সুখের পাখি পর্ব -৩৯+৪০

#সুখের_পাখি

৩৯
এই কাণ্ডের পর তনু ভুলেও ইহানের সামনে পড়তে রাজি না। ভাগ্য ভালো ইহান ভাই হাঁটতে পারছে না। নইলে এতক্ষণে তার ঘরে চলে আসতো। এসে তনুর নিজের নামই ভুলিয়ে দিত। তনুর খুশি লাগছে আবার ভয়ও হচ্ছে। একটু বেশিই করে ফেলেছে না তো সে! না,না৷ বেশি কই করেছে? ইহান ভাই নিজেই তো তার বন্ধুদের সম্পর্কে ওসব কথা বলেছে। তনু জানত নাকি ওর বন্ধুদের চরিত্রে সমস্যা আছে। আর কই সমস্যা? ওর সাথে তো ভালো করেই কথা বলেছে।

–‘উচিত শিক্ষা দিয়েছি আপনাকে। আরও আমাকে জ্বালাবেন?’

–‘তনু! ও তনু।’

–‘বলো ফুলি আপা।’

দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল ফুলি। তনু শোয়া থেকে উঠে বসে ওড়না গায়ে দিল।

–‘ভাইজান তোমারে ডাকে।’

–‘আমি এখন পড়তে বসবো।’

–‘ভাইজানের নাকি অনেক জরুরি কথা আছে তোমার লগে।’

–‘আমারও অনেক পড়া বাকি আছে।’

–‘কথাটা শুইনা আইসা পড়ো।’

–‘যে কঠিন পড়া গো ফুলি আপা। সারা রাতেও শিখতে পারব কিনা জানি না। এখন গেলেই সময় নষ্ট হবে। তুমি যাও তো। আমাকে ডিস্টার্ব করো না। আমি এখন পড়বো।’

ফুলি তনুর কথায় কিছুটা বিরক্ত হলো। ভাইজান বলেছে যেভাবে হোক তনুকে ভাইজানের ঘরে পাঠাতে। তনু পড়ার বাহানা দিয়ে যেতে চাচ্ছে না।
তনু দেখল ফুলি আপা কিছু ভাবছে।

–‘কী হলো? এখনও দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও, আমি পড়ব।’

–‘হু, তোমার যে কত পড়া! এই পড়ালেখা না করে বড় বাঁচা বেঁচে গেছি।’

ফুলি চলে গেলে তনু বুক ভরে দম নিল। ইহান ভাই নিজে আসতে না পারলেও ফুলি আপাকে ঠিকই পাঠিয়ে দিয়েছে।

–‘না বাবা না। আমি এই কয়দিন আর ইহান ভাইয়ের সামনেই পড়ব না।’

–‘ভাইজান, তনু পড়তাছে। এখন আসতে পারব না। ওর নাকি অনেক পড়া বাকি৷ না পারলে স্যার ক্লাসে কান ধরে দাঁড় করাই রাখব।’

ফুলি এসে ইহানকে বললে ইহান রাগে ফোঁসে উঠে।

–‘আমাকে ও পড়া দেখাচ্ছে! কবেকার পড়ুয়া হয়েছে ও? অংকে বত্রিশ পাওয়া মেয়ে আমাকে পড়া শিখাচ্ছে! আরে আমিই তো ওকে পড়াশোনার ব্যাপারে সিরিয়াস করে তুলেছি। নইলে এতদিনে ওর পড়া লাটে উঠত।’

ফুলি ভাইজানের অকারণ রাগ বুঝতে পারছে না। ইহান নিজে নিজেই বলছে,

–‘আসবে না তো ও! আচ্ছা ঠিক আছে। আসতে হবে না। ওকে তো আমি ছাড়ব না। একবার হাতের কাছে পেয়ে নিই। আমার বন্ধুদের সামনে আমার ইজ্জতের তেরোটা বাজিয়েছে। ওর জন্যই এখন গাধা গুলো জানে আমি ওকে ভালোবাসি।’

–‘ভাইজান আমি যাই?’

