সূর্যাস্ত,পর্ব:১০

#সূর্যাস্ত
পর্ব-১০

কুমিরটা রোদ্দুরের পা কামড়ে ধরেছে। সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে। রোদ্দুর অবশ্য হার মানেনি। ওর কোমরে ছুরি ছিল। কুমিরের চোয়ালের ভেতর নরম অংশে ইচ্ছেমতো ছুরি চালিয়েছে যতটা পারা যায়৷ প্রচন্ড ব্যথা যদিও তাকে কাবু করে ফেলছে দ্রুত। পানিতে ডুবে যাচ্ছে বারবার। মাথা সামান্য সময়ের জন্য তুলতে পারলেও শ্বাস নিতে পারছে না ঠিকমতো। অক্সিজেনের অভাবে শরীর অবশ হয়ে আসছে। বুঝতে পারছে তার আয়ু এখানেই শেষ। শেষবারের মতো চাকুটা কুমিরের শরীরে বসিয়ে দেবার চেষ্টা করল সে। শক্ত চামড়ায় তার কোনো প্রভাব পড়ল না। হাত থেকে ছুটে গেল ছুরিটা। রোদ্দুরও তলিয়ে যেতে থাকল।

শ্রবনী কিছুমাত্র না ভেবে লাফিয়ে পড়ল পানিতে। সাঁতরে চলে গেল লড়াইয়ের জায়গায়। ওর হাতে তীক্ষ্ণ ফলা ছিল বল্লমের মতো করে বানানো। চিকন গাছের ডাল দিয়ে গতকালই বানিয়েছিল ওরা মাছ ধরার জন্য। সেটা হাতে নিয়েই যত দ্রুত সম্ভব কাছাকাছি চলে গেল। ধস্তাধস্তিতে পানি ঘোলাটে হয়ে গেছে। শ্রাবনী কাছে যেতেই কুমিরের লেজের বাড়ি খেল। প্রচন্ড ব্যথা পেলেও স্থিতি হারাল না। যথাসম্ভব মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করল। ঘাবড়ে গেলে সেও মরবে, রোদ্দুরকেও বাঁচাতে পারবে না।

একটু দূরে গিয়ে ভালোমতো লক্ষ্য করল কুমিরটাকে। ওটা শ্রাবনীকে দেখেনি। রোদ্দুরকে কাবু করতে ব্যস্ত। শ্রাবনী কুমিরের অবস্থান আন্দাজ করে সেটার ঠিক চোখ বরাবর সর্বশক্তি দিয়ে ফলাটা ঢুকিয়ে দিল। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। কুমিরটা খেয়াল করল তার দ্বিতীয় শত্রুকে। রোদ্দুরের পা কামড়ে ধরে থেকেই শ্রাবনীর কাছাকাছি চলে এলো। এই সুযোগটাই খুঁজছিল সে। ফলাটা আবারও বসিয়ে দিল, লাগল না ঠিকঠাক। ঝুঁকি নিয়েই এবার আরেকটু সামনে এগিয়ে গেল। একেবারে কাছে এসে চোখের ভেতর ঢোকালো তীক্ষ্ণ ফলা। অনেকখানি গেঁথে গেল সেটা৷ কুমিরটা ঘড়ঘড় শব্দ করে ছিটকে সরে গেল। রোদ্দুরের পা টাও তার মুখ থেকে আলগা হয়ে গেল।

শ্রাবনী টেনে নিল রোদ্দুরকে। কুমিরটা আবার ছুটে আসছিল, কিন্তু পারল না। সংবেদী অঙ্গে আঘাত লাগায় সেখানেই লাফালাফি করতে থাকল। শ্রাবনী রোদ্দুরকে টেনে নিয়ে যেতে থাকল পাড়ের দিকে। একটা আস্ত জ্ঞানহীন মানুষকে নিয়ে সাঁতরানো সহজ কথা নয়৷ পরিস্থিতি সব করিয়ে নেয় আপনাতেই। বাঁচার তাগিদে অসম্ভবও সম্ভব হয়ে ওঠে। সে তাড়াতাড়িই রোদ্দুরকে নিয়ে খালের অপর পাড়ে গিয়ে উঠল। পাড়ে উঠেও দাঁড়াল না। রোদ্দুরকে কোনোমতে কাঁধে তুলে বনের আরও গভীরে টেনে নিয়ে গেল, যেখানে কুমিরটা আসতে পারবে না।

