সুপ্ত অনুরাগে পর্ব -১০+১১

#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[১০]

কাজু আজ থেকে শিমুলকে পড়াবে। যেহেতু তার দ্বারা কোনো কাজই হচ্ছে না তাই জাহেদা বেগম হুকুম করেছেন ভাগ্নেকে পড়াতে। তাহলে মাস গেলে টিউশন ফি হিসেবে কিছু হাতখরচ পাবে সে। কাজু প্রথমে না মানলেও যখন হাতখরচের কথা শুনল, গাইগুই করে রাজি হয়ে গেল। শুধু রাজি হয়েই থেমে থাকল না, সেদিনই বিকেলে শিমুলের বইপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়ল ড্রইংরুমে। কিন্তু শিমুলই নেই। বিকেলে সে ছাদে গেছে খেলতে। এটা তার নতুন অভ্যাস। গত সপ্তাহে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। শিমুলের বয়সী এক মেয়ে আছে তাদের। সমবয়সী খেলার সঙ্গী পেয়ে শিমুলও তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলেছে। এখন তারা দুপুরের ঘুম বাদ দিয়ে বিকেল অবধি ছাদে বসে খেলে। অপু মামাকে একা বই খুলে বসে থাকতে দেখে বলল,
“তুমি মাছিকেও শিক্ষিত করতে বসেছো নাকি?”

কাজু বিরস মুখে উত্তর দিলো,
“আমি সার্বজনীন শিক্ষক নই, ওকে? নেহাত তোর মা বারবার বলল শিমুলের লেখাপড়াটা একটু দেখতে। নাহয় আমার এত সময় কই?”
“তাহলে বই খুলে মাছি তাড়াচ্ছো কেন?”
“বাজে না বকে ওই গা’ধাকে ডেকে আন। তোর বাপ আসার আগে আমাকে বেরোতে হবে। মোটেও ওই লোকের মুখ দেখে যেতে চাই না।”
অপু ঠোঁট টিপে বলল,
“স্বীকার করছো যে বাবাকে ভয় পাও?”
“তোর বাপ একটা কুফা। মুখটা দেখলেই দিনটা খারাপ যায়। এখন রাত খারাপ যাক মোটেও চাইব না। একটা সুন্দর রাত একটা সুন্দর দিন গঠনের কারিগর।”

অপু মিটিমিটি হাসতে হাসতেই ছাদে উঠল। কার্তিকের স্তব্ধ বিকেল। বিশাল মেঘলা আকাশ নিয়ে সূর্য পশ্চিমে প্রস্থানগামী। অপু দেখল শিমুল ও রিঙ্কি চিলেকোঠার ঘরের পাশ ঘেঁষে বসে খেলছে।
“শিমুল, পড়তে যা। মামা আজ থেকে তোকে পড়াবে।”
শিমুল করুণ চোখে আপুর দিকে তাকায়। বলে,
“এখন না। আমি আরেকটু খেলব।”
অপু তার সরল মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আচ্ছা, আরেকটু সময়। এরপর নেমে যাবি।”

অপু হেঁটে হেঁটে সম্মুখের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে সরে আসে। সুপ্ত ফরিদ মিয়ার দোকানে বসে আছে। আজ তো হর্নের শব্দ পেল না! লোকটা আজ চুপিচুপি এসেছে! ভাবনার মাঝে অপুর ফোনটা কেঁপে ওঠে। সুপ্তেরই ফোন। অপু ধরল না। কে’টেও দিলো না। একাধারে ফোন বাজতেই থাকল। অনেকক্ষণ দ্বিধাবোধ করে অবশেষে ফোন রিসিভ করতেই সুপ্তের ক্ষীণ হাসির শব্দ তার কান ছুঁয়ে গেল। সুপ্ত বলল,
“আজকাল আমায় চোখে হারাচ্ছো, তাইনা?”
“কে বলল? আপনার জ্যোতিষী মন?”
“তার মানে সত্যিই!” সুপ্তের কণ্ঠ সপ্রতিভ শোনায়। অপু কপট রাগী সুরে বলল,
“ডাহা মিথ্যা! সারাক্ষণ দারোয়ানের মতো বাড়ির সামনে বসে থাকলে দেখা হতেই পারে। নিজের বাড়িতে নিশ্চয়ই গুম হয়ে থাকব না।”

