সুখের পাখি পর্ব -৩৫+৩৬

#সুখের_পাখি

৩৫
পরের দিন সকাল সকালই তনু ইহানকে দেখতে ফুলি আপার সাথে হাসপাতালে চলে এলো। রাতে একটুও ঘুমোতে পারেনি সে। পুরোটা রাত অস্থিরতা নিয়ে জেগে থেকে কাটিয়েছে। কখনও যদি চোখ লেগে এসেছে তাহলেই ইহানকে নিয়ে বাজে বাজে সব স্বপ্ন দেখে চোখ থেকে ঘুমের সমস্ত রেশ কেটে গেছে। ওসব স্বপ্ন দেখার পর আর ঘুম না আসাই স্বাভাবিক। তনু সাদাফকে নিয়ে আসতে বলেনি। ফুলি যেহেতু কাল রাতে ইহানকে দেখেনি। তাই আজ সকালে তনুকে নিয়ে আসতে রাজি হয়ে গেল। ছোট তিন ফুপু রাতে কখন ফিরেছে তনু জানে না। সকালে আসার সময় সবাই ঘুমিয়ে ছিল। এখানে আসার পর ফুলি আর তনুকে রেখে সাবিনা, রাশেদা বাড়ি গেল। ফ্রেশ হয়ে নিজেরা নাস্তা করে ইহানের জন্যও খাবার নিয়ে আসবে। এখন ফুলি ইহানের জন্য স্যুপ বানিয়ে এনেছে। তনু এসে দেখল ইহান ঘুমিয়ে আছে। হাতে, পায়ে প্লাস্টার। মাথায় ব্যান্ডেজ। মুখের নানা জায়গায় আঘাতের দাগ লাল হয়ে আছে। তনু শব্দ না করে ইহানের পাশে এসে বসল। ইহানের কপালের আঘাতে আলতো করে হাত ছুয়ে দিল। মায়া ভরা দৃষ্টি নিয়ে ইহানের কাটাছেঁড়া মুখের দিকে এক ধ্যানে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল। ফুলি চলে এলে তনুকে উঠে দাঁড়াতে হলো।

–‘ভাইজানের এ কী দশা হলো তনু? আম্মাজান কইল ভাইজান নাকি ভালো আছে। ভালো থাকার এই নমুনা! সারা শরীরে এত ব্যথা নিয়ে ভালো থাকা যায়!’

–‘আস্তে কথা বলো ফুলি আপা। ইহান ভাই এখনও ঘুমাচ্ছে। হয়তো রাতে ঘুমাতে পারেনি। এখন ওকে জাগিও না।’

–‘হুম।’

ইহানের জাগার অপেক্ষায় ওরা বসে থাকল। অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও ইহানের ঘুম না ভাঙায় ফুলি বাইরে বেরিয়ে গেল। তনু বসেই থাকল। মানুষটা একদিন আগে পর্যন্তও সুস্থ ছিল। দিব্যি হাঁটছিল চলছিল। আর আজ কীরকম অসহায় ভাবে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে।
তনু নিজের অজান্তেই ইহানের কপালে হাত রাখল। কপালে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে ইহান নড়ে উঠে। চোখ খুলে সে তনুকে দেখে। তনু অপ্রস্তুত হয়ে হাত সরিয়ে নেয়। ওর কিছু বলা উচিত। নইলে ইহান ভাই তাকে ভুল বুঝবে।

–‘ফুপু আম্মা বাড়ি গেছে। আমাকে রেখে গেছে। আপনার জন্য স্যুপ এনেছি। ফুপু আম্মা বলে গেছে আপনার ঘুম ভাঙলে খাওয়াতে। একটু পরেই ফুপু আম্মা চলে আসবে।’

গড়গড় করে তনু কথাগুলো বলে গেল। ইহান কিছুই বলল না। চুপ করে শুনল। তনু কী বলছে তার ওদিকে ধ্যান নেই। সে তনুকে দেখছে। যেন কত যুগ পর তনু আজ তার সামনে এসেছে। তৃষ্ণার্ত চোখ দু’টো অন্য কোনোকিছু দেখছেই না।

–‘আপনি কি এখন খাবেন? খিদে পেয়েছে?’

