#সুখের_পাখি
৩৩
ইহানের বাকি তিন ফুপু এসেছে। সবার ছেলেমেয়েরা আসতে পারেনি। তারপরও যারা যারা এসেছে তাতেই বাড়িতে বিয়ে বাড়ির আমেজ লেগে গেছে। মেজো ফুপু দুই মেয়ে। একজনের নার্সিং পরীক্ষা চলছে তাই আসতে পারেনি। সেজো ফুপুর এক ছেলে। সে হোস্টেলে থাকে। হঠাৎ করে এরকম একটা ঘটনায় ছুটির দরখাস্ত দেওয়ারই সময় পায়নি। ছোট ফুপু এক মেয়ে, এক ছেলে। দু’জনই এসেছে। ইহানের তিন ফুপুই তনুকে দেখে পছন্দ করল। রাশেদা ওদের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল। এখন শুধু আকদ হয়ে থাকবে। কেউ জানবে না। পরিবারের বড় ছেলের বিয়ে। সঠিক সময়ে ধুমধাম করেই করানো হবে। এখন আপাতত লোক জানাতে চাচ্ছে না। ছোট ফুপুর দুই মেয়ে এখন থেকেই সমানে তনুকে ভাবি ডেকে যাচ্ছে। তনুও প্রতিবাদ না করে হাসি মুখে ওদের ডাকে সাড়া দিচ্ছে। সব ফুপুদের একসাথে দেখেও ইহানের ভালো লাগছে না। তার অস্থিরতা বেড়েই চলেছে।
–‘অনুষ্ঠান হবে না। লোক জানবে না মানলাম। তাই বলে কী বিয়ের শপিংও হবে না! এটা কেমন কথা হ্যাঁ।’
ছোট ফুপুর জীবনে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে সেটা তার শাড়ি। শপিং করতে সে বড্ড ভালোবাসে। বিশেষ করে নানান শাড়ির কালেকশন। তার কাছে কতগুলো শাড়ি আছে সে নিজেও হয়তো জানে না। গুনতে গেলে হাঁপিয়ে যেতে হবে। ছোট ফুপুর কথা শুনে সেজো ফুপু বলল,
–‘তোর জীবনে শপিং ছাড়া আর কী আছে বল তো? তোর স্বামী যদি তোকে হাজারটা শাড়ি গিফট করে বলে আমি বিয়ে করে তোমার সতীন নিয়ে এসেছি, তুই সেটাও খুশি খুশি মেনে নিবি।’
মেজো ফুপু হাসতে হাসতে বললেন,
–‘ঠিক বলেছিস। ওর স্বামীর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ শাড়ি। শাড়ি নিয়েই তো এত বছর সংসার করছে।’
ছোট ফুপু বোনদের টিটকারি গায়ে মাখল না। রাশেদা বললেন,
–‘সাদাফের বিয়ের জন্য কয়টা শাড়ি এনেছিস?’
চট করে ছোট ফুপু বলে দিল,
–‘ষোলোটা। ব্যাগে আর জায়গা হয়নি। অনেক ঠেলেঠুলে এই কয়টাই এটেছে।’
এই কথা শুনে তিন বোনই একসাথে হাসতে লাগল।
ফুলি দূর থেকে ওদের কথা শুনছিল। ষোলোটা শাড়ি! তাও মাত্র এক দিনের জন্য। এই কথা শুনে ফুলির চোখ বড় বড় হয়ে গেল। বিস্মিত গলায় বলল,
–‘ষোলোটা শাড়ি! একদিনে তিনটার বেশি কীভাবে পরবে? একটা শাড়ি এক ঘন্টা করে পরলেও তো বারোটার বেশি একদিনে পরতে পারব না। হুহ, সবই বড়লোকদের বড়লোকি কারবার। আমাদের মতো মানুষরা এক শাড়িই দুই তিন বছর চালিয়ে দেয়।’
ওদের উচ্চহাসি আর কথাবার্তা এখনও শোনা যাচ্ছে। ফুলি নিজের কাজ করতে করতে বলল,
–‘তনুটা সত্যিই ভাগ্যবতী। সাদাফ ভাইজান ওরে সুখী রাখব। আমার মতো অভাগীর ভাগ্যে আল্লাহ কারে মিলাই রাখছে কে জানে!’
