সম্পর্ক,পর্ব-৭+৮

সম্পর্ক
অলিন্দ্রিয়া রুহি
|পর্ব ৭|

________
হুট করে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে বসে মৌনি। বুক ধুকপুক করছে তার৷ পুরো শরীর ঘেমে গেছে। তার পাশেই ঘুমিয়ে আছে মাধুরি, আজ মঈনুল হোসেনের সাথে ঝগড়া করে মেয়ের ঘরে ঘুমাতে এসেছেন। মৌনি এক পলক মাধুরিকে দেখে নিয়ে ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর নিঃশব্দে হেঁটে এলো বারান্দায়, মাধুরি জেগে গেলে সমস্যা হবে ভেবে কোনোপ্রকার শব্দ করল না সে। বাহিরে চন্দ্র তারকাবিহীন ম্লান আকাশ! চাঁদ কিছুক্ষণ আগেও ছিল হয়তো, এখন ডুবে গেছে। কেননা আকাশে এখনো ঈষৎ আলো! মৌনি এক পানে সেদিকে তাকিয়ে আছে, আর সাক্ষাৎ করছে নিজের ভেতরকার আগুন অনুভূতির সঙ্গে। স্বপ্নে দেখেছে, প্রান্তের সাথে সে হানিমুনে যাচ্ছে, সাজেক। প্রান্ত গায়ে ছাই রঙের একটি শার্ট ছিল, আর মৌনি পরেছিল গাঢ় খয়েরী শাড়ি। দু’জনে হাতে হাত রেখে হেঁটে বেড়াচ্ছিল একটা খোলা রাস্তায়, কোথাও কেউ ছিল না। আকাশে ঝকঝকে সচ্ছ রোদ ছিল, মৌনির হাঁটতে খুব ভালো লাগছিল। আচ্ছা, এরকম একটা স্বপ্ন সে কেন দেখল? কেনই বা তার মস্তিষ্কে সবসময় প্রান্তের বিচরণ? বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করতে থাকা যে অনুভূতি নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে, এরই বা নাম কী?
উত্তর দিক থেকে হুট করে এক টুকরো হাওয়া উড়ে এসে মৌনির গা গতর ছুঁলো, মৌনি চমকে সম্বিত ফিরে পেল। নিকষ কালো আঁধারের দিকে তাকাতেই ভয়ে কুঁকড়ে উঠল। মনে হচ্ছে চারিদিকে প্রচুর প্রেতাত্মা, ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু সুযোগ পেলেই মৌনির রুহ টা ছিনিয়ে নেবে। মৌনি জান ছেড়ে দৌড়ে রুমে আসলো। কাচুমাচু হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, মায়ের কোল ঘেঁষে। হাতের উপর মুখ রেখে ভাবতে লাগল প্রান্তের কথা। এভাবেই একসময় ঘুম রাজ্যে পাড়ি জমালো আবার!

সকাল সকাল নিজে থেকেই উঠল মৌনি। অন্যদিন মাধুরি অনেকবার ডেকে, মেরেধরে ঘুম থেকে উঠান। আজ একা একাই মৌনিকে উঠতে দেখে একটু আশ্চর্য হলেন। খাওয়া নিয়েও মৌনির পেছনে ঘুরঘুর করতে হয় অনেকবার তাকে। আর আজকে মৌনি নিজে থেকেই খেয়ে নিল। তারপর দ্রুত স্কুলের জন্য তৈরি হলো। মঈনুল হোসেন মেয়েকে স্কুল দিয়ে আসার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, মৌনি গিয়ে চঞ্চল গলায় বলল, ‘বাবা তোমাকে আসতে হবে না। স্যারের সাথে চলে যাবোনি আমি।’
‘এভাবে বারবার প্রান্তকে বলা কী ঠিক?’
‘তাতে কী? উনি কিচ্ছু মনে করবেন না বাবা। তোমার শুধুশুধু কষ্ট করতে হবে না। আমি যাই..’
ছুঁটে বেরিয়ে এলো মৌনি। প্রান্ত সবেমাত্র মেইন গেট দিয়ে বেরিয়েছে, মৌনি দৌড়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ক্রমাগত হাঁপাচ্ছে সে। মৌনির এমন আচরণে প্রান্ত চমকালো, প্রকাশ করল না। কপালে ভাঁজ সৃষ্টি করে বলল, ‘কী হয়েছে?’
মৌনি দম নিয়ে বলল, ‘আপনার সাথে স্কুল যাব।’
‘আজকেও?’ ভ্রু কুঁচকে গেল প্রান্তের। গলা দিয়েও বিরক্তি ঝরছে। মৌনি মনে মনে বলল, ‘যতই বিরক্ত হও না কেন চান্দু, আমি তোমার সাথেই যাব।’
মুখে বলল, ‘আপনি তো স্কুলের রাস্তা দিয়েই যাবেন। আমাকে একটু সঙ্গে নিলে কী এমন হবে?’
প্রান্ত কিছু বলতে গিয়েও বলল না।অগত্যা মৌনিকে নিয়েই হাঁটা ধরল। প্রান্তের আজ ক্লাস নেই, কিছু জরুরি নোটস আনার জন্যেই ভার্সিটি যাচ্ছে সে।