ইহান মাথা নাড়ল। তার তনুকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, তনু আমার অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে তোমার কেমন লেগেছিল? ভয় পেয়েছিলে? কষ্ট হয়েছিল?

–‘মুখ না ধুয়ে কীভাবে খাব তনু?’

ইহান স্বাভাবিক ভাবে তনুর সাথে কথা বলছে। ঠিকই তো। তনু একবার ওয়াশরুমের দিকে দেখল। পরক্ষণে ইহানের পায়ের দিকে দেখল।

–‘হাঁটতে পারবেন আপনি? পায়ে কি বেশি ব্যথা পেয়েছেন?’

–‘ভাঙেনি।’

তনু সংকোচে কুঁচকে গিয়ে ইহানকে উঠে বসতে সাহায্য করল। এপর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু ইহানকে উঠে দাঁড় করাবে কীভাবে সে? ইহান তার থেকেও দ্বিগুণ বড়সড় একজন মানুষ।

–‘কী হলো? আমাকে দাঁড়াতে সাহায্য করো। একা একা তো আমি ওয়াশরুম পর্যন্ত যেতে পারব না।’

–‘ফুলি আপাও এসেছে ইহান ভাই। আমি ফুলি আপাকে ডেকে নিয়ে আসি?’

–‘ফুলিকে ডেকে আনার অপেক্ষায় আমি খিদে পেটে না খেয়ে বসে থাকব নাকি? তুমি একটু হাতটা ধরলেই আমি দাঁড়াতে পারব। পা তো ভাঙেনি। আমাকে তোমার কোলে তুলে নিতে হবে না। এক পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে পারব।’

তনু ইতস্তত ভাব কাটিয়ে ইহানের হাত ধরে ওকে দাঁড় করিয়ে দিল। ইহান ভেবেছিল হালকা ব্যথা পেয়েছে হয়তো। কিন্তু দাঁড়াতে গিয়ে বুঝল ব্যথা ভালোই পেয়েছে। পায়ের হাড় না ভাঙলেও হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। পড়ে যেতে নিচ্ছিল ইহান। তনুর কাঁধ ধরে সামলে নিল। ওর ডান হাত গলার সাথে ঝুলানো। ওটা নড়ানো যাচ্ছে না। বাঁ হাতে তনুর কাঁধে ভর দিয়ে ওয়াশরুম পর্যন্ত গেল। তনু দরজার সামনে দাঁড়াল। ইহান ভেতরে গেল। একটু পরেই তনুকে ডাকল,

–‘তনু! ডান হাত তো ব্যবহার করতে পারছি না। মুখে পানি দেব কীভাবে? একটু ভেতরে আসবে?’

এখানে এসে এ কোন জ্বালায় পড়ল তনু! ফুলি আপাটা কোথায় গেল কে জানে? ও এলে এরকম পরিস্থিতি তৈরি হতো না। মানুষটা অসুস্থ। সাহায্য চাইছে। তনু না-ও করতে পারছে না। আবার সাহায্যও করতে পারছে না। ইহান আবার চেঁচিয়ে বলল,

–‘তনু, আরেকটু হেল্প করো না প্লিজ।’

–‘ফুলি আপা, কাজের সময় কোথায় থাকো তুমি! এত রাগ লাগছে তোমার সাথে। কেন এসেছিলে তুমি হ্যাঁ? এই তোমার ভাইজানের প্রতি দরদ! তাড়াতাড়ি আসো না প্লিজ।’

বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলে আল্লাহর নাম নিয়ে তনু ওয়াশরুমের ভেতরে ঢুকে পড়ল। ইহানের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,

–‘কী করব আমি?’

ইহান কুলি করে মুখে পানি দিয়ে তনুর কাঁধে ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেডে এসে বসল।

–‘প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে তনু। কী এনেছে তাড়াতাড়ি দাও। রাতেও কিছু খাওয়া হয়নি। ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল হতচ্ছাড়া ডাক্তারটা।’

তনু হটপট থেকে বাটিতে স্যুপ ঢেলে নিল। গরম স্যুপ থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে। ইহান নিজের ডান হাতের দিকে ইশারা করে বলল,

–‘আমার হাতের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছো। দয়া করে আমাকে নিজের হাতে খেতে বলো না।’

