সুপ্ত অনুরাগে পর্ব -১২+১৩

#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[১২]

টিকটিক করে সচল ঘড়ির মিনিট ও ঘন্টার কাটার সাক্ষাত ঘটেছে। অর্থাৎ কাটায় কাটায় মাঝরাত। অপুর ফোনে এখনো লাগাতার আলো জ্বলছে, নিভছে। অপু সেদিকে তাকিয়ে ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠছে। পাশেই শিমুল ঘুমিয়ে আছে। হাত-পা ছড়িয়ে দিয়েছে এদিক-ওদিক। অপু তাকে ঠিক করে দিয়ে পাশ ফিরতেই এবার স্ক্রিনে ম্যাসেজ নোটিফিকেশন ভেসে উঠল। ওপেন না করেও দুটো শব্দ সে পড়তে পারল।
“ছাদে এসো।”
অপু শোয়া থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠল। ছাদে! লোকটা কী তার বাড়ির ছাদে এসে উঠেছে নাকি? অপু ম্যাসেজ ওপেন করতে না করতেই আবারো একটা ক্ষুদে বার্তা জমা হলো ইনবক্সে।
“এখন যদি ছাদে লাফিয়ে লাফিয়ে চারতলার বাসিন্দাদের ঘুম ভাঙাই, নিশ্চয়ই খুব ইন্টারেস্টিং হবে, তাইনা?”

অপু আঁ’তকে উঠল। সে যাবে কী যাবে না ভাবার আগেই সরাসরি যাওয়ার জন্য হু’মকি দিয়ে বসল! অপু রে’গেমেগে লিখল,
“আপনার হু’মকিতে ভয়ে ম’রে যাচ্ছি মনে হয়?”
সেন্ড বাটনে ক্লিক করেই জিভ কা’টল। এ কী করে ফেলল? পাত্তা দেবে না দেবে না করেও খুব ভালোমতো জানিয়ে দিলো ফোনটা তার হাতের মুঠোতেই আছে। অপু কপাল চাপড়ালো। মিনিট গড়ানোর আগেই রিপ্লাই এলো,
“মাঝরাতে ভূতের নৃত্যতে বিল্ডিংবাসী অবশ্যই ভয় পাবে। নমুনা দেখাই? তুমি চাইলে সরাসরি এসে দেখতে পারো। অবশ্য পাঁচ মিনিট সময় নিতে পারো। প্রিয় মানুষের সামনে আসতে একটু সেজেগুজে নিতে হয় কিনা!” সাথে একটা ঠোঁট বাঁকানো ইমোজি।

অপু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও প্রবল এক নিষিদ্ধ আকর্ষণে বিছানা থেকে নামল। শব্দহীন পায়ে রুম থেকে বেরিয়েই তার গলা শুকালো। কেউ যদি টের পায়? অপু ডাইনিং থেকে গ্লাস ভরে পানি পান করে নিল। গলা ভিজিয়ে আলগোছে স্যান্ডেল গলায় পায়ে। এরপর যতটা সম্ভব শব্দ না তুলে দরজার লক খুলল। তখনই খেয়াল হলো নিজের পোশাকের কথা। জিভ কেটে পুনরায় রুমে গেল। আঁধারে হাতড়ে একটা ওড়না জড়িয়ে নিল গায়ে। এরপর বাইরে থেকে দরজা লক করে সিড়ি বেয়ে উঠে গেল উপরে।

সুপ্ত রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ ছাদের দরজামুখী। ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলে লোহার দরজাটা খুলে যেতে সে ঠোঁট ছড়িয়ে সাফল্যের হাসি হাসল। অপু গটগটিয়ে এলো তার সামনে। রুম থেকে ছাদের শেষ ধাপ অবধি আসতে যে জড়তা, ভয় আর সংকোচ তার মধ্যে ছিল তা যেন সদর্পে এক অঘোষিত অথচ কপট ক্রোধে রূপান্তর হলো। কেন, তার ব্যাখ্যা নিজের মনের কাছেও চেপে যেতে চাইল অপু। সুপ্ত মাথা ঝুকিয়ে শাহী ভঙ্গিতে কুর্নিশ করে বলল,
“অশেষ মেহেরবানি আমার পুষ্পরানী।”

