সম্পর্কের বন্ধন, পর্ব:২

গল্প–#সম্পর্কের_বন্ধন
লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ

২.
রিপা চমকে তাকানোর পূর্বেই তার মুখে ক্লোরোফম স্প্রে করা হয়। জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ার সাথে সাথে এক জোড়া শক্তপোক্ত হাত এসে ধরে ফেললো। দৌড়ে আসার কারণে হাঁপাচ্ছে সে, রিপার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। তারপর, বাকিদের দিকে ঘুরলো। হাত জোড়ার মালিক স্বয়ং শ্যামল। তাকে দূরে রাখা হয়েছিলো, সিদ্ধান্ত ছিলো ইমনের বন্ধুরা রিপাকে আটকাবে আর ওর পাশে কেউ থাকবে না। শ্যামল জানতো রিপাকে আটকানো যাবে না। এ মেয়ের পুরো বায়োডাটা জানা তার। রিপাকে ধরে ফেলতেই তালি বাজালো ইমন। দুই হাতে তালি বাজাচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে সে।

—‘কি মজা! কি মজা! ভাইয়া বার্বিডল ক্যাচ ধরেছে। ইয়াপ্পি, বার্বিডল এবার আর যেতে পারবে না।’

ইমনের কন্ঠ পাঁচ বছরের বাচ্চার ন্যায় শুনাচ্ছে। নেহাত সে অসুস্থ নাহলে সবাই তার অদ্ভুত কর্মকান্ডে হাসতো। নির্মলা বেগম ছলছল নয়নে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলো। মায়ের বুক পুড়ছে। কত হ্যান্ডসাম আর বুদ্ধিমান ছেলে ছিলো তার। সবসময় গম্ভীর থাকতো, মুখে কদাচিৎ হাসি দেখা যেতো। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কথা বলতো না। তিনি সমসময় বলতেন, ‘ও বাপ তুই হাসোছ না কেনো? একটু হাস। আজ বলতে ইচ্ছা করছে, তুই হাসিছ না,যেমন থাকতি তেমন হয়ে যা। ‘ তার ছেলেকে না হাসলেই বড্ড সুন্দর লাগে। পৃথিবীতে কিছু মানুষ রয়েছে, যাদের না হাসলে সুন্দর দেখায়। ইমন তেমন একজন। যাকে না হাসলে রাজপুত্রদের মতো দেখায়। না,না রাজপুত্ররা তো হাসে।


সন্ধ্যা নেমেছে ইতোপূর্বেই, পক্ষীকূল নীড়ে ফিরে গিয়েছে। আশপাশের পরিবেশ নিস্তব্ধ । রুমের মধ্যে জানালার পর্দা ভেদ করে বাতাস বইছে। বিছানায় রিপা জ্ঞানহীন পড়ে আছে। তাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। শরীরের নাজেহাল দশা। বেশ কিছু সময় বাদে, আধো আধো চোখে চারপাশে তাকালো রিপা। শরীর আর মাথা যন্ত্রণা করছে। ভালোমতো চোখ মেলতেও পারছে না, মনে হচ্ছে মাথায় দশ কেজি ওজনের বস্তু ফেলে রাখা। দুই হাতে মাথা আকড়ে ধরে বসে এদিক ওদিক তাকালো। নিজের দিকে তাকাতেই চোখ বড় করে ফেললো। কি হয়েছে অনুমান করতে সময় লাগলো না। ঘৃণায় চোখ বন্ধ করে ফেললো। চোখের কোণ গড়িয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়ালো। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার মাঝেই দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো নুহা। নুহা সম্পর্কে রিপার ভাবী। তার হাতে কিছু খাবার রয়েছে। তাকে দেখেই ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো রিপা। মানুষ এত নির্লজ্জ, বেহায়া হয় তা নুহাকে না দেখলে রিপাও জানতো না।

–‘ভাবী, আপনাকে এগুলা খেয়ে নিতে বলেছে।’

রিপা শক্ত গলায় বললো,

—‘এগুলা নিয়ে যান।’

—‘ খাবারের উপর রাগ করতে নেই। আপনার শরীর খারাপ করবে তো ভাবী। খেয়ে নিন।’

রিপা উচ্চসুরে বললো,
—‘ চুত*মারা** আমার শরীর খারাপ করলে কি তুই তোর শরীরের জ্বালা মিটিয়ে নেওয়া বন্ধ করবি?’

