সম্পর্কের বন্ধন, পর্ব:১

১.
“বড় ভাবীর সাথে একই বিছানায় ঘনিষ্ট অবস্থায় আমার স্বামী। স্পষ্ট সব দেখেছি আমি। বিষয়টা যদি বিয়ের পরের দিন সকালেই ঘটে থাকে আমার সাথে, তাহলে? এরপরেও আপনারা আমাকে চুপ থাকতে বলছেন? আপনাদের কি বিবেক-বুদ্ধি কিছুই নেই?”

উত্তেজিত কন্ঠে কথা বলছে রিপা। রিপা যখন উত্তেজিত হয়ে কথা বলে তখন তার কপালের রগগুলো ঈষৎ কালো হয়ে ফোলা দিয়ে ওঠে, এবারও তার ব্যতিক্রম হয় নি। রাগ যেনো শিরায় শিরায় টগবগ করছে। নির্মলা বেগম তাকে থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। বাড়ীতে লোকজন গিজগিজ করছে, বিষয়টি তার সম্মানের ব্যাপার। বাড়ীর নতুন বউ এমন তামাশা করলে তো তার লাগবেই। রিপাকে গতকাল তার ছোট ছেলে শ্যামল কে বিয়ে করিয়েছেন তিনি। বিয়ের একটা দিন না যেতেই নতুন বউয়ের মুখে এমন কথা তার জন্য বদহজমের মতো। তার হাব-ভঙ্গি স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে, ছেলের ব্যাপারে আরোপিত অভিযোগে তার কোনো মাথা ব্যাথা নেই, তার মাথা ব্যাথা কেবল মান-ইজ্জতের। রিপাকে থামাতে না পেরে অনুনয়ের সুরে তিনি বললেন,

‘ বউমা চুপ করো। দোহাই লাগে।’

নির্মলার অনুনয়ের সুর রিপার কান অবধি ঠেকেছে কি না কে জানে? সে তো দিব্যি চেঁচিয়ে যাচ্ছে। তার চোখ মুখ স্পষ্ট বলে দিচ্ছে সে কতটা শোকে আছে। ভয়ংকর কান্না পাচ্ছে,কিন্তু কাঁদছে না। এমন মানুষ গুলোর সামনে কিছুতেই কাঁদবে না। সে চায় না, তারা তাকে দুর্বল ভেবে ঝাপিয়ে পড়ুক। এজন্য সে তার গর্জন চালিয়ে রেখেছে। কড়া আওয়াজে বললো,

‘ শাশুড়ি মা, আপনি চুপ থাকতে বলছেন? এটা চুপ থাকার বিষয়? বিয়ের একটা দিন না যেতেই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কাহিনী। আপনি ঠিক আছেন তো?ভেবে চিন্তে কথা বলছেন? আমার পরিবর্তে আপনার মেয়ে শিলা যদি থাকতো তাহলেও কি একই জবাব আসতো?’

রিপার কন্ঠে প্রতিবাদের ধ্বনি। সে টের পাচ্ছে তার রক্ত চলাচল দ্রুত চলছে। হার্টবিট অস্বাভাবিকভাবে দপাদপ আওয়াজ তুলছে। শরীর থেকে চিকন ঘাম তরতর করে বয়ে যাচ্ছে। চোখের পেছনের সাদা অংশ সূর্যের আভার মতো লাল হয়ে আছে। সে সেই রক্তবর্ণ চোখে তাকালো শ্যামলের দিকে। শ্যামলের দৃষ্টি মাটির দিকে নিবদ্ধ। রিপার সাথে না বিয়ের সময় আর বিয়ের পর এক দন্ড হেসে কথা বলেছে সে। সবময় এড়িয়ে চলেছে। বিয়ের আগে এর কারণ ধরতে না পারলে এখন স্পষ্ট ধরতে পারছে রিপা। তাহলে বড় ভাবী বলে যাকে পরিচয় করিয়েছিলো তার সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক থাকার কারণেই তাকে এড়িয়ে চলা হতো। শ্যামলের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি নিপাত করেই মুখ মন্ডল ঘুরিয়ে নিলো সে। একটা সময় তার ঘর্মাক্ত নাকের ডগা দেখে কত প্রতিবেশী ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলো সে নাকি স্বামী সোহাগী হবে। এই কি তার স্বামী সোহাগীর নমুনা? তাচ্ছিল্যের হাসি আসছে তার। কি ভাগ্য! সাদামাটা আর সহজ-সরল দেখতে লোকটার ভেতর টা যে এমন হবে কল্পনায় আনে নি রিপা। তাকে সবাই বলে সে নাকি মানুষ চিনতে পারে না, আজ তার বিশ্বাস হলো, সে আসলেই মানুষ চিনতে পারে না। লোকে একদম সত্য বলে!