এরপর মাথা তুলে সরাসরি তাকাল অপরাজিতার দিকে। চাঁদের ম’রা আলোয়, নির্জন ছাদ যেন হুট করেই সতেজ হয়ে গেল। সুপ্তের হৃদয়ে বইছে দমকা হাওয়া। এই প্রথম অপরাজিতাকে সে এলোমেলো চুলে, বাড়ির পোশাকে দেখল। বাকি সময় অনেকটা পরিপাটিই থাকে সে। সুপ্তের মনে কিছু অযাচিত ইচ্ছেরা হা’না দিলো। হাত বাড়িয়ে তার কপোলে আঙুল ছোঁয়াতে মন চাইল। এলোচুলগুলোকে আরেকটু ছন্নছাড়া করে দিতে ইচ্ছে হলো। ঠিক যেমনটা তার অন্তরের ভেতরটা। অন্ধকার বলেই কী দুষ্টু ইচ্ছেরা মাথাচাড়া দিচ্ছে নাকি? সুপ্ত মাথা নেড়ে খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে। বলে ওঠে,
“ইশ আমার নাচ দেখার এত লোভ তোমার? দুমিনিটেই ছুটে এলে!”
“বাজে না বকে বলুন, আপনি আমার বাড়ির ছাদে কী করছেন?”

অপুর একটা হাত কোমড়ে। সামনের দিকে কিছুটা ঝুকে আছে। জোড়া দুই ভ্রুয়ের মাঝে যেন অমাবস্যার রাতের অন্ধকার যায়গা করে নিয়েছে। সুপ্ত কাঁধ ঝাকিয়ে বলল,
“শ্বশুরের ছাদটা ভ্রমণ করতে এসেছি। ভাবলাম শ্বশুরের মেয়েটাকে পাশে পেলে একটা রোমান্টিক ছাদবিলাস হয়ে যেত। তুমি এত উদার যে নিজেই সে ইচ্ছে পূরণ করে দিলে।”
“আমার বাবা আপনার কোন জনমের শ্বশুর? কোন সম্পর্কের শ্বশুর?”
“এই জনমের শ্বশুর, বউ সম্পর্কের শ্বশুর।”

অপুর কপালের ভাজ গাঢ়ত্ব পেল। মেজাজের তাপমাত্রা বাড়ল কয়েক ডিগ্রি। কনুই ভাজ করে বলল,
“উপরে এলেন কীভাবে?”
সুপ্ত হেসে উঠল,
“তা তো বলা যাবে না। নিজের হাতে নিজের আসার পথ বন্ধ করি কী করে বলো?”

অপু হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত নামায়। মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে বলে,
“আচ্ছা, আপনার কী আমার পেছনে সময় নষ্ট করা ছাড়া জীবনে কোনো লক্ষ্য নেই?”
“তুমি আমার লক্ষ্য, তোমাকে পটানো আমার উদ্দেশ্য, তোমার অন্তরে প্রেমের বিজ অঙ্কুরিত করা আমার সাফল্য। তোমাকে বুকের মাঝে পাওয়া আমার তৃপ্তি। আর তোমাতে মিশে অভিন্ন হৃদয়ে পরিনত করা আমার অর্জন। তোমার জন্য নয়, আমি নিজের জন্য, নিজের সুখের জন্য তোমাকে চাই।”