কথাটা শুনে তনুর চোখ কপালে উঠে গেল। সে খাইয়ে দিবে নাকি তাহলে? ইহান ভাই কি মাথায়ও কোন চোট পেয়েছে! আগে তো উনি একরকম ছিল না। কালকের অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে এরকম হয়ে গেছে নাকি? তনুর সাথে এভাবে কীভাবে কথা বলছে! যেন তনু ওর খুব আপন কেউ। গার্লফ্রেন্ডের মত ব্যবহার করছে তার সাথে। নিজের বউ মনে করে হুকুম করে যাচ্ছে। তখন থেকে তনু চুপ করে ইহানের সব কথা শুনেছে। শুধু এইজন্য যে মানুষটা অসুস্থ।

–‘আমি আপনাকে খাইয়ে দিব নাকি!’

–‘দিলে সমস্যা কি?’

বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে তনু। চোখ বড় বড় করে বলল,

–‘আমি খাইয়ে দেব!’

–‘তোমার হাতে খেতে আমার তো কোন অসুবিধা নেই। অবশ্য আমাকে খাইয়ে দিতে তোমার যদি কোন সমস্যা থেকে না থাকে।’

–‘আপনি আমার হাতে খাবেন? মাথা ঠিক আছে আপনার?’

–‘মাথায় তো তেমন আঘাত পাইনি। কপালে সামান্য কেটে গেছে।’

–‘আমার তো মনে হচ্ছে আপনি মাথায়ও সাঙ্ঘাতিক আঘাত পেয়েছেন। যা ডাক্তাররা ধরতে পারছে না। নইলে আপনার কথাবার্তা এরকম এলোমেলো হয়ে গেছে কেন। আমার তো এটাও মনে হচ্ছে আপনি কী বলছেন তা আপনি নিজেও বুঝতে পারছেন না।’

–‘এসব কথা কি পরে বলা যাবে না? আমার সত্যি সত্যিই ভীষণ খিদে পেয়েছে। ডান হাত নাড়াতেই পারছি না। তুমি একটু খাইয়ে দিলে তোমার তো কোন ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে না। বরং একজন রোগীকে সেবা করার সোয়াবটুকু পাচ্ছ।’

এই ছেলে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তাই এরকম আচরণ করছে। তনু উপায় না পেয়ে চামচে নিয়ে সামান্য একটু স্যুপ ইহানের মুখের সামনে ধরল। ইহান তনুকে রাগতে দেখে মনে মনে হাসছে। তনুর রাগ এখনও পুরোপুরি কমেনি। ঠোঁটের কোণা কেটে গিয়েছিল। ব্যথা পেয়ে ককিয়ে উঠল ইহান।

–‘আস্তে তনু। রোগী মানুষটাকে আর কষ্ট দিও না। এমনিতেই পুরো শরীরে ব্যান্ডেজ।’

তারপর সাবধানে তনু ইহানকে সবটুকু স্যুপ খাইয়ে দিল। খাওয়া শেষ হয়ে গেল ফুলি এসে হাজির হয়েছে। মনে মনে তনু ফুলিকে একচোট বকে নিল। ফুলিকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে তনু। সে তাড়াহুড়ো করে সব গুছিয়ে নিল। ইহান তনুর ওড়নার একপাশ দিয়ে মুখে লেগে থাকা খাবারের অবশেষে অংশটুকু মুছে নিল। ইহানের এই কাজে তনু হতবাক হয়ে গেল। এক ঝটকায় ওড়না টেনে নিয়ে প্রায় চেঁচিয়েই বলল,

–‘কী করছেন আপনি ইহান ভাই!’

যেন কিছুই করেনি সে। এটা আর পাঁচটা ঘটনার মতই স্বাভাবিক একটা কাজ। মৃদু হেসে ইহান বলল,

–‘মুখে লেগেছিল। আশেপাশে রুমাল টুমাল বা পরিষ্কার কোন কাপড় দেখতে পাচ্ছিলাম না। তাই তোমার ওড়না… ফুলি তুই-ই বল, আমি কি খারাপ কিছু করেছি? আমি এমনিতেই অসুস্থ। রোগ জীবানুর একটা ব্যাপার স্যাপার আছে তো নাকি। যদি ইনফেকশন হয়ে যায় তখন!’

