়া বলেছে,আমরা চাইলে যেতে পারি।’

অঞ্জলি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও অঞ্জলির সাথে তোহার আত্মার সম্পর্ক। এমনকি দুই পরিবারের সম্পর্কও বেশ সহজ।তোহা রাজি হয়। বলল,’যাবো। বিপ্লব ভাইয়াকে বলিস পাপাকে কল করতে।’
‘আচ্ছা বলবো।’
‘রাখ এখন।আমার ভীষণ মাথা ধরেছে।’

অঞ্জলির ফোন কাটার অপেক্ষায় তোহা থাকলো না। সে কেটে দিল। এরপর চোখ বুজলো। বেশি সময় লাগলো না ঘুমাতে। কান্নার পর জম্পেশ ঘুম হয়। ভালো ঘুমের জন্য হলেও কাঁদা উচিৎ।

__________
তোহা ভেবেছিল বিপ্লব ভাইয়ার অফিস থেকে ট্যুরে যাওয়া হচ্ছে। এ ভুল ভাঙলো এরপরদিন। বিপ্লব ভাইয়া তাঁর অফিসের ক্লোজ চার-পাঁচ জনকে নিয়ে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে এই প্ল্যান করেছে। বাকি কলিগদের মধ্যে তিন জন পরিবারের সদস্য নিয়েছে। একটাও মেয়ে নেই। সে,অঞ্জলি আর বিপ্লব ভাইয়ার একজন কলিগই মেয়েদের মধ্যে। মহাখালী বাস টার্মিনালে সবার সাথে দেখা হয়। ঠিক,ঠিক সময়ে যাত্রা শুরু হয়। অঞ্জলি বিপ্লবের কলিগ বসন্তকে একা সিটে বসতে দেখে চট করে পাশে বসে পড়ে। তোহার মেজাজ খারাপ হলেও কিছু বললো না। অঞ্জলি লুকিয়ে লুকিয়ে বসন্ত দা’কে খুব ভালবেসে। একসাথে জার্নির সুযোগ পেয়েছে, থাকুক না। তোহার পাশে বসে বিপ্লব ভাইয়ার কলিগ মেয়েটি।
তোহাকে বিগলিত হয়ে সে প্রশ্ন করে, ‘নাম কী?’

তোহা পিটপিট করে তাকায়।এরপর সহজ গলায় বলে, ‘তোহা আহমেদ।আপনার নাম কী?’
‘আমি শেখ নুপুর।তুমি আমাকে তুমি বলতে পারো।’

তোহা মিষ্টি করে হাসলো।যার অর্থ,সে তুমি করেই বলবে।নুপুর কথা বাড়াতে থাকল।
‘সিট খালি পেলে সবাই জানালার পাশে বসতে চায়।তুমি বসোনি কেন?’
‘আমার জানালার পাশের সিট ভালো লাগে না।’
নুপুর অবাক হবার ভান করে বলল,’এই প্রথম কোনো মেয়ের মুখে শুনলাম।’

তোহা মনে মনে বেশ বিরক্ত হলেও কিছু বলছে না। কি দরকার অন্যের প্রফুল্লতা কেড়ে নেওয়ার? কথার ফাঁকে তোহার নজর পড়ে পিছনের সিটে। ব্ল্যাক শার্ট পরা একটা ছেলে আড়চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তোহা ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেলল। চোখ সরিয়ে নিল। নুপুরের সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলো।

‘আচ্ছা? আমি তোমাকে আপু ডাকলে খুশি হবে নাকি আপা?’
নুপুর হেসে কোমল কণ্ঠে বলে, ‘তোমার যাতে তৃপ্তি।তাই ডেক।’
‘তাহলে আপা ডাকি? আপা ডাকটায় কিছু যেন আছে। আমি আমার কাজিনদের আপা ডাকতে চাই। কিন্তু তাদের আপা ডাকটা আনস্মার্ট লাগে।’

নুপুর হাসলো। দীর্ঘ হাসি। বললো, ‘সত্যি বলেছো,আপা ডাকটায় অদ্ভুত একটা টান আছে। আমি আমার বোনকে আপা ডাকি। আমার ছোট বোনও আমাকে আপা ডাকে।’

তোহার মনে হচ্ছে ছেলেটি তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। একবার কি ফিরে দেখবে? সেই চিন্তা তোহা করছে মিনিট খানিক ধরে। শেষমেশ সে পিছন ফিরে তাকায়। সত্যি তাই! ছেলেটা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। অথচ, তোহার বিন্দুমাত্র অস্বস্তি হচ্ছে না। সে স্বাভাবিকভাবেই চোখ ঘুরিয়ে নেয়। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে।

বেশ কিছুক্ষণ পর তোহা আবিষ্কার করলো ছেলেটি তার ডান পাশের সিটে এসে বসেছে। আগে যিনি বসেছিলেন তিনি পিছনে চলে গিয়েছেন। কি অদ্ভুত!

