সম্পর্কের বন্ধন, পর্ব:৩+৪

গল্প–#সম্পর্কের_বন্ধন
লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ

৩.
শ্যামল রেগে গেলো। তার দিকে তেড়ে যেতেই নির্মলা বেগম থামিয়ে দিলেন। অগত্যা রাগ দেখিয়ে ইমনের খাবারগুলো কেড়ে নিয়ে ফেলে দিলো। ওকেও খাবার দিবে না সে। দেখবে কি করে আজ না খেয়ে থাকে। তেজ দেখাচ্ছে তার সাথে, সেও দেখবে। তাকেও খাবার না দেওয়ার কঠিন ফরমায়েশ দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো। রক্তিম চোখে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো ইমন। নির্মলা বেগম বুঝে গিয়েছেন তার ছেলে রেগে গিয়েছে। এখন নিশ্চই ভাংঙ্গাচুরা করবে। তিনি নুহা কে ইশারায় নিয়ে আসতে বলে ছেলেকে এ কথা সে কথা বলো মনোযোগ ভ্রষ্ট করতে চাইলেন। ইমন চোখের পলক ফেলেছে না। ইতোমধ্যে চোখে পানি জমে গিয়েছে। রাগে কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। মা কে ঝাটকা মেরে সরিয়ে কাচের কাপ ঠাস করে মেঝেতে ফেললো। দ্বিতীয়বার অন্য কিছু ফেলার পূর্বেই “মিউ মিউ” আওয়াজ করে ডাকতে ডাকতে রুমে প্রবেশ করলো বার্বিডল। বার্বিডল বিড়ালের নাম। এ বিড়াল ছাড়া থাকতে পারে না ইমন। এর বিশেষ কারণ রয়েছে। বিড়াল টি ইমন ভক্ত। ইমনের যেমন বিড়ালের প্রতি টান ঠিক তার উল্টো শ্যামল। বিড়ালে তার এল্যার্জি, বিড়াল তার আশেপাশে গেলেই সে অনবরত হাঁচি দিতে থাকে। আর এ বিড়াল টি তার চরম শত্রু। এর আগেও একবার ওকে মেরে ফেলার জন্য বের করে পাঠিয়ে দিয়েছিলো, তখন বার্বিডলকে না পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো ইমন। কোনো ধরনের ঔষধ নিতে চায় নি,কোনো কিছুতেই শান্ত থাকতো না। তারপর উল্টোমুখে সে বিড়ালের খোঁজে গিয়েছিলো শ্যামল। ভাগ্যবশত বিড়াল টি জীবিত ছিলো। আর এ বিড়ালের সাথে বোধ হয় শ্যামলের শত্রুতা রয়েছে,কারণ বিড়ালটি তার একদম কাছে ঘেঁষে না, তাকে স্পর্শ করতে আসলেই আঁচড় দিতে যায়। আজও তাকে আঁচড় দিতে চেষ্টা করেছিলো সেজন্যই ওকে স্টোর রুমে আটকে রাখা হয়েছিলো।
খাবার প্লেট আর বিড়ালটিকে রেখে বেরিয়ে যায় নুহা। কারণ এখন তাকে শ্যামলকে সামলাতে হবে। কোনোমতেই শ্যামলকে জানতে দেওয়া যাবে না তার আদেশ অমান্য করা হয়েছে। নির্মলা বেগম প্লেট হাতে নিলেন খাইয়ে দেওয়ার জন্য, তখনই তাকে সাফ না করে দেয় ইমন। সঙ্গে এ ও বলে দেয় যে নির্মলা বেগম থাকলে সে খাবে না। অনেকবার চেষ্টা করে ক্ষান্ত হয়ে চলে গেলেন তিনি। নির্মলা চলে যেতেই প্লেট নিয়ে চুপিচুপি পা ফেলে বেরিয়ে যায় ইমন। উদ্দেশ্য রিপাকে যেখানে আটক রাখা হয়েছে সেখানে যাওয়ার। বিনা আওয়াজে খুবই সন্তর্পণে দরজা ধীরে ধীরে খুলে ফেললো সে। চুপিচুপি রুমে ডুকে দরজা ভিড়িয়ে দিলো।তার পেছন পেছন বার্বিডল ও প্রবেশ করেছে।

