সুখের পাখি পর্ব -৪৩+৪৪

#সুখের_পাখি

৪৩
ইহানকে চোখের সামনে দেখে তনুর এখন প্রাণ যায় যায় দশা। নাক মুখ বন্ধ করে দম চেপে অনড় দাঁড়িয়ে আছে। এই সময় ইহান তার ঘরে চলে আসবে ভাবতেই পারেনি তনু। সবটা তার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। এসব স্বপ্ন হলেই বোধহয় বেশি ভালো হতো।
তনুকে দম আটকে থাকতে দেখে ইহান মুচকি হাসছে। তার শার্ট যে তনু ছাড়া অন্য কেউ নিবে না এটা ইহান খুব ভালো করেই জানতো। তনু পাগলী তার শার্ট চুরি করে কী খুশি পেল সে-ই জানে! অল্পবয়সী মেয়েদের মন বোঝা কঠিন থেকেও কঠিনতম কাজগুলোর থেকে একটা। ইহান চেহারার ভাব গম্ভীর করে দরজার সামনে থেকে এগিয়ে এলো। তনুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে ওকে দেখল। তনু এখনও কথা বলা বা নড়াচড়া করার শক্তি ফিরে পায়নি। চোখের পাতাও নড়ছে না ওর। পাঁচ সেকেণ্ডের মত ইহান তনুর উপর থেকে চোখ সরাল না। তারপর ঝুঁকে নিচে থেকে শার্টটা তুলে নিল। ময়লা পরিষ্কার করার ভঙ্গিতে হাত দিয়ে শার্টটা ঝাড়লো।

–‘এটা তো আমার শার্ট। আমার চুরি যাওয়া ওই শার্ট তোমার কাছে কীভাবে এলো তনু?’

তনু এতক্ষণ আঁটকে রাখা দম ফোঁস করে ছেড়ে দিল। এই মুহূর্তে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে ওর। নয়তো মাটি দু-ফাঁক হয়ে যাক, তনু তার ভেতর ঢুকে যাক। বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কা শেষ না হতেই ইহান আবার বলল,

–‘আমার শার্ট তুমি চুরি করেছ!’

ঢোঁক গিলল তনু। সে বুঝতে পারছে তার কিছু একটা বলা দরকার। অথচ গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। ইহান চেহারায় রাগ ফুটিয়ে তুললো।

–‘এটা কেমন বেয়াদবি তনু! তুমি তো আমার মা’র নাম ডোবাবে দেখছি। মা’র ভাইঝি তুমি। তুমি এরকম চুরি ছ্যাঁচড়ামি করলে তো লোকে আমার মা’কে কথা শোনাবে। সাথে আমাকেও ছাড়বে না। আমাদের তো ভাগ্য ভালো তুমি নিজের বাড়িতে চুরি করেছ। মানুষের বাড়ি গিয়ে চুরি করলে ঘটনাটা কী হতো ভাবো তো একবার। লোকে তুমি সহ আমাদের নামেও থানায় কেস মামলা করে বসতো। তুমি তো দেখছি পাক্কা চোর হয়ে গেছ।’

এই অপমানটা কোনোভাবেই নীরবে গ্রহণ করতে পারল না তনু। সামান্য একটা শার্টের জন্য ইহান ভাই তাকে এতগুলো কথা শোনালো! না। তনু এবার কিছুতেই চুপ করে থাকতে পারবে না। ইহান ভাই নিজেকে কী ভেবেছে হ্যাঁ! তনুকে যা ইচ্ছা বলবে আর তনু চুপ করে শুনবে? একটা শার্টই তো। সাত রাজার ধন তো আর না। রাগে, ক্ষোভে হিংস্র বাঘিনীর রূপ নিলো তনু। ইহান ভাইকে ভয় পাওয়া তো সে কবেই ছেড়ে দিছে। আজ ইহান বড় বলে সম্মান করাটাও নাহয় ভুলে যাবে। তবুও ইটের জবাব পাথর দিয়ে ফেরত দিবে তনু। ইহান ভাইয়েরও বুঝতে হবে তনু কোন সাধারণ মেয়ে না। ওকে ভালোবাসে তো কী হয়েছে? ভালোবাসা গেল তেল কিনতে।
ছোঁ মেরে ইহানের হাত থেকে শার্টটা নিয়ে নিল তনু। ঝনঝনে গলায় বলল,