সেদিনই তনুকে নিয়ে ছোট ফুপু শপিং করতে গেল। তনুর পছন্দের পাশাপাশি নিজের পছন্দের শাড়ি, গয়নাও তনুকে কিনে দিল। তনু এসবের কিছুই চায় না। তার এসব জিনিসের দরকার নেই। ফুপু এক প্রকাশ জোর করেই অনেক কিছু কিনে ফেলল। ছোট ফুপু শপিংয়ে সময় লাগায় বলে আর কেউ তার সাথে আসতে রাজি হয়নি। ওরা বাড়ি থেকে ছোট ফুপুর সাথে তনুকে একাই পাঠিয়েছে। এতকিছু কিনে দেওয়ার পরও ফেরার সময় ছোট ফুপু জিজ্ঞেস করছিল,
–‘তনু, তোমার কি আরও কিছু লাগত?’
তনু মানুষটাকে দেখল। এই পরিবারের সবাই এত ভালো কেন? শুধু একজনকে বাদ দিয়ে সবাই কেন তাকে এত ভালোবাসা দিচ্ছে? সে কি সবার এত ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য? তনুর তো নিজের বলতে কিছুই নেই। সে এই মানুষকে ভালোবাসার বদলে শুধু ভালোবাসাই দিতে পারবে। এছাড়া তার কাছে দেওয়ার মত কিচ্ছু নেই।
–‘সবকিছুই তো প্রয়োজনের থেকে বেশি কিনে দিয়েছেন ফুপু। আর কী লাগবে বলুন?’
–‘দূর! মাত্র পাঁচটা শাড়ি নিলে। গহনাগাঁটিও তো কিছুই নাওনি। ওই চিকন একটা হার শুধু। তোমার বিয়ে হচ্ছে তনু। এখন নাহয় শুধু কবুল বললে, তা বলে কি? বিয়ে তো বিয়েই।’
তনু কিছু বলল না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাতে বসার ঘরে সবাই তনুর শাড়ি গহনা খুলে বসেছে। ওকে সব ক’টা একবার করে পরিয়ে দেখে নিচ্ছে, কোনটাতে সবথেকে ভালো লাগে। তনুকে দেখে ছোট ফুপুর পছন্দের প্রশংসা না করে পারছে না ওরা। সব ক’টা শাড়িতেই তনুকে পরীর মতো লাগছে। সাদাফ মাত্র যেন কোথায় থেকে ফিরেছে। ফুলি দরজা খুলে দিয়ে ভেতরে ঢুকেই তনুর উপর চোখ আটকে যায় ওর। বোকার মত মা, খালাদের সামনে হাঁ করে তনুকে দেখতে থাকে৷ ওর এই অবস্থা দেখে সবাই ওকে শাসন করে ঘরে পাঠিয়ে দিল। বেচারা মন ভরে হবু বউকে দেখতেও পারল না। সাদাফ চলে যাবার সাথে সাথে সবাই হেসে ফেলল। তনুর লজ্জা লাগল না। কষ্টও লাগছে না। যেন অনুভূতি শূন্য হয়ে গেছে ও। শুধু বুকের ভেতর ফাঁকা লাগছে। ইহান জানত না ওরা সবাই তনুকে নিয়ে হলরুমে বসে আছে। সে এমনিতেই নিচে এসেছিল। লাল বেনারসিতে তনুকে দেখে ইহান চোখ সরাতে পারল না। খোঁপা করা চুল। খোঁপাটা আলগা হয়ে গেছে। সামনের দিকের ছোট ছোট চুলগুলো কান ঢেকে রেখেছে। গলায় স্বর্ণের হার। হাতে মোটা মোটা দু’টা বালা।
–‘আমাদের সাদাফের ভাগ্যটা কত ভালো দেখেছ আপা! তনুর মত লাল টুকটুকে একটা পুতুলকে বিয়ে করছে। ওদের দু’জনকে একসাথে খুব মানাবে।’
–‘আমার ছেলের জন্য দোয়া কর তোরা৷ ওদের যেন কারো নজর না লাগে। ছেলে আর ছেলের বউ যেন সারাজীবন সুখে থাকে।’
ইহান নিঃশব্দে চলে যেতে নিচ্ছিল। ও এখানে এসেছে তা কেউ না দেখলেও তনু ঠিকই দেখেছে। ইহান আশেপাশে থাকলে কিভাবেই যেন তনু বুঝে যায়। ইহানের চোখে তার চোখ পড়লে তনু চোখ নামিয়ে নেয়। যাবার সময় সাবিনা ইহানকে দেখে ডাকে।