রিপা ওয়ালে হেলান দিয়ে কাঁদছে। সারাদিন না খেয়ে থাকার ফলস্বরুপ, শরীর টা নেতিয়ে পড়েছে। তার মাথায় এক প্রশ্ন চলছে তাকে এভাবে আটকে রাখার কারণ কি? তখনই
কক্ষে অন্য কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ তুলে তাকালো সে। মুহূর্তেই রুমে অচেনা পুরুষকে দেখে নড়েবড়ে যায়। হাতে প্লেট নিয়ে তার সামনে দাড়িয়ে আছে ইমন। রিপা বললো,

‘আপনি? আপনি এখানে কেনো এসেছেন? আমি বলেছি না খাবো না?’

তার কথা বারবার জড়িয়ে যাচ্ছে, শরীরে বেশ জোর নেই। ইমন তার পাশ ঘেঁষে বসে মলিন মুখে বললো,

‘তুমি কাঁদছো কেনো? তোমাকে মেরেছে,না? আমাকেও মারে, ‘ভাইয়া’ না ডাকলে। তুমি ভাইয়া বলে দাও নি কেনো? তাহলে তো আর এত মারতো না। থাক কেঁদো না।’

রিপা যা বলতে উদ্বুত হয়েছিলো তা আর বললো না। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করতে লাগলো। এ ছেলে তো পাগল, অযথা ওর উপর না আবার রাগ দেখিয়ে দেয়। রিপার একটা স্বভাব রয়েছে, সে নিজের রাগ কখনো অন্যের উপর দেখায় না। যার রাগ তার সাথেই মেটায়।

–‘আচ্ছা,আর কেঁদো না। আমি বকে দিবো। এখন খেয়ে নাও।’

—‘আমি খাবো না।’

—‘কেনো?’

—‘কারণ আমার খাওয়া শেষ।’

—‘মিথ্যা কথা, তুমি খাও নি। আমি দেখেছি ভাইয়া তোমার খাবার ফেলে দিয়ে তোমাকে এখানে আটকে রেখেছে। তুমি না খেলে আমি খেয়ে নিবো। মনে রেখো পরে কিন্তু আর পাবে না। ভাইয়া চলে আসবে।’

রিপা নিরুত্তর রইলো। ইমন করুণ সুরে বললো,

—‘ তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। ভাইয়া চলে আসবে। আর এসে আমাকে দেখলে আমাকে তো মারবে সাথে তোমাকেও মারবে।’

—‘তোমার ভাই তোমাকে মারে?’

–‘হ্যা,মারে। ভাইয়া খুব পঁচা। জানো, আমাকে না মাঝে মাঝে অন্ধকার ঘরে নিয়ে তেলাপোকা আর ইদুরের সাথে আটকে রাখে। ‘

বলতে বলতে ইমনের চোখ ছলছল করে উঠে।
বিড়ালটি মেউ মেউ ডেকে ইমনের পেছন থেকে বেরিয়ে আসলো। ইমনের গা ঘেষে শান্ত্বনা দিতে লাগলো, যেনো সে বুঝেছে তার মালিক কষ্ট পাচ্ছে। এ অবলা প্রাণীগুলো হয় খুবই প্রভুভক্ত। তাদের একটু আদর দিলেই অন্ধভক্ত হয়ে উঠে। রিপা ফ্যালফ্যাল চোখে বিড়ালের দিকে তাকালো। এ বিড়ালকে সে দেখেছিলো। একদল লোক ওকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছিলো, ঠিক তখন ই সে ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো। এত সুন্দর বিড়াল দেখে ও তাদের মারতে দেয় নি। কাঠখড় পোড়ার মতোন অনুরোধ করে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। ভাগ্যের পরিহাসে দ্বিতীয়বার দেখা হয়ে গিয়েছিলো। স্থান টি ছিলো শপিং মলের সিড়ি লিফ্ট। বিড়াল টি সিড়িতে হুট করে দৌড়ে চলে এসেছিলো। এসেই বিপাকে পড়েছিলো, সিড়ি নিচে নামার সাথে সে ও লাফাচ্ছিলো। তখন সে ওকে আবারো বাঁচিয়েছিলো। সে অবাক হয়ে হাত বাড়িয়ে বিড়ালকে ছুঁয়ে দিলো। ইমনকে অবাকের সুরে প্রশ্ন করলো,