–‘একটা শার্টের জন্য অত কথা শোনাচ্ছেন কেন হ্যাঁ? কত দাম এটার? দাম কত বলুন? স্বর্ণ লেগে আছে এই শার্টে? আপনি যা ভাবসাব করছেন তাতে মনে হচ্ছে আমি চুরি করে আপনাদের বাড়ি সাফ করে ফেলেছি।’

ইহান ভাবেনি তনু রেগে যাবে। তবে ওকে রাগাতে ইহানের মন্দ লাগে না। ইহান আবার তনুর হাত থেকে শার্ট কেড়ে নিল।

–‘স্বর্ণ লেগে থাকুক বা তামা লেগে থাকুক শার্টটা তো আমার। তুমি আমাকে না বলে এটা নিজের কাছে কেন এনে রাখবে?’

তনু আবার ইহানের হাত থেকে শার্ট নিয়ে গেল।

–‘রেখেছি তো কী হয়েছে? আপনাকে বললে আপনি এটা আমাকে আনতে দিতেন?’

ইহানও আবার তনুর হাত থেকে শার্টটা নিয়ে বলল,

–‘কেন দেব? এটা আমার জিনিস। তোমার এ দিয়ে কাজ কী? তুমি তো ছেলেও না। শার্ট পরতে পারবে তুমি!’

–‘তাই তো বলিনি। জানতাম বললেও দিতেন না। এইজন্যই না বলে এনেছি।’

–‘তাই তো আমিও তোমাকে চুন্নি বলব।’

–‘এই খবরদার বলে দিচ্ছি। আর একবার এই কথা বললে কিন্তু ভালো হবে না।’

–‘ খারাপ কী হবে শুনি! একশো একবার বলব। একহাজার বার বলব। কী করবে তুমি?’

–‘আমি কিন্তু আপনার সব শার্ট কাঁচি দিয়ে কেটে কুটিকুটি করে ফেলব।’

–‘তনু চুন্নি!’

–‘ভালো হবে না কিন্তু।’

ইহান তনুকে ভেঙ্গিয়ে বলল,

–‘ভালো হবে না কিন্তু। খারাপ কী হবে তনু চুন্নি?’

এর থেকে বেশি রেগে যাওয়া তনুর পক্ষে সম্ভব না। শুধু তনু কেন? পৃথিবীতে কোন মানুষের পক্ষেই হয়তো এর থেকে বেশি রাগ করা সম্ভব না। তনু নিজেকে শান্ত করতে বড় বড় করে দম টানছে ও ফেলছে। ইহান ভাই মিচকা শয়তান। এই শয়তান কখনও ভালো হবে না এটাও তনুর জানা। শুধু শুধু নিজের বিপি বাড়িয়ে লাভ নেই।
ঝগড়ার মাঝখানে অপ্রত্যাশিত ভাবে তনু থেমে যাওয়াটা ইহান মানতে পারছে না। তনুর গাল, নাক লাল হতে শুরু করে দিয়েছিল। কথা বলার সময় নাকের দু’পাশ ফোলে যাচ্ছিল যা ইহানের কাছে অসম্ভব ভালো লাগে। তনুকে রাগাতেই যেন তার যত সুখ। তাইতো এতদিনেও ভালোবাসি কথাটা বলছে না। পুরোপুরি শান্ত হয়ে তনু বলল,

–‘এখন আপনি কী চান?’