–‘ইহান, এদিকে আয়। দেখে যা তনুকে কেমন সুন্দর লাগছে! শাড়িতে ওকে আগে কখনও দেখিনি আমি। ভাবতেই পারিনি এই মেয়েকে শাড়িতে এত বড় দেখাবে।’
ইহান মা’র কথা শুনেও না দাঁড়িয়ে চলে গেল। রাশেদা বলল,
–‘লজ্জা পেয়েছে। তনুকে এতদিন এভাবেই দেখত। এখন থেকে ভাবি হবে। তাই সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছে।’
সেজো ফুপু বলল,
–‘আহানটা কবে আসবে? ওর পরই তো ইহানের পালা। আহান এক দু’বছরের মধ্যে না এলে ইহানকেই আগে বিয়ে করিয়ে ফেলব।’
ছোট ফুপু তনুর মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিতে দিতে বলল,
–‘ইহানের জন্যও তনুর মত একটা লাল টুকটুকে পুতুল বউ আনতে হবে। দেখো তো আপা ঘোমটা দিলে তনুকে কেমন লাগে। সুন্দর না?’
–‘হ্যাঁ, ভীষণ সুন্দর লাগছে। ইহান যা নাক উঁচু রে! ওর বউ খুঁজতে খুঁজতে বুড়ি না হয়ে যাই।’
ফুপুদের কথা শুনে তনুর কেনই যেন হঠাৎ করে কান্না পেয়ে গেল। তার চোখ ভরে পানি আসছে। এসব কেন হচ্ছে? এমনটা কি চেয়েছিল ও? সবকিছু কেন এরকম জটিল, গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। রাশেদা ওদের তাড়া দিল।
–‘এবার ওকে ছাড় তো। রাত হয়েছে। ঘুমুতে যেতে দে। তনু তুমি ঘরে গিয়ে শাড়ি খুলে রাখো। পুতুল পুতুল করতে করতে সত্যি সত্যিই ওকে পুতুল বানিয়ে ফেলেছে। যা খুশি তা করে যাচ্ছে।’
তনু ঘরে গিয়েও শাড়ি গহনা খুলল না। আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখতে লাগল। তখন ইহান ভাই তাকে দেখছিল। দু’চোখে একরাশ মুগ্ধতা ফোটে উঠেছিল। তনু আলমারি থেকে ওই দিন ইহানের ঘর থেকে চুরি করে নিয়ে আসা ওর শার্টটা বের করল। নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ শুঁকে বুকের সাথে চেপে ধরল। আর কয়টা দিন। তারপর সে অন্য কারো আমানত। চাইলেও তখন তনু ইহানকে ভাবতে পারবে না।
ইহান ছটফট করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তনুকে বউ সাজে দেখে কিছুতেই সে নিজের মনকে আয়ত্তে রাখতে পারছে না। না। যা হবার হবে। ইহানের এক্ষুনি একবার তনুকে দেখতে হবে। নইলে সে দম আটকে মারা যাবে। ইহান তনুর ঘরের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। না, কী করতে যাচ্ছে সে! ফিরে গেল ইহান। তনু কান্নাকাটি করে ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়ল।
দু’দিন পর সেই দিন এসেই গেল। বাড়িতে মোটামুটি ভালোই আয়োজন চলছে। আজ রাতেই আকদ হবে। ছোট ফুপুর মেয়ে হাফসা তনুর হাতে মেহেদি পরিয়ে দিচ্ছে।
–‘সাদাফ ভাইয়ার নাম বড় করে লিখে দিই, কী বলো? এখন থেকে তো দিনরাত তোমাকে ভাইয়ার নামই জপতে হবে।’
এই সময় ইহান কোথাও যাচ্ছিল। ওরা হলরুমে বসেছে। হাফসা ইহানকে ডাকল,
–‘ভাইয়া এদিকে এসো। যাচ্ছ কোথায়?’