‘ এই বিড়ালকে কই পেয়েছেন?’

ইমন অভিমানের সুরে বললো,

‘ওকে বিড়াল বলবে না। ও আমার বার্বিডল।’

রিপা ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে নিলো। কি বললো? বার্বিডল! এটা তো মেয়ে মেয়ে লাগছে। বিড়ালের নাম তো হয়, মিনি,পুষি, ক্যাটি। সে কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,

‘বার্বিডল?এটা আবার কেমন নাম?’

‘ খুব সুন্দর তাই না? জানো এটা আমি রাখি নি। প্রি্,,,’

তার কথার মাঝখানেই রিপা থামিয়ে দিলো। বিড়াল নিয়ে সে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চায় না। তার এখনে জরুরী কথা জানার আছে। রিপা একটু খাবার মুখে তুলে বললো,

‘ তোমাকে আর কেউ মারে? তোমার বউ, বোন,মা উনারা?’

‘না। আমাকে আর কেউ মারতে পারে না। নুহা তো আমাকে দেখলে ভয় পায়। শিলা আপু সারাদিন ফোন কানে নিয়ে থাকে আর আম্মা সারাক্ষণ আমাকে আদর করে। মারে না, কিন্তু বউ কে? আমাদের ঘরে তো আর কেউ নেই। ‘

‘ওহ আচ্ছা, তাহলে আমার ভুল হয়েছে। তা নুহা তোমাদের কে হয়? ‘

কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করে রিপা। তার ধারণা কিছু গন্ডগোল আছে। ইমনের বোকা বোকা কথায় সে বেশ কিছুই জানতে পারছে। ওকে ওর মতোই হ্যান্ডেল করতে হবে। ইমন খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,

–‘ নুহা , নেহাখালামনির আম্মু। আমাদের যে নেহামনি আছে না উনার। জানো নেহাখালামনি এত বড় হয়েও নুহাকে আম্মু ডাকে। হি হি হি, কি লজ্জা।’

বলেই খিলখিল করে হাসলো ইমন। রিপা বুঝে ফেললো নুহা তাদের হয়তো খালাতো বোন। রিপা তার কথার ফুলঝুরি চালু রাখলো। কথায় কথায় জেনে ফেললো, প্রতি রাতে নুহা আর শ্যামল একসাথে থাকে। এটুকু শুনতেই তার গা ঘিনঘিন করে উঠলো। সে যা দেখেছে তার কিছুই ভুল নয়। তাদের কথার মধ্যেই রুমে এসে উপস্থিত হন নির্মলা বেগম। ইমন আর রিপাকে একসাথে দেখেই সে থতমত খেয়ে যান। কঠিন আদেশের সুরে ছেলেকে শাসিয়ে বললেন,

‘তুই এখানে এসেছিস কেনো? তোকে না নিষেধ দিয়েছিলাম?’

ইমন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলো। রিপা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,

‘ কেনো, আমি সব জেনে যাবো বলে?’