ইহান এখনও তনুকে খেপাতে চাইছে।

–‘তুমি আমার শার্ট চুরি করেছ কেন?’

–‘চুরি করতে যাব কেন?’

–‘চুরি করোনি!’

–‘না।’

–‘তাহলে কী করেছ! কারো ঘর থেকে তাকে না বলে তার জিনিস নিয়ে এসে লুকিয়ে রাখা চুরি না?’

–‘না। আমার জিনিস আমি এনেছি। এটা চুরি না।’

তনুর এই কথায় ইহান অবাক না হয়ে পারলো না।

–‘তোমার জিনিস!’

তনুর কী হলো কে জানে। সে ইহানের চোখে চোখ রেখে স্থীর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে নিঃসংকোচে অধিকারী সুরে বলল,

–‘হ্যাঁ। যে মানুষটাকে আমি আমার মনে করি। তার সব জিনিসও কি তাহলে আমার না? আমার জিনিস আমি না বলে আনি বা বলে আনি। সেটাকে চুরি বলার আপনি কে?’

থতমত খেয়ে গেল ইহান। তনুর সহজ স্বীকারোক্তি তার ভাষা কেড়ে নিয়েছে। সে চেষ্টা করেও যে কথা আজ একটা সপ্তাহের উপর ধরে বলতে পারছে না, তনু সেই কথাগুলো কত সহজ ভাবে বলে ফেলছে। ইহানকে ওভাবে দাঁড় করিয়েই তনু ওই স্থান থেকে চলে আসতে নিচ্ছিল। কিন্তু ইহান এই সুযোগ ছাড়লো না। আজই উপযুক্ত সময় তনুকে তার মনের কথা জানিয়ে দেওয়ার। তনুর হাত ধরে ফেলল সে। তনু বিরক্ত হয়ে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে ইহান ওকে এক টানে নিজের সামনে নিয়ে এলো। তনু এখনও কিছুই বুঝতে পারছে না। হাত ছাড়ানোর জন্য জোড়াজুড়ি করছে সে। এদিকে ইহান পৃথিবীর সব একপাশে রেখে তনুকে নিজের মনের অনুভূতি জানিয়ে দিলো।

–‘ভালোবাসি তনু। তোমাকে বড্ড বেশি ভালোবাসি।’

এক মুহূর্তের জন্য নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারল না তনু। ভুল শুনেছে সে? ইহান ভাই সত্যিই এরকম কিছু বলেছে। ইহানের মুখের দিকে তাকালে ওর চোখে প্রশ্ন দেখে ইহান মাথা নাড়িয়ে আবার বলল,

–‘ভুল শুনোনি। ঠিকই শুনেছ। আমি তোমাকে ভালোবাসি। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন বেসে যাব। মরার আগ পর্যন্ত তোমাকে ভালোবাসতে ভুলবো না। তুমি আমাকে তোমাকে ভালোবাসার একটা সুযোগ দিবে? প্লিজ তনু! আমি জানি আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। নিজেও যে তোমার থেকে কম কষ্ট পেয়েছি তা কিন্তু নয়। আজ আমি আমার সব ভুলের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না?’

তনু মাঝে মাঝেই এমন স্বপ্ন দেখে। সে স্বপ্নে দেখে ইহান ভাই তাকে প্রপোজ করছে। বিয়ের কথা বলছে। এমনও স্বপ্ন তনু দেখেছে সেটাতে ওদের বিয়ে হয়েছে। ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে। অথচ চোখ খুলে দেখে সে নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। স্বপ্নগুলো এতটাই জীবন্ত হয় যে তনু ওগুলোকে সত্যি ভাবতে বাধ্য হয়। স্বপ্ন ভেঙে গেলে ইহান ভাইকে পায় না সে। তখন তনুর ভীষণ কষ্ট হয়। এখনও তনুর কাছে এটাই মনে হচ্ছে সে ভীষণ সুন্দর মিষ্টি একটা স্বপ্ন দেখছে। ইশ! এই স্বপ্নটা যদি সত্যি হতো। নয়তো কোনোদিনও না ভাঙতো। বাস্তবে ঘুম না ভেঙে স্বপ্নেই থেকে যেত ও। তবুও তো পুরোটা জীবন ইহান ভাইয়ের সাথে থাকতে পারতো। এটাই বা ওর জন্য কম কিসের?
তনুকে চুপ থাকতে দেখে ইহানের ভয় হচ্ছে। তনু কি ওকে ক্ষমা করবে না! কিছু বলছে না কেন ও।