নিশ্চুপ, নিরব দু’জনে। প্রান্ত বেখেয়ালি ভাবে হাঁটছে, মৌনি আড়চোখে বারবার তাকে দেখছে।একটা রিকশার সাথে প্রান্তের প্রায় ধাক্কা লাগবে লাগবে ভাব, মৌনি হ্যাঁচকা টানে প্রান্তকে সরিয়ে নিল। প্রান্ত রেগে যাচ্ছিল, কিন্তু ভুলটা যে নিজেরই বুঝতে পেরে বলল, ‘থ্যাংকিউ। খেয়াল করিনি।’
‘করবেন কীভাবে? সারাক্ষণ দেখছি এদিক সেদিক তাকাচ্ছেন। ছটফট করছেন। কিছু খুঁজছেন নাকি?’
‘তা দিয়ে তোমার কী?’
‘আমার কিছু না। বলুন না, খুঁজছেন কিছু?’
প্রান্ত একটু নিভলো, অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দিল, ‘হুঁ।’
‘কী খুঁজছেন?’
‘যেটা দিয়ে আমার মনে হওয়া একটা ক্ষত সারানো যাবে।’
মৌনি থমকে গেল। এই কথার মানে সে ভালোভাবে বুঝতে না পারলেও তার মন খারাপ হয়ে উঠেছে। বুকের ভেতর ভার ভার লাগছে। বাকিটা রাস্তা মৌনি একদম চুপ করে রইলো। স্কুলের গেটের কাছে গিয়ে মৌনি পেছন ফিরে তাকাল, প্রান্ত কে বায় বলার জন্য। পেছন ঘুরে দেখল, প্রান্ত তার দিকে ফিরে তাকানো তো দূর, চলে গেছে!

________
প্রান্ত আবার বাসার রাস্তা ধরেছে। তার মন খুব অশান্ত হয়ে আছে। সে ভেবেছিল আজকেও যদি আহ্নির সঙ্গে একবার দেখা হয়ে যেতো! আহ্নির সাথে ওই একটুক্ষণ দেখা হওয়া, প্রান্তের জীবনটা পুরোপুরি ভাবে বদলে দিয়েছে। গতকাল সারারাত প্রান্তের ঘুম হয়নি। কেমন ছটফট ছটফট করেছে সে।
ভার্সিটিতে এখন আর যেতে ইচ্ছে করছে না বলে বাসায় যাওয়ার কথা ভাবছে প্রান্ত। আনমনে পকেটে হাত ঢুকিয়ে ধীর গতিতে হেঁটে যাচ্ছে সে। ঠিক তখনি একটা মেয়ে তার পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। প্রান্ত চমকে উঠল। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখল, মেয়েটি আহ্নি! প্রান্তের মনে রং-বেরঙের প্রজাপতিরা ডানা ঝাপটাতে শুরু করেছে। মনের আকাশে মেঘ কেটে গেছে। প্রান্ত হাঁটার গতি বাড়ায়। আহ্নির পাশাপাশি যেয়েই ডেকে উঠল, ‘শুনুন।’
আহ্নি থমকে দাঁড়াল। পেছন ঘুরে প্রান্তকে দেখে আরো থমকে গেল। ধবধবে ফর্সা গায়ের রং টা নজর কাড়া, বলতেই হয়। ছেলেরা এত ফর্সা হলে কেমন যেন দেখায়! থুতনিতে একটা কাটা দাঁগ, গালে টোল পড়ে আছে, বাম ভ্রু’য়ের মাঝ দিয়েও একটা ছোট্ট কাটা দাগ। খুঁতযুক্ত এই চেহারাও আহ্নির কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় লাগল। সে উৎসুক হয়ে উঠল।
প্রান্ত সাহস করে আরো এগিয়ে এলো। আহ্নি আর প্রান্তের মধ্যবর্তী দূরত্ব এখন এক হাত সমান।

‘এটা আপনার?’ আহ্নির দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিল প্রান্ত। সেই হাতের উপর একটা কানের দুল। গতকাল ধাক্কা লাগার সময়ই খুলে পড়েছিল, আহ্নি খেয়ালই করেনি। আহ্নি অবাক হয়। সঙ্গে সঙ্গে কানে হাত দিয়ে দেখে তার এক কানে দুল নেই, অন্য কানে আছে। আর এই কানের দুল নিয়েই সে গতকাল গোটা দিনটা কাটিয়েছে! অথচ একবারও নজরে পড়েনি! এত গা-ছাড়া ভাব কবে থেকে হলো তার?

ক্ষীণ কণ্ঠে আহ্নি জবাব দিল, ‘জি, আমার।’
‘আপনি বোধহয় জানতেনই না আপনার কানের দুল হারিয়েছে, তাই না?’
‘জি।’ আড়ষ্টতায় ভরে গেল আহ্নি।
‘আমি না জানালে হয়তো আগামী দুই-তিন দিনেও জানতেন না।’ প্রান্ত হাসল, গালের টোল টা আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠল। সেদিকে তাকিয়ে আহ্নির বুকে জ্বালা ধরল, এরকম টোল তার কেন নেই! উফ!

‘ধরুন। আপনার সম্পদ আপনাকে ফিরিয়ে দিলাম।’
আহ্নি হেসে দুলটা নিল, ‘আপনি কী সবার সম্পদই সবাইকে এভাবেই ফিরিয়ে দেন?’
‘না, অতটা উদার আমি নই। যদি কোনো কিছু খুব বেশিই পছন্দ হয়ে যায়, তাহলে সেটা চুরি করে হলেও রেখে দেই।’
‘আমার এই দুলটা বুঝি পছন্দ হয়নি?’ বলেই আহ্নি জিভ কাটল, চমকালো, লজ্জা পেল। এসব কী বলছে সে! পাগল টাগল হয়ে যায়নি তো? প্রান্ত জবাব দিল না, উত্তরে চমৎকার করে হাসল। আহ্নির আপাদমস্তক লজ্জায় ভরে উঠল এবার। সে কোনোরকমে বলল, ‘আসি।’
‘আবার কখনো দেখা হবে?’ প্রান্তের উৎকণ্ঠা।
আহ্নি স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে, হেসে উত্তর দিল, ‘ভাগ্য চাইলে…’
তারপর দ্রুত পা চালালো,যেন পালিয়ে যেতে চাইছে। প্রান্ত আর আগে বাড়লো না, সে আবার ভার্সিটির পথ ধরেছে। এখন তার ভার্সিটি যেতে খুব ভালো লাগবে।বুকের ভেতরের খালি খালি ভাবটা এখন আর নেই!