–‘না, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আমার চেহারা দেখ। যা বলছি। অনুমতি নিচ্ছিস কেন হ্যাঁ?’

ফুলি দৌড়ের আগে চলে গেল।

–‘কী ভেবেছ তুমি? ঘরে বসে থাকলে আমার হাত থেকে বেঁচে যাবে তুমি? কখনও আমার সামনে পড়বে না? দেখি না কতদিন তুমি ঘরে বসে কাটাতে পারো।’

রাতে তনু নিশ্চিন্ত মনে খাবার টেবিলে গেল। কারণ ইহান ভাই ডাইনিংয়ে খেতে আসে না। ঘরে বসেই খায় সে। তনু মাত্র ভাত মুখে নিচ্ছিল সামনে থেকে ইহানকে আসতে দেখে হাত থেকে ভাত প্লেটে পড়ে গেল। রাশেদা ইহানকে নিয়ে আসছে। ইহান ইচ্ছে করেই তনুর পাশের চেয়ারটাতে বসলো। তনু পাথরের মতো জমে গেল। সবার সামনে ইহান ভাই কিছু করবে না তাকে। এটা ভেবেও স্বস্তি পেল।
সাবিনা বলল,

–‘ওকে আবার এখানে আনতে গেলেন কেন আপা’

–‘ছেলেটা ঘরে বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছে। কতদিন একা খাওয়া যায়! সবার সাথে বসে গল্প করে খাওয়ার মজাই আলাদা। আমাকে ডেকে বলল, ফুপ্পি আমি আজ তোমাদের সাথে খাব।’

ছোট ফুপু বলল,

–‘ইহান তো নিজে খেতে পারবে না। ওকে খাইয়ে দিতে হবে। আমি তোকে খাইয়ে দেই ইহান?’

রাশেদা ধমক মারল।

–‘তুই তো নিজেই এখনও ভালো করে খেতে পারিস না। ইহানকে আমি খাইয়ে দিব।’

তনু চুপচাপ এসব দেখছে। ইহান ভাই তো আগে থেকেই সবার চোখের মণি ছিল। হাত পা ভেঙে এখন আরও আদর পাচ্ছে। হঠাৎ হাতে কারো স্পর্শ পেয়ে তনু চমকে গেল। টেবিলের নিচে দিয়ে কেউ তার হাত ধরেছে বুঝতে পেরে ঝট করে হাতটা কার দেখার জন্য তাকাল তনু। যা দেখল তাতে ওর দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। ইহান ভাই! ইহান ভাই তার হাত চেপে ধরেছে। কয়েক মুহূর্ত কিছুই বুঝতে পারল না তনু। তার হাত পা অবশ হয়ে আসছে। ভয়ে ভয়ে ইহানের দিকে দেখল ও। ইহান তার দিকে দেখছেই না। খুব স্বাভাবিক ভাবে সে ফুপুর হাত থেকে খেয়ে যাচ্ছে। যেন আশেপাশে কিছুই ঘটছে না। তনু হাত ছাড়ানোর জন্য টান দিলে ইহান আরও শক্ত করে ধরল। তনু ছটফট করা শুরু করলে ইহান তার পুরো হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিল। তনু শান্ত হয়ে গেল।

–‘তনু, তুমি খাচ্ছ না কেন?’

মেজো ফুপুর কথার জবাবে জোর করে হাসল তনু। মুখ দিয়ে কোন কথাই বের করতে পারল না।
সেজো ফুপু সাদাফ, তনুর বিয়ের কথা তুলে বলল।

–‘ইহান তো এখন অনেকটাই সুস্থ। আর কয়টা দিন দেখে তারপর ওদের বিয়েটা করিয়ে ফেললে ভালো হয় না?’