— ‘ছিঃ, ভাবী। আপনি আমার সাথে মুখ খারাপ করে কথা বলছেন কেনো?’

—‘ এ্যাহ, ন্যাকামি! তোর ন্যাকামি দেখে আমি না আমার কাপুরুষ স্বামী গলবে। তখন লজ্জা করে না যখন পর-পুরুষের কাছে যাস? এখন লজ্জা লাগছে। কেমন মানুষ তুই? স্বামী অসুস্থ বলে অন্যের স্বামীর কাছে যাস। আবার আসে ছিঃ বলে নাক ছিঁটকাতে।’

–‘ দেখুন ভাবী আপনি এবার বেশি করছেন। না জেনে আমাকে যা নয় তা বলছেন। ‘

নুহার অগ্নিশর্মা রুপে কোনোরুপ পরিবর্তন দেখা দিলো না রিপার মধ্যে। সে তাচ্ছিল্যের হাসি ছুড়ে দিলো। নুহা অপমানিতবোধ করলো। খাবার প্লেট টা ধিরাম করে ওর সামনে রাখলো। প্লেট রাখার সাথে ঝনঝন আওয়াজ হলো, যার রেশ ধরে ঘরে আসলো শ্যামল। নুহা যা শুনাতে চেয়েছিলো,তা আর শুনানো হলো না। রিপা বিছানার চাদর টেনে শরীরে জড়িয়ে নিলো। শ্যামলকে দেখতেই তার ঘেন্না লাগছে। শরীর কেমন ঘিন ঘিন করছে।

—‘কি হয়েছে?’

রিপা হুট করে চাদর সহ দাড়িয়ে গেলো। রাগাণ্বিত স্বরে বললো,

—‘ আমাকে অজ্ঞান করে এখানে আটকে রাখার কারণ কি? আর আমার সাথে কি করেছেন আপনারা? আমার মা-বাবা কই?’

রিপা ভীষণ বুদ্ধিমতি মেয়ে। ক্লোরোফর্ম তার নাকের নিকট নিয়ে আসতেই সে চিনে ফেলেছিলো। ল্যাবরেটরিতে বহুবার এটা নিয়ে কাজ করেছিলো সে। সে ধরে নিয়েছে, তাকে অজ্ঞান করে আটকে উল্টাপাল্টা কিছু করা হয়েছে তার সাথে। শ্যামল বাম ভ্রু উচিয়ে ঠোঁটে কুৎসিত হাসি ফুটিয়ে বললো,

–‘বাহ, বেশ বুদ্ধি তো। কি করেছি সেটা তো বুঝেছো,তার পরেও প্রশ্ন কেনো করছো? উমম, বুঝেছি আমার মুখ থেকে শুনতে চাও। আচ্ছা বলছি,,,’

—‘একদম বাজে বকবেন না।আপনি কাপুরুষ জানতাম, এতটা কাপুরুষ ভাবি নি। আমার ঘুমের ঘোরের সুযোগ নিয়েছেন। আপনার পুরুষত্বের আন্দাজ হয়ে গিয়েছে। খুব ভালো করেই জানতেন, আমি স্বজ্ঞানে থাকলে আমার সাথে কিছুই করতে পারতেন না। যাই হোক বলে রাখি, যদি বলেন এ কথা বলে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে আটকে রাখবেন তাহলে বলি এটা আপনার ভুল ধারনা। আমি এসবের পরোয়া করি না, আপনাদের গোমড় ফাঁস করেই ছাড়বো সাথে এখান থেকেও বের হবো।’

শ্যামল চোখ বন্ধ করে রেখেছে। রিপার শরীর জ্বালানো কথা কানে পৌঁছাতেই শরীরের লোম দাড়িয়ে গিয়েছে। শ্বাস-প্রশ্বাস গভীরভাবে টানছে আর ছাড়ছে। রাগে লাল হয়ে যাচ্ছে সে। কেউ তাকে এমন কথা বলার সুযোগ পায় নি কখনো, অথচ এই মেয়ে তাকে যা নয় তা বলছে। রাগটুকু যথাসম্ভব হজম করে থমথমে গলায় বললো,

—‘ বেশি তেজ ভালো না। উল্টো বেগ সামলাতে পারবে তো? চুপচাপ খাবারটুকু খেয়ে নাও।’

—‘খাবো না আপনার খাবার।’