–‘এই তনু, কিছু তো বলো। ক্ষমা করবে না আমায়? তোমাকে ভালোবাসার সুযোগ দিবে না?’

–‘স্বপ্নটা ভীষণ মিষ্টি ইহান ভাই। এই স্বপ্নটা আমি সারাজীবন দেখতে চাই। স্বপ্নটা যাতে খুব সহজে না ভাঙে। আপনি চলে যাবেন না।’

ইহান বেআক্কেল হয়ে গেল। কী বলছে তনু এসব! কিসের স্বপ্ন! আবোলতাবোল বলছে কেন তনু?

–‘এই তনু, কী বলছো তুমি? কিসের স্বপ্ন?’

–‘উহম জানি তো এটা একটা স্বপ্ন। আপনি স্বপ্নে আমার কাছে এসেছেন। বাস্তবে তো আপনি কোনোদিন আমাকে এসব কথা বলবেন না। হাত ধরে এরকম ঝাঁকি দিচ্ছেন কেন? স্বপ্নটা তো ভেঙে যাবে। আমার ঘুম ভেঙে গেলে আপনিও চলে যাবেন।’

ইহান শব্দ করে হাসতে লাগল। বলল,

–‘পাগল মেয়ে, এটা কোন স্বপ্ন না। তুমিও ঘুমিয়ে নেই। আর আমিও তোমার স্বপ্নে আসিনি। আমি সত্যি সত্যি তোমার সামনে আছি।’

–‘স্বপ্নও কতটা জীবন্ত। পুরো বাস্তবের মতো লাগে। মনেই হচ্ছে না আমি স্বপ্ন দেখছি।’

ইহান বুঝতে পারল এভাবে তনুর ঘোর ভাঙানো যাবে না। পাগল মেয়ে তাকে এতটাই ভালোবাসে যে ইহানের মুখে নিজের জন্য ভালোবাসার কথা শুনে পাগলামি শুরু করে দিয়েছে। ভাবছে সে স্বপ্ন দেখছে। এর জন্য দোষী কে? ইহান নিজেই। সে তনুকে বারবার ফিরিয়ে দেওয়ার ফলেই তনু ভাবছে ইহান কখনও ওকে ভালোবাসতে পারবে না। ওটা শুধু স্বপ্নেই সম্ভব হবে। ইহান তনুর হাতে জোরে একটা চিমটি কাটল। ব্যথা পেয়ে তনু চেঁচিয়ে উঠে ওর থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ব্যথার জায়গায় ডলতে লাগল। চোখে ওর অবিশ্বাস্য চাহনি। ইহানকে মানুষ নাকি জ্বীন মনে করছে ও ও-ই জানে।
ইহান হাসতে হাসতে বলল,

–‘এখন বিশ্বাস হয়েছে তো! আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। এটা কোন স্বপ্ন না। তবে হ্যাঁ এখন থেকে শয়নেস্বপনে তুমি শুধু আমাকেই দেখবে। তোমার প্রতিটা স্বপ্ন আমাকে ঘিরে হবে। জেগে থেকেও প্রতিটা মিনিট তুমি আমাকে নিয়ে ভাববে। কি ভাববে তো? আমি ছাড়া অন্য কেউ ভুলেও যদি তোমার ভাবনায় আসে তাহলে আমি কিন্তু তোমার ঠ্যাঙ ভেঙে ফেলব তনু।’
#সুখের_পাখি