_________
সকাল সকাল হাউকাউ শুরু করেছেন লিলি বেগম। চিল্লানোর কারণ, তাশরিফ হুট করে একটা মেয়েকে ঘরে নিয়ে এসেছে, আবার বলছে, গতকাল রাতে নাকি এই মেয়েকে বিয়ে করেছে। মেয়ের নাম ঝিলম, দেখতে কালো, বেঁটে, মোটা, চোখেমুখে অহংকারী অহংকারী একটা ভাব, লিলি বেগমের আড়ালে বেশ কয়েকবার ঝিলম মুখ বাঁকিয়েছে। তবে রয়েছে একদম চুপচাপ।

তাশরিফ ঘরে নেই, চিল্লাচিল্লির মুখে পরে কোথায় যেন বেরিয়ে গেছে। ঝিলম একা একা দমবন্ধ করে বসে আছে। তার চেহারায় ঘোর অন্ধকার! দুপুর বেশ তেজ নিয়ে ঘরে ঢুকল। ঝিলম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে দাঁড়াতেই দুপুরের তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ, ‘এই ছেড়ি, তুই আমার ভাইরে ফুঁসলাইছোস ক্যান?’
ঝিলম হতবাক, তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, নাকের পাঠা ফুলে উঠছে। ভীষণ রাগ লাগছে তার, ভীষণ। ইচ্ছে করছে কাঁচা আমের মতো ক্যাঁচক্যাঁচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে দুপুরকে। ঝিলম নিজের ইচ্ছা খুব কষ্টে দমন করল। যথাসম্ভব নিচু গলায় বলল, ‘আপা আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি আপনার ভাইকে খুব পছন্দ করি। আমি আপনাদের বাধ্য হয়ে থাকব। আপনারা যেভাবে বলবেন সেভাবেই চলব। আমাকে ক্ষমা করে দিন আপা।’
দুপুর একটু নিভলো। খাটে বসে ঝিলম কেও বসতে বলল। তারপর বলে, ‘আপনি ভাইয়াকে পছন্দ করেন , ভাল কথা৷ তাহলে ভাইয়াকে বলতেন আমাদের বলতে। পারিবারিক ভাবেই একটা ব্যবস্থা করতাম আমরা।’
‘ইয়ে, মানে, আপা… আমার প্রথম স্বামী সজ্ঞানে আমার বিয়ে হতে দিত না। সে এখনো আমাকে চায়।’
দুপুর চমকে উঠল, বিড়বিড় করে বলল, ‘আপনার আগে বিয়ে হয়েছে?’
তখন ঘরে তাশরিফ ঢুকল। দুপুরের প্রশ্ন শুনে ঝিলমের আগে সে বলল, ‘হুম। সাত বছর। ওর পাঁচ বছরের একটা ছেলেও আছে।’
‘ছেলে আছে?’ দুপুর হঠাৎ আক্রোশে ফেটে পড়ে বলল, ‘সব জেনেশুনে এরকম একটা মেয়েকে কীভাবে বিয়ে করলে তুমি ভাইয়া?’
‘এই চুপ কর। ও বিবাহিতা, আমিও তো বিবাহিতই ছিলাম। আম্মার অতিরিক্ত যন্ত্রণায় আমার বউটা চলে গেছে এই বাড়ি ছেড়ে। সে কথা ভুলে যাস কেন?’
দুপুর থামলো, সত্যি কথাই বলেছে তাশরিফ। ছয় বছর আগে তাশরিফ বিয়ে করেছিল, ভালোবেসেই, তবে পারিবারিক ভাবে। সেই মেয়েকে খুব বেশিই ভালোবাসতো সে, নিজের উড়নচণ্ডী স্বভাব বাদ দিয়ে ঠিকমতো কাজকর্ম ও করতে লাগল তখন। তাদের বিবাহিত জীবন ছিল আড়াই বছরের, এই আড়াই বছরে এমন কোনো দিন ছিল না, যেদিনটা তমার (প্রথম বউ) সুখে কেটেছে। লিলি বেগমের কটুক্তি কথা, অত্যাচার সব হজম করেও তাশরিফের জন্য তমা সব সহ্য করে গেছে। খাটতে খাটতে সোনার বদন কয়লা হয়ে গিয়েছিল। তারপর একসময়, মেয়ের এই দুর্দশা দেখে তমার বাবা-মা আর মেনে নিতে পারলেন না। তমাকে চাপ দিতে থাকলেন সব ফেলে চলে আসার জন্য। তমাও একসময় হার মেনে নিল। চলে গেল। তাশরিফ অনেকবার চেষ্টা করেছে তমাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। লিলি বেগম দিলেন না। তার ভাষ্যমতে তমা অন্য ছেলের জন্য তাশরিফকে ছেড়ে চলে গেছে। আর এমন বউ সে কখনোই ঘরে তুলবে না। সমাপ্তি ঘটলো তাদের সম্পর্কের। তমার অন্যত্র বিয়ে হয়েছে, এক বাচ্চার মা-ও। সুখেই আছে এখন। এরপর থেকেই তাশরিফ আবার বদলে গেল। আগের চেয়েও বিগড়ে গেল। সব ছেড়ে নেশা নিয়ে পড়ে রইলো। এখন এমন হয়ে গেছে যে, তার ভেতরের সমস্ত বিবেক-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। চোখের সামনে অন্যায় দেখেও সে নির্বাক হয়ে থাকে। দুনিয়ার প্রতি মনই উঠে গেছিল, তখন আবার দেখা হলো ঝিলমের সাথে… তাশরিফ কে নিজের ভালোবাসার জালে আঁটকে ফেলল। এইজন্যেই তো এক ছেলে আছে জেনেও তাশরিফ ঝিলমকে বিয়ে করতে আপত্তি করেনি। মেয়ে বিবাহিতা আবার সন্তান আছে শুনলে লিলি বেগম কোনদিন এই বিয়ে হতে দিতেন না। তাই চুপেচাপে বিয়েটা করে ফেলেছে তাশরিফ।