এতগুলো কথার বিপরীতে অপু যেন খেই হারিয়ে ফেলল। সহসাই কোনো উত্তর দিতে পারল না। সুপ্ত দূরত্ব কমিয়ে কোমল সুরে জানতে চাইল,
“আমাকে এভাবে এড়াচ্ছো কেন?”
অপু মুখ ঘোরালো। দৃষ্টি অসীমে নিক্ষেপ করে বলল,
“বিরক্ত করছেন, তাই।”
“তুমি সত্যিই বিরক্ত হও? আমার তো মনে হয় তুমি উপভোগ করো।”
“বাজে কথা। আমি আসলেই বিরক্ত। মন থেকে চাই আপনি আমার জীবন থেকে চলে যান। আমি রেহাই চাই আপনার থেকে।”
সুপ্ত একদম কাছে চলে এলো। চাপা ক্রো’ধে হি’সহি’সিয়ে উঠল,
“রেহাই? তুমি আমার থেকে রেহাই চাইছো?”
“হ্যাঁ চাইছি। আপনি কেন বুঝতে পারছেন না, এ হওয়ার নয়।”
অপুর কণ্ঠ সামান্য ভেঙে এলো। সুপ্ত রাগ ভুলে দুহাতে তার মুখ আজলায় তুলে নিল। কণ্ঠে খানিকটা আদর, আহ্লাদ ঢেলে জানতে চাইল,
“কেন নয়? আমাকে বলো। কারণটা কী শুধুই আমি?”

অপু নিজেকে সামলে নিল সঙ্গে সঙ্গে। কী করতে যাচ্ছিল সে? সুপ্তের সামনে নরম হয়ে পড়ছিল? এই অন্ধকার এত বেশি ছলনাময়ী কেন? যা করতে চায় না তাই করিয়ে নেয়। সে ঝট করে সুপ্তের হাত সরিয়ে দিয়ে দূরে সরে গেল। সুপ্ত মনে মনে ব্যথিত হলো খানিক। অপু বলল,
“আমি কোনো রিলেশনশিপে জড়াব না।”
সুপ্ত হাঁপ ছেড়ে বাচঁল। বুকে হাত দিয়ে বলল,
“এমনভাবে বলছিলে, মনে হলো গুরুতর কিছু ঘটে গেছে। সে যাক, রিলেশনশিপ বিষয়টা খুবই দুষ্টু বুঝেছো। খালি জড়াজড়ি করতে চায়। আমি আবার অতি ভদ্র। কাজেই জড়াজড়ি নয়, শুধু সুপ্ততে এমনভাবে মিশে যাও যেন নিজেকে আলাদা করে না খুঁজতে হয়।”
অপু মুখ ফিরিয়েই রইল। সে কীভাবে সুপ্তকে বোঝাবে নিজেই বুঝতে পারছে না। বরং সামনে এলে আরেকটু করে দুর্বল হচ্ছে লোকটার প্রতি। কিন্তু এ থামাতে হবে। দিনশেষে অপুর নিজস্ব কোনো স্বকীয়তা নেই। পরিবারের মতামত আর ভালোটাই তার কাছে মুখ্য। অপুর ভাবনার মাঝেই সুপ্ত তার পেছনে রাখা হাতটা সামনে এনে ধরল। অপু এতক্ষণে খেয়াল করল সুপ্তের কাছে একটি প্যাকেট আছে।