তনু কটমট করে ইহানের দিকে চেয়ে রইল। ফুলি বরাবরের মতো তার ভাইজানের হয়েই কথা বলছে। তনু ইহানকে একদমই বুঝতে পারছে না। ইহানকে তার কাছে অচেনা মনে হচ্ছে। ইহান ভাই তো আগে এরকম ছিল না। ইহানের এসব কাজে তনু যারপরনাই অবাক হচ্ছে। ইহান ভাই কি ইচ্ছে করে তাকে জ্বালানোর জন্য এসব করছে! শয়তান মরে গেলেও শয়তানি ছাড়ে না। হাড় বজ্জাত মানুষ। শয়তানের নানা শ্বশুর। এর রগে রগে, পেটে পেটে, শিরা উপশিরায় শয়তানি। তনু আজ এখানে এসে ভুলই করেছে। বেশি দরদ দেখিয়ে ফেলেছিল।
মনে মনে তনু নিজের উপরই ক্ষোভে ফেটে পড়ল।

–‘অনেক পিরিত তোর। কার জন্য এসেছিস তুই? কাকে দেখতে এসেছিস এখানে? কে রোগী? এই শয়তানকে কোন দিক দিয়ে রোগী মনে হয়? হাত পা ভেঙেও বদমায়েশি কমেনি। আমাকে নিজের চাকর পেয়েছে। এতদিন এক ভাবে আমাকে কষ্ট দিয়েছে। যখন দেখছে আমি তাকে ভুলে যাচ্ছি। এখন আবার নতুন ভাবে আমাকে জ্বালানোর পথ বের করে ফেলেছে।’

এই শেষ। এরপর যদি ইহান সারা বছরও হাসপাতালে থাকে তবুও তনু ওকে দেখতে আসবে না। একদিনেই অনেক শিক্ষা হয়েছে। বদ মানুষ বদই থাকে। ইহান তনুর মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। তনুর বিয়ে আটকানোর জন্যই বাড়ি ফিরছিল সে। অ্যাক্সিডেন্ট করার পরেও যেটুকু জ্ঞান ছিল তখনও এটাই ভাবছিল সে, বেঁচে থাকলে তনুকে অন্য কারো হতে দিবে না।
#সুখের_পাখি

৩৬
চারদিন পর ইহানকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হলো। চার দিনেই ইহান হাঁপিয়ে উঠেছে। ডাক্তাররা যথেষ্ট বিরক্ত করেছে তাকে। এটা খাওয়া যাবে না। ওটা করা যাবে না। উঁহু, হাঁটাচলা তো একদমই নিষেধ। রুটিন মেনে চলতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে হবে। ঘুম না হলেই এরা ইনজেকশন লাগিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। ইহান মা’র হাতে পায়ে ধরে ডাক্তারদের মানাতে বলেছে।

–‘তুমি কি চাও তোমার দুই ছেলে থেকে এক ছেলে হয়ে যাক?’

–‘ইন্না-লিল্লাহ! এসব কেমন কথা! এটা কেন চাইব আমি?’

–‘তাহলে আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও। এখানে থাকলে আমি মরে যাব মা। ডাক্তারগুলা আমাকে পাগল করে ছাড়বে।’

–‘অ্যাক্সিডেন্ট করার সময় মনে ছিল না। এখন ভোগ একটু।’

–‘অনেক ভুগেছি মা। তুমি আমাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। তারপর তুমি যা বলবে সব শুনব।’

–‘সত্যি তো?’

–‘হুম। একদম সত্যি। এই দেখো মাথায় হাত রেখে বলছি।’

সাবিনা ইহানের ছেলেমানুষি দেখে হাসতে হাসতে বলল,

–‘আচ্ছা দেখছি।’

–‘দেখছি না মা। আজই আমি বাড়ি যাব। রাতে সবার সাথে বসে খাব।’

তনু ওইদিন যাওয়ার পর একবারও ইহানকে দেখতে আসেনি। ফুলি এসেছে কয়েকবার। ইহান ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ফুলির থেকে তনুর কথা জেনেছে। তনু বাড়িতেই আছে। ইহানকে নিয়ে চিন্তাও করছে। তবুও কেন ইহানকে দেখতে আসছে না তা ফুলি বুঝতে পারছে না। ইহান তনুর উপর চটে আছে। একবার শুধু বাড়ি যেয়ে নিক সে। তারপর তনুকে এর শাস্তি দিবে। অ্যাক্সিডেন্টটা তো তনুর জন্যই হয়েছে। ওরই তো দায়ী। ওর কথা ভাবতে ভাবতে বাইক চালাচ্ছিল বলেই তো ট্রাকটাকে দেখতে পায়নি। ওর এত বড় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হলো৷ মরতে মরতে বাঁচল ইহান। অথচ তনুর কোন মাথা ব্যথাই নেই তাকে নিয়ে! ভালোবাসি ভালোবাসি বলে তো অনেক লাফালাফি করতো।