‘শোন, ওর অতীত জেনে লাভ নেই। ও কেমন এটা হচ্ছে মেইন। আমার জীবনটা যদি আর একবার থমকে যায় দুপুর, আমি কিন্তু নিজেকে শেষ করে দিব। নয়তো এই ঘর ছাড়া হবো। তমার বেলায় আমি মায়ের মুখ চেয়ে কিছু করিনি, চুপ ছিলাম। এবার থাকব না। মা যদি ঝিলমকে মেনে না নেয়, তবে কান খুলে শুনে রাখ, আমি এই ঘর ছাড়ছি।’ একদমে বলে গেল তাশরিফ। দুপুর গুমোট মুখ নিয়ে উঠে গেল। ঝিলম আতংকিত হয়ে জানতে চায়, ‘কী মনে হয়? আমাকে মেনে নিবে?’
‘নিতেই হবে। আর আমার উপর মায়ের আলাদাই আধ্যাত্মিক টান আছে। আমি নিশ্চিত সে মেনে নিবে।’ জোর গলাতেই বলল তাশরিফ, তারপরও ঝিলম চিন্তামুক্ত হতে পারল না।

দুপুর উঠে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর লিলি বেগম নিজেই ছুটে এলেন তাশরিফের ঘরে। তাশরিফ আর ঝিলম মুখোমুখি বসে ছিল, লিলি বেগম কে দেখে ঝিলম মাথানিচু করে ফেলল। তাশরিফ উঠে দাঁড়াল।

‘তুই নাকি এই বাড়ি ছেড়ে যাবি, বলছিস?’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন লিলি বেগম। গর্জে উঠেছেন তিনি। তাশরিফ শান্ত গলাতেই জবাব দিল, ‘হুম, আম্মা। ঝিলম কে নিয়ে শান্তি মতো সংসার করতে চাই।’ তারপর একটু থেমে করুণ স্বরে বলল, ‘আর কিছু চাই না।’
লিলি বেগম অপলক নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর গলার স্বর অনেকটা নিভিয়ে বললেন, ‘তোর বউকে বলে দিস, এই ঘরে থাকতে হলে কাজ-কাম করে খেতে হবে। ফাও শুয়ে বসে থাকলে চলবে না কিন্তু।’
‘সংসার করতে আসলে কেইবা শুয়ে বসে খায় আম্মা? আর তোমার ঘরে কেউ শুয়ে বসে খেতে পারবে?’ কথাটায় শ্লেষাত্মক, লিলি বেগম জবাব না দিয়ে চলে গেলেন। ঝিলম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাথা থেকে ঘোমটা সরালো।

মাত্র আধঘন্টার মাথায় লিলি বেগমকে অনেকটাই পটিয়ে ফেলল ঝিলম। নিজের হাতে নাশতা বানালো, যদিও রতি মানা করেছিল, তবুও সে জোর করে করেছে, লিলি বেগম আর নাছির মাহতাব কে খুব আপ্যায়ন করে খাওয়ালো, চা বানিয়ে দিল, লিলি বেগমের জন্য সুপারি কেটে দিল, লিলি বেগম এর পা টিপে দিয়ে আনন্দের সহিত বলল, ‘আম্মা আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা পালিয়ে বিয়ে করছি, এই জন্যে আপনার ছেলে যে জামাই আপ্যায়ন থেকে বাদ যাবে, তা ভাববেন না। আমি আজই আমার আব্বাকে ফোন দিয়ে বলব। তারা মেয়ের শ্বশুর বাড়ি ভরিয়ে দিবে, দেইখেন।’
এই এক কথায় লিলি বেগম কুপোকাত! রতি ঘরে ঢুকছিল, দুপুরে কী রান্না হবে জিজ্ঞেস করতে, তখন শুনল, লিলি বেগম বলছেন, ‘তোমারে দিয়াই আশা মা.. আমার ছোটো ছেলেটার তো কপাল পুড়া। ওই তো বউ! আবার বাপের বাড়ি থেইকা একটা সুতাও পায়নাই! আশপাশ দিয়ে কত মানুষ আসছে, বেয়াই বাড়ি দিয়ে কী দিছে দেখার জন্য। আমি কাউরে কিছু দেখাইতে পারিনাই।’ লিলি বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। ঝিলম পা টেপা বাড়িয়ে দেয়, বলে, ‘চিন্তা করবেন না। আমার আব্বা দিবে। আপনার ছেলেকে ব্যবসাও ধরিয়ে দিবে, আমি বললে। আর আপনাদের সবার জন্যেই যা যা দেওয়া লাগালে, সব পাঠাবে। আমি আজকেই কথা বলব।’
‘ওরে আমার লক্ষী মা..’
লিলি বেগম আবেগে আপ্লুত।
রতির নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো। সে দ্রুত সরে এলো। নিজের রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। কলিজায় আগুন ধরিয়েছে যেন কেউ! তার বাবা নিজেই খুব টানাপোড়েনে সংসার চালায়। অবশ্য যদি তার মা থাকতো, তাহলে হয়তো একটু একটু করে রতির জন্য সঞ্চয় করতো! রতির বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। বাবা-মায়ের ছায়া মাথার উপর না থাকলে এভাবেই প্রতি পদে পদে ছেলেমেয়েরা অপদস্ত হয়, কষ্ট পায়। বিশেষ করে, মায়ের ছায়া! রতি তার পেটে উপর হাত রেখে বিড়বিড় করে বলে, ‘আমি যদি কখনো মা হই খোদা, তবে আমার সন্তানের গতি না করা অবধি তুমি আমায় মাটির বুকে নিয়ো না। আর যদি আমার সন্তানের জীবন আমার মতোই হয়, তাহলে সেই সন্তান জন্ম দেওয়ার আগেই আমাকে পৃথিবীর আলো দেখানো বন্ধ করো। এই কষ্ট যে ভীষণ ভয়ংকর! বুক ভেঙে গুড়িয়ে দেয় বারংবার, কেউ বুঝে না, কেউ না!’