“কী?” অপু ক্ষীণ স্বরে জানতেই চাইল।
“খুব ইচ্ছে হলো তোমাকে কিছু উপহার দেই। কিন্তু দোকান থেকে কিছু কিনে হাতে তুলে দেওয়ার মাঝে অনুভূতির মিশেল বড্ড হালকা মনে হলো। তাই তোমার জন্য আমার একটি বিশেষ অনুভূতি এনেছি।”
অপু ভ্রু কুচকে প্যাকেটটা দিকে তাকিয়ে রইল। সুপ্ত তার ভেতর হতে একটা শাড়ি বের করল। রঙটা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও লাল কিছু তা আন্দাজ করা গেল। সুপ্ত অপুর মৌনতায় আরেকটু সাহস করল। শাড়ির ভাজ খুলে ঘোমটা দিয়ে দিলো ওর মাথা। এরপর পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে লম্বা শ্বাস নিল।
“অপরাজিতা?”
“হু?”
“লম্বা শ্বাস নাও।”
অপু লম্বা শ্বাস নিল। সুপ্ত জানতে চাইল,
“কীসের ঘ্রাণ পাও?”
“পুরোনো তোলা কাপড়ের ঘ্রাণ।”
“খুব একটা দামী নয়। কিন্তু অনেক মুল্যবান স্মৃতি, অমায়িক অনুভূতির ধারক। এই শাড়িটা পরে মা বাবার সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। এটাতে এখনো মায়ের গায়ের গন্ধ লেগে আছে। মায়ের শাড়িগুলো আমার খুব প্রিয় জানো? মায়ের কথা মনে হলেই বাবার আলমারি থেকে শাড়ি নামিয়ে নাকে চেপে ধরতাম। মনে হতো মা আমার খুব কাছে। আমাকে বুকের উষ্ণতায় জড়িয়ে নিয়েছে।”

অপু চমকে উঠল।
“আপনার মা…”
“ফিরিয়ে দিয়ো না প্লিজ। আমি চাই আমার এক পশলা অনুভূতি তোমাকে ছুঁয়ে থাকুক। তুমি যখন সম্পূর্ণ মন থেকে আমার হয়ে যাবে, সেদিন এই শাড়িতে তোমাকে দেখতে চাই। যদি নাও হও তবুও রেখে দিয়ো। আলমারিতে কতশত অব্যবহৃত কাপড় পড়ে থাকে। এটাও নাহয় সেভাবেই থাকবে। আরেকটা পরিনয়ের সাক্ষী এই শাড়িটা নাইবা হবে। শুধু কখনো চোখে পড়লে মনে করবে সুপ্ত তার এক অমূল্য অনুভূতি তোমায় দিয়েছিল।”

অপু এমন আকুল নিবেদনের বিপরীতে কী বলবে ভেবে পেল না। কণ্ঠে কোনো শব্দ জুটল না। সুপ্ত তার ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সরে যাওয়া উচিত। অপু কেন জানি সেটাও পারল না। রাতের গাঢ়ত্ব ক্রমশ বাড়ছে। চাঁদের ম’রা আলোটা আগের চেয়ে ম্লান হয়েছে। অথচ সেই ম্লানতায় উদ্ভাসিত দুটি হৃদয় যেন এক অমোঘ টানে ক্রমেই নিকটবর্তী হচ্ছিল। সুপ্ত গা ঝারা দিয়ে উঠল। অপুর কানের কাছে ঠোঁট নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“অবশ্য আমি নিশ্চিত, এই শাড়ি পরে একদিন তুমি আমায় ‘ওগো শুনছো’ বলে ডাকবে।”
মুহূর্তেই যেন রাতের মুগ্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। অপু ঝট করে সরে গেল। আঙুল তুলে শাসিয়ে বলে উঠল,
“ভালো হয়ে যান বলছি।”
সুপ্ত কাঁধ ঝাকিয়ে দুষ্টু হেসে বলল,
“আমি মাসুদ না যে ভালো হবো। আমি সুপ্ত। সুপ্তের হৃদয়ার্দ্র গুপ্ত কুঠুরিতে জমানো সবটুকু আবেগ তো তোমাকেই সইতে হবে ললনা।”
“আপনি একটা অসহ্য, নি’র্ল’জ্জ! ”
“তুমি বড্ড অধৈর্য।” #সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[১৩]