রিপার বিয়ে ঘটকের আয়োজনে হয়েছে। শশুড়বাড়ীর লোকজন তাকে পছন্দ করেই বিয়ে ঠিক করিয়েছেন। সে বারবার শুনেছে পাত্র পক্ষের নাকি তাকে খুব পছন্দ হয়েছে আর সেজন্য বিয়ে বাবদ সকল খরচ তারা বহন করবে। এবং খুব কম আয়োজনে বিয়ে সম্পন্ন করবেন। মেয়ে পক্ষের উপর কোনো রকম দাবি নেই তাদের, শুধু মেয়ে হলেই চলবে। এমন দু মুখো সাপের দেখা যে এভাবে পাবে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো সে। নিপা আর শিপা কলেজে পড়ে। বাবা বে-সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরী করেন। মাসিক বেতন ২০ হাজারের কাছাকাছি। মধ্যবিত্ত স্বচ্ছল পরিবার তাদের। তিন মেয়ে বাবদ খরচ আর সংসারের যাবতীয় খরচ এ টাকা দিয়ে দিব্যি কেটে যায়। কিন্তু যখন কোনো বাড়তি খরচ এসে কাঁধে পড়ে তখন হিমশিম খেতে হয়। এ যেমন- গত ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে যখন শিমা টাইফয়েড বাঁধিয়েছিলো তখন কোনো রকম সিদ্ধ চাল আর ডিম খেতে হয়েছিলো এবং বাড়তি কোনো খরচ করতে পারে নি। রিপার বাবা রুবেল সাহেব বড্ড ইন্ট্রোভার্টেড মানুষ। তিনি ধার-দেনা পছন্দ করেন না। নিজের যে টুকু আছে সেটুকু দিয়েই সংসার চালান, কোনো রকম বাড়তি খরচ করেন না। তাই বলে কি মেয়েদের শখ আহ্লাদ মেটান না? মেটায়। মেয়েরা কিছু চাইলে কখনো না করেন না, দ্বিতীয়বার তাকে মনে করিয়ে দেওয়ার পূর্বেই নিয়ে আসেন। তিন মেয়েকে বড্ড ভালোবাসেন তিনি। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার খেয়াল পূর্বে ছিলো না, কিন্তু যখন সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে তখন আর না করে নি। কে জানে কয়দিন আর বাঁচবে সে! তার আগে মেয়েদের একটা ঠিক করে যেতে চান তিনি। ডায়বেটিসের ভুক্তভোগী সে। তার উপর মাস খানেক আগে পায়ের আঙ্গুলের গোড়ালি কাটিয়ে এসেছেন তিনি। আর তার জন্য সম্পূর্ণ হাসপাতালের চিকিৎসার উপরে রয়েছেন। ডাক্তার কড়া নির্দেশ পা যেনো কোনো মতেই ইনফেকশন না হয়। কারন ডায়বেটিসের রোগীর জন্য পা খুবই নাজুক(সেন্সিটিভ) স্থান। এবং উনাকে যেনো বাড়তি টেনশন না দেওয়া হয়। নাহলে উনার জন্য বিরাট ঝুঁকি রয়েছে। এ বিষয়গুলো ডাক্তার বলার পূর্বেই অবগত ছিলো রিপা। বাবার কথা বড্ড মনে পড়ছে রিপার। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। বাবার কোলে একটুখানি কেঁদে নিলে হয়তো শান্তি পাবে। চাপা শ্বাস ফেলে কাপড়-চোপড়ের ট্রলি নিয়ে বেরিয়ে আসলো সে। মানুষের ভীড় কম দেখাচ্ছে। পরিবারের আত্মীয় ব্যতীত বোধ হয় আর কেউ নেই। রিপা বিলম্ব না করে পা বাড়ালো।