৪৪
–‘ও আল্লাহ! তনু তুই চুপ করবি? বকবক করে আমার মাথা পাগল করে দিচ্ছিস। নাহলেও সকাল থেকে তোর এই কথাগুলো পঞ্চাশ বারের উপরে শুনেছি। প্রতি বাক্য দাড়ি, কমা সহ চোখ বন্ধ করে বলে যেতে পারব আমি। মুখস্ত হয়ে গেছে তোর পিরিতের গল্প। এবার আমাকে মাফ করব। প্লিইজ!’

মিতা বিরক্ত হয়ে কানে হাত চেপে কথাগুলো বলে তনুকে থামিয়ে দিল। রাতেও নাহয় এই কথাগুলো ওকে একশো বার শুনিয়েছে। মিতা যখন বুঝল এই পাগলের জ্বালায় আজ ও ঘুমাতে পারবে না, তখন এক প্রকাশ বাধ্য হয়ে ফোন অফ করে রেখেছে। একটা পর্যন্ত পাগলটা ওকে জ্বালিয়ে খেয়েছে। এখন আবার কলেজে আসার পর থেকেই শুরু হয়েছে। এক কথা কতবার শুনতে ভালো লাগে? একশো বার? হাজার বার? বেশি হলে দুই তিন ঘন্টা শোনা যায়। তনুটা কাল রাত থেকে শুরু করেছে। সব দোষ শালা ইহান গাধার। ঝুলিয়ে রেখেছিলি খুব ভালো করেছিলি। কাল কেন একে ভালোবাসি বলতে গেলি?

–‘ইহান ভাইও আমাকে ভালোবাসে মিতা! আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। তোর বিশ্বাস হচ্ছে? বল না।’

মিতার খিটখিটে ব্যবহারও আজ তনুকে নিরুৎসাহী করতে পারছে না। মিতা যে বিরক্ত হচ্ছে এতে তনুর কিছু যাচ্ছে আসছে না। সে কারো কাছে কথাগুলো বলতে পারলেই খুশি।

–‘ইয়ার তনু প্লিজ, এবার তো থাম। মানুষ কি প্রেমে পড়ে না? কিন্তু প্রেমে পড়ে তোর মত পাগল হয় কয়জনে? আমি বুঝতে পেরেছি ইহান তোকে ভালোবাসে। তবুও ঘুরেফিরে এই কথা হাজার বার কেন বলছিস!’

–‘আমার যে বিশ্বাস হচ্ছে না দোস্ত।’

মিতা খেঁকিয়ে উঠল,

–‘গাধা বাচ্চা বলদা! বিশ্বাস না হলে মরে যা। তবুও আমাকে পাগল বানাস না। সব দোষ ওই গাধার। ওর জন্য পাগল হতে যাচ্ছিস তুই। সাথে আমাকেও পাগল করতে চাচ্ছিস। আমি ওই বলদাকে ছাড়ব না।’

তনু গালে হাত রেখে ফোঁস করে দম ছেড়ে উদাস গলায় বলল,

–‘ওরকম বলিস না রে। আমার কলিজায় লাগে।’

–‘তোর কলিজায় ছুরি মারব আমি। কুচিকুচি করে কেটে কলিজা ভুনা খাব।’

–‘খা। খেয়ে ফেল। তবুও আমাকে বল ইহান ভাই কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসে?’

মিতা ছেড়ে দিল। এই মেয়েকে কিছু বলে আর লাভ হবে না। এই মেয়ে গেছে। পুরোপুরি গেছে। মিতা তনুকে দেখছে। তনু অন্য কোনো জগতে আছে এখন। অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও তনু ওঠার নাম নিচ্ছে না। আজ দিনটা কি লাইব্রেরিতে বসেই কাটাবে নাকি? বাড়ি ফিরবে না।

–‘ওই, বাড়ি ফিরবি? নাকি এখানেই থেকে যাওয়ার ইচ্ছা আছে।’

হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়াল তনু। চেয়ারে শব্দ হলে অনেকেই ওদের দিকে তাকালো। মিতা চোখ পাকিয়ে কিড়মিড় করে বলল,

–‘কী করছিস হ্যাঁ?’