সুপ্ত ভারী গলায় বলে,
‘হুম হুম, তাইতো! আমিও চাই তুমি নিজের বাড়িতে গুম হয়ে না থাকো। ছাদে উঠবে, জানালার পাশে গিয়ে বসবে। বিকেলে একটু বাড়ির বাইরে হাঁটতেও বের হতে পারো। কিন্তু তুমি খুবই অলস।”
“ওহহ আচ্ছা! আর আপনি খুবই এক্টিভ? ঘন্টার পর ঘন্টা অন্যের বাড়ির সামনে বসে ঘাস চিবানো বুঝি খুবই কাজের?”
“ঘাস চিবাতে দেখেও তো একদিন দাওয়াত দিলে না। অল্প হলেও আমরা চেনা-জানা। একজন পরিচিত মানুষকে নি’র্দয়ের মতো দোরের সামনে থেকে ভাগিয়ে দিচ্ছো। বাঙালির অতিথিপরায়ণ স্বভাবটা হারিয়ে যাচ্ছে।” সুপ্ত জিভে চুকচুক শব্দ তুলে আফসোস করল।

অপু বিরক্তিতে চোখ বোজে। এই লোকের সাথে কথায় পারা মুশকিল। সে লম্বা দম ছেড়ে বলল,
“আচ্ছা! সামান্য এক্সি’ডেন্টে এক মুমূ’র্ষু রো’গীকে কেয়ার করলেই কেউ কারো প্রেমে পড়ে?’
“উত্তরটা আমি দেব না।”
“কেন?”
“শ’ত্রু আর নারী, এদের কখনো দুর্বলতা দেখাতে নেই। তাহলেই কেল্লাফতে! অবশ্য উত্তরটা তুমি নিজে খুঁজে পেলে আলাদা কথা।”

কথাটার মানে অপু ঠিক বুঝল না। বুঝতে চেয়ে ব্রেইনে প্রেশারও দিলো না। সুপ্ত অপরপাশ থেকে আবার বলল,
“দেখা যখন হয়েই গেছে আর লুকিয়ে থেকো না প্লিজ! আরেকবার সামনে এসো আমার অপরাজিতা। তোমায় দেখেই চলে যাব, প্রমিজ!”
অপু কঠিন কিছু শোনাতে উদ্যত হলো। সুপ্ত তড়িঘড়ি করে আগেই বলে উঠল,
“প্লিজ! রাগ করতে হলেও সামনে এসো।”

অপু যাবে না যাবে না করেও রেলিংয়ের দিকে পা বাড়াল। দেখতে পেল সুপ্ত বাইকের কাছে দাঁড়িয়ে ওপরের দিকেই তাকিয়ে আছে। দুজনের চোখাচোখি হতেই সুপ্ত নির্মল হেসে বলে উঠল,
“আহ! দুটো দিন তোমায় না দেখে শুকিয়ে যাচ্ছিলাম। এখন মনে হয় তাজা হচ্ছি।”
অপু হাসি লুকিয়ে বলল,
“আমি কী ভিটামিন?”
“তুমি আমার মনের ভিটামিন। না দেখলে কেমন অসুস্থ অসুস্থ লাগে।”
“এটা আবার কোন সাইন্স?”
“বেশি ভালো ছাত্রীদের এই এক সমস্যা। বইয়ের ব্যাখ্যা ছাড়া কিছুই বুঝতে চায় না। একটু বইয়ের পড়াশোনা রেখে মনের পড়াশোনা করো। দেখবে সাইন্স, কমার্স, আর্টস সব সাবজেক্ট নখদর্পনে। না পারলেও চলবে। আমি শেখাব। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি…”

