সূর্যাস্ত,পর্ব:১১

#সূর্যাস্ত
পর্ব- ১১(শেষ পর্ব)

শ্রাবনীর জ্ঞান ফেরার পর সে নিজেকে দেখতে পেল হাসপাতালের বেডে। আকাশী রঙের দেয়াল, সাদা পর্দা দেয়া ছোট একটা কক্ষ। রোদ্দুর বেডের পাশে টুলে বসে তার মাথার কাছে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত লাগছে তাকে। শ্রাবনী দুর্বল হাতে রোদ্দুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। রোদ্দুর ধড়মড় করে উঠে বসল। শ্রাবনীকে জাগ্রত দেখে চওড়া হাসি হাসলো।

শ্রাবনী জিজ্ঞেস করল, “আমি এখানে এলাম কী করে?”

“অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর সেই রাতটা ওই কুড়েতেই কাটিয়েছি আমরা। তারপর তোমার যখন জ্ঞান আসছিল না তখন হাসপাতালে আনতে হয়েছে। ওরাই ব্যবস্থা করেছে। কতদিন পর জেগেছ জানো?”

শ্রাবনী ভয়ার্ত গলায় বলল, “কতদিন?”

“চার।”

“তোমার পায়ের কী অবস্থা?”

রোদ্দুর একটু হেসে বলল, “জিনসের প্যান্ট বাঁচিয়ে দিয়েছে। সরাসরি কুমিরের দাঁত বসলে পঁচে যেত পা। লড়াই করছিলাম বলে জুতমতো দাঁত বসাতে পারেনি। অনেকটা ঠিকও হয়ে গেছে। আর ক’দিন গেলে পুরোপুরি ভালো হয়ে যাব।”

“কিন্তু আমার এমন হলো কেন?”

“কিসের কামড় খেয়েছ তুমি জানো! শরীরে দুনিয়ার জীবানু ছড়িয়ে দিয়েছে। খারাপ ধরনের জ্বর হয়েছে। সারতে আরো ক’দিন লাগবে।”

শ্রাবনী বিষন্ন হয়ে বলল, “আমার জন্য তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে না?”

“হু অনেক কষ্ট হয়েছে। সুস্থ হয়ে উঠে তারপর সেসব কষ্টের প্রতিদান দেবে।”

“কীভাবে?”

“আমার বাড়ির কাজের বুয়া করে নিয়ে যাব।”

শ্রাবনী যেন খুশিই হলো প্রস্তাবে। বলল, “ভালো হলো। একটা থাকার জায়গা পাব আমি।”

রোদ্দুর হাসতে হাসতে বলল, “আমি অলওয়েজ ভালো প্রস্তাব দেই। বাই দ্য ওয়ে, পরে কিন্তু না করতে পারবে না।”

শ্রাবনী জোরে মাথা নেড়ে বলল, “একদম না।”

রোদ্দুর ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বের হয়ে গেল কেবিন থেকে। শ্রাবনী মাথা নাড়ায় হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গেছে। রোদ্দুরকে বুঝতে দেয়নি। সে বের হলেই শ্রাবনী শুয়ে পড়ল। সে চোখে অন্ধকার দেখছে। আচ্ছা মরে যাবে না তো?

এক সপ্তাহ পর।

রোদ্দুর শ্রাবনীর মুখের সামনে চামচ ধরে বলল, “খেয়ে নাও।”

শ্রাবনী স্যুপটা মুখে নিয়ে কেঁদে ফেলল। রোদ্দুর ব্যস্ত হয়ে বলল, “কী হলো? কাঁদছ কেন?”

শ্রাবনী স্মিত হেসে বলল, “কেউ এত মায়া করে না যে তাই।”

“ধুর! পাগল একটা। কাঁদবে না কখনো।”

বিকেলের দিকে শ্রাবনীর শরীরটা বেশ চাঙ্গা লাগছে। হাসপাতালের বদ্ধ ঘরে ভালো লাগছে না। সে রোদ্দুরকে বলল, “আর কতদিন থাকতে হবে?”