ছোট ফুপু সায় দিয়ে বলল,

–‘হুম। আমিও এই কথাই বলতে চাচ্ছিলাম আপা। এবার ওদের বিয়েটা হয়ে যাক। অনেক দিন হলো এসেছি। আমার মেয়েদের স্কুল মিস যাচ্ছে।’

–‘আমার মেয়েটার পরীক্ষা চলছে। তবুও আমি এসেছি। ভেবেছিলাম কয়েকদিন থেকে চলে যাব। কিন্তু ইহানটা…

ফুপুদের কথা শুনে ইহানের রাগ বাড়ছে। ওদিকে তনুর হাতে চাপ পড়ছে। এবার তনু হাতে ব্যথা অনুভব করছে। চোখে পানি এসে গেছে তার। ইহান ভাই কি বুঝতে পারছে না সে ব্যথা পাচ্ছে?

–‘সাদাফের ছুটিরও তো বেশিদিন নেই। আমার মনে হয় তিন চার দিনের মধ্যে বিয়েটা হয়ে গেলে সবার জন্যই ভালো হয়।’

তনু আর সহ্য করতে পারল না। ওর মুখ থেকে কাতর একটা ধ্বনি বেরিয়ে এলো। ইহান সেটা শুনে সাথে সাথে তনুর হাত ছেড়ে দিল। সবাই তনুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

–‘কিছু বলেছ তনু?’

তনু কান্না চাপা গলায় বলল,

–‘না।’

তনুর চোখের কোণে পানি ইহানের চোখ এড়াল না। সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হলো। নিশ্চয় ব্যথা পেয়েছে তনু। নইলে এত সহজে চোখে পানি আসতো না।
ঘরে গিয়ে ইহান ভাবল, আর লুকোচুরি না। তনুর সামনে সে স্বীকার করবে, সে-ও তনুকে ভালোবাসে। তনুর ভালোবাসা, ওকে পাওয়ার আকুলতা, তনুর পাগলামি যে কখন ইহানের মন গলিয়ে দিয়েছে তা ইহান বুঝতে পারেনি। তনুকে সে ভালোবাসে। সাদাফ ভাইকে তনু বিয়ে করতে পারবে না।
তনু ঘরে গিয়েই গালাগালি করে ইহানের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে। হাত ডলতে ডলতে বলে যাচ্ছে,

–‘শালা বদ। হারামি৷ লুচ্চা। মিচকা শয়তান। বুইড়া শয়তান। ল্যাংড়া শয়তান। কত শক্ত করে হাত ধরলো। আমার হাত ভেঙে ফেলতে চাইছিল। ভেঙেই ফেলেছে মনে হয়। আল্লাহ তোকে এর শাস্তি দিবে। দেখে নিস তুই। আমার দোয়া লাগবে। কালো কুচকুচে বউ জুটবে তোর কপালে।’

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফোন হাতে নিয়ে তনু ইহানের টেক্সট দেখল। ইহান ছোট করে একটা শব্দই লিখেছে। ‘সরি’। তনুর নিভে যাওয়া রাগটা আবার টগবগিয়ে উঠল।

–‘সরি! নিকুচি করি আমি তোর সরির। বজ্জাতের বজ্জাত। ব্যথা দিয়ে এখন সরি বলা হচ্ছে। লাগবে না আমার সরি। তোর সরি তুই আচার দে।’

তনু হাতটা চোখের সামনে তুলে আনলো। দেখল ইহান ভাই যেখানে ধরেছিল, ওই জায়গাটা লাল হয়ে গেছে। গায়ে গন্ডারের শক্তি! ভাগ্য ভালো ইহান ভাইয়ের ওই কাণ্ড কেউ দেখেনি। দেখলে কী ভাবতো?