–‘এটাই তোমার ভালোবাসা তনু! একবার না কী করে দিয়েছি তুমি রাগ করে সাদাফ ভাইকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলে। তুমি আমার ভাবি হয়ে গেলে আমার কী হবে সেটা একবারও ভাবোনি। তোমাকে তো আমি এত সহজে ছাড়ব না। এত রাগ কোত্থেকে আসে দেখে নেব আমি। একবার শুধু বাড়ি ফিরি।’

ইহান বাড়ি ফিরে এসেছে। যেন দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে। ওকে পেয়ে এতটাই খুশি হলো সবাই। চার ফুপুই ওকে ধরে একচোট কান্নাকাটি করে নিল। কেউ ওকে ছাড়তেই চাচ্ছিল না। শেষে হাতে ব্যথা পেয়ে ককিয়ে উঠলে রাশেদা সবাইকে ধমক দিয়ে বলল,

–‘হয়েছে, হয়েছে। ইহান বাড়ি ফিরে এসেছে। এখন ও আমাদের চোখের সামনেই থাকবে। তোরা ওকে ছাড় তো এখন। ছেলেটাকে ঘরে যেতে দে। বাবা তুই ঘরে গিয়ে রেস্ট নে। হাত পা বেশি নড়াচড়া করিস না কেমন?’

–‘হুম।’

ইহান চোখ ঘুরিয়ে একবার চারপাশটা খুঁজে নিল। তনুকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তার ফেরার খবর কি তনু এখনও পায়নি? পেলে অবশ্যই ছুটে আসত। ফুপুরা ওকে ঘরে দিয়ে এলো। চারদিন পর নিজের ঘরে এসে ইহানেরও ভালো লাগছে। নিজেকে হালকা লাগছে। হাসপাতালে মানুষ থাকে নাকি! কী থাকার ব্যবস্থা! আর কী খাওয়া! পুরো রোগী বানিয়ে রেখেছিল ওরা। রোগীকে সারাক্ষণ রোগী রোগী ফিল করালে তার রোগ সারতে ঠেকা পড়েছে তো!
ইহানের এখনও হাঁটাচলা নিষেধ। ডান হাতটা দিয়ে তো ইচ্ছে করলেও কিছুই করতে পারছে না। নাড়ালেই বরং ব্যথা লাগে।
ঔষধের প্রতিক্রিয়ায় হোক। বা পরপর কয়েক রাত অঘুমে থাকার কারণেই হোক। বাড়ি ফেরার পর আজকের পুরোটা বিকেল ঘুমিয়ে কাটাল ইহান। ওর ঘুমিয়ে থাকার এই ফাঁকে তনু এসে ওকে দেখে গেছে। ফুলির থেকে তনু যখন শুনেছে ইহান ভাইকে বাড়ি নিয়ে আসা হয়েছে, সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছে সে। এসে দেখে ইহান ঘুমিয়ে আছে। যাক ভালোই হয়েছে। এই সুযোগে ইহানকে তার দেখা হবে। কিন্তু ইহান তাকে দেখবে না।
ওর বাঁ পা-টা একটা বালিশের উপর রাখা। ডান হাতটা বুকের উপর আলগোছে পড়ে আছে। কেমন আদুরে ভঙ্গিতে বাচ্চাদের মতো ঘুমোচ্ছে ইহান। তনুর দেখেই মায়া লাগল। আহা বেচারা! হাত পা ভেঙে কষ্টেই আছে।