রোদ্দুর অচেতন। পানি খেয়ে ঢোল হয়ে আছে। পায়ের ক্ষত বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ রক্তের ধারা। শ্রাবনী রোদ্দুরের পেট চেপে অনেকখানি পানি বের করল। রোদ্দুরের কাপড়চোপড় সব ওপাড়ে রয়ে গেছে। শ্রাবনীর গলায় তখনো নিজের ওড়নাটা বাঁধা ছিল। সেটা নিয়ে ওর ক্ষততে বেঁধে দিল শক্ত করে। দাঁত বসে গেছে কুমিরের। ইনফেকশন হওয়ার তীব্র সম্ভাবনা। আরও কিছু সেবাযত্ন করার ওর রোদ্দুরের জ্ঞান ফিরল। বার কয়েক কেশে আরেকটু পানি বের করল মুখ থেকে। ধীর লয়ে চলতে থাকল শ্বাস প্রশ্বাস। আস্তে আস্তে চোখ মেলল সে। প্রথমটায় চোখের মণি ঘোলাটে দেখা গেল। সময় নিল সেটা উজ্জ্বল হতে। বোধহয় কী হয়েছিল সেটা মনে করতেও সময় লাগল রোদ্দুরের।

রোদ্দুর চোখ মেলে ওর ওপর ঝুঁকে থাকা শ্রাবনীকেই আগে দেখতে পেয়েছে। বেশ বুঝতে পারছে তার আজ বেঁচে যাওয়ার কারন এই মেয়েটাই। শ্রাবনীর উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। রোদ্দুরকে ডাকছে সে। রোদ্দুরের এখন অনেকটা সুস্থ লাগছে। যদিও পায়ে অসহ্য ব্যথা। তবে তারচেয়ে অনেক বেশি স্বস্তি লাগছে বেঁচে থাকায়। গাছে গাছে পাখির ডাক, পাতার ফাঁক দিয়ে চুইয়ে পড়া রোদ, গিরগিটির ডাক সব ভালো লাগতে শুরু করেছে। সবচেয়ে ভালো লাগছে তার সামনে বসে থাকা মেয়েটিকে। যাকে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে অপূর্ব নারী বলে বোধ হচ্ছে। সে তার অবশিষ্ট শক্তিটুকু দিয়ে শ্রাবনীকে নিজের কাছে টেনে নিল। বুকে জড়িয়ে রাখল অনেকটা সময়। শ্রাবনীও কেন যেন বাঁধা দিল না।

__________________________

শ্রাবনী বাকিটা দিন ঘোরাঘুরি করে খাবার খুঁজল অনেক, কিন্তু পেল না। তবে দুটো জিনিস তাকে অন্যরকম স্বস্তি দিল৷ সে কুড়িয়ে পেয়েছে একটা বোতল আর একটা চিপসের প্যাকেট। তার মানে তারা লোকালয়ের কাছাকাছি আছে। সন্ধ্যার দিকে ব্যাপারটায় শিওর হলো তারা৷ আজানের শব্দ ভেসে আসছে। যদিও দূর থেকে, তবু শোনা তো যাচ্ছে। সেদিকে গেলে নিশ্চয়ই লোকালয় পাওয়া যাবে! রোদ্দুরকে হাসপাতালে নেয়া খুব জরুরি। ওর জ্বর এসেছে আবার। বেঘোরে ভুল বকছে।

রাত বাড়ার সাথে সাথে আবহাওয়া খারাপ হয়ে এলো। গতদিনের মতো ঝড় শুরু হলো। তারা আশ্রয় নিল একটা বড় পাতাওয়ালা গাছের নিচে। রোদ্দুরকে নিয়ে ওপরে ওঠা যাবে না। এখন নিচটা পানিতে ভেসে না গেলেই হয়! ঝড়ের তান্ডব চলল মধ্যরাত পর্যন্ত। কি ভয়ানক ঝড়! বনের পশুদের চিৎকারে টেকা দায়। সাথে গাছগুলোর ডাল একটা আরেকটার সাথে বাড়ি খেয়ে জোরালো শব্দ হচ্ছে। শ্রাবনী রোদ্দুরকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল শক্ত হয়ে। পুরোটা সময় রোদ্দুর ঠকঠক করে কাঁপল।

মধ্যরাতের পর বৃষ্টি শুরু হলো। তুমুল বৃষ্টি! শীতের মধ্যে শেষরাতে দুজনে পুরোপুরি ভিজে গেল। দুপুরেও একবার ভিজেছে। শীতের কাপড়গুলো ওপাড়ে রয়ে গেছে, যেগুলো আর ফেরত আনার কথা চিন্তাও করতে পারছে না।