—‘ ভাবী,ভাবী। কোথায় যাচ্ছেন আপনি।’

হুট করে একদল ছেলে আর মেয়ে এসে পথ আটকায় রিপার। এদের এর আগে দেখে বলে মনে হয় নি রিপার।তাদের মধ্যে রয়েছে তিনটা ছেলে আর দুইটা মেয়ে। মেয়ে দুটোর কি সুন্দর গড়ন, ছেলেগুলো শ্বেতরঙ্গা। তাদের চোখ মুখে অস্থিরতা। দিশেহারা ভাব টাও ফুটো উঠেছে মুখে।

—‘আপনারা কারা? আমাকে আটকাচ্ছেন কেনো? জানেন কি হয়েছে আমার সাথে?’

–‘ সব জানি,ভাবী। আপনি একটু বসে দয়া করে আমাদের কিছু কথা শুনুন। আমরা ইমনের বন্ধু।’

—‘সব জানার পরেও আপনারা বসতে বলছেন? আর ইমন কে? এ বাড়ীর পাগল ছেলেটা?’

নেহাল চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। বন্ধুকে এমন শব্দ বলা টা তার গায়ে লেগেছে। শ্যামলের বড় ভাইয়ের নাম ইমন। ইমন প্রতিবন্ধি। তবে জন্মগত নয়, কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনার প্রভাবে সে প্রতিবন্ধী হয়েছে। তার রোগ চিরস্থায়ী নয়, চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যাবে। তবে কবে ঠিক হবে এর কোনো নিশ্চয়ইতা নেই। পারিবারিকভাবে সুস্থ করার জন্যই গত কয়েক মাস পূর্বে বাড়ীতে নিয়ে আসা হয়েছে। রিপাকে বসানো হয়েছে, তার সামনেই ইমনের বন্ধুরা বসেছে। তাকে ঘিরে যত আলোচনা চলছে। এর মধ্যে বাড়ীতে একবারও তাকে বিষয়গুলো জানানোর সুযোগ দেওয়া হয় নি।

—‘ভাবী, আপনি যাবেন না প্লিজ। আমাদের অনুরোধ রইলো নাহলে কিছু ঘটে যাবে।’

বিস্ফোরিত চোখে তাকালো রিপা। তার অবাক লাগছে, সবকিছু শুনার পরেও তাকে থাকার কথা বলছে কীভাবে? মানুষ এমনও হয়? সে বুঝেছে এখানে কেঁদে কোনো লাভ নেই। সবাই ঘুরেফিরে একতাল। চোখের জল মুছে, তাচ্ছিল্যের হাসি ছুড়ে উঠে দাড়িয়ে পড়লো রিপা।

—‘এখন তো আর এক মুহূর্ত দাড়াতে পারবো না। আমি এক্ষুণি চলে যাবো।’

নির্মলা বেগমের দিকে অসহায় দৃষ্টি এক পলক তাকালো ইমনের বন্ধুরা। নির্মলা বেগম সেই চাহনী এড়িয়ে স্বাভাবিক ভাবে তাকালেন। যার ভাবার্থ ‘তোমরা দায়িত্ব নিয়েছে কীভাবে সামলাবে সেটা তোমাদের ব্যাপার।’ ছেলে-মেয়েগুলো পরস্পরের মুখের দিকে বার কয়েক বার চাওয়াচাওয়ি করলো। হিসাব মিলিয়ে জুঁথি উঠে রিপার সামনে দাড়িয়ে পড়লো। রিপা চমকে তাকানোর পূর্বেই তার মুখে ক্লোরোফম স্প্রে করা হয়। জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ার সাথে সাথে এক জোড়া শক্তপোক্ত হাত এসে ধরে ফেললো। দৌড়ে আসার কারণে হাঁপাচ্ছে সে, রিপার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। তারপর,

চলবে?
® সোনালী আহমেদ

গল্প–#সম্পর্কের_বন্ধন
লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ
প্রথম পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here