–‘আপনি আমাকে জ্বালানোর জন্য জেনে-বুঝে এসব করছেন। এতে যে আমার খারাপ লাগে তা আপনার বুঝতে হবে না। আপনি একটা স্বার্থপর। শুধু নিজের দিকটাই ভাবেন।’

এভাবে আরও দুই তিনটা দিন কেটে গেল। ইহান এখন কিছুটা হাঁটতে পারে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটলেও এখন আর পায়ে ব্যথা লাগে না। তবে হাত ঠিক হতে এখনও অনেক দেরি। ইহান হাজার বাহানায় সারাক্ষণ তনুকে নিজের আশেপাশে রাখে। তনু বিরক্ত হলেও তার কিছু করার নেই। তনুকে সে সাদাফ ভাইয়ের কাছে যেতে দিতে পারে না। তনু সাদাফ ভাইয়ের থেকে দূরে থাকলেই ইহান ভালো থাকবে।

–‘তনু আমার একটা কাজ করে দাও তো। হাসপাতাল থেকে আসার পর থেকে নিজের ঘরে থাকছি। আমার চিলেকোঠাটাকে বড্ড মিস করছি। ঘরটা একটু ঝাড়ু টাড়ু দিয়ে গুছিয়ে রেখে আসো। আজ থেকে আমি আবার ওখানে থাকব।’

–‘ফুলি আপাকে করে দিতে বলি ইহান ভাই? কাল থেকে আমার কলেজে পরীক্ষা।’

–‘আচ্ছা। ফুলিকেই বলো তাহলে।’

–‘হু।’

তনু চলে যাচ্ছিল। ইহান পেছন থেকে ডাকল। তনু দাঁড়িয়ে বলল,

–‘আবার কী?’

–‘কাল থেকে পরীক্ষা। এজন্য তোমাকে এমন লাগছে! আরে বোকা টেনশন করার কী আছে? তুমি তো এখন ভালো স্টুডেন্ট। নিজের উপর কনফিডেন্স নেই তোমার?’

–‘আছে। কিন্তু… আমি কী ভালো রেজাল্ট করতে পারব?’

–‘অবশ্যই। আমার তো তোমার উপর পুরো ভরসা আছে।’

তনু হাসল। ইহান ভাই তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। যাক, মানুষটা এতটাও খারাপ না। তাকে নিয়ে একটু হলেও ভাবে। তাইতো সে যে টেনশনে আছে সেটা চোখে পড়েছে। সাবিনা, রাশেদা ঠিক করেছে তনুর পরীক্ষা শেষ হলে বিয়ে হবে। তনু ভাবছে এতদিনে যেহেতু বিয়ের কথা উঠেনি, তাহলে হয়তো ইহান ভাই পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া অব্দি কেউ কিছু বলবে না। ততদিনে তনু ফুপু আম্মাকে সব জানিয়ে দিবে। তার একমাত্র ভরসা ফুপু আম্মা।

রাত তখন সাড়ে এগারোটা। তনু পড়া শেষ করে ছাদের দিকে আসলো। তার মনে ক্ষীণ আশা ইহান ভাই যদি এখনও জেগে থাকে। যদি দেখা হয়ে যায়। ছাদে এসে তনু দেখে ইহানের ঘর অন্ধকার। ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়। সে ছাদের রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়াল। আজকের চাঁদটা ভীষণ সুন্দর। খুব আলো দিচ্ছে। তনু মুগ্ধ চোখে এক ধ্যানে চাঁদটাকে দেখছে। ইহান কখন এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে সে খেয়াল নেই। ইহানের উপস্থিতি তনু টের পায়নি ভেবে হাসছে ইহান। তনু যতটা না মুগ্ধ হয়ে চাঁদ দেখছে ইহান তার থেকেও বেশি মুগ্ধ হয়ে তনুকে দেখছে।
#সুখের_পাখি

৪০
–‘কী আছে ওর মাঝে? এরকম অন্যমনস্ক হয়ে ওকে কী এত দেখছ!’