সুপ্তের থেকে নিস্তার পেয়ে রুমে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দেড়টা গড়িয়েছে। অপু রুমে ঢুকে সময় দেখেই আঁতকে উঠল। মনে হচ্ছে এই তো গেল আর এলো। এরই মাঝে কী করে এতটা সময় বয়ে গেল টেরই পেল না!
“পা’গলের পাল্লায় পড়ে আমিও পা’গল হয়ে যাচ্ছি!”
অপু বিড়বিড় করে আওড়ালো। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বে’লে শাড়িটা দেখল। সোনালি জরি পাড়ের লাল জামদানী শাড়ি। কিছুটা মলিন হলেও যত্নের ফলে এখনো সুন্দর আছে। ন্যাপথলিনে গন্ধযুক্ত পুরোনো গন্ধের মাঝেও আলাদা একটি মায়া মায়া ব্যাপার আছে তাতে। অপু কিছুতেই সুপ্তকে ফেরাতে পারল না। লোকটা কী থেকে কী বলে দিলো, হতবুদ্ধি হয়ে অপুও নিরবে সম্মতি দিলো৷ এখন বেশ বুঝতে পারছে লোকটা তাকে ইমোশোনাল ফুল করেছে সেন্টিমেন্টাল কথা দিয়ে। তবুও… সুপ্তের মহা মূল্যবান জিনিসটাই তো দিয়েছে। বাবা-মায়ের বিয়ের স্মৃতি কেউ অন্যকে দেয়? কতটা আপন হলে দিতে পারে! ভেবে অপু নিজের বোকামি ঢাকার চেষ্টা করে। কী যেন বলল আরো? মায়ের কথা মনে পড়লে শাড়িটাকে আগলে ধরে।
“লোকটার কী মা নেই?”

অপুর মনে কেমন মায়া মায়া ভাবের জন্ম হতে লাগল। হেমন্তের শেষ রাতে যেমন টুপ করে শিশির ঝরে দূর্বাঘাসকে সিক্ত করে, তেমনই যেন মাঝরাতে অপুর হৃদয়ে শিশির ঝরতে লাগল। অপু টের পাচ্ছে প্রবল প্রতিরোধ গড়েও সে এক অমোঘ টানে নিজেরই প্রতিরোধের মোকাবিলা করতে চলেছে। নিজেই নিজের বেষ্টনীর দ্বারে ফাটল ধরাচ্ছে একটু একটু করে। মনের মাঝে শঙ্কা জাগে, আদৌ নিজেকে ধরে রাখতে পারবে তো? রুখতে পারবে তো এই শাড়ি পরা থেকে নিজেকে আটকাতে? পরক্ষণেই স্মৃতিতে হা’না দেয় বাবার মুখটা। কন্যার দ্বারা অ’প’মানে বিমুঢ় মুখটা হসপিটালের সাদা বেডে মুষড়ে পড়ে ছিল দুটি বছর আগেও। অপু শাড়িটা হাত থেকে নামিয়ে রাখে৷ ক্ষণিকের আবেগের কাছে সুদীর্ঘ বাইশ বছরের যত্ন, ভালোবাসা, স্নেহ ম্লান হতে পারে না। সে বাবাকে ঠকাবে না। কক্ষণো না। তক্ষুণি ম্যাসেজ টোন বেজে উঠল।

“আমি লাফাব শুনেই তুমি ছাদে কেন এসেছিলে জানো? কারণ এটা নয় তুমি অন্যদের শান্তি বিঘ্নিত করতে চাওনি। বরং তুমি চেয়েছিলে আমি যেন কারো হাতে ধরা না পড়ি। অথচ আমি ধরা পড়লে তোমার কিছু আসা-যাওয়ার কথা না। অপরাজিতা, তুমি কী বুঝতে পারছ তোমার হৃদয়ের সুপ্ত অনুরাগ জেগে উঠছে? পাচ্ছো কী তার প্রেমানলের আঁ’চ?”