–‘আপনার উপর কেন আমি রাগ করে থাকতে পারি না বলুন তো? আপনি কতবার আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তবুও আমি বেহায়া হয়ে আপনার কাছে ছুটে আসি। আমাকে এত কষ্ট দেওয়ার পরেও আমার বেহায়া মন আপনার জন্য কাঁদে। আপনার অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে আমার কী অবস্থা হয়েছিল জানেন আপনি? সেদিন আপনার কিছু হলে আমিও মনে হয় মরে যেতাম। বাবাকে হারানোর পর ওরকম ভয়, ওরকম আতঙ্ক, ওরকম কষ্ট আমি আপনার জন্য পেয়েছি। এখনও তো আপনাকে দেখার লোভ সামলাতে না পেরে ছুটে এলাম। আপনি পাষাণ দিব্যি আছেন।’

তনু সাবধানে ইহানের মাথার ব্যান্ডেজে হাত বুলিয়ে দিল।

–‘আপনার কপাল আমার কাছে কত সুন্দর লাগত। এই কপালেই ব্যথা পেয়ে বসে আছেন। আমার এখন কী ইচ্ছে করছে জানেন? ইচ্ছে করছে কপালের ওই ক্ষতটায় গাঢ় করে একটা চুমু খাই। দিনদিন আমার সাহস বেড়ে যাচ্ছে ইহান ভাই। আপনাকে নিয়ে আমি যা-তা ভেবে ফেলি। মনকে শাসন করেও আটকে রাখতে পারি না।’

তনু ইহানের হাতটা ধরল। ইশশ! এই হাতের নাকি হাড় ভেঙে গেছে। হতাশ গলায় তনু বলল,

–‘না জানি এটা জোড়া লাগবে কিনা কে জানে। হাত ঠিক না থাকলে আপনি আমাকে কোলে নিবেন কীভাবে? না, আমাকে কেন নিবেন? নিজের বউকে তো নিবেন। হ্যাঁ, যাকেই নিন হাত ভালো না থাকলে কীভাবে হবে! পায়েও আঘাত পেয়েছেন। এতগুলো দিন গেল এখনও হাঁটতে পারেন না। আবার কবে আগের মত সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে হাঁটবেন আপনি? আপনাকে এরকম সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকতে দেখতে আমার ভালো লাগছে না। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন তো।’

তনু ইহানের পাশে বসে ওর ঘুমন্ত মুখটা মায়া নিয়ে দেখছে। এই মুখ যতই দেখে সাধ মিটে না।

–‘হাত পা না ঠিক হলে একদিক দিয়ে আমারই ভালো। কোন মেয়ে আর আপনাকে বিয়ে করবে না। তখন আপনি আমাকে না করবেন কীভাবে? অন্য মেয়েরা পাত্তা না দিলে ঘুরেফিরে আমার কাছেই আসতে হবে।’

সাবিনার ডাক কানে এলে তনু ঝটপট উঠে দাঁড়াল। ইহানের দিকে একটু ঝুঁকে এসে বলল,

–‘শাশুড়ি মা ডাকছে। আমি যাই৷ আপনি ঘুমিয়ে থাকলে রাতে আবার আসব৷ জেগে থাকলে আসব না। আমি আর আপনার সামনে পড়তে চাই না। মাথায় চোট পেয়ে আপনার মাথায় গণ্ডগোল হয়ে গেছে। কেমন আজব ব্যবহার করেন। আর শুনুন, বিয়েটা আমি করব না। আপনি যখন হাসপাতালে ছিলেন,ভেতরে আপনার চিকিৎসা হচ্ছিল। আমি বাইরে একা বসে কাঁদছিলাম। তখনই ঠিক করে নিয়েছি সাদাফ ভাইকে আমি বিয়ে করব না। বিয়ে যদি কোনোদিন করি তাহলে আপনাকেই করব। রাগের মাথায় রাজি হয়ে গেলেও হাসপাতালের করিডরে বসে ফেলা আমার চোখের প্রতিটা অশ্রুকণা জানে আমি আপনাকে কতটা ভালোবাসি। সেদিন আপনাকে হারানোর ভয় আমাকে নতুন করে উপলব্ধি করিয়েছে আমি শুধু আপনারই। অন্য কারো না। কিন্তু এসব কথা আমি কখনও আপনাকে বলব না। সারাজীবন মনে মনেই রেখে দেব। আপনার চোখে আমি যথেষ্ট ছোট হয়েছি। আমার একটা আত্মসম্মান আছে ইহান ভাই। আপনাকে ভালোবেসে সেটাও খুইয়েছি।’