“কালকে রিলিজ দেবে।”

“আমার এখানে আর ভালো লাগছে না।”

রোদ্দুর একটু ভেবে বলল, “ছাদে যাবে শ্রাবনী? আমি একবার গিয়েছিলাম। সুন্দর ছাদ। চারতলা পর্যন্ত লিফট আছে, একতলা শুধু ধরে তোমাকে সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে যাব।”

শ্রাবনী রাজি হলো। তার শরীরটা এখন মোটামুটি ভালোই বলা চলে। নার্স একটু অরাজি থাকলেও শেষমেষ রাজি হয়ে গেল। রোদ্দুর বলে গেল সে নিজ দায়িত্বেই নিয়ে যাচ্ছে।

বিশাল ছাদ দেখে মুগ্ধ হলো শ্রাবনী। তার ইচ্ছে হলো ছুটে এক মাথা থেকে আরেক মাথায় চলে যেতে। কিন্তু শরীর কাহিল বলে পারলো না।

ছাদের এক কোণে একটা কাঠের নড়বড়ে বেঞ্চ। দুজন গিয়ে তাতেই বসল। খুলনা শহরের অনেকখানি দেখা যায় এই বিল্ডিং থেকে। শীতকালে চারপাশটা ধুলাময় হয়ে আছে। মন খারাপ করা শহরে দুজন ছেলে মেয়ে একঝাঁক তৃষ্ণা নিয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে।

শ্রাবনী বলল, “আমি আজ তোমাকে কিছু বলতে চাই। আমার অতীত জীবন সম্পর্কে।”

রোদ্দুর বলল, “বলতে হবে না। সেসব পুরানো কাহিনী ঘেটে কী লাভ? তুমিও অতীতে ফিরে যাবে না, আমারও জানার তেমন আগ্রহ নেই। তবে তোমার স্বামী যদি তোমাকে নিতে আসে তবে…”

শ্রাবনী হেসে ফেলল শব্দ করে। বলল, ” রোদ্দুর! আমার বিয়ে হয়নি।”

রোদ্দুর বিষ্ময়ে হা হয়ে বলল, “সত্যি হয়নি?”

“না, সত্যি হয়নি।”

রোদ্দুরের মুখে হাসি ফুটে উঠল। একটু শব্দ করে হেসে বলল, “এটা আগে বলো নাই কেন?”

“বললে কী হতো?”

“তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না তাই না?”

“সেটা না আসলে। তুমি ভুল বুঝো না প্লিজ!”

“বাদ দাও তো, ভালোই হলো তবে।”

“কী ভালো?”

“এইযে তোমার বর নামক ঝামেলা গেল।”

“ওহ! তাহলে বলি এবার পুরোটা?”

“আর কিছু জানা লাগবে না।”

“আমার বলতে ইচ্ছে করছে।”

“তাহলে বলো।”

শ্রাবনী বলতে শুরু করলো- “আমার মা মারা গেছিল আমি যখন কলেজে পড়ি তখন। বাবার মাথায় আগে থেকেই একটু সমস্যা ছিল, মা মারা যাওয়ার পর সে পুরোপুরি পাগল হয়ে যায়। তাকে রেখে আসা হয় পাগলাগারদে। আর আমার জায়গা হয় ফুফুর বাড়িতে। আশ্রিত মানুষ যেমন থাকে, আমার জীবনটাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। খেয়ে না খেয়ে সারাদিন কাজ করে দিন কাটতো। তার মাঝে অবশ্য পড়াশুনাটা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। সব চলছিলো কোনোরকম..