ইহানের কথায় ঝট করে ওর দিকে ফিরে তাকায় তনু। ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। ইহানকে দেখে দম নিল সে। চাঁদের আলোয় ইহান তনুকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ওকে দেখে এতটা ভয় পেয়ে যাবে তনু ভাবেনি সে। মিটিমিটি হাসছে ইহান। এই মেয়েটা এতদিন পাগলের মতো তার পেছনে ঘুরেছে। ইহানের বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল যার কারণে তনুকে বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে সে।
তনু ভাবেনি ইহান জেগে আছে। আর তাকে ছাদে আসতে দেখেছে। এটাও তনুর ভাবনার বাইরে ছিল যে, ইহান ভাই তাকে ছাদে দেখলেও তার কাছে আসবে। বরং তাকে দেখলে ঘরেই থাকবে। এখন তো দেখা যাচ্ছে ইহান ভাই তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে তার সাথে কথা বলছে।

–‘চাঁদ তোমার ভালো লাগে, তাই না তনু?’

–‘হুম। ভীষণ।’

–‘চাঁদের কোন জিনিসটা তোমার ভালো লাগে?’

–‘ওর আলো। দেখুন কেমন অন্ধকার দূর করে দিয়ে পৃথিবীকে নিজের আলোয় আলোকিত করে রেখেছে। স্নিগ্ধ, কোমল, মায়াবী, মনোমুগ্ধকর।’

শেষের কথাগুলো ইহান তনুকে দেখে ভাবল। স্নিগ্ধ, কোমল, মায়াবী, মনোমুগ্ধকর! ইহান দোটানায় পড়ে গেল। সে ভাবছে তনুকে কি এখন বলে দিবে, সে-ও তনুকে ভালোবাসে। নাকি পরে সুযোগ বুঝে কোনো একদিন বলবে। তনু তাকে বুঝবে তো?

–‘তনু!’

–‘হুম।’

কী বলবে ইহান? সোজা বলে ফেলবে, আমি তোমাকে ভালোবাসি তনু। গায়ে শিহরণ অনুভব করছে ইহান। বেশ বুঝতে পারছে তার কপালে ঘাম হচ্ছে। ভালোবাসার কথা বলতে এত সাহস লাগে! তনু কীভাবে বলেছে তাহলে? তনু তো সকাল, দুপুর, রাত তিন বেলায়ই বিনা দ্বিধা, নিঃসংকোচে, বুক ফুলিয়ে তাকে ভালোবাসে বলেছে।

–‘তনু…

–‘কিছু বলবেন ইহান ভাই?’

–‘হ্যাঁ।’

–‘বলুন।’

–‘কাল তোমার কী পরীক্ষা?’

যা বাবাহ! কী বলতে চাচ্ছিল, আর কী বলে ফেলেছে। মুখ দিয়ে ভালোবাসি কথাটা না এসে ফালতু পরীক্ষার কথা বেরিয়েছে। নিজেকেই গাল দিল ইহান। গাধা! একটা কাজ হচ্ছে না তোকে দিয়ে! তনুকে কি তুই ভয় পাচ্ছিল! যেখানে জানিস তনু তোকে ভালোবাসে তবুও ভয় পাচ্ছিস তুই! শালা ভীতুর ডিম।

–‘ফিজিক্স।’

–‘ওহ। তাহলে তুমি এখানে কী করছো? কেমন প্রিপ্রারেশন নিয়েছ?’

–‘ভালো।’

–‘হু। কাল তো পরীক্ষা। ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। ঘুম না হলে পরীক্ষা ভালো হবে না।’

–‘হুম।’

তনু চলে যাচ্ছে। ইহান পেছন থেকে ওকে যেতে দেখছে। ভাবছে, থাক এখন তনুর পরীক্ষা। আগে পরীক্ষাটা শেষ হোক। তনু যা পাগল মেয়ে এসবের চক্করে পরীক্ষা না লাটে তুলে। ইহান কয়েকটা দিন সময় নিয়ে কথাগুলো একটু গুছিয়ে নিবে। নিজেকে সময়, সাহস দু’টোই দিবে৷ তনু চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত ইহান ঘরে এলো না। নিজেকে এই রূপে আবিষ্কার করে হাসল ইহান। সে সত্যিই একটা ভীতু। অন্তত তনুর মত সাহস তার নেই। নিজেকে ভীতু ভাবতেও ভালো লাগছে ইহানের। আজকাল তার আশেপাশের সব কিছুই ভালো লাগছে। কোনো কিছুতে বিরক্ত হচ্ছে না৷ সারাক্ষণ মনের মাঝে অজানা এক কারণে সুখ সুখ লাগছে। ইহান মৃদু হেসে বলল,