চোখ মুছতে মুছতে তনু বেরিয়ে গেল। ইহান চোখ খুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সিলিঙের দিকে চেয়ে রইল সে। তনুর ভালোর জন্য ওর সাথে কঠিন আচরণ করতে করতে নিজের অজান্তে সে তনুকে কতটা কষ্ট দিয়েছে তা আজ বুঝতে পারছে। সে শুধু তার দিকটা ভেবেছে। তার থেকে প্রতিনিয়ত বাজে ব্যবহার পেয়ে তনুর কেমন লাগছে সেটা জানার প্রয়োজন মনে করেনি।

–‘অনেক হয়েছে। তোমাকে কাছে টেনে নিলে যদি তোমার পড়াশোনা না হয়, তাহলে না হবে। আমার বউয়ের চাকরি বাকরি করার কোন দরকার নেই। ওরকম একটা বউকে আমি খাওয়াতে পরাতে পারব। আর কোন কষ্ট দেব তোমাকে তনু। আমার আগের ভুলগুলোর জন্যে আমাকে ক্ষমা করে দিও তুমি।’

রাশেদা সাবিনার সাথে কথা বলছে,

–‘ইহান যতদিন ঠিক না হয় ততদিন আর বিয়ের নামও মুখে আনতে হবে না। ছেলেটা মরতে মরতে বেঁচে এসেছে। ওর এরকম অবস্থায় বাড়িতে বিয়ে না ছাই হবে।’

–‘ইহান তো এখন সুস্থই আপা।’

রাশেদা রেগে উঠলেন,

–‘কচু জানো তুমি। সুস্থ হলে ছেলেটা আসার পর থেকে ঘুমায়! আমি তিনবার গিয়ে দেখে এসেছি। ইহান কখনও দিনের বেলা এত সময় ঘুমাতো না। হাত পা নাড়াতে পারে না এটা নাকি আবার সুস্থ। আমার সাদাফ আর আহান ইহানের মাঝে কোন পার্থক্য আছে আমার? সাদাফ হাত পা ভেঙে বসে থাকলে তুমি যদি তোমার ছেলেদের বিয়ে করাতে তাহলে সারাজীবনেও তোমার ছেলের বউয়ের মুখ দেখতাম না আমি।’

সাবিনা হাসে। ওর দুই ছেলেকে ওর থেকেও বেশি যদি কেউ ভালোবেসে থাকে তাহলে তারা হলো ওদের চার ফুপু। ভাই বলতে যেমন ওরা জীবন দেয়। তেমনই ভাইয়ের ছেলেদের বেলায়ও। সাবিনা ভাগ্য করে এরকম শ্বশুরবাড়ি আর ননদ, ননাস পেয়েছে। এসব যত ভালোই হোক, স্বামীর ভালোবাসা কি অন্যরা পূরণ করে দিতে পারবে? উনার সুখের সংসারে কোনোকিছুরই অভাব নেই। কিন্তু ওদের বাবা বছরে ক’মাস বাড়ি থাকে?

খুঁড়িয়ে হাঁটতে ইহানের কষ্ট হয়। তাই সে আপাতত হুইলচেয়ার ব্যবহার করছে। ডান হাত অচল। এক হাতে হুইলচেয়ারও চালানো যায় না।

–‘ভালো জাতাঁকলে পড়লাম তো আমি। আল্লাহ আমাকে কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছ! শেষমেশ আমি কিনা ল্যাংড়া হয়ে গেলাম!’

তনু এদিক দিয়েই যাচ্ছিল। ইহান ওকে দেখে ডাকল।
তনুকে দেখে মনে হয় কলেজ থেকে মাত্র ফিরেছে ও। এখনও ব্যাগ কাঁধে।

–‘তনু! এদিকে এসো।’

ইহান ভাই ডাকছে! তনু না গিয়েও পারল না। ইহানের কাছে এসে বলল,

–‘কী হয়েছে? ডাকছেন কেন?’

–‘কলেজ থেকে ফিরেছ?’

তনু একবার নিজের দিলে দেখল। কলেজ ড্রেস পরনে। পরেও এই কথা জিজ্ঞেস করছে। কানা নাকি মজা নিচ্ছে? তনুও হেসে বলল,

–‘না তো৷ শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরেছি।’

চলবে🌸
#জেরিন_আক্তার_নিপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here