চলবে…

#সম্পর্ক
#৮

ঝিলম নিজের ঘরে চুপচাপ বসে আছে। আপাতদৃষ্টিতে তাকে নিশ্চুপ লাগলেও, ভেতরে ভেতরে সে ফেটে পড়ছে রাগে। রাগের কারণ, আহ্নি মসজিদ থেকে আসার পর ঝিলম তার জন্য একটা প্লেটে করে সকালের নাশতা নিয়ে যায়, আহ্নির সঙ্গে ভাব করতে চাইলে আহ্নি কাটাকাটা গলায় বলে দেয়, ‘আপনি আমার সাথে কথা বলবেন না। খারাপ মেয়ে মানুষ!’
অপমানে ঝিলমের মুখ থমথমে হয়ে যায়। পাশেই রতি ছিল, রতি বলল, ‘আহ্নি! এসব কেমন আচরণ?’
‘একটা খারাপ মানুষ কে খারাপ বলছি, ব্যস শেষ। উনি খারাপ না হলে কী করে পারল, নিজের চার বছরের ছোট্ট বাচ্চাকে ফেলে চলে আসতে?’
রতি উত্তর দেওয়ার মতো যুতসই কিছু খুঁজে পেল না। ঝিলমকে উপর দিয়ে তার ভালো লাগলেও, এই একটা কারণে রতিও একটু ভারাক্রান্ত মনে রয়েছে৷ মা ছাড়া সন্তানের জীবন যে কী দুর্বিষহ আর ভয়াবহ হয়, তা রতি জানে। হাড়ে হাড়ে টের পায়! সেই একই জীবন ভোগ করতে যাচ্ছে আরো একটি প্রাণ, হোক সে ছেলে, তবুও তো.. মা ছাড়া ছেলে-মেয়ে সবাই-ই সমান অসুখী হয়। রতির একবার ইচ্ছে হয়েছিল, ঝিলমকে জিজ্ঞেস করতে, দশমাস দশদিন পেটে ধরে, পুরো পৃথিবীর সঙ্গে যুদ্ধ করে যাকে এই পৃথিবীর আলো দেখালো, তাকে ফেলে চলে আসতে কী এতটুকুও হাত-পা কাঁপলো না? কীভাবে পারল সে? সে তো মা নাকি! শেষমেশ রতি চুপ থেকেছে। কিচ্ছুটি জিজ্ঞেস করেনি। শুধু শুধু ঝামেলা করতে কেই বা চায়?

আহ্নির পড়ার টেবিলের উপর খাবার প্লেটটা রেখে ঝিলম দ্রুত নিজের ঘরে চলে আসে। তারপর থেকেই মুখ গোঁজ করে বসে রয়েছে। নাশতা সেড়ে তাশরিফ বাইরে বেরিয়েছিল সিগারেটের তাড়নায়। বাসায় ফিরে ঝিলমের অন্ধকার মুখটা দেখে বলল, ‘কী ব্যাপার? এরকম হয়ে আছো কেন?’
চোখের পলকে তাশরিফের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে ন্যাকা কান্না শুরু করে দিলো ঝিলম। তাশরিফ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ঝিলমের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কী হয়েছে? বলো আমাকে। আম্মা কিছু বলছে?’
ঝিলম মাথা নাড়ালো। তারপর কান্নার দমক কমিয়ে আহ্নির বলা কথাগুলো বলল। সব শুনে রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়ে তাশরিফ।
‘কান্না করো না। আমি দেখছি।’ বলে বেরিয়ে যায় তাশরিফ। ঝিলম চোখ মুছে মৃদু হাসলো। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘আমাকে ভ্যাবদা ভেবো না আহ্নি! আমি গভীর জলের মাছ। কারো ধরাছোঁয়ার বাইরে!’

ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল আহ্নি। পানি খাচ্ছিল সে। লিলি বেগম, রতিও আছে। দুপুরে কী রান্না হবে না হবে তাই নিয়ে রতিকে আদেশ দিচ্ছেন লিলি বেগম। তাশরিফ আহ্নিকে চেঁচিয়ে ডাকতেই, আহ্নি কেঁপে উঠল মৃদুভাবে। হাত থেকে পানির গ্লাস ছিটকে পড়ে যেতে নিলে, সে দ্রুত সামলালো। তারপর পেছন ফিরে বিস্মিত চোখে তাশরিফের দিকে তাকাল। তাশরিফের চোখ জ্বলছে, সেখানে অসংখ্য আগুনের শিখা!

আহ্নি বিস্ময় নিয়ে উচ্চারণ করল, ‘কী ভাইয়া?’
‘এইটুকুন পুঁচকে মেয়ে হয়ে এতো তেজ তোর হয় কী করে?’ গলার স্বর উঁচিয়ে বলল তাশরিফ। আহ্নির বিস্ময় যেন বাড়ছেই…
‘আ..আমি কী করছি?’
‘হ্যাঁ, ও কী করছে?’ মাঝ দিয়ে বললেন লিলি বেগম। তিনি ঘটনার কিছুই জানেন না।
‘কী করছে? তোমার মেয়ে আমার বউকে বলে কীনা খারাপ মেয়ে মানুষ! ওর সন্তান রেখে আসছে দেখে যা তা বলছে। দুপুর বললে নাহয় তাও মানতাম, ও কীভাবে বলে? ও কী এই বাড়ির বড় গার্ডিয়ান হয়ে গেছে?’
লিলি বেগম সরু চোখে আহ্নির দিকে তাকালেন। আহ্নির গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললেন, ‘কী করে? তাশরিফ যা বলছে তা সত্যি? তুই ঝিলমকে এসব বলছিস?’