অপু তর্জনী দেখিয়ে খেকিয়ে উঠল,
“এই থামুন বলছি। বসতে দিয়েছি বলে শুতে চাইছেন?”
সুপ্ত দুষ্টু হেসে বলল,
“ছিহ! ডা’র্টি মাইন্ড! আমার মাথায় এসব কখনোই আসেনি। এখনো তো হাতই ধরতে দিলে না।”
অপু থতমত খেয়ে গেল। ফোন কেন রিসিভ করেছে তার জন্য নিজের ওপরই রাগ হলো। নাক ফুলিয়ে বলল,
“আপনি একটা অসহ্য!”
“চো’রকে গৃহস্থের বাড়ি দেখিয়ে দিয়েছো সুন্দরী, এবার চু’রি করা ঠেকাও।”
অপু ফোন কে’টে সরে গেল। শিমুলকে খেলা থেকে টেনে নিয়ে সিড়ি বেয়ে তরতরিয়ে নামার সময় বাইকের হর্ন শুনতে পেল। সুপ্ত চলে গেছে।
______________

বেলীর শরীর একটু অসুস্থ থাকায় অপুর ফোনের বিষয়টা তার খেয়ালে ছিল না। আজ একটু সুস্থ বোধ করতেই আবারো বোনের গোপন প্রণয় উন্মোচনে ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু অপু তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সেদিন এসি নিয়ে ঝগড়ার পর অপু তার সঙ্গে কথা বলছে না। বেলীও ইগো দেখিয়ে দূরে সরে আছে। কিন্তু এভাবে হবে না। তাকে আগে বোনের কাছাকাছি যেতে হবে। বেলী ঠিক করল অপুর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে দুজনের তি’ক্ততা একটু কমাবে।
বেলী আজ ইচ্ছে করেই আজিজকে আগে খাইয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিলো। বাবা যখন অপু, শিমুলকে নিয়ে খেতে বসল সেও চেয়ার টেনে পাশে বসে পড়ল। আনিসুল সাহেব দেখেও কিছু বললেন না। নির্বিঘ্নে খেতে লাগলেন। মাঝে মাঝে এটা ওটা এগিয়ে দিতে বললেন জাহেদা বেগমকে। খাওয়া যখন প্রায় শেষের পথে তখন বললেন,
“জাহেদা, সামনের সপ্তাহে আমার বন্ধু ইমদাদুল আমেরিকা থেকে আসবে। তাকে বাড়িতে ইনভাইট করেছি। আমাদের অপুকে দেখতে চেয়েছে ওরা।”

অপু খাওয়া থামিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো। তাকালো বাকি সবাই। আনিসুল সাহেব তা বুঝে বললেন,
“ইমদাদুল আমার ভার্সিটির ইয়ারমেট ছিল। আমেরিকা থাকে বিশ বছর যাবত। ছেলের বিয়ে দিতে দেশে আসছে। অপুর কথা শুনে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যদি দুই পরিবারের মতের মিল হয় তাহলে এগোবো। অপুর মাস্টার্সটা দেশের বাইরে হোক অনেক আগেই চাইছিলাম। এই সম্বন্ধটা হলে পড়াশোনা প্লাস ফিউচার দুটোতেই সুবিধা হবে।”

অপুর গলায় খাবার আটকে গেল। না চাইতেও কেন জানি সুপ্তের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের পাতায়। একটা নাম না জানা অনুভূতি ক্রমশই গ্রা’স করে নিল মনের অলিগলি। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বেলী ক্রু’র হাসে। আসন্ন এক দা’মা’মার গন্ধ পাচ্ছে যেন। এবার অপু কি করবে তা দেখতে মনে মনে উত্তেজিত হয় সে।
#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[১১]

সুপ্তের মন বিক্ষিপ্ত। আজ দুদিন ধরে অপরাজিতা তাকে এড়িয়ে চলছে। না ফোন, না ম্যাসেজ। জানালার ধারে কিংবা ছাদেও তার নিশান নেই। এদিকে দেখা হওয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থান, ভার্সিটিতেও অপু গত দুদিনে পা রাখেনি। তাপমাত্রা প্রেমোষ্ণ হতে হতে হুট করে বিষাদশীতল রুপে হিমাঙ্কের নিচে নেমে যাওয়ার কারণটা ঠিক বুঝতে পারছে না সুপ্ত। তবে ঝামেলা কিছু একটা আছে এটুকু নিশ্চিত। তার ভুল হলে তো অপু গলা উঁচিয়েই বলে দিত। তাহলে হুট করে এমন উপেক্ষা কেন? সুপ্ত মনে মনে একাই যুক্তিতর্ক চালায়। এই দুদিনে শিমুলকেও পায়নি সে। শিমুলের মামা তাকে আনা-নেওয়া করছে। হুট করে এতগুলো পরিবর্তন সুপ্তের ভালো লাগছে না।