বলেই প্লেট ছুঁড়ে ভেঙ্গে ফেললো রিপা। নুহা তার দিকে এগিয়ে যেতেই শ্যামল তাকে থামিয়ে দিলো। শান্ত চোখে রিপার দিকে এক পলক তাকিয়ে নুহাকে যেতে বললো। নুহা যেতে চাইলো না, ঠাঁই দাড়িয়ে রইলো। কিন্তু শ্যামলের চোখের দিকে তাকাতেই দ্বিতীয়বার উহ্ বলার সাহস করলো না। চুপচাপ বেরিয়ে গেলো। শ্যামল নিচু হয়ে সবটুকু খাবার তুলে নিলো, একটুও ছিটেফোঁটা রাখলো না। সব নিয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিলো। রিপার একদম কাছাকাছি যেয়ে শান্তস্বরে বললো,

–‘ এখন থেকে আগামি ২৪ ঘন্টা কোনো খাবার পাবি না। এটা তোর তেজের সামান্য প্রতিক্রিয়া দেখালাম।’

রিপা মুখ ফিরিয়ে নিলো। শ্যামল নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো। যেতে যেতে ভালো করে দরজা আটকিয়ে গেলো। রিপাকে আরো কঠিন শাস্তি দেওয়া উচিত ছিলো। তাকে যা বলেছে এসবের কাছে শাস্তিটা পিঁপড়া সমান। সে ভালো ব্যবহার করতে চেয়েছিলো,কিন্তু রিপার নোংরা ভাষা তা করতে দিলো না তাকে। তীক্ত মেজাজে বেরোতেই ডাইনিং রুমে মায়ের মুখোমুখি হতে হলো। নির্মলা বেগম পানে চুন লাগাচ্ছিলেন। শ্যামলকে দেখে তড়িঘড়ি পান মুখে দিতে দিতে বললেন,

–‘ হ্যা রে, কি হয়েছে? ঝামেলা করে নাই তো? ইমনের বন্ধুদের একবার আসিতে বলিবো নাকি?’

—‘কোনে দরকার নেই। প্রতি কথায় ওদের কেনো ডাকতে হবে? তাহলে আমাকে আর কি দরকার।’

—‘ আহা, রেগে যাচ্ছিস কেনো? মেয়ের বাপ বারবার ফোন দিয়ে জ্বালাইতেছে। বলতেছে, ফিরা না কইরা বিয়ের পরের দিন হানিমুনে গেছে কেনো? আরেকদিন পরে গেলে কি হতো? একবার তার সাথে কথা বলিয়ে দিতে। আমি এ কথা ও কথা বলে বুঝাতে বুঝাতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। তাই বলছিলাম একবার কোনোরকম যদি ওরে দিয়ে কথা বলাইতে পারোস তাহলে টেনশন থাকবে না। আমি ক্লান্ত মিথ্যা বলতে বলতে ।’

শ্যামল কথা বললো না। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে লাগলো। তার ধ্যান ভেঙ্গে গেলো কাচের জিনিস ভেঙ্গে যাওয়ার চুরমার শব্দে। মায়ের পেছন পেছন সেও দৌড়ে দেখলো ইমন ফুলদানী ভেঙ্গে ফেলেছে। তার সামনে খাবারের প্লেট নিয়ে ঘুরছে নুহা। খাবে না সে জিদ ধরেছে। শ্যামল ধমকের স্বরে বললো,

—‘খাবে না কেনো? খাবারে কি হয়েছে? খাবার তোমার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে? চিনো না আমাকে বুঝেছো, দশদিন ও খাবার দিবো না।’

ইমন তার ধমকের পাত্তা দিলো না। উল্টো আরো অস্বাভাবিক হয়ে উঠলো। আরো একটা ফুলদানী ভেঙ্গে ফেললো।

—‘খাবো না,খাবো না। বার্বিডল ছাড়া খাবো না। বার্বিডলের সাথে খাবো।’

শ্যামল রেগে গেলো। তার দিকে তেড়ে যেতেই নির্মলা বেগম থামিয়ে দিলেন। অগত্যা রাগ দেখিয়ে ইমনের খাবারগুলো কেড়ে নিয়ে ফেলে দিলো। ওকেও খাবার দিবে না সে। দেখবে কি করে আজ না খেয়ে থাকে। তেজ দেখাচ্ছে তার সাথে, সেও দেখবে। তাকেও খাবার না দেওয়ার কঠিন ফরমায়েশ দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো।

চলবে।

®সোনালী আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here