‘এই মেয়ে তুমি বেশি কথা বলো? ‘

‘এখনো কিছু বলেছি কই? আর আমাকে এখানে আটকে রাখার কারণ কি? কেনো আটকে রেখেছেন? আমি যেতে চাই, যেতে দিন। আপনার ছেলের পরকীয়ার সকল ডিটেইলস জানা হয়ে গিয়েছি আমার।’

‘ এই, এই মেয়ে। কি “পরকীয়া” “পরকীয়া” লাগিয়ে রেখেছো? আমি ওর বউ। স্বামী, স্ত্রীর কিসের পরকীয়া? একটা থাপ্পর দিবো। ‘

কথাটা বলে চেঁচিয়ে ভেতরে আসলো নুহা। রাগে ঠোঁট কাপছে। তখন শ্যামলের ভয়ে কিছু বলতে পারে নি। এখন সব ঝাল মিটিয়ে নিবে। কৌশলে শ্যামলকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে এসেছে সে।
রিপা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো। নুহার কন্ঠে তেজ শুনা যাচ্ছে। তার আওয়াজ বলে দিচ্ছে সে যা বলছে তার সব ঠিক। বেতালের মতো রিপা প্রশ্ন করলো,

—‘ তাহলে আমি কে?’

নির্মলা বেগম নির্লিপ্ত গলায় বললেন,

—‘ তুমি তার ভাবী। অর্থাৎ ইমনের বউ।’

—‘মানে? কি বলছেন ? ক্লিয়ারলি বলেন।’

–‘ ফুফুআম্মার কথার অর্থ হলো, তোমাকে ইমনের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন কারণ নিশ্চই জানতে চাইবে, তার জন্য বলে রাখি তোমার বাবা ইমনের সাথে তোমাকে বিয়ে দিবে না তাই এ চাল চেলেছি আমরা। যাই হোক শুনো, ভালো কথা মনে পড়েছে, এখন ফটাফট তোমার বাবাকে ফোন দিয়ে বলো তুমি ঠিক আছো,কদিন যেনো তিনি তোমাকে ডিস্টার্ব না করে। না বলতে চাইলে সমস্যা নেই, তোমার সুন্দর শরীরের সুন্দর ভিডিও সবার কাছে পৌঁছে দিবো। ‘

নুহার কথা শুনে রিপা তব্দা খেয়ে যায়। মাথায় যেনো বাজ ভেঙ্গে পড়েছে। মুখ বিশাল বড় হা করে তাকিয়ে রইলো তাদের দিকে। সবটুকু হজম করা তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। ধাক্কাগুলোর বেগের গতি খুবই ভারী পড়লো তার উপর। নিজেকে কেমন আউলা-ঝাউলা লাগছে।

চলবে!
®সোনালী আহমেদ

গল্প–#সম্পর্কের_বন্ধন
লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ

৪.
নুহার কথা শুনে রিপা তব্দা খেয়ে যায়। মাথায় যেনো বাজ ভেঙ্গে পড়েছে। মুখ বিশাল বড় হা করে তাকিয়ে রইলো তাদের দিকে। সবটুকু হজম করা তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। ধাক্কাগুলোর বেগের গতি খুবই ভারী পড়লো তার উপর। নিজেকে কেমন আউলা-ঝাউলা লাগছে। পলকহীন চোখে কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ রইলো। খুবই শান্তস্বরে সে বললো,

‘ বিয়ের সময় কাগজপত্রের নামগুলো আমি পড়েছি। এবং বর কে ছিলো সেটাও দেখেছি। ‘

নুহা অকপটে জবাব দেয়,

‘ ওসব কিছুই সাজানো ছিলো। সবাইকে দেখানোর জন্য। ‘

রিপা একদৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো। নুহা এবার গলার সুর খানিকটা মিইয়ে বললো,

—‘ দেখো, যা হয়েছে হয়ে গিয়েছে। তুমি সব মেনে নাও। ধরে নাও এসব তোমার কপালে ছিলো। তাছাড়া তোমার বাবাও খুব অসুস্থ, তুমি নিশ্চই জানো তোমার সাথে এমন কিছু ঘটেছে জানলে উনার কি হতে পারে?’