মাঝখানে উটকো ঝামেলা হয়ে এসে বসল ফুফুর বড় ভাসুরের ছেলে। সেই ছেলের বাবার অনেক টাকা। উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেকে শাসনের কোনো বালাই নেই। উল্টো তাকে রাজপুত্রের মতো সেবা করতে হয়। প্রথমেই তার নজর পড়ল আমার ওপর। আমি ভয়ে কুঁকড়ে থাকতাম সে সময়। ছেলেটা সুযোগ পেলেই তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে। খুবই জঘন্য দৃষ্টি।

এরপর একদিন ঘটলো বিচ্ছিরি ঘটনা। আমি দুপুরে শুয়েছিলাম। সে এলো আমার ঘরে। জোর করতে শুরু করলো আমার সাথে। আমিই বা ছেড়ে দেব কেন? মার্শাল আর্ট শিখিয়েছিল ছোটবেলায় মা। সোজা ঘুষি বসিয়ে দিলাম নাকে। নাকটা বাঁকাই হয়ে গেল। রক্তে ভেসে গেল ঘর। বিচার বসলো তারপর। একমাত্র অপরাধী আমি। আমি যতই বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কেউ বুঝল না। ফুফু সেদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে আমার অনেক মারলো। রাতে জ্বর এলো। সারা শরীর অসহ্য ব্যথা। ঔষধ এনে দেয়ারও কেউ নেই। আমি তবু মুখ বুজে পড়ে রইলাম।

এরপর কয়েকটা দিন এরপর নির্বিঘ্নে গেল। আমি ভাবলাম সেই ছেলে বোধহয় আর কাছে ঘেঁষবে না। কিন্তু ভুল ছিলাম। একদিন মাঝরাতে সে আমার ঘরে ঢুকে গেল। দরজা লাগানোই ছিল, কেমন করে যেন চোরের মতো বাইরে থেকে বন্ধ দরজা খুলতে পারতো। আমি তখন ঘুমে। যখন জেগে উঠলাম দেখলাম সে আমাকে খুব খারাপভাবে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। আমি উঠে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। ইচ্ছেমতো পেটালাম সেদিন। দরজা বন্ধ ছিল, আমার ঘরটাও অন্যদের তুলনায় একটু দূরে ছিল। তাই কেউ শোনেনি শব্দ। সেও যেন নেশা করে ছিল। মার খেয়েও চিৎকার করেনি। মারতে মারতে প্রায় মেরেই ফেলেছিলাম। জানটা শুধু ছিল। ইচ্ছে করেছিল ঘরের কোণায় রাখা দা দিয়ে গলাটা কেটেই ফেলি। কিন্তু কী মনে করে ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেদিনই জমানো টাকাগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেছিলাম বাড়ি থেকে। কাউকে কিছু না বলেই।”

শ্রাবনী কাঁদছে। রোদ্দুর তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কেঁদো না। তুমি কত সাহসী মেয়ে জানো?”

“সাহসী হয়ে কী লাভ? নিরাপত্তাহীনতায় সবসময় ভুগি যে! সমাজটা কি বেঁচে থাকার মতো আছে?”

“এখন থেকে সেসব কালো ছায়াগুলো আর তোমার ধারে কাছেও আসতে দেব না আমি।”

শ্রাবনী তবু নিরবে কেঁদে যাচ্ছে। রোদ্দুর শ্রাবনীর হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে বলল, “একটা কথা বলার ছিল আমারও।”

শ্রাবনী নাক টেনে বলল, “বলো।”

“বলব?”

“হু।”

“তবে কান্না বন্ধ করো?”

“করলাম। এবার বলো।”

“ভালোবাসি তোমাকে।”

শ্রাবনীর মুছে ফেলা চোখে আবার অশ্রুধারা নামলো। আজ যেন কান্নার দিন। রোদ্দুর বলল, “কিছু বলো?”

“কী বলব?”

“আমাকে ভালোবাসো?”

শ্রাবনী এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলে ফেলল, “বাসি।”

আকাশটা গোধুলী বেলার লাল আলোয় মেতেছে। সূর্যটা ডোবার পায়তারা করছে। পাখিরা নিড়ে ফিরছে। শ্রাবনী ধীরে ধীরে মাথাটা রোদ্দুরের বুকে রেখে বলল, “ছেড়ে যাবে না তো?”

“কক্ষনো না।”

“সূর্যাস্ত হচ্ছে।”

“সূর্যটা ওর কাজ শেষে ঘুমোবে এখন।”

“আর আমরা?”

“নতুন করে জেগে উঠব।”

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here