–‘কাছেই৷ কোন কাজ আছে?’
–‘না। এমনিই ডেকেছি। দেখো আমি ভাবিকে কত সুন্দর করে মেহেদি পরিয়ে দিয়েছি।’
ইহান না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল। তনু ছলছল চোখে ইহানের যাওয়ার দিকেই দেখছে।
সব আয়োজন ঠিকই আছে। সন্ধ্যার আগে আগে কাজিও চলে আসবে। ইহান যে সেই বেরিয়েছে এখনও ফিরেনি। সবাই ওকে খুঁজছে। ভাইয়ের বিয়েতে কেউ এরকম করে উধাও হয়ে যায়! দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলে একটা।
ছোট ফুপু বিকেলেই তনুকে সাজিয়ে বসিয়ে রেখেছে। তনুকে আজ যা সুন্দর লাগছে না!
সবার মাঝে তনুর বেহায়া মন একজনকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোথায় ইহান ভাই?
কাজি চলে এসেছে। সাদাফ তনু পাশাপাশি কাজির সামনে বসে আছে। কাজি লেখালেখি করছে।
–‘হ্যালো কে?’
সাবিনার ফোনে কল আসছিল। সে একটু দূরে সরে এসে কল তুলে কথা বলে। নাম্বারটা অচেনা।
–‘হ্যাঁ। আমিই ইহানের মা। আপনি কে বলছেন?’
ওপাশ থেকে কেউ একজন কিছু বলল। সাবিনা কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পর চিৎকার করে উঠল। ওর চিৎকারে সবাই ভয় পেয়ে এদিকে তাকায়। সাবিনা হাত থেকে ফোন ফেলে দরজার দিকে ছুটতে ছুটতে বলতে লাগল,
–‘আমার ইহান! আমার বাবা।’
বাকি সবাই কিছু বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। কী হয়েছে ইহানের?
#সুখের_পাখি
৩৪
ইহানের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। তার বাইককে সামনে থেকে আসা একটা ট্রাক ধাক্কা দিয়ে চলে গেছে। ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে বাইকসহ রাস্তা থেকে ছিটকে নিচে পড়ে ইহান। বাইক চুরমার হয়ে যায়। ইহান সেখানেই জ্ঞান হারায়। লোকজন ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখনও ইহানের জ্ঞান ফিরেনি। মাথায়, হাতে,পায়ে সারা শরীরেই আঘাত পেয়েছে সে। প্রচণ্ড ব্লিডিং হচ্ছে। ওর পকেট থেকে ফোন পেয়ে স্ক্রিনে যে নাম্বারটা দেখে সেটাতেই কল করে যোগাযোগ করা হয়। সাবিনা ইহানের অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে পাগলের মতো ছুটে আসে। তার পেছন পেছন বাড়ির সবাই আসে। ইহানের ফুপুরা কান্নাকাটি করছে। সাবিনাকে সান্ত্বনা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। রাশেদা নিজেও কান্না চেপে সাবিনাকে বললেন,
–‘পাগলের মতো কাঁদছো কেন? আমাদের ইহানের তো কিছু হয়নি। ও ঠিক আছে। দেখো নিও ইহানের কিছু হবে না।’
ছোট ফুপু বলল,
–‘হ্যাঁ ভাবি, ইহানটা তো ছোট থেকেই হিরো। কখনও ব্যথা পেয়ে কেঁদেছে ও? আজও দেখবে ইহান ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবে।’
সেজো ফুপু বললেন,
–‘উল্টো আমাদের কাঁদতে দেখলে ইহান রেখে যাবে।’
কী থেকে কী হয়ে গেল তনু এখনও বুঝতে পারছে না। ইহান ভাই এভাবে তাকে শাস্তি দেওয়ার কথা ভেবেছে! তনু তো ইহানের উপর অভিমান করে, সাদাফ ভাইকে বিয়ে করে সারাজীবনের জন্য ইহানের থেকে দূরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ইহান ভাই তো দুনিয়া থেকে চলে গিয়েই তাকে শাস্তি দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছে। সাদাফ ছুটাছুটি করছে। তনু বিয়ের শাড়িতে কনের সাজে হাসপাতালের করিডরে একটা বেঞ্চে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। চারপাশে কী হচ্ছে তনুর কানে ওসব কিছুই ঢুকছে না। ইহানের অবস্থা এখন কেমন? বাঁচবে তো ও? ডাক্তাররা কী করছে?