“ভাইজান?”
ফরিদের ডাকে সুপ্তের মন ভাবনার অতল থেকে ভেসে উঠল। বলল,
“হু কী?”
“চা খাইবেন না?”
“আজ ভালো লাগছে না ফরিদ মিয়া।”
ফরিদের মন খারাপ হলো। তা দেখে সুপ্ত একটা বিস্কুটের প্যাকেট ছিঁড়ে চিবোতে লাগল। ফরিদ গলা বাড়িয়ে একবার উঁকি দেয় সম্মুখের বিল্ডিংটায়। এরপর বলল,
“ভাবীর লগে মান হইছে?”
সুপ্ত সে কথার উত্তর না দিয়ে পালটা জিজ্ঞেস করল,
“তোমার আদুরীর সঙ্গে সব ঠিকঠাক?”
ফরিদ সলজ্জে মাথা নোয়ায়। মিনমিন করে বলে,
“মাইয়া মাইনষের মন, তুলার চাইতেও নরম-সরম। বেশিক্ষণ জিদ ধইরা রাখতে পারে না। ইট্টু উপহার-টুপহার দিতেই গইল্যা পানি।”

সুপ্তের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। উপহার! সে এখনো অপরাজিতাকে কোনো উপহার দেয়নি। দিলেও যে অপরাজিতা নিতে বসে আছে তেমনও নয়। শান্তশিষ্ট হলে কি হবে, ভীষণ নাক উঁচু। সুপ্ত খানিকটা সময় নিয়ে ভাবল। এমন কিছু দিতে হবে যেটা অপরাজিতা ঝট করে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। বরং সুপ্তের প্রতি তার ভাবনা আরেকটু প্রশস্ত হবে। সুপ্তের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু মেয়েটিকে পাবে কোথায়? পুনরায় বাড়ির দিকে তাকাতেই ছাদে শিমুলকে ছোটাছুটি করতে দেখল। সুপ্ত বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়ায়। হাত নেড়ে শিমুলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। সফল হতে খানিকটা সময় ব্যয় ও কসরত করতে হলো। শিমুল তাকে দেখে থমকাতেই হাতের ইশারায় তাকে নিচে ডাকল। শিমুল ছুটে নেমে আসে। দৌড়ের ফলে তার স্বাস্থ্যবান দেহটিতে ঘাম জমেছে। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। গেইটের বাইরে বেরোতেই সুপ্ত ওর হাতে চকলেট ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“দিন দিন ভীতু হয়ে যাচ্ছিস নাকি? স্কুলে যেতে গার্ডিয়ান লাগে?”

শিমুল বলল,
“মামা আমার পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে।”
“স্কুলেরও?”
“হু।” শিমুল মাথা নাড়ে।
সুপ্ত একটু সতর্ক গলায় বলল,
“তোর মেজো আপুর পড়ার দায়িত্বও নিয়েছে?”
“না, শুধু আমার। আপু তো বড়ো মানুষ।”
“তাহলে তোর আপু ভার্সিটি যায় না কেন?”
“আপুর মন ভালো না।”
সুপ্তের কপালে সরু রেখা উদিত হলো। কণ্ঠের উদ্বেগ লুকিয়ে জানতে চাইল,
“কেন?”
“জানি না।”
“তাহলে আমার চকলেট ফেরত দে।”
শিমুল তড়িঘড়ি করে তাতে থুতু দিয়ে বলল,
“এটায় আমার থুতু লেগে আছে৷ কেউ খেতে পারবে না।”
সুপ্ত ঠোঁট বাঁকা করে,
“তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। ওটায় আমি আগেই থুতু মাখিয়ে দিয়েছি।”
শিমুলের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। চকলেট ফেলে দিতে চাইলে সুপ্ত বাধা দিলো,
“গিলে নে। আমি তোর মতো গিদর নই।”
_______________