রতির বুক কাঁপছে ভয়ে। এখন তো এরা সত্য মিথ্যার ফারাক না করেই আহ্নির উপর চড়াও হবে! রতি কী কিছু করবে? কিছু বলবে? আহ্নিকে বাঁচানোর উপায় কী?
রতি মিনমিনিয়ে বলল, ‘আম্মা.. ও ছোটো মানুষ। ওর কথা এতো ধরলে চলে?’
‘তুমি চুপ থাকো। কলেজে পড়ুয়া মাইয়া কেমনে ছোটো হয়? হ? আর তুমি এতো সাফাই গাইয়ো না। তোমার কারণেই আমার মাইয়া বিগড়ে গেছে। এসব তুমি ওরে শিখাইছো।’
রতি ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। তার গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ। পুনরায় কিছু বলতে যাওয়ার আগেই আহ্নি বলল, ‘হ্যাঁ, আমি বলছি। একটা ছোটো লোক,বাজে কে তো বাজেই বলব, তাই না? আর শুধু শুধু ভাবির উপর দোষ দিয়ো না। কেউ আমাকে কিচ্ছু শেখায়নি। কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়, আমি চোখে দেখি, আমি বুঝি।’
‘ওরে আমার বুঝদার রে!’ কটাক্ষ করলেন লিলি বেগম। তাশরিফ এক কদম এগিয়ে এসে বলল, ‘আমার বউ ছোটো লোক? বাজে?’
আহ্নি তাশরিফের চোখে চোখ রাখে। ঠান্ডা স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ, বাজে, নোংরা, কুৎসিত।’ আহ্নির কথাটা মাটিতে পড়ার আগেই, তাশরিফের শক্ত হাতের চড় আহ্নির মাথার ভেতরটাই ফাঁকা করে দিলো। পেছনে চেয়ার ছিল, সেই চেয়ারে ধাক্কা খেয়ে আহ্নি কোনোরকমে টাল সামলালো। চোখের কোণে জ্বল চিকচিক করছে তার। মারের ব্যথায় নয়, মাত্র একদিন আসা একটি মেয়ের জন্যে তার ভাই তার গায়ে হাত তুললো! এই ভেবে আহ্নির বুকটা ভার হয়ে যায়। রতি চেঁচিয়ে উঠল, ‘এটা আপনি কী করলেন ভাইয়া!’
তারপর দৌড়ে এসে আহ্নিকে জড়িয়ে ধরলো। রতির ডানায় আহ্নি নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল।

‘ঝিলমকে যদি সম্মান না দিতে পারিস, এই ঘর থেকে বের করে দিব একদম বুঝছিস?’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল তাশরিফ। তখন ডাইনিং এ এসে দাঁড়াল ঝিলম। তার অশান্ত মন এবার গিয়ে শান্ত হয়েছে। চোখে খুশি চকচক করছে। খুশি লুকিয়ে সে নির্বিকার গলায় বলে উঠল, ‘থাক, মেরো না। ছোটো মানুষ, বুঝেই বা কী!’
লিলি বেগম বললেন, ‘আর দুইটা দে শয়তানটারে। পড়ালেখা করিয়ে একটা বেজন্মা বানাইতাছি। এরচেয়ে আমার দুপুর কত ভালো! আমার কথার বাইরে একটা পা-ও ফেলে না। আর এটা তো সাক্ষাৎ পিচাশ!’
আহ্নি ঝট করে কান্না থামিয়ে মুখ তুলে তাকাল। শূন্য দৃষ্টি নিয়ে লিলি বেগম কে দেখল, তাশরিফ কে দেখল, ঝিলমের আনন্দে চকচক করা মুখটাও দেখল। মুখস্থ করে নিল। তারপর বিনাবাক্য ব্যয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। দুপুর তার ঘরে আবিরের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত, এদিকে কী হয়ে যাচ্ছে তার পাত্তাও নেই!

রান্নাঘরে ঢুকতেই রতির গাল গড়িয়ে এক ফোঁটা পানি পড়ল। তার কারণে আহ্নি পদে পদে অপদস্ত হয়। এই ঘরে সে যেমন সবার জন্য উটকো ঝামেলা, আহ্নিও যেন তাই। কেউ বলবেই না আহ্নি এই ঘরের মেয়ে। এই পরিবারেরই সন্তান! লিলি বেগম আর নাছির মাহতাবের রক্ত তার শরীরেও বইছে!

________
সেই ঝগড়ার পর থেকে দুপুরকে একটিবারের জন্যেও আবির কল দেয়নি। এমনকি ইমোতে দুপুরকে ব্লক করে রেখেছে আবির, এফবি থেকেও ব্লক করে রেখেছে। দুপুরও রাগ করে এতো ঘাটাঘাটি করেনি, তবে এখন মনে হচ্ছে, সে নিজে থেকে পা না বাড়ালে আবির আর কোনোদিনই ফোন করবে না। তখন তো ঝামেলা হয়ে যাবে! আবিরের সাথে কোনোক্রমেই সম্পর্ক নষ্ট করা যাবে না এখন… এই ভেবে দুপুর অন্য একটি নাম্বার দিয়ে ইমো আইডি খুলে আবিরের নাম্বারে ফোন দিয়েছে। অনেকবার দেওয়ার পর আবির রিসিভ করল,
‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।’
‘হ্যালো, আবির, আমি..’ সালামের জবাব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ নেই বোধহয় দুপুরের কাছে!
আবিরের গলাটা মুহূর্তেই ভার হয়ে এলো। গমগম আওয়াজে বলল সে, ‘কী কারণে ফোন দিছো?’
‘কী কারণে মানে? আমি তোমার ওয়াইফ! আর একটা ওয়াইফ তার হাজবেন্ডের কাছে কেন ফোন দেয়?’