রিপা জড়বস্তুর ন্যায় ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। রিপার দৃষ্টিপাত দেখে, নুহা কন্ঠে আরো খানিকটা মধু মাখালো। রিপার বাহুতে আদরের সুরে হাত বুলিয়ে বললো,

‘ আমার তোমার জন্য খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কি করবো বলো? আমিও নিরুপায় । ইমন ভাই তোমাকেই পছন্দ করেছিলেন। তোমাকেই বার্বিডল মানেন। তাছাড়া উনি তো সুস্থ হয়ে যাবেন। উনার ট্রিটমেন্ট চলছে। আর উনি সুস্থ হয়ে গেলো উনার চাকরী আবারো ফিরত পাবেন, তাহলে তো তোমার লাইফ পুরো স্যাটেল। এর জন্য শুধুই তোমার খানিকটা ধৈর্য্য দরকার। তুমি বুদ্ধিমতি, আমার থেকেও তোমার বেশি জ্ঞান। তাই সিদ্ধান্ত তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম।’

রিপা এবারো কোনো পরিবর্তন দেখালো না, সে শুধু তাকিয়ে রয়েছে। নির্মলা বেগম খাবারের প্লেট নিয়ে এসে রিপার মুখের সামনে ধরে বললেন,

‘ ছেলেটা আমার প্রাণ রে মা। তার অসুস্থতা আমাকে স্বার্থপর বানিয়ে দিয়েছিলো তাই তোমার দিক টা দেখতে পাই নি। স্বার্থপর মা হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার কাছে অনুরোধ, আমাকে ক্ষমা করে সব মেনে নাও। বিনিময়ে যা চাও তাই দিবো।’

রিপা খাবার টুকু মুখে নিলো। কোনোরকম নাড়াচাড়া না করে ধীরে ধীরে গিলে ফেললো। নির্মলা বেগম তাকে খাবার খাওয়াতে লাগলেন। ধীরে ধীরে তার অনুরোধ বাড়ছিলো বৈ কমছিলো না। রিপা চুপচাপ সব হজম করছে। রিপার নিরবতায় দুজনে পলকেই বদলে তার সামনে অনুরোধের হাত পেতে রইলেন। সে যা চাইবে তারা তা ই করবে এ কথাও বললেন। রিপা তাকিয়ে দেখলো, ইমন খেলতে খেলতে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সে এখন গোলক ধাঁধাঁয় আটকে আছে। নুহা আলমারি থেকে ভালো এক সেট সুতি জামা নিয়ে এসে তাকে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললো। রিপা কোনোরকম রিয়েক্ট না করে ফ্রেশ হয়ে নিলো। সে বের হয়ে দেখলো দুজনেই বসে আঙ্গুল কচলাচ্ছেন। তারা টেনশনে রয়েছে তা বুঝতে বেগ পেতে হলো না রিপার। বেশ কিছুক্ষণ মৌনতা পালন করলো সে। ঘড়ির দিকে এক পলক তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে তাদের উদ্দেশ্য বললো,

‘ আমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে চাই।’