চকলেট অবশ্য শিমুল একা খেল না। বাড়িতে যদি জানতে পারে শিমুল অচেনা মানুষের থেকে খাবার নিয়েছে তাহলে মহা বি’পদ। কাজেই শিমুল বুদ্ধি করে রিঙ্কিকে অর্ধেক ভাগ দিয়ে নিজের ভাগ শেষ করতে করতে তিনতলায় উঠতেই অপুর সামনে পড়ল। তড়িঘড়ি করে পেছনে কাগজ লুকিয়ে নিল সে৷ ঠোঁটের কোণে তখনো চকলেট লেগে আছে৷ অপু ভ্রু কুচকে, সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভাইয়ের দিকে।
“চকলেট কে দিলো?”
শিমুল উত্তর দিলো না। অপু আবারো ধমকে একই প্রশ্ন করলে শিমুল ভয়ার্ত গলায় উত্তর দিলো,
“সুপ্ত ভাইয়া।”

অপু চোয়াল শক্ত করে। আবার সুপ্ত! ঠান্ডা গলায় জানতে চাইল,
“সুপ্ত ভাইয়া কী তোর আত্মীয়?”
শিমুল ডানে বামে মাথা নাড়ে। অপু একই রকম থমথমে গলায় বলে,
“প্রতিবেশী বা চেনা-পরিচিত কেউ?”
শিমুল এবারও নেতিবাচক উত্তর দেয়। অপু ধমকে ওঠে,
“তাহলে অচেনা মানুষের থেকে চকলেট নিলি কেন?”
“সুপ্ত ভাইয়া প্রতিদিন বাড়ির সামনে আসে।”
“লোকটা যদি ছেলেধরা হতো? তোকে খাবারের লোভ দেখিয়ে কি’ড’ন্যাপ করে নিতো? তাহলে? তুই জানিস কি’ড’ন্যাপাররা আগে মানুষের সঙ্গে মিশে, মিষ্টি মিষ্টি কথায় আলাপ করে সব তথ্য নিয়ে তারপর তাকে চু’রি করে নিয়ে যায়?”

শিমুল ঘাবড়ে যায়। এমন ভাবনা তো তার মাথায় আসেইনি। সুপ্ত ভাইয়া কী তবে তাকে কি’ড’ন্যাপ করতেই এভাবে পছন্দের খাবার দেয়? তার বাড়ির সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে? ভয়ে শিমুল সিঁটিয়ে যায়। অপু রাগত পায়ে এগিয়ে এসে শিমুলের হাত থেকে চকলেটের কাগজ ছিনিয়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে। ক্রো’ধান্বিত চোখে শাসিয়ে বলে,
“আর কোনোদিন যদি দেখেছি তাহলে বাবাকে বলে দেব। আজ থেকে খেলতে যাওয়া বন্ধ তোর।”
_______________

অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে অপুর বুকের ভেতরটা। অপু অন্ধকার রুমে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। পাশে পড়ে থাকা ফোনটা খানিক পর পরই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ফাঁকা ঘরে এক টুকরো আলোয় দৃশ্যমান হচ্ছে অপুর বিষন্ন মুখটা। কিন্তু নিরব উপেক্ষায় আবারো আঁধারে মিশে যাচ্ছে। অপুর মন দুটো দিন ধরে অদ্ভুত বেদনায় ডুবে আছে। এর ব্যাখ্যা সে দিতে পারে না, কিন্তু বুঝতে পারে। আর এই বুঝতে পারাই অপুর জন্য য’ন্ত্র’ণাদায়ক। অতি সতর্কতা যেমন মানুষকে দিয়ে ভুল করিয়ে ফেলে তেমনই অপু তার বোনের প্রেমের পরিনতি দেখে নিজেকে সামলে রাখতে গিয়েও পা হড়কেছে। অথচ এটা হওয়ার কথা ছিল না। অপুর বেদনা আসলে কোমলপ্রাণ হৃদয়ের সুক্ষ্ম ভুলে নাকি নিজের ভাগ্য নিয়ে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তবে বাবাকে সে দুঃখ দেবে না।