আবির হাসল ঈষৎ, সেই হাসির শব্দ দুপুরও শুনতে পেয়ে অবাক হয়ে গেল।
‘ওয়াইফ? হাজবেন্ড? রিয়েলি? আমাদের মধ্যে আর কোনোই সম্পর্ক নেই দুপুর।’ পূর্বের স্বরে বলে আবির। দুপুর কাঁদোকাঁদো হয়ে পড়ল, ‘প্লীজ, এমনটা বোলো না। আমি মরেই যাব। দেখো, আমি জানি আমি আবারও ভুল করছি, বাট লাভ করি তো তোমাকে, করি না? বলো? প্লীজ আমাকে এই লাস্ট বারের মতোন ক্ষমা করে দাও। আমি আর কক্ষনো তোমার কথার বাইরে যাব না। তুমি যেভাবে বলবা, সেভাবেই চলব।’
‘তোমার এসব ডায়লগ বন্ধ করো দোহাই লাগে। একই ডায়লগ বারবার শুনতে শুনতে আমি টায়ার্ড দুপুর! তোমাকে কম সুযোগ দেইনি। অনেক, অনেকবার তোমাকে বুঝিয়েছি, মাফ করে দিয়েছি। সেসবের মর্যাদা দিছো তুমি? দাওনি! আসলে তুমি কখনো ভাবতেই চাওনি, দ্যাট ইউ আর ম্যারেড! তুমি সবসময় ভাবো, তুমি স্টিল সিংগেল। শুধু যখন টাকা পয়সার দরকার হয়, তখন মনে পড়ে আমার কথা! আমি তোমার ব্যাংক নাকি দুপুর?’
দুপুরের ভেতরটা শুকিয়ে এলো। অন্তর কাঁপছে। এরকম ভাবে এর আগে আবির কখনোই কথা বলেনি। পরিস্থিতি খুব বিগড়ে গেছে, উফ!

দুপুর ভয়ে ভয়ে বলল, ‘এগুলো কী বলছ তুমি! আ..আমি তোমাকে ব্যাংক ভাবতে যাব কেন? আর তাছাড়া প্রতিদিন সকাল, বিকেল, রাত যে তোমার সাথে কথা বলি? সেটা?ভালোবাসা না থাকলে তোমার সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করতাম আমি?’

‘হা হা হা! হাসিয়ো না। প্রতিদিন কথা বলো, এর পেছনে ভালোবাসা নেই। কথা না বললে সম্পর্ক ঠিক থাকবে না। তখন টাকা চেয়েও পাবা না। না পাবা আমার অন্য সম্পত্তি! আচ্ছা দুপুর, তুমি এতোটা ছ্যাঁচড়া কীভাবে হলা? মেয়ে মানুষের যে এতো লোভ থাকতে পারে, আমি জীবনেও ভাবিনি!’

দুপুর তাজ্জব বনে গেছে। কী বলবে সে? কী প্রত্যুত্তর করবে? আবিরের বলা প্রতিটি কথা সত্য! আবিরের সাথে কথা বলতে হয় বলেই কথা বলা, বাড়তি কোনো ফিলিংস কখনোই কাজ করেনি দুপুরের ভেতর। আবিরের থেকে টাকা নিয়ে ফ্রেন্ড নিয়ে আড্ডা মাস্তি করা, ইচ্ছেমতো শপিং করা, সবাইকে দেখানো, এসবেই শান্তি পেয়েছে দুপুর। দুপুর নিশ্চুপ, কতকাল আর আবিরের চোখে ধুলো জমে থাকবে? ন্যায়ের ঝড়ো বাতাস এসে সব ধুলো উড়িয়ে নিয়ে গেছে। দুপুরের ভেতর কী চলছে বা চলেছে তার সবটাই আবির স্পষ্ট দেখতে পারছে…

‘কথা বলছো না কেন? নাকি মিথ্যে সাজাতে পারছো না?’
দুপুর কেঁদে দিলো, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি আবির, আই রিয়েলি লাভ ইউ! প্লীজ ট্রাস্ট মী! আমি কখনো তোমার কথার বাইরে চলবো না। প্রমিস, মন দিয়ে পড়ব, নামায পড়ব, পুরোদস্তুর সংসারী মেয়ে হয়ে থাকব। প্লীজ আবির, তাও এরকম বোলো না। আমার কষ্ট হয়,আমার খুব কষ্ট হয়!’
দুপুর কেঁদে যেতে লাগল। আবির বিরক্তি নিয়ে ধমকালো, ‘চুপ করো তো। এসব নাটক একদম ভালো লাগছে না।’ তারপর হঠাৎ, গাঢ় গলায় বলল, ‘তুমি জানো দুপুর, আমার উনত্রিশ বছরের জীবনে আমি কখনো কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাইনি। আমার যৌবন কেটেছিল অংক আর ইংলিশ শিখতে শিখতে। বিধাতা আমার ব্রেন এমনভাবে গড়েছে যে, আমি একশোবার একটা জিনিস পড়লেও সেই জিনিস ভুলে যেতাম! প্রতিটা ক্লাসে মনোযোগী থাকতাম, প্রতিদিনের হোমওয়ার্ক করে নিয়ে যেতাম, স্যাররা যেভাবে বলতো, যা বলতো, সব ফলো করেও, পরীক্ষার হলে রেজাল্ট শূন্য! সবচেয়ে বেশি কষ্ট হতো অংকের সিস্টেম মনে রাখতে আর ইংলিশ বানান। যে সময়টা আমার বন্ধুরা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে, আমি ঘরে বসে ডিকশনারি ঘাটাঘাটি করতে ব্যস্ত থাকতাম। আমার একটাই লক্ষ্য ছিল, একটু ভালো রেজাল্ট করা। আধুনিক যুগের থেকে পিছিয়ে না পড়া। অনেক কষ্টে এইচএসসি দিলাম, রেজাল্ট মোটামুটি, আহামরি ভালো নয়। কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকলাম না। বাবা বলল, প্রাইভেটে পড়ো। আমি মানা করে দিলাম। এতো পড়াশোনা করেও আলটিমেটলি আমি কিছুই করতে পারব না ভবিষ্যতে এই কথা চিন্তা করে বাবাকে বললাম, আমি বিদেশ যেতে চাই। মাথা না কাজে লাগাতে পারলাম, শরীর টাকে লাগাবো। বাবা আমাকে বিদেশ পাঠিয়ে দিলেন। পড়ালেখার ইতি টেনে চলে এলাম সবকিছু ছেড়ে! এখানে আসার পর, অনেক নারীদের থেকে অফার পেয়েছি। কন্ট্রাক্ট ম্যারেজও করতে চেয়েছে অনেকে! আবার শুধু একরাতও চেয়েছে অনেকে! আমি কাউকে পাত্তা দেইনি। না, না, তুমি ভেবো না আমি সাধু পুরুষ!আসলে কাউকে পাত্তা দেওয়ার মতো ফিলিংসটাই আসেনাই। সবসময় মেয়েদের থেকে দূরে থাকতে থাকতে একটা আলাদাই দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমার ভেতর। তোমার মনে আছে, যেদিন প্রথম তোমার সাথে অডিও কলে কথা বলেছিলাম? তুমি একটার পর একটা প্রশ্ন করেছিলে, আমি চুপচাপ উত্তর দিয়ে গেছি। তুমি একসময় বলেও ছিলে, আপনি এত চুপচাপ কেন? আপনি কী এরকমই গম্ভীর? আমি নিঃশব্দে হেসেছিলাম তখন, জবাব দেইনি। সেই তখন থেকে, তোমার রিনরিনে গলার স্বরে একটা আলাদা টান অনুভব করলাম আমি। না চাইতেও তোমাকে নিয়ে ভাবতে থাকলাম। কল্পনায় দুজনের সংসার সাজালাম, কত স্বপ্ন আঁকলাম। নাহলে একবার ভাবো তো, যাকে আমি দেখিনি, সে কেমন জানিনা, যাকে কবে সামনাসামনি দেখব, তাও জানি না, অথচ পরিবারের কথায় আমি বিয়েতে রাজী হয়ে গিয়েছিলাম! আসলে তখন মনে হচ্ছিল, তুমিই সেই, যার জন্য আমি অপেক্ষা করেছি এতগুলো বছর! দীর্ঘ সময় পার করতেও আমার একটুও খারাপ লাগেনি, আফসোস হয়নি। আর এইজন্যে আল্লাহ আমার হাতে চাঁদ তুলে দিয়েছেন! অথচ আস্তে আস্তে..৷ তুমি আমাকে মেরে দিয়েছো দুপুর।’