তোহা ছেলেটিকে ইগ্নোর করতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। চতুর্থবারের মতো তাকিয়ে দেখল, ছেলেটি তার কোমরের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। তোহা ডান পাশের কোমরের দিকে তাকিয়ে দেখলো, কামিজ উপরে উঠে এসেছে।ফলস্বরুপ, কোমর দেখা যাচ্ছে। তোহার মেজাজ বিগড়ে যায়। কামিজ টেনে উন্মুক্ত অংশ ঢাকে। এরপর বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজের মেজাজ কন্ট্রোল করে আবার চোখ বুজে। তোহা ছেলেটির দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পেরেছে, ছেলেটি ভারী অবাক হচ্ছে তার ব্যবহারে। অবাক হওয়ারই কথা।

_________
তখন রাত অনেকটা।একদম প্রথম সারির প্রথম সিটের একটি মেয়ে বিরতিহীন ভাবে বমি করছে প্রায় মিনিট দশেক ধরে। বাসে উঠলে এতো বমি হয় তাহলে উঠে কেন এরা? অন্যদের বিভ্রান্ত করে। মেয়েটির মা বাস ড্রাইভারকে বাস থামাতে বলছেন। ফার্মেসী থেকে মেয়ের জন্য ঔষধ নিবেন। বাস ড্রাইভার কিছুতেই থামাবেন না। তোহার ড্রাইভারকে ঘাউড়া মনে হচ্ছে। ড্রাইভার বলছেন, ‘পলিথিনে বমি করান আর পানি খাওয়ান।রাইতের বেলা বাস থামানো যাইব না।’

এ নিয়ে মহিলা ভেজাল করছেন খুব। মহিলার মুখে একটা ঝগড়াটে ছাপ আছে। তোহা বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করল। এতো বিশৃঙ্খলা ভাল লাগে না তার। অঞ্জলির পাশ থেকে বসন্ত বলল, ‘সামনে তো একটা বাজার আছে। ড্রাইভার চাচা,আপনি বরং কষ্ট করে একটু বাস থামানোর চেষ্টা করিয়েন।’

ড্রাইভারের বসন্তের কথা পছন্দ হলো না। তবুও তিনি থামালেন। মহিলা মেয়েকে নিয়ে নেমে যান। পিছু পিছু আরো অনেকে নামে। এটা, ওটা কিনার অযুহাত দিয়ে। একসময় বাসের সবাই নেমে যায়। শুধু বাকি তোহারা। বাস ড্রাইভার বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘আপনাদের কিছু দরকার লাগলে নিয়া আসেন। ‘

না চাইতেও ওরা নামল।বিপ্লব লুকিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল। অনেকক্ষণ সিগারেট থেকে দূরে ছিল।অঞ্জলিকে বসন্ত চানাচুর কিনে দিচ্ছে।নুপুর আর তোহা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। তোহা চিপস দেখছে। কোনটা কিনবে বুঝে উঠতে পারছে না। নুপুর খেয়াল করে বাসের সেই অসভ্য ছেলেটি তোহার গা ঘেঁষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। নুপুর শুরু থেকেই দেখছে ব্যাপারটা। নুপুর বরাবরই প্রতিবাদী মেয়ে। চাকরিজীবী বেশিরভাগ মেয়েই সাহসী আর প্রতিবাদী হয়।নুপুর তোহাকে টেনে সরিয়ে ছেলেটির সামনে দাঁড়ায়।চেহারায় রাগ ভাব নিয়ে বলে, ‘এই ছেলে সমস্যা কি? বাসায় মা বোন কি নাই?’

ছেলেটি যেন আকস্মিক ঘটনায় থতমত হয়ে গেল।কয়েকজন খারাপ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

চলবে….
@ইলমা বেহরোজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here