–‘আপনি এভাবে আমাকে ছেড়ে যেতে পারেন না। সব সময় আপনিই কেন আমাকে শাস্তি দিবেন? আমি যে কষ্ট পাই তাতে আপনার কিচ্ছু এসে যায় না, তাই না? আপনি বড্ড স্বার্থপর।’
কয়েক ঘন্টা পর ডাক্তাররা জানাল ইহানের উপর থেকে বিপদ কেটে গেছে। তবে এখনও ওর জ্ঞান ফিরেনি। মাথা ফেটে গেছে। তবে গুরুতর কিছু না। হাতে, পায়ে ভালোই ব্যথা পেয়েছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানের ক্ষত ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে। ডান হাতের হাড় ভেঙে গেছে। প্লাস্টার করে দেওয়া হয়েছে। পায়ের হাড় ভাঙেনি। তবে পা নিয়েও কম করে হলেও এক মাসের আগে হাঁটতে চলতে পারবে না।
ইহান যে বেঁচে আছে এতেই ওরা আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করল। ইহানের এরকম খবর জানার পর হাসপাতালে এসে সবাই ভুলেই গেল আজ যে সাদাফ তনুর বিয়ে হবার কথা ছিল। এই মুহূর্তে ওদের বিয়ে নিয়ে কেউ ভাবছে না। এমনকি সাদাফ, তনুও না।
দীর্ঘ তিন চারটা ঘন্টা রুদ্ধশ্বাসে ছুটাছুটি করার পর সাদাফ এসে তনুর থেকে এক হাত দূরত্বে ওর পাশে বসল। মাঝে সময়টুকুতে সাদাফ পাঁচ মিনিটও ভালো ভাবে দাঁড়ায়নি। ইহানটা যে কী করে! ওভাবে বাইক চালাতে কে বলেছিল ওকে? আজ যদি ওর কিছু হয়ে যেত? পরিবারটাই এলোমেলো যেত তাহলে। ওকে যে সবাই কতটা ভালোবাসে তা ইহান কবে বুঝবে?
তনু চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে। সাদাফ তনুকে দেখল। পরনে লাল বেনারসি। মুখে ক্লান্তির ছাপ। চুল এলোমেলো ছন্নছাড়া। চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। সাদাফ ডাকল,
–‘তনু!’
তনু তাকাল। সোজা হয়ে বসে বলল,
–‘ইহান ভাই এখন কেমন আছে?’
–‘ভালো। তবে জ্ঞান ফিরেনি। ডাক্তাররা বলেছে ভয়ের কিছু নেই।’
–‘অহ।’
–‘ইহানটা সারাজীবন এরকম বেখেয়ালি। নিজের প্রতি একটুও গুরুত্ব নেই ওর। আজ এর থেকেও খারাপ কিছু ঘটতে পারত।’
সাদাফ ইহানের উপর বিরক্ত। মূলত ইহানের চিন্তায়ই ও এসব বলছে। ভয় পেয়েছে ও। তনু কিছুই বলল না।
–‘তুমি কি এতক্ষণ এখানেই বসেছিলে?’
–‘হু।’
–‘মামীর কাছে যাও নি? চলো ওদিকে। মা, খালামনিরা সবাই টেনশন করছে।’
–‘হুম।’
তনু উঠতে গিয়ে বুঝতে পারল এখনও হাত পা কাঁপছে ওর। উঠে দাঁড়ানোর মত শক্তি নেই শরীরে। পায়ে এক ফোঁটাও জোর পাচ্ছে না। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে যায় তনুর। সাদাফ ওকে ধরে ফেলে। নইলে পড়েই যেত।
–‘সাবধানে তনু। আস্তে উঠো।’
তনুকে দেখে কেউই কিছু বলল না। মেয়েটা এখনও কনে সাজে আছে। ইহানের এরকম কিছু না হলে এতক্ষণে ওদের বিয়ে হয়ে যেত। যাক ওসব কথা এখন না তুললেই ভালো। ইহানটা হাত পা ভেঙে বসে আছে। এতে তো ওরও হাত নেই। সবাই ভাগ্য। রাশেদা সাদাফকে বলল,
–‘কতক্ষণের মধ্যে ইহানের জ্ঞান ফিরবে? ডাক্তাররা বলেছে কিছু?’