“কক্ষনো না কক্ষনো না।” অপু বিড়বিড় করে ওঠে। যার ফলে দুদিন যাবত সুপ্তের সঙ্গে সামান্যতম দেখা বা কথা হওয়ার সুযোগ সে এড়িয়েছে। নাম্বারটা ব্লক করেছিল। কিন্তু লোকটা আরেক নাম্বার দিয়ে লাগাতার ফোন দিয়েই যাচ্ছে। অপু ভেবে পায় না শত উপেক্ষা পেয়েও মানুষটার এত ধৈর্য কোত্থেকে আসে। ম্যাসেজ, ফোন-কলের কারণে বিরক্ত হয়ে অপু ফোন বন্ধ রেখেছিল অবশ্য। সন্ধ্যায় বাবা বাড়ি ফিরেই রাশভারী স্বরে বলেছেন,
“ফোন বন্ধ রাখলে ব্যবহার করার কী প্রয়োজন?”
“কেন বাবা? কল করেছিলে?”
“তোর মায়ের প্রেশারের ঔষধটার নাম ভুলে গেছিলাম। বললে আনা যেত।”
তখন অপু ফোন চালু করেছিল। আবারো একের পর এক ম্যাসেজ মিসড কল ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে। অপু সাড়া দেয়নি।

খানিক বাদেই দরজায় করা’ঘা’তের শব্দ ভেসে এলো। অপু দরজা খুলতেই দেখল শিমুল বালিশ কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চশমার ভেতরের বড়ো চোখদুটি শেষ রাতের সঞ্চিত শিশিরের মতো টলোমলো। অপু আজ একা ঘুমাতে চেয়েছিল। তাই শিমুলকে মামার রুমে ঘুমাতে বলেছে। শিমুল ভেবেছিল বিকেলের ঘটনায় অপু তার ওপর রেগে আছে। তাই বোনের থমথমে মুখ দেখে ভয়ে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আধঘন্টাও মামার রুমে টিকতে পারেনি। কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে ফিরে এসে দরজায় টোকা দিয়েছে। সে ফোলা ঠোঁটে বলল,
“আমি অল্প জায়গায় ঘুমাব। তোমাকে ডিস্টার্ব করব না।”
“মামার ঘরে বেশি জায়গা, সেখানে কী সমস্যা?”
“এই রুম ছাড়া আমার ঘুম আসে না।”

পাশের রুম থেকে বেলী বেরিয়ে এসেছে। ভাইয়ের কথা শুনে বলে উঠল,
“সে কী! ছেলেটার কী বাজে স্বভাব বানিয়েছিস অপু?” এরপর শিমুলকে বলল, “এবার একা থাকতে অভ্যাস কর সোনা।”
“কেন?”
“তোর আদরের আপুর তো বিয়ে হয়ে যাবে কদিন পর।”
কথাটা বলে বেলী অপুর মুখভঙ্গি পরখ করে নেয়। অপু আলোচনা বাড়তে না দিয়ে শিমুলের চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে বলল,
“ঘরে ঢোক। আমি যেতে যেতে যেন দেখি ঘুমিয়ে গেছিস।”
শিমুল বালিস নিয়ে ছুটে রুমে চলে গেল। বেলী বলল,
“ওকে এবার অভ্যাস করা আলাদা ঘুমানোর। বড়ো হচ্ছে। তারওপর তুইও বেশিদিন নেই।”
“আছি কী নেই তা আগেই নিশ্চিত হচ্ছো কীভাবে?”
বেলী আগ্রহী দৃষ্টিতে এগিয়ে আসে।
“কেন? তোর অন্য কোনো প্ল্যানিং আছে নাকি?”
“আল্লাহর প্ল্যানিং কী তা তো আমরা আগেই বলতে পারি না। তুমি ঘুমাতে যাও। রাত জাগা মা-বাবু দুজনের জন্যই ক্ষতিকর।”
অপু চলে গেল। বেলী তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উঠল,
“কিন্তু আমার প্ল্যানিং রেডি। শুধু সুযোগের অপেক্ষা। আমার বিশ্বাস, সেটা তুই-ই করে দিবি।।”

চলবে…
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here