–‘আমার #সুখের_পাখি তুমি তনু। এই পাখিটাকে আমি সারাজীবন আমার বুকের খাঁচায় পোষে রাখব। কখনও উড়ে যেতে দিব না।’

সিঁড়ির শেষ ধাপ নামতেই তনু ভূতগ্রস্ত হয়ে আতঙ্কে দাঁড়িয়ে গেল। তার চেহারা থেকে রক্ত নেমে গেছে। তনুর দু-হাত সামনের সাদাফ দাঁড়িয়ে আছে। সাদাফকে দেখে ভয়ে তনুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সাদাফ ভাই তাকে ছাদ থেকে নামতে দেখে ফেলেছে। ছাদে ইহান ভাই আছে। এত রাতে তনু ছাদ থেকে আসছে। কেন ছাদে গিয়েছিল ও? সাদাফ ভাই এই কথা জিজ্ঞেস করলে কী জবাব দিবে তনু?
তীক্ষ্ণ চোখে সাদাফ তনুকে পর্যবেক্ষণ করছে। ছাদ থেকে আসছে তনু। কিন্তু তাকে দেখে এভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল কেন?

–‘তনু, ছাদে গিয়েছিলে?’

কোনোরকমে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল তনু।

–‘কাল তো তোমার পরীক্ষা। পড়া শেষ হয়েছে?’

–‘হ্যাঁ।’

–‘ওহ। তাহলে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো।’

তনু আর এক সেকেন্ডও সাদাফের সামনে দাঁড়ানোর সাহস করল না। এর আগেও ইহান ভাইয়ের কাছে অনেকবার গিয়েছে সে। তখন ধরা পড়ার ভয় ছিল না। আজ তনু ইহান ভাইয়ের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে না গেলেও ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছে। ইহান ভাই তার জন্য কোনোকিছু ফিল করে না। তনু নিজের অনুভূতির জন্য ইহান ভাইয়ের বদনাম করতে পারে না। ফুপু আম্মাকে তনু এখনও কিছু বলেনি। তার আগেই সবাই জেনে গেলে ফুপু আম্মা তনুকেই ভুল বুঝতো।

পরের দিন পরীক্ষা দিয়ে এসেই তনু কাপড় না পালটে ফুপু আম্মার ঘরে গেল। ফুপু আম্মাকে সব জানিয়ে দিবে সে। তনু নিজের মনে মনে আর এসব কথা চেপে রাখতে পারছে না। তার সহজ সরল সুন্দর জীবনটা ক্রমশ প্যাঁচালো, অসহ্যকর হয়ে যাচ্ছে। জীবনের এই নাটকীয়তা তনু আর নিতে পারছে না। গ্রামে থেকে মাতব্বরের ছেলেকে বিয়ে করে নিলেই ভালো হতো। না সে শহরে আসতো। আর না ইহান ভাই নামক কোন মানুষের সাথে দেখা হতো। দেখা হয়েছিল ভালো কথা, পৃথিবীতে এতো এতো মানুষ থাকতে তনুর এই মানুষটাকেই ভালোবাসতে হতো। সৃষ্টিকর্তাও হয়তো তাকে নিয়ে নতুন নাটক রচনা করার জন্য তার বাবাকে নিয়ে গেল। তনু তো এখন চাইলেও এই পরিবারের থেকে দূরে যেতে পারবে না। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তার।
সাবিনা তনুর মুখ দেখেই ওর মনের অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করে নিলো। চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করল,

–‘তনু, কী হয়েছে তোর? পরীক্ষা ভালো হয়নি?’