–‘ঘন্টা দু’য়ের লাগতে পারে। বা তার থেকেও কম।’
–‘তুই তাহলে তনুকে নিয়ে এবার বাড়ি চলে যা। তোদের আর এখানে কাজ কী? তনুরও হয়তো কষ্ট হচ্ছে।’
–‘আমি এখন বাড়ি যাব না।’
তনুর সরাসরি বাড়ি যেতে মানা করে দিল। ইহানকে এই অবস্থায় হাসপাতালে রেখে সে কী করে বাড়ি গিয়ে বসে থাকবে?
সাবিনা বলল,
–‘চলে যা মা। ইহান তো এখন ঠিক আছে। ডাক্তার বলেছে ওকে কয়েকদিন হাসপাতালেই থাকতে হবে। এখন বাড়ি নেওয়া যাবে না। আজই তো শেষ না। পরেও আসতে পারবি। কাল সকালে নাহয় একবার এসে দেখে যাস।’
–‘তুমি এখানে থাকবে?’
–‘আমাকে তো থাকতেই হবে।’
–‘তাহলে আমিও তোমার সাথে থাকব।’
–‘দূর পাগলি। হাসপাতালে সবাই থাকতে পারব নাকি? তুই বাচ্চাদের নিয়ে সাদাফের সাথে চলে যা। ইহানের জ্ঞান ফিরলে আপারাও চলে যাবে।’
–‘তুমি একা থাকবে এখানে?’
রাশেদা বলল,
–‘না। আমিও থাকব।’
তনুর ইচ্ছা না থাকলেও সাদাফের সাথে বাড়ি ফিরে আসতে হলো। ওখান থেকে বেরিয়েই তনুর কান্না পেয়ে গেল। সে কেঁদেই ফেলত। সাদাফ তাকেই দেখছে বুঝতে পেরে তনু অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চোখের পানি মুছলো।
ঘরে এসে তনু অনেকক্ষণ বসে রইল। তার কিছুই করতে মন চাচ্ছে না। ইচ্ছে করছে ছুটে ইহান ভাইয়ের কাছে চলে যেতে। ইচ্ছে করলেও সেটা সম্ভব না।
তখন রাত সাড়ে এগারোটা। তেমন রাত না হলেও সাবিনার চোখ লেগে আসছে। আজ সারাদিনের ধকলে শরীর আর সঙ্গ দিতে চাইছে না। সেই সকাল বেলা উঠে কাজে লেগে পড়েছে। সারাটা দিন একটু বসা নেই। এখন ক্লান্তিতে ঘুম এসে যাচ্ছে। সাবিনা ইহানের মাথার কাছে বসে ঝিমুচ্ছিল। তখনই ইহানের জ্ঞান ফিরে। পিটপিট করে চোখ মেলে সে। আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কোথায় আছে সে। কোন অবস্থায় আছে। ইহানের বেশ মনে আছে সামনে থেকে একটা ট্রাক আসছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই। বেঁচে আছে সে? নাকি মৃত্যুর পরে কোন দুনিয়ায় চলে এসেছে! হাত, পা নাড়াতে চাইল ইহান। আল্লাহর দান চার হাত পা-ই আছে? নাকি এক দুইটা কাটা পড়েছে? না, পা সাথেই আছে। নাড়াতে গিয়ে সামান্য ব্যথা অনুভব করল। কিন্তু হাত নাড়াতে পারল না। মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। ইহান মা’কে ডাকল। নিজের কন্ঠ শুনেই বিস্ময় প্রকাশ করল। এটা তার গলা! এরকম চিঁচিঁ করছে কেন? জোরে ডাকতে চাইল ইহান। বুঝতে পারল গলায় এর থেকে বেশি জোর নেই। ভালোই আহত হয়েছে তাহলে।
–‘মা। মা।’
সাবিনার তন্দ্রার মত হলেও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়নি সে। যার কারণে ইহানের মৃদু ডাকেও হুড়মুড়িয়ে জেগে উঠল সে। ইহানকে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে সাবিনা কেঁদে ফেলল। ইহান বুঝতে পারছে মা তাকে নিয়ে ভয় পেয়ে গেছে। হাসল সে। বলল,
–‘আমি কি বেঁচে আছি মা?’