নির্মলা বেগম এবং নুহা সম্মতি জানিয়ে উঠে পড়লো। দুজনের ভেতর কিছুটা হালকা হয়েছে। তারপর যে যার রুমে চলে গেলো ঘুমুতে। নুহা যাওয়ার পূর্বে শ্যামলের রুমে একবার উঁকি দিয়ে গেলো। ঘন্টাখানেক পেরোতেই ঘুম ভেঙ্গে যায় শ্যামলের। হকচকিয়ে উঠে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে বারোটা। মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ঝিমুতেই মনে পড়ে গেলো রিপার কথা। তাকে তো সে খাবার না দিয়ে আটকে রেখেছে। দ্রুত নাকেমুখে উঠে রান্নাঘর থেকে একটা শুকনো রুটি নিলো, সাথে একটা ডিম ভেজে নিলো। প্লেট নিয়ে হড়বড়িয়ে দরজা খুলে প্রবেশ করলো সে। সাথে সাথে ঘুম ভেঙ্গে যায় রিপার। রিপার ঘুম খুবই পাতলা। হালকা আওয়াজ শুনলেও তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। রিপা চোখ বন্ধ করে দেখতে চাইলো শ্যামল কি কি করে? হাতেনাতে শ্যামলের কু-উদ্দেশ্য ধরার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছে রিপা। শ্যামল এসেই তাকে ডাকতে লাগলো। তবে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। রিপা নড়লো না। মনে মনে ভেবে নিলো,তাকে ঘুমে বিভর দেখে কি করে সেটা দেখবে। কিন্তু শ্যামল আশানুরূপ কিছুই করলো না। তাকে ডেকে কোনো সাড়া না পেয়ে, চলে গেলো। রিপা চোখ খুলে অবাক হয়ে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড বাদে আবারো তাকে ফিরে আসতে দেখে চোখদুটো পুনঃপুন বুজে নিলো সে। শ্যামল পানির গ্লাস নিয়ে এসেছে। বাম হাতে গ্লাস নিয়ে, ডান হাতের আঙ্গুলে পানি নিয়ে তার মুখের উপর ছিঁটা দিলো। রিপার মুখমন্ডল তার অজান্তেই কুচকে ফেললো। ঘুমের ভান বেশিক্ষণ করতে পারলো না। চোখ মুখ কুচকাতে দেখে শ্যামল আবারো পানি ছিঁটালো। রিপা এবার চোখ মেলে স্বাভাবিকভাবে তাকালো। তাকানো দেখে শ্যামল খাবার প্লেট এগিয়ে বললো,

‘ খেয়ে নাও। প্রথমবার বলে মাফ করে দিয়েছি। এরপর হলে আর কখনো মাফ হবে না।’

রিপা চুপচাপ তাকিয়ে রইলো। শ্যামল তাকে নেওয়ার জন্য আরেকবার বললো কিন্তু কোনোরুপ সাড়া পেলো না। তৃতীয়বার বেশ ঝাঁঝালো গলায় বলতেই সে প্লেট হাতে নিলো। ডিমের কুসুম কাঁচা দেখে বললো,

‘আমি কুসুম কাঁচা খাই না।’

শ্যামল চোখ বন্ধ করে কপালে ভাজ ফেললো। কন্ঠে দ্বিধাবোধ ফুটিয়ে বললো,

‘ আমি কুসুম কাঁচা খাই সেজন্য ভুলে ভুলে আপনার জন্যও নিয়ে এসেছি।’

‘আপনি’ সম্বোধন শুনে রিপা খানিক সময় স্তব্ধ রইলো। শ্যামল তাকে, ‘তুমি এবং তুই’ সম্বোধন করেছিলো। এখন স্বাভাবিক অবস্থায় আপনি বলেছে। অর্থাৎ নুহার বলা কথাগুলো সত্য। সে শ্যামলের ভাবী, নুহা তার ভাবী নয়। খাবার দিয়ে যাবার সময় শ্যামল তাকে বললো,

‘মেয়ে মানুষ, দরজা লাগিয়ে ঘুমাবেন। ‘

রিপা হুট করে কেঁদে ফেললো। হু হু করে কান্নার আওয়াজ শুনে শ্যামল দাড়িয়ে পড়লো। রিপার চোখের পানি স্রোতের মতো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে, একবারও থামছে না। কাঁদতে কাঁদতে সে বলে উঠলো,

‘ দরজা লাগিয়ে কি হবে? আমার সাথে যা হবার তা হয়েই গিয়েছে। ‘

কথাটা শেষ করে খানিকটা দম নিলো। কঠিন গলায় বললো,

‘ আমার জীবন কেনো এমন করলেন? আমার কি দোষ ছিলো? আমি ই কেনো? জানতে চাই আমি,কোন দোষে আমার সাথে এমন প্রতারণা করেছেন?’