তনু আর পারছিল না। এই কয়দিনে তার মনের উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। অনেক কষ্ট নীরবে সহ্য করে নিয়েছে ও। কিন্তু আজ আর সম্ভব হচ্ছে না। হাঁপিয়ে উঠেছে সে। নিজের কাছেই হেরে গেছে। তনু সাবিনার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। সাবিনা কিছুই বুঝতে না পেরে হতবুদ্ধি হয়ে তনুর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বলছে,

–‘এই তনু! তনু মা আমার। কী হয়েছে তোর? পরীক্ষা ভালো হয়নি মা? এই তনু… দেখো দেখি কাণ্ড! আমাকে না বললে কীভাবে বুঝবো আমি। কাঁদে না মা। আমাকে বল। বল কী হয়েছে? আমি সব ঠিক করে দেব। বল না রে তনু…

সাবিনা এখনও এটাই ভাবছে তনুর হয়তো পরীক্ষা খারাপ দিয়েছে তাই কাঁদছে। আগেও তো রেজাল্ট খারাপ করে কেঁদেছে। কান্নার কারণে তনু কথা বলতে পারছে না। হেঁচকি তুলতে তুলতে ও বলল,

–‘আমি আর পারছি না ফুপু আম্মা। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমার কষ্টের কথা কাকে বলবো আমি? আমার তো মা নেই। কে আমার সব কথা শুনবে? কে আমাকে মায়ের মত বুঝবে?’

সাবিনা স্তব্ধ হয়ে গেল। মেয়েটার হঠাৎ কী হয়েছে? তনুর মত একটা হাসিখুশি মেয়ে কী নিয়ে এমনভাবে কষ্ট পাচ্ছে? এই বয়সে কোন দুঃখ থাকতে পারে ওর!

–‘এই তনু, কে বলেছে তোর মা নেই? আমি তোর মা না! ফুপু কি মায়ের থেকে কম? তোকে তো আমি সবসময় নিজের মেয়ের মতই দেখি রে। তুই তোর কষ্ট গুলো আমাকে বল। কী কষ্ট তোর? আমি তোকে বুঝবো না!’

–‘আমি এখন বিয়ে করব না ফুপু আম্মা। তুমি সাদাফ ভাইয়ের মা’কে না করে দাও। আমি বিয়ে করব না। তোমাদের থেকে কখনও দূরে যাব না। সবসময় তোমার কাছে থাকব। আমাকে নিজের কাছে রেখে দাও না।’

এই কথা! পাগল মেয়ে এইজন্য এভাবে কাঁদছে! আরে বিয়ে করার জন্য ওকে জোর করেছে কেউ? সাবিনা তো প্রথম থেকেই বলে আসছে তনুর খুশিতে সে খুশি। তনু তখন না করলে সাবিনা কখনও এই ব্যাপারে কথা আগাতো না। তনু তো তখন খোলাখুলি ভাবে কিছুই বলেনি।

–‘বিয়ে করবি না এজন্য এভাবে কাঁদছিস তুই! আরে পাগল, আমি কি কখনও তোকে জোর করেছি? আমি তোকে জিজ্ঞেস করিনি বল? তুই-ই তো তখন আমাকে কিছুই বলিসনি। তুই না করলে আমি কি জোর করে তোকে বিয়ে দিতাম।’

–‘তখন বলিনি। এখন বলছি। তুমি না করে দাও।’

–‘আচ্ছা দিব। আগে তুই কান্না থামা। নইলে কিন্তু জোর করেই বিয়ে দিয়ে দিব। কান্না থামা পাগল মেয়ে। চোখ মুছ।’

তনু কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। চোখ মোছার সাথে সাথে চোখ গড়িয়ে আবার পানি পড়ে যাচ্ছে। মুখ তুলে ফুপু আম্মাকে দেখছে ও। সাবিনা সহজ গলায় জানতে চাইল,

–‘কেন বিয়ে করবি না? সাদাফকে তোর পছন্দ না?’