–‘চল চল বাড়ি যাই। আমি এখানে বসে কী করছি? ইহান ভাই কি এখানে আসবে নাকি? ও তো বাড়িতেই আছে। ইশশ রে, কী পাগল আমি। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত উনাকে দেখিনি।’

–‘তুই গেছিস তনু।’

লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে তনু মিতার হাত ধরে বলল,

–‘এই মিতা, আমার না কেমন লজ্জা করছে।’

–‘লজ্জা! লজ্জা কেন করছে তোর?’

–‘ইহান ভাইয়ের সামনে কীভাবে যাব আমি? ওর সামনে যেতে হবে ভেবেই আমার লজ্জা লাগছে।’

মিতা বিরক্ত হলো। মুখ বাঁকিয়ে বলল,

–‘এহহ রে! আমার লজ্জাবতী লতা রে! এতদিন লজ্জা করেনি? এতদিন তো বেহায়া বেলাজ্জা হয়ে ইহান ভাই ভালোবাসি, ইহান ভাই ভালোবাসি বলে গলা ফাটাতি।’

–‘হুম। এতদিন তো শুধু আমি উনাকে ভালোবাসতাম। এখন তো সে-ও বাসে। আর তাই তো লজ্জা পাচ্ছি। এমন কেন হচ্ছে জানি না। হঠাৎ করে যেন পৃথিবীর সব লজ্জা এসে আমাকে ভর করেছে। কত কাণ্ডই না করেছি। ইহান ভাইকে নিয়ে কত পাগলামি করেছি। ওসব মনে পড়লে মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।’

–‘তাহলে মরে যা।’

তনু অসহায় মুখে বলল,

–‘মরে যাব!’

–‘হুম। কলেজের ছাদ থেকে লাফ দে। তোর ভয় লাগলে চল আমি তোকে ধাক্কা দিই। মরা সহজ হয়ে যাবে।’

–‘তুই কী পাষাণ রে মিতা! আমি মরে গেলে ইহান ভাইয়ের কী হবে?’

–‘ওরে তনু রে, থাম মা। এবার তো থাম। তোকে ছাড়া এতদিন তোর ইহান ভাই বেঁচে ছিল না? হ্যাঁ, তাহলে তোকে ছাড়াও থাকতে পারবে।’

তনু মিতার সাথে কলেজ গেটের বাইরে পা দিয়েই থমকে গেল। ওকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে মিতা বিরক্ত হলো।

–‘আবার দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?’

তনু কথা বলতে পারছে না। তার সামনে এটা কে দাঁড়িয়ে আছে? চোখে ভুল দেখছে নাকি ও। ওটা কি সত্যি সত্যিই ইহান ভাই!

–‘তনু যাবি?’

তনুর দৃষ্টি অনুসরণ করে মিতাও সামনে তাকাল। ইহানকে দেখে সে-ও অবাকই হলো। ফিসফিস করে তনুর কানে বলল,

–‘একদিনে কী জাদু করেছিস শুনি! তোকে নিতে কলেজে চলে এলো! মানে তুই বাড়ি ফেরা পর্যন্ত তর সইলো না!’