দুপুর যন্ত্রের মতো এতক্ষণ শুনছিল, আবিরের শেষ বাক্যটা শুনে ভয়ে কেঁপে উঠল। কেমন যেন করতে শুরু করল তার বুকের ভেতর!

আবির বলে চলেছে, ‘তোমাকে একবার না দুইবার না, কতবার আমি সুযোগ দিয়েছি! বিয়ের সাতদিনের মাথায় তুমি কোচিং এর কথা বলে আমারই বাসা থেকে বের হয়ে ছেলে ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরতে যাও! বাসায় ফিরে আসো রাত আটটায়! কোন বাড়ির বউ রাত আটটায় ঘুরেফিরে আসে? বলতে পারো? তোমাকে জিজ্ঞেস করা হলে তুমি তোমার মায়ের কসম কেটে বলো, এক বান্ধবীর জন্মদিনে গিয়েছিলা, তাও জোর করে নিয়ে গেছে তোমাকে তোমার বান্ধবী! আমার পরিবার তোমার কথা বিশ্বাস করে নেয়, তোমাকে আর দ্বিতীয় বার কিছুই বলেনি। অথচ আমার প্রশ্ন, তোমাকে জোর করে নিয়ে গেলেও, একবার ফোন করে কেন জানাওনি সবাইকে? জানাবা কী করে! তুমি তো যাওনি কোনো জন্মদিনে, কোনো বান্ধবীর বাসায়! তুমি তো ছিলা ছেলে ফ্রেন্ড নিয়ে.. বাইকে ঘুরে বেরিয়েছো সেদিন। পরে সবটাই জানতে পারছি আমি। তাও তোমাকে কিচ্ছু বলিনি। আমাকে একটা কথা বলো তো দুপুর,যে মেয়ে নিজের মায়ের নামে কসম কেটে মিথ্যে বলতে এক দণ্ড ভাবে না, সে কেমন মেয়ে? তাকে কীভাবে বিশ্বাস করি আমি?’

দুপুরের চোখের পানি নাকের পানি মিশে একাকার হয়ে গেছে। ফেঁসে গেছে সে, দারুণ ভাবে ফেঁসে গেছে! দুপুর ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলতে চাইল, ‘আর একবার বিশ্বাস করো আবির, জাস্ট একবার।’
‘নো দুপুর, আই এম সরি। আমি তোমাকে আর একবারও বিশ্বাস করতে পারব না। আসলে, বিশ্বাস করতে চাচ্ছি না। আমি এই অসুস্থ সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাই।’
দুপুরের মাথায় বাজ পড়ল যেন। সে ফ্লোরে ধপ করে বসে পড়ে, শরীরের সবটুকু শক্তি যেন কেউ শুষে নিল এই মুহুর্তে…শেষ, সব কী শেষ?

‘ক..কী বলছো আবির?’ অনেক কষ্টে উচ্চারণ করল দুপুর।
আবির একটা দম নিয়ে, চোখের পানিটুকু মুছে জোরালো কণ্ঠে বলল, ‘তালাক, তালাক, তালাক। তোমাকে তিন তালাক দিলাম। আমি দু’দিনের মধ্যে দেশে এসে কাগজে কলমেও তোমাকে মুক্তি দিয়ে দিবো। আল্লাহ হাফেজ।’
আবির ফোন কেটে দেয়। দুপুর ‘থ’ হয়ে বসে রইলো। এতক্ষণ কী ঘটলো,এখনো বুঝতে পারছে না সে!

চলবে…
®অলিন্দ্রিয়া_রুহি
*সাইলেন্ট রিডাররাও কমেন্ট করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here