অপু ক্ষুদেবার্তাটি পড়ে বিমূঢ় হয়ে রইল। যাকে এড়াতে নানান যুক্তিতর্ক সাজিয়ে বসেছে, সেই আবার আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে। প্রেমানলের আঁ’চ সত্যিই পাচ্ছে কী?
______________

শীত শীত হেমন্তের রাতেও বেলী উত্তেজনায় ফুঁসছে। কপালে আক্ষেপের বিন্দু বিন্দু ঘাম উঁকি দিয়ে আবার শুকিয়ে যাচ্ছে। একটু আগে, হ্যাঁ একটু আগেই সুযোগটা তার হাতছাড়া হয়ে গেল। এমনিতেই এখন বেলীর রাত-বিরেতে খিদে পায়। তারওপর আজিজের উষ্ণ ভালোবাসায় নাজেহাল হয়ে সে আজ একটু বেশিই ক্লান্ত, খুদার্ত। তাই বেরিয়েছিল ফ্রিজ থেকে বিকেলে বানিয়ে রাখা ফালুদাটা বের করে খাওয়ার জন্য। তখনই নিজের বোনকে চো’রের মতো ঘরে ঢুকতে দেখেছে। অন্ধকারেই থমকে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ছিল বেলী। অপু কোথায় গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল, কতক্ষণের জন্য গিয়েছিল, প্রশ্নগুলো ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসছে চাপা ক্রো’ধ থেকে। বাবার আদরের মেয়ের এত অধঃপতন! রাত-বিরেতে একা একা দেখা করতেও যায়! বেলী নিজের বোনের কাজে নিজেই বিস্মিত হয়ে পড়ছিল। তার মনেও কিছুটা দ্বিধা ছিল অপুর মতো শান্তভদ্র মেয়ে বাবার মতের বাইরে যাবে কিনা। কিন্তু অপুর হাবভাব, কর্মকান্ড তো বেলীর চেয়েও বেপরোয়া হয়ে উঠছে!

আজিজ ঘুমঘুম চোখে বেলীকে জাপটে ধরে। তার পিঠে মুখ ঘষে। বেলী ঝারা দিয়ে তাকে সরিয়ে দেয়। আফসোসে হাতের তালুতে আরেক হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে কিল দেয়। আজিজের ঘুমের রেস কেটে গেল। চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কোনো সমস্যা বেলী?”
“সমস্যা! তুমি আমার জীবনে ঢোকার পর থেকে সবই সমস্যা।”
“কথাটা তো উল্টোও হতে পারত।”
বেলী জ্ব’লে উঠল,
“কী বললে তুমি?”
“বাদ দাও। এত সুন্দর সময়টা বাজে কথায় নষ্ট করতে চাইছি না। এরচেয়ে ঘুমালে কাজে দেবে। শুয়ে পড়ো।”
“হ্যাঁ, ফ্রিতে খেয়ে-পড়ে থাকতে পেলে সবই সুন্দর সময়। তুমিই ঘুমাও। খোটাগুলো তো আমাকেই সইতে হবে।”

আজিজ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে বেলীর কোনো কথাই বিশেষ গায়ে মাখে না ইদানীং। বেকার পুরুষ, বউ অন্তঃসত্ত্বা। দায়িত্বের বোঝা সামলাতে না পেরে শ্বশুরবাড়িতে এসে মুখ লুকিয়েছে। প্রভাবটা সম্পর্কের ওপরই পড়েছে। তাই বোঝাপড়াটাও কেমন লবনাক্ততা হারিয়ে পানসে হয়ে যাচ্ছে। যেন একসাথে থাকতে হবে বলেই থাকা। অথচ দুবছর আগে পা’গলকরা প্রেমে দুজনেই হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছিল। জীবনে দুজনের একসঙ্গে থাকা ছাড়া বাকিসব তুচ্ছ জ্ঞান হয়েছিল। কোথায় সে উন্মা’দনা? আজিজের মনে হয় ভালোবাসা হচ্ছে অনেকটা গিরিগিটির মতো। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। কিংবা পরিস্থিতি বাধ্য করে।
________________