সেবার ইহান ভাই তাকে স্কুল থেকে নিতে এসেছিল। সেদিন তনুর বাবা মারা গেছিল। আজও ইহান ভাই এসেছে। আজ কোন দুঃসংবাদ আছে নাকি? এটা ভেবেই তনুর বুক কেঁপে উঠল। বাড়িতে কোনোকিছু না হলে ইহান ভাই তাকে নিতে আসতো না। তনু ধুকপুক বুকে ইহানের দিকে এগোচ্ছে। খারাপ কোন কিছু যেন না ঘটে থাকে আল্লাহ। সবকিছু এত ভালো যাচ্ছে তার মাঝে যেন এমন কিছু না ঘটে যাতে ওদের সম্পর্কের শুরু থেকেই কোন বাজে স্মৃতি বয়ে নিতে হয়।

ইহান তনুকে দেখে হাসল। মনের সাথে পেরে না উঠে সে তো তনুকে নিতে এসেছে। কিন্তু এখন তনুকে দেখে লজ্জা লাগছে। তনু ওকে এখানে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে কী বলবে ইহান? একটা কিছু বলে দিবে। হোক সেটা পৃথিবীর সবথেকে বাজে অজুহাত। প্রেমে পড়লে মানুষ আরও কতকিছু করে!
মিতা তনুর হাতে চিমটি কেটে বলল,

–‘মুখ বন্ধ কর। আস্ত একটা গরু তোর মুখে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে। এরকম হ্যাংলামি করিস না তো। বয়ফ্রেন্ডের সামনে শক্ত ইমেজ বানিয়ে চলতে হয়। তবেই পাত্তা পাবি। নইলে তুই ওকে না বরং ও তোকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে বুঝলি গাধী। সম্পর্কের শুরু থেকেই টাইট দিতে হয় নইলে পরে হাত থেকে বেরিয়ে যায়।’

তনু ইহানের উপর চোখ রেখে ঘোর লাগা গলায় মিতার কথার জবাব দিচ্ছে,

–‘ আমার তো এখন নিজের বলতে কিছু নাই রে। আমার সবই উনার। উনাকে যেমন আমি নিজের মনের মতন করে চাই, তেমন উনিও হয়তো চান। উনার জিনিস উনি যেভাবে গড়িয়ে পরিয়ে নিবেন। এতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমাকে উনার যেভাবে দেখতে ইচ্ছে করবে আমি সেভাবেই থাকব। আমার যে কাজ উনার অপছন্দ তা আমি কখনও করব না। আমি উনার মন মতন হবো। পুরোটাই উনার হবো। তবেই না উনিও আমার হবেন। সম্পর্কে একজন কেন অধিকার খাটাবে? দু’জনের সমান অধিকার হলেই সম্পর্ক সুন্দর হবে।’

–‘তুই গেছিস তনু। পুরাই গেছিস। প্রেমে পড়ে হাতপা ভেঙে বসে আছিস।’

মিতা তনুকে একা রেখে নিজে কেটে পড়ল। তনু ইহানের সামনে এসে দাঁড়ালে ইহান মৃদু হাসল। তনু কিছুই বলতে পারল না। দু’জন পাশাপাশি আছে অথচ কেউ বলার মত কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না। হয়তো লজ্জা পেয়ে জড়তা কাজ করছে। আগে তো কেউ কারো মনের কথা জানত না।
ইহান তনুকে নিয়ে রিকশায় উঠে। পাশাপাশি বসলেও ইহান তনুর থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেছে। যাতে তার গা তনুর গা স্পর্শ না করে। পুরোটা পথ কেউ কোন কথা বলল না।
ঘরে এসে তনু নিজের বোকামির কথা ভেবে চুল টানছে।

–‘এত গাধা কীভাবে হলি তুই? মানুষটা তোকে আনতে গেল আর তুই কিনা ওর সাথে একটা কথা বললি না! তুই কথা বলিস নি দেখেই তো ইহান ভাইও কিছু বলেনি। বেচারা হয়তো লজ্জা পেয়েছে। তুই যে কী…

পরক্ষণে নিজেকেই আবার বলছে,

–‘আমি বলিনি তো কী হয়েছে? সে তো বলতে পারত। তার বোঝার উচিত ছিল আমি লজ্জা পাচ্ছি। জীবনের প্রথম প্রেম। কী কথা বলতে হয় কীভাবে বলতে হয় অত কিছু বুঝি নাকি?’