শ্যামল নিশ্চুপ রইলো। রিপা তেজী কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

‘জবাব দেন। কেনো প্রতারণা করেছেন? কেনো একটা প্রতিবন্ধীর সাথে আমাকে বিয়ে দিয়েছেন? ‘ খানিকটা দম নিয়ে নাক টেনে টেনে আবারো বললো, ‘ আমার বিয়ে তো আপনার ভাইয়ের সাথে ঠিক হয় নি,হয়েছিলো আপনার সাথে। নিজের বউকে ভাবী পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় একটুও লজ্জা করে নি? বিবাহিত হয়ে অবিবাহিত পরিচয় দিয়ে অন্য ছেলের সাথে আমাকে ঠকিয়ে বিয়ে দিতে লজ্জা লাগে নি? আমাকে অচেতন করে রেপ করে ভিডিও করতে হাত কাঁপে নি। আমার সাথে কি আপনার কোনো শত্রুতা ছিলো যে আপনি এমন করেছেন? আরে আমি তো আপনাকে চিনি ই না,তাহলে কেনো এমন করেছেন?বলুন, চুপ থাকবেন না।’

কথা বলতে বলতে নিচে হাটুগেড়ে বসে পড়লো সে। শ্যামল চোখেমুখে বিষ্ময় ফুটিয়ে বললো,

‘ এসব কে বলেছে?’

রিপা শক্ত গলায় বললো,

‘সব জেনে গেছি আমি। উনারা আমাকে সব বলে দিয়েছেন। ‘

শ্যামল নিরুত্তর রইলো। রিপা নিজেকে শক্ত করে উঠে পড়লো, বিছানার পাশ থেকে ছুরি বের করে শ্যামলের সামনে নিয়ে আসলো। এই ছুরিটা রুমেই পেয়েছিলো সে,তখনই লুকিয়ে রেখেছে। সাথে মাথায় ফন্দিও এটেছে।

‘আপনারা সবাই যে জাল বুনেছেন তার জন্য সমবেদনা। আমি কখনোই এসব মেনে নিবো না। তার থেকে বরং মৃত্যুকে গ্রহণ করে নিবো। মনে রাখবেন মরলে একা মরবো না, আপনার পুরো পরিবার কে সম্পূর্ণ ফাঁসিয়ে সারাজীবন জেলের ভাত খাওয়ানোর পূর্ণ ব্যবস্থা করে যাবো। আমার মতো দ্বিতীয় কারো সাথে কিছু করার ছিঁটেফোটাও সুযোগ রাখবো না। এমনিতেই আমার যে শরীর পর-পুরুষ ছুয়েছে সে শরীর আমি রাখবো না। শেষ করে দিবো সব সাথে আপনাদের।’

‘ পাগলামি করবেন না। ছুরি টা ফেলে দেন। আমার কথা শুনুন। আমি সব বলছি, আপনি এমন কিছু করবেন না। ‘

‘ এ শরীরে এখন শুধু রক্ত,পানি আছে, কোনো প্রাণ নেই। আমি তো মরেই গিয়েছি তখনই যখন জানলাম পর-পুরুষ ছুঁয়েছে। ‘

শ্যামল রিপা কে বুঝাচ্ছে উল্টাপাল্টা কিছু না করতে। সে যা চাইবে তাই করবে ও। কিন্তু রিপা শুনতে চাইছে না। কথা বলতে বলতে রিপার একদম কাছে এসে খপ করে ওর হাত থেকে ছুরি টা নিয়ে নিলো সে। অন্য হাত ওর গালের সামনে এনে থামিয়ে নিলো। হত নামিয়ে ফেলে
চোখ বন্ধ করে দাঁত চেঁপে বললো,

‘ প্রথমত আমি কোনো পর-পুরুষ নই তোমার স্বামী। দ্বিতীয়ত,তোমাকে কিছুই করি নি। এমনকি একবারও স্পর্শ করি নি। তোমাকে ওমন এলেমেলো নুহা করেছিলো শুধু মাত্র ভয় দেখাতে। দমিয়ে রাখার জন্যই ওই মিথ্যা বলা হয়েছিলো। কোনো কিছুই হয় নি তোমার সাথে। বুঝেছো তুমি?’

চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here