অশ্রুসিক্ত নয়নে সাবিনা হেসে ফেলল,
–‘বেঁচে না থাকলে কথা বলছিস কীভাবে?’
–‘তাহলে এখন আর কাঁদছ কেন? আমার তো কিছু হয়নি৷ যতটুকু দেখলাম হাত পা-ও কাটা পড়েনি।’
সাবিনা এবার ছেলের উপর ক্ষোভে ফেটে পড়ল।
–‘তোকে বাইক নিয়ে বের হতে কে বলেছিল? আমাকে বলে বেরিয়েছিলি তুই?’
–‘তোমার বড় ছেলের বাইক ভেঙে গেছে বলে বকছো আমাকে?’
–‘শুধু কি ভেঙেছিস? একেবারে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলেছিস। আহান ফিরে তার শখের অতি প্রিয় বাইকের এরকম ভাঙ্গারি অবস্থা দেখে তোকে কী করবে আল্লাহই জানে।’
–‘তোমার ছেলেকে বলে দিও আমার টাকায় একদিন আমি ওকে এর থেকেও ভালো বাইক কিনে দেব। ততদিন পর্যন্ত যেন সবুর রাখে।’
–‘কথা তো ভালোই বলতে শিখেছিস। এই অবস্থায়ও পটরপটর করে যাচ্ছিস। ব্যথা লাগছে না তোর?’
–‘লাগছে। তবে সামান্য। হাত নাড়াতে পারছি না কেন মা?’
–‘নাড়াতে পারবি কীভাবে? হাত তো ভেঙে বসে আছিস। এবার গিটার বাজাস ভালো করে।’
–‘পা-ও ভেঙেছে নাকি?’
–‘না৷ হবে এক মাস বেড রেস্ট নিতে হবে। চাইলেও হাঁটতে পারবি না।’
–‘কাম সেরেছে!’
–‘তুই এমন কেন রে ইহান? নিজের একটু খেয়াল রাখবি তো নাকি। আজ তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কীভাবে বাঁচতাম বল তো! আজকের মতো একটা দিনেই তুই এরকম ঘটনা ঘটিয়ে বসলি। তুই কি কোনোদিন বড় হবি না।’
ইহানের মনে পড়ল আজ সাদাফ ভাই আর তনুর বিয়ের দিন ছিল। ওদের বিয়েটা কি হয়ে গেছে? এতক্ষণ ইহান শরীরে তেমন ব্যথা অনুভব করেনি। কিন্তু এখন করছে। অঙ্গে অঙ্গে অসহ্য ব্যথা হচ্ছে। তনু এসেছিল? তার এরকম একটা খবর পাওয়ার পরও কি তনু তাকে দেখতে আসবে না!
সাবিনা বলতেই থাকল,
–‘তোর জন্য ওদের বিয়েটাও হয়নি।’
ইহানের আবার ভালো লাগতে লাগল। ব্যথা ফোঁস হয়ে গেছে। অবাক গলায় সে চট করে বলে বসল,
–‘বিয়ে হয়নি!’
–‘কীভাবে হবে? তোর ওই খবর পাওয়ার পর কারো মাথা ঠিক ছিল? সাদাফই তো সব ছুটাছুটি করেছে। তনুও পুরোটা সময় এখানেই ছিল। একটু আগে ওকে জোর করে বাড়ি পাঠিয়েছি। ও তো যেতেই চাচ্ছিল না। কাল সকালে আসবে। এসে তোকে দেখে যাবে।’
যাক তনু তার উপর রাগ করে থাকেনি। তনুর বিয়েও হয়নি। ইহান চোখ বুজল। সারা শরীরে ব্যান্ডেজ, ব্যথা থাকলেও হালকা লাগছে তার। মনটা ফুরফুরা লাগছে। তনুকে শুধু একবার দেখতে ইচ্ছে করছে। তনু কি তার জন্য কেঁদেছে? ইহানকে এভাবে দেখে কষ্ট হয়নি ওর?
চলবে🌸
#জেরিন_আক্তার_নিপা