–‘না,না। তুই বুঝিস না। সে তো অনেক বুঝে। তোর প্রথম প্রেম। আর সে তো মনে হয় দশ বারোটা করে রেখেছে। কী বলতে হয় কীভাবে বলতে হয় এসব ব্যাপারে তার পিএইচডি করা আছে।’

–‘আরে দূর! দোষ তারও না, আমারও না। দোষ সব এই পিরিতের। এতদিন উনার সামনে দুনিয়ায় সব কথা পটরপটর করে বলে গেছি। এখন টু শব্দ বলতে পারছি না।’

তনু রাগে দুঃখে চুল টেনে বিনুনি খুলতে লাগল। এটা কোন কথা হলো! এরকম হলে বাকি জীবন তো বোবা লেগে চলতে হবে।
রাতে খাবার টেবিলেও কেউ কারো দিকে তাকায়নি। ঘরে গিয়ে ইহান তনুর ফোনে কল দেয়। কল রিসিভ করে তনুর কথা বলতে লজ্জা লাগছিল। কী বলবে সে? তার কিছু বলার আগেই ইহান বলল,

–‘শুয়ে পড়েছ তনু?’

–‘না। আপনি?’

–‘উঁহু। কী করছো?’

–‘কিছু না।’

–‘ছাদে আসবে একটু? আকাশে বিশাল বড় একটা চাঁদ উঠেছে। খুব জ্যোৎস্না দিচ্ছে। একা একা চাঁদ দেখতে ভালো লাগছে না। তুমি পাশে থাকলে ভালো লাগত।’

ইহানের বলতে যা দেরি হলো তনুর ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে দেরি হলো না। দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে হাঁপাচ্ছে তনু। ইহান ওর শব্দ পেয়ে পেছন দিকে ফিরে অবাক হলো। এটুকু সময়ের মধ্যে কীভাবে এসেছে তনু? উড়ে এসেছে নাকি? ইহান হাসল। তনু সত্যিই পাগল। তনু আর এগোচ্ছে না দেখে ইহান ডাকল,

–‘এদিকে এসো। আমি এখানে।’

তনু একপা একপা করে ইহানের দিকে এগোচ্ছে। আর তার বুকের ভেতর ভূমিকম্প হচ্ছে। তনু ইহানের থেকে দু’হাত দূরে দাঁড়াল। ইহান আড়চোখে ওকে একবার দেখে নিল। কয়েক মিনিট নীরবতার পর ইহানই কথা বলল,

–‘সবকিছু কেমন নতুন নতুন লাগছে।’

–‘আমার তো সবকিছুতেই লজ্জা লাগছে।’

মুখ ফসকে বলে ফেলে ঝট করে তনু দু’হাতে মুখ চেপে ধরল। কী বলে ফেলেছে এটা? ইহান অনেক কষ্টে হাসি চাপল। তনু মনে মনে নিজেকে ধমকালো।

–‘আর একটা কথাও বলবি না তুই। একদম চুপ থাকবি। তুই বোবা। বুঝেছিস? তুই বোবা। কথা বলতে পারিস না তুই। মুখ খুললেই সবসময় আজেবাজে কথা বেরিয়ে আসে। তোর ঠোঁট সেলাই করে দেওয়া উচিত। কথা বলার কোন অধিকার নেই তোর। বিশেষ করে ইহান ভাই যখন সামনে থাকবি। ইহান ভাইয়ের সামনে আর একটা বাজে কথা বললে আমি তোকে খুন করে ফেলব।’

ইহান তনুর ছেলেমানুষি দেখে মনে মনে খুব হাসছে। জীবনটা হঠাৎ রঙিন লাগছে।

চলবে🌸
#জেরিন_আক্তার_নিপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here