আজ তিন বছর পর বৈশাখী পা রেখেছে সেই চিরচেনা বাড়িতে, যার প্রতিটি কোণা তিনি নিজের হাতে সাজিয়েছিলেন। গড়েছিলেন স্বপ্নের সংসার৷ স্বপ্ন! হ্যাঁ স্বপ্নই তো। যেই স্বপ্ন ভাঙতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। স্বপ্নের জগত ছেড়ে বাস্তবতার জগতে পা পড়তেই জীবনের সব রঙ হারিয়ে গেল। শুধু একা বৈশাখীর নয়। তার আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত বাকি মানুষেরও। এত বছর পরেও সবই একই রকম আছে। শুধু তিনিই হয়ে গেছেন অতিথি, যে বছর কয়েক পর পর এসে বেড়িয়ে যায়। মাস কয়েক আগে যখন সুপ্তের বাইক এ’ক্সি’ডেন্ট-এর সংবাদ পৌঁছালো আমেরিকা, বৈশাখী ছেলের কাছে আসার জন্য মড়িয়া হয়ে উঠেছিলেন। ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায় দেরি হলো। সেই থেকে সুপ্ত উনার সঙ্গে কথা বলে না। ফোন করলেও রিসিভ করে না। যার ফলে উনার আসার তাড়া আরেকটু বেশিই ছিল।

বৈশাখী সদর দরজায় পা দিয়েই কেমন কেঁপে উঠলেন। আজও অনুভূতির সুক্ষ্ম আঁ’চড়ে হৃদয় আন্দোলিত হয়। ফারিহা উনাকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে গেল। বাড়িতে হৈ হৈ লেগে গেল মুহূর্তেই। রফিক সাহেব হাসিমুখেই উনাকে গ্রহণ করলেন। যেন প্রতিনিয়ত দেখা হচ্ছে এমন ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন,
“আসতে অসুবিধা হয়নি তো?”
“নাহ, কেমন আছো তুমি?”
রফিক সাহেব মৃদু মাথা নাড়েন,
“আলহামদুলিল্লাহ। লম্বা জার্নি করে এসেছো। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। খেয়েদেয়ে ঘুম দেবে।”
“উহুম, আমি এখন সকালের নাশতা বানাব। আগে ছেলেটার মান ভাঙাতে হবে তো।”
“বলো কী? বিদেশিনী বিমান থেকে নেমেই সোজা রান্নাঘরে? জেট ল্যাগ কাটতে সময় লাগবে তো। বিশ্রাম নেবে না?”
“তুমি ভুলে যাচ্ছো আমি এ বাড়িতে যতদিন আছি সংসারটা আমার।”
রফিক সাহেব দুই হাত কাঁধ বরাবর তুলে বললেন,
“সরি সরি! সংসার এখন তোমার। সিদ্ধান্তও তোমার। আমি নিছক উপদেষ্টা মাত্র।”
দুজনে একত্রে হেসে উঠলেন। দূর থেকে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখে ফারিহার মন ভরে যায়। দুটো মানুষ যোজন যোজন দূরত্বে বসবাস করেও কী সাবলীল! যেন এ সংসারে তারা নিত্য বিরাজ করে। ইশ যদি করত!

সুপ্ত তখনো সদ্য ফোটা ভোরের আদুরে উষ্ণতায় তন্দ্রাবিভোর। হুট করে তার বিছানাকে আন্দোলিত করে কিছু একটা ঝাপিয়ে পড়ল। সুপ্ত ঘুম ভেঙে প্রায় লাফিয়ে উঠল। নিজের পাশে আরেকজনকে উপুর হয়ে শুতে দেখে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল। ছেলেটি এবার সোজা হলো। সুপ্তের লাল চোখের দিকে ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে বলল,
“হেই ব্রো, একটা বউয়ের অভাবে তোর সঙ্গে বেড শেয়ার করতে এলাম। ঘুম থেকে উঠে আলাপ হবে, কেমন?”

সুপ্ত গর্জে উঠল, “তন্ময়!”

তন্ময় চাদরের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে বলল,
“প্লিজ ভাই, নো ডিস্টার্বেন্স!”

চলবে…

চলবে…
(গল্প কী ভালো লাগছে না? আপনাদের সাড়া শব্দ পাই না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here