–‘পছন্দ। কিন্তু ওভাবে না। বিয়ে করার জন্য যেমন পছন্দ হতে হয় তেমন না।’

–‘তাহলে আগে কেন বলিসনি?’

–‘তখন বুঝিনি।’

–‘এখন বুঝেছিস তো?’

–‘হু।’

–‘বুঝতে যে এত দেরি করলি ওইদিন যদি বিয়েটা হয়ে যেত। ইহান অ্যাক্সিডেন্ট না করলে তো ওইদিনই বিয়ে হয়ে যেত।’

তনু চুপ করে রইল। সাবিনা দু’হাতে তনুর গালে লেগে থাকা চোখের পানি মুছে দিচ্ছে। তনুটা এরকম অবুঝ কেন? ওর বাবাকে সাবিনা কথা দিয়েছে কখনও তনুর অনাদর হতে দিবে না সে। মেয়েটা ভেতরে ভেতরে এভাবে কষ্ট পাচ্ছে আর সে খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। তনুর প্রতি তার এই অবহেলা দেখে মৃত ভাই কি কষ্ট পাচ্ছে না। তনু শান্ত হয়ে গেছে। অপরাধী মুখে ফুপুর মুখের দিকে চেয়ে বলল,

–‘তুমি আমার উপর রাগ করোনি তো ফুপু আম্মা?’

সাবিনা অবাক হয়ে বলল,

–‘রাগ করব কেন?’

–‘আমি যে তোমার কথা রাখতে পারছি না।’

–‘আমার কথা রাখতে কে বলেছে তোকে? আমি বলেছি? আমি তো ভেবেছিলাম তুই হয়তো সাদাফকে পছন্দ করিস। তাই বিয়েতে আপত্তি করিনি। আগে জানলে আমি কখনও তোকে এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে দিতাম না।’

তনুর এখন অনেকটা হালকা লাগছে। ফুপু আম্মা তাকে ভুল বুঝেনি। উল্টো তাকে সাপোর্ট করছে।

–‘ তুমি আমাকে কোনোদিন ভুল বুঝবে না তো? আমি যদি কাউকে পছন্দ না করি, তবুও তাকে বিয়ে করি তাহলে কি তার প্রতি এটা আমার অন্যায় হবে না? আমি সাদাফ ভাইকে একজন ভালো মনের মানুষ হিসেবে পছন্দ করি। আমি উনার যোগ্য না৷ তুমি তো জানো আমি কেমন। এত ভালো মানুষটাকে কষ্ট দিতে চাই না আমি। আর আমি কোনো ছেলেকেই বিয়ে করে তোমার থেকে দূরে যেতে চাই না।’

ওর কথা শুনে সাবিনা হাসতে লাগলো। তনু হালকা লজ্জা পেল।

–‘তাহলে কি তুই জীবনেও বিয়ে করবি না?’

–‘করব।’

–‘কাকে করবি? বিয়ে করে বরকে ঘরজামাই নিয়ে আসবি নাকি? তুই তো আমাকে ছেড়ে যাবি না। তাহলে বরকেই আমার এখানে নিয়ে আসতে হবে। পাগল মেয়ে, পৃথিবীতে সব মেয়েকেই একদিন না একদিন বিয়ে করে বাবা,মা নিজের বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়ি যেতে হয়। কোন মেয়েই সারাজীবন বাবা মা’র কাছে থাকতে পারে না। আমাকেই দেখ না। এটা কি আমার বাড়ি? আমি কি বিয়ে করে আমার বাবা মা’কে ছেড়ে তোর ফুপার সাথে আসিনি? তোর ফুপার পরিচয়ই এখন আমার পরিচয়। বাপের বাড়ি কয়দিন যেতে পারি আমি?’

চলবে🍁
#জেরিন_আক্তার_নিপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here