সকালের আলো ফোটারও বেশ খানিকক্ষণ পর বৃষ্টি থামলো। দুজনে তখন ভিজে চুপচুপে। রোদ্দুরের জ্ঞান এসেছে বৃষ্টির ঝাপটায়। সে এখন গাছে হেলান দিয়ে বসেছে। শ্রাবনীরও গা কাঁপছে। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ না খাওয়া শরীর আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে। শ্রাবনী বুঝতে পারছে তার কোমরের কাছটায় ভয়ানক ব্যথা। কুমিরের লেজের বাড়ি খেয়েছিল ওখানটাতেই।

বৃষ্টি থামার ঘন্টাখানেকের মধ্যে আকাশ পরিষ্কার হয়ে রোদ উঠল। রোদের হালকা আঁচে বসে দুজন মোটামুটি শুকিয়ে নিল নিজেদের। কিন্তু ক্ষুধায় পেট জ্বলছে। শ্রাবনী বলল, “লোকালয় কাছেই। চলো যেতে থাকি৷ ওখানে যেতে পারলে কিছু একটা ব্যবস্থা হবে।”

রোদ্দুর বলল, “পারব না মনে হচ্ছে।”

“দুজন হাত ধরাধরি করে চলতে থাকি। দেখি কতটা যেতে পারি৷ এভাবে পড়ে পড়ে মরার কোনো মানে হয় না।”

রোদ্দুরের মাথা কাজ করছে না৷ ঠান্ডায় গলায় কফ বসে গেছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। পায়ের ব্যথা তো আছেই। তার ওপর জ্বর।

তবু শ্রাবনীর জোরাজুরিতে উঠে পড়ল সে। দুজন চলতে শুরু করল। খুবই ধীর গতিতে, তবে কিছুটা যেতে পারছে এই স্বস্তি। বনের পশুপাখির ডাকাডাকি শুরু হয়েছে। ওদের খাবারও জুটে গেল একটু দূরে যাওয়ার পর।

গতকালকের ঝড়ে মরেছে বোধহয় পাখিটা। কী পাখি জানা নেই। জানার প্রয়োজনও মনে করল না শ্রাবনী। সেটাই নিল খাওয়ার জন্য। কিন্তু ছুরি, কাচি, আগুন কিচ্ছু নেই ওদের কাছে। সেগুলোর ব্যবস্থা করবে এমন গায়ের জোরও নেই। কাচা তো আর খাওয়া যায় না!

রোদ্দুর তার পকেট থেকে একটা লাইটার বের করে বলল, “দেখো তো জ্বলে কি না।”

বার কয়েক চেষ্টার পর লাইটার তো জ্বলল, কিন্তু বৃষ্টিতে লাকড়ি, পাতা সব ভেজা। কিসে আগুন জ্বালবে?

শেষ পর্যন্ত একটা বুদ্ধি বের করল শ্রাবনী। পাখিটার পালক সবার আগে ছাড়াল হাত দিয়ে টেনে টেনে। তারপর সেই পালকে লাইটার দিয়ে আগুন ধরালো। আগুন মোটামুটি জ্বলার পর আধশুকনো কিছু পাতা আর লাকড়ি দিয়ে দিল সেখানে। ফু দিয়ে দিয়ে আগুন কোনোরকম জ্বালিয়ে রেখে পাখিটা পুড়িয়ে নিল। তারপর দুজন ভাগ করে খেল সেটা। শ্রাবনী তেমন খেতে পারল না৷ জ্বর মাথায় উঠেছে মনে হচ্ছে।

সেদিনটা তারা লোকালয় খুঁজে পেল না। পরের দিন আবার চলতে শুরু করল। শরীর অত্যাধিক দুর্বল। রোদ্দুরের এখন জ্বর নেই। তবে পায়ের ব্যথায় খুঁড়িয়ে হাঁটে। শ্রাবনীর জ্বর কমার নামগন্ধ নেই।

প্রায় সারাদিনের অভুক্ত তারা খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল। সন্ধ্যার আলো মিলিয়ে যাওয়ার একটু আগে একটা আলো নজরে পড়ল। পা টেনে টেনে কোনোরকমে এগিয়ে গেল তারা। গোলপাতার ছাউনি দেয়া ঘরটার কাছাকাছি এসে কয়েকটা বাচ্চাকে দেখতে পেল খেলছে। ঘরের সামনে পর্যন্ত অতিকষ্টে যেতে পারল তারা৷ উঠোনে পৌঁছে শ্রাবনী জ্ঞান হারিয়ে ধপ করে পড়ে গেল লুটিয়ে।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here